ডার্টি গেম – ১

কাজী আনোয়ার হোসেন

এক

কর্দমাক্ত এসইউভিটা কালো রঙের, গত তিন দিনে ছয়টি দেশের সীমান্ত পার হয়ে ঢুকে পড়েছে পুব ইউরোপের বেলারুশে। এর আগে পেছনে ফেলে এসেছে বুলগেরিয়া, রোমানিয়া, হাঙ্গেরি, স্লোভাকিয়া, পোল্যাণ্ড ও লিথুয়ানিয়া।

এখন ধোঁয়াভরা কালিঝুলি মাখা কারখানাগুলোকে পাশ কাটিয়ে ঝড়ের বেগে চলেছে ওটা। পথের ধারে কাঁচফাটা জানালাসহ কিছু দোকান এবং রঙচটা, পুরনো জং-ধরা রাশান সেডান। দু’পাশে পরিত্যক্ত এক হাউসিং এরিয়া যেন পচা লাশ থেকে খসে পড়া ক’টা হাড়। এসইউভির আরোহীদের মনে হচ্ছে, ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকার মত বিপন্ন এক যুদ্ধবিধ্বস্ত দুর্বিষহ এলাকায় খুন হওয়ার জন্যে পৌঁছে গেছে তারা।

গত তিন দিন ধরে যা খুঁজছে, তা এখনও পায়নি। তাদের বিত্তবান নিয়োগকারী বলেছে দুনিয়ার সবচেয়ে নিষ্ঠুর অপরাধীকে হাতের মুঠোয় চাই তার।

সিটের পাশে শটগান ঠেস দিয়ে রেখে সানগ্লাস না খুলে ভিউফাইণ্ডারে চোখ রাখল ক্যামেরাম্যান। হাই ডেফিনিশন ভিডিয়ো ক্যামেরা দিয়ে তুলল রুগ্‌ণ এক ক্ষুধার্ত কুকুরের ছবি।

‘বলো তো, আর কত দূরে যেতে হবে?’ ড্যাশবোর্ড থেকে ঠাণ্ডা বার্গার নিয়ে চিবুতে লাগল ড্রাইভার। গত বাহাত্তর ঘণ্টায় মেঝেতে জমে গেছে অনেকগুলো রুপালি র‍্যাপার। ড্রাইভারের চোখে সানগ্লাস, নইলে যখন-তখন ঘটত দুর্ঘটনা। মধ্য দুপুরে গনগনে আগুন ঢালছে সোনালি সূর্য। রোদের খরতাপে রুক্ষ পথে নানান ধরনের রহস্যময় অতিলৌকিক মরীচিকা।

এসইউভির ড্রাইভারের নাম বনি মার্সেল, উত্তর আমেরিকার মানুষ সে। বয়স একত্রিশ। গত চার বছর ধরে দুনিয়ার দুর্লভ সব জিনিস খুঁজে নিয়ে লুঠ করছে সে। ফ্রিল্যান্সিং করে বলে চেনা অনেকে তাকে নাম দিয়েছে: ‘স্কাউট’। মাঝে মাঝে নিজের পথে বাধা এলে কাঁচকলা দেখিয়ে দেয় মানুষের তৈরি আইনগুলোকে। গত একমাস ধরে নানান দেশের অপরাধীদেরকে বের করে আনছে জেল থেকে। এই কাজে জুড়ি নেই তার।

গাড়ির দরজার পাশে চামড়ার পকেট থেকে মানচিত্র নিল ক্যামেরাম্যান। ওটার ভাঁজ খুলে আঙুল রাখল সরু, আঁকাবাঁকা এক পথের ওপরে। ‘আমরা ঠিক পথেই আছি,’ বলল সে।

দু’পাশে রোদে পোড়া বাদামি ঘাসে ছাওয়া শুকনো জমি। সামনে ছোট শহর পোলাতস্ক। ওটা পেরোলে কয়েক মাইল দূরে ওদের আজকের গন্তব্য।

মার্সেলের চেয়ে বয়সে ছোট অস্ট্রেলিয়ান ক্যামেরাম্যান, নাম তার জোহানসন। সে-ও ফ্রিল্যান্সার। অস্ট্রেলিয়ান টিভির জন্যে শ্যুট করে নিউয ফুটেজ। অবশ্য পুব ইউরোপে এসেছে আলাদা এক কাজে। তার ফুটেজ পছন্দ হলে মালিকপক্ষের তরফ থেকে পাবে মোটা অঙ্কের টাকা।

বার্গার শেষ করে মেঝেতে র‍্যাপার ফেলল স্কাউট। রেডিয়ো চালু করে দুটো স্টেশনের গান পছন্দ না হওয়ায় বিরক্ত হয়ে বাটন টিপে বন্ধ করল যন্ত্রটা। দু’পাশে সাঁই-সাঁই করে পিছিয়ে যাচ্ছে বাদামি ঘাসে ভরা জমি।

বিশ মিনিট পর ছোট শহর পোলাতস্কে ঢুকল এসইউভি। সামনের মোড়ে বামে বাঁক নিয়ে পেছনে ফেলে দিল শহরটাকে। এখন চারপাশে বিরান এলাকা। কোথাও নেই জনমানবের কোন চিহ্ন। যদিও বহু দূরে দিগন্তের কাছে ধুলোর ভেতরে খরতাপে থরথর করে কেঁপে চলেছে বিশাল এক ধূসর দুর্গ। ওটার সামনের কম্পাউণ্ডে দু’সারিতে রেযর ওয়াএয়ার, একটু দূরে টাওয়ারের ওপরে গান টারেট। ওখানে পাহারা দিচ্ছে সশস্ত্র সৈনিকেরা। পাথুরে দুর্গ থেকে কেউ পালিয়ে যাবে, সে-উপায় নেই।

মেইন গেটের সামনে গিয়ে গাড়ি রাখল মার্সেল। সাবমেশিন গান হাতে ওর দিকে এল একজন গার্ড। তার হাতে নিজেদের কাগজপত্র ধরিয়ে দিল মার্সেল। মন দিয়ে পেপার্স পড়ছে গার্ড। একবার দেখল কালো এসইউভির ছাতে স্যাটেলাইট ডিশ। মুখে কিছু না বলে ফেরত দিল কাগজপত্র। হাতের ইশারা করল সঙ্গীদের দিকে। ধীরে ধীরে খুলে গেল খিলান দেয়া লোহার ফটক। মার্সেল গাড়ি নিয়ে ভেতরে ঢুকতেই পেছনে বন্ধ হয়ে গেল গেট।

‘তোমার কাজ অডিশনের ভিডিয়ো তোলা,’ গাড়ি নিয়ে সামনে বেড়ে ক্যামেরাম্যানকে বলল বনি মার্সেল।

‘আমরা ওকে কিনে নিলে আশপাশের ভিডিয়ো চাইবে মিস্টার স্টিল।’ ক্যামেরা ঘুরিয়ে ছবি তুলছে জোহানসন।

দোতলা উঁচু পাথুরে দেয়ালের কাছে গাড়ি রেখে নেমে পড়ল তারা। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেছে শরীর। আড়মোড়া ভাঙল তারা দু’জন, তারপর ক্যামেরা হাতে মার্সেলের পিছু নিল জোহানসন। দুর্গের দরজার কাছে যেতেই হাজির হলো সশস্ত্র ক’জন সৈনিক। অতিথিদের জন্যে খুলে দেয়া হলো দালানের চওড়া দরজা। মার্সেল ও জোহানসনকে হাতের ইশারায় পথ দেখাল নিম্নপদস্থ এক অফিসার।

ধূসর দুর্গ দেখলে মনে হবে, ওখানে বাস করে অত্যাচারী কোন রাজা বা জমিদার। ভেতরের পরিবেশ নরকের ভয়ঙ্কর গভীর কোন গহ্বরের মত। মানুষ তো দূরের কথা, কোন জানোয়ারও থাকতে চাইবে না ওখানে। বদ্ধ দুর্গে ঘামের বাসি বোটকা গন্ধ। সেই সঙ্গে পচা মাংসের কুবাস। মেঝেতে এখানে-ওখানে শুকিয়ে যাওয়া রক্তের খয়েরি দাগ। দু’পাশে জং-ধরা লোহার খাঁচার ভেতরে জ্বলজ্বলে চোখে চেয়ে আছে হিংস্র চেহারার ক’জন কঠোর লোক।

জোহানসন বুঝে গেল, এখানে বাঁচতে হলে খুব কষ্টসহিষ্ণু হতে হবে। মার্সেল ও জোহানসনের দিকে এল বেলারুশ আর্মির এক অফিসার। পরনে তার লাল ল্যাপেলসহ খাকি ইউনিফর্ম। অফিসারের পেছনে দুই সৈনিক। তাদেরকে দেখে নীরবে বিদায় নিল নিম্নপদস্থ অফিসার। মার্সেল ও জোহানসনের সঙ্গে হাসিমুখে হাত মেলাল কারাগারের জেলার।

জোহানসন ধারণা করল, মায়ের পেট থেকে পড়ে সঙ্গে সঙ্গে হারামিপনা করতে শুরু করেছে এ-লোক। মার্সেল অবশ্য আগেই বলে দিয়েছে, কারাগারের বন্দিদের ওপরে প্রচণ্ড নির্যাতন করে এই নরপশু। তার হাসি চওড়া হলেও চোখ দুটো বরফ-শীতল। একে রাগিয়ে দিলে আর এখান থেকে বাকি জীবনে বেরোতে পারবে না, বলে দিয়েছে মার্সেল। অফিসারের ছবি তুলতে চাওয়ায় জোহানসনের ক্যামেরা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল এক সৈনিক।

ঘড়ঘড়ে গলায় কী যেন বলল ওয়ার্ডেন। তার কিছুই বুঝল না জোহানসন। বেলারুশের ভাষা জানা আছে স্কাউটের। আলাপ শুরু করল সে। একটু পর জোহানসনকে বলল, ‘বসের ছবি ভুলেও তুলবে না।’

জোহানসন ক্যামেরা নিচু করতেই এগোবার ইশারা করল অফিসার। সঙ্গীকে নিয়ে তার পিছু নিল মার্সেল। কাঠের নড়বড়ে সিঁড়ি বেয়ে তিনতলায় উঠে এল তারা। সামনের করিডরে লোহার শিক দেয়া একের পর এক পাথুরে প্রকোষ্ঠ। ওগুলোর ছবি তুলবে বলে মার্সেলের কাঁধে টোকা দিল জোহানসন। ‘এগুলোর ভিডিয়ো নেব?’

জবাবে মাথা দোলাল বনি মার্সেল।

সেলগুলোর ভিডিয়ো নিল জোহানসন। এদিকে মাঝারি এক অফিসঘরে গিয়ে ঢুকেছে ওয়ার্ডেন ও মার্সেল। কিছুক্ষণ ভিডিয়ো করার পর সামনের অফিসে ঢুকল জোহানসন। ঘরটা সাদামাঠা। দেয়ালে আর্মির কিছু ছবি ও ডেকোরেশন। আসবাবপত্র সস্তা হলেও একদিকের কোণে মেহগনি কাঠের পুরনো লিকার কেবিনেট। ওখানে আছে দুনিয়ার নামকরা সব মদের বোতল। বেলারুশের কারাগারের ওয়ার্ডেন যে বেতন পায়, তাতে ওগুলো তার অফিসে থাকার কথা নয়। যে-কেউ বুঝবে, অপরাধে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িত এ-লোক। ছবি তোলার লোভ হলেও ভিডিয়ো ক্যামেরা চালু করল না জোহানসন।

চেয়ারে না বসে ওদিকের একটা দরজা দেখাল ওয়ার্ডেন।

তার পিছু নিল ওরা। দরজার ওদিকে খাঁচার মত এক ব্যালকনি। ওখান থেকে নিচে দেখা গেল পাথুরে উঠন।

ওখানে এখন আছে মাত্র একজন বন্দি। তবে সে সাধারণ কেউ নয়, তাকে বলা চলে বিশাল এক ইয়েতি!

চুলদাড়ি ও দেহের লোমে ভরা লোকটা দৈর্ঘ্যে অন্তত সাড়ে সাত ফুট। চওড়ায় তিনজনের সমান। মনে মনে খুশি হলেও মুখ খুলল না মার্সেল। আগে দেখবে কেমন লড়াই করে এই লোক।

দানবের মত এই বন্দির নাম ম্যানইয়া লোপাতিন। হাতে-পায়ে, বুক-পেটে থোকা থোকা পেশি। বসে বসে আধপচা এক পাউরুটিতে কামড় দিচ্ছে সে। ফুলে উঠছে দু’চোয়াল। মাঝে মাঝে গিলছে কাঠের বউলে রাখা ধূসর স্যুপ। ন্যাড়া মাথা চারকোনা বাক্সের মত। সারামুখে অসংখ্য কাটাছেঁড়ার দাগ। গরিলার মত কোঁৎ-কোঁৎ করে খাচ্ছে নিজের খাবার।

আগেই তার ছবি দেখেছে মার্সেল। ম্যানইয়ার বয়স এখন তিরিশ। দেখার মত তার ডোশিয়ে। জাতে রাশান। ক্ষুধার্ত বাঘের চেয়েও হিংস্র। এরই ভেতরে খুন করেছে আঠারোজন মানুষকে। তাদের ছয়জন মারা গেছে এই কারাগারে। মৃতদের ভেতরে ছিল চারজন মহিলা। খুন করার আগে তাদেরকে ধর্ষণ করেছে ম্যানইয়া।

কারাগারের বন্দিদের কাছে চরম এক আতঙ্ক হয়ে উঠেছে এই দানব। নিচের উঠনে তার সঙ্গে থাকতে রাজি নয় কেউ। এগারোজন মানুষকে হত্যার দায়ে ফাঁসির রায় আছে তার বিরুদ্ধে। কিছু দিনের ভেতরে কার্যকর করা হবে মৃত্যুদণ্ড।

এমনই কাউকে মনে মনে খুঁজছিল বনি মার্সেল।

লোপাতিনের মত দানবকে হাতের মুঠোয় পেলে খুব খুশি হবে তার নিয়োগকারী ব্র্যাড স্টিল।

এবার দেখতে হবে কাজে কেমন লোপাতিন।

‘দেখে তো ভালই লাগছে,’ রাশান ভাষায় বলল মার্সেল, ‘শরীরটা বড় হলেও লড়াইয়ে কেমন তা দেখতে চাই।’

তার কথা শুনে হাসল ওয়ার্ডেন। লোহার খাঁচার শিকে ব্যাটন দিয়ে বাড়ি মেরে ঠং-ঠং করে শব্দ তৈরি করল। উঁচু গলায় বলল, ‘এবার ওদেরকে নিয়ে এসো!’

নিচে উঠনের একদিকে খুলে গেল ইস্পাতের ভারী জালের দরজা। এক এক করে ভেতরে ঢুকল তিন কয়েদী। তারা পুব ইউরোপের লোক। প্রত্যেকে কমপক্ষে সাড়ে ছয় ফুট উঁচু। তাদের পেছনে ঝটাং শব্দে বন্ধ হলো জালের দরজা। ওদিক থেকে আটকে দেয়া হলো বল্টু। পেশিবহুল তিন কয়েদীর গায়ে নানান ধরনের ক্ষত-চিহ্ন। হাত-পা ও বুকে উল্কি। দাগী খুনি। তাদেরকে আগে আহত করেছে, তাই লোপাতিনের রক্ত ঝরাতে ব্যাকুল হয়ে আছে তারা। ভাবছে, উঠনে বইয়ে দেবে রক্তের স্রোত।

লোপাতিন আর তার তিন প্রতিপক্ষের দিকে চেয়ে ডান ভুরু উঁচু করল মার্সেল। তিন বন্দির যে-কোন একজন দানবের জন্যে শক্ত প্রতিপক্ষ। আর এবার একসঙ্গে হামলা করবে তারা! এরপরেও লোপাতিন জিতে গেলে বুঝতে হবে তাকেই আসলে চাইছে ব্র্যাড স্টিল।

‘এবার ভিডিয়ো চালু করো!’ নির্দেশ দিল মার্সেল।

ক্যামেরা বাগিয়ে বারো ইঞ্চি অ্যান্টেনা ওপরে তাক করল জোহানসন।

এদিকে স্পিড ডায়াল থেকে স্টিলের নাম্বার নিয়ে যোগাযোগ করল মার্সেল। ‘বস্, আমি বনি। এবার ভিডিয়ো পাঠাচ্ছি।’

খাবার ফেলে উঠে পড়েছে ম্যানইয়া লোপাতিন। দুই প্রতিপক্ষের চেয়ে প্রায় একফুট উঁচু সে। তিনদিক থেকে তাকে ঘিরে ধরেছে তিন খুনি। বিশাল মাথা ঘুরিয়ে তাদেরকে দেখছে লোপাতিন।

পেছন থেকে দানবের ওপরে হামলা আসতেই ক্যামেরা যুম করল জোহানসন। মস্ত শরীরে ঝট্ করে ঘুরল লোপাতিন। তবে আরও দ্রুত পেছনের শত্রু। দানবের মাথা হেডলকে আটকে নিল সে। ময়লা ভরা কালো আঙুলে উপড়ে নিতে চাইল শত্রুর চোখ। তাতে আরও রেগে গেল লোপাতিন। কুঁজো হয়ে খপ্ করে ধরল সাড়ে ছয় ফুটি প্রতিপক্ষের ডান ঊরু, পরক্ষণে দু’হাতে ময়দার বস্তার মত তাকে তুলে গায়ের জোরে ছুঁড়ে ফেলল দেয়ালের ওপরে। পরিষ্কার শোনা গেল লোকটার পাঁজরের হাড় ভাঙার মড়াৎ আওয়াজ। ধপাস্ করে মেঝেতে পড়ল অচেতন বন্দি। সে জানে না, কপাল খুব ভাল তার।

এবার একই সঙ্গে লোপাতিনের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল অন্য দুই কারাবন্দি। মস্ত মুঠো পাকিয়ে একের পর এক ঘুষি মারছে দানবের মুখে, ঘাড়ে, বুকে ও পেটে। দুই বন্দির মধ্যে আকারে যে ছোট, হাঁটু তুলে লোপাতিনের থুতনির নিচে গুঁতো দিল সে। সঙ্গে সঙ্গে দানবের মুখ থেকে কলের পানির মত ঝরঝর করে ঝরল টকটকে লাল রক্ত। দু’সারি দাঁতের মাঝে পড়ে কুচ করে কেটে গেছে রাশানের জিভের ডগা।

খারাপ হয়ে গেল মার্সেলের মন। বসের চাই দুর্দান্ত লড়াকু কাউকে। তাকে হতে হবে এমন একজন, যে লড়বে নয়জন প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে। অথচ দেখা যাচ্ছে মাত্র তিনজনের সঙ্গে লড়তে গিয়ে মার খাচ্ছে লোপাতিন।

দর্শকেরা এত টাকা খরচ করে হারু পার্টির লড়াই দেখলে ফ্লপ হবে ব্র্যাড স্টিলের শো। এদিকে টাকা না দিয়ে পিছিয়ে যাওয়ার আর কোন উপায় নেই মার্সেলের, নইলে খেপে উঠবে ওয়ার্ডেন। তাকে বেশি কিছু বলতে গেলে, টাকা কেড়ে নিয়ে গুম করবে ওদের দু’জনকে।

এইমাত্র ‘থুহ!’ করে মুখ থেকে কাটা জিভ ফেলেছে লোপাতিন। বারকয়েক মাথা দুলিয়ে নিচু হলো। গরিলার মত দীর্ঘ দু’হাতে খপ করে ধরল আকারে ছোট শত্রুর মাথা। তবে সেটা মাত্র একসেকেণ্ডের জন্যে, পরক্ষণে শুকনো সরু ডালের মত মড়াৎ করে ভেঙে দিল বন্দির ঘাড়। মেঝেতে পড়ে থাকা অচেতন শত্রুর ওপরে ছুঁড়ে দিল লাশটাকে।

যে-কেউ ভাববে আগুন জ্বেলে নেয়ার জন্যে এক এক করে চ্যালা কাঠ গুছিয়ে নিচ্ছে লোপাতিন। দু’হাতে তার মুখ ও বুকে ঘুষি মারছে তৃতীয় কারাবন্দি। আকারে সে লোপাতিনের প্রায় সমান। তবে প্রতিপক্ষের হিংস্রতা দেখে ঘাবড়ে গেছে।

ক্ষুধার্ত বাঘের মত তার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল রাশান দানব। দু’জনের তুমুল লড়াই দেখে হেসে ফেলল মার্সেল। বুঝে গেছে, ভালভাবে শেষ করেছে নিজের হোমওঅর্ক। বহু খুঁজে বের করতে পেরেছে এই বিশাল দানবটাকে। বলা চলে পেয়ে গেছে সোনার খনি। ভিডিয়ো দেখে নিশ্চয়ই মুগ্ধ হচ্ছে ওর বস্। আর তার মানেই শো-র কমিশন হিসেবে পকেটে আসবে লাখ লাখ ডলার!

এদিকে জোহানসন বুঝ দিচ্ছে নিজের মনকে, সে মানুষ খুনের কোন ভিডিয়ো তুলছে না। যদিও রাশান দানবের মুখ থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোতে সেই ভিডিয়ো করেছে সে। ভুলে যেতে চাইছে, এই মারামারির প্রতিটি দৃশ্য আসলে রূঢ় বাস্তব।

ক’দিন পর ফিরবে সিডনিতে। নৃশংস দৃশ্যগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠলে খচখচ করবে তার বিবেক। বিশেষ করে আঠারো মাসের সন্তানদুটোকে কোলে নিয়ে চোখ তুলে তাকাতে পারবে না স্ত্রীর চোখে। যে কাজ নিয়েছে সেটা চরম অন্যায় জেনেও বা কী করার আছে তার?

দু’হাতে মুড়ির মত ডলার ছিটাচ্ছে ব্র্যাড স্টিল।

সংসারের খরচ মেটাতে গিয়ে তার কথায় রাজি হয়ে গেছে সে। যাবে লোকটার সঙ্গে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এক দ্বীপে। কীভাবে খুন হবে একদল দাগী আসামী, সেটা গোপনে ভিডিয়ো করবে। এরপর হয়তো বাকি জীবন ঘুমাতে পারবে না আর। মেয়েদুটোর কথা ভাবতেই মনে মনে বলল: মা রে, স্রেফ টাকার জন্যে বিক্রি করে দিয়েছি নিজের আত্মা।

নিচের উঠনে লড়ছে দুই দানব।

সুস্থ মস্তিষ্কের কেউ ভাববে না লড়াই হচ্ছে সমানে সমানে। যা ঘটছে সেটা ঠাণ্ডা মাথায় মানব-হত্যা।

মুখোমুখি সংঘর্ষে হুড়মুড় করে মেঝেতে পড়েছে দুই বন্দি। ট্রাকের ওপরে দ্রুতগামী ট্রেন যেভাবে চড়াও হয়, শত্রুর বুকে চেপে বসেছে লোপাতিন। দু’হাতে ঘুষি মারছে শত্রুর মুখে। লোপাতিনের মুঠো যেন বৈদ্যুতিক মুগুর। দু’মিনিটে কিমা হলো প্রতিপক্ষের মুখ।

অচেতন শত্রুর গলা টিপে ধরল রাশান দানব। মিনিট তিনেক পর উঠে দাঁড়িয়ে খুশি হয়ে ছাড়ল বিকট এক হুঙ্কার।

.

হাজারো মাইল দূরে দামি চামড়ামোড়া লাউঞ্জ চেয়ারে বসে মস্তবড় এলইডি স্ক্রিনে লড়াই দেখছে ব্র্যাড স্টিল। রাশান দানবের প্রথম প্রতিপক্ষ খুন হতেই মুচকি হেসেছে সে। মন ভাল লাগছে বলে দোলাচ্ছে পায়ের উডল্যাণ্ড ণ্ড্য। দামি সুতির সাদা ফুলহাতা শার্টের আস্তিন গুটিয়ে দেখল ত্রিশ হাজার ডলারের রোলেক্স ঘড়ি। বুঝে গেছে, তার নতুন শো-র সেরা আকর্ষণ হয়ে উঠবে লোপাতিন।

জিন্সের প্যান্টের উরুতে মুছে নিল হাতের তালুর ঘাম। বসে আছে স্টেট-অভ-দি-আর্ট এক বিশাল তাঁবুর ভেতরে। একপাশে অসংখ্য এলইডি স্ক্রিন, অন্যদিকে কমপিউটারাইড্ এডিটিং বে ও টপ-এণ্ড অডিয়ো ভিণ্ড্যুয়াল ইকুইপমেন্ট। বেলারুশের কারাগারে নিজেকে যেমন রাজা ভাবছে ওয়ার্ডেন, তার মতই নিজেকে দ্বীপের মালিক বলে মনে করছে স্টিল।

বয়স তার পঁয়ত্রিশ। মাথার চুল বালির মত ধূসর। চোখের মণি যেন সাগরের হালকা নীল। ম্যালিব্যুতে সূর্যস্নান করে ত্বক করে নিয়েছে বাদামি রঙের। ছাত্রজীবনে পড়াশোনা করেছে ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে। ক’দিন আগেও ব্যবসার প্রসার নিয়ে ব্যস্ত ছিল লস এঞ্জেলেসে। লাকি সিক্স কোম্পানির সিইও সে। গত আট বছরে রিয়েলিটি টেলিভিশন শো তৈরি করে এরই ভেতরে অর্জন করেছে আটাশ মিলিয়ন ডলার।

অত্যন্ত সুদর্শন এক পুরুষ সে। তারুণ্যে টাকা না থাকলেও অমোঘ আকর্ষণে তার চারপাশে ঘুরঘুর করত রূপসী মেয়েরা। আর এখন তো কোন কিছুরই অভাব নেই। গত ছয় বছরে দু’বার বিয়ে করে নিজেই ডিভোর্স দিয়েছে সুন্দরী দুই স্ত্রীকে। বুঝে গেছে, বিয়েতে প্রথমে ফূর্তি হলেও পরে গচ্চা দিতে হয় বহু টাকা। তাই ভেবেছে, আর কখনও পা দেবে না সংসারের ফাঁদে। মন চাইলে দৈহিক সম্পর্ক গড়ছে সুন্দরী মডেলদের সঙ্গে। বিরক্তি লাগলে আগের জনকে বিদায় করে দিয়ে জোগাড় করে নিচ্ছে অন্য কোন রূপসী মেয়েকে।

আবারও স্ক্রিন দেখল ব্র্যাড স্টিল।

এইমাত্র তৃতীয় কয়েদীর বুক থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বিকট গর্জন ছাড়ল ম্যানইয়া লোপাতিন। বুটের হিল দিয়ে চুরমার করে দিল শত্রুর কণ্ঠনালী।

দৃশ্যটা দেখে নিয়ে হেডসেটে বলল স্টিল, ‘হ্যাঁ, আমি ওকে চাই।’

স্বস্তির হাসি হাসল মার্সেল। ‘আপনি ওকে পেয়ে গেছেন, বস্!’

ভিডিয়ো লিঙ্ক কেটে যেতে স্টিল বুঝল, এবার ব্যাগ থেকে পঞ্চাশ হাজার ইউরো ওয়ার্ডেনের হাতে তুলে দেবে মার্সেল। আজই কারাগার থেকে নিয়ে ম্যানইয়া লোপাতিনকে পার করে দেয়া হবে বেলারুশের সীমান্ত।

আগামী ক’দিন পর তাকে হাতে পাবে ব্র্যাড। এরপর আর কোন বাধা থাকবে না নতুন শো শুরু করতে। মনের মত দশজন দাগী অপরাধী পেয়ে গেছে সে।

অধ্যায় ১ / ৩৭

সকল অধ্যায়

১. ডার্টি গেম – ১
২. ডার্টি গেম – ২
৩. ডার্টি গেম – ৩
৪. ডার্টি গেম – ৪
৫. ডার্টি গেম – ৫
৬. ডার্টি গেম – ৬
৭. ডার্টি গেম – ৭
৮. ডার্টি গেম – ৮
৯. ডার্টি গেম – ৯
১০. ডার্টি গেম – ১০
১১. ডার্টি গেম – ১১
১২. ডার্টি গেম – ১২
১৩. ডার্টি গেম – ১৩
১৪. ডার্টি গেম – ১৪
১৫. ডার্টি গেম – ১৫
১৬. ডার্টি গেম – ১৬
১৭. ডার্টি গেম – ১৭
১৮. ডার্টি গেম – ১৮
১৯. ডার্টি গেম – ১৯
২০. ডার্টি গেম – ২০
২১. ডার্টি গেম – ২১
২২. ডার্টি গেম – ২২
২৩. ডার্টি গেম – ২৩
২৪. ডার্টি গেম – ২৪
২৫. ডার্টি গেম – ২৫
২৬. ডার্টি গেম – ২৬
২৭. ডার্টি গেম – ২৭
২৮. ডার্টি গেম – ২৮
২৯. ডার্টি গেম – ২৯
৩০. ডার্টি গেম – ৩০
৩১. ডার্টি গেম – ৩১
৩২. ডার্টি গেম – ৩২
৩৩. ডার্টি গেম – ৩৩
৩৪. ডার্টি গেম – ৩৪
৩৫. ডার্টি গেম – ৩৫
৩৬. ডার্টি গেম – ৩৬
৩৭. ডার্টি গেম – ৩৭

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন