৫১. সাতকাহন প্ৰথম পর্ব সমাপ্ত

সমরেশ মজুমদার

সুভাষচন্দ্র সম্ভবত কল্পনাবিলাসী ছিলেন। সম্পত্তির মূল্যায়নে আকাশকুসুম মূল্য নির্ধারণ করে নিজের কল্পিত অংশের চেহারা দেখতে ভালবেসে ছিলেন। রায়মহাশয় সমস্ত কাগজপত্র পর্যালোচনা করে বলেছেন যা শেষপর্যন্ত আইনসংগত করা সম্ভব হবে তার পরিমাণ ছয় লক্ষ টাকার বেশি হবে না। এবং এই ছয় লক্ষ টাকাও দরাদরিতে বেশ কিছুটা কমে যাওয়া স্বাভাবিক। অর্থাৎ প্রতুল বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্পত্তির দামের পরিমাণ সুভাষচন্দ্রের করা হিসেবের প্রায় অর্ধেক হয়ে যাচ্ছে। অবশ্য এতে দীপার কিছু এসে যায়নি। যদি মোট সম্পত্তির দাম এক হাজার টাকাও হত তা হলে তার ব্যক্তিগত কারণে মন খারাপ হত না। হ্যাঁ, জনসাধারণের উপকারের জন্যে বেশি টাকা দেওয়া গেল না, এটাই মনে হত তার।

আমাদের দেশের আইনি ব্যবস্থায় তিন দিন থেকে সব কাজ উদ্ধার করে যাওয়া সম্ভব না। সুভাষচন্দ্রের সংগ্রহ করা তালিকা অনুযায়ী একটা হিসেব আদালতে দাখিল করে উত্তরাধিকার আইনসংগত করতে গেলে যে-সব বিধিনিষেধ মানতে হবে তার জন্যে সময় দরকার। এমনিতেই প্রতুল বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যু এবং এই দরখাস্তের মধ্যে যথেষ্ট সময় পার হয়ে গিয়েছে। দখলদাররা ইতিমধ্যে সেইসব সম্পত্তি নিজেদের বলে ভাবতে শুরু করেছেন। অতএব এইসব সম্পত্তিতে কারও কোনও দাবি থাকলে জানান— এইরকম একটা নোটিশ জারি করতে হবে। রায়মহাশয় এবং অমলকুমারকে সে তার হয়ে সমস্ত করার অধিকার লিখিতভাবে দিয়ে দিল।

এই তিনদিনে একটি ব্যাপার মেনে নিতে খুব অসুবিধে হচ্ছিল দীপার। কাছারি বা সরকারি অফিসে যেখানেই সে অমলকুমার অথবা রায়মহাশয়ের সঙ্গে গিয়েছে সেখানেই প্রতুল বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুত্রবধূর পরিচয় স্বীকার করতে হয়েছে। যে-সরকারি অফিসে জমিজমার হিসেব-রাখা হয় সেখানে হাকিমপাড়ার এক ভদ্রলোক কাজ করেন যিনি প্রতুল বন্দ্যোপাধ্যায়কে চিনতেন। তাঁর পুত্রের বিবাহে নেমন্তন্ন খেয়ে গেছেন বলে দাবি করলেন। তিনি তো বলেই ফেললেন, বউমা, শেষপর্যন্ত তুমি এসে শ্বশুরের সম্পত্তি গ্রহণ করছ দেখে খুব খুশি হলাম। আবার কোনও বদলোক আমার মতো কাউকে দাঁড় করিয়ে না দেয় এইরকম ভয় করছিলাম।’

আপনি স্বর্গীয় প্রতুল বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুত্রবধূ? বলতে হয়েছে, হ্যাঁ। আপনার স্বামীর নাম? স্বর্গীয় অতুল বন্দ্যোপাধ্যায়। সমস্ত মন এবং শরীর প্রতিবাদ করেছিল, জিভ আড়ষ্ট হয়ে যাচ্ছিল, তবু বাধ্য হয়ে দীপাকে ওই সমস্ত সত্য উচ্চারণ করতে হয়েছিল। আর তখনই তার মনে হয়েছিল সত্য কী? যা ঘটেছে তাই সত্য না যা ঘটার সময় মেনে নিতে বাধ্য করা হয়েছিল, মনপ্রাণে একবিন্দু সায় ছিল না, ঘটার পরেই যাকে মুছে ফেলে নিজেকে পবিত্র ভাবতে পেরেছিল, তাই সত্য? নাকি দুটোই সত্যি। তাই তার জের মেটাতে এখনও তাকে এইভাবে মাথা নোয়াতে হচ্ছে। কিন্তু কেন? একটি মাত্র সান্ত্বনা মলমের মতো কাজ করছিল, এই মাথা নোয়ানোতে যদি আশেপাশের স্বার্থলোভী আত্মীয়রা দূরে সরে যায়, যদি কিছু অসহায় মানুষ উপকৃত হয়, তা হলে জীবনে শেষবারের মতো না হয় নোয়ানো গেল। দ্বিতীয় যে-চিন্তাটা মাথায় এল তা হল কোনও বাঙালি মারা গেলে তার নামের আগে চন্দ্রবিন্দু জুড়ে দেওয়া হয় কেন? তখন সে কি ঈশ্বর হয়ে যায়! নিশ্চয়ই নয়, এটা মিথ্যে। এই তিন দিনে দীপা যেমন প্রতুল বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুত্রবধূ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে তেমনি অনেকের কাছে বিস্ময়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার শাড়ি, চালচলন, কথাবার্তা জলপাইগুড়ির অনেককেই বিস্মিত করেছে। অমলকুমার সঙ্গে থাকায় তারা প্রকাশ্য কিছু বলেনি কিন্তু দীপার বিশ্বাস অমলকুমারকে প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়েছে। কবে বিদ্যাসাগর মশাই বিধবাদের সপক্ষে আন্দোলন করেছিলেন অথচ বাঙালির মানসিকতার খুব বেশি পরিবর্তন আজও হল না।

অথচ অমলকুমার জলপাইগুড়ি সফরে তার উজ্জ্বল আবিষ্কার। চিঠিপত্রে মানুষ অনেক সাজানো কথা লিখতে পারে। সেদিন কলেজে অধ্যাপক বলছিলেন একটা ঘটনার কথা। একজন শিক্ষিত লেখক বিখ্যাত হয়েছিলেন তার ভারী রচনার কারণে। তিনি নিজস্ব একটি ভাষা, যা ইংরেজি ভাষার অনুকরণে তৈরি, আবিষ্কার করে তাতেই গল্প প্রবন্ধ লিখতেন। এক ধরনের বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় তখন তাঁর চারপাশে ভিড় করেছিল কিন্তু বাঙালি পাঠক তাঁকে আপন করে নেয়নি কখনও। তাঁর কথাবার্তাও নাকি ওই একই স্টাইলে বসানো ছিল। সেই ভদ্রলোক একবার অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভরতি হয়েছিলেন। তখন যন্ত্রণায় কাতর হয়ে নার্সদের সঙ্গে যে-ভাষায় তিনি কথা বলতেন তার সঙ্গে তাঁর রচিত সাহিত্যকর্ম অথবা আড্ডায় ভাষার কোনও মিল নেই। একজন পড়ুয়া নার্স মন্তব্য করেছিল, শুনেছি উনি খুব বড় লেখক কিন্তু বই পড়তে মোটেই ভাল লাগেনি। এখানে যে-ভাষায় আমাদের সঙ্গে কথা বলেন সেই ভাষায় যদি বই লিখতেন তা হলে কী ভালই না হত। অধ্যাপক ঘটনাটি বলে আক্ষেপ করেছিলেন, ‘উনি নিজের ভাষায় লিখলে আমরা কত লাভবান হতাম!’

অমলকুমার অন্তত ওই দলে পড়েন না। সহজ অথচ দৃঢ়, উদার অথচ সংযত একটি মানুষ চিঠি এবং কাজে নিজের চরিত্র আলাদা করেনি। নিজেদের বাড়িতে দীপাকে থাকতে অনুরোধ করেছে আন্তরিকভাবে কিন্তু আপত্তি শোনামাত্র জোর করেনি। সকাল থেকে বিকেল যখনই দীপাকে কোথাও নিয়ে যেতে হয়েছে ঠিক সময় এসেছে, ভদ্রভাবে দূরত্ব রেখেও আন্তরিকতা হারায়নি। আর যে-জিনিসটা দীপাকে মুগ্ধ করেছে তা হল ওর পড়াশুনা। পরিষ্কার বলেছিল, ‘জানেন দীপাবলী, আমি বঙ্কিমচন্দ্র শরৎচন্দ্র মায় রবীন্দ্রনাথ পড়েছি অনেক পরে। মা আমাকে পড়ার অভ্যেস করিয়েছিলেন সুকুমার রায়, উপেন্দ্রকিশোর আর লীলা মজুমদার দিয়ে। সেই সঙ্গে সুনির্মল বসু আর সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত। আর তারপরেই চলে এসেছিলাম বিভূতিভূষণ তারাশঙ্করে। কলেজে উঠে বঙ্কিম শরৎ শেষ করেছি কিন্তু রবীন্দ্রনাথে হাবুডুবু খাচ্ছি।’

ভাল লেগেছিল দীপার, ‘কেন?’

‘আপনি কেন জিজ্ঞাসা করছেন? উপন্যাস বাদ দিলে রবীন্দ্রনাথ মানুষের হৃদয় নিয়ে যাচ্ছেতাই কাণ্ড করে গেছেন। এমনকী গানেও এক একটা শব্দ আচমকা যেভাবে বসিয়ে দিয়েছেন তাতে হৃৎকম্প না হয়ে উপায় নেই।’

‘আপনার তা হলে হৃদয় আছে অমল?’

‘সরি। নেই। ওই রবীন্দ্রনাথ নিয়ে নিয়েছেন।’

অমলকুমার কথাগুলো এমন গলায় বলেছিল যে আচমকা শব্দ করে হেসে উঠেছিল দীপা। ওরা তখন দাড়িয়ে আছে নেতাজি পুলের কাছে, করলা নদীর ধারে। কোর্ট থেকে রায়মহাশয়ের সঙ্গে দেখা করে ফিরছে। কিছু মানুষ চমকে এদিকে ফিরে তাকালেন। দীপা বলল, ‘সরি! আমার বোধহয় এভাবে চেঁচিয়ে হাসা ঠিক হয়নি।’

অমলকুমার বলল, ‘আমি তো অপরাধের কারণ খুঁজে পাচ্ছি না। আর তখনই দাঁড়িয়ে পড়া একটি রিকশা থেকে ভারী চেহারার মানুষ নেমে এল। দীপা ততক্ষণে চিনতে পেরেছে। সে কিছু বলার আগেই শ্যামলদা বলে উঠল, দীপা, তুই এখানে?’

শ্যামলদা বেশ মোটা হয়েছে এরই মধ্যে। দীপা উত্তর দিলে, ‘এই তো, কাজে এসেছি।’

‘কবে এসেছিস?’

‘দিন দুয়েক হল।’

‘চা-বাগানে?’

‘না। এ-যাত্রায় জলপাইগুড়িতেই আছি।’

‘ও। ওখানে যাবি না?’

‘না। আপনি কেমন আছেন?’

‘আমি? ভাল। অবশ্য একটু চিন্তায় আছি। ললিতার বাচ্চা হবে, এখানকার হাসপাতালে ভরতি হয়েছে। কিন্তু আজই আমাকে একবার চা-বাগানে ফিরে যেতে হবে। জরুরি কাজ, কাল সকালে ফিরে আসব। ও একা রইল, তাই চিন্তা। তা একে চিনলাম না!’

যেন দীপার পরিচিত সমস্ত মানুষকে চেনার অধিকার ওর আছে এমন গলায় প্রশ্নটা করা হল। দীপা খুব সহজ গলায় বলল, ‘আমার বন্ধু, অমলকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়।’

‘বন্ধু? ও।’ শ্যামলদার মুখটা অন্যরকম লাগল। তারপর আচমকা ‘আচ্ছা চলি’ বলে রিকশার দিকে ফিরে গেল। দীপা বলল, ‘দেখুন অমল, কথাটা উনি হজম করতে পারলেন না।’

‘কে উনি?’

‘আমার বাবা যে-চা-বাগানে চাকরি করতেন সেখানেই কাজ করেন উনি। এককালে ভাল ফুটবল খেলতেন। এখন বাগানে ফিরে গিয়ে সবাইকে আমার গল্প করবেন।’

‘না-ও করতে পারেন।’

‘বাঙালিকে আমি যত চিনেছি আপনি তত চেনেননি অমল। আচ্ছা, আমি আপনাকে বন্ধু বলে, পরিচয় দিলাম বলে আপনি অসন্তুষ্ট হননি তো?’

‘অভয় দেন তো একটা কথা বলি।’

‘নিশ্চয়ই।’

‘মাঝে মাঝে আপনাকে দেখে এবং শুনে মনে হয় আর পাঁচটা বাঙালি মেয়ের থেকে আপনি একদম আলাদা। আপনার ব্যক্তিত্ব ভাবনা শ্রদ্ধা আনে। আবার আচমকা এমন কথা বলেন যে তার সঙ্গে মেলানো যায় না।’

‘এ-কথা কেন?’

‘আপনার বন্ধু হতে পারলে আমি খুশি হব। অসন্তোষের কথাই ওঠে না।’

দীপা মুখ ফেরাল। তারপর চেঁচিয়ে একটা রিকশাকে ডাকল। অমলকুমার জিজ্ঞাসা করল, ‘কোথায় যাবেন এখন?’

‘আপনাদের বাড়িতে?’

‘বাঃ, গেলে মা খুশি হবেন। আপনি এগোন, আমি একটু ঘুরে আসছি।’

‘কেন? আমার সঙ্গে এক রিকশায় যেতে অসুবিধে হচ্ছে?’

অমলকুমার হাসল, ‘আমি যদি বলি বাঙালির স্বভাব হল যে-কোনও ব্যাপারকেই একটু বাঁকা চোখে দেখতে ভালবাসে তা হলে কিন্তু আপনি দায়িত্ব এড়াতে পারবেন না। আমি আমার ব্যাবসার কাজে একটু ফণীন্দ্রদেব স্কুলের কাছে যাচ্ছি।’

লজ্জিত হল দীপা। সে কিছু না বলে রিকশায় উঠে বসল। ধড়ধড়া নদী ছাড়িয়ে একটু এগোতেই দীপা হাসপাতালটা দেখতে পেল। সঙ্গে সঙ্গে ললিতাদির কথা মনে পড়ল। বাবার মৃত্যুর সময় ললিতাদি তাদের খুব সাহায্য করেছিলেন। এত কাছে এসে ওঁর সঙ্গে দেখা না করে যাওয়াটা ঠিক হবে না। দীপা রিকশা ছেড়ে দিল। ভাড়া দিয়ে হাসপাতালে জিজ্ঞাসা করে মেটারনিটি ওয়ার্ডে চলে এল সে। বড় হলঘরে এপাশ ওপাশের বিছানায় শুয়ে আছেন আসন্ন প্রসবা বা সদ্য প্রসূতিরা। একবার চোখ বোলালেই এতগুলো মা হতে যাওয়া শরীরের ভেতর থেকে একটা চমৎকার ছবি উঠে আসে। এখন প্রত্যেকেই যেন ধরিত্রীর যথার্থ প্রতিনিধি। ভাবীকালের মানুষের পাশ দিয়ে সে যেন হেঁটে যাচ্ছে। শেষপর্যন্ত ললিতাদির দেখা পেল সে। একেবারে ধারের বিছানায় কাত হয়ে শুয়ে ছাদ দেখছেন। ললিতাদির পাশের টুলে বসতেই যে শব্দ হল তাতে চোখ নামালেন তিনি। সঙ্গে সঙ্গে চোখ বড়, মুখ হ্যাঁ। দীপা বলল, ‘কেমন আছেন?’

‘কলকাতা ছেড়ে এখানে কবে?’

‘এই তো ক’দিন হল। কেমন আছেন?’

ললিতাদি মুখটা সামান্য নাড়লেন যার অর্থ স্পষ্ট বোঝা গেল না। তারপর বললেন, ‘তুমি খুব সুন্দর দেখতে হয়েছ। খু-উ-ব।’

‘শ্যামলদার সঙ্গে দেখা হল। ওঁর কাছেই জানতে পারলাম। উনি তখন চা-বাগানে যাচ্ছিলেন।

‘ভাগ্যিস দেখা হয়েছিল।’ ললিতাদি কথা বলে মুখ ফেরালেন।

‘আপনার শরীর কি ভাল লাগছে না?’

‘আঁ? না না। ঠিক আছি।’

‘তবে?’

‘ভাল লাগছে না। আমি, আমি এটা মানতে পারছি না।’

‘কোনটা?’

‘তোমার শুনে দরকার নেই। যাক, পড়াশুনা কেমন হচ্ছে?’

‘হচ্ছে।’

‘জলপাইগুড়িতে কোথায় উঠেছ?’

‘আমার পুরনো হস্টেলে।’

‘চা-বাগানে গিয়েছিলে? ওঁরা তো অমর গ্যারেজের দিকে বাড়ি করেছেন!’

‘শুনেছি। আমি যেতে পারিনি।’

‘সেকী? কেন?’

‘সময় হয়নি।’

‘তোমার সম্পর্কে অনেক গল্প শোনা যায়। আমার বিশ্বাস হয় না।’

‘কেন?’ দীপা হাসল।

‘পুরুষরা গল্প বানায় আর মেয়েরা সেটার ডালপালা তৈরি করে ছড়ায়।’

দীপা কিছু বলল না। এই একটা কথায় ওর মনে হল ললিদি যথেষ্ট বুদ্ধিমতী।

ললিতা বললেন, ‘তোমাকে দেখে খুব ভাল লাগছে।’

‘আমার সম্পর্কে গল্প শুনেও?’

‘গল্প তো আমার সম্পর্কেও হয়েছিল!’

‘সেগুলোর কি সবই গল্প ছিল?’

‘তুমি কিছু জানো?’

‘জানি। আপনাকে আব শ্যামলদাকে একদিন আমি চা-বাগানের ভেতরে দেখেছি।’ হঠাৎই অনেকদিন আগে হাতির তাড়া খেয়ে পালিয়ে আসার সময় চা-বাগানের ভেতর থেকে আসা শ্যামলদা ও ললিতাদির ভেসে আসা কণ্ঠস্বর স্মৃতি উগরে দিল।

ললিতাদি ওর দিকে স্পষ্ট চোখে তাকালেন, ‘আমি বিষ খেয়েছিলাম, জানো?’

‘জানি।’ দীপার মনে পড়ছিল ঘটনাগুলি।

‘লোকে গল্প তৈরি করেছিল আমার শরীরে বিয়ের আগে বাচ্চা এসেছিল বলে আমি বিষ খেয়েছিলাম আত্মহত্যা করতে।’ নিশ্বাস ফেললেন ললিতাদি।

‘গল্পটা তো ক’দিন বাদে মিথ্যে প্রমাণিত হয়েছিল।’

‘হয়েছিল। কিন্তু তারপর, বিয়ের পর আমি আর বাচ্চা চাইনি।’

‘সেকী! কেন?’

‘বিয়ের আগে তোমার শ্যামলদা আমার জন্যে পাগল ছিলেন। এমনকী আমি যখন হাসপাতালে তখনও। কিন্তু বিয়ের পরে সেই মানুষটা আচমকা বদলে গেল। তার বাবা আত্মহত্যা করেছে নাকি আমার জন্যে। জানো ভালবাসা হল সকালের মতো। স্বার্থর লম্বা ছায়া সূর্য ওঠামাত্র ছোট হতে আরম্ভ করে। সূর্য যখন মাথার ওপর তখন ছায়া পায়ের তলায়। ভালবাসার পূর্ণতা তখনই হয়ে যায়। তারপর যত বেলা গড়ায়, ছায়া লম্বা হয়, তত ভালবাসার আয় ফুরিয়ে আসে। পৃথিবীতে সবকিছুর মতো ভালবাসার আয়ু বড় ক্ষণস্থায়ী। ভালবাসাহীন সম্পর্ক বয়ে চলা যে কী কষ্টকর! এখন আমি তোমার শ্যামলদাকে আর ভালবাসতে পারি না। অথচ তার সন্তান আমাকে বহন করতে হচ্ছে। জানো, প্রতি মুহুর্তে আমি ঈশ্বরকে বলছি যে আসবে সে যেন ভালভাবে আসে কিন্তু তিনি যেন আমাকে সেইমুহূর্তে কাছে টেনে নেন!

‘ললিতাদি’।

‘হ্যাঁ গো। সত্যি কথা শুনতে খারাপ লাগে। তোমার ওপর অনেক ঝড় বয়ে গিয়েছে আমি জানি। তবু একটা কথা বলি, যদি কখনও কাউকে ভালবাসো তা হলে তাকে বিয়ে কোরো না। ভালবাসা হল বেনারসি শাড়ির মতো, ন্যাপথালিন দিয়ে যত্ন করে আলমারিতে তুলে রাখতে হয়, তাকে আটপৌরে ব্যবহার করলেই সব শেষ।’ ললিতা নিশ্বাস ফেললেন।

কিছুক্ষণ চুপ করে রইল দীপা। তারপর বলল, ‘আপনি এসব মাথায় রাখবেন না। যে আসছে তার দরকার আপনাকে। এটা ভুলে যাবেন না!’

ললিতাদি হাসলেন। বড় বিষন্ন সেই হাসি।

দীপা উঠে দাঁড়াল। ললিতাদির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সে ধীরে ধীরে বেরিয়ে এল বাইরে। তার শরীরে অস্বস্তি হচ্ছিল। সেই ললিতার্দি এবং শ্যামলদা, যারা ভালবাসার উগ্রতায় অন্ধ হয়ে পরস্পরকে আঁকড়ে ধরে সমস্ত চা-বাগানের মানুষকে নস্যাৎ করতে পেরেছিল তারা আজ কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে। মানুষের সম্পর্ক বড় জটিল। কিন্তু তাই বলে এই জায়গায় পৌঁছাবে তা সে কখনও ভাবতে পারেনি। ললিতাদির জন্যে তার খুব কষ্ট হচ্ছিল। শেষ হাসিটা ললিতাদির ঠোঁট থেকে বিষন্নতা নিয়ে যেন সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছিল। ভালবাসার মৃত্যুর পরে বেঁচে থাকা অর্থহীন। কিন্তু ভালবাসা মরে যায় কেন।

আচ্ছন্নের মতো হেঁটে এল দীপা রায়কত পাড়ায়। অমলকুমারের বাড়ির সামনে এসে তার যেন চৈতন্য ফিরল। টিনের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। সে দু’বার শব্দ করতে ভেতর থেকে মাসিমার গলা ভেসে এল, ‘কে ওখানে?’

দীপা গলা তুলল, ‘আমি দীপাবলী।’

কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে দরজা খুললেন অমলকুমারের মা। একগাল হেসে বললেন, ‘আরে, তুমি একা কেন? অমল কোথায়?’

‘উনি ব্যাবসার কাজে গিয়েছেন।’

‘দ্যাখো কাণ্ড, তুমি একা এলে?’

‘বাঃ, আমি নাবালিকা? জলপাইগুড়িতে কি আমি নতুন?’ দীপার কথা শেষ হওয়ামাত্র মহিলা তার হাত ধরে ভেতরে নিয়ে এলেন। ‘আজ রাত্রে তুমি এখানে খেয়ে যাবে?’

‘আপনার কষ্ট হবে না?’

‘মানে! কী কথা বললে? আমরা মায়েরা ছেলেমেয়েদের খাওয়াতে ভালবাসি। দু’জনের জায়গায় তিনজন যদি খায় তা হলে কষ্ট বেড়ে যাবে? তোমরা যখন আমার বয়সে পৌঁছাবে তখন হয়তো মানসিকতা পালটাবে কিন্তু আমরা পুরনো দিনের মায়েরা একইরকম রয়েছি!’

সারাটা বিকেল, সন্ধে চমৎকার কাটল দীপার। মাসিমার সঙ্গে রান্নাঘরে বসেও গল্প হল। সন্ধের মাথায় অমলকুমার ফিরল। একটু চিন্তিত। মাসিমা জিজ্ঞাসা করলেন, কী হয়েছে রে?’

অমলকুমার দীপার দিকে তাকাল, তারপর বলল, ‘উনি এসে কাকাবাবুর বিষয়সম্পত্তির অধিকার আইনসংগত করতে চান তা অনেকের পছন্দ নয়। যাঁদের স্বার্থে আঘাত লাগছে তাঁদের কেউ কেউ খেপে উঠেছেন। এমনই একজন আমাকে পোস্ট অফিসের সামনে ধরে শাসাতে চেয়েছিল।’

‘কে? দীপা প্রশ্ন করল।

আপনি নাম বললে চিনতে পারবেন না। গত দশ বছর ধরে ভদ্রলোক কাকাবাবুর জমি ভোগ করছেন। উনি বেঁচে থাকতে ঠিকঠাক টাকাপয়সা দিতেন। মারা যাওয়ার পর ভেবে নিয়েছিলেন যে জমিটা ওঁরই হয়ে গেল। একবার ভাবনাটা পাকা হয়ে গেলে তা উপড়ে ফেলা মুশকিল হয়ে যায়। অমলকুমার হাসল।

মাসিমা বললেন, ‘কোনও গোলমাল হবে না তো?’

‘হলে হবে। যা আইনের মারফত পাওয়া যাবে তাই যথেষ্ট।’

মাসিমা বললেন, ‘দেখিস বাবা, মেয়েটা ক’দিনের জন্যে এসেছে, কোনও বিপদে যেন না পড়ে। মানুষের মন বড় জটিল ব্যাপার। তোরা কথা বল, আমি একটু রান্নাঘর থেকে ঘুরে আসি।’

মাসিমা চলে গেলে অমলকুমার দীপার দিকে তাকিয়ে হাসল, ‘তা হলে কবে যাচ্ছেন জলপাইগুড়ি ছেড়ে?’

‘আগামীকাল। উকিলবাবু তো বললেন, এখন আমাকে প্রয়োজন নেই!’

‘দীপাবলী, আপনি কাকাবাবুর সমস্ত সম্পত্তি কোনও জনহিতকর প্রতিষ্ঠানকে দান করে দেবেন বলে ঠিক করেছেন। খুব ভাল কথা। কিন্তু কোন প্রতিষ্ঠানকে দেবেন ঠিক করেছেন?’

‘ঠিক করিনি এখনও। তবে রাজনীতির ছোঁওয়া নেই এমন প্রতিষ্ঠানকেই বেছে নেব। এই ধরুন, রামকৃষ্ণ মিশন, ভারত সেবাশ্রম, যারা সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ান। কিন্তু একটা কথা, আপনি যেন ভাববেন না এই দেওয়াটা আমি দিচ্ছি। সম্পত্তি আমার নয়, এই দেওয়াটা আমার গৌরব বা ব্যক্তিগত অহংকারে নয়। অন্যায়ভাবে সংগ্রহ করা সম্পদ যাদের জন্যে ব্যয় হওয়া উচিত তাই করা হচ্ছে।’

‘কাকাবাবু নিশ্চয়ই অন্যায় পথে রোজগার করেছিলেন, কিন্তু কিছু তো পরিশ্রমের বিনিময়ে সৎপথে আয় করা ছিল। তাই না?’

‘হয়তো ছিল। কিন্তু ঘোলা জলের নদীতে পরিষ্কার জলের ঝরনা এসে পড়লে তাকে কিছুক্ষণ বাদে আলাদা করে চেনা যায় না, যায় কি?’

‘চমৎকার। আপনার কথা বলার ধরনটি বেশ ভাল।’

‘বাঃ, শুধু ভঙ্গির প্রশংসা করছেন, বিষয়ের নয়?’

কিছুক্ষণ সব চুপচাপ। উঠোনে গাছপালার ফাঁক দিয়ে এক মায়াবী জ্যোৎস্না কোন ফাঁকে নেমে এসেছে। খুব ভাল লাগছিল দীপার।

অমলকুমার জিজ্ঞাসা করল, ‘পরীক্ষার পর কী করবেন?’

‘বাঃ, খুব ভাল হল। বলুন তো মশাই কী করা যায়? পড়াশুনা চালানো না চাকরি? আমি ভেবে কুল পাচ্ছি না।’

‘পড়াশুনা চালাবার সুযোগ থাকলে তাই করা উচিত।’

‘তা হলে টিউশনি বাড়াতে হয়।’

‘আপনি টিউশনি করেন নাকি?’

‘হ্যাঁ।খরচ চালাতে রোজগার করতে হয়।’

‘বাঃ, খুব ভাল।’

‘কিন্তু সাধারণ চাকরি করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই আমার।’

‘কী ধরনের চাকরি চান? কলেজে পড়াতে গেলে তো বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতেই হবে। ইস্কুলের জন্যে আপাতত দরকার নেই।’

‘না, পড়ানোর চিন্তা মাথায় নেই। অনেকদিন থেকে ভেবেছি আই এ এস-এ বসব। যদি পারি তা হলে ছেলেদের সমান কর্তৃত্ব নিয়ে চাকরি করব।’

‘ভাবনাটায় চিড় ধরল কেন?’

‘ঠিক চিড় ধরেনি একটু হোঁচট খেয়েছি। সরকারের বড় চাকর হলে এমন অনেক অপ্রিয় কাজ করতে হয় যা আমি মানুষ হিসেবে করতে চাই না।’

‘কর্তৃত্ব চাইলে সেটা উপেক্ষা করতে হবে।’

‘সেটাই পারছি না। সমস্যা এখানেই। আপনি বলুন তো কী করি?’

অমলকুমার মুখ তুলে আকাশ দেখল। তারপর বলল, ‘আপনি নিজেকে ছেলে ভাবতে পারলে খুব খুশি হন, না?’

‘ঠিক তা নয়। আমি নিজেকে ছেলেদের থেকে কোনও অংশে দুর্বল ভাবতে রাজি নই?’

‘এতে তো ভবিষ্যতে দ্বন্দ্ব আসতে পারে?’

‘মানে?’

‘কোনও ছেলের সঙ্গে বাস করতে গেলে—!’

‘ও হো, না, তেমন কিছু এখনও মাথায় আসেনি। আর তা ছাড়া ঘর আর বাইরেটা সবসময় আলাদা। আমি কখনও বাইরের জগৎটাকে ঘরে টেনে আনব না। আমি যদি কারও সঙ্গে থাকি তা হলে তাকে প্রথমে আমার বন্ধু হতে হবে তারপরে অন্য কিছু। বন্ধুত্ব থাকলে আর দ্বন্দ্ব লাগবে কেন?’

‘বেশ, আই এ এস-এ বসুন, দেখুন কী ফল হয়। সেইসঙ্গে অন্য কিছু ভাবুন। কলকাতায় যে-সব সুযোগ পাওয়া যায় তা আমি জলপাইগুড়িতে বসে ভাবতে পারব না।’

‘আপনার পরিকল্পনা কী?’

‘এই যেমন চলছে।’

‘আপনাকে ব্যবসায়ী হিসেবে মোটেই মানায় না।’

‘কীসে মানায়?’

‘যদি কলেজে বা স্কুলে পড়াতেন, বইপত্তর নিয়ে থাকতেন?’

‘তা হলে আমি কেমন ছদ্মবেশী বলুন?’

‘বাজে বকবেন না। আচ্ছা, আপনি আমার থেকে কত বড়?’

‘আপনার বয়স জানি না তো!’

‘সত্যি, আপনি বুদ্ধিমান।’

‘এটা গালাগালি, না প্রশংসা।’

‘বেশ, আমি কুড়ি পেরিয়ে একুশ।’

‘আমি পঁচিশ।’

‘তা হলে পড়াশুনা করলেন না কেন?’

‘পড়তে হলে কলকাতায় যেতে হত। মাকে একা ছেড়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি।’

‘যাঃ মাসিমাকে দেখে সেরকম মনেই হয় না।’

‘দেখে মনে হয় না। মায়ের হাঁপানি আছে। খুব বর্ষায় বা শীতে সেটা যখন জানান দেয় তখন কাছে কেউ না থাকলে—সেই সময়ের মায়ের চেহারা আপনি অনুমান করতে পারবেন না। তা ছাড়া পড়াশুনা মানে আমার কাছে আর এম এ ডিগ্রি নয়। অনেক ব্যাপক ব্যাপার। জলপাইগুড়িতে বসে যা বই পাই তাই শেষ করতে পারছি না! যাই বলুন এমন শহরে আমি অনেক শান্তি এবং স্বস্তিতে আছি। কলকাতায় তো বেঁচে থাকতে হলে প্রতিমুহূর্তে যুদ্ধ করতে হয়।’

খুব তৃপ্তির সঙ্গে খাওয়াদাওয়া করে দীপা হস্টেলে ফেরার জন্যে তৈরি হল। অমলকুমারকে মাসিমা বললেন হস্টেলে ওকে পৌঁছে দিতে। রাত সাড়ে আটটাতেও ওকে একা রিকশায় ছেড়ে দিতে তিনি রাজি নন। টিনের গেট পর্যন্ত তিনি দীপাকে জড়িয়ে ধরে এগিয়ে দিলেন। যাওয়ার আগে বললেন, ‘মা, আমি জানি না তোমার সঙ্গে কখনও দেখা হবে কিনা। কিন্তু তোমাকে খুব ভাল লেগেছে আমার। যদি কখনও তোমার আমাদের মনে পড়ে সটান চলে এসো। আসবে তো?’

‘আসব। আপনি আপনার দেওরের পুত্রবধূ হিসেবে আমাকে গ্রহণ করেননি, আমাকে একটা আলাদা মানুষ হিসেবে স্বীকার করেছেন, আপনাকে ভুলব কী করে?’ মহিলাকে প্রণাম করল দীপা। তিনি বুকে জড়িয়ে ধরে চিবুকে আঙুল ছুঁয়ে আদর করলেন। দীপা কোনওমতে নিজেকে ছাড়িয়ে রাস্তায় নামল অমলকুমারের সঙ্গে।

সমস্ত জলপাইগুড়ির রাতের রাস্তা এখন চকচকে জ্যোৎস্নায় ঝকঝক করছে। আশেপাশের বাড়িগুলোর আলো ছাড়া রাস্তায় কোনও আলো জ্বলছে না। ওরা দু’জন চুপচাপ হাঁটছিল সেই জ্যোৎস্না গায়ে মেখে। দিনবাজার পেরিয়ে ওরা বাঁদিকে মোড় নিল। সন্ধের পর জলপাইগুড়ি বড্ড তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ে। হঠাৎ অমলকুমার জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনার হাঁটতে অসুবিধে হচ্ছে না তো?’

‘না।’দীপা মুখ ফেরাল, ‘কিন্তু আপনাকে এত পথ একা ফিরতে হবে!’

‘এরকম জ্যোৎস্নার রাত্রে অনেকদিন পরে হাঁটছি, খারাপ লাগার কথা নয়। অবশ্য—।’ কথাটা বলতে গিয়েও থেমে গেল অমলকুমার।

‘কথা শেষ করুন।’

‘না, ভাল শোনাবে না।’

‘অমল, আমি জীবনে এত খারাপ কথা শুনেছি যে এটুকু বলতে পারি খারাপ লাগার বোধ খুব ধারালো অবস্থায় নেই।’

বলতে চেয়েছিলাম ফেরার সময় আপনি সঙ্গে থাকবেন না, আমার একা ফিরতে হবে সারাটা পথ।

‘আপনাকে এই পথটুকু একা যেতে হবে, কিন্তু আমার কথা ভেবেছেন?’

‘আমি অনুমান করতে পারি।’

‘কী।’

‘আপনিই বলুন।’

দীপা হাসল, অদ্ভুত বিষন্ন হাসি, ‘আমাকে হেঁটে যেতে হবে অনেকটা পথ, একা, একদম একা। সেটা এখান থেকে কলকাতায় নয়। বেঁচে থাকার প্রতিটি দিন, প্রতিটি রাত হয় জাগরণে, নয় স্বপ্নে একা পার হয়ে যেতে হবে। কিন্তু কই, আমি তো আফশোস করছি না!’

‘করছেন না?’

‘না। যা স্বাভাবিক যা সত্যি তাই মেনে নিতে হবে।’

‘কোনটে সত্যি? আপনি যাকে সত্যি বলে এই মুহূর্তে ভাবছেন তা তো সত্যি না-ও হতে পারে। পারে না?’

দীপা চুপ করে রইল। তার সমস্ত শরীর রোমাঞ্চিত হচ্ছিল। এই রোমাঞ্চ অসীমের সঙ্গে কথা বলার সময় হয়নি, শমিত কাছে এলেও হয় না। সে কথা বলার সাহস পাচ্ছিল না। যেন কথা বললেই নিজেকে হারিয়ে ফেলবে। হস্টেলের সামনে পৌঁছে অমলকুমার বলল, ‘আমি দাঁড়িয়ে আছি, আপনি দেখুন, ভেতরে যেতে অসুবিধা হয় কিনা!’

দীপা বন্ধ গেটে শব্দ করতেই দারোয়ান দরজা খুলে উঁকি মারল। দীপাকে দেখে সে দরজার একটা পাল্লা ঈষৎ খুলে দিল।।

দীপা বলল, ‘অমল, আপনি চিঠি দেবেন?’

অমলকুমার মাথা নাড়ল, ‘কাল কখন বেরুচ্ছেন?’

‘সকালে। কিন্তু প্লিজ, আপনি আসবেন না।’

‘কেন?’

‘আমার যেতে খারাপ লাগবে।’

‘ও।’

‘আমাকে কি আপনি বুঝতে পারছেন?’

‘হ্যাঁ।’অমলকুমার বলল, ‘আমাকে?’

‘হুঁ।’

‘তা হলে?’

‘আমি জানি না। আমাকে সময় দিন।’

‘বেশ তাই হবে। তিন দিনে কেউ এর চেয়ে বেশি আশা করতে পারে না। আমি এলাম। আপনি ভালভাবে থাকবেন, ভাল থাকবেন।’অমলকুমার আর দাঁড়াল না। জ্যোৎস্নায় তার শরীর ফিরে গেল। ক্রমশ আড়ালে মিলিয়ে যাওয়ার পর দীপা দারোয়ানকে ডেকে বলল, ‘এবার তুমি গেট বন্ধ করে দাও।’

॥ প্রথম পর্ব সমাপ্ত ॥

দ্বিতীয় পর্ব

অধ্যায় ৫১ / ৫১

সকল অধ্যায়

১. ১. আজ সারাটা দিন সূর্যদেব উঠলেন না
২. ২. মেয়েরা কি ভূত হয়
৩. ৩. ভালো-মন্দ বোঝার বয়স
৪. ৪. রমলা সেন
৫. ৫. সত্যসাধন মাস্টার
৬. ৬. বৃষ্টিটা চলে যাওয়ার পরে
৭. ৭. চারদিন পৃথিবীটাকে দ্যাখেনি দীপা
৮. ৮. দীপাবলীর বিয়ে
৯. ৯. বাসর এবং বউভাত
১০. ১০. দীপাবলীর ফুলশয্যা
১১. ১১. পুত্ৰটি দেহ রেখেছে
১২. ১২. রমলার চিঠি
১৩. ১৩. প্ৰাপ্তবয়স্কতা শরীরের না মনের
১৪. ১৪. চাবাগানের আশেপাশে
১৫. ১৫. আসাম রোড
১৬. ১৬. একটি মানুষের চেহারা
১৭. ১৭. জলপাইগুড়ি শহরে
১৮. ১৯. রমলা সেনের কাছে
১৯. ১৮. পুলিশের লাঠিচার্জ
২০. ২০. জলপাইগুড়ির হোস্টেলের মেয়ে
২১. ২১. দুশ্চিন্তার ছাপ
২২. ২২. একতারা বাজিয়ে গান
২৩. ২৩. দুর্দান্ত ব্যবসাদার প্রতুল বন্দ্যোপাধ্যায়
২৪. ২৪. সত্যসাধন মাস্টার এসে পড়বেন
২৫. ২৫. অমরনাথ হতভম্ব
২৬. ২৬. তিনদিন ধরে সমানে বৃষ্টি
২৭. ২৭. অমরনাথের শরীর
২৮. ২৮. কলকাতা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে
২৯. ২৯. প্রৌঢ় ভদ্রলোকটি হাঁটছিলেন
৩০. ৩০. এক অদ্ভূত অভিজ্ঞতা
৩১. ৩১. বাড়িটা শুধু পুরনো নয়
৩২. ৩২. উত্তর কলকাতার পথে পথে
৩৩. ৩৩. কলেজ এবং হোস্টেলের বাইরে
৩৪. ৩৪. দীপা অঞ্জলির দিকে তাকাল
৩৫. ৩৫. অমরনাথ শুয়ে আছেন
৩৬. ৩৬. ভবিষ্যৎ সম্পর্কে প্ৰচণ্ড অসহায়তাবোধ
৩৭. ৩৭. তিনতলার ব্যালকনি
৩৮. ৩৮. দীপা চুপ করে আছে
৩৯. ৩৯. সুভাষচন্দ্র এগিয়ে এলেন
৪০. ৪০. মেয়েটির নাম লাবণ্য
৪১. ৪১. বিছানায় টান টান দীপা
৪২. ৪২. কলেজের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে
৪৩. ৪৩. কিছু মানুষ খুন হলেন
৪৪. ৪৪. কেমন একটা সংসার-সংসার ভাব
৪৫. ৪৫. রাধা চলে এল সেজেগুজে
৪৬. ৪৬. দ্বিতীয় অভিনয় হয়ে যাওয়ার পরে
৪৭. ৪৭. কলোনি থেকে কলেজ পাড়ায়
৪৮. ৪৮. স্কটিশ চার্চ কলেজে জানাজানি হয়ে গেল
৪৯. ৪৯. একদম লেডি
৫০. ৫০. রমলা সেন চোখ ছোট করলেন
৫১. ৫১. সাতকাহন প্ৰথম পর্ব সমাপ্ত

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন