১৪. চাবাগানের আশেপাশে

সমরেশ মজুমদার

চা-বাগানের আশেপাশে যে-সমস্ত সরকারি জমি খালি পড়ে ছিল সেগুলোর দিকে কেউ নজর দিত না। বার্নিশঘাট পেরিয়ে লঙ্কাপাড়া অথবা হয় ময়নাগুড়ি লাটাগুড়ি নয় বানারহাট হয়ে সেবক পর্যন্ত, আর ওদিকে কুচবিহার আলিপুরদুয়ারে যাওয়ার পথে দু’পাশে তাকালে হয় জঙ্গল, নয় বুনো ঝোপ আর ফাঁকা মাঠ চোখে পড়বে। সেইসব মাঠের সর্বত্র লাঙলও পড়ে না। মদেশিয়ারা তো চা-বাগানের কাজেই অভ্যস্ত— রাজবংশী সম্প্রদায়, যাঁদের ভূমিপুত্র বলা যায়, তাঁরাও বিচ্ছিন্নভাবে বাস করেন। সরকারের মনের অবস্থা এইরকম, চা-বাগান তার সীমানার মধ্যে স্থির থাক, আমরা আমাদের মতো আছি। এখনও চা-বাগানে মাঝেমধ্যে বাঘ বের হয়। সাপ তো আছেই। হাতির দল বেখেয়ালে চলে আসে রাজবংশীদের গ্রামে, মদেশিয়াদের কুলি লাইনে। তবে এরকম ঘটনা বেশি ঘটে না। এখনও গঞ্জে গঞ্জে শিকারিরা আছেন যাঁরা পুরনো বন্দুক নিয়ে বাঘ কিংবা হরিণ মারতে বের হন। চা-বাগানের ম্যানেজাররা অবশ্য এ-ব্যাপারে অনেক সুবিধে ভোগ করেন।

দ্বিখণ্ডিত ভারতবর্ষের পরবর্তী প্রতিক্রিয়ায় দক্ষিণবঙ্গ যেভাবে আক্রান্ত হয়েছিল ঠিক সেইভাবে প্রথমদিকে চা-বাগানগুলো হয়নি। পূর্ববাংলার মানুষেরা এইরকম আদিম পরিবেশে চট করে আসতে চাননি। এখানে জীবিকার সম্ভাবনা খুব কম ছিল। চা-বাগানের বাবুর চাকরি সীমিত। যাঁরা করছেন তাঁরা প্রায় বংশানুক্রমেই করে যাচ্ছেন। চা-শ্রমিকদের কাজে পূর্ববাংলার মানুষ নিজেকে নিয়োগ করার কথা ভাবতেই পারতেন না। এটা পশ্চিমবঙ্গের মানুষ সম্পর্কেও প্রযোজ্য। অন্য কোনও শিল্প অথবা অর্থ উপার্জনের পথ না থাকায় এদিকটায় মানুষের ঢল প্রথমে নামেনি।

কিন্তু জলের সঙ্গে মানুষের স্বভাবের কিছুটা মিল আছে। অবরুদ্ধ হলেই একটা পথ খুঁজে নিতে দেরি হয় না। স্বাধীনতার সাত-আট বছর পর থেকেই ঢলটা নামল। যে-যার মতো গোরু-ছাগল চাষের জমি কিনে নিয়ে ডুয়ার্সের বিশাল ফাঁকা এলাকায় চলে আসতে আরম্ভ করলেন। ফলে প্রথমেই কাঠের ব্যবসায়ীদের সংখ্যা বাড়ল। এবং সেইসঙ্গে জমি জবরদখল করে গঞ্জ এলাকার কাছেই কলোনি তৈরি শুরু হয়ে গেল। এই ব্যাপক অনুপ্রবেশের বিরুদ্ধাচরণ করার ক্ষমতা সরকারের ছিল না। এতদিন মদেশিয়া নেপালি পশ্চিমবঙ্গীয় ভাষা ইতস্তত শোনা যেত। এখন তাদের সবাইকে ছাপিয়ে পূর্ববাংলার ভাষা এল। কিন্তু মুশকিল হল যেহেতু পূর্ববাংলার জেলাভিত্তিক ভাষার চেহারা আলাদা, চট্টগ্রামের মানুষের সঙ্গে যশোরের মানুষ একই গলায় কথা বলতে পারে না, তাই এখানে এসে একটি সংকর ভাষা তৈরি হল। ডুয়ার্সে যেসব মানুষ বেশি এসেছিলেন তাঁদের বাড়ি ছিল রংপুর রাজশাহী ইত্যাদি জেলায়। ঢাকার কিছু মানুষও দিগ্ভ্রান্ত হয়ে এদিকে চলে এসেছিলেন। এই সংকর ভাষার সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ প্রথমে মিলতে না চাইলেও শেষপর্যন্ত আলাদা হয়ে থাকতে পারলেন না।

চা-বাগানের গায়েই এখন প্রায় ঘনবসতি। অবশ্য তা বাজার এলাকাকে ঘিরেই। স্কুলের ছাত্রসংখ্যা বাড়তে লাগল। ব্যাপারটা এমন হয়ে দাঁড়াল যে স্কুলবাড়িতে আর জায়গা কুলোচ্ছিল না। ফলে নতুন স্কুলবাড়ি তৈরি হল। নবাগতদের মধ্যে যাঁরা ম্যাট্রিক পাশ করেছিলেন কোনওমতে তাঁদের কেউ কিছু করার না পেয়ে মাস্টারিতে যোগ দিলেন।

চা-বাগানের মানুষেরা প্রথমে পূর্ববঙ্গের মানুষদের পছন্দ করেননি। কিন্তু সংখ্যায় নবাগতরা এমনই বিপুল ছিল যে প্রতিবাদ মনে মনেই থেকে গেল। তাঁরা প্রতি মুহূর্তে পূর্ববঙ্গের মানুষের জীবনযাপনের পদ্ধতিতে ছিদ্র অন্বেষণ করতেন। এ-ব্যাপারে মনোরমার সঙ্গে বড়বাবুর বাবা তেজেন্দ্রর কোনও মতপার্থক্য ছিল না। ব্যাপারটা অমরনাথের মধ্যেও অসংক্রমিত ছিল না। ছেলেদের কথার মধ্যে পূর্ববঙ্গের ভাষা হুড়মুড় করে ঢুকে পড়েছে। একা সত্যসাধন মাস্টার এতদিন ছিলেন কিন্তু এখন তো হাজার হাজার সত্যসাধন ছড়িয়ে পড়েছেন চারধারে। একমাত্র বাঁচোয়া তাঁরা চা-বাগানের এলাকায় ঢুকতে পারেননি। বাজার এবং বাস রাস্তার দু’পাশে তাঁরা বসতি স্থাপন করে ফেললেন। প্রচণ্ড সংগ্রামের সময় কে তাদের অপছন্দ করছে সেদিকে লক্ষ করলেন না। খুব অল্পদিনেই বাজার এলাকার যা কিছু সামাজিক কাজকর্ম তা ওঁদের দখলে গেল। পুজো পার্বণ বেড়ে গেল এবং সেইসঙ্গে বঙ্গে বর্গী, সিরাজ, দুইপুরুষ ইত্যাদি নাটকের অভিনয় শুরু হয়ে গেল সেইসময়। এখন আর বোঝাই যায় না এঁরা পূর্ববাংলা ছেড়ে আসতে বাধ্য হয়েছেন, বাস ট্যাক্সি লরি থেকে পানবিড়ি সিগারেটের ব্যবসায় তাঁরা ছড়িয়ে পড়লেন। অতি স্বাভাবিকভাবেই এঁদের হাতে কাঁচা পয়সা আসতে লাগল। প্রথমদিকে জীবন ধারণের পক্ষে তা অতি সাধারণ হলেও কেউ কেউ ক্রমশ অর্থবান হয়ে উঠলেন। মুখার্জি রায়েদের শ’-মিলের পাশাপাশি পালেদের শ’-মিল চালু হল। কিন্তু অনুপ্রবেশ হওয়া সত্ত্বেও চা-বাগান তার অতীত ঐতিহ্য এক জায়গায় ধরে রাখতে পেরেছিল। নবাগতদের মধ্যে শিক্ষার ছাপ ছিল খুবই কম। জীবনসংগ্রামে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় শিক্ষার দিকে তাঁরা নজর দিতে পারেননি। ফলত, তাঁদের পরিবারের মহিলারাও পূর্ববঙ্গ থেকে বয়ে আনা সংস্কার এবং ধর্মান্ধতা আঁকড়ে ছিলেন। মেয়েদের বিয়ের আগে বা পরে চা-বাগানের রাস্তায়, গঞ্জের পথে দেখা যেত না। অন্তত যৌবন এলে তো নয়ই।

একমাত্র ললিতা এ-ব্যাপারে ব্যতিক্রম। কোয়ার্টার্সের সবাই অবাক হয়ে দেখত শ্যামলকে বিয়ে করার পর ললিতা তাকে নিয়ে সন্ধের আগে আসাম রোড ধরে চা-বাগানের দিকে বেড়াতে যায়। তেজেন্দ্র নিজের চোখে দেখেছেন কোয়ার্টার্সের এলাকা ছাড়িয়ে গেলেই ললিতা শ্যামলের কনুই ধরে হাঁটে। এইসময় ললিতা পরিপাটি করে চুল বাঁধে, ভাল শাড়ি কায়দা করে পরে, মাথায় ফুলও গোঁজে। এই নিয়ে প্রথমদিকে সবাই খুব হাসাহাসি করেছিল। যে-মেয়ে বিষ খেয়ে যমের বাড়িতে প্রায় পৌঁছে গিয়েছিল সে এত গদগদ প্রেম দেখাবে— এটা মুখ বুজে সইতেই হবে এমন ভাবা অন্যায়। কিন্তু পরবর্তীকালে অনেকেই উষ্ণ হয়ে উঠলেও এ-ব্যাপারে কেউ সরাসরি শ্যামলকে কিছু বলতে পারলেন না। হরিদাসবাবুর মৃত্যুর পর শ্যামল স্বাভাবিকভাবেই চাকরিটা পেয়েছিল। সাহেব নিজে শ্যামলকে ডেকে চাকরি দিয়েছিলেন একটাই শর্তে, ললিতাকে বিয়ে করতে হবে। শ্যামল এক পায়ে খাড়া ছিল। বিয়ে হয়ে গেল, কিন্তু একবছর অতিক্রান্ত হয়ে গেলেও যখন ললিতা মা হল না তখন সবাই হতভম্ব। বীণাবউদি গালে হাত দিয়ে বলেছিলেন, ‘ওমা, পেটে পেটে এত। এই শুনলাম পেটে বাচ্চা এসেছে বলে মেয়েটা আত্মহত্যা করতে গিয়েছিল। সেটা গেল কোথায় গো!’ কেউ বলল, জলপাইগুড়ির হাসপাতালে ললিতা যখন ছিল তখনই নাকি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। আবার কারও মতে ওসব কিছু নয়। বিষ খেয়েছিল মনের জ্বালায়। মেয়ের দোষ ঢাকার জন্যে সেইসময় মালবাবুর বউ কেঁদেকেটে গল্পটা ফেঁদেছিলেন। ললিতা যদি মরে যেত তা হলে ওই কারণে শ্যামলকে হয়রান করা যেত। বেঁচে থাকলে বিয়ে করতে বাধ্য হবে। তা চালটা খুব ভাল কাজ করেছে। কিন্তু যাদের নিয়ে এত কথা তারা যেন গ্রাহ্যই করছে না। শ্যামল কাজে যায়। ফিরে এসে বাড়িতেই থাকে অথবা ললিতার সঙ্গে বেড়াতে বেরোয়। ফুটবল ছেড়েছে, লাইব্রেরির দায়িত্ব নিচ্ছে না। ললিতা আগেও কারও সঙ্গে কথা বলত না, এখন তো তার নাক আরও উঁচু হয়েছে।

দীপার কিন্তু ললিতাকে ভাল লাগে। কেমন সাহসী। কিন্তু সেইসঙ্গে শ্যামলের ওপর একধরনের শ্রদ্ধা তৈরি হয়েছে তার। চা-বাগানের ভেতর ললিতা যখন ভয় পেয়েছিল তখন শ্যামল তাকে ভরসা দিয়েছিল। সেই কথাটা অন্তত রেখেছে। অবশ্য লক্ষ্মীজেঠিমা যখন এসে ঠাকুমার কাছে ললিতামাসি সম্পর্কে অভিযোগ করে তখন ভাল লাগে না। চেনাজানা পৃথিবীতে একমাত্র তার মা এবং ঠাকুমা ছাড়া কোনও শাশুড়ি বউমার মধ্যে সদ্ভাব দেখতে পায়নি সে। বিছানায় শুয়ে সে মনোরমাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি তোমার বউমাকে সহ্য করো কী করে ঠাম্মা?’

মনোরমা চাল বাছছিলেন। অবাক হয়ে তাকালেন। জলপাইগুড়ি থেকে পরীক্ষা দিয়ে ফেরার দু’দিন পরে ইনফ্লুয়েঞ্জাতে পড়েছে দীপা। আজ সকাল থেকে জ্বর নেই। মোটেই ইচ্ছে নেই তাকে ভাত দেবার। অমরনাথকে বলেছেন ডাক্তার জলখাবার খেয়ে যখন ডিসপেন্সারিতে যাবে তখন যেন দীপাকে দেখে যায়।

দীপা হাসল, ‘তোমার সংসারে একটি অন্য বাড়ির মেয়ে কর্তৃত্ব করছে তা তুমি সহ্য করছ কী করে ভেবে পাই না।’

মনোরমা হাসলেন, ‘তোর মা তো খুব ভাল মেয়ে।’

‘খারাপ কে বলেছে। তোমার সঙ্গে সব ব্যাপারে বনে?’

‘সব ব্যাপারে বনতে পারে?’

‘তা হলে মেনে নেয় তোমাকে, এই তো। কিন্তু মনে মনে খুশি নিশ্চয়ই হয় না। উলটো ব্যাপার হলে তুমিও হও না। তোমরা ঝগড়া করো না কেন বলো তো?’

‘এই, আজ তোর কী হয়েছে বল তো?’

দীপা জোরে জোরে হেসে উঠল, ‘মা বলছিল ইচ্ছে হলে ভাত খেতে পারি। তুমি বলছ রুটি খেতে। তোমরা ঝগড়া করে ঠিক করে নাও না।’

মনোরমা গম্ভীর হলেন, ‘সেটা ডাক্তারবাবু এসে ঠিক করবেন।’

দীপা জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমার শাশুড়ি তোমার সঙ্গে ঝগড়া করতেন?’

মনোরমা হেসে ফেললেন, ‘দ্যাখ ঝগড়া হয় দু’জনে মিলে। একপক্ষ বকে যাচ্ছে অন্যপক্ষ চুপ করে আছে, এতে ঝগড়া হয়? বাপের বাড়ি থেকে আমাদের শেখানোই হয়েছিল গুরুজনদের মুখের ওপর কথা না বলতে। উনি বকতেন যাতে আমার শিক্ষা হয়। জীবনের অনেক কিছুই তো জানতাম না তখন।’

‘তোমার আড়ালে অন্যদের কাছে নিন্দে করতেন না?’

‘আড়ালে কেন, সামনেই বলতেন। রাঁধতে জানে না, কাজকর্মে ছিরিছাঁদ নেই, দুপুরে পড়ে পড়ে ঘুমোয়। তা আমি তো সত্যি রাঁধতে ভাল জানতাম না আর ঘুমোতেও ভালবাসতাম খুব। সেটা তো সত্যি কথা।’

‘খোঁটা দিত না?’

‘তা দিত। তোর শাশুড়ি যদি সুযোগ পেত তা হলে ছাড়ত?’

‘আমার শাশুড়ি! তোমাকে বারবার বলেছি সেই মহিলা আমার কেউ নয়। ওদের বাড়ির কেউ আমার কিছু নয়। তুমি ও-বাড়ির কথা আমার কাছে বলবে না।’ আচমকা গলা বেড়ে গেল দীপার।

মনোরমা মাথা নাড়লেন, ‘সাত পাকে বাঁধা পড়েছিল অগ্নিসাক্ষী করে, সম্পর্ক কি আর এ-জীবনে অস্বীকার করতে পারবি?’

এইসময় অঞ্জলির গলা শোনা গেল, ‘আসুন ডাক্তারবাবু।’

মনোরমা চাল রেখে উঠে দাঁড়িয়ে ঘোমটা টানলেন। ডাক্তারকে দরজায় দেখা গেল, ‘কী খবর? পরীক্ষা কেমন হল?’

দীপা মাথা নাড়ল, ‘ভাল।’

‘তোমাকে আর জলপাইগুড়িতে যেতে দেব না। ফিরে এলেই একটা-না-একটা অসুখ বাধাও। জ্বর আছে?’ ভদ্রলোক হাত রাখলেন কপালে। অঞ্জলির সঙ্গে মনোরমার গোপন চোখাচোখি হল। ডাক্তার মাথা নাড়লেন, ‘নাঃ, জ্বর নেই। খুব ভাল।’

দীপা জিজ্ঞাসা করল, ‘কী খাব আজকে?’

‘যা ইচ্ছে। শুধু আচার ছাড়া।’

এইসময় মনোরমা বললেন, ‘ওকে আজ ভাত দেব না ডাক্তারবাবু।’

‘কেন দেবেন না? জ্বর নেই যখন তখন ভাত খাবে না কেন? ভাত খাবে।’

হঠাৎ দীপা বলল, ‘ঠাকুমা, এক গ্লাস জল খাব।’

অঞ্জলি সেটা আনতে যাচ্ছিল, মনোরমা তাকে নিষেধ করে নিজেই বেরিয়ে গেলেন। তিনি চোখের আড়াল হওয়ামাত্র দীপা বলল, ‘আমার না খুব খিদে পায়, দুর্বল দুর্বল লাগে, মাথা ঘোরে। শুধু নিরামিষ তরকারি খেতে একদম ইচ্ছে করে না।’

‘মাথা ঘোরে? প্রেশার ঠিক আছে তো?’ ডাক্তার যন্ত্র খুলতে লাগলেন।

দীপা ফিসফিস করে বলল, ‘ডিম খেলে তো শরীরে জোর আসে। আমাকে দেখেটেখে আপনি বলুন রোজ একটা করে ডিম খেতে।’

‘খুব ইচ্ছে করছে?’ ডাক্তার গলা নামালেন।

‘হুঁ।’

‘দিচ্ছে না?’

‘হুঁ। বিধবা বলে।’

‘সেকেন্ড ডিভিশন থাকবে?’

‘থাকবে।’

‘খোকাটা পাশ করবে কিনা সন্দেহ। কিন্তু সেকেন্ড ডিভিশন না থাকলে আমি কিন্তু সব ফাঁস করে দেব।’ প্রেশার দেখে অনেক কষ্টে হাসি চাপলেন তিনি। এতক্ষণ কথাবার্তা হচ্ছিল চাপা গলায়।

মনোরমা এইসময় কাঁসার গ্লাসে জল নিয়ে ঢুকলেন, ‘কেমন দেখলেন ডাক্তারবাবু?’

‘খুব দুর্বল হয়ে পড়েছে। প্রেশারটাও। শুনুন, ওর শরীরে শক্তি হওয়া দরকার।’

‘দুধ খেতে চায় না যে। একটু বলে দিন তো।’ মনোরমা বললেন।

‘দুধে মোটা হয় শক্তি বাড়ে না।’ দীপা জলের গ্লাস নিল।

‘ওর শরীরের যা অবস্থা তাতে ডিম খাওয়া দরকার। রোজ একটা।’

‘ডিম?’ প্রায় চিৎকার করে উঠলেন মনোরমা।

ডাক্তার বললেন, ‘কী হল?’

‘ও ডিম খাবে কী? ওর ব্যাপার তো সব জানেন।’

‘জানি। কিন্তু ওর শরীরের জন্যেই খাওয়া দরকার। আরও দুর্বল হয়ে পড়লে আমার চিকিৎসায় কোনও কাজ দেবে না।’ কোনওরকমে হাসি চেপে ডাক্তার বেরিয়ে গেলেন।

দীপা গ্লাস রেখে শুয়ে পড়ল, ‘উঃ মাথাটা কী ঘুরছে।’

অঞ্জলি বলল, শুয়ে থাক কিছুক্ষণ।’

মনোরমা ঘুরে দাঁড়ালেন, ‘বউমা, দীপাকে কী করে ডিম দেব?’

অঞ্জলি বলল, ‘এ-ব্যাপারে আমি কী বলব বলুন। আপনি যা ভাল মনে করেন তাই হবে। ডাক্তাররা তো এরকম বলেই।’

মনোরমা মাথা নাড়লেন, ‘যুগ যুগ ধরে বাঙালি বিধবারা নিরামিষ খেয়ে এল কারও শরীর খারাপ হল না, বৈষ্ণবরা মাছ-মাংস খায় না তাদের শরীর ঠিক থাকে, আর তোমার মেয়ে দুর্বল হয়ে পড়ছে।’

‘এ-কথা আমাকে বলছেন কেন?’ অঞ্জলি জানতে চাইল।

‘অমরের প্রশ্রয়ে এসব হচ্ছে।’

‘কী বলছেন আপনি! আপনার ছেলে কখনও আপনাকে অস্বীকার করে না।’

‘করত না। কিন্তু দিন পালটাচ্ছে। জলপাইগুড়ি থেকে ফিরে এসেই ও অন্যরকম হয়ে গেছে এবার।’ মনোরমা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। তাঁকে খুব বিরক্ত দেখাচ্ছিল।

অঞ্জলি মেয়ের দিকে তাকাল। দীপার মুখটা এবার বেশ সহজ। সে বলল, ‘যা খুশি করো তোমরা। আমাকে কিছু বলতে এসো না।’

দীপা হেসে ফেলল, ‘এ-ব্যাপারটা নিয়ে শাশুড়ি বউমার ঝগড়া হতে পারে না?’

‘মানে?’ অঞ্জলি হতভম্ব।

‘তুমি ঠাকুমার অনেক কিছু পছন্দ করো না, অনেক কিছু ওঁকে বলতে চাও না। আবার ঠাকুমাও তোমার অনেক কিছু মানতে পারে না। অথচ তোমরা কেউ কারও নামে নিন্দে করে বেড়াও না, ঝগড়া করা তো দূরের কথা। এরকম তো দেখা যায় না।’

‘বড্ড বেশি পেকে গেছিস তুই, না?’ অঞ্জলি ঝাঁঝিয়ে উঠল। আর তখনই মনোরমা ফিরে এলেন দরজায়, ‘তখন থেকে বলে যাচ্ছে মায়ের সঙ্গে কেন ঝগড়া করো না তুমি? কী মতলব বলো তো? আমার তো মাথায় ঢুকছে না।’

‘কুবুদ্ধি আর কাকে বলে। ফাজলামি করছে। খবরদার ওকে ডিম দেবেন না মা? ডাক্তার যতই বলুক দিতে! অঞ্জলি চলে যাচ্ছিল। দীপা তাকে পেছন থেকে ডাকল, ‘এম্মা! তুমি ঠাকুমাকে খবরদার বললে?’

মনোরমা এবার হেসে ফেললেন, ‘তুই সত্যি পারিস বাবা!’

ডাক্তারের নির্দেশ এ-বাড়িতে মানা হল না। ডিম মাছ মাংসের জন্যে দীপা প্রথম প্রথম টান অনুভব করত, তারপর সেটা চলে গিয়েছিল। জলপাইগুড়ি থেকে ফিরে আসার পর এবার, পরীক্ষা চুকে যাওয়া আলস্যের সময় তার বারংবার মনে হতে লাগল একমাত্র ওই তিনটে খেলেই বিদ্রোহ করা যায়। অথচ চুরি করে খেতে মোটেই ইচ্ছে করছিল না। বোঝা গেল মনোরমা কিংবা অঞ্জলি তার পাতে আমিষ তুলে দেবেন না।

দুপুর পেরিয়ে গেলে অঞ্জলির আলমারির হাতলে হাত দিল দীপা। তালা না দেওয়া মায়ের স্বভাব এটা সে জানত। ওটা খুলতেই দুই আর তিন নম্বর তাকটায় শাড়ির মিছিল দেখল সে। এর অনেকগুলোও অঞ্জলি এক বছরের বেশি পরেনি। চা-বাগানের নিস্তরঙ্গ জীবনে কেউ ভাল শাড়ি পরে বসে থাকে না। আর ওই দুর্ঘটনাটা ঘটে যাওয়ার পর থেকেই রঙিন শাড়ি এড়িয়ে চলে। সেগুলো পাশাপাশি পড়ে রয়েছে আলমারিতে। এইসময় মনোরমা আর অঞ্জলি বাইরের বারান্দায় মোড়া পেতে বসে। অতএব নিশ্চিন্তে শাড়ি বাছতে লাগল সে। রঙিন শাড়ির গায়ে হাত দিতেই অদ্ভুত একটা শিরশিরানি এল শরীরে। ব্যাপারটা এমন যে সে নিজেই অবাক হল।

একটা হলুদ শাড়ি বেছে নিল দীপা। অঞ্জলির জামা তার গায়ে আঁটবে না। নিজের বিয়ের বাক্স খুলে অনেক যাচাই করে হলুদের কাছাকাছি একটা জামা বের করে নিল। বাথরুমে পোশাক পালটে শোওয়ার ঘরের আয়নার সামনে এসে থমকে গেল সে। তার চেহারা এইরকম! নিজেকেই চিনতে পারছে না এখন। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল অনেকবার। তারপর হেসে ফেলল। আয়নায় দীপাকে মুহূর্তে লাজুক দেখাল।

বাইরের ঘর পেরিয়ে আসতে সময় লাগল। পা দুটো যেন খুব ভারী হয়ে গেছে। জোর করে নিজেকে সচল করল সে। মনোরমা আর অঞ্জলি রাস্তার দিকে মুখ করে বসে গল্প করছিলেন। মনোরমা বলছিলেন, ‘দুধ না খাক, ছানাও তো খেতে পারে। ডাক্তারের যেমন বুদ্ধি!’

অঞ্জলি কিছু বলতে গিয়ে চোখের কোণে হলুদ রং দেখল। খুব দ্রুত মুখ ফিরিয়েই সে অবাক হয়ে গেল। তার মুখ দেখে আরও লজ্জা পেল দীপা। ততক্ষণে মনোরমাও চোখ ফিরিয়েছেন। কী বলবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না তিনি।

দীপা হাসবার চেষ্টা করল, ‘তোমার শাড়ি। আলমারিতে নষ্ট হচ্ছিল। পরে ফেললাম। কেমন দেখাচ্ছে বলো তো?’

অঞ্জলি মাথা নাড়ল, ভাল। শেষপর্যন্ত তার মুখে হাসি ফুটল। মনোরমা মুখ ফিরিয়ে নিলেন গম্ভীরভাবে। দীপা চোখের ইশারায় তাঁকে দেখাল অঞ্জলিকে। অঞ্জলি বলল, ‘আট বছর হয়ে গেল শাড়িটা। দেখিস ফেঁসে না যায়।’

‘তুমি কি এটা পরবে?’

‘আমি আজকাল ওসব শাড়ি পরি?’

‘আমি একটু ঘুরে আসছি।’ নেতানো রোদমাখা মাঠের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলল দীপা। দুই মহিলা কোনও কথা বললেন না। পাশের সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামল সে। প্রতি মুহূর্তেই মনে হচ্ছিল মনোরমা বাধা দিতে পারেন। কিন্তু কোনও কিছু ডাক সে শুনল না। খানিকটা এগিয়ে চারপাশে তাকিয়ে ভারী ভাল লাগল তার। কত বছর বিকেলে এভাবে বাইরে আসেনি সে। দূরে মাঠের মাঝখানে বাচ্চারা ফুটবল খেলছে। আজকাল বিশু খোকন ফুটবল খেলে না। মনে হওয়ামাত্র ওদের দেখতে পেল দীপা। আসাম রোড দিয়ে পাঁচটা সাইকেল অলস গতিতে যাচ্ছে। বিশু খোকন তার সঙ্গে পড়েছে। একই স্কুল থেকে পরীক্ষা দিতে গিয়েছে। ছেলেদের সিট পড়েছিল অবশ্য আলিপুরদুয়ারে। কিন্তু তার বিয়ের পর আর ওরা নিজে থেকে কথা বলতে আসেনি। যেভাবে দীপা নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিল তাতে তাকে এড়িয়ে যাওয়াই সমীচীন মনে করছিল ওরা। আজ দীপার ইচ্ছে হল ওদের সঙ্গে কথা বলতে।

অবশ্য এই কয় বছরে ওরা অনেক বড় হয়ে গেছে। দু’জনেরই গোঁফ বেরিয়েছে, দাড়ি গজিয়েছে হালকাভাবে। হাফপ্যান্ট পরা ছেড়ে দিয়েছে এখন। তার ওপর বাজার কলোনি এলাকার পূর্ববঙ্গের কিছু ছেলে এখন ওদের বন্ধু হয়েছে। এই এখন যে তিনজন ওদের সঙ্গে সাইকেলে আছে তারা চা-বাগানের কেউ নয়। দু’জনই তাদের এক ক্লাস নীচে পড়ে। দেখে মনে হয় পড়াশুনা ছাড়া সবকিছু করে। তিনজন সঙ্গে থাকায় একটু অস্বস্তি হচ্ছিল। কিন্তু সেটাকে কাটিয়ে উঠল সঙ্গে সঙ্গে। চটপট পা চালিয়ে সিঁড়ি টপকে সে চিৎকার করল। ‘এই বিশু!’

প্রায় একই সঙ্গে থেমে গেল পাঁচটা সাইকেল। বিশু আর খোকন পরস্পরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল। বাকি তিনজনের চোখে কৌতূহল। আসাম রোডের দিকে পা বাড়িয়ে দীপার খেয়াল হল অনেক পেছনে বারান্দায় বসে থাকা দুই মহিলার কথা। অঞ্জলির যতটা হবে না মনোরমার বুকের মধ্যে নিশ্চয়ই এতক্ষণে ঝড় উঠে গেছে।

এইসময় দূরে একটা বাস দেখা গেল। দীপা গলা তুলেই বলল, ‘একপাশে সরে আয়, বাস আসছে, চাপা পড়বি।’ স্পষ্টত দুটো ভাগ হয়ে গেল দলটা।

নতুন তিনজন চলে গেল ওপাশে, খোকন আর বিশু দীপার কাছে এসে সাইকেল থেকে নেমে দাঁড়াল।

খোকনই প্রথম কথা বলল, ‘তুই আমাদের সঙ্গে কথা বলছিস?’

‘তাই তো মনে হচ্ছে। কেমন পরীক্ষা দিলি তোরা?’

‘একরকম।’ খোকন জবাব দিল।

‘তুই?’ বিশুর দিকে তাকাল দীপা।

‘কিছু বলবি তুই?’ বিশু বেশ কঠোর মুখে তাকাল।

সঙ্গে সঙ্গে দুষ্টুবুদ্ধি খেলে গেল দীপার মাথায়। সে বলল, ‘অনেকদিন থেকেই একটা কথা খুব ভাবছিলাম। আচ্ছা বল তো, বিয়ের পর আমি যখন শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছিলাম তখন তোরা ওরকম কেঁদে উঠলি কেন?’

প্রশ্নটা শোনামাত্র কেমন বোকা হয়ে গেল বিশু। খোকন হেসে ফেলল। শেষপর্যন্ত বিশু বলল, ‘অনেকদিন আগের কথা, ভুলেই গিয়েছি।’

‘ওমা, তাই? আমাকেও ভুলে গিয়েছিস তোরা?’

‘তোকে কী করে ভুলব! তুই স্কুল ছাড়া বাড়ি থেকে বের হতিস না। আমাদের কারও সঙ্গে কথা বলতিস না, তাই।’ খোকন কথা শেষ করল না।

এবার বিশু বলল, ‘ডাকলি কেন?’

‘এমনি। হঠাৎ ভাবলাম আজ জিজ্ঞাসা করি সেই রাত্রে কেঁদেছিলি কেন? ভুলে গিয়েছিস যখন তখন আর মনে করে কী লাভ!’

এইসময় খোকন বলল, ‘অ্যাই দ্যাখ, সবাই দেখছে।’

শোনামাত্র দীপা এবং বিশু মুখ ঘুরিয়ে দেখল মাঠের ওপাশে কোয়ার্টার্সগুলোর বারান্দায় বারান্দায় মেয়েরা দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে এদিকে দেখছে। যেন এরকম অবাক কাণ্ড অনেকদিন তারা দেখেনি। মুখ ফিরিয়ে নিয়ে দীপা জিজ্ঞাসা করল, ‘কোথায় যাচ্ছিস তোরা?’

খোকন জবাব দিল, ‘এমনি ঘুরছি।’

রাস্তার ওপারে তিনটি ছেলে তখনও দাঁড়িয়ে। ওদের ভঙ্গিতে নায়ক নায়ক ভাব। দীপা জিজ্ঞাসা করল, ‘তোদের বন্ধু ওরা?’

খোকনই জবাব দিল, ‘হ্যাঁ, ও হল সুভাষ, মাঝখানে গোবিন্দ আর ডানদিকে অজয়। তুই ওদের আগে দেখিসনি?’

দীপা জবাব দিল না। ওর খুব ইচ্ছে করছিল এদের সঙ্গে আসাম রোড ধরে বেড়াতে। কিন্তু তিনটি অপরিচিত ছেলে থাকায় যাওয়াটা ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারছিল না। তার ওপর একইদিনে রঙিন শাড়ি পরে রাস্তায় বেরিয়ে এদের সঙ্গে কথা বলাটাই অনেকখানি হয়ে গিয়েছে। মনোরমা এবং অঞ্জলির পক্ষে আর হজম করা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। সে বলল, ‘যা তোরা। কাল সকাল দশটায় আসব। মাঠে থাকিস।’ কথা শেষ করেই দীপা ফিরল। এবং সত্যসাধন মাস্টারকে দেখতে পেল। তাঁকে দেখেই সম্ভবত বিশুরা আর দাঁড়াল না। দীপা অপেক্ষা করল মানুষটির জন্যে।

কাছে এসে সত্যসাধনের চোখ বড় হয়ে গেল, ‘তুমি রঙিন শাড়ি পরছ?’

কথা না বলে দু’বার মাথা নাড়ল দীপা। বিস্ময়টা কেটে গিয়ে হাসি ফুটল সত্যসাধন মাস্টারের মুখে ‘বিদ্রোহীর জয় হইল নাকি?’

‘এখনও বোঝা যাচ্ছে না। আজই প্রথম পরলাম। দেখছেন না, ওপাশের কোয়ার্টার্সগুলোর বারান্দায় ভিড় জমে গিয়েছে।’

‘তাই তো৷ আসলে কী জানো, অভ্যাস। অভ্যাসের চাকর মানুষ। আমিও তার ব্যতিক্রম না। সত্যি কথা বলি, আমিও খুব কনজারভেটিভ। এক একটা থিয়োরি মাথার মধ্যে এমন বইস্যা যায় যে অন্য চিন্তা আসে না। কিন্তু প্র্যাকটিক্যাল লাইফে যদি সেই প্রবলেম আসে তা হলে দেখি থিয়োরিটা ভুল। এক্কেবারে ভুল। শোনো দীপা, এখন বলি পোশাক হইল মনের প্রতিফলন। তোমার মন চাইলে রঙিন পরবা, না চাইলে পরবা না।’

‘আপনি আমাদের বাড়িতে যাচ্ছেন?’

‘হুঁ। একটু আর্লি আইস্যা পড়ছি। তোমার বাবা তো আসে নাই এখনও?’

‘না। তাতে কী আছে চলুন না।’ দীপা মাস্টারমশাইকে ছাড়তে চাইছিল না। তিনি সঙ্গে থাকলে আর যাই হোক মনোরমা কিংবা অঞ্জলি আপাতত মুখে কুলুপ এঁটে থাকবেন। বাইরের লোক বাড়ির লোক ব্যাপারটা মনোরমা খুব মানেন। আর এইসময় যদি অফিস থেকে অমরনাথ ফিরে আসেন তা হলে দীপা ম্যানেজ করে নিতে পারবে।

সিঁড়ি টপকে মাঠে নামতে নামতে সত্যসাধন বললেন, ‘এই ছেলেগুলো তোমারে কী কইতেছিল? অত্যন্ত বদ। থার্ড ডিভিশন পাইবে কিনা সন্দেহ।’

দীপা হেসে ফেলল। সত্যসাধন রেগে গেলেন, ‘হাসো কেন?’

‘বদ বললেন কেন?’

‘বদ না? লেখাপড়ায় মন নাই শুধু বাপের পয়সায় সিগারেট ফোঁকে।’

‘ওরা সিগারেট খায়?’ অবাক হয়ে গেল দীপা।

মাথা নাড়লেন সত্যসাধন, ‘এ ম্যান ইজ নোন বাই দ্যা কম্পানি হি কিপস। খারাপ আলুর সঙ্গে ভাল আলু রাখলে সেইটাও পইচ্যা যায়। ভাল মানুষের সঙ্গ পাইলে জ্ঞান বাড়ে, মন বড় হয়।’

দীপা কিছু বলল না। কিন্তু ও দৃশ্যটা ভেবে পুলকিত হল। বিশু খোকন বসে সিগারেট টানছে। ওরা এত বড় হয়ে গিয়েছে এর মধ্যে! খোকনটা এখনও তেমনি বোকাবোকা কথা বলে কিন্তু বিশু যেন বেশ পালটে গিয়েছে। গলার স্বরটাও অন্যরকম হয়ে গিয়েছে। ভাল না মন্দ তা বুঝতে পারছিল না সে।

অঞ্জলি উঠে দাঁড়িয়েছিল, সত্যসাধন মাস্টারকে মোড়াটা এগিয়ে দিয়ে মনোরমা ভেতরে চলে গেলেন। তাঁর মুখে এখন ঘোর অমাবস্যা। কিছুক্ষণ কথা বলে অঞ্জলি চা বানাতে চলে গেলে সত্যসাধন জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমার জ্বর সারল কবে?’

‘আজই।’

‘আছ কেমন?’

‘খুব দুর্বল লাগে। ডাক্তার ডিম খেতে বলেছেন।’

‘ডিম?’

‘গায়ে জোর হবার জন্যে।’

‘তোমার ঠাকুমায়— ?’

‘মানতে চাইছেন না।’

একটু চুপ করে থাকলেন সত্যসাধন। তারপর বললেন, ‘তুমি নিশ্চয়ই জানো না যে আমি নিরামিষাশী। দীক্ষান্তে আমিষ ত্যাগ করছি আজ সাত বৎসর। কোনও অসুবিধা হয় না। পৃথিবীর অনেক মানুষ আমিষ খায় না। অ্যানিমাল প্রোটিনে যা কাজ হয় তা ভেজিটেবিল প্রোটিনেও হইতে পারে। যে-সংস্কার তোমার ক্ষতি করে না তা মান্য করলে কেউ যদি সুখী হয় তাই তো তোমার করা উচিত।’

দীপার মনে পড়ল রমলা সেনের কথা। তিনিও প্রায় একই কথা লিখেছেন। জলপাইগুড়ি থেকে সে যে-চিঠি দিয়েছিল তার উত্তর এখনও পায়নি, কিন্তু আগের অনেক চিঠির ভাষা মাস্টারমশাইয়ের মতের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। কিন্তু সে বিদ্রোহ করতে চায়। আর তা করতে গেলে কেউ-না-কেউ তো দুঃখ পাবেই। দীপা জবাব দিল না।

এইসময় চা-বাগান থেকে সাইকেলগুলো বেরিয়ে আসতে লাগল। গরম পড়ে যাওয়ায় দিনের আয়ু বেড়েছে। সন্ধে হতে বেশ দেরি। অমরনাথ কোয়ার্টার্সের সামনে সাইকেল থেকে নেমে যেন হতভম্ব হয়ে গেলেন মেয়েকে দেখে। দীপা হাসল। সাইকেল বেড়ার গায়ে হেলান দিয়ে রেখে অমরনাথ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী ব্যাপার?’

‘পরলাম।’ দীপা মুখ ফিরিয়ে নিল।

‘বেশ ভাল দেখাচ্ছে তোকে। কেউ কিছু বলেনি?’

‘এখনও সুযোগ পায়নি।’

সত্যসাধন হেসে ফেললেন। তারপর বললেন, ‘অমরনাথবাবু, আপনার লগে কিছু কথা ছিল। ভোরবেলায় একটা স্বপ্ন দেখছি।’

‘বলুন।’ অমরনাথ অঞ্জলির মোড়ায় বসলেন।

‘দেখলাম দীপা মা ডাক্তার হইছে। তখনই চিন্তাটা মাথায় ঢুকল। ওরে কী পড়াইবেন? সায়েন্স না আর্টস?’

‘আগে পাশ করুক।’ অমরনাথ হঠাৎ আড়ষ্ট হলেন।

‘সে ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নাই। জলপাইগুড়ি এ সি কলেজ ভাল তবে খুব ভাল না। সবচেয়ে ভাল ওকে কলকাতায় পাঠানো। বেথুনের কলেজে ভাল হস্টেল আছে কিনা জানি না, থাকলে ওর চেয়ে ভাল কিছু হয় না।’

‘দেখি।’ অমরনাথ গম্ভীর গলায় বললেন।

রাত্রে শোওয়ার সময় অমরনাথ স্ত্রীর কাছে প্রসঙ্গ তুললেন। ছেলেদুটো বড় হচ্ছে। স্কুল ফাইন্যাল পর্যন্ত দীপাকে তিনি যথেষ্ট যত্নে পড়িয়েছেন। কিন্তু তারপর পড়তে গেলে যে অর্থব্যয় করতে হবে তা কতটা সম্ভব? বাড়িতে থেকে পড়া এক কথা আর কলকাতা কিংবা জলপাইগুড়িতে গেলে ওর থাকা খাওয়ার খরচ লাগবে। অঞ্জলি নিচু গলায় জবাব দিল, তুমি যা পারবে তাই করবে।’

‘করতে গেলে কষ্ট করতে হবে। মেয়ে পাশ করে চাকরি নেবে এবং আমাদের খাওয়াবে এতটা আশা করি না। আর লোকেই বা বলবে কী! এইজন্যেই অমরবাবু ওকে লেখাপড়া শিখিয়েছে।’

‘তোমার ছেলেরা বড় হয়ে চাকরি করলে তুমি তাদের কাছে থাকবে না?’

অমরনাথ জবাব দিলেন না। তিনি উসখুস করতে লাগলেন। আজ আর একটা ঘটনা ঘটেছে। বিকেলের ডাকে দুটো চিঠি এসেছে। একটা রমলা সেনের। সেটা মেয়েকে দিয়ে দিয়েছেন। দ্বিতীয়টি প্রতুলবাবুর। জলপাইগুড়ি থেকে লিখেছেন। তিনি অসুস্থ। অতীতের সব ঘটনার জন্য মার্জনা চেয়েছেন। তিনিই গিয়েছিলেন গেস্ট হাউসে দেখা করতে। পরদিন সকালে গিয়ে শুনেছেন যে তাঁরা চলে গেছেন। তিনি কথা বলতে চান। অমরনাথ যদি জলপাইগুড়িতে যেতে পারেন তা হলে খুব ভাল হয়। ব্যাপারটা অঞ্জলিকে বলতে সাহস পেলেন না অমরনাথ। চিঠি পাওয়ার পর থেকেই হরদেব ঘোষালের কথা মনে পড়ছে তাঁর। অত বড় সম্পত্তি দীপাব হাতে আসতে পারে। আর কিছু না হোক, মেয়েটা যদি পাশ করে তা হলে ওই বাড়িতে থেকে কলেজে পড়তে পারে। এতে প্রচুর খরচ বাঁচবে। এখন প্রতুলবাবু নিশ্চয়ই তাঁর আগের গোঁ আঁকড়ে বসে থাকবেন না। ভুল বুঝে যে-মানুষ অনুশোচনা করে তার সঙ্গে বিরোধ জিইয়ে রেখে লাভ নেই।

মনোরমার পাশে চুপচাপ শুয়েছিল দীপা। মনোরমা উলটোদিকে মুখ করে শুয়েছিলেন। খানিক আগে শোওয়ার সময় রঙিন শাড়ি ছেড়ে নিজের আটপৌরে সাদা শাড়ি পরে এসেছে দীপা। সেদিকে তাকিয়ে প্রথম কথা বলেছিলেন মনোরমা, ‘যাক, তা হলে আর নিষেধ করছি না। ভেবেছিলাম রঙিন শাড়ি পরলে আমার পাশে শুতে দেব না।’

দীপা উত্তর দেয়নি। বিকেলে অমরনাথের দেওয়া রমলা সেনের চিঠি পড়ে তার মন খুব খারাপ হয়ে গিয়েছে। ছোট্ট চিঠি লিখেছেন তিনি। ‘পরীক্ষা ভাল হয়েছে জেনে খুব খুশি হলাম। রেজাল্টের জন্যে উদ্গ্রীব হয়ে আছি। আর একটা কথা, লিখেছ বিদ্রোহ করব, বিদ্রোহ করতে গেলে নিজেকে উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে হয়। নিজেকে প্রশ্ন করো তুমি তার কতটা উপযুক্ত।’ দূরে কুলি লাইনে মাদল বাজছে। রাত নিশুতি। দীপার বুক মুচড়ে একটা নিশ্বাস বেরিয়ে এল।

সকল অধ্যায়

১. ১. আজ সারাটা দিন সূর্যদেব উঠলেন না
২. ২. মেয়েরা কি ভূত হয়
৩. ৩. ভালো-মন্দ বোঝার বয়স
৪. ৪. রমলা সেন
৫. ৫. সত্যসাধন মাস্টার
৬. ৬. বৃষ্টিটা চলে যাওয়ার পরে
৭. ৭. চারদিন পৃথিবীটাকে দ্যাখেনি দীপা
৮. ৮. দীপাবলীর বিয়ে
৯. ৯. বাসর এবং বউভাত
১০. ১০. দীপাবলীর ফুলশয্যা
১১. ১১. পুত্ৰটি দেহ রেখেছে
১২. ১২. রমলার চিঠি
১৩. ১৩. প্ৰাপ্তবয়স্কতা শরীরের না মনের
১৪. ১৪. চাবাগানের আশেপাশে
১৫. ১৫. আসাম রোড
১৬. ১৬. একটি মানুষের চেহারা
১৭. ১৭. জলপাইগুড়ি শহরে
১৮. ১৯. রমলা সেনের কাছে
১৯. ১৮. পুলিশের লাঠিচার্জ
২০. ২০. জলপাইগুড়ির হোস্টেলের মেয়ে
২১. ২১. দুশ্চিন্তার ছাপ
২২. ২২. একতারা বাজিয়ে গান
২৩. ২৩. দুর্দান্ত ব্যবসাদার প্রতুল বন্দ্যোপাধ্যায়
২৪. ২৪. সত্যসাধন মাস্টার এসে পড়বেন
২৫. ২৫. অমরনাথ হতভম্ব
২৬. ২৬. তিনদিন ধরে সমানে বৃষ্টি
২৭. ২৭. অমরনাথের শরীর
২৮. ২৮. কলকাতা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে
২৯. ২৯. প্রৌঢ় ভদ্রলোকটি হাঁটছিলেন
৩০. ৩০. এক অদ্ভূত অভিজ্ঞতা
৩১. ৩১. বাড়িটা শুধু পুরনো নয়
৩২. ৩২. উত্তর কলকাতার পথে পথে
৩৩. ৩৩. কলেজ এবং হোস্টেলের বাইরে
৩৪. ৩৪. দীপা অঞ্জলির দিকে তাকাল
৩৫. ৩৫. অমরনাথ শুয়ে আছেন
৩৬. ৩৬. ভবিষ্যৎ সম্পর্কে প্ৰচণ্ড অসহায়তাবোধ
৩৭. ৩৭. তিনতলার ব্যালকনি
৩৮. ৩৮. দীপা চুপ করে আছে
৩৯. ৩৯. সুভাষচন্দ্র এগিয়ে এলেন
৪০. ৪০. মেয়েটির নাম লাবণ্য
৪১. ৪১. বিছানায় টান টান দীপা
৪২. ৪২. কলেজের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে
৪৩. ৪৩. কিছু মানুষ খুন হলেন
৪৪. ৪৪. কেমন একটা সংসার-সংসার ভাব
৪৫. ৪৫. রাধা চলে এল সেজেগুজে
৪৬. ৪৬. দ্বিতীয় অভিনয় হয়ে যাওয়ার পরে
৪৭. ৪৭. কলোনি থেকে কলেজ পাড়ায়
৪৮. ৪৮. স্কটিশ চার্চ কলেজে জানাজানি হয়ে গেল
৪৯. ৪৯. একদম লেডি
৫০. ৫০. রমলা সেন চোখ ছোট করলেন
৫১. ৫১. সাতকাহন প্ৰথম পর্ব সমাপ্ত

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন