সমরেশ মজুমদার
বেলা দুটোর সময় রাধা চলে এল। সেজেগুজে। তার দিকে তাকিয়ে হাসল দীপা। মুখে পাউডারের দাগ স্পষ্ট, কানের পাশেও। সে বলল, ‘মুখটা চট করে ঠিক করে নাও। আমার হয়ে গিয়েছে।’
রাধা আয়নার সামনে গেল, ‘আমাদের ঘরটা এমন অন্ধকার না! ভুতের মতো দেখাচ্ছিল, ভাগ্যিস। তখন বললে!’
দরজায় তালা দিয়ে দীপা কাঁধে ঝোলানো ব্যাগের স্ট্যাপটা ধরে বলল, ‘জানো, খুব নার্ভাস লাগছে। কাল রাত্রে নাটকের ওপর লেখা এক সাহেবের বই পড়েছি। সেটা পড়ার পর আরও নার্ভাস হয়ে পড়েছি।’
রাধা হাসল, ‘প্রথমবার বলে এমন হয়। কলেজে যেদিন প্রথম গিয়েছিলাম সেদিনও আমি খুব নার্ভাস ছিলাম। যদি খারাপ হয় আর কোরো না, ব্যস।’
দীপা চুপচাপ হাঁটল। মনে মনে কথাটা মানতে পারছিল না। যে-কাজে হাত দেবে তা শেষ না করে পালিয়ে আসার মেয়ে সে নয়। যতই নার্ভাস হয়ে যাক শেষ মুহূর্তে নিশ্চয়ই সে এটা কাটিয়ে উঠতে পারবে।
রাধা ওর সঙ্গে যাচ্ছিল। আজ তাকে অন্যরকম লাগছে। একটু সাজুলেই কোনও কোনও মেয়ের চেহারা পালটে যায়। দীপার মনে হচ্ছিল আটপৌরে রাধাকেই অনেক ভাল দেখায়। মোড়ের মাথায় বাড়িওয়ালার সঙ্গে দেখা হল। হাতে একটা সাদা কাপড়ের থলে নিয়ে তিনি ফিরছিলেন। ওদের দেখতে পেয়ে একগাল হাসলেন, ‘দুই সখী যাও কোথায়?’
‘নাটক!’ রাধা এক চিমটি হাসল।
‘না না। নাটক দেখা এই বয়সে ঠিক না। মন বিপথে যায়। আর দুইজন একা একা নাটক—সঙ্গে কোনও পুরুষমানুষ নাই, এটাও ঠিক না।’ ঘনঘন মাথা নাড়তে লাগলেন ভদ্রলোক কিন্তু তাঁর চোখ দীপার মুখের ওপর থেকে সরছিল না।
রাধা বলল, ‘আমরা কি বাচ্চা মেয়ে, আপনি কী ভাবেন আমাদের?’
‘সেটাই তো সমস্যা। সবাই আমারে জিগায়, একটা আকাশ থিকা পড়া মাইয়াকে ঘর ভাড়া দিলা তুমি, সে আবার একা থাকে। আমি কই, কোন মানুষ মন্দ কোন মানুষ ভাল তা বুঝতে পারি আমি। তোমরা বাচ্চা হইলে তো এইসব কথা কওয়ার কোনও প্রয়োজনই হইত না। কী রাঁধলা আজ?’
রাধা হাসল, ‘আপনি খাবেন একদিন? বাড়ি থেকে খেতে দেবে?’
‘আর কইও না। কী কষ্টে যে আছি আমি!’ নিশ্বাস ফেললেন উনি।
রাধা আর দাঁড়াল না। দীপার হাত ধরে টেনে বাড়িওয়ালাকে পেরিয়ে চলে এল। খানিকটা দূরত্বে এসে বলল, ‘এই বুড়োর মনে এখনও রং আছে!’
দীপা বলল, ‘উনি যদি শুনতেন আমি অভিনয় করছি তা হলে হয়তো ঘর ছেড়ে দিতে বলতেন। কিন্তু জানো, এরকম আচরণ করেন তো, তবু ওঁকে দেখে আমার একটুও ভয় করে না। মাঝে মাঝে এসব শুনতে খারাপ লাগে না।’
বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছে রাধা যেন একটু আড়ষ্ট হল। একটা খালি বাস ছাড়ছিল কিন্তু তার যেন ওঠার ইচ্ছেই ছিল না। দীপা বলতে মুখ নিচু করল, ‘একটু দাঁড়াও না।’
‘আরে শোয়ের অন্তত দু’ঘণ্টা আগে যেতে বলেছে শমিত। না গেলে যেভাবে বকে তা আমি শুনেছি। দেরি করতে চাই না মোটেই।’
‘আর পাঁচ মিনিট। পরের বাসে যাব।’ রাধা মুখ ঘোরাল।
দীপার সন্দেহ হল, ‘তুমি কি কারও জন্যে অপেক্ষা করছ?’
‘হুঁ!’ হঠাৎ রাধার শ্যামলা মুখেও রক্ত জমল।
‘কে?’
‘আছে একজন! ও তোমার নাটক দেখতে চায়।’
‘তোমার বন্ধু?’
‘বন্ধু ঠিক না, অনেক বড়।’
‘বাঃ, বড় বলে বন্ধু হতে পারবে না?’
‘তা না—!’
দীপা ভাল করে দেখল রাধাকে। ওর এই সাজ, দাঁড়াবার ভঙ্গি, মুখের রং পালটে যাওয়া—এ সবই একটা সত্যি বোঝাচ্ছে। সে সরাসরি জিজ্ঞাসা করল, ‘যার জন্যে অপেক্ষা করছ তাকে তুমি ভালবাসো?’
কথা না বলে মাথা নেড়ে উত্তরটা সে বলে উঠল, ‘কাউকে বোলো না, দাদাকেও না। বাড়ির লোকে শুনলে আমাকে মেরে ফেলবে।’
‘কেন?’
‘ওরা নিচু জাতের। আমাদের পাশের গ্রামে থাকত। ওই যে এসে গিয়েছে।’
রাধার কথা শেষ হতেই দীপা দেখল দূরে একটি যুবক এগিয়ে আসতে আসতে থমকে গেল। কাছে আসবে কিনা সেই চিন্তা করছে এখন। চেহারা মোটেই সপ্রতিভ নয়, বরং বেশ অশিক্ষার ছাপ রয়েছে। সে বলল, ‘ডাকো ওকে।’
চারপাশে তাকিয়ে নিয়ে রাধা মাথা নেড়ে ডাকল নিঃশব্দে। তারপর বলল, ‘ওর নাম গৌরাঙ্গ। তুমি নিজে ওর সঙ্গে কথা বলো, আমি চুপ করে থাকব।’
দীপা অবাক হল। যে-মেয়েটিকে এতদিন সে সংগ্রামী বলে মনে করেছিল, অন্যসময় যে সোজা কথা মুখের ওপর বলে দিতে সংকোচ করে না, তার এমন পরিবর্তন ভাবতে পারা মুশকিল।
গৌরাঙ্গ এগিয়ে এল, এসে বলল, ‘একটু দেরি হয়ে গেল।’
দীপা বলল, ‘ওর মুখে শুনলাম আপনিও নাটক দেখতে চান। চলুন।’
‘কী বই?’
‘বই?’
এবার রাধা নিচু গলায় বলল, ‘নাটকের নাম জানতে চাইছে।’
সিনেমার ব্যাপারে মফস্সলে এখনও বই শব্দটি ব্যবহৃত হয়। এইরকম সময়ে দীপার মনে হয় কলকাতার সঙ্গে মফস্সলের কোনও ফারাক নেই।.গৌরাঙ্গকে নাটকের নাম বলতে সে খুব উৎসাহিত হল বলে মনে হল না। একটু ভেবে জিজ্ঞাসা করল, ‘ঐতিহাসিক বই?’
দীপা হেসে ফেলল, ‘না, সামাজিক।’ তার মনে হল শমিত থাকলে এই লোকটাকে কিছুতেই দর্শক হিসেবে চাইত না।
গৌরাঙ্গ বলল, ‘আমি রাধাকে বলছিলাম, ও তো রোজ ওদিকে যায়, বিশ্বরূপা কিংবা স্টারের টিকিট কেটে আনতে। ওর আর টাইম হয় না।’
‘আহা। টাইম হয় না। সবসময় আমার কাছে অত টাকা থাকে নাকি?’
‘টাকা তো আমি দিতে চেয়েছিলাম। তখন তো নিতে চাওনি।’
এইসময় আর একটি বাস ছাড়ার জন্যে তৈরি হলে দীপা বলল, ‘আর দেরি করা যাবে না। ওঠো।’
বাস খালি ছিল। গৌরাঙ্গ এগিয়ে গিয়ে বসল, দীপার কাছে এল রাধা। দীপা তাকে বলল, ‘ও একা যাবে কেন, তুমি ওর পাশে গিয়ে বসো।’
‘না, ও বসবে না।’ দীপার দিকে না তাকিয়ে বলল রাধা।
‘কেন? তোমরা যখন অন্যসময় দেখা করো তখনও বসে না?’
‘উঁহুঁ। যদি কেউ দেখে ফেলে তা হলে ওর বাড়িতে খুব ঝামেলা হবে।’
‘আশ্চর্য!’
‘এতে আশ্চর্য হচ্ছ? ওর বাড়ির লোককে একবার কাউকে দিয়ে আমার কথা বলিয়েছিল। তারা সঙ্গে সঙ্গে নাকি নাক সিঁটকেছে, খারাপ খারাপ কথা বলেছে।’
‘কেন?’
‘আমি নাকি বাঙাল, বাঙাল মেয়েকে ঘরের বউ করে কিছুতেই নিয়ে যাওয়া যায় না। বাঙালরা নাকি সভ্যতা ভব্যতা জানে না, অবাধ্য হয়।’
‘গৌরাঙ্গ প্রতিবাদ করেনি?’
‘আমার সঙ্গে আলাপ হবার আগে ওরও এরকম ধারণা ছিল।’
দীপা মুখ ফিরিয়ে রাস্তা দেখল। শমিত বলেছে শোয়ের দিন মাথায় অন্য কোনও চিন্তা না ঢোকাতে। কিন্তু এইসব কথা শুনে ওর খুব অস্বস্তি হচ্ছিল। সে সোজাসুজি জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমাকে গৌরাঙ্গবাবু বিয়ে করবে? নাকি তোমরা এমনি বন্ধু।’
‘বাঃ, বিয়ে না করলে আমি মিশব কেন?’
‘গৌরাঙ্গবাবু কথা দিয়েছেন?’
‘না, এখনও দেয়নি। ওই তো বাড়িতে গোলমাল হল—।’
‘যদি বাড়ির চাপে কোনওদিন কথা না দিতে পারেন, রাখা তো দূরের কথা। তা হলে তুমি কী করবে? ভেবেছ?’
‘হুঁ। কিন্তু ওকে যে আমার খুব ভাল লাগে।’
দীপা বলল, ‘রাধা, তুমি খুব ভাল মেয়ে। কিন্তু এটা আমার পছন্দ হচ্ছে না।’
রাধা নিশ্বাস ফেলল। তার সামান্য আওয়াজ যেন বলে দিল সে দ্বিমত নয়।
আজ ম্যারাপ বেঁধে নয়। যারা নাটক করতে ডেকেছে তারা রীতিমতো মিনার্ভা থিয়েটার ভাড়া নিয়েছে। নাটকের আগে কয়েকটা উৎসব হবে, গান বক্তৃতা আবৃত্তির। তার জন্যে স্বেচ্ছাসেবীরা ছুটোছুটি করছে। সুদীপ তাকে দেখতে পেয়ে বলল, ‘ঠিক সময়ে এসেছেন। সোজা এই পাশের দরজা দিয়ে ভেতরে চলে যান। ওখানে সবাই আছে।’
দীপা একটু ইতস্তত করল, ‘আচ্ছা, যদি আমার দু’জন গেস্ট নাটক দেখতে চান তা হলে কি অসুবিধে হবে? ওঁরা আমার পাড়ায় থাকেন।’
‘আচ্ছা! ঠিক আছে, ওঁদের দাঁড়াতে বলুন। আমি দেখছি।’
দীপা রাধাকে ইঙ্গিত করে রওনা হল। পা বাড়াবার আগে চোখে পড়ল গৌরাঙ্গ বেশ কিছুটা দূরে থেকে চালু নাটকের হোর্ডিং দেখছে। পুরুষরা যদি মেয়েদের মতো ভান করে তা হলে আর তাকে পুরুষ বলে ভাবতে ইচ্ছে করে না। মনে হল রাধা ভুল করছে।
মেয়েদের আলাদা সাজঘর আছে এখানে। সেখানে বসে আয়নায় নিজেকে দেখছিল সে। এতখানি স্পষ্ট করে সে নিজেকে কখনও দ্যাখেনি। চোখ নাক চিবুক যদি ঠিকঠাক থাকে তা হলে কি সুন্দর বলা, চলে? মাথা নাড়ল সে। মনটা কিছুতেই সহজ হচ্ছে না, বারংবার মনে হচ্ছে রাধা অন্ধকারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এইসময় দেবেশদা নক করে ভেতরে ঢুকলেন, ‘কী ব্যাপার? আমাকে হাত লাগাতে হবে নাকি? না, প্রথম কাজটা নিজের হাতেই করে ফেলো। আমি সব পাঠিয়ে দিচ্ছি। মুখ গলা হাত পরিষ্কার করে প্রথম পাউডারটা নিজেই লাগিয়ে নাও। তোয়ালে আছে সঙ্গে?’
দীপা মাথা নাড়ল, ‘পরিষ্কার গামছা এনেছি।’
‘বাঃ। তা হলে তো কথাই নেই। তবে পরে একটা ছোট্ট ভোয়ালে কিনে নিয়ো। আমি দেখিয়ে দেব, নিজের মেকআপ নিজেই শিখে যাবে।’ দেবেশদা ঘাড় ঘুরিয়ে বললেন, ‘আমাদের তো এখনও অনেক দেরি আছে শমিত। আগে বাবুরা খেলা করে নিন।’
‘হ্যাঁ, দেরি আছে। কিন্তু তোমার কী হয়েছে দীপা?’ শমিত সামনে এল।
‘কিছু হয়েছে মনে হচ্ছে?’
‘হুম। শোয়ের আগে মনে কিছু রাখা উচিত নয়। বলে ফেলো।’
‘আমার কিছু হয়নি।’
‘কার হয়েছে?’
‘রাধার। আপনি চেনেন।’
‘হ্যাঁ। কী হয়েছে ওর?’
দীপা দেবেশদার দিকে তাকাল। তিনি বললেন, ঠিক আছে বাবা, চলে যাচ্ছি, আমার সামনে তোমাকে কিছু বলতে হবে না।’
‘না না।’ দীপা তাঁকে থামাল, ‘আপনি থাকুন।’ তারপর সমস্ত ঘটনাটা মোটামুটি সংক্ষেপে বলে গেল। শেষ করল, ‘জানেন, আমার একদম এই ব্যাপারটা ভাল লাগছে না।’
শমিত দেবেশদার দিকে তাকাল। ওরা একসঙ্গে হেসে ফেলল।
‘আপনারা হাসছেন?’ দীপা অবাক হল।
শমিত বলল, ‘ওঃ, দীপা! তুমি বড্ড আগে জন্মে গিয়েছ।’
‘মানে?’
‘বাঙালি ছেলেরা প্রেমে পড়লে সাহসী হবেই এমন কোনও ফর্মুলা নেই, আবার প্রেম চলার সময় যে-সব ছেলে পিছিয়ে থাকে তারা সেই মেয়েকে বিয়ের পর খারাপ স্বামী হবে এমন ভাবার কোনও কারণ নেই।’
‘তার মানে এইসব ছেলে শেষপর্যন্ত বিয়ে করে?’
এবার দেবেশদা বললেন, ‘এই অধম তার প্রমাণ ভাই। আমার বাবা ছিলেন সিংহ আর তোমার বউদির বাবা যাকে বলে শঙ্খচূড়। ভয়ে কাছে ঘেঁষতে পারতাম না তোমার বউদির। অবশ্য তখন বউদি হয়নি সে। স্কুলে যেত ঝিয়ের সঙ্গে, বাবার সঙ্গে। আর আমি একপায়ে সেই যাওয়ার পথে দাঁড়িয়ে থাকতাম। একবার চোখাচোখি, ব্যস। তিন বছর বাদে এক সপ্তমীর বিকেলে কথা বলেছিলাম।’
শমিত বলল, ‘সংলাপদুটো বলে দাও।’
দেবেশদা হাসলেন, ‘মণ্ডপে খুব ভিড়। সেই সুযোগে কোনওমতে পাশে পৌঁছে গিয়ে শুকনো গলায় বলতে গেলাম, ‘আমি—।’ কিন্তু তখনই গলার স্বর আটকে গেল। তার উত্তরে মুখ মাটির দিকে নামিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘জানি!’ তারপরও সিংহ আর শঙ্খচূড়ের সঙ্গে লড়াই করতে অনেক সময় লেগেছিল। আর এখন জামাই হিসেবে শঙ্খচূড় আমাকে মাথায় নিয়ে নাচলেও তোমার বউদির সার্টিফিকেট হয়তো এ-জীবনে পাব না।’ কথা শেষ হবার পর কিছুক্ষণ এই ঘরে হাসি থাকল।
শমিত বলল, ‘অতএব দীপাবলী, তোমার ধারণা যে জীবনের সবক্ষেত্রে সত্যি হবে তা ভেবো না। রাধার আর তোমার মানসিকতা তো এক নয়। বাঃ, এই তো মুখের চেহারা পালটে গেল। এবার নিজের চরিত্রটি ভাবো।’
শমিত বেরিয়ে গেল। দেবেশদাও চলে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ ফিরে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘এই যে খুকি, তোমাকে একটা কথা বলি। জীবনে আজ প্রথম স্টেজে নামছ, তাও বড় চরিত্র নিয়ে, কিন্তু সবসময় মনে রাখবে তুমি যা করছ তাই ঠিক। মঞ্চে ঢোকার আগে বাবা মাকে স্মরণ করবে আর শমিতের কাছে আশীর্বাদ নেবে।’
‘কেন?’ খুব অবাক হল দীপা।
‘বাবা মা তোমার জন্মগুরু আর শমিত শিক্ষাগুরু। এদের আশীর্বাদ না থাকলে জীবনে সফল হওয়া যায় না।’ দেবেশদা চলে গেলেন। মনে মনে হাসল দীপা। আর আবিষ্কার করল রাধার ব্যাপারটা মাথা থেকে চলে গিয়েছে।
মেকআপ হয়ে যাওয়ার পর চুপচাপ বসে নিজের সংলাপ পড়ছিল দীপা। একটা কথা এক এক রকম করে বললে তার অর্থও পালটে যায়। শমিত বলেছে, ‘মনে রাখবে নাটক একজন অভিনেতা অভিনেত্রীর ওপর নির্ভর করে না। তোমার সহঅভিনেতাকে সমান সুযোগ দেওয়া তোমার কর্তব্য। দু’জনের মধ্যে যেন সমঝোতা নষ্ট না হয়। তাই রিহার্সালের সময় একভাবে সংলাপ বলে শোয়ের সময় অন্যভাবে বলবে না।’
গতকাল রিহার্সালে যাওয়ার আগে মায়ার বাড়িতে গিয়েছিল। বেচারার জ্বর হয়েছে। দীপা করছে জেনেছিল আগেই। খুব খুশি। জড়িয়ে উড়িয়ে ধরেছিল। ডাক্তার এখনও দিন সাতেক বাড়ি থেকে বেরুতে নিষেধ করেছে। পারলে আজ চলে আসত দীপার অভিনয় দেখতে। কিন্তু যতই খুশি হোক, দীপার মনে হয়েছিল শরীরের জন্যে সে অভিনয় করতে পারছে না বলে গলায় একটা আফশোস ফুটে উঠেছিল ওর।
ডাক পড়ল। মঞ্চের একপাশে গিয়ে দাঁড়াল সে। প্রথম পনেরো মিনিট তার কোনও ভূমিকা নেই। এখন পরদা পড়ে আছে। মাইকে ঘোষণা চলছে। হঠাৎ নিজের নাম কানে এল, ‘দীপাবলী বন্দ্যোপাধ্যায়।’ সঙ্গে সঙ্গে বুকের ভেতর ছ্যাঁত করে উঠল। আর তার পরেই মনে হল যদি সমস্ত সংলাপ ঠিকঠাক মনে না আসে। যদি পরের সংলাপ আগেই বলে ফেলে। শমিত বলেছে, কো’নও প্রম্পটার থাকবে না। আধুনিক নাটকে সংলাপ শুনে বলা হয় না, ওতে অভিনয় যান্ত্রিক হয়।’ অতএব ভুল হলে ধরিয়ে দেবার কেউ থাকবে না।
এইসময় একটি ছেলে তার কাছে এসে চাপা গলায় বলল, ‘দীপাবলীদি, আমি ওই উইংসে থাকব। খেয়াল রাখবেন।’
‘কেন?’
‘শমিতদা বলেছেন আপনার গোলমাল হলে ধরিয়ে দিতে। একটু কান খাড়া রাখবেন। আমি ঠিক ম্যানেজ করে দেব।’
দীপার হঠাৎ রাগ হয়ে গেল। শমিত কি ধরেই নিয়েছে সে ডোবাবে। তাই সবার ক্ষেত্রে যা যান্ত্রিক বলে করা হচ্ছে না তার ক্ষেত্রে সেটা করতে দ্বিধা করছে না। ছেলেটিকে সে বলল, ‘আগে থেকে কিছু বলার দরকার নেই তোমার। আমার ভুল হবে না।’
পরদা ওঠার জন্যে নির্দেশ দেওয়া হলে সে শমিতকে দেখতে পেল। শমিতের পায়ের ধুলো নিতে বলেছিলেন দেবেশদা। সে এগিয়ে গেল, ‘আশীর্বাদ করুন যেন দলের নাম রাখতে পারি।’
শমিত যেন খুব ঘাবড়ে গেল, ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে।’
নাটক শুরু হয়ে গেল। সংলাপ শুনতে শুনতে দীপা সবকিছু ভুলে গেল। মিনিট পাঁচেক বাদে কেউ একজন বলল চাপা গলায়, ‘রেডি তো?’
‘হুঁ।’ সে চোখ বন্ধ করল। জন্মগুরু কে? কার আশীর্বাদ চাইবে এখন? হঠাৎ বন্ধ চোখের পাতায় সত্যসাধন মাস্টারের মুখ ভেসে উঠল। হেঁকে যেন বলছেন, ‘তোমারে জিততেই হইব দীপাবলী, কখনও কোনও কাজে তুমি হারবা না।’ দীপা চোখ খুলে ফেলল। বুক যেন খালি হয়ে গেল। দীপা তারপরেই অমরনাথের মুখ ভাবল। নিঃশব্দে বলল, ‘বাবা, আমাকে আশীর্বাদ করো।’
তখনই পিঠে কেউ আলতো চাপ দিল। সে শুনল তার ঢোকার আগের সংলাপ বলছে অভিনেতা। শেষ হওয়ামাত্র সে ধীরে ধীরে মঞ্চে পা বাড়াল।
উত্তেজনা ছিল। কিন্তু তার লাগাম ছিল শক্ত হাতে ধরা। ফলে পেটে একটু চিনচিনে ব্যথা জন্ম নিয়েছিল। অবশ্য এ সবই অবহেলা করতে পেরেছিল দীপা। সংলাপ বলার সময়ে শব্দের অর্থ স্পষ্ট করতে সচেষ্ট ছিল। সংলাপের বাইরে হাত মুখ চোখের ভূমিকা দর্শককে খুশি করেছিল। আজ ইন্টারভ্যাল দিতে চায়নি শমিত। টানা নাটক শেষ হওয়ামাত্র হাততালিতে লক্ষ পায়রা উড়ল প্রেক্ষাগৃহে। পরদা পড়ার পরে যখন সবাই সারি দিয়ে দাঁড়াল দর্শকের সামনে, পরদা উঠল আবার, তখন সেই একই হাততালি। আর সেই শব্দ দীপার মনে নতুন রোমাঞ্চ আনল।
সাজঘরে এসে বসামাত্র শমিত ঢুকল উদ্ভাসিত মুখে, ‘দারুণ। আমি কোনও ত্রুটি পাইনি। আর শেষ বিহার্সালে যা করেছিলে তার পাঁচ গুণ ভাল আজ। আমি জানতাম দীপাবলী, তুমি পারবে। আমি গর্বিত কারণ তোমাকে আবিষ্কার করতে পেরেছি।’
দেবেশদা থেকে অনেকেই এসে তাকে অভিনন্দন জানিয়ে যাচ্ছিল। এত প্রশংসায় ডুবে গিয়ে দীপা লজ্জায় যেন মাথা তুলতে পারছিল না। এইসময় রাধা চলে এল সাজঘরে। ঢুকেই দু’হাতে দীপাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘উঃ, তুমি এত ভাল অভিনয় করো? আমি ভাবতেই পারিনি।’
বাধার আলিঙ্গনে আবদ্ধ হয়েও দীপা হঠাৎ কেঁপে উঠল। সে ভাল অভিনয় করতে পারে? কার সঙ্গে? যাঁরা অভিনয় করেন তাঁরা অভিনেত্রী। সে তো অভিনেত্রী হতে চায়নি কখনও। ভাগ্য তার সঙ্গে অভিনয় করেছে বারংবার। তা হলে? কিন্তু এই ভাবনা বেশিক্ষণ থাকল না। অন্যেরা কথা বলছিল। রাধা তাড়া দিচ্ছিল, দেরি হয়ে গিয়েছে বেশ। সঙ্গে গৌরাঙ্গ থাকলেও বেশি রাত্রে কলোনিতে ফেরা ঠিক নয়। শমিত জিজ্ঞাসা করেছিল দীপাকে পৌঁছে দিতে হবে কিনা! দীপা মাথা নেড়ে বলেছিল ‘তিনজন একসঙ্গে আছি!’
কাল সন্ধে ছ’টায় বিহার্সাল।’
‘আবার কাল?’
‘বাঃ। একদিন শো কবেই হয়ে যাবে?’
‘কিন্তু আমি এই তিনটে শোয়ের পর আর করব না।’
‘কেন? এ-কথার মানে কী?’ শমিত হকচকিয়ে গেল।
‘আমার ক্ষতি হচ্ছে। এখন না হয় কলেজ ছুটি। খোলা থাকলে সকালে বেরিয়ে রাত দশটায় বাড়ি ফিরলে পড়ব কখন? আমি তো কলকাতায় পড়তে এসেছি।’
‘কেন, যে চুল বাঁধে সে রাঁধে না? মায়া পড়াশুনা আর নাটক একসঙ্গে করছে না?’ শমিত বিড়বিড় করল, ‘ঠিক আছে, এ নিয়ে পরে কথা হবে।’
কলোনিতে ফিরতে বেশ রাত হয়ে গেল। গৌরাঙ্গ বাস স্ট্যান্ড থেকে সরে গিয়েছে। দীপার বেশ মজা লাগছিল। নাটক দেখতে বসে ওদের মধ্যে কী কথা হয়েছিল জানা নেই, কিন্তু এই যাওয়া আসার পথে দু’জন যেন কেউ কাউকে চেনে না এমন ভান করে বসে ছিল। এমনকী বাস থেকে নেমেও গৌরাঙ্গ শুধু একবার ‘চলি’ ছাড়া কিছু বলেনি। দীপা আছে বলে এই আড়ষ্টতা কিনা তা বোঝা যাচ্ছে না। বাস স্ট্যান্ড থেকে কয়েক পা এগোতে-না-এগোতে একটা মাতালের দেখা পেয়েছিল ওরা। ভয় পেয়েছিল দু’জনেই। পরস্পরের হাত ধরে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। ছোট রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে মাতালটা বকর বকর করছিল। ওদের দেখতে পেয়ে বলে উঠল, ‘আসুন, আসুন মা লক্ষ্মীরা, কী সৌভাগ্য, মধ্যরাত্রে লক্ষ্মীর আগমন।’
রাধা দীপার দিকে তাকাল। দীপা বিরক্ত হয়ে বলল, ‘সরে যান সামনে থেকে।’
‘সরেই তো আছি। বউ ভেগেছে বন্ধুর সঙ্গে, আমি সরে ছিলাম। এই দেখুন সরে যাচ্ছি। এক দুই তিন।’ সরতে সরতে একেবারে নর্দমায় গিয়ে দাঁড়াল লোকটা, ‘দেখুন যমুনায় চলে এলাম। রাস্তাটাকে নিয়ে আপনারা চলে যান।’
জোরে পা চালিয়েছিল ওরা। পাড়া নিঝুম। বাড়ির সামনে পৌঁছে রাধা বলল, ‘আজ খুব বকুনি খাব। দরজা না খোলা পর্যন্ত তুমি একটু দাঁড়াবে?
দীপার খুব খিদে পাচ্ছিল এবং সেইসঙ্গে চিনচিন ব্যথা পেটে ছড়িয়ে পড়ছিল। তবু সে দাঁড়াল। উঠোনে ঢুকতেই ওর মায়ের গলা পাওয়া গেল, ‘এই যে, আইছে, এক তুর দাদারে নিয়ে আমি পাগল, রাইত দুপুর না হইলে সে ঘরে ফেরে না দোকান বন্ধ কইরা, তার উপর তুই আইলি এখন! ভাবছিস কী? আমি মইর্যা না যাইতেই এই অবস্থা? কুথায় ছিলি, ক আমারে?’
‘দীপার সঙ্গে নাটক দেখতে গিয়েছিলাম। শ্যামবাজার।’
‘সেখানেই থাকলে পারতিস তো৷ মিইয়া মানুষ রাত দুপুরে ঘরে ফেরে, পাঁচজনে এখন মুখ বন্ধ কইর্যা থাকব, না?’
দীপা আর দাঁড়াল না। নির্জন রাস্তা দিয়ে হাঁটতে গা ছমছম করছে। রাস্তা থেকে নেমে বাড়ির ভেতরে ঢুকে দেখল সব অন্ধকার। বাড়িওয়ালাদের কেউ জেগে নেই। তার বারান্দার ওপর একটা সাদা বেড়াল বসে আছে। তাকে এগোতে দেখে সে ম্যাও বলে ডেকে সামান্য সরে বসল। তালা খুলে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করল দীপা। বাইরের পোশাকেই বিছানায় শরীর এলিয়ে দিয়ে মড়ার মতো পড়ে রইল কিছুক্ষণ। খিদে পেটের ব্যথা ক্লান্তি ছাপিয়ে আর একধরনের কষ্ট যেন ডালপালা মেলে ঝাঁপিয়ে পড়েছে তার ওপর। এই ঘরে ওই রাস্তায় শুধু নয়, সমস্ত পৃথিবীতে সে একা, একদম একা। রাত করে বাড়িতে ফিরলেও কেউ দুটো কথা শোনাবার নেই। শাসন শুনতে যতই খারাপ লাগুক যে-মানুষের জীবনে শাসন করার মানুষ না থাকে তার মতো অভাগা আর কে আছে!
সকালবেলায় ঘুম ভাঙল বেশ দেরি করে। ধড়মড়িয়ে উঠে বসে দীপা আবিষ্কার করল কাল যে অবস্থায় ঘরে ঢুকে খাটে শুয়েছিল সেই অবস্থায় রয়েছে এখনও। কাপড় ছাড়া খাওয়াদাওয়া কোনও কিছুই হয়নি কাল। ছোট আয়নায় মুখ দেখল সে। কুৎসিত দেখাচ্ছে বলে মনে হল। কাল রাতের মেকআপের অবশিষ্টাংশ এখনও লেগে আছে নাকের পাশে, ওপর- কপালে। কেমন তেল চিটচিটে হয়ে আছে পুরো মুখ। বাসি মুখেই স্টোভ ধরিয়ে জল বসিয়ে দিয়ে গামছা নিয়ে দরজা খুলে সে কলতলায় গেল। দরজা খুলে যাওয়া নিয়ে এখানে কোনও সমস্যা হয়নি এখন পর্যন্ত। পরিষ্কার হতে গিয়ে হঠাৎ এক ধরনের স্বস্তি পেল দীপা। কাল রাত্রে না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে তার একটা লাভ হয়েছে। গরম তেমন নেই এখন। তরকারি ভাত নষ্ট হয়েছে বলে মনে হয় না। এখনই একটু গরম করে রাখলে দুপুরে দিব্যি চলে যাবে। অন্তত আজকের সকালে রান্না করার ঝামেলা রইল না। ভাবতেই বেশ আরাম লাগছে।
চা খাওয়া শেষ হবার পর বই নিয়ে বসেছিল। পাতায় চোখ রাখতে-না-রাখতেই বারান্দায় কেউ গলা খাঁকারি দিল। সে উঠে বসল, ‘কে?’
‘আমি’ বাড়িওয়ালার গলা।
দীপা ঠোঁট কামড়াল। তারপর উঠে ভেজানো দরজা খুলে বাইরে এসে দাঁড়াল। বাড়িওয়ালার মুখে হাসি, ‘কাল আর পারলাম না। ঘুমাইয়া পড়ছিলাম। কখন ফিরলা তোমরা?’
‘একটু রাত হয়ে গিয়েছিল।’
‘এত রাতে আসা যাওয়া ঠিক না। কার কী মতলব জানো না তো। এখন তোমাদের উঠতি বয়স, ভরা যৌবন, এখনই তো বাঁধ দেওয়া দরকার। বুঝলা?’
মাথা নাড়ল দীপা, না।
‘আরে এখন একটু নিয়মকানুন মানা দরকার। মাইয়া মানুষ মাইয়া মানুষের মতো থাকলে কোনও বিপদ হয় না। অত্যন্ত চিন্তায় ফেলছিলা আমারে।’
‘আমি চেষ্টা করব যাতে এত দেরি না হয়।’
‘বাঃ, গুড। এই দ্যাখো, যে জন্যে আইছিলাম, নাও, চিঠি আইছে।’ হাত বাড়িয়ে একটা খাম দিলেন বাড়িওয়ালা। দিয়ে ফিরে গেলেন।
এ-বাড়িতে আসার পর এই প্রথম চিঠি এল। খামের মুখ খুলতে খুলতে মনোরমার মুখ মনে পড়ল তার। কিন্তু চিঠির তলায় চোখ রেখে সে অবাক। গোটা গোটা অক্ষরে লেখা রয়েছে ‘অঞ্জলি’।
এই প্রথম, কলকাতায় আসার পর এই প্রথম মায়ের চিঠি এল। মা! অঞ্জলি মা শব্দটি লিখতে পারেনি। দীপা চিঠির গোড়ায় চোখ রাখল। ‘স্নেহের দীপা, আশা করি কলিকাতায় তোমার মন বসিয়া গিয়াছে। আগে এক পত্রে জানিয়াছিলাম যে তুমি হস্টেল ছাড়িয়া বাসা ভাড়া করিয়া আছ। ভাল। তুমি নিজের পায়ে দাঁড়াইতে পারলে তাঁহার আত্মা সুখী হইবেন। আমাদের পছন্দ অপছন্দের কথা আজ নতুন করিয়া কিছু বলার নাই।
‘যা হোক, তোমাকে একটি দুঃসংবাদ দিবার জন্য এই পত্র লিখিতে বাধ্য হইতেছি। ইচ্ছা ছিল তোমাকে বিরক্ত করিব না কিন্তু তোমার ঠাকুমা প্রতিনিয়ত তোমাকে খবর পাঠাইতে বলিতেছেন। দিন চারেক আগে আমাদের নতুন বাড়ির উঠানে পা পিছলাইয়া তিনি পড়িয়া যান। তাঁহাকে কেউ উঠোন নিকাইতে বলে নাই তবু তিনি ওই কাজ করিতে গিয়াছিলেন। তাঁহার যন্ত্রণা দেখিয়া আমি ডাক্তার ডাকিতে বাধ্য হই। ডাক্তার আসিয়া বলিল সম্ভবত তাঁহার পায়ের হাড় ভাঙিয়া গিয়াছে। উহার ছবি তুলিতে হইবে। এইস্থানে ছবি তুলিবার কোনও ব্যবস্থা নাই। সুতরাং জলপাইগুড়িতে লইয়া যাইতে হইবে। প্রয়োজনে অপারেশন করিতেও হইতে পারে। তাঁহাকে জলপাইগুড়ি শহরে লইয়া যাওয়ার জন্যে আলাদা গাড়ি ভাড়া করা প্রয়োজন। হাসপাতালে চিকিৎসার জন্যে যথেষ্ট অর্থ দরকার। আমার পক্ষে এই ব্যয়ভার একা বহন করিবার শক্তি নাই। তোমার মামা এক পত্রে জানাইয়াছিল যে তুমি নাকি ছাত্রী পড়াইয়া রোজগাব করিতেছ। তোমার মৃত শ্বশুরমহাশয়ের অর্থ নিশ্চয়ই সঞ্চয়ে আছে। এই ঠাকুরমার সহিত তোমার খুব ভাব ছিল। তাই লিখি, যদি সম্ভব হয় অন্তত তিনশো টাকা অবিলম্বে পাঠাইয়া দিলে চিকিৎসার সুবন্দোবস্ত হয়। এখন তোমার বিবেক যাহা বলে তাহাই করিয়ো। ইতি আশীর্বাদিকা, অঞ্জলি।’
নাতিদীর্ঘ চিঠিটি পড়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল দীপা। তারপর চিঠির তারিখ দেখল। তিন দিন আগে লেখা। তার মানে মনোরমা অসুস্থ হয়েছেন দিন সাতেক আগে এবং এই সাত দিন তেমন কোনও চিকিৎসা হয়নি।
কী করবে ভেবে পাচ্ছিল না দীপা। ইচ্ছে হচ্ছিল এখনই টিকিট কেটে চা-বাগানে চলে যেতে। মনোরমার এমন কিছু হলে অমরনাথ স্থির থাকতে পারতেন না। কিন্তু অঞ্জলি একবারও তাকে চলে আসার কথা লেখেননি। তার কাছে কত টাকা আছে এবং তাতে কতদিন চলতে পারে এ ধারণাও নিশ্চয়ই ওঁর আছে। তা সত্ত্বেও তিনি টাকা চাইতে দ্বিধা করেননি। মামা এর মধ্যে কবে হস্টেলে এসেছেন, কার কাছ থেকে টিউশনির খবর পেয়েছেন তা ঈশ্বর জানেন। সঙ্গে সঙ্গে কথাগুলো চা-বাগানে জানিয়ে দিতে ইতস্তত করেননি। পড়াশুনা মাথায় উঠল। টাকাপয়সা, মানুষের ব্যবহার ইত্যাদি ছাপিয়ে মনোবমার মুখ মনে পড়ছিল বারেবারে। তার জীবনে অনেক অসংগতি এসেছে হয়তো এই ভদ্রমহিলার জন্যে। বিয়েটাই তো মনোরমা না থাকলে শেষপর্যন্ত হত কিনা সন্দেহ। বিধবা হবার পর তিনিই বাধ্য করেছিলেন ওইসব নিয়মকানুন মেনে চলতে। বাঙালির যা কিছু অন্ধত্ব তাই নিয়ে বাস করেন ওই প্রায়-বৃদ্ধা মহিলা। এ সবই সত্যি। কিন্তু দিনের পর দিন বছরের পর বছর একসঙ্গে থেকে, প্রায় প্রতিটি রাত শরীরের একই গন্ধ পেয়ে পেয়ে যে সম্পর্ক ভেতরে ভেতরে তৈরি হয়ে গিয়েছিল, তাকে অস্বীকার করবে সে কী করে? অন্তত এই মুহূর্তে পৃথিবীতে একটি মানুষের কাছে তার চাহিদা আছে। একটি মানুষ বিপদে পড়লে তার কথা ভাবে। আজকেই তার চলে যাওয়া উচিত।
তারপরেই মনে পড়ল শমিতের কথা, নাটকের কথা। সে কথা দিয়েছে অন্তত তিনটে শো সে করে দেবে। গতকাল দলের ছেলেদের মুখে সে যে-হাসি, কাজে যে-উৎসাহ দেখেছে তা এক দমকায় নিবে যাবে এই সিদ্ধান্তে। চা-বাগানে গিয়ে ওই প্রতিকূল পরিবেশে সে বিশেষ কিছু করতে পারবে না। মনোরমাকে ওই বাড়িতেই থাকতে হবে। অথচ চলে গেলে এখানে কথার খেলাপ করতে হবে। কথা দিয়ে কথা না-রাখা মানুষই প্রকৃত চরিত্রহীন।
তিনশো নয়, পাঁচশো টাকা মনিঅর্ডার করল দীপা মনোরমার নামে। ফর্মের নীচে সে কোনও শব্দ লিখল না।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন