সমরেশ মজুমদার
পুলিশের লাঠিচার্জ নিয়ে জলপাইগুড়ি শহরে বামপন্থী আন্দোলন তীব্র হবে আশঙ্কা করেই কলেজ বন্ধ করে দেওয়া হল। চা-বাগানে থাকতে আন্দোলনের গল্প দীপা পড়ত খবরের কাগজে। জ্ঞান হবার পর থেকে সে সেখানে কোনও মিছিল দ্যাখেনি। আন্দোলন মানে শেষপর্যন্ত পুলিশের সঙ্গে লড়াই, একদল লাঠি নিয়ে তেড়ে যাবে আর একদল দূর থেকে পাথর ছুড়বে, এমন দৃশ্য চা-বাগানে কল্পনাই করা যায় না। অনির্দিষ্ট কালের জন্যে কলেজ বন্ধ হওয়ায় কাছাকাছি যারা থাকে তারা হস্টেল ছেড়ে বাড়ি চলে যাচ্ছে। গতকাল জলপাইগুড়িতে ধর্মঘট ডাকা হয়েছিল। শহরে বাস ঢোকে শিলিগুড়ির রাস্তায় কদমতলা পর্যন্ত। যানবাহন বলতে ভরসা রিকশা। সকালের দিকে সেটাও চালু ছিল। দোকানপাট আধভেজানো।
আজ সকালে মায়াকে নিয়ে ওর বাবা চলে গেল। ক’দিন আগে যে-মেয়ে বাড়ি ছেড়ে হস্টেলে আসার জন্যে কান্নাকাটি করছিল আজ সে কিছুতেই যেতে চাইছিল না। দীপা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘সেকী! তুমি তো বাড়িতে যাওয়ার জন্যে ছটফট করছিলে? হঠাৎ কী হল?’
মায়া মাথা নেড়েছিল, ‘দুর! বাড়িতে গেলেই সবকিছু বাবা-মায়ের হুকুমমতো করতে হবে। এখানে আমি খুব ভাল আছি। তা ছাড়া’—‘
‘তা ছাড়া কী?’ দীপার মজা লাগছিল।
‘যদি ওর সঙ্গে দেখা হয়ে যায় তা হলে কী মুশকিলে যে পড়ব।’
‘জগন্নাথবাবুর সঙ্গে দেখা হলে তোমার ভাল লাগবে না?’
‘না! যাকে ভালবাসি অথচ বিয়ে করলে ভালবাসা মরে যাবে তার সঙ্গে দেখা করলে শুধু কষ্টই হবে।’
‘তুমি আগে থেকেই কী করে ভাবছ অমন হবে।’ দীপা বোঝাতে চেয়েছিল। তবু মায়া ফোঁপাতে ফেঁপাতে চলে গেল। দীপার মাথায় কিছুই ঢুকছিল না। যে-মেয়ে একটা লোকের জন্যে অমন পাগলামি করে নিজের বাবার বিরুদ্ধে কথা বলেছিল, সে হঠাৎ একটা কথা কানে নিয়ে নিল এমন যে পাগলামি সেরে গেল! লালাবাবুর গল্পের মতো ব্যাপার তা হলে জীবনেও ঘটে! জগন্নাথবাবুর জন্যে ওর মন খারাপ হয়ে গেল। চিঠিটা তার নিজের নয়, কোনও পুরুষকে ওরকম চিঠি নিজের নামে লেখার কথা সে ভাবতেও পারে না, কিন্তু এটা তো সত্যিই সে মায়ার হয়ে চিঠিটা সারারাত ধরে লিখেছিল। সেই লেখাটা মিথ্যে হয়ে গেল এই ক’দিনেই? প্রেমপত্রের গুরুত্ব শুধু প্রেমিক-প্রেমিকার মধ্যে। তৃতীয় ব্যক্তি তার মর্ম বুঝবে না, এমনটা যেন কোথায় পড়েছিল। হয়তো তাই।
অনেকদিন রমলা সেনের কোনও খবর নেই। সেই যে রেজাল্ট বের হবার পর শিলিগুড়িতে পড়ার প্রস্তাব নিয়ে এসেছিলেন তারপর মাত্র একটি চিঠি দিয়েছিলেন। খুব সংক্ষিপ্ত এবং পড়াশুনার উপদেশই ছিল তাতে। আজ হঠাৎ মনে হল, শিলিগুড়িতে গেলে কেমন হয়। সকালে জলপাইগুড়ি থেকে ট্রেন যায় শিলিগুড়িতে। যাতায়াতে প্রায় দু’ঘণ্টা পড়বে। ব্যাপারটা ভাবতেই বুকের মধ্যে একটা উত্তেজনা জন্ম নিল। অমরনাথ জানতে পারলে নিশ্চয়ই খুব রেগে যাবেন। আচমকা গেলে রমলা সেনও কী মনে করবেন জানা নেই। দীপা ভেবে পাচ্ছিল না, গেলে কতটা খারাপ হবে। শিলিগুড়ি থেকে ট্রেন জলপাইগুড়িতে আসে দুপুরের একটু পরে। দিনে দিনে যাওয়া আসায় কোনও বিপদ নেই। কলেজ খোলা থাকলে কাউকে কিছু বলতে হত না, এখন বেরুবার সময় বলে যেতে হবে বন্ধুর বাড়িতে যাচ্ছে। এইটুকু মিথ্যে। বেশ উত্তেজনার মধ্যে দিনটা কাটল। জীবনে কখনও ট্রেনে চাপেনি সে। শিলিগুড়ি সম্পর্কে নানান গল্প কানে এসেছে। সেখানে নাকি অবাঙালির সংখ্যা বেশি। বাধ্য না হলে মেয়েরা একা যাওয়া আসা করে না। কলেজ থেকে ফেরার সময় একটু ঘুরপথে অনেকদিন সে জলপাইগুড়ির রেলস্টেশন দেখে এসেছে। চলন্ত ট্রেনের আকর্ষণ তখন থেকেই মনে লেগে ছিল। পরদিন সকালে দীপা বেরিয়ে পড়ল স্নানটান সেরে।
কদমতলা হয়ে তিন নম্বর গুমটির পাশ দিয়ে স্টেশনে পৌঁছোতে মিনিট বারো লাগল। এই পথটুকু আসতেই নাকের ডগায় ঘাম জমে গেছে তার, পা ভারী হয়ে উঠেছে। ট্রেন লাইনটা চোখে পড়ার পর থেকেই মনে হচ্ছে না গেলেই ভাল হত। কিন্তু স্টেশনে এসে ফিরে গেলে আরও খারাপ লাগবে। হস্টেলের ঘড়ি দেখে সে বেরিয়েছিল, শিলিগুড়ির ট্রেন আসতে দেরি থাকার কথা নয়। খুব গম্ভীর মুখে সে টিকিট কাটার জন্যে লাইনে দাঁড়াল। তার সামনে দাঁড়ানো এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক মাথা ঘুরিয়ে দেখে বললেন, ‘মেয়েছেলেদের লাইন দিতে হয় না। আগে যাও, পেয়ে যাবে।’
মেয়েছেলে শব্দটা কানে আসামাত্র মুখ ফিরিয়ে নিল দীপা। না, আগে গিয়ে সুযোগ নেবার কোনও দরকার নেই। সে যাচ্ছে না দেখে বৃদ্ধ আবার বললেন, ‘কী হল? যাও না। ক’টা টিকিট কাটবে?’
দীপা বলল, ‘আমি আপনার পরেই কাটব।’
বৃদ্ধ সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। তারপর তাঁর সামনের লোকটিকে বললেন, ‘আজকাল কারও ভাল করতে নেই। ছেলেদের দোষ কী দেব মেয়েদের যেভাবে পাখা উড়ছে।’
সামনের লোকটি ঘাড় ঘুরিয়ে দীপাকে দেখল। যেন সত্যি তার দুপাশে পাখা লাগানো আছে। দীপা ঠোঁট টিপে রইল। এইসময় এক বিশাল পরিবার এল বুকিং কাউন্টারের সামনে। টাক-মাথা এক ভদ্রলোকের সঙ্গে অন্তত গোটা এগারো বাচ্চা বালক কিশোরী সমেত মধ্য বয়সের স্বাস্থ্যবতী স্ত্রী। ভদ্রমহিলার মাথার ঘোমটা শুধু কপাল ঢেকেছে। টাক-মাথা ভদ্রলোক লাইনের দিকে তাকিয়ে স্বগতোক্তি করলেন, ‘এই মরেছে। মেয়েছেলে লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট কাটছে যে। ভাবলাম ওয়াইফকে দিয়ে আগেভাগে টিকিট কাটাব— ।’
বৃদ্ধ হাত নাড়লেন, ‘কে নিষেধ করেছে। লেডিস এখনও ফার্স্টে। তবে যে-মেয়েছেলে লাইনে দাঁড়াতে চায় সে দাঁড়াতে পারে।’ কথাগুলো শোনামাত্র টাক-মাথা লোকটা পকেট থেকে টাকা বের করে চিৎকার করতে লাগল, ‘অ দেবী, তোর মাকে পাঠিয়ে দে, তাড়াতাড়ি।’ ভদ্রমহিলার শরীরের ভার এত বেশি যে তিনি আসতে সময় নিলেন। দীপা মুখ ফিরিয়ে নিল। লোকগুলো অযথা এমন চিৎকার চেঁচামেচি করে কেন? যেন সমস্ত পৃথিবীকে জানিয়ে দিচ্ছে যে ওরা কোথাও যাচ্ছে। ‘কোথায় যাবে?’ প্রশ্নটা শুনে মুখ তুলে জানলার দিকে তাকিয়ে দীপা চটপট জবাব দিল, ‘শিলিগুড়ি।’
হলদিবাড়ি থেকে ট্রেনটা জলপাইগুড়ি স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে ঢুকে হাঁপাতে লাগল। দীপা খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে বিস্ময়ে তাকিয়ে ছিল কামরাগুলোর দিকে। প্রচণ্ড হুড়োহুড়ি করে যাত্রীরা উঠছে। যারা নামতে চাইছে তারা জায়গা পাওয়ার জন্যে চিৎকার করছে। কিন্তু সেসব পালা চুকে গেলে ট্রেনটাকে বেশ খালি বলেই মনে হল। দীপা পায়ে পায়ে এগোল। একেবারে সামনে যে-কামরার দরজা পড়ল তাতেই উঠে পড়ল সে।
জানলাগুলো সব দখল হয়ে গেছে এর মধ্যে। চট করে বসার জায়গা দেখতে পেল না দীপা। দেওয়ালে ঠেস দিয়ে সে কামরার ভেতরটা দেখছিল। আর তখনই ট্রেনটা দুলে উঠল। বাইরের দিকে তাকাতেই দীপার বুকের ভেতরটা টলে উঠল। ঠোঁট কামড়াল সে। যা হবার হবে। এখন আর কোনও মানে হয় না এসব নিয়ে ভাবার। সে কোনও অন্যায় করছে না, এটাই আসল কথা। জলপাইগুড়ি শহরটা হুহু করে পেছনে সরে যাচ্ছে। হঠাৎ কেউ যেন তার সামনে এসে দাঁড়াতেই দীপার চমক ভাঙল। এক ভদ্রলোক তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন। ধুতি শার্ট পরা, ব্যাকব্রাশ চুল, গোঁফ আছে এবং তার তলায় হাসিও, ‘আপনি বসবেন?’
দীপা বুঝতে পারল না ঠিক কী বলা উচিত। ভদ্রলোক আর একটু বেশি হাসলেন, ‘সংকোচের কিছু নেই। জায়গা আছে, চলে আসুন।’ ভদ্রলোক কথা শেষ করেই এমন ভঙ্গিতে নিজের বেঞ্চির দিকে চলে গেলেন যেন ধরেই নিয়েছেন দীপা তাঁর সঙ্গে আসবে। আড়ষ্টতা প্রবল হচ্ছিল কিন্তু জোর করে সেটাকে সরিয়ে ফেলল সে। শিলিগুড়িতে পৌঁছাতে এক ঘণ্টার বেশি সময় লাগবে। বসার জায়গা থাকলে খামোখা দাঁড়িয়ে যাওয়ার কোনও মানে হয় না। সে ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে দেখল ভদ্রলোক ছাড়া দু’জন রাজবংশী মহিলা বসে আছেন বেঞ্চিতে। তাঁদের ভাবভঙ্গিতে নিজেদের গুটিয়ে নেবার চেষ্টা আছে। ভদ্রলোক ঈষৎ ডান দিকে সরে গিয়ে বললেন, ‘মহিলাদের পাশেই বসুন। ওরা স্বস্তি পাবে, আপনিও।’
দীপা বসল। ভদ্রলোক একটা সিগারেট ধরিয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ রইলেন। উলটো পিঠে চারজন বাঙালি ভদ্রলোক একবার দীপাকে দেখছেন আর একবার এই ভদ্রলোকের দিকে তাকাচ্ছেন। দীপা দেখল, চার জোড়া চোখেই এক ধরনের মজা পাওয়ার উৎসাহ। হঠাৎ খুব চাপা গলায় পাশের ভদ্রলোক বললেন, ‘ওদিকে নজর দেবেন না। বাঙালি থিয়েটার দেখতে ভালবাসে। আপনি এমন ভান করুন যেন আমার সঙ্গে আগেই আলাপ আছে।’
দীপা অবাক হয়ে তাকাল। তারপরে এক ঝটকায় উঠে দাঁড়িয়ে চলে এল দরজার পাশে সেই দেওয়ালের কাছে যেখানে সে কামরায় উঠেই দাঁড়িয়েছিল। তার চলে আসার সময় পাশের লোকটা একবারও মুখ ফিরিয়ে তাকায়নি। কিন্তু উলটোদিকের চারজোড়া চোখ ঘুরেছিল। দীপার সমস্ত অনুভূতি বলছিল ওই লোকটি ভাল নয়। কিন্তু সামনের চারজনও কি ভাল? লোকটা যদি আবার উঠে আসে? শক্ত হয়ে দাঁড়াল সে। কিন্তু লোকটা আর এদিকে এল না। ট্রেন থামল পরের স্টেশনে। দীপা দ্রুত নেমে পড়ল কামরা থেকে। পরপর তিনটে কামরা ছেড়ে আবার উঠে পড়ল সে। জানলার পাশে একটি একক আসন পেয়ে সে চটপট বসে পড়ল। ট্রেন চলতেই চোখের সামনে সবুজ মাঠ চাষের খেত এবং নীল আকাশ ভেসে উঠল। দীপার এত ভাল লাগছিল যে একটু আগের ঘটনা তার মন থেকে হারিয়ে গেল।
শিলিগুড়ি স্টেশনে ট্রেনটা থামতেই সে প্ল্যাটফর্মে নামল। একটা স্টেশন এত বড় হয় তার ধারণাই ছিল না। এত হকার এত মানুষ। ও-পাশেও একটা ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে। ট্রেন থেকে নামা যাত্রীদের অনুসরণ করে বাইরে আসতেই রিকশা দেখতে পেল সে।
রিকশা চেপে শিলিগুড়ির রাস্তায় চুপচাপ যাচ্ছিল দীপা। একটা নদী পড়ল। খুব চওড়া নয়, তিস্তার মতো নয়। এই নদীটার নাম কী? রিকশাওয়ালাকে জিজ্ঞাসা করতে গিয়ে সামলে নিল সে। নিশ্চয়ই লোকটা বুঝতে পারবে সে এই শহরে নতুন এসেছে। শিলিগুড়ির রিকশাওয়ালারা কেমন তা কে জানে। রাস্তায় প্রচুর সাইকেল, অনেক রিকশা। কান ঝালাপালা হবার জোগাড় তাদের ঘণ্টার শব্দে। সেসব ছাড়িয়ে শেষপর্যন্ত বাঁ দিকের একটা রাস্তায় নামল রিকশাটা। ছোট ছোট বাড়ি, কাঠের বাড়িও নজরে পড়ছে, একসময় রিকশাওয়ালা বলল, ‘এসে গেছি দিদি।’
দীপা ভাড়া চুকিয়ে দিয়ে কয়েক পা হাঁটল। রমলা সেনের ঠিকানাটা তার মুখস্থ। কিন্তু কাউকে জিজ্ঞসা না করে বাড়িতে পৌঁছানো যাবে না। এখন বেশ রোদ। সকাল শেষ হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। রাস্তায় লোকজন কম। একটি ছেলে সাইকেল চালিয়ে আসছিল। দীপা দাঁড়িয়ে পড়তেই ছেলেটি এত বিস্মিত হল যে একটু হলেই অ্যাকসিডেন্ট করত।
দীপা জিজ্ঞাসা করল, ‘আচ্ছা, প্রফেসর রমলা সেনের বাড়িটা কোথায় বলুন তো?’
ছেলেটির মুখচোখ লাল হয়ে উঠল। কথা বলতে গিয়েও থেমে গেল। দীপা অবাক হয়ে গেল। তারপরেই মনে হল হয়তো ছেলেটি বোবা। চা-বাগানে একটি মদেশিয়া ছেলে বোবা ছিল। তাকে দেখে বোঝাই যেত না সে কথা বলতে পারে না। দীপা কী করবে বুঝতে পারছিল না। এইসময় ছেলেটি কথা বলল। বলল না বলে, বলতে চাইল বলা ভাল।
‘ইয়ে, মানে, রমলা সেন— ।’
দীপা দেখল ছেলেটি ঢোঁক গিলল। সে জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনি ওঁর বাড়ি চেনেন? আমাকে একটু দেখিয়ে দেবেন?’
প্রথম প্রশ্নের সময়েই ঘাড় নেড়েছে ছেলেটি। এবার সাইকেলটা ঘুরিয়ে নিল। দীপা দেখল ওর মুখে বেশ ঘাম জমে গেছে। ছেলেটা তার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে যে নার্ভাস হয়ে পড়েছে বুঝতে পেরে হঠাৎ তার মজা করার ইচ্ছে হল। সে জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনি নিশ্চয়ই এই পাড়ায় থাকেন?’
ছেলেটা দু’বার মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল। দীপা হাসল, ‘আপনি জবাব দিচ্ছিলেন না বলে আমি কিন্তু ভাবতে আরম্ভ করেছিলাম আপনি বোবা।’
ছেলেটা প্রতিবাদ করে উঠল, ‘না না। আসলে, আপনার মতো— ।’ ছেলেটি কথা শেষ করল না।
হাঁটতে হাঁটতে দীপা জিজ্ঞাসা করল, ‘আমার মতো মানে?’
‘সমবয়সি মেয়েদের সঙ্গে কথা বলার অভ্যেস নেই তো, তাই।’ ছেলেটি সরল গলায় বলতে পারল।
দীপা আড়চোখে তাকাল, ‘আপনার কোনও বোন নেই? ’
ছেলেটি মাথা নাড়ল, ‘না। আমরা তিন ভাই। আমি কোনও মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে পারি না। মানে মেয়েরাও আমার সঙ্গে কথা বলতে চায় না।’
‘কেন?’
‘কথা বললে লোকে আজেবাজে কথা বলবে।’
‘তা হলে এই যে আমার সঙ্গে কথা বলছেন!’
‘হুম। আপনি না বললে বলতাম না। আপনি কি শিলিগুড়িতে থাকেন?’
‘না। জলপাইগুড়ি।’
‘সেকী! জলপাইগুড়ি থেকে একা এসেছেন?’
‘হ্যাঁ।’
‘আপনার সাহস তো খুব। ওই যে, ওই বাড়ি।’ ছেলেটি হাত বাড়িয়ে দেখিয়ে দিল। কাঠের গেটের ও পাশে একটা গ্যারেজ, বাগান এবং একতলা বাংলো প্যাটার্নের বাড়ি। দেখতে বেশ সুন্দর। দীপা বলল, ‘আপনি আমার খুব উপকার করলেন। আসুন না?’
‘কোথায়?’ ছেলেটি চোখ বড় করল।
‘ওঁর বাড়িতে।
‘না না। উনি খুব কড়া মহিলা। আপনি কি ওঁর আত্মীয়?’
‘না না।’
‘ওঁর ওখানে থাকবেন?’
‘না। আজই চলে যাব।’
ছেলেটি মাথা নেড়ে সাইকেলে উঠে বেরিয়ে গেল আচমকা। যাওয়ার সময় কোনও কথা বলল না। গেট খুলে ভেতরে ঢুকতেই দরজায় রমলা সেনের নাম চোখে পড়ল। তা হলে ঠিক জায়গায় এসেছে ও। এবং এতক্ষণ ধরে যে-উদ্বেগ চাপা ছিল তা ঝট করে চলে গেল। দীপা মুখ ঘুরিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে ছেলেটিকে আর দেখতে পেল না। এই ছেলেটার সঙ্গে ট্রেনের লোকগুলোর কোনও মিল নেই। কিন্তু ও কেন স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পারছিল না তাই তার মাথায় ঢুকছিল না।
দরজা খুললেন এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক! ‘কাকে চাই?’
‘রমলা সেন আছেন?’
‘না। নেই! কী নাম তোমার?’
‘দীপাবলী ব্যানার্জি।’
ভদ্রলোকের কপালে ভাঁজ পড়ল, ‘জলপাইগুড়ির কলেজে পড়ো?’
দীপা মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল। ভদ্রলোক দরজা থেকে সরে দাঁড়ালেন, ‘ভেতরে এসো, রমা আধঘণ্টার মধ্যে এসে পড়বে। এসো।’
দীপা ভেতরে পা দিয়ে মুগ্ধ হল। এত সুন্দর সাজানো বসার ঘর সে এর আগে কখনই দ্যাখেনি। ঠিক উলটোদিকে রবীন্দ্রনাথের বিরাট ছবি, যেন সোজাসুজি লক্ষ করছেন।
ভদ্রলোক আবার বসতে বললে দীপা একটু আড়ষ্ট হয়েই বসল। ভেতরে আর কেউ আছে কিনা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। মুখ তুলতেই শুধু রবীন্দ্রনাথ। একটি বিশাল মানুষ যেন সমস্ত পৃথিবী আড়াল করে রয়েছেন। ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি একা এসেছ?’।
দীপা মাথা নাড়ল। তিনি হাসলেন, ‘বাঃ, সাহস তো খুব। কী খাবে বলো?’
‘কিছু না। উনি অনেকক্ষণ গিয়েছেন?’
‘হ্যাঁ। সকালে কলেজের কী একটা ব্যাপারে মিটিং ছিল।’
ভদ্রলোক বসে আছেন খানিকটা দূরে। লম্বা, গায়ের রং ময়লা, পরনে ফতুয়া আর পাজামা। জুলপি সাদা কিন্তু মুখচোখে বুড়োটে ভাব নেই। ইনি রমলা সেনকে রমা বললেন। রমলা নামটার মধ্যে আটপৌরে ব্যাপার নেই, রমায় আছে। ইনি কে? সে চোখ তুলে দেখল ভদ্রলোক তাকে লক্ষ করছেন, ‘তুমি কোনও বইপত্তর পড়বে?’
দীপা বলল, ‘না, থাক।’
‘তুমি চুপচাপ বসে থাকলে আমার খারাপ লাগবে। আমি স্নান সারতে যাব।’ ভদ্রলোক একটা পত্রিকা এগিয়ে দিলেন। তারপর দরজা বন্ধ করে ভেতরে চলে গেলেন। বাইরের ঘর এবং ভেতরের ঘরের মাঝখানে একটা ভারী পরদা ঝুলছে। পরদার নীচে সম্ভবত ছোট ছোট ঘণ্টা লাগানো আছে। উনি চলে যাওয়ার সময় মৃদু মিষ্টি শব্দ বাজল। দীপা পত্রিকাটি দেখল। দেশ। চা-বাগানে কারও বাড়িতে এই পত্রিকা সে দ্যাখেনি। হস্টেলে রাখা হয়। এই সংখ্যাটা গতকাল পড়ে এসেছে সে। তবু পাতা ওলটাতে লাগল। কত বই। কত লেখক। বিজ্ঞাপনগুলো পড়লেই অনেক বইয়ের নাম জানা যায়।
এইসময় রমলা সেন এলেন। বাইরের কড়া নাড়ার শব্দ শুনে দীপা একবার ভেতরের দিকে তাকিয়ে উঠে পড়ল। দরজা খুলতেই রমলা সেন হতভম্ব, ‘আরে! কী আশ্চর্য? তুমি?’
দীপা হাসল, ‘আপনাকে দেখতে ইচ্ছে করল।’
রমলা সেন দু’হাত বাড়িয়ে দীপাকে জড়িয়ে ধরলেন। একটা নরম শরীর এবং তা থেকে উঠে আসা মিষ্টি গন্ধে মন ভরে গেল দীপার। মাথায় মুখে হাত বুলিয়ে রমলা সেন জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কখন এসেছ? হোয়াট এ সারপ্রাইজ!’
‘এই তো একটু আগে।’ দীপা হঠাৎ লজ্জা পেল।
তাকে নিয়ে ঘরে ঢুকে চারপাশে চোখ বুলিয়ে রমলা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘সঙ্গে কে এসেছে। নিশ্চয়ই বলবে না একা একা চলে এসেছি।’
‘ঠিক তাই!’ দীপা গর্বিত ভঙ্গিতে জানাল।
‘ও মা! তুমি এত বড় হয়ে গিয়েছ?’ রমলা চোখ কপালে তুললেন।
দীপার মনে হল বয়স হওয়া সত্ত্বেও রমলাকে অনেক সুন্দরী দেখাচ্ছে আজ। ওঁর শাড়ি পরার ধরন, জামার স্টাইল, চুল আঁচড়ানোর কায়দা মিলে ওঁকে চেনাজানা মহিলাদের থেকে একদম আলাদা করে রেখেছে। রমলা ওকে হাত ধরে চেয়ারে বসালেন, ‘তোমাকে দরজা খুলে দিল কে? সুধাময়?’
‘নাম জানি না। একজন বয়স্ক ভদ্রলোক!’
সঙ্গে সঙ্গে হাসিতে ভেঙে পড়লেন রমলা, ‘সুধাময় যদি বয়স্ক হয় তা হলে আমিও তো বুড়ি হয়ে গেলাম। কিন্তু দ্যাখো, আমার একটাও চুল পাকেনি।’
‘আপনি কেন বুড়ি হতে যাবেন?’
‘বাঃ। আমি আর সুধাময় তো একসঙ্গে কলকাতায় পড়তাম।’
‘উনি আপনার কে হন?’
‘বন্ধু।’
দীপা অবাক হয়ে তাকাল। ঠিক বুঝতে পারছিল না সে। সুধাময়বাবুকে দেখে মোটেই মনে হচ্ছিল না এ-বাড়িতে বেড়াতে এসেছেন। এই মুহূর্তে তিনি বাথরুমে স্নান করছেন। ছেলে এবং মেয়েতে বন্ধুত্ব হয় বিয়ের আগে। হয় তারা বিয়ে করে, নয় সেখানেই বন্ধুত্ব শেষ হয়ে যায়। এত বয়স পর্যন্ত কোনও বন্ধুত্ব থাকে নাকি? রমলা সেন তখন দরজা বন্ধ করছেন।
দীপা জিজ্ঞাসা করল, ‘উনি কোথায় থাকেন?’
‘কে? ও সুধাময়ের কথা জিজ্ঞাসা করছ? ও থাকে বর্ধমানে। ওখানকার কলেজে পড়ায়। ছুটি পেলেই এখানে চলে আসে।’ রমলা ব্যস্ত হয়ে উঠলেন, ‘আজ কিন্তু বাড়িতে শুধু মাংস ভাত। তোমার খেতে অসুবিধে হবে না তো?’
দীপা মাথা নাড়ল, না।
রমলা সেন জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমার ঠাকুমা অনুমতি দিয়েছেন?’
দীপা হেসে ফেলল, ‘এখনও না। কিন্তু আমি হস্টেলে খাওয়া শুরু করেছি।’
‘বাড়িতে জানে?’
‘এখনও না। কারণ হস্টেলে আসার পর এখনও আমি চা-বাগানে যাইনি। শুধু মাছটা খাই না। কেমন আঁশটে গন্ধ লাগে।’
‘গুড। আপরুচি খানা। যা তোমার খেতে ভাল লাগে তাই খাবে। এসো, ভেতরে।’ রমলা সেন পরদা সরিয়ে ভেতরে পা বাড়ালেন। দীপা তাঁকে অনুসরণ করল। একটাই শোওয়ার ঘর। দ্বিতীয় ঘরে খাওয়ার টেবিল এবং একটা ছোট ডিভান। সেখানে পৌঁছে রমলা গলা তুলে বললেন, ‘সুধাময়, হয়ে গিয়েছে?’
‘এক মিনিট।’ ও-পাশের একটা দরজার আড়াল থেকে শব্দদুটো ভেসে এল।
শোওয়ার ঘরে ঢুকে আটপৌরে হচ্ছিলেন রমলা। দীপা দরজায় দাঁড়িয়ে দেখল দুটো সিঙ্গল খাটের মাঝখানে একটা ছোট টেবিল। এ-পাশে ড্রেসিং টেবিল। ও-পাশের দেওয়াল জুড়ে তরুণ রবীন্দ্রনাথের ছবি। যে-রবীন্দ্রনাথের দাড়ি ওঠেনি, মাথার চুলে কাঁধ তেমন ঢাকেনি। এত সুন্দর পবিত্র মুখ কোনও মানুষের হয় তা ছবিটির দিকে না তাকিয়ে বোঝা যাবে না। দীপা ছবিটির দিকে তাকিয়ে আছে দেখে রমলা বললেন, ‘আমার প্রথম ও শেষ প্রেমিক। কেমন দেখছ?’
‘খুব সুন্দর। আপনি ওঁকে দেখেছেন?’
‘না। এখন ভাবি কী বোকা ছিলাম তখন। তোমার মতো সাহসী হলে ঠিক চলে যেতাম জোড়াসাঁকোয়। ওঁকে কবে দেখলাম জানো? যখন উনি দেহ রাখলেন। সেদিন হাজার হাজার মানুষের সঙ্গে আমরাও শ্মশানে গিয়েছিলাম। পরে মনে হয়েছিল ওটাও ভুল করেছিলাম। কবির সঙ্গে কখনও শ্মশানে যেতে নেই। যিনি বেঁচে থাকবেন আমার শেষ নিশ্বাস পড়া পর্যন্ত তাঁর শরীর লীন হওয়া দেখতে যাব কেন?’
রমলা সেনের কথা শেষ হওয়ামাত্র সুধাময় বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলেন, ‘গুরু-শিষ্যার মিলন হল?’
রমলা বললেন, ‘গুরু বলছ কেন? সেই যোগ্যতা আমার আছে? যাও দীপা, বাথরুম থেকে হাতমুখ ধুয়ে নাও।’ সুধাময়ের জন্যেই দীপা দরজা ছেড়ে বাথরুমে চলে এল। একটি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন বাথরুম। কিছুদিন আগে কারও একটা লেখায় দীপা পড়েছিল যে কোনও মেয়ের রুচি বোঝা যায় তার পায়ের গোড়ালি দেখে আর কোনও বাড়ির চরিত্র বোঝা যায় তার বাথরুমে ঢুকলে। চৌব্বাচ্চা নেই ফলে তার নীচে জমা ময়লাও নেই। দু’ দুটো কল আছে। আর আছে মাথার ওপর ঝাঁঝরি। মনোরমা বলেন, ‘মেয়েদের কখনও উদোম হয়ে স্নান করতে নেই। বাথরুমেও নয়। গায়ে একটা কিছু আবরু না থাকলে নিজের কাছেই লজ্জা করবে।’ কিন্তু ওই শাওয়ারের নীচে দাঁড়িয়ে সেটা করতে কারও ভাল লাগবে? র্যাকে সাবান এবং কতরকমের শিশি। দীপার মনে হল চাকরি পেলে সে এইরকম একটা ফ্ল্যাটে একা থাকবে সাজিয়ে গুছিয়ে। হাতমুখ ধুয়ে একটা পরিষ্কার তোয়ালেতে মুখ মুছল সে। চা-বাগানে এখনও সবাই গামছা ব্যবহার করে। একটা তোয়ালে আছে যা অঞ্জলি কোনও বিশেষ অতিথির জন্যে তুলে রাখে। এতে এতদিন তাদের কোনও অসুবিধে হয়নি। আজ মনে হল তোয়ালের আরাম গামছায় পাওয়া যায় না। মুখ মোছার পর দরজা খুলতে গিয়ে তার শোওয়ার ঘরটার কথা মনে এল। সুধাময় কোথায় শোন? এ-বাড়িতে তো আর কোনও শোওয়ার ঘর নেই। খাওয়ার ঘরে যে-ডিভান রয়েছে সেখানে? নাকি পাশাপাশি দুটো খাটের একটাতে? শুধুই যদি বন্ধু হয় তা হলে ওরা এক ঘরে শুতে পারে? দীপার শরীর একটু একটু করে ভারী হয়ে উঠল। রমলা সেন সম্পর্কে মা যা বলে তাই কি ঠিক? তারপরেই খেয়াল হল উনি রবীন্দ্রনাথের ছবি দেখিয়ে বলেছেন আমার প্রথম ও শেষ প্রেমিক। তার মানে সুধাময় ওঁর প্রেমিক নয়। রবীন্দ্রনাথ তো মারা গিয়েছেন উনিশশো একচল্লিশ সালে। একটু স্বস্তি হল দীপার। সে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এল।
খাওয়ার টেবিলে বসে একটু নার্ভাস হল দীপা। চিনেমাটির পাত্রে ভাত চাপা দেওয়া, মাংসও সেইরকম। আর একটা পাত্রে অদ্ভুত একটা তরকারি রয়েছে। সুধাময় চামচে করে ভাত এবং সেই তরকারি তুলে নিচ্ছিলেন। রমলা সেন বললেন, ‘ইস, একটা চিঠি লিখে যদি আসতে তা হলে ভাল কিছু রাঁধতে পারতাম। ডাল পর্যন্ত করিনি।’
সুধাময় পাত্রদুটো দীপার দিকে এগিয়ে বললেন, ‘আর একদিন খাইয়ে দিয়ো।’
খেতে বসে নিজের হাতে খাবার তুলে নেবার অভ্যেস নেই দীপার। মনোরমা দেখলে এতক্ষণে কুরুক্ষেত্র বেধে যেত। রমলা সেন এঁটো মানেন না বোঝাই যাচ্ছে। ভাত নিতে গিয়ে যতটা সম্ভব কম নিল সে। মনে হচ্ছিল ওরা যেন না ভাবে সে বেশি খায়। তরকারিটা তুলে সে জিজ্ঞাসা করল, ‘এটা কীসের তরকারি?’
‘পোস্ত ঝিঙে চিংড়ি দিয়ে। তোমরা পোস্ত খাও না?’
‘বাড়িতে হয় না।’ সত্যি কথাটা বলে ফেলল দীপা?
‘সেকী!’ সুধাময় অবাক হলেন, ‘এইরকম ডিলিশিয়াস তরকারি তোমরা খাও না?’
রমলা বললেন, ‘পোস্তটা দক্ষিণবাংলায় চালু বেশি। উত্তরবাংলায় এখনও চল হয়নি। শিলিগুড়িতে মাত্র তিনটে দোকানে এখন পোস্ত পাওয়া যায়।’
‘অদ্ভুত তো।’ সুধাময় খেতে খেতে মন্তব্য করলেন।
‘অদ্ভুত কেন হবে! অঞ্চলভিত্তিক খাবার খাওয়ার অভ্যেস তো হবেই। পূর্ববাংলায় শুঁটকির চল খুব, দক্ষিণবাংলায় লোকে বমি করবে। উত্তরবাংলায় ঢেঁকির শাক নামে এক ধরনের শাক আছে। তুমি কখনও নাম শুনেছ?’
না।’ সুধাময় মাথা নাড়লেন।
‘একদিন খাওয়াব। দারুণ। যাক, দীপা, তোমার খবর বলো। কলেজ কেমন লাগছে?’
‘ভাল।’ দীপার পোস্ত খারাপ লাগছিল না।
‘জলপাইগুড়ির কলেজ তো কোএডুকেশন?’ সুধাময় মুখ তুললেন।
‘হ্যাঁ। ছেলেদের সঙ্গে আলাপ হয়েছে?’ রমলা জিজ্ঞাসা করলেন।
‘না।’ দীপা মাথা নাড়ল।
‘সেকী! কেন?’
‘খুব কম মেয়েই ছেলেদের সঙ্গে কথা বলে। আমরা কমনরুমে বসে থাকি। স্যার যাওয়ার সময় ডেকে নিয়ে যান। ক্লাসেও আমরা আলাদা বসি।’
‘কখনও মনে হয়নি তোমার, কেন এইভাবে আলাদা রাখা হবে? তোমরা এক ক্লাসে একই মাইনে দিয়ে পড়াশুনা করছ। বয়সও একই।’
‘আসলে কিছু কিছু ছেলে এত উদ্ধত যে সব মেয়ে তাদের সহ্য করতে পারে না।’
‘এটা কোনও যুক্তি হল না। পোস্ত কেমন লাগল?’
দীপা ঘাড় নাড়ল, ‘ভাল।’
রমলা সেন বললেন, ‘তুমি যদি শিলিগুড়িতে থেকে কলেজে ভরতি হতে তা হলে একটা প্রত্যক্ষ যোগাযোগ থাকত। কিন্তু তোমার বাবা রাজি হলেন না। আমি ওঁর মানসিকতা বুঝি। এখন তোমার হস্টেল কলেজ মিলিয়ে কেমন খরচ পড়ছে?’
‘আমি ঠিক জানি না। বাবাই প্রথমবার দিয়ে গিয়েছেন।’
‘ঠিক নয়। নিজের ব্যাপারটা সবসময় নিজে খেয়াল রাখবে। তা না হলে দায়িত্ববোধ আসবে না। ভাল রেজাল্ট করতেই হবে। নইলে তোমার বাবার এত পরিশ্রমের অর্থের অপচয় হবে, এই কথাটা সবসময় মনে রাখবে।’
‘প্রথম মাসে বাবা টাকা দিয়েছেন। কিন্তু তারপর থেকে জলপাইগুড়ির এস সি রায় আমার সমস্ত খরচ দেবেন৷ উনি ভাল ছেলেমেয়েকে দিয়ে থাকেন।’
কী খরচ দেবেন? হয়তো কলেজের মাইনেটা দিয়ে দেবেন, তার বেশি কেউ করে না।’
‘শুনেছি উনি মাসে দেড়শো টাকা করে দেবেন।’
‘ইম্পসিব্ল। এখন একটি আপার ডিভিশন ক্লার্ক কিংবা স্কুল মাস্টার কাজে ঢুকে অত টাকা পায় না। না না, এসব কথায় কান দেবে না। তোমাকে দাঁড়াতেই হবে। কলেজে রাজনীতি হবেই, আমার উপদেশ, তুমি সেখানে নাক গলিয়ো না। কলেজ পলিটিক্স হল শরতের বৃষ্টির মতো। হেমন্ত শীত বসন্ত গ্রীষ্মে তার কোনও মূল্য নেই।
দুপুরের ট্রেন ধরিয়ে দেবার জন্যে রমলা সেন দীপাকে নিয়ে দেড়টা নাগাদ রিকশায় উঠলেন। সুধাময় গেট পর্যন্ত এলেন। রমলা বললেন, ‘আজ এসেছ ঠিক আছে, কিন্তু খুব জরুরি দরকার না থাকলে হুটহাট চলে এসো না। এখনও এ-দেশে একা মেয়েকে রাস্তায় দেখতে মানুষ অভ্যস্ত নয়।’
দীপা জবাব দিল না। কিছুক্ষণ বাদে রমলা নিজেই বললেন, ‘সুধাময়কে দেখে তুমি নিশ্চয়ই অবাক হয়েছ! এ-দেশের ভাবনায় তাই হওয়া স্বাভাবিক। আমরা খুব ভাল বন্ধু। নানান কারণে একসময় আমাদের ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল। আমার মতো ও নিজেও বিয়েথা করেনি। ওর আমার কাছে আসা নিয়ে শিলিগুড়িতে একসময় হইচই হতে যাচ্ছিল। কিন্তু আমার জীবনযাপন দেখে আর সেটা দানা বাঁধেনি।
রিকশায় বসে দীপা কথাগুলো শুনতে শুনতে অন্যমনস্ক হয়ে পেছনে তাকাতেই চমকে উঠল। সেই ছেলেটা। যে তাকে রমলা সেনের বাড়িটা দেখিয়ে দিয়েছিল সে রিকশার বেশ কিছুটা পেছনে সাইকেল চালিয়ে আসছে। দীপার খুব মজা লাগল। সে বুঝতে পারল ছেলেটি এতক্ষণ তার জন্যে অপেক্ষা করছিল। কেন?
দীপা রমলা সেনকে জিজ্ঞাসা করল, ‘রিকশাটাকে দাঁড়াতে বলবেন?’
‘কেন? ও, নদীটাকে দেখবে। মহানন্দা। এখন অবশ্য কিছুই নেই দেখার। কিন্তু তোমার ট্রেনের তো বেশি দেরি নেই। ভুল হয়ে গেল, এদিকে না এসে টাউন স্টেশনের দিকে গেলেই হত।’ রমলা ঘড়ি দেখলেন কবজি ঘুরিয়ে।
‘না না। পেছনে একটা ছেলে সাইকেল চালিয়ে আসছে। ও আপনার বাড়িটা আমাকে দেখিয়ে দিয়েছিল। ওকে একটা ধন্যবাদ দেওয়া উচিত।’
রমলা সেন মুখ ফিরিয়ে তাকালেন। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, ‘সে তো অনেক আগের কথা। এখন পেছন পেছন আসছে কেন?’
‘তা আমি জানি না।’ দীপা সহজ গলায় জানাল।
‘ভেরি ব্যাড। এইসব ছেলেকে সবসময় এড়িয়ে চলবে।’
‘ও কিন্তু খুব নার্ভাস। আমার সঙ্গে কথা বলার সময় ঘমছিল। বাড়িতে বোনটোন নেই। কোনও মেয়ে নাকি ওর সঙ্গে কথা বলে না।’ দীপা জানাল।
‘এইট্টি পার্সেন্ট বাঙালি ছেলের ওই বয়সে একই অবস্থা! সহজভাবে মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে পারে না বলেই মেয়েরা এড়িয়ে যায়। এদের নিয়ে মাথা ঘামাবার কিছু নেই।’
স্টেশনে রিকশা থেকে নামবার পর দীপা ছেলেটিকে দেখতে পেল না। হয়তো তখন রমলা সেন মুখ ফিরিয়ে ওকে দেখায় সে আর সাহস পায়নি এগিয়ে আসার। কেন জানে না, দীপার মনে মায়া জন্মাল ছেলেটির জন্যে।
রমলা সেন জোর করে টিকিট কেটে দিলেন। দাঁড়িয়ে থাকলেন যতক্ষণ ট্রেন না ছাড়ে। শেষ মুহূর্তে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘রবীন্দ্রনাথের কবিতাগুলো সব পড়েছ?’
জানলার পাশে বসে দীপা মাথা নাড়ল, ‘হ্যাঁ।’
‘মনের মধ্যে গেঁথে নাও, এক্কেবারে হৃদয়ে। সারাজীবন অক্সিজেন দেবে।’
দীপা হাসল। রমলা বললেন, ‘ট্রেন দেখলেই আমার মন খারাপ হয়ে যায়। খুব ইচ্ছে হচ্ছে তোমার সঙ্গে চলে যেতে।’
‘আসুন না। খুব মজা হবে।’
‘না বাবা। বাড়িতে সুধাময় একলা থাকবে। তোমার ওকে কেমন লাগল?’
‘ভাল। আচ্ছা, একটা কথা বলব?’
‘বলো।’ রমলা সেন প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে ট্রেনের জানলায় বসা দীপার সঙ্গে কথা বলছিলেন।
‘আপনাদের বিয়ে হচ্ছে না কেন?’ সাহস করে জিজ্ঞাসা করে ফেলল দীপা।
চোখ বন্ধ করলেন এক পলকের জন্যে রমলা সেন, ‘আমাদের যেমন অনেক ব্যাপারে বেশ মিল তেমন বহু ব্যাপারে আকাশ পাতাল ফারাক। এই অবস্থায় কিছুদিন ভাল থাকা যায় কিন্তু চিরকাল থাকলে গেলে অশান্তির আগুনে জ্বলতে হবে।’
কথা শেষ হওয়ামাত্র ট্রেন ছাড়ল। রমলা সেন ধীরে ধীরে পেছনে পড়ে গেলেন। দীপা কথাগুলোর অর্থ তলিয়ে ভাবতে যেতেই চমকে উঠল। প্ল্যাটফর্মের শেষ প্রান্তে সেই ছেলেটা একা দাঁড়িয়ে। চোখাচোখি হতেই কেমন লজ্জিত হল। দীপা জানলা থেকেই হাত নেড়ে উঠল। ছেলেটা হাত তোলার সুযোগ পেল না। তার আগেই ট্রেন গতি বাড়িয়েছে। কিন্তু দীপার মনে হল ছেলেটা হাত তুলতেও সংকোচ বোধ করছিল। ছুটন্ত ট্রেনের কামরায় বসে আবার ছেলেটার জন্যে ওর মায়া থেকে কষ্টবোধ হল। কী করুণ লাগছিল ওর মুখটা। রমলা সেন বলেছেন এদের এড়িয়ে যেতে। রমলা সেন। এক অদ্ভুত জীবন দেখে এল সে আজ। ভাল না মন্দ তা পরের কথা।
হস্টেলের দরজায় যখন ফিরল সে তখনও রোদ মরেনি। আর তখনই সে দরজার পাশে অমরনাথকে দেখতে পেল। দুটো হাত বুকে ভাঁজ করে রেখে দাঁড়িয়ে আছেন। মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কোথায় গিয়েছিলে?’
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন