৪৩. কিছু মানুষ খুন হলেন

সমরেশ মজুমদার

কলকাতা শহরে কিছু মানুষ খুন হলেন।

বিধান রায় পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী। সাধারণ মানুষ তাঁকে ভালবাসে। ডাক্তার হিসেবে তাঁর খ্যাতি প্রবাদের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছে। দেশ গড়ার কাজে মানুষটি নিত্যনতুন চিন্তাভাবনা করে তাকে বাস্তবায়িত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। আর সবার ওপরে ওই অবিবাহিত মানুষটির চেহারায় এমন একটা ব্যাপার আছে যা সাধারণ বাঙালিকে তাঁর অনুগামী করে তুলতে বাধ্য। এই মুহূর্তে বিরোধী পক্ষের কোনও শক্ত মাটি পশ্চিমবাংলায় নেই। পাটি নিষিদ্ধ হওয়ার পর তাদের কার্যাবলি নিয়ে দেশের মানুষের নানারকম ধন্দ ছিল। আবার কার্যকরী অবস্থায় ফিরে গিয়ে সামান্য কিছু আন্দোলন করা ছাড়া তেমন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিতে পারেনি এখনও।

শরণার্থীদের স্রোত পশ্চিমবাংলার ওপরে আছড়ে পড়ছে। দেশের দ্রব্যমূল্য হুহু করে বেড়ে যাচ্ছে। ক্রয়ক্ষমতা এবং আয়ের মধ্যে বিশাল বৈষম্য সৃষ্টি হয়ে গিয়েছে। এবং এই পটভূমিতে কিছু মানুষ অন্ধকার পথে তাদের পুঁজি বাড়িয়ে চলেছে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠরা দারিদ্র্যসীমার নীচে নেমে যাচ্ছেন। আর এ সবই হচ্ছে শাসক দলের কিছু অসৎ নেতার প্রত্যক্ষ মদতে। এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গের শাসক দলের ওপরতলার নেতাদের মধ্যে শ্রমজীবী মানুষের উপযুক্ত প্রতিনিধি খুঁজতে গেলে হয়রান হতে হবে। বিধান রায় এবং দুই-তিনজন তাঁর অনুগামী নেতার পক্ষে এই কৌরবদের সামাল দেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। ঠিক এইসময় কলকাতার ওপরে কয়েকটি আন্দোলনের ঢেউ তুলতে পারলেন বিরোধীরা। কোনও রাজনৈতিক আদর্শের সংঘাত নয়, বিরোধীরা সাধারণ মানুষের অত্যন্ত বাস্তব সমস্যাকে মূলধন করায় তাঁদের সক্রিয় সমর্থন পেয়েছিলেন। এর একটি হল খাবারের দাবি অন্যটি হল ট্রাম বাসের ভাড়া বৃদ্ধি। এই আন্দোলনে সক্রিয় অংশ নিতে প্রথমে উদ্বুদ্ধ হল ছাত্ররা যারা বেশিরভাগ সময়েই শাসক দলের বিরোধিতা করতে চায়। একমাত্র পাইয়ে দেবার লোভ অথবা আদর্শের প্রতি আনুগত্য দাবি করে অন্ধ করে দেওয়া ছাড়া ছাত্রনেতাদের হাতে রাখা অসম্ভব। তারা চিরকাল অন্যায়ের প্রতিবাদ এবং গণতন্ত্রের দাবি করবেই। শাসকদলে বেশিদিন থাকলে যে-স্বৈরাচারী মানসিকতা তৈরি হয়ে ওঠে তা ছাত্রদের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব হয় না। আর এই সময়ের কংগ্রেসি শাসকদের একাংশ তাঁদের কাজের মাধ্যমে ছাত্রদের বিক্ষুব্ধ হতে সাহায্য করেছিলেন। এই ছাত্রদের সমর্থন পেয়েছিলেন বিরোধীরা। মূলত সি পি আই-এর নেতৃত্বে যে-আন্দোলন শুরু হয়েছিল তার প্রকাশ সর্বত্র যে অহিংস হবে এমন ভাবার কোনও কারণ নেই। কলকাতার রাস্তায় ভারতবর্ষ স্বাধীন হবার এক যুগের মধ্যে ট্রাম বাস যখন পুড়ল তখন পুলিশ গুলি চালাল। আর সেই গুলিতে লুটিয়ে পড়লেন কিছু মানুষ। শুধু কলকাতা নয়, শিকার হলেন পশ্চিমবঙ্গের জেলায় আরও কয়েকজন। হয়তো বিধান রায়, হয়তো স্বাধীনতা আন্দোলনে কংগ্রেসের ভূমিকা, সদ্য মৃত গাঁধীজির প্রভাব ওই আন্দোলনকে স্তিমিত করে দিয়েছিল কিছুদিনের মধ্যেই। এবং হয়তো অনেককাল ধরে এর প্রতিক্রিয়া চলবে যা এই মুহুর্তে স্পষ্ট নয়। হয়তো ভাবীকালের অনেক আন্দোলনে কাঁটা পড়ে গেল। শুরুটা যদি শেষ হবার জন্যে না হয় তা হলে সেটাই অভ্যেসে না দাঁড়িয়ে যায়!

এই খুন হওয়া চোখের ওপর দেখল দীপা। গুলি ছুটে এল মানুষটির বুক বরাবর। গোড়া থেকে কেটে ফেলা কচুর ডাঁটির মতো খসে পড়ল মাটিতে। একটা জীবন একটু আগে প্রতিবাদে মুখর ছিল, এই মুহূর্ত থেকে আর নেই। হস্টেলেব ছাদ থেকে দৌড়ে নেমে এসেছিল দীপা। নিজের বিছানায় মুখ চেপেও পড়ে যাওয়া মানুষটিকে ভুলতে পারছিল না। কী সহজে একটি মানুষকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়া যায়! এক পলকে বর্তমানকে ইতিহাস করে দেওয়া আর শুধু সময়ের হিসেবেই নয় মানুষের হাতযশেও। যে-পুলিশগুলো গুলি চালিয়েছিল তারা দেখতে বীভৎস নয়। তারাও জামা পালটালে জনতা হয়ে যেতে পারত। যে খুন হল সে ট্রাম বাস পোড়ায়নি, রাস্তার একধারে দাঁড়িয়ে ছিল।

আন্দোলন চলেছিল কয়েকদিন। বিরোধী নেতারা জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিলেন। সরকার থেকে এসব খুনের জন্যে কোনও দুঃখপ্রকাশ করা হল না। পালটা যুক্তি তাঁদের ছিল। চোখের সামনে যদি রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি জনসাধারণের জিনিস ধ্বংস করে কেউ তা হলে সরকার চুপ করে বসে থাকতে পারে না। কেউ খুন করলে তার মৃত্যুদণ্ড স্বাভাবিক। যে-বিচারক সেই দণ্ড উচ্চারণ করেছেন বা যে-জল্লাদ তা কার্যকর করবে, তাঁদের কেন শাস্তি হবে? অতএব একসময় দু’পক্ষই শান্ত হল। জীবন যেমন চলছিল তেমনই চলতে লাগল। সরকারি সম্পত্তি যা ধ্বংস হয়েছিল তার বদল করতে সরকার আবার কর বসাবেন, জিনিসের দাম যা বেড়েছিল তা কমার কথা নয়। আগে শীতকালে দাম কমত, গ্রীষ্মে বাড়ত। আন্দোলন এভাবে শেষ হবার পর সেটা বারো মাসের জন্যে স্থির জায়গা পেয়ে গেল।

ছুটির পরেও এই কারণে কয়েকদিন হস্টেল খোলা রাখতে বাধ্য হয়েছিলেন কর্তৃপক্ষ। দীপার চোখের সামনে সেই নাম-না-জানা মানুষটি যেন পাকা জায়গা নিয়ে নিয়েছে। একটু শান্ত হতেই সে ছুটে গিয়েছিল মায়ার বাড়িতে। গিয়ে দেখল সে শুয়ে আছে। তার হাতে প্লাস্টার। মাসিমা বললেন, ‘হাত ভেঙেছে পুলিশের লাঠিতে। ভালই হয়েছে, কদিন বাড়িতে বিশ্রাম পাবে।’

দীপা জিজ্ঞাসা করল, ‘কী হয়েছিল?’

‘কী আর হবে। ভারতবর্ষের পুলিশ লাঠি দিয়ে একটু আদর করল।’

‘তুই ট্রাম পোড়াতে গিয়েছিলি?

‘তা হলে তো গুলি খেতাম। আমাদের পরে যারা গিয়েছিল তারা ট্রাম পুড়িয়েছে।’

‘কী লাভ হল এতে?’

‘লাভ? সরকার জানল আমাদের মেরুদণ্ড আছে। এখন থেকে কোনও কাজ করার আগে দু’বার ভাববে। আর প্রতিবাদ করতে পেরেছি, এটুকুই লাভ।’

‘তোদের নেতাদের কেউ গুলিতে মরেছে? কারও হাত ভেঙেছে?’

‘কেন বল তো?’ অবাক হল মায়া।

‘ভাঙলে ভাল লাগত। মনে হত ওঁরাও জনসাধারণের সঙ্গে ছিলেন।’

মাসিমা শুনছিলেন ওদের কথা। হেসে বললেন, ‘যুদ্ধক্ষেত্রে সেনাপতিরা একদম পেছনের শিবিরে থাকে দীপা যেখানে কোনও বিপদ হুট করে আসে না।’

মায়া মাথা নাড়ল, ‘এসব কথা না বলে আগে বল তোর প্রবলেম সল্‌ভ হয়েছে কিনা! থাকার জায়গা পেয়েছিস? মা, তোমাকে যেটা বলেছিলাম।’

মাসিমা বললেন, ‘হ্যাঁ, মায়া বলছিল বটে। তুমি এখানেই থাকতে তো পারো। ছুটি আর ক’টা দিন। স্নানটানের সময় না হয় একটু সাবধান হতে হবে, ওপরে উঠে এলে তো কোনও কথা নেই। চলে এসো এখানে।’

‘না মাসিমা, দরকার নেই।’ দীপা হাসল, ‘একটা ব্যবস্থা হয়ে গিয়েছে।’

‘কী ব্যবস্থা?’

‘আমি একটা ঘর ভাড়া পেয়েছি। খুব সস্তায়। সেখানেই থাকব।’

মায়া অবাক হল, ‘তোকে কেউ ঘর ভাড়া দিল?’

‘দিয়েছেন। তবে শ্যামবাজার ভবানীপুরে নয়। যাদবপুরের ওদিকে কলোনিতে!’

সঙ্গে সঙ্গে মাসিমা বললেন, ‘ওমা! সেখানে তুমি একা থাকবে?’

‘ঠিক একা নয় মাসিমা, আমাদের সঙ্গে পড়ে রাধা, ওর বাড়ির পাশে।’

‘কিন্তু কলোনির জীবনযাত্রা, মানে শুনেছি উদ্বাস্তুদের ভিড়ে ঠাসাঠাসি—।’

‘আমি তো ঘুরে এসেছি। ওঁদের তো আলাদা বলে মনে হয়নি। বরং পূর্ববঙ্গের মানুষদের বুকে আমাদের চেয়ে বেশি উত্তাপ আছে বলে মনে হয়েছে। জানেন মাসিমা, চা-বাগানে আমাকে যিনি পড়াতেন তিনি ছিলেন যাকে বলে কাঠ-বাঙাল। সেই মানুষটির উৎসাহে আমি আজ এখানে পৌঁছেছি। তাই আমার কোনও অসুবিধে হয়নি কলোনিতে গিয়ে। ছেড়ে দিন এসব কথা, মায়া, তোর নাটক কী হবে?’

শুয়ে শুয়ে মাথা নাড়ল মায়া, ‘সেইটেই হয়েছে মুশকিল। হাত ভাঙার জন্যে মা আমাকে কিছু বলেনি কিন্তু শমিত যাচ্ছেতাই বলে গেল। এ-মাসে তিনটে শো পেয়েছে দল, তিনটেই কল-শো। শমিতের রেগে যাওয়া অন্যায় নয়, দলের সবাই আমার জন্যে নাটক করতে পারবে না এতে আমারই খারাপ লাগছে।’

‘শমিত আন্দোলনে অংশ নেয়নি?

‘না। ও সক্রিয় রাজনীতি করে না। ওর চিন্তাভাবনা অবশ্যই প্রতিক্রিয়াশীলতার শোষকের বিরুদ্ধে, বামপন্থী মানসিকতা নিয়ে কোনও প্রশ্ন নেই। কিন্তু ও বলে যুদ্ধ অনেক রকমের হয়। সবাইকে যে একরকম যুদ্ধ করতে হবে তার কোনও মানে নেই।’

‘ভাল লাগল কথাটা শুনে।’

চোখ বন্ধ করল মায়া, ‘দেখিস বাবা, ভাল লাগাটাকে ডালপালা মেলতে দিস না, শমিত হল সূর্যের মতো, দূর থেকে ভাল, উপকারী, কাছে গেলেই পুড়ে ছাই হয়ে যেতে হবে।’ কথা শেষ করে মায়া হাসল। মাসিমা উঠে গেলেন।

হস্টেলের গেটে মালপত্র রেখে দীপা ট্যাক্সি ডাকতে পাঠিয়েছিল দারোয়ানকে। শ্যামবাজার থেকে অতদূর টানা ট্যাক্সিতে যাবে না সে। শেয়ালদা হয়ে ট্রেনে চেপে যাবে মালপত্র নিয়ে। এইসময় গেটের ফাঁক দিয়ে কেউ আসছিল দারোয়ান পেছন থেকে আটকাল তাকে। দীপা দারোয়ানের গলা শুনতে পেল, ‘আরে আরে, আপনি কোথায় যাচ্ছেন। এখন দেখা করার সময় নয়। আর হস্টেলে কেউ নেই, দিদিমণিরা যে যার বাড়িতে চলে গিয়েছেন।’

‘কেউ নেই?’

‘না। বিকেলে আসবেন যদি বড়দির সঙ্গে দেখা করতে চান।’

দারোয়ানকে গেটের এপাশে আসতে দেখা গেল, ‘ট্যাক্সি এসে গেছে।’ মালপত্র সে-ই বয়ে নিয়ে গেল বাইরে। গেটের বাইরে এসেই বিস্মিত হল দীপা। ফুটপাতে দাঁড়িয়ে আছে দুই হাত বুকের ওপর ভাঁজ করে শমিত। দাঁড়িয়ে উলটোদিকের ফুটপাতের কিছু লক্ষ করছে। দীপা তাড়াতাড়ি কাছে গেল, ‘কী ব্যাপার? এখানে?’

‘আরে, তুমি, ও যে বলল হস্টেল খালি। সবাই চলে গিয়েছে।’ ট্যাক্সির ডিকিতে জিনিসপত্র রাখছিল দারোয়ান, তাকে দেখাল শমিত।

‘চলেই তো যাচ্ছিলাম। আর সবাই চলে গিয়েছে। কিন্তু আপনি এখানে কী জন্যে?’

‘আশ্চর্য! লেডিস হস্টেলে আমি আবার কার জন্যে আসব? তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলাম। তা তুমিও তো চলে যাচ্ছ?’ শমিত চিন্তিত হল।

‘নিশ্চয়ই কোনও দরকার ছিল। বলুন কী ব্যাপার।’

‘কোনও লাভ নেই ফালতু বকে। আমি স্মৃতিচারণ বা হা-হুতাশে মোটেই বিশ্বাস করি না। চলি।’ শমিত হাসল। দীপা তাকে বাধা দিল, ‘আমার হস্টেল ছেড়ে চলে যাওয়ার ব্যাপারে আপনার কি অসুবিধে হচ্ছে?’

‘তুমি যদি কলকাতায় থাকতে—, আবার সেই যদি বলছি!’

‘আমি তো কলকাতাতেই থাকব।’

‘তার মানে? মালপত্তর নিয়ে যাচ্ছ কোথায়?’

‘হস্টেল বন্ধ। আমার একটা থাকার জায়গা দরকার তাই ঘর ভাড়া করেছি যাদবপুরের দিকে। সেখানেই যাচ্ছি।’ দীপা হাসল।

‘তাই বলো! কিন্তু তোমার সঙ্গে আর কে থাকছে?’

‘আশ্চর্য! আপনিও নারীকে এত অসহায় ভাবেন?’ দীপা প্রশ্ন করামাত্র ট্যাক্সিওয়ালা হাঁক দিল, ‘দিদি, তাড়াতাড়ি করুন একটু।’

দারোয়ান দাঁড়িয়ে ছিল গেটের সামনে। তার দিকে মাথা নেড়ে দীপা একটু অস্বস্তি নিয়ে শমিতকে বলল, ‘আমি আদৌ বড়লোক নই। ট্যাক্সির মিটার উঠছে।’

‘ঠিক হ্যায়। আমরা তো ট্যাক্সিতে বসেই কথা বলতে পারি। আমিও যাচ্ছি তোমার সঙ্গে, চলো।’ দীপা দেখল, অনুমতির জন্যে বিন্দুমাত্র অপেক্ষা না করে ট্যাক্সির দরজা খুলল শমিত, ‘উঠে পড়ো।’

ট্যাক্সি চলতে শুরু করতেই হঠাৎ একটু শক্ত হয়ে গেল দীপা। এই এইরকম একটা জায়গা থেকে অসীম ট্যাক্সিতে উঠে শিয়ালদায় গিয়েছিল। শিয়ালদা থেকে শিলিগুড়ি। সেই দিন এবং সেই রাত একটু একটু করে স্বপ্নের মতো হয়ে গিয়েছিল। আজ অসীম নেই কিন্তু শমিত একই ভূমিকা নিচ্ছে। অবশ্য দু’জনের কথাবার্তা স্বভাব সম্পূর্ণ বিপরীত। ঈশ্বর এক একজনের জন্যে আলাদা ছাঁচ তৈরি করেন। কিন্তু সে একই জায়গায় থেকে যাচ্ছে। মাথা নাড়ল দীপা, যে-কোনও ঘটনাই কোনও-না-কোনও ইতিহাসকে নকল করে। এ নিয়ে এত ভাবার কী আছে। অসীমকে সে বন্ধু ভেবেছে, এখনও ভাবে। শমিত ঠিক কী তা বুঝে উঠতে পারছে না, তফাত এটুকু। ট্যাক্সি ড্রাইভার বলল, ‘শিয়ালদায় যাব তো?’

‘শিয়ালদা মানে?’ শমিত বলে উঠল, ‘যাবে যাদবপুরে।’

দীপা মাথা নাড়ল, ‘ট্রেনে যাব।’

‘ট্রেনে? ওই মালপত্তর নিয়ে। লোকাল ট্রেন তোমার জন্যে থেমে থাকবে যতক্ষণ ওগুলো না নামানো হয়?’

এইটে ভাবেনি দীপা। তার একার পক্ষে সব জিনিস নামিয়ে ফেলা, অন্তত একবারে, একদম অসম্ভব। স্টেশনে নেমে পড়তে পারলে কুলি দিয়ে রিকশায় তুলে সে ওগুলো নিয়ে পৌঁছে যেতে পারে। কিন্তু তার ভাবনা শেষ হবার আগেই শমিত বলল, ‘না না দাদা, আপনি সোজা যাদবপুর চলুন। মানুষের স্বভাব হল কোনও-না-কোনওভাবে সরল জিনিসকে জটিল করে তোলা। ট্যাক্সি থেকে নামা, কুলি ধরা, টিকিট করা, ট্রেনে ওঠা, ট্রেন থেকে নামানো, তারপর আরও কত কী আছে কে জানে! সুখে থাকলে লোককে ভূতে কিলোয়।’

দীপা প্রতিবাদ করতে চাইল, ‘ট্যাক্সিতে যাদবপুর পর্যন্ত কত ভাড়া দিতে হবে জানেন? ট্রেনে গেলে অনেক কমে হয়ে যাবে না?’।

‘সামান্য কম। কিন্তু পরিশ্রম আর সময় অনেক গুণ বেশি। বাঃ, তুমি তো বেশ হিসেব করে চলতে পারো দেখছি। খুব ক্যালকুলেটিভ।’ শমিত শব্দ করে হাসল।

শব্দটা কানে যাওয়ামাত্র রাগ হয়ে গেল দীপার, ‘পরিশ্রম না করলে যাকে একটা পয়সা দিয়ে কেউ সাহায্য করবে না, তাকে হিসেব করে চলতেই হবে। সুস্থভাবে বেঁচে থাকার চেষ্টা করা যদি ক্যালকুলেটিভ মানসিকতার প্রমাণ হয়, তা হলে বলব আপনাদের মতো ভ্যাগাবন্ড-জীবনের প্রতি আমার বিন্দুমাত্র লোভ নেই।’

‘কী? আমি, আমরা ভ্যাগাবন্ড?’ সোজা হয়ে বসল শমিত।

‘নিশ্চয়ই। আপনারা স্রেফ আবেগে ভাসছেন। একজন মানুষ স্ত্রীর শরীরে অতখানি জ্বর দেখেও ছুটে আসছেন নাটক করতে। কী, না শিল্প হচ্ছে! যে নাটক তাঁকে একটা পয়সা দেবে না যা দিয়ে তিনি স্ত্রীর জন্যে ওষুধ কিনতে পারবেন। আপনারা যা করছেন তা স্রেফ আত্মহত্যা। কোনও কনস্ট্রাক্টিভ পরিকল্পনা আপনাদের কাজে নেই। ধার করে নাটক করছেন, লোকে এসে সেই নাটক দেখছে না কিন্তু নিজেদের নাটকের লোক বলে নিজেরাই বাহবা দিচ্ছেন। অথচ ধার শোধ করার কোনও রাস্তা আপনাদের জানা নেই। এটা আত্মহত্যা নয়?’

শমিত হাততালি দিল, ‘শাবাশ।’

‘আমি কিন্তু খুব সিরিয়াসলি বলছি।’

শমিত ঘুরে বসল, ‘দেখুন মশাই, স্রোতের বাইরে দূরে পারে দাঁড়িয়ে লোকে অনেক কথা ভাবতে পারে। নদীতে ময়লা আছে আবর্জনা আছে। জলে না নেমে যারা সাঁতার সম্পর্কে জ্ঞান দেয় তাদের কোনও উপদেশ শুনতে আমি রাজি নই।’

‘এটা আপনাদের জেদের কথা। গোঁয়ারতুমি।’ দীপা লক্ষ করল উত্তেজিত হয়ে শমিত তাকে ‘দেখুন’ বলল। অর্থাৎ এই মুহুর্তে শমিত তাকে প্রতিপক্ষ ভাবছে।

‘ইয়েস। জেদ। জেদ না থাকলে কোনও কাজ করা যায় না। আমরা তবু কিছু করছি। নাটক করছি। অন্য ধরনের নাটক। আমরা চেষ্টা করছি দেশের মানুষের মোটা দাগের রুচি পালটে ফেলতে। আপনারা কী করছেন? ভারতবর্ষের নব্যনাগরিকরা? সমালোচনা! কাজ করে দেখান মাঠে নেমে, তারপর জ্ঞান দিন।’

‘নিশ্চয়ই আপনারা কিছু করছেন। কেউ যদি মনুমেন্টের ওপরে উঠে বলে আমি একটা কাজ করছি আর তার পরেই ঝাঁপিয়ে পড়ে সেই কাজটা দেখায় তা হলে সে হয়তো কাজ করল কিন্তু তার পরিণতি কী হবে তা ভেবে দেখুন।’ দীপা হাসল।

‘দুর মশাই! আপনার মতো হতাশবাদী লোকের সঙ্গে কথা বলাই বিপদ।’

শব্দ করে হাসল দীপা, ‘আপনি কিন্তু আমাকে একটু আগে পর্যন্ত তুমি বলছিলেন। দেখুন, উত্তেজনা মানুষকে কীভাবে পালটে দেয়।’

চমকে ফিরে তাকাল শমিত। তারপর বলল, ‘আই অ্যাডমিট। এই একটি কথা ঠিক বললে। দ্যাখো, যেসব জ্ঞান দিলে সেগুলো আমার বিশদ জানা। আমি নাটক করতে চাই। আমি মরে যাওয়া পর্যন্ত নাটক করব। কিন্তু আমি কালিন্দী, দুই পুরুষ করতে পারব না। ওই নাটক স্বম্পর্কে আমার কোনও অশ্রদ্ধা নেই। কিন্তু আমি যে-নাটক করব তা আমার সময়ের মানুষের সমস্যার কথা বলবে। আমি যদি প্রাচীন বিষয় নিয়ে নাটক করি তা হলে তার বিশ্লেষণ হবে আজকের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে। নাটক মানে আমার কাছে শুধু গপ্পো শোনানো নয়, সেইসঙ্গে ভাবানো। কে আমাকে এই নাটক করতে দেবে? কলকাতার পেশাদারি থিয়েটারগুলো ফিল্ম স্টার দেখিয়ে আর গপ্পো শুনিয়ে হাউসফুল করে। তারা কোনও ঝুঁকি নেবে না। অতএব আমাদেরই চেষ্টা হবে দর্শক তৈরি করতে। আমরা যদি কাছিমের মতো কামড়ে পড়ে থাকি, একদিন-না-একদিন আমাদের নাটক দেখতে দর্শক আসবেই। সেই সময় পর্যন্ত আমি লড়ে যাব। তোমার যা মনে হয় তুমি মনে করতে পারো।’

বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ। ট্যাক্সি মধ্য কলকাতা পেরিয়ে দক্ষিণে ঢুকল। হঠাৎ শমিত বলল, ‘তোমার মতো সাহসী মেয়ে কিন্তু খুব কম আছে।’

‘বেশি প্রশংসা করলেন। আপনি মায়ার কথা ভুলে যাচ্ছেন।’

‘মায়া? ওর তুলনা ও। কিন্তু ও নিজেই জানে না কী করবে। নাটক না রাজনীতি? তবু ওর পায়ের তলায় মাটি আছে যার ওপরে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করা যায়।’

‘তার মানে?’

‘কলকাতা শহরে ওর একটা বাড়ি আছে, বাড়িতে মা আছেন, দু’বেলা খাওয়া পরার চিন্তা ওকে করতে হয় না। অন্তত মালপত্তর নিয়ে ঘর খুঁজতে ওকে বেরুতে হচ্ছে না।’

‘ঠিক হল না। আপনি যা বললেন বাংলাদেশের মেয়েদের তার সবই রয়েছে। কিন্তু স্বাধীনতার এই এক যুগের মধ্যেও তারা মায়ার দিকে আতঙ্কের চোখে তাকিয়ে থাকে।’ দীপা মাথা নাড়ল, ‘মায়া ঠিক করছে না ভুল তার বিচার পরে হবে। কিন্তু ও যে মেয়েলিপনা আঁকড়ে নেই এটা সবচেয়ে বড় সত্যি।’

শমিত কোনও কথা বলল না। সে যে খুব স্বস্তিতে বসে নেই তা বোঝা যাচ্ছিল। দীপা জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনি কিন্তু এখনও বলেননি আমার কাছে কী জন্যে এসেছিলেন!’

শমিত নড়েচড়ে বসল, ‘দুর! সব গোলমাল হয়ে গেল। এখন আর বলে কোনও লাভ নেই। আমাকে অন্যভাবে চিন্তা করতে হবে।’

‘তবু শোনাই যাক না।’

শমিত তাকাল, ‘মায়ার অবস্থা তো জানো। দেখতে গিয়েছিলে শুনলাম। এদিকে আমরা পরপর কয়েকটা কল-শো পেয়েছি। ওই হাত নিয়ে তো ও অভিনয় করতে পারবে না। এখন একজন অভিনেত্রী না পেলে শোগুলো ছেড়ে দিতে হয়।’

‘কলকাতায় অভিনেত্রীর অভাব?’

‘দুটো অসুবিধে আছে। প্রথমটা টাকা। যাঁরা অ্যামেচার অফিস ক্লাবে করছেন তাঁদের নিতে গেলে যে টাকা দিতে হবে তাতে হাতে কিছুই থাকবে না। দলে একটা শৃঙ্খলা আছে। এই পেশাদারি মহিলা তা যখন মানতে বাধ্য নন তখন তাঁর আচরণ দলে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবেই। দুই, খেপ-খাটা অভিনয় করে করে এঁরা যে অ্যাক্টিং-এর প্যাটার্ন তৈরি করে গলায় বসিয়ে ফেলেছেন তা ভাঙা অসম্ভব। ওই আন্টিং আমাদের থিয়েটারে চলবে না। এ ছাড়া আর একটি আছে। ওঁরা যেসব নাটক করেন তাতে শিক্ষার কোনও প্রয়োজন হয় না। শিক্ষিত মহিলাদের মুখে চোখে যে ছাপ থাকে তা এঁদের নেই। আমার নাটকের সব চরিত্রই শিক্ষিত অভিনেতা অভিনেত্রীর জন্যে।’

‘শিক্ষিত বলতে?’

‘বোধ এবং বুদ্ধির মধ্যে সেতু তৈরি করে যিনি সেই সেতু ব্যবহার করতে পারেন।’

‘তা আমাদের হস্টেলে তেমন কেউ আছেন নাকি?’

‘ভেবেছিলাম আছেন কিন্তু ভাবাটা ভুল হয়েছিল।’

দীপা হাসল, ‘তা হলে তো সব চুকেই গেল।’

ট্যাক্সিওয়ালা পথের নির্দেশ চাইল। এদিক দিয়ে দীপা সেদিন যায়নি। সে চারপাশে তাকিয়ে বলল, ‘আপনি যাদবপুর স্টেশনে চলুন, সেখানে গেলে চিনতে পারব।’

‘অনেক ঘুরতে হবে তো!’ ট্যাক্সিওয়ালা বলল।

শমিত জিজ্ঞাসা করল, ‘ঠিকানাটা বললা তো?’

দীপা ব্যাগ খুলে ঠিকানা লেখা একটা কাগজ দিল ওর হাতে। সেটা পড়ে দু’-তিনজনকে জিজ্ঞাসা করে যে এলাকায় পৌঁছাল ওরা সেখানে যাওয়ামাত্র দীপা চিনতে পারল, ‘ওই রাস্তা ধরে খানিকটা এগিয়ে ডানদিকে বেঁকুন।’

শমিত হাসল, ‘সবসময় কেন প্রথম থেকে শুরু করতে হবে?’

দীপা বলল, ‘বুঝতে পেরেছি।’

রাধাদের বাড়ির সামনে ট্যাক্সি থামতেই কিছু কুচো ছুটে এসে জানলা দিয়ে উঁকিঝুঁকি মারতে লাগল। শমিত বলল, “আরে! এ যে দেখছি মফস্সলে চলে এলাম।’

ট্যাক্সিওয়ালা যখন জিনিসপত্র নামিয়ে দিচ্ছে তখন রাধা ছুটে এল বাড়ির ভেতর থেকে, ‘ওমা, তুমি ট্যাক্সি করে এসেছ? আমি আবার একজনকে স্টেশনে পাঠালাম।’

‘কাকে? সে আমাকে চিনবে কী করে?’

‘সেদিন দেখেছে। আর মালপত্র থাকবে যখন তখন বুঝতেই পারত।’

দীপা দেখল রাধাদের বাড়ির সবাই বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে। সে রাধার মাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘মাসিমা, আপনি ভাল আছেন।’

‘আছি। শোনো, জিনিসপত্র সব আমাগো বাড়িতে থাক, পরে সেখানে নিয়া যাইবা। আর আজ তুমি এখানেই ভাত খাইবা।’ প্রৌঢ়া সস্নেহে বললেন।

দীপা হেসে শমিতের দিকে তাকাল, ‘পায়ের তলায় মাটির কথা বলছিলেন না? কেউ জন্মসূত্রে পায়, কেউ অর্জন করে।’

‘কী ব্যাপার?’ রাধা জিজ্ঞাসা করল।

‘কিছু না। তোর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিচ্ছি। ইনি শমিত, মায়া যে-দলে নাটক করে ইনি তার পরিচালক। আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন, শিফ্ট করছি জেনে সঙ্গে চলে এলেন। আর এ হল রাধা, আমার বন্ধু, ও-ই ঘর পেতে সাহায্য করেছে।’ দীপা কথাগুলো বলে ড্রাইভারের কাছে এগিয়ে গেল। যে-টাকাটা মিটারে উঠেছিল তা দিতে বেশ গায়ে লাগল। ভাড়া নিয়ে ড্রাইভার ট্যাক্সি ঘুরিয়ে চলে যেতেই দীপা শুনল, রাধা বলছে, ‘আসুন না, এক কাপ চা খেয়ে যাবেন।’

‘কোনও আপত্তি নেই। জিনিসগুলো তো ভেতরে নিয়ে যেতে হবে।’

ধরাধরি করে ওরা দীপার জিনিসপত্র উঠোনের একপাশে নিয়ে গিয়ে রাখল। রাধা ভেতর থেকে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে এল উঠোনে, ‘আমাদের বসার ঘর নেই। উঠোনেই বসতে হবে।’ চেয়ারটা নিয়ে শমিত বসে পড়ল, ‘দারুণ, এভাবে আকাশের নীচে একা চেয়ারে কখনও বসিনি।’

দীপা বলল, ‘রাধা, জিনিসপত্রগুলো আমার ঘরে রেখে এলে হত না?’

‘মায়ের ধারণা, তুমি ওখানে চলে গেলে আমাদের বাড়িতে ভাত খাবে না।’

‘সেকী? কেন?’

হাসল রাধা, ‘কী করে বুঝব বলো। কেউ এলে তাকে ভাত খাওয়াতে পারলে উনি আনন্দ পান। কলকাতায় আসার আগে আমাদের বাড়িতে চা হত না। এখনও দু’-তিনজনের বেশি কেউ এখানে চা খায় না।’

রাধার মায়ের সঙ্গে শমিতের আলাপ করিয়ে দিল দীপা। ভদ্রমহিলা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি কী করো বাবা?’ শমিত হেসে জবাব দিল, ‘আমি নাটক করি আর স্কুলে পড়াই।’

‘কী করো? নাটক?’ ভদ্রমহিলা বিস্মিত।

‘হ্যাঁ। আমাদের একটা দল আছে।’

‘পালাগানের দল?’

শমিত হাসল, ‘না না। আপনাকে না দেখালে আপনি বুঝবেন না।’

‘তোমার বাড়িতে কে কে আছে?’

‘মা আর আমি৷’

‘বিয়াশাদি হয় নাই?’

‘না না আমি তো সবে পাশ করলাম। আপনি আমার বয়স খুব বেশি ভাবছেন নাকি?’ প্রশ্নটা করে শমিত মজার চোখে দীপাকেও দেখল।

এইসময় রাধা বলল, ‘মা। তোমার এসব কথা থামাও তো।’

এবার ভদ্রমহিলা সরে গেলেন। সম্ভবত শমিতকে তাঁর পছন্দ হচ্ছিল না। একটু আড়ালে গিয়ে তিনি একটা কুচোকে দিয়ে দীপাকে ডেকে পাঠালেন। দীপা রাধার দিকে তাকাল। রাধা হেসে বলল, ‘যাও। তোমাকে ডেকেছে মানে মায়ের খুব পছন্দ হয়ে গিয়েছে।’

দীপা উঠোন পেরিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে দেখল আর একজন মহিলা চায়ের ব্যবস্থা করছেন। মাসিমা একটা পিঁড়িতে বসেছিলেন, ‘বসো। তোমাকে একটা কথা কই।’

বাধ্য মেয়ের মতো বাড়িয়ে দেওয়া আর একটা পিঁড়িতে উবু হয়ে বসল দীপা। এই রান্নাঘর ছোট্ট, চা-বাগানের বাড়ির সঙ্গে কোনও তুলনাই চলে না। তবু কলকাতা শহরে বসে সেই স্মৃতি এনে দেয়। রাধার মা বললেন, ‘অরে তুমি কতদিন চেনো? নাটক টাটক করা মানুষের সঙ্গে মিশা ঠিক না।’

ভদ্রমহিলা যে এই কথা বলতে ডেকে এনেছেন তা আন্দাজ করতে পারেনি দীপা। এবার হেসে ফেলল, ‘না না। ওরা ভাল নাটক করে। লোক খারাপ না।’

কলকাতার মানুষ তো?’

‘তাই মনে হয়।’

‘খবর নাও। কলকাতার মানুষকে আমি বুঝতে পারি না। তোমার মন নরম কিন্তু সবাই তোমার মতো না।’

এইরকম কথা চলল কিছুক্ষণ। একজন মা, যিনি সন্তানের মঙ্গলের জন্যে চিন্তা করেন, তাঁর ভয়ের ব্যাপারগুলো অকপটে বলতে বাধে না, দীপার খারাপ লাগছিল না। এইভাবে বলতে পারেন এমন মানুষও তো নেই তার আশেপাশে। শেষপর্যন্ত ভদ্রমহিলা বললেন, যেহেতু এটা কলোনি, সবাই সবাইকে চেনে, তাই অনাত্মীয় কোনও পুরুষকে সঙ্গে আনা ঠিক নয়। দীপা যে একা থাকবে তা লোকে জেনে গেছে এরই মধ্যে। অনাত্মীয় কোনও পুরুষ এলে কথা উঠবে। মনে পাপ না থাকলেও ঝামেলা ডেকে এনে লাভ কী!

দীপা শক্ত হয়ে গেল। সে কার সঙ্গে মিশবে, কে তার কাছে আসবে, তা কলোনির লোকেরা ঠিক করে দেবে? সে কি শিশু? কোনও ছেলের ক্ষেত্রে কেউ এমন কথা বলত? রাধার মা সম্ভবত বুঝলেন দীপার মনের কথা। বোঝানোর ভঙ্গিতে তিনি বললেন যে মানুষকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। এই যে শমিত এসেছে, তার মনের ভেতরে কী আছে তা কেউ জানে? আত্মীয়তা হল একটা বেড়ার মতো, যা কিছু চোরা স্রোতকে বাঁধ দিয়ে আটকে রাখে। আর দীপারা তো তাঁর মতো পরাধীন নয়, বাইরে যাচ্ছে। তা বাইরের মানুষকে বাইরে রাখলেই হয়, ঘরে আনার দরকার কী। সে যখন আত্মীয় নয়। তা ছাড়া। দীপা যে ঘর ভাড়া নিয়েছে তার বাড়িওয়ালা যদি আপত্তি করে কেউ আসার জন্যে তা হলে ঘর ছেড়ে দেওয়া বুদ্ধিমতীর কাজ হবে না। আগে নিজের স্বার্থ সামলে রাখে তারপর অন্য ব্যাপারে প্রতিবাদ করতে যাও।

একেই কি বলে অ্যাডজাস্টমেন্ট? আধুনিক মানুষের যেটা শেখা সবচেয়ে জরুরি? এক্ষেত্রে বিদ্রোহ করলে বাড়িওয়ালা তাকে ঘর ভাড়া না-ও দিতে পারেন! সে কোনও অন্যায় করছে না জেনেও এই ব্যবস্থা মেনে নেওয়া কি ঠিক হবে? দীপা গম্ভীর হয়ে আছে দেখে রাধার মা বললেন, ‘এখানে তো তুমি একা থাকবা না। আমরা আছি। বাইরের বন্ধুদের যদি বাসায় না আনো তা হলে কী এমন ক্ষতি?’

না, তেমন কিছু ক্ষতি নেই। তার বেঁচে থাকার পক্ষে ব্যাপারটা জরুরিও নয়। অতএব এক্ষেত্রে অ্যাডজাস্টমেন্ট করলে কোনও ক্ষতি হচ্ছে না তার। দীপা বাইরে বেরিয়ে এল। এসে দেখল, একগাদা কুচো এবং রাধাকে গল্প শোনাচ্ছে শমিত। সবাই খুব মন দিয়ে শুনছে। এইসময় রান্নাঘর থেকে চা এল।

গল্প শেষ হলে চা খেতে খেতে শমিত জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমার নতুন ঘর-প্রবেশ কখন হবে? দেখে যাব নিশ্চয়ই!’

‘না। আপনার দেখা হবে না। কারণ আমি এখন যাচ্ছি না ওখানে।’

‘কেন?’

‘অসুবিধে আছে। দেরি হবে একটু।’

চায়ের কাপ প্লেট নীচে নামিয়ে রেখে শমিত বলল, ‘তা হলে চলি। অনেক পথ একা যেতে হবে। লঙ ওয়ে টু গো।’

‘আপনি কিন্তু এখনও বলছেন না কেন এসেছিলেন?’

শমিত ঘুরে দাঁড়াল, ‘দীপা, আমাদের দলে নাটক করবে? মায়া পারছে না, এই তিনটে শো করা দলের জন্যেই খুব জরুরি।’

‘আমি?’ বুকে হাত রাখল দীপা, ‘আপনাকে যদি বলা হয় প্লেন চালাবেন, পারবেন? কোনও প্রস্তুতি নেই, কোনও অনুশীলন নেই, মন তৈরি নেই, এত সোজা?’

‘এরকম কথা যে ভাবতে পারে সে কিন্তু সাধারণ নয়।’

‘তা ছাড়া আমার বাসস্থান থেকে আপনার রিহার্সাল রুমের দূরত্ব ভাবুন।’

‘হুম।’ শমিত আর দাঁড়াল না। তার বিশাল শরীর সোজা হেঁটে যাচ্ছিল। রাধা বলল, ‘কীরকম যেন, না? সবার সঙ্গে মেলে না। মনে মুখে কোনও ঢাকাঢ়াকি নেই।’

হঠাৎ দীপাব খুব রাগ হয়ে গেল। সে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, ‘ঠিক আছে, এখন তো ও চলে গিয়েছে। এবার আমি জিনিসপত্র নিয়ে আমার ঘরে যেতে পারি তো?’

সকল অধ্যায়

১. ১. আজ সারাটা দিন সূর্যদেব উঠলেন না
২. ২. মেয়েরা কি ভূত হয়
৩. ৩. ভালো-মন্দ বোঝার বয়স
৪. ৪. রমলা সেন
৫. ৫. সত্যসাধন মাস্টার
৬. ৬. বৃষ্টিটা চলে যাওয়ার পরে
৭. ৭. চারদিন পৃথিবীটাকে দ্যাখেনি দীপা
৮. ৮. দীপাবলীর বিয়ে
৯. ৯. বাসর এবং বউভাত
১০. ১০. দীপাবলীর ফুলশয্যা
১১. ১১. পুত্ৰটি দেহ রেখেছে
১২. ১২. রমলার চিঠি
১৩. ১৩. প্ৰাপ্তবয়স্কতা শরীরের না মনের
১৪. ১৪. চাবাগানের আশেপাশে
১৫. ১৫. আসাম রোড
১৬. ১৬. একটি মানুষের চেহারা
১৭. ১৭. জলপাইগুড়ি শহরে
১৮. ১৯. রমলা সেনের কাছে
১৯. ১৮. পুলিশের লাঠিচার্জ
২০. ২০. জলপাইগুড়ির হোস্টেলের মেয়ে
২১. ২১. দুশ্চিন্তার ছাপ
২২. ২২. একতারা বাজিয়ে গান
২৩. ২৩. দুর্দান্ত ব্যবসাদার প্রতুল বন্দ্যোপাধ্যায়
২৪. ২৪. সত্যসাধন মাস্টার এসে পড়বেন
২৫. ২৫. অমরনাথ হতভম্ব
২৬. ২৬. তিনদিন ধরে সমানে বৃষ্টি
২৭. ২৭. অমরনাথের শরীর
২৮. ২৮. কলকাতা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে
২৯. ২৯. প্রৌঢ় ভদ্রলোকটি হাঁটছিলেন
৩০. ৩০. এক অদ্ভূত অভিজ্ঞতা
৩১. ৩১. বাড়িটা শুধু পুরনো নয়
৩২. ৩২. উত্তর কলকাতার পথে পথে
৩৩. ৩৩. কলেজ এবং হোস্টেলের বাইরে
৩৪. ৩৪. দীপা অঞ্জলির দিকে তাকাল
৩৫. ৩৫. অমরনাথ শুয়ে আছেন
৩৬. ৩৬. ভবিষ্যৎ সম্পর্কে প্ৰচণ্ড অসহায়তাবোধ
৩৭. ৩৭. তিনতলার ব্যালকনি
৩৮. ৩৮. দীপা চুপ করে আছে
৩৯. ৩৯. সুভাষচন্দ্র এগিয়ে এলেন
৪০. ৪০. মেয়েটির নাম লাবণ্য
৪১. ৪১. বিছানায় টান টান দীপা
৪২. ৪২. কলেজের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে
৪৩. ৪৩. কিছু মানুষ খুন হলেন
৪৪. ৪৪. কেমন একটা সংসার-সংসার ভাব
৪৫. ৪৫. রাধা চলে এল সেজেগুজে
৪৬. ৪৬. দ্বিতীয় অভিনয় হয়ে যাওয়ার পরে
৪৭. ৪৭. কলোনি থেকে কলেজ পাড়ায়
৪৮. ৪৮. স্কটিশ চার্চ কলেজে জানাজানি হয়ে গেল
৪৯. ৪৯. একদম লেডি
৫০. ৫০. রমলা সেন চোখ ছোট করলেন
৫১. ৫১. সাতকাহন প্ৰথম পর্ব সমাপ্ত

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন