সমরেশ মজুমদার
প্রথম দিন জল পর্যন্ত ছুঁয়ে দ্যাখেনি মেয়ে খাবার তো দূরের কথা। কেঁদেকেটে গলা ভেঙেছে। তখন বাড়িতে ঢুকলে মনে হত সদ্য কারও বিয়োগ ঘটেছে। এখন চুপচাপ। বলা যায় বেশি রকমের চুপচাপ। একমাত্র প্রাকৃতিক প্রয়োজন ছাড়া মনোরমার ঘর ছেড়ে বেরুচ্ছে না সে। খুদে দুটো কথা বলতে চেষ্টা করে ফিরে এসেছে। স্কুল তো একদম বন্ধ। এমনকী অঞ্জলিরও মনে হচ্ছিল হয়তো ব্যাপারটা বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। সাততাড়াতাড়ি বিয়ে না দিলেই চলত। মনোরমা বলেছেন, ‘একটু বাদলা হয়েছে বলে কি রোদ উঠবে না? ওসবে নজর দিয়ো না। মেয়েছেলের গতি স্বামীর ঘরে না গেলে হয় না। বাড়ি ঘরদোর ভাল, অবস্থাপন্ন, ছেলেটিও মিষ্টি চেহারার, বিয়ের সাতদিন পরে দেখবে এসব ওর মনেই থাকবে না।’
অমরনাথ কিন্তু বাড়িতে ফিরেই গোঁজ হয়ে থাকেন। পাঁচজনে তাঁকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলতে ছাড়ছে না যে তিনি দায় নামাচ্ছেন কাঁধ থেকে। এমনকী সত্যসাধনবাবু খবরটা শুনে কিছুক্ষণ গম্ভীর হয়ে বসে রইলেন। ওঁর মুখের দিকে তাকিয়ে অমরনাথের নিজেরই খুব খারাপ লাগছিল। জবাবদিহি দেবার ভঙ্গিতে বলেছিলেন, ‘হঠাৎই সম্বন্ধটা এসে গেল। ওরা খুব চাইছে— ।’
সত্যসাধনবাবু বললেন, ‘অন্যায়, ঘোরতর অন্যায়। সেই কবে বিদ্যাসাগর মশায় আন্দোলন করেছিলেন বাল্যবিবাহ বন্ধ যাতে হয় তার লাইগ্যা। কী লাভ হইল! আপনার মতো শিক্ষিত মানুষ যদি না বোঝেন—, ঘোরতর অন্যায়। আমার দুঃখ কী জানেন, এখানে ভাল ছাত্রছাত্রী পাই না, এই মেয়েটার মধ্যে পসিবিলিটি ছিল, আপনারা সেইডা শ্যাষ কইর্যা দিলেন। এখনও তো সে চঞ্চল, বুদ্ধিসুদ্ধি পোলাপানের মতো— ।’
অমরনাথ বললেন, ‘না না, যা ভাবছেন তা নয়। ওর পড়াশুনা বন্ধ হবে না। প্রতুলবাবু, মানে ছেলের বাবা, আমাকে কথা দিয়েছেন যে ওকে পড়ার সুযোগ করে দেবেন।’
‘দ্যাখেন!’ নিশ্বাস ফেললেন সত্যসাধন।
‘আপনার একমাসের মাইনেটা—।’
‘না না না। মাস তো পূর্ণ হয় নাই। টাকা আমার লাগব না। শুধু একবার দীপারে একটু দেইখতে পাইলে খুশি হইতাম।’
অমরনাথ উঠে ভেতরে এলেন। অঞ্জলি আড়ালে দাঁড়িয়ে সব শুনছিল। মুখোমুখি হতেই অমরনাথ বললেন, ‘দীপাকে একবার বাইরের ঘরে আসতে বলো।’
‘ও আসবে না। মাস্টারমশাই এসেছেন শুনে আমি ওকে ডেকেছিলাম— ।’
‘ভাল করে বুঝিয়ে বলো। উনি দেখতে চাইছেন।’
‘না শুনলে আমি কি টেনে আনব। আমি জানতাম লোকে আমাদের দোষ দেবে।’
অঞ্জলি চলে যেতেই অমরনাথ ফিরে এলেন বাইরের ঘরে। একটু বিব্রত গলায় বললেন, ‘মাস্টারমশাই, মেয়েটা খুব অভিমানী। হয়তো আপনার সামনে এখন আসতে লজ্জাও পাচ্ছে। পরে একসময়— । অবশ্য বিয়ের দিন তো আপনি আসছেনই!’
‘না না, আমারে আপনি নিমন্ত্রণ কইরেন না। আমি এই বিয়ায় আইতে পারুম না। সে যখন আইতে চায় না আমিই যাই চলেন। যাওয়ার আগে দেখা হইব না এ কেমন কথা।’
সত্যসাধনবাবু উঠে দাঁড়ালেন। অগত্যা অমরনাথ তাঁকে পথ দেখিয়ে ভেতরে নিয়ে এলেন। এখন লোকটার ওপর রাগ হচ্ছিল তাঁর। ব্যাপারটা নিয়ে যেন বাড়াবাড়ি করছেন খামোকা। মনোরমার দরজার সামনে এসে তিনি বললেন, ‘ওই ঘরটি আমার মায়ের। ওখানেই আছে সে।’
ঘরের দরজা আধা ভেজানো। সত্যসাধন সেখানে দাঁড়িয়ে ডাকলেন, ‘দীপা, ও দীপা মা!’
ভেতর থেকে কোনও সাড়া এল না। সত্যসাধন মুখ ঘুরিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনার মা ঘরে নাই তো?’
বারান্দা থেকে মনোয়ার গলা ভেসে এল, ‘না। ও একাই আছে।’
সত্যসাধন চাপ দিতেই দরজাটা খুলে গেল। তিনি এক পা ভেতরে গিয়ে বললেন, ‘কেমন আছ মা? শুনলাম তুমি আমাদের ছাইড়্যা জলপাইগুড়ি যাইবা। আর তো দেখা হইব না। তাই কই, সুযোগ পাইলে মন দিয়া পড়াশুনা করবা!’
কথা শেষ হওয়ামাত্র তিরের মতো ছুটে এল দীপা খাট ছেড়ে। দু’হাতে সত্যসাধনকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কেঁদে উঠল।
অমবনাথ দৃশ্যটি দেখলেন। তাঁর বুক টনটন করতে লাগল। এই কান্নাটা দীপা যদি তাঁকে জড়িয়ে ধরে কাঁদত তা হলে কী করতেন তিনি জানেন না। কিন্তু এখন সত্যসাধনবাবুকে তিনি ঈর্ষা করতে লাগলেন।
চিৎকার করতে করতে দীপা বলছিল, ‘ও মাস্টারমশাই, আমি পড়ব, আমি বিয়ে করব না, আপনি বাবাকে বলুন, আমি সমস্ত কথা শুনব, দেখবেন ঠিক ফার্স্ট ডিভিশন পাব, ও মাস্টারমশাই।’ চোখের জলে দীপার সমস্ত মুখ সপসপে।
সত্যসাধনকে খুব অসহায় দেখাল। তাঁর লংক্লথের পাঞ্জাবি ভিজে গেছে চোখের জলে। তিনি কথা বলতে চাইলেন। গলার স্বর রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছিল, ‘আমি কে মা? আমি তো কেউ না। আমি শুধু তোমারে কই পড়াশুনা ছাড়বা না। যে যাই বলুক এইটা মনে রাখবা।’
কোনওমতে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে সত্যসাধনবাবু হনহন করে বেরিয়ে গেলেন। অমরনাথ তাঁর পেছন পেছন এসেও ধরতে পারলেন না। মানুষটিকে যেন ভূতে তাড়া করেছে এমনভাবে মাঠের ভেতর দিয়ে চলে যাচ্ছেন।
মন খারাপ হয়ে গেল অমরনাথের। আজ শ্যামল পর্যন্ত তাঁকে বলেছে, ‘কাকাবাবু, বাবা সম্বন্ধ এনেছেন ঠিক কিন্তু আপনি রাজি না হলেই পারতেন। দীপা তো নেহাতই বাচ্চা।’
‘তোমার বাবা যদি সম্বন্ধ না আনতেন তা হলে কথাই উঠত না শ্যামল।’
‘তা ঠিক। আজ বড়সাহেব আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। বলেছেন ছয় মাসের জন্যে তিনি আমাকে অ্যাপ্রেন্টিসশিপ দেবেন। সেইসময় বড়বাবু সেখানে ছিলেন। হঠাৎ আপনার কথা উঠল। দীপার ব্যাপারটা দেখলাম সাহেব শুনেছেন। উনিও খুব বিরক্ত দেখলাম।’ শ্যামল আগ বাড়িয়ে এসব কথা বলে গেল। আজ অবশ্য বড় সাহেবের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়নি। যদিও কারও ব্যক্তিগত ব্যাপারে বড় সাহেবের কিছু বলার অধিকার নেই, কিন্তু তিনি কথা তুললে তাঁর ভাল লাগবে না। বাইরের ঘরে বসে তিনি অঞ্জলিকে ডাকলেন, ‘মাকে নিয়ে এ-ঘরে এসো। একটু কথা বলব।’
অঞ্জলি অবাক হল, ‘কী ব্যাপার?’
‘যা বলছি তাই করো।’ গম্ভীর গলায় বললেন অমরনাথ।
মনোরমা এলেন। বাইরের দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছিলেন অমরনাথ। মনোরমা বসলে তিনি বললেন, ‘মা, ব্যাপারটা এমন হয়ে যাচ্ছে যেন আমরা খুব খারাপ লোক। ঘাড় থেকে বোঝা নামাতে চাই।’
মনোরমা বললেন, ‘এ-কথা মনে হচ্ছে কেন?’
‘পাঁচজনে তাই বলছে। আর আমারও খুব ভাল লাগছে না।’ অমরনাথ মুখ নামালেন।
মনোরমা অঞ্জলির দিকে তাকালেন। সে দরজায় ঠেস দাঁড়িয়ে ছিল। ‘তোমার?’
অঞ্জলি জবাব দিল না। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মনোরমা বললেন, ‘তা হলে বিয়ে ভেঙে দাও।’
কেউ কোনও কথা বলল না। অমরনাথ শেষপর্যন্ত বললেন, ‘মুশকিল হল প্রতুলবাবু বিয়ের দিন পর্যন্ত ঠিক করেছেন। এই অবস্থায় বিয়ে ভেঙে দিতে একটা যুক্তি দেখাতে হবে।’
মনোরমা হঠাৎ উষ্ণ গলায় বললেন, ‘তোমাদের আক্কেল দেখে মাথা গরম হয়ে যায়। তোমার বিপদে তো কেউ ঝাঁপিয়ে পড়বে না। এখন যারা ফুট কাটছে তারা কেউ পরে তোমার মেয়ের বিয়ে দিতে আসবে না। কে কী বলছে তাতে তোমাদের কী, মেয়েটার খারাপ হবে এমন কাজ তো তোমরা করছ না।’
‘সবাই বলছে এই বয়সে বিয়ে দিলে ভাল হয় না।’
‘কীসের ভাল? ধিঙ্গি করে কোনওমতে একটা পাত্র জুটিয়ে বিয়ে দেওয়ার পর মেয়ে যে সেখানে শান্তিতে সংসার করতে পারবে এমন কথা জোর গলায় কেউ বলতে পারে? জন্ম মৃত্যু বিবাহ নিয়ে কোনও ভবিষ্যৎবাণী উচ্চারণ করা যায় না অমর। ওর কপালে যেখানে লেখা আছে সেখানেই বিয়ে হবে। মেয়েটা কান্নাকাটি করছে, আরে বাবা কোন মেয়ে শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার আগে পা ছড়িয়ে কাঁদে না?’ মনোরমার গলায় বিরক্তি স্পষ্ট।
অঞ্জলি বলল, ‘মা ঠিকই বলেছেন। কে কী বলছে তা নিয়ে ভেবে কিছু লাভ নেই। তবে আমরা একটা কাজ করতে পারি। তুমি আর একবার প্রতুলবাবুর কাছে যাও। গিয়ে বলো, কথাবার্তা সব পাকা হয়ে রইল, ইচ্ছে করলে তিনি মেয়েকে আশীর্বাদও করে রাখতে পারেন। এর মধ্যে ও একটু বড় হোক, মানে স্কুল ফাইন্যালটা পাশ করে নিক, তারপর অনুষ্ঠান করা যাবে। এর জন্য তো আর এক যুগ অপেক্ষা করতে হবে না।’
মনোরমা বললেন, ‘তা যদি ওঁরা অপেক্ষা করতে পারেন ভাল কথা। তবে বাপু আমার একটা ব্যাপারে কেমন খটকা লাগছে। লোকে গাই গোরু পর্যন্ত যাচাই করে কেনে, ওঁরা এসে একবার মেয়ের মুখও দেখলেন না। খোঁড়া বোবা তো হতে পারত।’
অমরনাথ বললেন, ‘প্রতুলবাবু লোক পাঠিয়ে দীপাকে দেখেছেন।’
‘নিজের চোখে তো দ্যাখেননি। তোর ছেলের বিয়ের সময় এমন করবি?’
‘বড়লোকদের ব্যাপার আমি ঠিক বুঝি না।’
‘ওইখানেই ভয়। আজ মত হয়েছে, মিষ্টি কথা কয়েছে, দু’-তিন বছর অপেক্ষার পর দেখলে বেমত হয়ে গেল। তখন তাঁরা সরে দাঁড়ালে মেয়ের নামে দুর্নাম ছড়াবে। একবার বাগদত্তা মেয়ের অন্য কোথাও বিয়ে হওয়া মুশকিল। যা ভাল বোঝো করো।’
মুখোমুখি কথা না বলে লোক মারফত চিঠি পাঠালেন অমরনাথ। সবিনয়ে সমস্ত ব্যাপারটা জানিয়ে প্রস্তাব রেখেছিলেন কয়েক বছর অপেক্ষা করার। পত্রবাহককে বসিয়ে তৎক্ষণাৎ উত্তর লিখেছিলেন প্রতুলবাবু। অমরনাথের অসুবিধে তিনি বুঝতে পারছেন। কিন্তু সেই কারণে তাঁর নিজের ভাবনার পরিবর্তন করার কোনও কারণ তিনি দেখছেন না। এই অবস্থায় যদি অমরনাথ অপারগ হন তা হলে তিনি দুঃখিত হবেন কিন্তু সিদ্ধান্ত বদল করবেন না। পুত্রের বিবাহ তিনি এখনই অন্যত্র দিতে দ্বিধা করবেন না।
তার পরের দিনই ফ্যাক্টরিতে হরিদাসবাবু তাঁর সঙ্গে দেখা করলেন। হরিদাসবাবুর বেয়াই জলপাইগুড়ি থেকে আজ সকালে লোক পাঠিয়েছিলেন। হরিদাসবাবু বললেন, ‘এ কী শুনছি অমরনাথ? লোকে কী বলছে তাই বড় হল আর মেয়েটার ভবিষ্যৎ দেখলে না। ও-বাড়িতে বিয়ে হলে রাজরানি হয়ে থাকবে সে। কী বিশাল বাড়ি। পাঁচিল পেরিয়ে ঢুকতেই ভয় হয়। একমাত্র ছেলে, যা কিছু বিষয় সম্পত্তি সবই তো তোমার মেয়ে পাবে।’
প্রতুলবাবুর উত্তর পাওয়ার পর মুষড়ে গিয়েছিলেন অমরনাথ। তিনি মাথা চুলকাতে লাগলেন।
হরিদাসবাবু বললেন, ‘আর পাঁচ-ছয় বছর পরে কেউ এ নিয়ে কথা তুলবে? আজ যারা বলছে তাদের হিংসেতে বুক ফেটে যাচ্ছে বলেই বলছে। তুমি সম্মতি দাও।’
অমরনাথ বললেন, ‘বেশ, আপনি আমার হয়ে যোগাযোগ করুন। আমার আপত্তি নেই। তবে ওঁরা এসে মেয়েকে দেখে যান আগে। বিয়েটা ঠিক বিয়ের মতো হোক।’
অস্টিন গাড়িতে চেপে প্রতুলবাবু এলেন একা। তাঁকে বাইরের ঘরে সমাদর করে বসানো হল। হরিদাসবাবুও ছিলেন। প্রতুলবাবু বললেন, ‘এ-ঘরের জিনিস ও-ঘরে যাচ্ছে। তাই নিয়ে এত চিন্তা করার কী আছে? তা ছাড়া হিল্লি দিল্লির ব্যাপার নয়, এখান থেকে ওখানে।’
অমরনাথ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনার স্ত্রীকে নিয়ে এলেন না?’
‘নাঃ। এতদিন ঘর করছি, আমার রুচির ওপর যদি তাঁর আস্থা না থাকে তা হলে আর অর্ধাঙ্গিনী হবেন কী করে! আমিও দেখতে চাইতাম না, আপনি জোর করলেন, তাই। নিয়ে আসুন মেয়েকে। চটপট সেরে নিই।’
‘একটু বিশ্রাম করুন। খাওয়াদাওয়া হোক, তারপর— ।’
‘না মশাই। খাওয়াদাওয়া চলবে না। আপনারা আমার বাড়িতে গিয়ে কিছু খাননি। মিষ্টিমুখ করা খাওয়া নয়। আমিও তাই আজ ওই একই ব্যবহার করব। আমার মিষ্টি খাওয়া বারণ কিন্তু একটি খাব।’
অমরনাথ বিষণ্ণ হলেন। তিনি বুঝলেন প্রতুলবাবুকে পীড়াপীড়ি করে কোনও লাভ হবে না। অতএব ঘর ছেড়ে ভেতরে এলেন। অঞ্জলি আর মনোরমা চুপচাপ খাটে বসে ছিলেন। সব কথাই তাঁদের কানে আসছে। অমরনাথ বললেন, ‘ওকে নিয়ে এসো।’
অঞ্জলি বলল, ‘জোর করে সাজিয়ে দিয়েছি কিন্তু উঠতে চাইছে না।’
অমরনাথ বড় বড় পা ফেলে মনোরমার ঘরের দরজায় এলেন। দরজা খোলা। অমরনাথ গম্ভীর গলায় ডাকলেন, ‘দীপা, এদিকে এসো।’
কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করলেন তিনি। তারপর দরজায় পৌঁছে গলা তুললেন, ‘কথা কানে যাচ্ছে?’
মনোরমার খাটে হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে ছিল সে, এবার চোখ না তুলেই ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল।
দরজা থেকে সামান্য সরে দাঁড়িয়ে অমরনাথ বললেন, ‘উনি যা যা জিজ্ঞাসা করবেন ভালভাবে জবাব দেবে। ভয়ের কিছু নেই। মুখ বন্ধ করে যেন থেকো না।’
মেয়ে সামনে হাঁটছে, অমরনাথ পেছনে। শোওয়ার ঘরে পৌঁছে অমরনাথ বললেন, ‘তোমরা কেউ সঙ্গে এসো।’
অঞ্জলির যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না। এর মধ্যেই চুল নষ্ট করেছে মেয়ে। সে দ্রুত ঠিক করে দিচ্ছিল।
মনোরমা বললেন, ‘তুমিই যাও বউমা।’
অমরনাথ ফিরে এলেন বাইরের ঘরে। প্রতুলবাবু কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, দরজায় অঞ্জলিকে দেখে চুপ করে গেলেন।
হরিদাসবাবু বললেন, ‘এসো বউমা। কোথায় সে? এসো, সামনে এসো।’
মাটিতে চোখ রেখে দীপা সামনে এসে দাঁড়াল।
প্রতুলবাবু প্রায় সেকেন্ড বিশেক চুপচাপ দেখে গেলেন। তারপর গলার স্বর নরম করার চেষ্টা করলেন, ‘নাম কী তোমার?’
দীপার নিজের ঠোঁট দাঁতে ঘষা খেল। অঞ্জলি চাপা গলায় বলল, ‘নাম বল।’
‘দীপাবলী।’
‘বাঃ সুন্দর নাম। দীপাবলী মানে তো দেওয়ালি! বাঃ বাঃ। একটু সামনে এসো তো!’
অঞ্জলি মেয়েকে আলতো করে ঠেলে দিতেই সে কয়েক পা চলে এল।
প্রতুলবাবু বললেন, ‘এবার একটু ঘুরে দাঁড়াও।’
দীপা পিছন ফিরল।
প্রতুলবাবু বললেন, ‘বেশ বেশ। শাড়ি পরেনি কেন?’
অঞ্জলি বলল, ‘এতদিন তো শাড়ি ধরেনি। আজ চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু পরতে চাইল না?’
‘না না। আমার স্ত্রীর আবার ইচ্ছে সবসময় শাড়ি পরিয়ে রাখবে, আজ পরেনি তা একপক্ষে ভালই হয়েছে। তা কী পড়ো তুমি?’
‘এইটে উঠব।’ খরখরে গলায় জবাব দিল দীপা।
‘হুঁ! রান্নাবান্না জানো? জানো না? ওটা যে শিখতে হবে মা। বাঙালির ঘরে তো আর মেমসাহেবের দরকার নেই, রান্না করে সবাইকে খাইয়ে তবে তোমাদের আরাম। অবশ্য আমার বাড়ি-ভরতি ঠাকুর চাকর, তবু ওটা শিখে নিতে হবে চটপট। চুল কেমন?’
অঞ্জলি চটপট দীপার মাথার চুল খুলে দিল। কোমরের কাছাকাছি তার প্রান্ত পৌঁছোল। অঞ্জলি বলল, ‘নিজে সামলাতে পারে না বলে প্রতি মাসে কেটে দিই।’
‘গোছ তো খুব মোটা নয়। যাই বলুন, মেয়েমানুষের মাথায় চুল না থাকলে শরীর উর্বরা হয় না। কথাটা খারাপ লাগল হয়তো কিন্তু আমার ঠাকুমা তাই বলতেন। যাও, ভেতরে যাও। আজ থেকে আর চুল ছেঁটো না।’
প্রতুলবাবুর কথা শেষ হওয়ামাত্র দীপা দ্রুত ভেতরে চলে গেল। অঞ্জলির মুখে রক্ত জমেছিল। সে আর দাঁড়াল না। ভেতরে ঢুকে মনোরমার মুখোমুখি হয়ে বলল, ‘শুনলেন?’
মনোরমা মাথা নাড়লেন, ‘মনে হচ্ছে মুখ খুব আলগা।’
হঠাৎ দীপা দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘উর্বরা তো মাটি হয়। শরীর উর্বরা মানে কী?’
অঞ্জলি দ্রুত তার কাছে গিয়ে চাপা গলায় বলল, ‘সব কথার মানে থাকে না। মায়ের ঘরে যা তুই।’
‘যে-কথার মানে থাকে না সে কথা বলে কেন?’ দীপা আর দাঁড়াল না।
বাইরের ঘরে তখন অমরনাথ জিজ্ঞাসা করছেন, ‘কেমন দেখলেন— মানে— ।’
‘ঠিক আছে। আর একটু ফরসা হলে, বংশধরদের কথা ভেবেই বলছি। যাক, কী আর করা যাবে। বিয়ের জল গায়ে পড়লে শুনেছি রং ফরসা হয়। না মশাই, আপনাদের মেয়েকে আমার অপছন্দ হয়নি। বিয়ের দিনটা পাকাই রইল। এ-বাড়ি থেকেই বিয়ে দেবেন?’
প্রতুলবাবু সিগারেট ধরালেন। হরিদাসবাবু হাসিমুখে বললেন, ‘জলপাইগুড়িতে গিয়ে বাড়ি ভাড়া নিয়ে দেওয়া যায় অবশ্য, যেমন আমি দিয়েছিলাম— ।’
‘না না, এখান থেকেই দিন। শহরে সবাই আমাকে চেনে। চোখের ওপর দেখবে কী রকম ব্যবস্থায় বিয়ে হচ্ছে। মানুষের মুখ তো জানেন, নিন্দে করতে পেলে আর কিছু চায় না। আপনি এখানে আপনার মতো ব্যবস্থা করুন। বরযাত্রী তো বেশি হবে না। তারা কেউ অভদ্র ব্যবহার করবে না। আর একটা কথা, আমার স্ত্রী এটা বলতে বলেছেন, পঁচিশটা নমস্কারি শাড়ি আপনাকে দিতে হবে। এদের মধ্যে আটজন বিধবা। এদের জন্যে অবশ্য শাড়ি নয়, থানই দিতে হবে। তবে সবগুলোই একটু উচ্চমানের হওয়া উচিত। তা আমিই কিনে সবাইকে পাঠিয়ে দেব না আপনি ব্যবস্থা করবেন?
অমরনাথ বললেন, ‘সেকী! নমস্কারি শাড়ি থান আপনি কিনবেন কেন? আমিই ব্যবস্থা করব। এ নিয়ে আপনি চিন্তা করবেন না।’
‘ভাল কথা। তা হলে আজ আমি উঠি।’ প্রতুলবাবু সিগারেট নেবালেন অ্যাশট্রেতে।
হরিদাসবাবু বললেন, ‘আরে উঠব বললে চলে! একটা মিষ্টি খাওয়ার কথা ছিল!’
প্রতুলবাবু বললেন, ‘বেশ, আনুন মিষ্টি।’
কথা শেষ হবার আগেই অঞ্জলি দুটো প্লেট ভরতি মিষ্টি নিয়ে ঢুকল। প্রতুলবাবু একটি তুলে নিয়ে বললেন, ‘আপনারা ভাল বুঝবেন, কিন্তু এই বিয়ে নিয়ে কোনও সমস্যা হবে না তো? আমি কী বলতে চাইছি বুঝতে পারছেন?’
‘সমস্যা?’ অমরনাথ জিজ্ঞাসা করলেন।
‘আপনার ভগ্নিপতি পুনর্বিবাহ করেছেন। আপনাদের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ নেই। এসব আমি যাচাই করে নিয়েছি। কিন্তু সেই ভদ্রলোকের অনুমতি নেওয়া দরকার কি?
জবাবটা অঞ্জলি দিল, ‘আমার বোন মারা যাওয়ার পর জামাইবাবু দায়িত্ব নিতে চাননি। সেই কথা তিনি চিঠিতে জানিয়ে দিয়েছিলেন। চিঠিটা চাইলে আপনি দেখতে পারেন। ওঁরও উপাধি ছিল মুখোপাধ্যায়। উনি লিখেছিলেন কোনওদিন পিতৃত্বের দাবি নিয়ে সামনে আসবেন না। সেই একমাসের বাচ্চাকে বুকে করে মানুষ করেছি। আমরাই ওর বাবা মা। পেটে না ধরলেও যে মা হওয়া যায় তা আমিই বুঝেছি। আপনি নিশ্চিত থাকুন এ নিয়ে ভবিষ্যতে কোনও সমস্যা হবে না।’
বিয়ের দিন দুপুরে দুর্ঘটনাটা ঘটল। ব্যাপারটা এমন আচমকা যে মন খারাপ হয়ে গেল অমরনাথের। এই চা-বাগানের প্রতিটি মানুষ পরস্পরের সঙ্গে একটা ভাল সম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করে যতই ভেতরে ভেতরে মন কষাকষি হোক। মন খারাপ সেইজন্যে। শুভকাজের আগে বিঘ্নটা ঘটল। বাড়ি সাজানো হয়ে গিয়েছে। ভেতরের উঠোনে ম্যারাপ বাঁধা হয়েছে। ছাদনাতলার ব্যবস্থা সেখানেই। বাড়ির বাইরে মাঠে প্যান্ডেল খাটিয়ে খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা। ভোরের আগেই ভিয়েন বসে গেছে। ঠান্ডা জমেছে খুব। নিমন্ত্রিতরা তাড়াতাড়ি চলে যাবেন। চা-বাগানের কেউ বাদ নেই, বাজারের অনেকেই আছেন, আশেপাশের যেসব চা-বাগানে অমরনাথ খেলতে যান তাদের অনেকেই নিমন্ত্রিত। সাহেবের কাছ থেকে ডায়নামো চেয়ে এনেছেন আজকের রাতটার জন্যে। সকালে জলপাইগুড়ি থেকে গায়ে হলুদের তত্ত্ব এসেছে। চা-বাগানের সব কোয়ার্টার্সে আজ দুপুর থেকেই রান্না বন্ধ। অঞ্জলি নিজে সবাইকে বলে আসায় মেয়েরা ভিড় করেছে সাতসকালেই। গায়ে হলুদের তত্ত্ব দেখে সবাই উচ্ছ্বসিত। মাছটাই প্রায় বিশ সের হবে। বেনারসি শাড়ির সঙ্গে চারটে যে শাড়ি এসেছে তা অঞ্জলি কখনও গায়ে তোলেনি। ঝুমকো দুল এসেছে ভেলভেটের বাক্সে। বীণাবউদি দেখেই বললেন, ‘এ নিশ্চয়ই তরুণ জুয়েলারি থেকে গড়ানো।’ মিষ্টি কত রকমের। ঘড়ায় করে সরষের তেল পাঠানো হয়েছে ঘানি থেকে ভাঙিয়ে। প্রসাধনের জিনিসপত্র সবই বিদেশি। রুপোর বাটিতে বাটা হলুদ আলাদা করে রাখা। সবাই বলতে লাগল এই চা-বাগানে এমন তত্ত্ব এর আগে কারও বিয়েতে আসেনি। হরিদাসবাবু বললেন, ‘দ্যাখো অমর, কীরকম সম্বন্ধ করেছি। শুধু পয়সাই নেই, নজরটা আকাশছোঁয়া। আমার মেয়েও গায়ে হলুদে এই তত্ত্ব পায়নি।’
এসব নিয়ে সকালটা ভালই কেটেছিল। দুপুরে যখন ছেলেরা খেয়ে উঠেছে, বীরপাড়ার রহমত আলি যখন সানাইটা ঝালিয়ে নিচ্ছে, তখনই চিৎকার শুরু হল মালবাবুর বাড়ি থেকে। মালবাবুর স্ত্রী খেতে বসতে যাচ্ছিলেন মেয়েদের সঙ্গে, এমন সময় ওদের চাকর চিৎকার করতে করতে ছুটে এল। ললিতা নাকি কেমন করছে। সে যে খেতে আসেনি দুপুরে সেটা খেয়াল করেনি কেউ। খবরটা শুনে অনেকের সঙ্গে অমরনাথও ছুটে গেলেন মালবাবুর বাড়িতে। গিয়ে দেখেন ললিতা তার ঘরের মেঝেয় শুয়ে ছটফট করছে। মুখ শক্ত হয়ে যাচ্ছে, পেট চেপে আছে। ডাক্তারবাবুও সঙ্গে ছিলেন। সামান্য পরীক্ষা করেই বুঝতে পারলেন মেয়েটা বিষ খেয়েছে। সাহেবকে বলে গাড়ি আনতে একটু সময় লাগল। এর চিকিৎসা বাগানের হাসপাতালে হবে না। ওষুধ যা দেবার দিয়ে মালবাবু আর ডাক্তারবাবু ললিতাকে নিয়ে শেষ চেষ্টা করতে ছুটলেন জলপাইগুড়ি। ডাক্তারবাবুর মুখ দেখে মনে হচ্ছিল আশা খুব একটা নেই। ললিতার টেবিলে একটা কাগজ পাওয়া গিয়েছিল, তাতে লেখা, ‘আমি চললাম, তোমার পথের কাঁটা, তুমি ভাল থেকো।’ ললিতা চলে যাওয়ার পর আর্তনাদ করতে লাগলেন মালবাবুর স্ত্রী। আর সেই আর্তনাদের মধ্যে যে-কথাগুলো উচ্চারিত হল তাতে সবাই জানতে পারল ললিতা বিষ খেয়েছে শ্যামলের জন্যেই। বিষ না খেয়ে ললিতার উপায় ছিল না। আজ সকালে তিনি ললিতাকে বমি করতে দ্যাখেন। ভেবেছিলেন দীপার বিয়ে চুকে যাওয়ার পর হরিদাসবাবুর সঙ্গে কথা বলবেন। কিন্তু ওই বোকা মেয়েটা যে ফস করে বিষ খেয়ে বসবে তা কে জানত!
ভিড়টা আস্তে আস্তে সরে এল আসাম রোডের এপাশে বিয়েবাড়ির সামনে। নানান জল্পনা চলছে এখন। ললিতা যদি না বাঁচে তা হলে থানা পুলিশ নিশ্চয়ই হবে। একটু একটু করে মেয়েটার পক্ষে বিপক্ষে অনেক কথা উঠতে লাগল। শ্যামলের সঙ্গে কে কবে কখন চা-বাগানের মধ্যে দেখেছে অথচ বদনামের ভয়ে বলেনি, মেয়েটার স্বভাবচরিত্র কেমন গোলমেলে ছিল। এর মধ্যেই শ্যামলের খোঁজ পড়েছে। তাকে দেখা যাচ্ছে না কেন?
অমরনাথ বললেন, ‘শ্যামলকে আমি বীরপাড়ায় পাঠিয়েছি দই আনতে।’
হরিদাসবাবু মাথা নিচু করে বসে ছিলেন পাথরের মতো। তাঁর স্ত্রী দু’পা পিছনে। সবাই ঘুরে ঘুরে তাকাচ্ছে। আবহাওয়া ক্রমশ ভারী হয়ে উঠছে। অমরনাথ পাশে এসে দাঁড়ালেন, ‘হরিদাসদা, আপনি শক্ত হন।’
হরিদাসবাবু বললেন, ‘সারাজীবন তো সন্তানদের ব্যাপারে একবারও নরম হইনি অমর, তবু শেষ বয়সে আমাকে এসব শুনতে হল! সে যে প্রেম করছে তাও কেউ আমায় জানায়নি। তাতে আর যাই হোক মেয়েটার সর্বনাশ হত না। মরে গেলে কী হবে অমর?’
অমরনাথ বললেন, ‘চিকিৎসা শুরু হয়েছে, ওসব ভাবছেন কেন? আজ দীপার বিয়ে। সব দায়িত্ব আপনার ওপরে— ।’
‘না হে অমর। আমার যাই হোক, তোমার মেয়েকে শ্বশুরবাড়িতে পাঠানো পর্যন্ত আমি ঠিক থাকব। শুধু খেয়াল রেখো, সেই শয়তান যেন আমার সামনে না এসে দাঁড়ায়।’
একটা কী হয় কী হয় ভাব সমস্ত মানুষের মনে। বিয়েবাড়ির কিছু মহিলা রয়ে গেছে মালবাবুর স্ত্রীকে সামলাতে। এবং তখনই একটা কথা উঠল। অমরনাথ যে অল্প বয়সে দীপার বিয়ে দিচ্ছেন এ ঢের ভাল। মেয়েকে বড় করে যদি বাপ মায়ের মুখ পোড়ায় তা হলে সেই মেয়ের না জন্মানোই ভাল ছিল। আর তা ছাড়া, ললিতা বাচ্চা মেয়ে নয়, কীসে কী হয় তা জানে, সে কী করে শ্যামলকে প্রশ্রয় দিল? ক্রমশ আবহাওয়াটা অমরনাথের অনুকূলে ঢলে পড়ল। যারা এতদিন বাল্যবিবাহের বিরোধী ছিল তারাও চুপ করে গেল। অমরনাথ প্রার্থনা করছিলেন মনে মনে, জলপাইগুড়ি থেকে মৃত্যু সংবাদটা যেন আজ রাতের মধ্যে না আসে।
তিনটে নাগাদ ভ্যানে মিষ্টি এবং দইয়ের হাঁড়ি চাপিয়ে শ্যামল ফিরল। সোজা বিয়েবাড়ির সামনে গাড়ি থেকে নেমে সে অমরনাথকে বলল, ‘খুব ভাল দই হয়েছে আজ, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।’ অমরনাথ জবাব দিলেন না। শ্যামল অবাক হল। ভিড়টাকে সে বিয়েবাড়িতে আনন্দ করতে আসা মানুষের জমায়েত বলেই ভেবেছিল। এখন দেখল, কেউ কথা বলছে না অথচ তার দিকে অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে আছে। সে খুব সরল গলায় জিজ্ঞাসা করল, ‘কী ব্যাপার? কিছু হয়েছে নাকি?’
সঙ্গে সঙ্গে হরিদাসবাবু উঠে এলেন। ইতিমধ্যে তাঁর পায়ের জুতো হাতে উঠেছে। শ্যামল কিছু বোঝার আগেই পাগলের মতো তিনি জুতো দিয়ে আঘাত করতে লাগলেন ছেলের মুখে।
শ্যামল কয়েকবার আঘাত খেয়ে খপ করে বাবার হাত ধরে ফেলে চিৎকার করল, ‘কী করছ তুমি?’
‘কী করছি? কিছুই করিনি এখনও। তুই আমার ছেলে নস। তুই আমার কাছে মরে গেছিস। গলায় দড়ি দে, গলায় দড়ি দিয়ে তুই আমাকে বাঁচা।’ আর এই প্রথম হাউহাউ করে কেঁদে উঠলেন হরিদাসবাবু। তাঁর শরীর কাঁপছিল।
ছুটে গিয়ে অমরনাথ তাঁকে ধরলেন। অমরনাথ বললেন, ‘আপনি কথা দিয়েছিলেন হরিদাসদা, ভুলে যাচ্ছেন।’
কাঁদতে কাঁদতে হরিদাসবাবু বললেন, ‘এই কুলাঙ্গারটাকে চোখের সামনে থেকে সরাও।’
অমরনাথ প্রায় টানতে টানতে হরিদাসবাবুকে বাইরের বারান্দায় এনে বসালেন। শ্যামল হতভম্ব। সে এগিয়ে গেল তার মায়ের কাছে। লক্ষ্মীবউদি পাথরের মতো দাঁড়িয়ে ছিলেন ঘোমটার প্রান্ত দাঁতে চেপে। শ্যামল তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘কী হয়েছে?’
‘ললিতা বিষ খেয়েছে।’ প্রায় ফিসফিস করে বললেন লক্ষ্মীবউদি।
চমকে পেছন ফিরে আসাম রোডের ওপাশে ললিতাদের কোয়ার্টার্সের দিকে তাকাল শ্যামল। তারপর জিজ্ঞাসা করল, ‘কোথায় সে?’
লক্ষ্মীবউদি বললেন, ‘হাসপাতালে নিয়ে গেছে। জলপাইগুড়িতে।’
শ্যামল সঙ্গে সঙ্গে তিরের মতো ছুটে গেল রাস্তায়। একটা স্টেট বাস আসছিল। মাঝখানে দাঁড়িয়ে বিপজ্জনকভাবে সেটাকে থামিয়ে উঠে পড়ল। চোখের পলকে বাসটা মিলিয়ে গেল চা-বাগানের আড়ালে। জনতা এবার গুঞ্জন করতে লাগল। শ্যামলের প্রতিক্রিয়া দেখে এর মধ্যেই কারও কারও ভাল লেগেছে। সত্যিকারের ভালবাসা নিয়ে আলোচনা হল। এত বড় ছেলেকে সবার সামনে জুতোপেটা করা উচিত হয়েছে কিনা তা নিয়ে দ্বিমত তৈরি হল। কিন্তু ধীরে ধীরে উত্তেজনা থিতিয়ে এল। আর বীরপাড়ার রহমত আলি সেই সুযোগে সানাইয়ের সুর ধরল। অঞ্জলি মাঠে নেমে এসে লক্ষ্মীবউদিকে ভেতরে নিয়ে গেল। আর আজ যার বিয়ে সে বাগানে দাঁড়িয়ে সমস্ত ঘটনা চুপচাপ দেখে গেল। বীণাবউদির নজর সেদিকে পড়তেই তিনি আঁতকে উঠলেন, ‘ওমা, বিয়ের কনে গায়ে হলুদ মেখে খোলা আকাশের নীচে চুল খুলে দাঁড়িয়ে আছে দ্যাখো। আক্কেল বলে কিছু নেই নাকি?’
শক্ত মুখ ঘুরিয়ে দীপা জিজ্ঞাসা করল, ‘শ্যামলদা কোথায় গেল?’
‘কোথায় গিয়েছে আমাকে বলে গিয়েছে নাকি?’ বীণাবউদি অবাক, ‘চলে আয় ভেতরে। একটু বাদে তোকে সাজাতে বসতে হবে।’
বিয়েবাড়ি জমজমাট। সন্ধের মুখে মুখে বর নিয়ে এসে গেছেন প্রতুলবাবু। বরযাত্রীদের সংখ্যা মাত্র বারো। তাঁদের আপ্যায়ন করছিলেন অমরনাথের সঙ্গে হরিদাসবাবু। এখন মানুষটার দিকে তাকিয়ে বোঝাই যাচ্ছে না যে অপরাহ্ণে অত বড় আঘাত পেয়েছেন। কর্তব্যের খাতিরে হরিদাসবাবু মাঝে মাঝে বাড়াবাড়ি করছেন এবং সেটা মনের কষ্ট চাপা দিতেই, অমরনাথ বুঝেও বাধা দিচ্ছিলেন না। পাত্র অতুলকে বসানো হয়েছিল যে-ঘরে সেখানে মেয়েদের ভিড় স্বাভাবিক। তাতে একদল খুদে যেমন আছে তেমন বীণাবউদির মতো বয়স্কাও বাদ যাননি। কিন্তু খোদ প্রতুলবাবু যখন ছেলের পাশে বসলেন তখন আমোদে বাধা পড়ল। বয়স্কা মহিলারা আড়াল থেকে দেখতে লাগলেন। বাচ্চারা জুলজুল করে দেখল ধুতি পাঞ্জাবি পরা বর আঙুলে হিরের আংটি নিয়ে পাশ বালিশে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে। হরিদাসবাবু ছুটে এসে প্রতুলবাবুর কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে কিছু বলতেই তিনি সজোরে বলে উঠলেন, ‘তাতে কী হয়েছে। এখনও আমার ছেলের বয়স আঠারো হয়নি যে তাকে জলে জঙ্গলে ছেড়ে দেব। আগলে রাখতে নির্দেশ দিয়েছেন হার হাইনেস। আদেশ অমান্য করতে বাপ মা শেখায়নি। হ্যাঁ, অমরনাথবাবুকে বলুন, আশীর্বাদটা সেরে নিতে। আগে আপনারা করুন তারপর আমি।’
এইসময় দরজায় সুভাষচন্দ্র এসে দাঁড়ালেন। আজ সকালে কলকাতা থেকে এসেছেন তিনি এই বিবাহ উপলক্ষে। সুভাষচন্দ্র অঞ্জলির একমাত্র ভাই। মালবাজারের পাট চুকিয়ে এখন তিনি কলকাতায় বাস করেন। ট্রেন যাত্রার কারণে সারাদুপুর ঘুমিয়েছেন। এখন পাত্র ও পাত্রের পিতাকে একঝলক দেখে বরযাত্রীদের সামনে দাঁড়ানো অমরনাথের সামনে গিয়ে বললেন, ‘ও জামাইবাবু। আপনার জামাই কে? ছেলে না ছেলের বাবা?’
‘কী যা তা বলছ সুভাষ?’ অমরনাথ বিরক্ত হলেন।
‘দেখুন গিয়ে, ছেলে ঘুমিয়ে পড়েছে আর বাপ আসর জমাচ্ছে।’
‘দুর! বিয়ে করতে এসে কেউ ঘুমিয়ে পড়ে?’
অমরনাথের কথা শেষ হতেই হরিদাসবাবু ছুটে এলেন, ‘আশীর্বাদটা করে নিতে হবে অমর। কী দিয়ে আশীর্বাদ করবে তা নিয়ে এসো, আমরা তো ধানদুব্বা।’
আগে দীপার আশীর্বাদ হল। জবুথবু হয়ে বসে আছে সে। সবাই দেখল একটা জড়োয়ার সেট দিলেন প্রতুলবাবু। বললেন, ‘এখনই এটা পরিয়ে দেবেন কেউ দয়া করে?’
সযত্নে পরিয়ে দেওয়া হলে তিনি বললেন, ‘বাঃ। চমৎকার।’
প্রতুলবাবু যখন এদিকে ব্যস্ত তখন সুভাষচন্দ্র অতুলকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী হে, তোমার কি ঘুম পাচ্ছে খুব?’
যাওয়ার সময় প্রতুলবাবু সঙ্গীদের ছেলের পাশে রেখে গিয়েছিলেন। তাঁদের একজন বললেন, ‘খুব পরিশ্রম হচ্ছে তো।’
অতুল জবাব না দিয়ে চোখ বন্ধ করল। সুভাষচন্দ্র বলেই ফেললেন, ‘শরীর খারাপ নাকি? জ্বর এসেছে মনে হচ্ছে।’
অতুল এবার হাসতে চাইল। কোনওমতে মাথা নেড়ে বলল, ‘না!’
সুভাষচন্দ্রের মনে হল ছেলেটির গলার স্বর বড় মেয়েলি। তিনি অমরনাথের কাছে গিয়ে বললেন, ‘জামাইবাবু, আপনার জামাই কিন্তু সুস্থ নয়।’
‘হ্যাঁ, একটু রোগা বটে, তবে নেহাতই অল্প বয়স।’ অমরনাথ আজই প্রথম জামাইকে দেখেছেন। গাড়ি থেকে নামবার সময় প্রতুলবাবু ছেলেকে যেভাবে ধরেছিলেন তা ওঁর ভাল লাগেনি। যতই রোগা হোক একা হাঁটতে কষ্ট হবে কেন?
অতুলকে আশীর্বাদের আগে সুভাষচন্দ্র ফস করে বলে বসলেন, ‘আপনার ছেলে কি অসুস্থ?’
চমকে ফিরে তাকালেন প্রতুলবাবু। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ইনি কে?’
হরিদাসবাবু পরিচয় করিয়ে দিলেন, ‘আমাদের অমরনাথের শ্যালক।’
‘ও। আপনার যদি সন্দেহ হয় তা হলে ডাক্তার ডাকতে পারেন।’
‘না না, সন্দেহ কেন হবে। মুখ চোখে কীরকম একটা ভাব দেখে— ।’
‘তাকেই সন্দেহ বলে। না না, আপনারা ডাক্তার ডাকুন। এখন বুঝতে পারছি আমি বলা সত্ত্বেও আগে কেন ছেলেকে আশীর্বাদ করলেন না আপনারা। ডাক্তার ডেকে প্রমাণিত হোক ও সুস্থ, তারপর আশীর্বাদ হবে।’
হরিদাসবাবু বলে বসলেন, ‘ডাক্তারবাবু তো এখানে নেই। জলপাইগুড়িতে গিয়েছেন।’
‘তা হলে অপেক্ষা করুন।’
কেউ একজন অমরনাথের কাছে ছুটে গিয়ে ব্যাপারটা জানাতেই তিনি চলে এলেন। বেশ কয়েকবার ক্ষমা চাইবার পর প্রতুলবাবু শান্ত হলেন। কিন্তু আশীর্বাদের পর অতুল হাত বাড়িয়ে প্রণাম করল না। ঘড়ি আংটি নিয়ে একপাশে রাখল। প্রণাম নেবার জন্যে দাঁড়িয়ে ছিলেন অমরনাথ। প্রতুলবাবু বললেন, সরে আসুন মশাই। সন্ন্যাসীৰ নিষেধ। একমাত্র গর্ভধারিণী ছাড়া কোনও মানুষকে যেন ও প্রণাম না করে। নইলে প্রতি প্রণামের জন্যে এক বছর করে আয়ু কমে যাবে। এই আমাকেই ও বিজয়াদশমীর রাতে প্রণাম করতে পারে না।’
অমরনাথ হকচকিয়ে তাড়াতাড়ি সরে এলেন। তাঁর মনের মধ্যে একটা দুশ্চিন্তা তিরতিরিয়ে উঠল। চারপাশের হইচই, সানাইয়ের সুর, মানুষের উজ্জ্বল মুখ সেই ভাবনাটাকে চাপা দিতে পারল।
ছাঁদনাতলায় বরকে নিজে নিয়ে গেলেন প্রতুলবাবু। তিনি সঙ্গে পুরোহিত এনেছেন। এই বাড়ির পুরোহিতের সঙ্গে সেই পুরোহিতের মতান্তর শুরু হয়ে গেল বিবাহবিধি নিয়ে। প্রতুলবাবুর পুরোহিতের বয়স হয়েছে। তিনি হুংকার দিলেন, ‘এইসব বাঙালপনা চলবে না। অবস্থা সামলাতে শেষপর্যন্ত তাঁকেই সব দায়িত্ব দেওয়া হল। শেষপর্যন্ত সিঁদুর পরানোও সাঙ্গ হল।
বর কনেকে যখন বাসরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তখন প্রতুলবাবু বলেন, ‘দাঁড়ান। রাত অনেক হয়েছে। আমি তিস্তার খেয়াঘাটে বলে এসেছি মাঝিদের, এগারোটার মধ্যেই ফিরব। তারা অপেক্ষা করছে। বাসর আজ রাত্রে জলপাইগুড়িতেই বসবে।’
অমরনাথ কাকুতিমিনতি করতে লাগলেন, ‘একটাই তো রাত। আপনাদের সমস্ত ব্যবস্থা করে রাখা হয়েছে। কোনও অসুবিধে হবে না। এখানকার পি ডব্লু ডি বাংলোয় আপনার জন্যে ঘর বুক করেছি। দয়া করে আজকের রাতটা থেকে যান এখানে।’
গম্ভীরভাবে মাথা নাড়লেন প্রতুলবাবু, ‘অসম্ভব। কথার নড়চড় আমি পছন্দ করি না।’
অসহায় অবস্থায় অমরনাথ হরিদাসবাবুর খোঁজ করলেন। বিয়েবাড়িতে হরিদাসবাবু নেই। কেউ দ্যাখেনি তাঁকে কোথাও যেতে। কী মনে হতে অমরনাথ ছুটলেন তাঁর কোয়ার্টার্সে। আজ সমস্ত মানুষ ভিড় করেছে বিয়েবাড়িতে। নির্জন কোয়ার্টার্সের দরজা খোলা। উঁকি মেরে আঁতকে উঠলেন অমরনাথ। হরিদাসবাবুর দুটো পা মাটি থেকে অনেক উঁচুতে ঝুলছে। খবরটা চিৎকার করে দিতে গিয়েও গিলে ফেললেন তিনি। প্রতুলবাবুরা দীপাকে নিয়ে আগে চলেই যাক ভালই ভালয়।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন