৩৫. অমরনাথ শুয়ে আছেন

সমরেশ মজুমদার

অমরনাথ শুয়ে আছেন তাঁর খাটে। যে-খাটটা কখনই তাঁর নিজস্ব ছিল না। বিয়ের পর অঞ্জলি ওই খাট নিয়ে এসেছিল। দীপা কিংবা তাঁর অন্য ছেলেদের অনেক বাল্যস্মৃতি রয়েছে ওই খাটকে ঘিরে। খাটের ওপাশে বসে অঞ্জলি মাঝে মাঝেই অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে। জ্ঞান ফেরামাত্র সে তীব্র চিৎকার করে ঝাপিয়ে পড়ছে অমরনাথের বুকে। চা-বাগানের অন্যান্য বাবুদের স্ত্রীরা তাকে সামলাতে চেষ্টা করছে প্রাণপণে। একজন ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলেন মনোরমাকে। নিজেকে তিনি কোনওমতে বহন করে এনেছিলেন এই ঘরে, ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে তিনিও অজ্ঞান হয়ে গেলেন। তাঁকে সেবা করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল কয়েকজন। দূরের দরজায় দীপা দাড়িয়ে রইল পাথরের মতো। তার সঙ্গে হাজার হাজার টাকা এবং একটি ব্যাঙ্ক ড্রাফট।

অমরনাথকে খুব শান্ত দেখাচ্ছিল। যেন প্রশান্ত মনে ঘুমাচ্ছেন। তার পরনে এখনও লুঙ্গি আর গেঞ্জি। সে দুটিও ধোপদুরস্ত। ডাক্তারবাবু এগিয়ে এলেন দীপার কাছে, হবে জানতাম কিন্তু এত তাড়াতাড়ি হবে ভাবতে পারিনি। প্রচণ্ড লড়াই করেছিলেন, চেষ্টা করলাম।’

দীপার শরীর এখন চৈত্রের আকাশ। একটা গরম হলকা যেন পাক খাচ্ছে শরীরময়। কথা বলতে গিয়ে আবিষ্কার করল জিভ নড়ছে না। আর সেইসময় অঞ্জলির জ্ঞান ফিরে এল। স্বামীর বুকের দিকে ঝাপিয়ে পড়তে উদ্যত হতেই তার নজর পড়ল দীপার দিকে, সঙ্গে সঙ্গে গলার স্বর পালটে গেল তার। হিমশীতল গলায় যদি উপহাস মেশে তা হলে এমনভাবে শব্দ উচ্চারণ করা যায়।

অঞ্জলি বলল, এসো, অত দূরে কেন, এসে দ্যাখো, যাকে এতকাল বাবা বলতে, যিনি তোমার সর্বনাশ করেছিলেন বলেছিলে, তিনি কী সুন্দর ঘুমিয়ে আছেন। কাছে এসো।’

নাড়া খেল দীপা। ঘরে যারা ভিড় করে ছিল গম্ভীর মুখে তারা এবার পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল। অঞ্জলি টলতে টলতে খাট থেকে নামল। ওকে আটকাবার চেষ্টা কেউ করল না। তার আঁচল মাটিতে লুটোচ্ছিল। কয়েক পা এগিয়ে এসে চিল-চিৎকারে অঞ্জলি বলে উঠল, ‘জন্মমাত্র মাকে খেয়েছিল বিয়েমাত্র স্বামীকে গিলেছিল, তবু তোর নোলা ভরল না রে, ওকে শেষ না করলে তোর কিছুতেই কি পেট ভরছিল না?

হঠাৎ তারস্বরে চিৎকার করে উঠলেন মনোরমা, ‘বউমা! না, এমন কথা বোলো না, বোলো না। পাপ। হবে, পাপ হবে।

‘পাপ হবে?’ ফুঁসে উঠল অঞ্জলি, ‘কীসের পাপ? আর পাপ হলে কে ভয় পাচ্ছে? আমার আর কী রইল? কী হবে পাপে? এতদিন মানুষটা ভাল ছিল। খেত ঘুমাত, তবু তো ছিল। যেই ইনি এলেন কলকাতা থেকে—।’দাঁতে দাঁত লেগে গেল অঞ্জলির। তার শরীর টলতে লাগল। দু’জন মহিলা দু’পাশ থেকে ধরে মেঝেতেই শুইয়ে দিলেন তাকে। সবাই খুব অপ্রস্তুত।

পাথরের মতো দাঁড়িয়ে ছিল দীপা। এখন তার চৈতন্য পরিষ্কার। কথাগুলো গরম লোহার মতো তাকে এফোঁড় ওফোঁড় করে দিয়ে গেল আচমকা। সে নড়তে পারছিল না।

ডাক্তারবাবু পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এবার তিনি দীপার কাঁধে হাত রাখলেন, ‘আপসেট হয়ো না।’ এইসময় তানেক মানুষ নার্ভ হারিয়ে ফেলে, সেন্স কাজ করে না। উনি কী বলছেন তা নিজেই জানেন না।’

দীপা দেখল মনোরমাকে ধরাধরি করে নিয়ে যাওয়া হল অমরনাথের কাছে। ছেলের মাথার পাশে। ধপ করে বসে পড়লেন তিনি। ওর খুব ইচ্ছে করছিল অমরনাথের কাছে যায়। কিন্তু সেইসঙ্গে ভয় হচ্ছিল জ্ঞান ফিরে আসামাত্র অঞ্জলি যদি আবার চিৎকার শুরু করে। ওই খারাপ কথাগুলো যদি আবার শুনতে হয়। ডাক্তারবাবু ওর পিঠে হাত দিয়ে তখনও দাড়িয়ে ছিলেন। দীপার সমস্ত শরীর কেঁপে উঠল। সে হঠাৎ জড়িয়ে ধরল ডাক্তারবাবুকে এবং সেইসঙ্গে কান্না ছিটকে উঠল। এতক্ষণের চাপা যন্ত্রণা শোক এবং আহত হবার অনুভূতি মিলে মিশে একাকার। এই কান্না অমরনাথের জন্যে যতটা নিজের জন্যে তার চেয়ে কিছু কম নয়। ডাক্তারবাবু মাথায় হাত বোলাচ্ছিলেন ‘বি স্টেডি। তুমি আর পাঁচটা মেয়ের মতো নও। তোমার নার্ভ খুব শক্ত, আমি জানি। বি স্টেডি।’

কান্নার বেগ সামান্য কমলে দীপার অনুভবে একটা পুরুষালি গন্ধ ছড়াল। এই গন্ধ অমরনাথ জড়িয়ে ধরলে সে অনুভব করত। পলকেই নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে সে ছুটে গেল অমরনাথের কাছে। মৃত মানুষের হাত টেনে নিয়ে নিজের মুখ রাখল সে এখানে। আর তখনই খাটের এক কোণে দাড়ানো বড় ভাই বলে উঠল, ‘এই দিদি, তুই বাবাকে ছুঁবি না।’

কেউ একজন প্রতিবাদ করল, ‘এই, তুই কী যা তা বলছিস?’

‘ঠিক বলছি। দিদির জন্যে বাবা মারা গিয়েছে।’

দীপার কানে কথাগুলো ঢুকছিল। দাঁতে দাঁত চেপে বসেছিল সে। যেন অমরনাথের স্পর্শের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। এই হাত কতবার তাকে ছুঁয়ে গিয়েছে। এখনও উত্তাপ চলে যায়নি চামড়ার। মানুষ মরে গেলে সম্পর্কও মরে যায়?

ডাক্তারবাবুর গলা কানে এল, শ্যামল, আর দেরি করে কোনও লাভ নেই।’

শ্যামলদা বলল, ‘নিয়ে গেলেই হয়। সাহেব আসবেন শুনছিলাম।

‘এসে পড়লেন বলে। তৈরি হও তোমরা।’

মনোরমা কোনও কথা বলছেন না। ওরা অমরনাথকে পোশাক পরানোর জন্যে হাত লাগাতেই তিনি দীপাকে নিয়ে নেমে এলেন উঠোনে। একটানা কেঁদে যাচ্ছিল দীপা। তাকে জড়িয়ে ধরে বসে রইলেন রান্নাঘরের সিড়িতে। তার দৃষ্টি শূন্য। দীপাকে আঁকড়ে ধরে বসে থাকা ছাড়া এই মুহূর্তে তার যেন কিছুই করার ছিল না।

একসময় ললিতাদি এগিয়ে এল কাছে! নিচু গলায় বলল, ‘দীপা, তোমাকে ওঁরা ডাকছেন। একবার এসো।’

দীপা মাথা ঝাকাল, ‘আমি যাব না, কোথাও যাব না।’ মনোরমার কোল থেকে মুখ তুলতে তার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে ছিল না।

ললিতা বলল, ‘ওঁকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সাহেব এসেছেন। এইসময় তোমার গিয়ে দাঁড়ানো উচিত। লক্ষ্মীটি, উঠে এসো।’

অমরনাথকে শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। দীপা শক্ত হয়ে গেল। আর তখনই মনোরমা শুকননা স্বরে বললেন, ‘যা।’ দীপা ধীরে ধীরে উঠল। ললিতা তার হাত ধরল।

অঞ্জলিকে ধরে রাখা মুশকিল হচ্ছিল। তার পৃথিবীতে আর কেউ নিজের বলে রইল না, এইরকম একটা বাধে আক্রান্ত হয়ে সে বেসামাল হয়ে গিয়েছিল। দীপাকে ছেড়ে দিয়ে ললিতাদি তার কাছে গিয়ে বলল, ‘কাকিমা, নিজেকে একটু সামলান। ছেলেরা সামনে আছে, ওদের কথা ভাবুন।’

একসময় অমরনাথকে নিয়ে ওরা রওনা হল। শিউলি গাছের পাশ দিয়ে মাঠ ডিঙিয়ে আসাম রোডের দিকে মিছিলটা চলে গেল হরিধ্বনি দিতে দিতে। মেয়েদের শ্মশানে যাওয়ার চল এখনও এ-বাগানে হয়নি। শুধু ছেলে না থাকলে এবং মেয়ে যদি অবিবাহিতা হয় তা হলে তাকে মুখাগ্নির জন্যে নিয়ে যাওয়া হয়। তবে সেসব ক্ষেত্রে মৃতের দাদা ভাই বা ওইরকম আত্মীয় যদি না থাকে তবেই।

সবাই মিলে অঞ্জলিকে ধরাধরি করে ভেতরে নিয়ে গেলে, দীপা একা মাঠে দাঁড়িয়ে আসাম রোডে শবমিছিল দেখছিল। কিছু বয়স্ক মানুষ যাঁরা শ্মশানে যাননি তারা এখন ফিরে যাচ্ছিলেন যে যার বাড়িতে। এই চা-বাগানের ম্যানেজার তার গাড়িতে চেপে রওনা হচ্ছিলেন শ্মশানের দিকে। ওঠার মুখে জিজ্ঞাসা করলেন, মেয়েরা যদি যেতে চায় তিনি লিফট দিতে পারেন। কিন্তু কেউ কিছু জবাব দিল না।

যে-মানুষটির সঙ্গে তার সবচেয়ে অপ্রীতিকর সম্পর্ক তৈরি হত বারংবার অথচ যে-মানুষটির ভালবাসা সে অনুভব করত প্রতিটি মুহূর্তে, এই পৃথিবীতে যিনি ছিলেন তার প্রকৃত শুভাকাঙ্ক্ষী, তার এগিয়ে যাওয়ার পথে সবরকম সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন নিজের কথা চিন্তা না করে, আজ আর। তিনি কোথাও রইলেন না।

দীপা ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগল। শ্মশানযাত্রীদের থেকে অনেক দূরে, একা একা। তার পায়ে জুতো নেই, চোখে জলের দাগ। আংরাভাসা নদী, বাজার, চৌমাথা পেরিয়ে সে যখন পুলের ওপর এসে দাঁড়াল। তখন শ্মশানযাত্রীরা নেমে গিয়েছে নীচে। চুপচাপ একা দাড়িয়ে অনেক দূর থেকে মানুষটিকে ছাই হয়ে। যেতে দেখল সে। মানুষটি মরে যাওয়ার পর আগুনের স্পর্শেই শুধু ছাই হয়ে যায়? জীবন্ত মানুষও তো কারও কারও কাছে ছাই হতে পারে! জন্মাবার পর তাকে যে-দুটো মানুষ স্নেহ-ভালবাসায় আপ্লুত হয়ে নিয়ে এসে নিজের সন্তানের মতো মানুষ করতে চেয়েছিল, বাবা ও মা বলতে শিখিয়েছিল, তার একজন যদি চিতার আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায়, অন্যজন জ্বালা ঈর্ষার সঙ্গে নিজের অস্তিত্ব লোপ পাবার আশঙ্কায় মরিয়া হয়ে এতদিনের সম্পর্কই শুধু পুড়িয়ে ছাই করে দেয়নি, নিজেকে অনেক নীচে নামাতেও। বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেনি।

দীপা আবার বাড়ির পথ ধরল। চৌমাথায় সবাই তাকে এখন লক্ষ করছে। এই চেনা জায়গাটাকে এখন তার অচেনা মনে হচ্ছে। চৌমাথা, পোস্ট অফিস, স্কুলের মাঠ, বাজার, আংরাভাসা নদী সব যেন অচেনা, অপরিচিত। অথবা তাদের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা স্মৃতিগুলো এই মুহূর্তে অবশ হয়ে গিয়েছে। আসাম রোড দিয়ে কোয়ার্টার্সের সামনে পৌছে স্থির হল সে। এখন সে ওই বাড়িতে থাকবে কী করে? যে-চারজন মানুষ ওই বাড়িতে বাস করবে তাদের তিনজন তাকে আর পছন্দ করছে না। অঞ্জলি যে-ভাষা প্রকাশ্যে ব্যবহার করেছে, বড় ভাই যে কথাগুলো উচ্চারণ করতে সাহস পেয়েছে, তারপর আর ওখানে থাকার কোনও মানে হয় না। যদি এটা মেনে নিতে হয় তা হলে অনেকদিন আগে সে প্রতুলবাবুর বাড়িতে সব মেনে নিয়ে বিধবা হয়ে থাকতে পারত। কিন্তু কোথায় যাবে সে? এই পৃথিবীতে তার যাওয়ার জায়গা নেই। হস্টেল খুলতে দেরি আছে। আর দু’দিন বাদেই পুজো। এবার মা দুর্গা অদ্ভুতভাবে আসছেন তাদের পৃথিবীতে।

বারান্দায় উঠে এল দীপা। ললিতাদি এবার তার সামনে দাড়িয়ে। যে-ললিতাদি একসময় শ্যামলদাকে পাওয়ার জন্যে আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল, যে কারণে শ্যামলদার বাবা আত্মহত্যা করেছিলেন, যাকে এই চা বাগানের সবাই খারাপ মেয়ে বলে একসময় এড়িয়ে চলত, সেই ললিতাদি আজ তাদের বাড়ির সমস্যা সামলাচ্ছে। সময় সবকিছু খুব সহজেই পালটে দিয়ে যায়। ললিতাদি জিজ্ঞাসা করল, ‘কোথায় গিয়েছিলে দীপা?’

‘শ্মশানের রাস্তায়।’

‘দাহ হয়ে গিয়েছে?’

‘হ্যাঁ।’

‘এখনই শ্মশানযাত্রীরা ফিরে আসবে। ওদের জন্যে সব ব্যবস্থা করে রেখেছি। বুধুয়াকে পাঠিয়েছি। মিষ্টি আনতে বাজারে। এলে মিষ্টি জল দিতে হবে।’

‘বুধুয়া? বুধুয়া এসেছে?’

‘হ্যাঁ। খবর পেয়ে চলে এসেছে।’

‘কিন্তু মিষ্টি খাওয়াতে হবে কেন?’

‘নিয়ম।’ ললিতাদি বলল, ‘মানুষগুলোর তো অনেক পরিশ্রম হল। আর হ্যাঁ, তুমি একবার ভেতরে যাও। তোমার মা বারংবার তোমার খোজ করছেন।’

দীপা শক্ত হয়ে গেল। ঠোট কামড়াল। ললিতাদি বলল, ‘যাও।’

অগত্যা দীপা পা বাড়াল। আর এক প্রস্থ আক্রমণ আর একগাদা নোংরা কথায় তাকে স্নান করতে হবে এখন। তখন অমরনাথের মৃতদেহের সামনে দাড়িয়ে সে কথা বলেনি, কিন্তু এবার জানতে চাইবে। কেন তাকে এসব বলা হচ্ছে। কী দোষ তার?

বড় ঘরটায় মেঝেতে চিত হয়ে শুয়ে আছে অঞ্জলি। তার একপাশে কয়েকজন মহিলা। একজন তাকে ডাকল, ‘এসো। ওই তো দীপা এসে গিয়েছে।’

অঞ্জলি উঠে বসতে চাইলে একজন মহিলা বাধা দিলেন, না না, আপনি উঠবেন না। অত মাথা ঘুরছে—।’

কিন্তু অঞ্জলি শুনল না। হাত বাড়িয়ে সে ডাকল, ‘দীপা, কাছে আয়।

একেবারে অন্যরকম গলা। দীপা হতভম্ব হয়ে গেল। কিন্তু তখনই তার নজর পড়ল অঞ্জলির ওপর। ইতিমধ্যেই হাত থেকে শাখা নোয়া খুলে নিয়ে স্নান করিয়ে দেওয়া হয়েছে তাকে। হঠাৎ যেন শরীরটাকে রক্তশূন্য দেখাচ্ছে। অঞ্জলি এবার কান্না মেশানো গলায় ডাকল, ‘রাগ করিস না মা, কাছে আয়।’

যেন শেকড়ের শেষ প্রান্তে টান পড়ল। দীপা নিজেকে সামলাতে পারল না। একরকম টলতে টলতেই সে অঞ্জলির কাছে পৌছে গেল। তাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে বুকে টেনে নিয়ে অঞ্জলি করে কেঁদে উঠল, ‘তোকে ও সবচেয়ে ভালবাসত রে। তোর জন্যেই শুধু দিনরাত চিন্তা করত। তোর অত বড় ক্ষতি হওয়ার পর ভীষণ মুষড়ে পড়েছিল মানুষটা। তোকে ও পাগলের মতো ভালবাসত।’

দীপা কেঁদে ফেলল। এই সত্যি কথাটা বুকের সমস্ত আড়াল যেন এক টানে সরিয়ে ফেলল।

কান্না চলল কিছুক্ষণ। অঞ্জলি সেই অবস্থায় বলতে লাগল, ‘আমি পাগল হয়ে গিয়েছি রে। আমার মাথার কোনও ঠিক নেই। তোকে তখন কী বলতে কী বলেছি, মানুষটার প্রাণ ছিল না শুনে গেল তো সব, কী করে প্রায়শ্চিত্ত করি।’

দীপা চিৎকার করে উঠল, ‘মা’

‘আমি তোর সঙ্গে সৎমার মতো ব্যবহার করেছি। কী করে করলাম—।’

এইসময় শ্মশানযাত্রীরা ফিরে এল। বুধুয়াও এল মিষ্টির হাঁড়ি নিয়ে। অঞ্জলির ছোট ছেলে ঘরে ঢুকে এই দৃশ্য দেখে দৌড়ে বেরিয়ে গেল। একটু বাদে বড় ছেলে এল, মা!’ একটি কিশোরের গলা থেকে যুবকের স্বর বের হল যেন!

অঞ্জলি কেঁপে উঠল। তার কান্না থেমে গেল। দীপাকে জড়িয়ে ধরেই সে আবার অমরনাথের উদ্দেশে বিলাপ শুরু করল। বড় ছেলে যেন হতবাক। দিদি যে আবার মায়ের এত কাছাকাছি পৌছে যাবে সে সম্ভবত আশাই করেনি।

পুত্রের মৃত্যুশোকে একটা মানুষ যে কতটা পাথর হয়ে যেতে পারে তা মনোরমাকে না দেখে বোঝ দীপার পক্ষে সম্ভব ছিল না। জলপাইগুড়িতে যে-কাপড়ে গিয়েছিলেন সেই এক কাপড়ে তিনি বসে ছিলেন মধ্যরাত পর্যন্ত। সন্ধের মুখে প্রায় জোর করে দীপা তাকে তার ঘরে নিয়ে এসেছিল। বৃদ্ধা বিছানায় শোননি। ঠাকুরের ছবির দিকে পেছন ফিরে চোখ বন্ধ করে বসেছিলেন তিনি। বারংবার বলা সত্ত্বেও কথার জবাব দেননি। মনোরমা সামান্য সুস্থ আছেন আর তার ঠাকুরের সামনে প্রদীপ জ্বলেনি এমন একটা সন্ধ্যার কথা দীপা কখনও কল্পনাও করতে পারেনি। রক্ত মাংসের শরীরটা যেন বাহ্যজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল।

আজ রাত্রে এ বাড়িতে রান্না হবার কথাও নয়। দুই ছেলে হবিষ্যি করবে। কিন্তু মেয়েদের জন্যে সামান্য খাবার ডাক্তারবাবুর স্ত্রী পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। অঞ্জলি সেটা ছুঁয়েও দ্যাখেনি। রাত বাড়লে দীপার হঠাৎ খিদে পেল। অথচ আবহাওয়া এমন যে সেই খাবার খেতে যেতেও খারাপ লাগছিল। অমরনাথকে সে ভালবাসত। অমরনাথের কাজের প্রতিবাদে সে একসময় জলপাইগুড়ির হস্টেল ছেড়ে চলে এসেছিল। নগ্ন একটা সত্য বলেছিল বলে অমরনাথ সেদিন অপমানিত বোধ করেছিলেন। কিন্তু এর বাইরে অমরনাথই সম্ভবত পৃথিবীর একমাত্র মানুষ যিনি তাকে বুঝতে পারতেন। সেই অমরনাথের চলে যাওয়াটা তার কাছে যেমন কষ্টের তেমনই এই রাত্রে খিদেবোধটাও সমান সত্যি।

বড় বাড়ির দরজা বন্ধ। উঠোনের ওপাশে রান্নাঘরের দরজা খোলা হয়নি। সে মনোরমার ঘর থেকে বেরিয়ে কলতলার দিকে গেল। টিউবওয়েল টিপে জল বের করে বেশ খানিকটা গিলে ফেলতেই শরীর যেন গুলিয়ে উঠল। মাথায় মুখে জল দিয়ে সোজা হয়ে দাড়াতেই সে চমকে উঠল। রান্নাঘরের বারান্দায় কেউ একজন বসে আছে। কে? চোর? অনেকগুলো চিন্তা একসঙ্গে পাকিয়ে ওঠামাত্র সে চিৎকার করে উঠল, ‘কে?’

‘হাম। আমি।’ বুধুয়ার গলা।

সহসা যেন নিশ্বাস সহজ হল, ‘ওখানে কী করছিস?’

‘এইস্যাই। বইঠা হ্যায়।’ বুধুয়ার গলায় নির্লিপ্ততা।

‘বাড়ি যাসনি কেন?’

‘এইস্যাই।’

‘খেয়েছিস কিছু?’

‘নেহি। ভুখ নেহি লাগতা।’

‘তোর ঘুম পাচ্ছে না?’

‘নেহি।’

দীপা অবাক হয়ে গেল। অমরনাথের সঙ্গে বুধুয়ার সম্পর্ক প্রভু এবং ভৃত্যের। হাটের দিন ব্যাগ হাতে পেছন পেছন যেত। অমরনাথের বাজার করা নিয়ে সে অঞ্জলির সঙ্গে তর্ক করত। কিন্তু কখনই অমরনাথের মুখের ওপর কথা বলার স্পর্ধা দেখায়নি। এই বাড়ির চাকরি থেকে বঞ্চিত হয়ে নিশ্চয়ই খুব কষ্টে ছিল বেচারা। আজ এই রাত্রে একা রান্নাঘরের বারান্দায় ওইভাবে যে-মানুষ বসে থাকে তার মনটাকে এ-বাড়ির কেউ কখনও বুঝতেই চায়নি। দীপা বলল, ‘বুধুয়া, তুই রান্নাঘরে গিয়ে শুয়ে পড়।’

বুধুয়া জবাব দিল না। এবং দীপা আবিষ্কার করল তার সমস্ত খিদেবোধটা এক মুহুর্তেই উধাও হয়ে গিয়েছে। পায়ে পায়ে মনোরমার ঘরে ঢুকে সে দরজা দিল। তারপর দু’হাতে মনোরমার কাঁধ ঝরে কঁকাল, ঠাকুমা, ঠাকুমা এবার উঠে বসো।’

মনোরমা চোখ তুলে তাকালেন। তারপর শুকনো গলায় জানতে চাইলেন, কার সঙ্গে কথা বলছিলি?’ দীপা বলল, ‘বুধুয়া। রান্নাঘরের বারান্দায় বসে আছে। তুমি ওঠো। শুয়ে পড়ো। তুমি না শুলে আমি ঘুমাতে পারব না।’

মনোরমা উঠলেন, ‘আমি বাথরুম থেকে আসছি। তুই আমার বিছানা নীচে করে দে।’

‘নীচে কেন?’

‘ছেলেদুটো আজ নীচে শোবে, আমি খাটে শুতে পারব না।মনোরমা বাইরে বেরিয়ে গেলেন। আর তার কয়েক সেকেন্ড বাদে হঠাৎ একটা কান্না বাজল উঠোনে। এ নিশ্চয়ই বুধুয়া। দীপা দরজা ফাক করে দেখার চেষ্টা করল। মনোরমা দাড়িয়ে আছেন উঠোনে আর তার পায়ের ওপর মাথা রেখে বুধুয়া কেঁদে যাচ্ছে, ‘বাবু দেওতা থা, মা, বাবু হামকো তিনশো রুপিয়া দেকে বোলা বুধুয়া, আজসে তুম কিসি কো গোলাম নেহি হ্যায়, তুম ব্যাবসা করো। লেকিন হাম জিন্দেগি ভর বাবুকো গোলাম—।’

অমরনাথের মৃত্যু যেন একটি পরিবারের বিশেষ কারও চলে যাওয়া নয়, চা বাগানের সমস্ত মানুষের আত্মীয়বিয়োগ বলে ক্রমশ মনে হচ্ছিল। দু’বেলা মানুষজনঃ আসছেন। ডাক্তারবাবুর পরিবার বিশেষ করে দেখাশোনা করছেন। শ্যামলদা এবং ললিতাদি দু’বেলা খবর নিচ্ছেন। অঞ্জলি যত তাড়াতাড়ি ভেঙে পড়েছিল তত তাড়াতাড়ি সামলে উঠেছে।

পুজো এসে গেল অমরনাথের শ্রাদ্ধের আগেই। এ-বাড়িতে পুজোর আবহাওয়া নেই। এখনও পুজো হচ্ছে বাজারে। চা-বাগানের একমাত্র পুজো কালীঠাকুরের। দুই ভাই থাকা সত্ত্বেও অমরনাথের কাজের ব্যাপারে দীপাকেই সব দায়িত্ব নিতে হচ্ছে। দু’জনের সঙ্গে সম্পর্ক একটুও স্বাভাবিক হয়ান তার। কিন্তু সেটা নিয়ে মোটেই ভাবছে না সে। অঞ্জলি তার সঙ্গে ভাল ব্যবহার করছে এখন। ব্যাঙ্ক ড্রাফট পোস্ট অফিসে জমা দেওয়া হয়ে গিয়েছে অঞ্জলির নামে। সেইটে পাওয়ায় তার দুশ্চিন্তা সামান্য কমেছে।

এসব সত্ত্বেও মনোরমা কিন্তু মোটেই স্বাভাবিক হননি। ঠাকুমাকে বোঝাবার কিছু নেই। যে-মানুষ জীবনে অনেক অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে এসেছে তাকে নতুন করে উপদেশ দিতে যাওয়ার কোনও মানে হয় না। তবু এক রাত্রে দীপা তাকে বলেছিল, তুমি কেন এত চিন্তা করছ ঠাকুমা। আমার ওপর তোমার একটুও ভরসা নেই?

মনোরমা জবাব দেননি। এখন তিনি একবেলা খাচ্ছেন। প্রায় হবিষ্যান্নই বলা চলে। একা থাকলেই উদাস চোখে তাকিয়ে থাকেন। দীপা দ্বিতীয়বার কথাটা তুলতে মুখ খুলেছিলেন, ‘আমার শৈশব কেটেছিল বাবা-মায়ের কাছে, সবার যেমন কাটে। অল্প বয়সে বিয়ে হল। স্বামীকে পেলাম। তাঁর বাড়িতে গেলাম। বাবা-মায়ের হাত থেকে তিনি আমার দায়িত্ব নিলেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে নৌকাডুবি হল, পেটে তোর বাবাকে নিয়ে ফিরে এলাম আবার সেই বাবার কাছে। তারপর বাবা গেলেন। ভাই দায়িত্ব নিল আমার। ছেলে হল, মানুষ করলাম। উপযুক্ত ছেলে চাকরি পেয়ে নিয়ে এল কাছে। এবার সে নিল দায়িত্ব। জীবনে এত স্বস্তি কখনও পাইনি। তা সেই ছেলেও চলে গেল। এবার দায়িত্ব নেবে ছেলের বউ? হয়তো নেবে। কিন্তু আমি কে? আমি কি একটা মানুষ? এইভাবে একজনের পর একজনের কাধে ভর করে বেঁচে থাকাকে কি মানুষের জীবন বলে? তোর মাকে কি আমি কখনও চিনতাম? অথচ এখন তার ভরসায় আমাকে জীবন কাটাতে হবে। এই হল বিধিলিপি।’

দীপা অবাক হয়ে বৃদ্ধার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। আত্মসম্মানবোধ প্রতিটি মানুষের আছে। যারা নিজেকে উন্মোচিত করতে অক্ষম তারা সেটাকে চেপে রাখে, মুখ বুজে সয়ে যায়। কিন্তু মনের মধ্যে মাঝে মাঝেই সেই বোধটা নিশ্চয়ই ঠোকর মারে। তাঁরা হয়তো দ্বারকানাথ ঠাকুরের স্ত্রী দিগম্বরী দেবী হতে পারেন না কিন্তু জ্বালা তো সবার সমান। সে বলেছিল, ‘ঠাকুমা, আমি তো তোমাদের বংশের কেউ নই। তোমাদের রক্ত আমার শরীরে নেই। কিন্তু জ্ঞান হবার পর থেকেই আমি তোমার গায়ের গন্ধ নিয়ে প্রতিটি রাত্রে ঘুমিয়েছি। মেয়ে হিসেবে কী করা উচিত তা শিখেছি তোমার কাছ থেকে। এখন বলো তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্ক কি রক্তের সম্পর্কের চেয়ে কম দামি?’

মনোরমা দীপার হাত জড়িয়ে ধরলেন। সেই স্পর্শে অনেক কথা বলে ফেললেন তিনি।

দীপা বলল, ‘তুমি আর কয়েকটা বছর অপেক্ষা করো ঠাকুমা, আমি চাকরি পাওয়ামাত্র তোমাকে আমার কাছে নিয়ে যাব। তুমি আর আমি থাকব।’

দীপা যাই বলুক মনোরমার কোনও পরিবর্তন ঘটল না। অঞ্জলি ব্যাপারটাকে যেন লক্ষই করছিল না। এমনকী অমরনাথের কাজের ব্যাপারে সে যখন মনোরমার কাছে এসে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘আপনার যদি কিছু বলার থাকে বলুন। আমি আমাদের সাধ্যমতো সব করার চেষ্টা করছি—।’মনোরমা তখন জবাব দিয়েছিলেন, ‘তুমি যা ভাল বোকো তাই করো।’

শ্রাদ্ধের কাজে যোগ দেবার জন্যে বাবুদের বাড়িতে গিয়ে ছেলেরা বলে এসেছে। বাজার এবং অন্যান্যদের জানানো হয়েছে। দূরের আত্মীয়দের চিঠিতে সংবাদ জানানোর কাজ সারা। কলকাতায় সুভাষচন্দ্রকে অঞ্জলি নিজে চিঠি লিখেছে। সুভাষচন্দ্র টেলিগ্রামে দুঃখ প্রকাশ করে জানিয়েছেন তার শরীর এত খারাপ যে আসা সম্ভব হচ্ছে না। অঞ্জলি শ্রাদ্ধের দু’দিন আগে দীপাকে বলল, ‘তুই অফিসে। গিয়ে সাহেবকে নেমন্তন্ন করে আয়।’

‘আমি? আমি কখনও ওদিকে যাইনি।’

‘যাইনি বলে কখনও যাবি না এমন তো কথা নেই।’

‘কী বলব?’

‘আসতে বলবি। এখন ওই লোকটার ওপর সব নির্ভর করছে।’

‘তার মানে?’

বড় হয়েছিস অথচ বাস্তবান হচ্ছে না কেন? তোর বাবার চাকরি যতদিন ছিল, অফিসে না গেলেও, এই বাড়িতে থাকার হক ছিল আমাদের। এখন তো যে-কোনও মুহূর্তে বলে দিতে পারে বাড়ি ছেড়ে দাও। অবশ্য যদ্দিন সব প্রাপ্য টাকা না হাতে দিচ্ছে তদ্দিন তাড়াতে পারবে না। কিন্তু দিয়ে দিলেই তো অন্য বাবুকে ঢুকিয়ে দেবে এখানে। যদি পারিস এ ব্যাপারে কথা বলিস একবার।

‘কী কথা বলব?’

‘বড় খোকা পাশ করা পর্যন্ত যদি এখানে থাকা যায়!’ অঞ্জলি মরিয়া হয়ে বলল। দীপা কিছু বলল না।

চা বাগানের ভেতর দিয়ে মুড়ি বিছানো পথ দিয়ে অফিস এবং ফ্যাক্টরির দিকে যাওয়া নিষেধ ছিল। ছেলেবেলায়। দীপা সেই পথে ফ্যাক্টরির সামনে আসতেই মালবাবুর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। তিনি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন আসার কারণ। দীপা উদ্দেশ্যটা জানাতেই নিজে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে নিয়ে গেলেন অফিস বাড়িতে। গিয়ে বড়বাবুকে ব্যাপারটা বললেন। বড়বাবু দীপাকে নিয়ে গেলেন। বড় সাহেবের ঘরে। পরিচয় করিয়ে দেবার পর বড়সাহেব ওকে বসতে বললেন। দীপা বসল।

বড়সাহেব বললেন, এটা খুবই দুঃখের ব্যাপার। মিস্টার মুখার্জি এই চা-বাগানের অ্যাসেট ছিলেন। কোম্পানি তার চিকিৎসার জন্যে সবরকম সহযোগিতা করেছে কিন্তু শেষরক্ষা হল না। ওয়েল, নিশ্চয়ই যাব আমি। কখন যেতে হবে?’ ভদ্রলোক কথা বলছিলেন যে-ইংরেজিতে তার উচ্চারণ বুঝতে অসুবিধে হচ্ছিল না দীপার।

দীপা বলল, ‘এগারোটা নাগাদ এলে ভাল হয়।’

‘ঠিক আছে। তুমি তো কলকাতায় পড়ো? কোন কলেজে?’

‘স্কটিশ চার্চ।’

‘আচ্ছা! ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেছ?’

‘আমার থার্ড ইয়ার চলছে।’

‘গুড। ঠিক আছে, আমি যাব।’

শ্রাদ্ধের দিন যে ব্যাপারটা ঘটবে তা দীপা আন্দাজ করেনি। একগাদা মানুষের সামনে বড়সাহেব বড়বাবুকে দিয়ে অঞ্জলিকে ডেকে আনলেন। দীপা দাড়িয়ে ছিল। বড়সাহেব হিন্দিতে বললেন, ‘আপনার মেয়ের সঙ্গে কথা বলে আমার ভাল লেগেছে। ও ইংরেজি বলতে এবং বুঝতে পারে। আমাদের কোম্পানিতে এখনও মেয়েদের ক্লার্ক হিসেবে নেওয়া হয়নি। ইন ফ্যাক্ট কেউ অ্যাপ্লাই করেনি। কিন্তু মিস্টার মুখার্জির মেয়ে হিসেবে আমি ওর নাম হেডঅফিসে সুপারিশ করব যাতে এখানে ওকে চাকরি দেওয়া হয়। ওর যা কোয়ালিফিকেশন তাতে কোনও অসুবিধা হবে না। আপনার আপত্তি আছে?’

অঞ্জলি বিগলিত হল, ‘আপনার দয়া। ওর চাকরি হলে আমরা বেঁচে যাব। এই বাড়ি ছেড়ে কোথায় যাব ভেবে পাচ্ছিলাম না।’

‘না না। ও চাকরি করলে আপনাদের এখান থেকে কোথাও যেতে হবে না।’ বড়সাহেব দীপার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তুমি কালই আমাকে অ্যাপ্লিকেশন দিয়ো।’

দীপা কী বলবে বুঝে উঠছিল না। এই চা-বাগানে চাকরি করা মানে সমস্ত জীবন একটা কুয়োর মধ্যে আটকে থাকা। যে স্বপ্ন সে দেখছে তা থেকে লক্ষ মাইল ছিটকে যাওয়া। একটা কেরানির জীবন কি তার কাম্য? কখনই না। অমরনাথ বলেছেন, অনেক ওপরে উঠতে হবে, অনেক বড় হতে হবে তাকে।

বড়সাহেব জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী ভাবছ তুমি?’

‘আমার বাবা চেয়েছিলেন আমি যেন গ্র্যাজুয়েট হই।’

‘আচ্ছা! কিন্তু তুমি এখনই চাকরি করতে পারো।’

‘বাবার ইচ্ছেটাই আমার ইচ্ছে।’

‘ওয়েল, সেটা তোমার ব্যাপার। কতদিন লাগবে?

‘দু’বছর।’

‘আমি জানি না কোম্পানি এতটা দিন তোমাকে ডিস্টার্ব না করে থাকবে কিনা। দেখি, কী করতে পারি। তুমিও ভেবে দ্যাখো।’ সাহেব গম্ভীর হয়ে গিয়েছিলেন।

সেই রাত্রে তুমুল হল। অঞ্জলি যেন পাগল হয়ে গেল। প্রথমদিকে বোঝাতে চেয়েছিল ভাল কথায়, শেষে শ্লেষ এল গলায়, ‘বিদ্যেধরী হবে। গ্র্যাজুয়েট হয়ে দুটো ডানা নেড়ে ঘুরে বেড়াবে? তখন কেউ দেবে চাকরি? তোমার বাবা এই কবেই তোমাদের মানুষ করেননি? আমি কোনও কথা শুনতে চাই না।

‘আমি আগে পড়াশুনা শেষ করব। আই এ এস দেব।’

‘তাতে আমার কী হবে? আমি তো তখন পথে বসব। একটু কৃতজ্ঞতা বোধ নেই তার। জন্ম দিয়ে মা মরে গেল, বাপ দায়িত্ব নিল না, আমরাই তোকে এত বড় করেছি, আর আমাদের দুর্দিনে তুই পাশে দাঁড়াবি না?’

দীপা বলল, ‘মা, যে টাকা পোস্ট অফিসে আছে, যা কোম্পানি থেকে পাবে তাতে তোমরা তিন-চার বছর বাড়ি ভাড়া করে ভালভাবে থাকতে পারবে। তদ্দিনে আমার চাকরি হয়ে যাবেই। আমাকে এই বদ্ধ জায়গায় সারাজীবন কাটাতে হবে না। তখন তোমরা আমার কাছে থাকতে পারবে।’

‘বাঃ। সেইসময় যদি তোমার মতিগতি পালটে যায় তা হলে জমানো টাকা শেষ করে কোথায় দাঁড়াব আমরা?’

‘মতিগতি তো এখানে থাকলেও পালটাতে পারে।’

‘না। এখানে তোমাকে মন্ত্রণা দেবার কেউ নেই।’ অঞ্জলি বলল, ‘এখানকার সবাই জানবে তুমি বাবার জন্যে চাকরি পেয়েছ।’

দীপা কোনও জবাব দিল না। চা-বাগানের এই জীবন অমরনাথদের কি পছন্দ ছিল! কোনও উচ্চাশা নেই, শুধু দিনগত পাপক্ষয় করে যাওয়া! অসম্ভব। সে মরে গেলেও এখানে থাকতে পারবে না। তাকে অনেক বড় হতে হবে। এই পুরুষশাসিত সমাজব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। কিন্তু সে কি অকৃতজ্ঞ হচ্ছে? না। কখনওই নয়। অঞ্জলির ব্যবহার যাই হোক সে কখনওই কর্তব্য থেকে সরে যাবে না।

অঞ্জলি জিজ্ঞাসা করল, ‘চুপ করে কী ভাবছ?’

‘বড়সাহেবের কাছে তো আমি সময় চেয়েছি।’

‘সময় যদি না দেয়?’

‘তখন দেখা যাবে।’

‘এটা তো পাশ কাটানো কথা। তোর ব্যাপার কী বল তো?’

‘কী ব্যাপারে?’

‘কলকাতার কোনও ছেলে কি তোর মাথা ঘুরিয়েছে?’

‘কী যা-তা বলছ?’

‘ঠিকই বলছি। তোর মামা একবার লিখেছিল এমন কথা। শোনো দীপা, যে-ছেলের সঙ্গে তুমি ঘুরে বেড়াও সে মজা লোটা ছাড়া কিছু করবে না। যদি কুমারী হতে তা হলে হয়তো বিয়েথা করত। চারধারে যখন এত কুমারী মেয়ে ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়াচ্ছে তখন সাধ করে কেউ বিধবাকে বিয়ে করে? ওসব মতলব ছেড়ে দে।’

‘তুমি মিছিমিছি ভয় পাচ্ছ মা। আমি যাই করি কখনও অকৃতজ্ঞ হব না।’

এই সরল স্বীকারোক্তিতে আস্থা পেল না অঞ্জলি। সমানে সে আক্রমণ চালিয়ে গেল ক’দিন ধরে। শেষপর্যন্ত ঘোষণা করল, ‘ঠিক আছে, যদি দুই-আড়াই বছর সাহেব অপেক্ষা না করে, যদি আমাদের। এই বাড়ি ছেড়ে যেতে বাধ্য করে, তা হলে যেন এ-জীবনে তোর মুখ আমাকে দেখতে না হয়। আমি লোকের বাড়িতে বাসন মেজে খাব তাও ভাল তবু তোর পয়সায় মুখে ভাত তুলব না।’

‘তুমি কি আমাকে এখনই চলে যেতে বলছ?’

‘তোকে আমি আর সহ্য করতে পারছি না।’

‘বেশ, আমি চলে যাচ্ছি।’

‘তাই তো যাবি। নিজের আখের গুছিয়ে চলে যাবি না?’

আর তখন বড় ছেলে বলল, ‘মা, তুমি কেন এত খোশামোদ করছ। দু’বছর পরে আমি স্কুল ফাইন্যাল পাশ করে যাব। তখন সাহেবকে বলব আমাকে চাকরি দিতে।’

এই বিতর্কে মনোরমা অংশ নিলেন না। তিনি যেন এসব ব্যাপারের অনেক ঊর্ধ্বে চলে গিয়েছেন। যেদিন দীপা কলকাতায় যাবে তার আগের রাত্রে তিনি কথা বললেন, দীপা, তোর মনে আছে, অনেকদিন আগে তেজেনবাবু আমাকে নিয়ে হরিদ্বার যেতে চেয়েছিলেন। তোর বাবা অভিমান করেছিল, আমি যেতে চাইনি!

‘মনে আছে। খুব মজা হয়েছিল।’ দীপা বলল।

‘এখন মনে হয় তখন গেলে পারতাম।’

‘কেন?’

‘যদি সেই মানুষটার দেখা পেতাম তা হলে বলতাম আমার এত বড় সর্বনাশ কেন করল?’

‘কে?’

‘যে একটা রাত্রে এসেছিল দায় মেটাতে!’

‘ঠাকুমা!’

‘হ্যাঁ রে। যে সন্ন্যাসী সে তো সংসারের কাছে মৃত। আমার কাছেও। আমার বৈধব্য তাই সত্যি। কিন্তু সেই মানুষটা তো বেশ বেঁচে আছে।’

‘তুমি তো কখনও সেটা স্বীকার করোনি।’

‘স্বীকার করলে তোর বাবা খুব কষ্ট পেত।’

ঠাকুমা, তুমি আমার সঙ্গে হরিদ্বারে যাবে?’

‘কেন?’

‘ওঁকে খুঁজতে।’

‘হিমালয় তো এটুখানি জায়গা নয়। এত বড় একটা পর্বতে কাউকে খুঁজতে যাওয়া বোকামি।’ মনোরমা নিশ্বাস ফেললেন। তারপর দু’হাতে দীপাকে জড়িয়ে ধরে পাশ ফিরে বললেন, ‘মাগো, জীবন হিমালয়ের চেয়ে অনেক বড়। সেখান থেকে যেটা খুঁজে নিতে চাইবি সেটা খুঁজবি আন্তরিকভাবে। কারও সঙ্গে আপোষ করবি না। আমার বয়সে কিছু খোঁজা যায় না, খুঁজে পাওয়া যায় না, কিন্তু তোর বয়সটা ঠিকঠাক খোঁজার বয়স।’

সকল অধ্যায়

১. ১. আজ সারাটা দিন সূর্যদেব উঠলেন না
২. ২. মেয়েরা কি ভূত হয়
৩. ৩. ভালো-মন্দ বোঝার বয়স
৪. ৪. রমলা সেন
৫. ৫. সত্যসাধন মাস্টার
৬. ৬. বৃষ্টিটা চলে যাওয়ার পরে
৭. ৭. চারদিন পৃথিবীটাকে দ্যাখেনি দীপা
৮. ৮. দীপাবলীর বিয়ে
৯. ৯. বাসর এবং বউভাত
১০. ১০. দীপাবলীর ফুলশয্যা
১১. ১১. পুত্ৰটি দেহ রেখেছে
১২. ১২. রমলার চিঠি
১৩. ১৩. প্ৰাপ্তবয়স্কতা শরীরের না মনের
১৪. ১৪. চাবাগানের আশেপাশে
১৫. ১৫. আসাম রোড
১৬. ১৬. একটি মানুষের চেহারা
১৭. ১৭. জলপাইগুড়ি শহরে
১৮. ১৯. রমলা সেনের কাছে
১৯. ১৮. পুলিশের লাঠিচার্জ
২০. ২০. জলপাইগুড়ির হোস্টেলের মেয়ে
২১. ২১. দুশ্চিন্তার ছাপ
২২. ২২. একতারা বাজিয়ে গান
২৩. ২৩. দুর্দান্ত ব্যবসাদার প্রতুল বন্দ্যোপাধ্যায়
২৪. ২৪. সত্যসাধন মাস্টার এসে পড়বেন
২৫. ২৫. অমরনাথ হতভম্ব
২৬. ২৬. তিনদিন ধরে সমানে বৃষ্টি
২৭. ২৭. অমরনাথের শরীর
২৮. ২৮. কলকাতা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে
২৯. ২৯. প্রৌঢ় ভদ্রলোকটি হাঁটছিলেন
৩০. ৩০. এক অদ্ভূত অভিজ্ঞতা
৩১. ৩১. বাড়িটা শুধু পুরনো নয়
৩২. ৩২. উত্তর কলকাতার পথে পথে
৩৩. ৩৩. কলেজ এবং হোস্টেলের বাইরে
৩৪. ৩৪. দীপা অঞ্জলির দিকে তাকাল
৩৫. ৩৫. অমরনাথ শুয়ে আছেন
৩৬. ৩৬. ভবিষ্যৎ সম্পর্কে প্ৰচণ্ড অসহায়তাবোধ
৩৭. ৩৭. তিনতলার ব্যালকনি
৩৮. ৩৮. দীপা চুপ করে আছে
৩৯. ৩৯. সুভাষচন্দ্র এগিয়ে এলেন
৪০. ৪০. মেয়েটির নাম লাবণ্য
৪১. ৪১. বিছানায় টান টান দীপা
৪২. ৪২. কলেজের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে
৪৩. ৪৩. কিছু মানুষ খুন হলেন
৪৪. ৪৪. কেমন একটা সংসার-সংসার ভাব
৪৫. ৪৫. রাধা চলে এল সেজেগুজে
৪৬. ৪৬. দ্বিতীয় অভিনয় হয়ে যাওয়ার পরে
৪৭. ৪৭. কলোনি থেকে কলেজ পাড়ায়
৪৮. ৪৮. স্কটিশ চার্চ কলেজে জানাজানি হয়ে গেল
৪৯. ৪৯. একদম লেডি
৫০. ৫০. রমলা সেন চোখ ছোট করলেন
৫১. ৫১. সাতকাহন প্ৰথম পর্ব সমাপ্ত

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন