সমরেশ মজুমদার
আজ সারাটা দিন সূর্যদেব উঠলেন না। কাঠকয়লার মতো মেঘ ভুটান পাহাড় থেকে নেমে সারা আকাশ জুড়ে অনড় হয়ে রয়েছে সেই শেষরাত থেকে। সারাটা দিন কেটে গেল গভীর আলস্য নিয়ে। শেষ বিকেলে বাতাস বইল; কাছাকাছি কোথাও বৃষ্টি হয়ে গেছে এমন আমেজ ছিল সেই বাতাসে। একটু শীতল হয়ে উঠল চারপাশ।
চকোলেট মিলিয়ে যাওয়ার পরও জিভে যেমন তুলতুলে অনুভূতি ছড়ানো থাকে তেমনি এক আলো এখন মাঠের ওপরে, দেওদার গাছের মাথায়, কোয়ার্টার্সগুলোর টিনের চালের চুড়োয় চুড়োয় নেতিয়ে রয়েছে। মুখ তুলে আকাশ দেখলে মনে হয় মেঘেরা বুঝি হাওয়ার ধকল সইতে না পেরে এক ছুটে নেমে এল; কিন্তু আজ বৃষ্টি হবে না। মেঘগুলো এই হঠাৎ-নামা শীতের দাঁত সইতে না পেরে কুঁকড়ে যাবে। এইভাবেই দু’-তিনদিন সইবার পর জল ঝরবে চা-বাগানের ওপর, কোয়ার্টার্স, মাঠ, আসাম রোড ভিজবে তেমাথা বুড়ির মতো অসাড়ে। এবং সেই পর্ব শেষ হলেই শীত নামবে জাঁকিয়ে। আজকের মেঘ যেন বুধুয়ার তরকারি কোটা, রান্নাঘরে মায়ের উনুনে কড়াই চাপানোর অনেক দেরি। মাঠের মাঝখানে চাঁপা ফুলের গাছের নীচে দাঁড়িয়ে শিরশিরে হাওয়ায় একটু কেঁপে উঠে দীপা চিৎকার করল, ‘তাড়াতাড়ি কর, আমার শীত করছে।’
ওপর থেকে কোনও উত্তর এল না। যে উঠেছিল ডালে ডালে পা দিয়ে, হাওয়া তার পাঁজরেও কাঁপন তুলেছিল। কিন্তু মরিয়া হয়ে সে হাত বাড়াচ্ছিল সদ্যফোটা সোনালি চাঁপার দিকে। এ-বছর ওই গাছে প্রথম কুঁড়ি ফুটেছে। লক্ষ করেছিল সে, আর তারপরই এই জেদ। অথচ ফুলটা কেবলই নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। পায়ের চাপে ডালটা দুলছে আর সেইসঙ্গে ফুলটাও। দীপা যখন দ্বিতীয়বার চিৎকার করল তখন তার মনোযোগ নষ্ট হল। চোখ তুলে আকাশ দেখে ভয় ঢুকল মনে। শাঁখ বাজছে কোয়ার্টার্সে কোয়ার্টার্সে। সে আবার মরিয়া হল। এবং এইবার পাতাসুদ্ধ ফুল চলে এল হাতে। তরতর করে দুটো ডাল নেমে এসে নীচে তাকিয়ে দেখল দীপা নেই।
মাঠটা এক নিশ্বাসে দৌড়ে আসতেই শীত উধাও, ঘনঘন নিশ্বাসে শরীর গরম। দীপা দাঁড়িয়ে গেল। এখন সামনের গেট দিয়ে ঢোকা মানে একশোটা বকুনির সামনে দাঁড়ানো। ঠাকুমা যতটা না মা তার তিনগুণ। সে পায়ে পায়ে পিছিয়ে এল। দুটো কোয়ার্টার্সের মাঝখানের সরু গলি দিয়ে চলে যাওয়া যায় পেছনে। যদিও ও-পাশটায় অযত্নে বেড়ে-ওঠা জঙ্গল সাধারণ বিকেলেই গা ছমছমে হয়ে থাকে এবং আজ মেঘ আছে বলে আরও মারাত্মক, তবু পেছনের বাগানের গেট খুলে ভেতরে ঢুকে একেবারে উঠোনে চলে গেলে অনেকের দৃষ্টি এড়ানো যাবে। দীপা দ্রুত পা চালাল। গলিটা পেরিয়ে কলাগাছের বনের মধ্যে ঢুকে যাওয়ামাত্র দ্বিতীয় চিন্তায় সে থেমে গেল। এখনও শীত পড়েনি। অতএব সাপেরা, রাত্তিরবেলায় সাপ বলতে নেই, ঠাকুমা বলেন অন্ধকারে পথ চলতে গেলে তালি দিতে হয় এবং সেইসঙ্গে আস্তিক আস্তিক বললে তেনারা সরে যান, দীপা সেইভাবে এগোতে লাগল। মাঠের ভেতর তবু কিছু দেখা যাচ্ছিল কিন্তু এখানে ঘাসগুলোও নজরে আসছে না। বাড়ির পেছনের পায়ে-হাঁটা পথটায় এসে দীপা বাতাবি লেবুর ফুলের গন্ধ পেল। এদিকটায় খোকনদের বাড়ির কোণে তিন তিনটে বাতাবির গাছ আছে। পূর্ণিমার রাত্রে, সেই ডিসেম্বর জানুয়ারি মাসে, খোকনের ঠাকুমা আকাশ থেকে নেমে আসেন বাতাবি লেবুর রস খেতে। যখন বেঁচে ছিলেন তখন তিনি কিছুতেই ডিসেম্বরের পূর্ণিমার আগে বাতাবি খেতেন না। তাঁর ধারণা ছিল কালীপুজো পেরিয়ে যাওয়ার অনেক পরে বাতাবির বুকের রস ঘন হয়। মারা যাওয়ার পর এক ডিসেম্বরের পূর্ণিমায় মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে কোয়ার্টার্সের জানলা দিয়ে চাঁদ দেখতে গিয়ে খোকনের মা নাকি দেখেছিলেন, তাঁর শাশুড়ি বাতাবি গাছের ডালে বসে রস চুষে খাচ্ছেন। তারপর থেকে ওই দুই পূর্ণিমার পরের সকালে গাছের নীচে পড়ে থাকা বাতাবিগুলো তুলে নদীতে ফেলে দিয়ে আসা হয়। গন্ধ নাকের মধ্যে দিয়ে শরীরের ভেতরে যেতেই পড়ি কি মরি করে ছুট দিল দীপা। খোকনের ঠাকুমাকে সে দেখেছে এই অ্যাট্টুকিনি বয়সে। ফোকলা দাঁতে হেসে বলতেন, ‘হ্যাঁরে বেটি, তোর বরের সঙ্গে আমার বে দিবি?’ শুধু এইটুকুনি মনে আছে কিন্তু তাতেই গায়ে কাঁটা উঠে এখন একাকার। টিনের দরজাটা একটা তারের হুকে আটকানো থাকে। হাতড়ে হাতড়ে সেটাকে খুলে তবে স্বস্তি। লক্ষ্মী ডাকছে গোয়ালঘরে। ঠাকুমা বলেন, গোরুটা কুকুরের কাজ করে। বাগানে কারও পায়ের আওয়াজ পেলেই হাম্বা হাম্বা ডাক শুরু করে দেয়। ওই ডাক কানে যাওয়ামাত্র দীপার মনে হল সে নিজের জায়গায় এসে গিয়েছে, আর কোনও ভয় নেই। টিনের দরজাটা তারের জালের দেওয়াল কেটে বানানো। সেটাকে বন্ধ করতে গিয়ে দীপা পেছনের অন্ধকারের দিকে তাকাল। ঝোপঝাড়ের পরই ছোট্ট নদীটা। এখনও জল আছে হাঁটু পর্যন্ত। চৈত্রমাসে পায়ের পাতায় নেমে যায়। বর্ষায় এক বুক। চওড়ায় আসাম রোডটার মতন। কিন্তু এখন তার বুকে কুন্দ ফুলের মতো জোনাকি ফুটে রয়েছে। রাত যত বাড়বে সমস্ত চরাচরে তখন জোনাকিরা কুরুক্ষেত্র শুরু করে দেবে। কী মজা লাগে তখন চেয়ে দেখতে। দীপার হঠাৎ মনে হল একমাত্র মানুষ ছাড়া পৃথিবীতে আর কারও বোধহয় শীত করে না।
রান্নাঘরের পাশ দিয়ে উঠোনে ঢুকতেই সে হ্যারিকেনের আলো দেখতে পেল। সর্বনাশ! হ্যারিকেন জ্বালা হয়ে যাওয়া মানে মায়ের হাত এখন খালি। নিশ্চয়ই ইতিমধ্যে দীপার খোঁজ পড়েছে কয়েকবার। বিশুর ওপর প্রচণ্ড রাগ হয়ে গেল তার। লক্ষবার বলেছে আজ চাঁপা ফুল তোলার দরকার নেই, তবু কথা শুনল না। কেউ ফুলের জন্যে গাছে উঠলে শেষ পর্যন্ত না দেখে তাকে গাছের ডালে ফেলে রেখে চলে আসা যায়? গাছের ডালের কথা মাথায় আসতে দীপা ফিক করে হেসে ফেলল। খোকনের কাকা এক বিকেলে কুল পাড়তে গাছে উঠেছিলেন নদীর ধারে। কেউ নাকি বলেছিল ওই গাছের নীচের ডালের কুলগুলো যত টক ওপরের ডালে তত মিষ্টি। ওঠার সময় বুঝতে পারেননি। প্রায় মগডালে ওঠার পর মিষ্টি কুল খেয়ে সময়টা ভুলে গিয়েছিলেন। খেয়াল হল যখন তখন এই আজকের মতো আঁধার নেমেছে। তড়মড়িয়ে নামতে গিয়ে ঠিক নীচের ডালটা গেল ভেঙে। ওপরের ডালটা ধরা ছিল বলে রক্ষা। তখন আর নামার উপায় নেই। সেই ডালেই কোনওমতে দাঁড়িয়ে চিৎকার শুরু করলেন। রাতটা ছিল অমাবস্যার। নদীর ধারে বড় বড় গাছের জঙ্গল ভেদ করে কেউ অকাজেও যায় না সন্ধে নামলে। খোকনের কাকার চিৎকার শুনতে পাবে কেন কেউ? ডেকে ডেকে গলা ধরে গেল। খিদে পেল এবং তারপরেই তাঁর মনে পড়ল গাছটা কুলের। আশশ্যাওড়া আর কুলগাছে পৃথিবীর যত শাঁকচুন্নিরা গপ্পো করতে খুব ভালবাসে। বট অশ্বথ হলে তবু ব্রহ্মদৈত্যির দর্শন পাওয়া যেত। তেনারা ভালমানুষের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেন না। কিন্তু শাঁকচুন্নিরা হল খুব খারাপ শ্রেণির পেতনি। তারা নাকি আইবুড়ো ছেলে দেখলেই আনন্দে ডিগবাজি খায়। আইবুড়ো ছেলের ঘিলু খেলে শাঁকচুন্নিদের আয়ু বেড়ে যায়। খোকনের কাকা যেই সেটা মনে করলেন তখনই রাম নাম করতে লাগলেন। ওই নদীটা যে পাশে সেই খেয়াল নেই তখন। নদী তো মেছোপেতনিদের প্রিয় জায়গা। সেটা মনে পড়তেই তাঁর চিৎকার বেড়ে গেল। ভাগ্য ভাল, ওপারের লাইনেব একটা মাতাল কুলি সেই চিৎকার শুনতে পেয়ে নদীর এপারে এসেছিল পেতনি পড়েছে মনে করে। তার চেঁচামেচিতে সবাই খোকনের ছোটকাকাকে নামিয়ে আনে। পরে নাকি তিনি খুব আফশোস করেছিলেন, যদি মাতালটা না আসত তবে সেইরাত্রে এক অপূর্ব অভিজ্ঞতা হত। এই বছরখানেক হল খোকনের ছোটকাকা জলপাইগুড়িতে চাকরি করতে গিয়ে বিয়ে করেছেন। ফরসা লম্বা সুন্দর চেহারা। বিয়ের পর এখানে যখন বউ নিয়ে এলেন তখন ঠাকুমাকে বলতে শুনেছিল, ‘কপালে যা লেখা আছে তা খণ্ডাবে কে বউমা! কুলগাছের শাঁকচুন্নির হাত থেকে না হয় মাতাল বাঁচিয়েছিল কিন্তু শহরের শাঁকচুন্নি তো ঠিক ঘিলু চুষে নেবে। ছেলেটার হাড়ে দুব্বোঘাস গজিয়ে ছাড়বে, দেখো।’ পরদিন দীপা সটান খোকনদের বাড়িতে গিয়ে ওর নতুন কাকিমাকে ভাল করে দেখেছিল। গায়ের রং কালো, মাথায় ঘোমটা নেই, বড্ড রোগা আর জোরে জোরে কথা বলেন, কিন্তু শাঁকচুন্নি বলে মনে হয়নি। ওর কেবলই মনে হয়েছিল সবাই যখন জানেই, তখন মাথায় ঘিলু ঠিক রাখার জন্যে খোকনের কাকুকে সাবধান করে দিচ্ছে না কেন?
চট করে বাথরুমে ঢুকে গেল দীপা। অন্ধকারেই। চৌবাচ্চার জলে হাত দিতেই মনে হল সেখানেও ঠান্ডা সেঁদিয়েছে। শিউলি ফুল ঘাসের ওপর পড়া মানেই শিশির জমা। কিন্তু ওই বৃষ্টিটা না-নামা পর্যন্ত সোয়েটার পরতে হয় না। তা হলে জল এত ঠান্ডা হল কেন? কিছুদিন হল একটা কথা ওর কেবলই মনে হচ্ছে, আকাশ, মাটি, গাছপালা, চা-বাগান, নদী, এমনকী পাখিদের মধ্যেও কীরকম গোপন যোগাযোগ রয়েছে তা কেবল তারাই বুঝতে পারে। বাড়ির পোষা কুকুর বেড়াল গোরুদের সঙ্গে ততটা যোগাযোগ নেই, বেড়ালের সঙ্গে তো একদম না।
এইসময় একই সঙ্গে ধারাপাত আর বর্ণপরিচয় পড়া আরম্ভ হল। দু’জন দু’গলায় সুর করে করে। আজ আর নিস্তার নেই। ওই মেঘটাও গোলমাল করে দিল। এমনভাবে আকাশটাকে ঢেকেঢুকে রেখেছিল যে আলো নেবার সময়টাকে ধরতে পারেনি। অথচ মায়ের কড়া হুকুম, শাঁখ বাজার আগেই ঢুকতে হবে। বাথরুম থেকে বেরিয়ে বারান্দার তারে ঝোলানো গামছা টেনে পা মুছতে গিয়ে জবাকুসুমের গন্ধ পেয়ে আবার শক্ত হল দীপা। মায়ের গামছা টেনে নিয়েছে সে। মা কাউকে নিজের গামছা ব্যবহার করতে দেয় না। চটজলদি পা না-মুছেই সেটাকে তারে টানটান করে মেলে দিল সে। তারপর লম্বা ঘরটায় উঁকি মারল। ঠাকুমা নেই, মাকেও দেখা যাচ্ছে না। কোনার দিকে মাদুর পেতে দুই ভাই পড়তে বসেছে। ওকে দেখামাত্র একজন একগাল হাসল, ‘অ্যাই দিদি, বিশুদা তোকে ডাকছিল!’ দীপা ঠোঁট কামড়াল। বিশু কেন এল? ও বাড়ির পেছন দিক দিয়ে ঘুরে এসেছে বটে কিন্তু এমন কিছু দেরি করেনি, আর এরমধ্যেই বিশু এসে গেল? দ্বিতীয়জন আরও কচি গলায় বলল, ‘তোর চাঁপা ফুল দিয়ে গিয়েছে।’
প্রচণ্ড রাগ হয়ে গেল দীপার। সে চাপা গলায় বলল, ‘চুপ কর!’ মনে মনে ঠিক করল কাল বিশুর সঙ্গে মোটেই কথা বলবে না। কিন্তু ফুলটা কার হাতে দিয়েছিল?
পাশের ঘরে ঢুকতেই সে থতমত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। মা ঠাকুরঘরের দরজা ভেজিয়ে ঘুরে দাঁড়াতেই ওকে দেখতে পেয়েছে, ‘কোথায় ছিলি?’
‘মাঠে।’ দীপার গলার স্বর কেঁপে উঠল।
‘তা মাঠেই থাকলে পারতে। এত্ত করে বলেছি শাঁখ বাজার আগেই বাড়ি ফিরবি, কথা কানে যায় না?’ বলতে বলতে কয়েক পা এগিয়ে এসে বাঁ হাতে খপ করে চুলের মুঠি ধরে টান দিল অঞ্জলি। আর মাথাটা ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করতেই তার ডান হাত এসে পড়ল মেয়ের গালে, ‘ধিঙ্গি মেয়ে কোনও কথা কানে যায় না? ফুল তোলানো হচ্ছে? মেরে তোমার বিষদাঁত ভেঙে দেব আজ। বল, কেন শুনিসনি কথা?’
দাঁতে দাঁত চেপে কান্নাটাকে সামলাল দীপা। অভিজ্ঞতায় জানে এইসময় কোনও প্রতিবাদ করা মানে প্রহার আরও বেড়ে যাবে। বেশ কয়েকবার মারার পর অঞ্জলি ওকে ঠেলে সরিয়ে দিল, ‘আজ রাত্রে তোমার খাবার জুটবে না। এই তোমার শাস্তি।’
এইসময় ঠাকুমার গলা বাজল দরজায়, ‘কানে মেরো না। মারতে হলে পিঠে মারবে।’
‘আমি অত হিসেব করে মারতে পারব না। কানে লেগে কালা হয়ে যায় যদি যাক। এত বড় বেয়াড়া মেয়ে, আমার কোনও কথা শুনবে না! শরীর বড় হচ্ছে, অথচ দেখুন বুদ্ধি যেন দিনদিন কমে যাচ্ছে।’ অঞ্জলি আবার মেয়ের হাত ধরে টান দিল, ‘আয় তুই আলোর কাছে।’ প্রায় হিড়হিড় করে হ্যারিকেনের কাছে নিয়ে যেতে যেতে বলল, ‘পৃথিবী তো উদ্ধার করে এলে, পা ধুয়েছ?’
ততক্ষণে এক পড়ুয়া বলে উঠল, ‘মা, দিদির পায়ে জল।’
অঞ্জলির চোখ বাঁদিকে পড়ামাত্র চিৎকারটা জোরালো হল, ‘দেখুন মা, আপনার নাতনির কাণ্ড, পা ধুয়েছেন এমন করে যে হাঁটু পর্যন্ত ধুলোয় সাদা হয়ে আছে, মোছার সময় পর্যন্ত পায়নি।’
মনোরমা গম্ভীর গলায় বললেন, ‘দীপু, যাও, ভাল করে হাত পা ধুয়ে এসো।’
মায়ের হাতের বাঁধন আলগা হওয়ামাত্র দীপা আবার বাথরুমে চলে এল। জোরে জোরে মগের শব্দ তুলে জল তুলে পায়ে ঢালতে ঢালতে সে অমরনাথের গলা শুনতে পেল, ‘আজ রাত্রে খুব ঢালবে মনে হচ্ছে! আরে, কী হয়েছে তোমাদের?
অঞ্জলির গলা কানে এল, অনেকের তো দশ-এগারো বছরে মেয়ের বিয়ে হয়ে যায়, তুমি তোমার পেয়ারের মেয়ের ওরকম একটা ব্যবস্থা করো।’ এরপর বারান্দা দিয়ে একজোড়া পা দুপদাপ শব্দ করতে করতে উঠোনে নেমে গেল। আর কথাগুলো কানে যাওয়ামাত্র দীপার বুক মুচড়ে একটা কান্না ছিটকে এল গলায়, সেইসঙ্গে চোখ ছাপিয়ে জল। সে কোনওমতে কান্নাটাকে গিলতে চাইল। অমরনাথের গলা কানে এল, ‘কী ব্যাপার?’
‘তোর মেয়েকে এবার শাসন কর অমর। বয়স হচ্ছে, এখন ছেলেদের সঙ্গে ঘুরে বেড়ানো ঠিক নয়। সন্ধের মধ্যে বাড়ি ফেরেনি বলে বউমা রাগ করে ঠিকই করেছে।’
‘ছেলেদের সঙ্গে মানে? ওর বন্ধু তো খোকন-বিশু, ওরাই?’
‘হ্যাঁ, ওরা তো ছেলেই।’
‘কী যে বলো মা, তোমাদের মাথার ঠিক নেই। মারধর হয়েছে?’
মনোরমা জবাব দিলেন না। দীপার হাত আর চলছিল না। অন্ধকার বাথরুমে যদি অনন্তকাল থাকা যেত তা হলে যেন সে বেঁচে যেত। কিন্তু এসবের মধ্যেই হ্যারিকেনের আলোটা এগিয়ে এল। অমরনাথ সেটিকে নীচে নামিয়ে রেখে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী করছিস ওখানে? আয়, বেরিয়ে আয়।’ দীপার চিবুক এবার বুকে মিশল। এবং কান্নাটা ছিটকে বের হবার পথ পেয়ে গেল। সেই শব্দ উঠোন পেরিয়ে রান্নাঘরে পৌঁছাতেই অঞ্জলি উঁচু গলায় বলে উঠল, ‘নাও, আরম্ভ হল, বাপকে দেখে মেয়ে এবার গলে গেলেন।’
অমরনাথ সেদিকে কান না দিয়ে ডাকলেন, ‘তোকে বেরিয়ে আসতে বলছি।’
প্রচুর জড়তা পায়ে নিয়ে দীপা বাইরে বেরিয়ে এসে বারান্দায় উঠে এল। অমরনাথ মেয়ের দিকে তাকালেন। গম্ভীর গলায় বললেন, ‘মুখ তোল।’
পেছন থেকে মনোরমা নিচু গলায় বললেন, ‘থাক, অনেক হয়েছে। আর কিছু বলিস না।’
‘আমি মুখ তুলতে বলেছি।’ অমরনাথের গলার স্বর বেশ কড়া।
দীপা মুখ তুলল চোখ বুজে। দুই গাল ইতিমধ্যেই চোখের জলে ভেজা, আর এক প্রস্থ জল উপচে নামল। অমরনাথ দু’হাতে মেয়েকে বুকে টেনে নিতেই কান্নাটা বাঁধন-ছেঁড়া হল। বাবার বুকে মুখ চেপে পিঠটা বারংবার ফুলে ফুলে উঠতে লাগল। কিছুক্ষণ ওরা এইভাবে দাঁড়িয়ে রইল। কান্না যখন প্রায় থামোথামো তখন রান্নাঘর থেকে অঞ্জলির গলা ভেসে এল, ‘মা, ওকে হাতমুখ ধুয়ে নিতে বলুন, চা হয়ে গিয়েছে।‘
অমরনাথ বললেন, ‘কিছু খেয়ে নিয়ে পড়তে বস মা।’
দীপার ফোঁপানি তখন স্থির। পেছন থেকে ঠাকুমা বললেন, ‘ঠিক সময়ে বাড়ি ফিরলেই তো হয়। বড় হচ্ছ তবু মাথায় বুদ্ধি হচ্ছে না কেন? তুই বিশুর কাছে চাঁপা ফুল চেয়েছিলি?’
দীপা কথা বলতে গিয়ে দেখল গলা শুকনো। সে ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলল।
অমরনাথ হাসলেন, ‘চাঁপা ফুল তোর ভাল লাগে?’
মেয়ে দু’বার মাথা ওপর নীচ করল। ঠাকুমা বললেন, ‘ছেলেদের কাছে কখ্খনও ফুলটুল চাইবি না।’
অমরনাথ মেয়েকে ছেড়ে নিজের গামছা বারান্দার তার থেকে টেনে নিলেন, ‘তা হলে তো ও চাঁপা ফুল পাবেই না। তোমার নাতনি গাছে উঠতে চাইলে দুটো পা-ই ভাঙবে।’
রান্নাঘর থেকে গলা ভেসে এল, ‘নবাবনন্দিনীকে একটু এখানে আসতে বলুন মা।’
ঠাকুমা কিছু না বলে ঘরের ভেতর চলে গেলেন। অমরনাথ ততক্ষণে বাথরুমে। দীপা দু’হাতে চোখ মুছল। জোনাকিগুলো উঠোনেও ঢুকতে আরম্ভ করেছে। পা যেন চলতেই চাইছে না এমনভাবে সে রান্নাঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়াল। একটা ট্রে-তে চায়ের কাপ ডিশ আর বিস্কুট রেখে গালে হাত দিয়ে বসে ছিল অঞ্জলি। হ্যারিকেন জ্বলছে। কিন্তু পাশের কাঠের উনুনের লকলকে শিখায় তাকে অন্যরকম লাগল এখন। দীপার মনে হল, মায়ের মুখটা মুখের ভেতর জিভ ঢুকিয়ে রাখলে মা কালীকে যেমন দেখাবে ঠিক সেইরকম দেখাচ্ছে। অঞ্জলি ট্রে-টা তুলে ধরে বলল, ‘দয়া করে বাইরের ঘরে নিয়ে গিয়ে টেবিলের ওপর রাখো। এক ফোঁটা চা যেন চলকে ডিশে না পড়ে। মানুষকে চা দেবার সময় ডিশ শুকনো রাখতে হয়।’
দীপা হাত বাড়িয়ে দেখল সে দুটো কাঁপছে। অঞ্জলি ট্রে নামিয়ে চোখে চোখ রাখতে চাইলেই মেয়ে চোখ নামাল। অঞ্জলি বলল, ‘থাক। এখানে বসো। আমি না আসা পর্যন্ত উঠবে না।’
‘পড়ব।’ গলা থেকে অনেক কষ্টে স্বরটা বের হল।
‘পড়ে তো আমাকে উদ্ধার করে দিয়েছ। আমি না ফেরা পর্যন্ত বসে থাকবি এখানে।’
ট্রে নিয়ে অঞ্জলি বেরিয়ে গেল রান্নাঘর থেকে। উনুনে কাঠ ফাটার শব্দ হচ্ছে। ওপরে একটা সসপ্যান চাপানো। দীপা বাইরে তাকাল। শোয়ার ঘরগুলো আর রান্নাঘরের মাঝখানে অন্ধকার উঠোন, ওপাশে ঠাকুমার ঘর। ঠাকুমার ঘরেই তাঁর ঠাকুরের আসন পাতা। মায়ের ঠাকুরঘরটা বড়। উঠোনে জোনাকিগুলো ছবি আঁকছে। বিশু তাকে একটা মজার মতলব বলেছে। জোনাকির পায়ে আঠা লাগিয়ে কপালে সেঁটে নিয়ে রাত্রে বের হলে লোকে অবাক হয়ে দেখবে আলোর টিপ। মায়ের ভয়ে সেটা করা হচ্ছে না। কালীপুজোর রাত্রে একবার চেষ্টা করবে সে। মাথার ওপরে টিনের চালে টপ টপ শব্দ হল। বৃষ্টি এল নাকি? একটু হাওয়া উঠতেই রান্নাঘরের দরজাটা দুলে উঠল। আর সঙ্গে সঙ্গে ভয়ে কুঁকড়ে উঠল দীপা। চোরের মতো আধ-খোলা দরজার দিকে তাকাল সে। ভূতেদের বিশ্বাস নেই। ঠাকুমা নিজের চোখে কত রাতে দেখেছে সাদা থানের মুণ্ড-হীন পা-হীন মূর্তি উঠোন দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। সারাগায়ে কাঁটা ফুটল দীপার। আগুনের কাছে সরে বসল। এইজন্যে একা রাত হলে রান্নাঘরে থাকতে চায় না সে। আর তখনই উঠোনে সাদা মূর্তিটাকে দেখতে পেল দীপা। সাদাটা তার দিকেই এগিয়ে আসছে। ভয়ে পরিত্রাহি চিৎকার করে উঠল সে। প্রায় দৌড়ে চলে এল অঞ্জলি উঠোন পেরিয়ে। এসে দেখল মেয়ে দুই হাঁটুতে মুখ ঢেকে থরথর করে কাঁপছে। অঞ্জলি ওকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞাসা করল, ‘কী হয়েছে, এই দীপু, চিৎকার করলি কেন?’ সঙ্গে সঙ্গে মাকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরল মেয়ে। কাঁপুনি তার থামতেই চায় না। মাথায় পিঠে হাত বোলাল অঞ্জলি আর সমানে কারণটা জানতে চাইল। ওপাশের বারান্দায় মনোরমা এসে গেছেন ততক্ষণে, ‘কী হল বউমা? ও চেঁচাল কেন? ও বউমা?’
অঞ্জলি নিচু গলায় বলল, ‘তাড়াতাড়ি বল কী হয়েছে নইলে ঠাকুমা ঠিক আমায় বকবে।’
মুখ না তুলে হাত বাড়িয়ে অন্ধকার উঠোনটাকে দেখাল দীপা, ‘ভূত।’
‘ভূত?’ অঞ্জলি চমকে পেছনে তাকাল।
‘সাদা থান পরে এগিয়ে আসছিল।’
‘কী যা-তা বলছিস।’ লণ্ঠনটা এক হাতে তুলে উঁচু করে ধরল অঞ্জলি মেয়েকে অন্য হাতে সামলে, ‘কিস্যু নেই। দ্যাখ না চেয়ে।’ তারপরেই তার গলা পালটে গেল, ‘এই, কে রে?’
‘হামি মাইজি!’ উঠোন থেকে বুধুয়ার গলা ভেসে এল।
‘কী করছিস ওখানে?’
‘কুছু না। দীপুদিদি আমাকে দেখে ডর পেয়ে গেল।’ বুধুয়া হেসে উঠল।
ওপাশে বারান্দায় দাঁড়িয়ে মনোরমা ধমকে উঠলেন, ‘ডর পেয়ে গেল! কী বেআক্কেলে কথা! তুই কেন রাতের বেলায় সাদা গেঞ্জি সাদা ধুতি পরেছিস। কালো শরীরে ওরকম পরলে অন্ধকারে চেনা যায়? আবার দাঁত বের করে হাসা হচ্ছে।’
অঞ্জলি বলল, ‘দেখলি? তুই বুধুয়াকে ভূত বলে ভেবেছিস! কী বোকা রে তুই!’
দীপা ধীরে ধীরে মুখ তুলল। বুধুয়া এবার রান্নাঘরের বারান্দায়। খুব রাগ হয়ে গেল দীপার। তবু নিজের বোকামিটা স্বীকার না করতে বলল, ‘ঠাকুমাও তো রাত্তিরবেলায় থান-পরা ভূতকে উঠোনে হেঁটে যেতে দ্যাখে।’
অঞ্জলি মাথা নাড়ল বিরক্তিতে, ‘ঠাকুমা বুধুয়াকে দেখে বুঝতে পারেনি।’
‘তা হলে কাল তুমি ওকে অন্য রঙের গেঞ্জি ধুতি কিনে দিয়ো।’
‘ঠিক আছে। এখন ওঠ, মোয়া দিচ্ছি, খেয়ে নিয়ে পড়তে বস। আর কখ্খনও সন্ধের পর বাড়ি ফিরবি না। অল্পবয়সি মেয়েদের সন্ধে হয়ে গেলেই কত কী হয়ে যায়!’
‘কী হয়ে যায় মা?’
‘উঃ, আবার কথা বাড়িয়ে সময় নষ্ট করা হচ্ছে। যে-কোনও ছুতোয় গল্প ফাঁদতে পারলেই হল, না?’ অঞ্জলি উঠে পাশের খাওয়ার ঘরে চলে গেল। সেখানে বিভিন্ন রকমের টিনের বাক্সে বাড়িতে তৈরি করা খাবার রাখা আছে। দীপা বুধুয়ার দিকে তাকাল। তারপর নিচু গলায় জিজ্ঞাসা করল, ‘বুধুয়াদা, তুমি কখনও ভূত দেখেছ?’
বুধুয়া মাথা নাড়ল, ‘বহুত। কিন্তু চিল্লালে ভূতরা খুব ভয় পেয়ে যায়।’
সন্ধে গড়িয়ে গেলেই ঠাকুমা নিজের ঘরে চলে যান। পুরনো দিনের একটা চিনে সেজবাতি আছে তাঁর ঘরে। আহ্ণিক সেরে তিনি রাতের খাওয়া সেরে নেন। তারপর ঠাকুর নাম লিখতে বসেন। অঞ্জলির রান্নার পাট চুকলেই বাচ্চাদের খাওয়ার ডাক পড়ে। আটটা বাজার আগেই ছোট দু’জনের বই গুটিয়ে ঢুলুনি শুরু হয়ে যায়। ডাকটা কানে আসামাত্র তারা রান্নাঘরের দিকে দৌড়ায়। এইসময় দীপার সঙ্গে অঞ্জলির একপ্রস্থ মন কষাকষি চলে আজকাল। দীপা কিছুতেই খাবে না এ-সময়ে, অঞ্জলি জেদ ধরবে তাকে খাওয়ানোর জন্যে। শেষপর্যন্ত মনোরমার গলা ভেসে আসবে, ‘ওর যখন খিদে নেই তখন কেন জোর করছ বউমা।’
আজ ছোট দু’জনের পেছনে রান্নাঘরের দরজায় চলে এল দীপা, ‘মা, আমি তো একটু আগে দুটো মোয়া খেয়েছি, এখনই কি ভাত খাব?’
অঞ্জলি হাসি চাপল, ‘ঘুমিয়ে পড়লে আর ডেকে খাওয়াব না।’
দীপা ছুটে ফিরে এল একেবারে বসবার ঘরে। বিশাল হ্যারিকেনটা স্ট্যান্ডের ওপর জ্বলছে। দীপা অমরনাথের আরামকেদারায় পা তুলে বসল। আঃ! কী আরাম! তারপর হাত বাড়িয়ে রেডিয়োটা খুলে দিল। কী সব বকর বকর করে বলছে। সে নব ঘোরাতে লাগল। হঠাৎ একটা বাজনা কানে আসতেই সে হাত সরিয়ে নিল। তারপর অমরনাথের রেখে-যাওয়া কাগজখানা টেনে নিল। সামনেই জওহরলাল নেহরুর ছবি। দীপা ছবিটাকে দেখল। বেশ দেখতে লোকটা। খোকনের চিবুকটা অনেকটা এইরকম। কাল বিশু মাছ ধরতে যাবে বলেছে। দুপুরের পর। সেই সময়টায়, খাওয়াদাওয়ার পর, যাওয়াই ভাল। কেউ খোঁজ করার সময় পাবে না। তবে যাই হোক না কেন সন্ধের আগেই ফিরতে হবে। সকালে ফড়িং ধরে রাখতে হবে দেশলাইয়ের বাক্সে। বিশু নেবে কেঁচো। কলাগাছের পচা বাকলে থাকা ওইসব লিকলিকে কেঁচোগুলোকে দেখলেই গা ঘিনঘিন করে। বঁড়শি ঢুকিয়ে ওগুলোকে ছিঁড়তে মরে গেলেও পারবে না। আগামীকালের ব্যাপারটা ভেবে উত্তেজিত হল সে। দেশলাইয়ের বাক্সের অভাব নেই। এখন বাড়িটা চুপচাপ শুধু টিনের ছাদে মাঝে মাঝে টপ টপ শব্দ হচ্ছে। বৃষ্টিটা পড়েও পড়ছে না। অমরনাথ গিয়েছেন তাস খেলতে। চা বিস্কুট খেয়েই বেরিয়ে গিয়েছেন। ফিরবেন দশটা নাগাদ। দীপা কাগজটা রেখে দিল। তারপর উঠে বাবার বইয়ের তাক থেকে রূপাঞ্জলি পত্রিকা টেনে নামাল। মায়ের সামনে এই পত্রিকায় হাত দেবার উপায় নেই। অঞ্জলির কড়া নিষেধ আছে। এখন কেউ এ-ঘরে আসবে না। কাননবালা। চন্দ্রাবতী। মেনকা। সন্ধ্যারানি। এরা সব সিনেমা করে। সিনেমা কী জিনিস জানে না দীপা। এই বাগানে সিনেমা দেখায় না। দেখতে হলে আট মাইল দূরে যেতে হবে। খুব ভাল সিনেমা এলে কয়েকদিন জল্পনা করে অমরনাথ অঞ্জলি এবং আরও তিন-চারটে পরিবার বাগান থেকে গাড়ি নিয়ে বাড়িতে ছেলেমেয়েদের রেখে সেখানে সিনেমা দেখতে যায়। প্রতিবার সঙ্গে যাওয়ার জন্যে বায়না করে বিফল হয়েছে দীপা। অঞ্জলির এক কথা, ছোটদের সিনেমা দেখতে নেই। বাবার চেয়ারে বসে দীপা ভাবতে বসল সে কবে বড় হবে! আর এটা ভাবতে গেলেই কেমন ঘুম পেয়ে যায় তার। পত্রিকাটাকে তার জায়গায় রেখে সে চেয়ারে মাথা এলিয়ে চোখ বন্ধ করতেই বাজনা বন্ধ হয়ে কী সব কথা চুং বুং করে বলা আরম্ভ হল। চটজলদি উঠে পড়ে রেডিয়োটা বন্ধ করে দিল দীপা।
রাত্রের খাওয়া চুকিয়ে ঠাকুমার ঘরে এল সে। আর তখনই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি শুরু হল। টিনের চালে বৃষ্টির বড় ফোঁটা প্রচণ্ড আওয়াজ তুলছে। আর এইরকম আওয়াজ শুনলেই বুকের ভেতরটা কেঁপে ওঠে দীপার। এক ছুটে মনোরমাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়ল সে।
মনোরমার তন্দ্রা এসেছিল। হাতের চাপে জেগে উঠে বললেন, ‘দরজাটা বন্ধ করেছিস?’
‘না।’ মনোরমার হাতে মুখ চেপে জবাব দিল দীপা।
‘যা, বন্ধ করে আয়।’
‘ভয় করছে।’
মনোরমা উঠলেন। তাঁর ঘরে ডিমবাতি জ্বলছে। দরজা বন্ধ করতে করতে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বাথরুম করেছিস তো?’
দীপা মুখ তুলল না, ‘হুঁ!’
‘বাবা ফিরেছে?’
‘না।’
‘রাত কত হল?’
‘জানি না।’
মনোরমা একটা চওড়া কম্বল বের করে নাতনির কাঁধ পর্যন্ত ঢেকে দিলেন। তারপর পাশে শুয়ে বললেন, ‘মনে মনে তিনবার শিব শিব শিব বলবি রোজ ঘুমাবার সময়।’
‘কেন?’
‘তাতে খারাপ স্বপ্ন দেখবি না।’
‘কী খারাপ স্বপ্ন?’
‘জানি না।’ নাতনির এইরকম প্রশ্নকে খুব উলটোপালটা বলে মনে হয় তাঁর। তিনি ওর মাথায় হাত দিলেন, ‘শোন, তুই তো মেয়ে। মেয়েদের সবসময় শান্ত থাকা উচিত।’
দীপা কোনও জবাব দিল না। মনোরমা বললেন, ‘বিশু খোকন, এরা সবাই ছেলে, বড় হচ্ছে, ওদের সঙ্গে আগের মতো হইচই করবি না।’
‘কেন?’
“আবার প্রশ্ন?’
‘ওরা আমার বন্ধু। তোমার কোনও বন্ধু নেই, তাই বলছ।’
মনোরমা ঢোঁক গিললেন, ‘মেয়েদের সঙ্গে মেয়েদেরই বন্ধুত্ব হওয়া উচিত।’
‘এখানে তো কোনও মেয়ে নেই আমার বয়সি। ছেলেবেলায় তোমার বন্ধু ছিল না?’
‘ওমা, আমার যখন বিয়ে হয়েছিল তখন নয়ই পার হয়নি।’
‘ধ্যাত!’
‘হ্যাঁ রে। তোর মা এ বাড়িতে এসেছিল পনেরো বছর বয়সে। তখনই সবাই বলত ধেড়ে মেয়ে ঘরে এল পোষ মানলে হয়। সেইসময় তো গৌরীদানের রেওয়াজ ছিল।’
‘গৌরীদান কী?’
‘খুব ছোটবেলায় বিয়ে দেওয়া। শিবঠাকুর যখন গৌরীকে বিয়ে করেছিলেন তখন তিনি ছিলেন এই এট্টুসখানি।’ হাসলেন মনোরমা।
‘আর শিবঠাকুর?’
‘তিনি যেমন থাকেন, তেমন।’
‘ওমা, ওই বিরাট ভুঁড়িওয়ালা বাবার বয়সি লোকটার সঙ্গে এট্টুসখানি মেয়ের বিয়ে হল! তোমার বর কীরকম ছিল?’
‘তোর ঠাকুরদা ছিল সুপুরুষ। তোর বাবার থেকেও লম্বা। কী গায়ের রং! আমার বাবাকে সবাই বলত জামাইভাগ্য বটে!’ হঠাৎ মনোরমার গলাটা কেমন হয়ে গেল।
‘ঠাকুরদা তোমাকে বকত?’
‘খুব। রেগে গেলে তো কাণ্ডজ্ঞান থাকত না।’ মনোরমা হাসলেন, ‘আবার সেই রাগ ঠান্ডা হতে সময় লাগত না বেশি। যখন রেগে যেত তখন আমি আড়ালে পালিয়ে যেতাম। রাগ ঠান্ডা হলে ডেকে ডেকে সারা হত।’
‘বাবা তখন কী করত?’
‘তোর বাবা তখন হয়নি। যে মাসে তোর বাবা এল সেই মাসেই তো গঙ্গায় নৌকোডুবি হল। তিরিশজন মানুষ জলে ভেসে গেল। তাঁর শরীর তো জলে খুঁজে পাওয়া যায়নি। বাবা বলেছিলেন শরীর না পাওয়া গেলে আমায় শাঁখা ভাঙতে দেবেন না। শেষপর্যন্ত সাত দিন যখন পেরিয়ে গেল তখন আমি বিধবা হলাম।’
‘তোমার বর যদি এখন হঠাৎ ফিরে আসে?’
মনোরমা জবাব দিলেন না। নাতনিকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরলেন। এই একটা চিন্তা তিনি দিনের পর দিন লালন করে গিয়েছেন। নৌকোডুবির পরও তো মৃত মানুষ জ্যান্ত হয়ে ফিরে এসেছিল। শরীর যখন পাওয়া যায়নি তখন তাঁর ভাগ্যেও এমন ঘটবে না কেন? একটার পর একটা বছর গেছে, চিন্তাটা ধীরে ধীরে ফ্যাকাশে হয়েছে। শেষপর্যন্ত অমরনাথ ম্যাট্রিক পাশ করে গেল।
হঠাৎ দীপা জিজ্ঞাসা করল, ‘ঠাম্মা, তোমার কি মাছ মাংস খেতে ইচ্ছেও করে না?’
‘চুপ। ওসব কথা মুখে উচ্চারণ করাও পাপ। আমি হিন্দুঘরের বিধবা। শুধু আলোচাল আর শাকসবজি খেয়ে থাকতে হয় বিধবাদের। পেঁয়াজ রসুন পর্যন্ত নয়।’
‘কেন নয়?’
‘যা খেলে শরীর উত্তপ্ত হয় তা বিধবাদের খাওয়া উচিত নয়।’
‘উত্তপ্ত হওয়া মানে কী?’
‘সব প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে নেই। নিজের জীবন দিয়ে বুঝতে হয়। এখন ঘুমিয়ে পড়।’
মনোরমার হাত একসময় নেতিয়ে পড়ল। ডুয়ার্সের বৃষ্টি তীক্ষ্ণধারায় পড়ে যাচ্ছিল টিনের ছাদের ওপর। দীপার চোখের সামনে একটি সুপুরুষ যুবক যে রাগ পড়ে যাওয়ার পর ‘রমা’ ‘রমা’ বলে ডেকে যাচ্ছে। ঠাকুমাই একদিন বলেছিল তার ডাক নাম রমা। সেই মানুষটা, যাকে তার দেখার কোনও সুযোগ ছিল না, তার জন্যে আজ এই বৃষ্টির রাত্রে খুব কষ্ট হচ্ছিল।
বর্ষার বৃষ্টির চরিত্রের সঙ্গে শীত বয়ে-আনা বৃষ্টির তফাত হল, এখন রাতভর জোর জল পড়লেও দিন ফোটার মুখেই তা থেমে যায়। আকাশের মুখ যতই ভার হোক সকাল আসে সকালের মতন। মনোরমা ঘুমাচ্ছেন। ঘড়ি দেখে দীপা উঠল। মাথার টিনে কোনও শব্দ নেই, তার মানে বাইরে বৃষ্টি নেই। যদিও ঘরে এখনও অন্ধকার এবং ডিমবাতিটা সমানে জ্বলে যাচ্ছে।
নিঃশব্দে দরজা খুলে সে সতর্ক হাতে ভেজিয়ে দিল। রাত নেই কিন্তু দিনও আসেনি। উঠোনে এক মায়াবী ঘনছায়া। অন্ধকারে আলো গুলে দেওয়ায় এমন ছায়া তৈরি হয় যাতে পৃথিবীর চেহারা অন্য রকম হয়ে যায়, কেমন আদুরে আদুরে। বড়বাড়ির ভেতর দরজা তো বন্ধ থাকবেই, এমনকী বুধুয়া, যে রান্নাঘরে শোয় এখান থেকেই তার নাক ডাকার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। দীপা হেসে ফেলল। মা বলে, ওই নাক ডাকার জন্যেই চোর আসবে না বাড়িতে।
কাঁঠাল লিচু গাছগুলোর মাথায় পাতলা অন্ধকার। পায়ের তলায় ঘাস জলে ভিজে একশা। দীপা দৌড়ে চলে এল উঠোন পেরিয়ে তারের বেড়ার ধারে। তারপর খুঁটিতে পা দিয়ে ওপরে উঠে এক লাফে চলে এল বাড়ির সামনে। এই দৃশ্যটা মা দেখলে পিটুনি খেতে হত। পড়ার সময় তার ফ্রকের প্রান্ত যে-জায়গায় উঠে গিয়েছিল তাতে মায়ের প্রচণ্ড আপত্তি। যখন কোথাও বসতে হবে তখনও যেন হাঁটু ঢাকা থাকে! কেন? খোকন বিশু তো হাঁটুর অনেক ওপরে প্যান্ট পরে। জিজ্ঞাসা করলেই একটা উত্তর, তুমি মেয়ে। আরে বাবা, মেয়ে তো হয়েছে কী! এক দৌড়ে দীপা চলে এল শিউলি গাছটার নীচে। আরি বাব্বা! গাছের নীচটায় যেন সাদা চাদর বিছিয়ে রেখেছে কেউ। পা মুড়ে বসে ফ্রকের প্রান্ত তুলে তাতে শিউলি টপাটপ তুলতে লাগল দীপা। ঘোরের মধ্যে তার হাত সমানে ওঠানামা করতে লাগল। এখনও ছায়াছায়া অন্ধকার চার পাশে। অথচ মোটেই ভয় করছে না। বাতাসে যে শীতশীত ভাব আলতো দাঁত বসাচ্ছে তাও যেন ধর্তব্যের মধ্যে নয়। হঠাৎ মাছ ধরার কথা মনে পড়তেই সে মাথা তুলে আকাশ দেখল। লক্ষ লক্ষ মোষ যেন স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। মুখ নামাতেই সে দেখতে পেল সেই লম্বা ছেলেটা আসছে। মালবাবুর বাড়িতে গতকাল দুপুরে এসেছে। হয়তো ভোরে বেড়াতে বেরিয়েছে।
বছর আঠারো বয়স, ফুল প্যান্ট আর সোয়েটার পরনে, ছেলেটা দাঁড়িয়ে পড়ল হঠাৎ তাকে দেখে। দীপা আবার ফুল তোলায় মন দিল। হঠাৎ কানে এল, ‘বিউটিফুল।’
সে না উঠে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘কিছু বলছেন?’
‘হুম।’ কেমন কায়দা করল মুখ চোখে ছেলেটা। ‘তোমাকে ঠিক সুচিত্রা সেনের মতো দেখাচ্ছে। কী নাম তোমার?’
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন