সমরেশ মজুমদার
কেমন একটা সংসার-সংসার ভাব। এই সংসার নিজের, একদম একার। অথচ বাজার করা থেকে আরম্ভ করে বাসনমাজা সবই আছে। এসব করতে গিয়ে বেশ নেশাও ধরে। সময় কীভাবে বয়ে যায় টের পাওয়া যায় না।
প্রথম রাত্রে রাধাদের বাড়িতে খাওয়াদাওয়া হয়েছিল। কলকাতার হস্টেলের ঠাকুরের রান্না খেয়ে মুখে যে অরুচি হয়েছিল তা এক রাতেই দূর হয়ে গিয়েছিল। রাধার মা চমৎকার রান্না করেন। অঞ্জলিও খারাপ রাঁধে না। তার রান্না খেতে অসুবিধে হয় না, ভালই লাগে। কিন্তু রাধার মায়ের রান্না খেয়ে মনে হয়েছিল ব্যাপারটা প্রায় শিল্পের পর্যায়ে চলে গিয়েছে। অমরনাথ প্রায়ই বলতেন পূর্ববঙ্গের মহিলারা পশ্চিমবঙ্গের মহিলাদের চেয়ে চমৎকার রাঁধেন। ব্যতিক্রম নিশ্চয়ই আছে কিন্তু রাধার মায়ের রান্না সে অনেককাল মনে রাখবে।
প্রথম সকালে বাজার করে রান্না করার সময় ভাগ্যিস রাধা সঙ্গে ছিল। স্টোভ ধরিয়ে রান্না করতে সে বেশ হিমসিম খেয়ে যাচ্ছিল। অঞ্জলি তাকে কোনওদিন রান্না করতে দেয়নি। মন দিয়ে লেখাপড়া করো, তাতেই আমি কৃতার্থ হব, এই ধরনের কথা বলত। হস্টেলে আসার পর তো সেই প্রশ্ন ওঠে না। শুধু দেখার চোখ দিয়ে যেটুকু, ভাত সেদ্ধ আর মাছ কিংবা ডিমের ঝোল। কখনও সেদ্ধর বদলে ভাজা। দুঃসাহসী হলে কোনও কোনও দিন খুব খারাপ স্বাদের তরকারি। একবেলায় রান্না করে দু’বেলায় খাওয়া। প্রথমদিকে রান্না শেষ করতে প্রায় দুপুর। দেখা গেল রাধা তার চেয়ে অনেক পটু এ-ব্যাপারে। কিন্তু মেয়েদের যে-সহজাত প্রবণতা আছে তা থেকেই ব্যাপারটা রপ্ত হয়ে যাচ্ছিল।
রাত্রে একা থাকতে ঠিক ভয় নয়, অস্বস্তি হচ্ছিল। দরজা বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে সামান্য শব্দ হলেই এক ধরনের উৎকণ্ঠা হচ্ছিল। অন্য সময় অস্বস্তি। যেন এইমাত্র কেউ এসে দরজায় শব্দ করবে। রাধার মা বলেছিলেন প্রয়োজন মনে করলে সে বাধাকে নিয়ে শুতে পারে। দীপা রাজি হয়নি। তার জন্য রাধা কেন কষ্ট করবে। আর ঘর ভাড়া নিয়ে যে একা থাকতে চাইছে তার কারও ওপর নির্ভর করা উচিত নয়। রাতে শুয়ে দীপা ভাবছিল, সব ভাল, শুধু রান্নার পর বাসনপত্র হাঁড়ি ধোয়ার ব্যাপারটা না থাকলে ঠিক হত। রাধা বলেছিল সে ইচ্ছে করলে একটা কাজের লোক রাখতে পারে, যে পাঁচ টাকার বিনিময়ে দু’বেলা বাসনপত্র মেজে ঘর পরিষ্কার করে দিয়ে যাবে। কিন্তু পাঁচ টাকা খরচ করার বিলাসিতা এই মুহুর্তে সে করতে পারে না।
রাত্রে শুয়ে আর একটা জিনিস হল। ঘুম আসছিল না কিছুতেই। এপাশ ওপাশ করতে করতে হঠাৎ অমরনাথের মুখ মনে পড়ল তার। আর তারপরেই চা-বাগানের বাড়ির সামনের মাঠ, আংরাভাসা নদী, সবুজ গালিচার মতো চায়ের গাছের সারি এবং সব শেষ অঞ্জলির মুখ। সঙ্গে সঙ্গে বুক কাঁপিয়ে কান্নার ঝড় উঠল। বালিশে মুখ চেপেও সেই কান্না থামানো যাচ্ছিল না। হঠাৎই এটা হল। ফেলে-আসা ছেলেবেলার জন্যে তার মন উথালি-পাথালি করতে লাগল। এইসময় সবাইকে তার ভাল লাগছিল। এমনকী অঞ্জলিকেও। নিজেকে ভীষণ নিঃস্ব বলে মনে হচ্ছিল।
অথচ দিন সাতেকের মধ্যেই সবকিছু অভ্যেসে এসে গেল। রান্না থেকে একা থাকা। এই সাতদিন এলাকার বাইরে যায়নি সে। এমনকী টিউশনিতেও না। প্রথম দিনেই লাবণ্যর দিদিমাকে চিঠি লিখে জানিয়ে দিয়েছিল এ-কথা। দিন সাতেকের ছুটি চাই। এখন লাবণ্যর স্কুল বন্ধ। অতএব তেমন অসুবিধে হবার কথা নয়। বাড়ি বদলের জন্যে এই ছুটি নিতে বাধ্য হচ্ছে বলে সে চিঠিতে দুঃখ প্রকাশ করেছে। দ্বিতীয় চিঠি সে লিখেছে মনোরমাকে। হস্টেল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সে একটি বাসা ভাড়া করে আছে। জীবনে প্রথম নিজে রান্না করে খাচ্ছে। এরকম সময়ে মনোরমাদের কথা খুব মনে পড়ছিল। নিজের নতুন ঠিকানা জানিয়ে লিখেছে তার পড়াশুনা ভালই চলছে। চিন্তার কোনও কারণ নেই।
কলকাতায় এসে বস্তি নজরে পড়ছিল দীপার। একেবারে শহরের বুকের ওপরে বড়বড় বাড়ির ফাঁকে কিছুটা জমির উপরে ভাঙাচোরা ঠাসঠাস একতলা টিন সিমেন্টের সঙ্গে টালির ঘর। ভীমরুলের চাকের মতো ওই বস্তিতে মানুষ কীভাবে থাকে সেটা ভাবতে অবাক লেগেছিল। তারপর যখন জেনেছিল কলকাতার বুকের বেশিরভাগ বস্তিতে পশ্চিমবঙ্গীয় মানুষেরাই থাকেন, তখন গোলমাল লেগেছিল। কলোনিতে এসে সে দেখল পূর্ববঙ্গের উদ্বাস্তু মানুষেরা নিজেদের বাসস্থান খুবই সাধারণভাবে নতুন জায়গায় গড়ে তুললেও তা বস্তির পরিবেশের মতো দমবন্ধ করা নয়। যথেষ্ট ফাঁকা, গাছপালা লাগানো, নিজেদের সম্ভ্রম বাঁচিয়ে এই কলোনিগুলো গড়ে উঠেছে। রাধার সঙ্গে কথা হয়েছিল একদিন। রাধা বলেছিল, আমরা তো মার খাওয়া মানুষ, বাঁচার জন্যে আমাদের এখনও চেষ্টা আছে। সবাই চেষ্টা করি আবার আগের জীবন ফিরিয়ে আনতে। পশ্চিমবঙ্গের মানুষদের শুধু আলস্য আছে, সেটা দূর করার জন্যে কোনও চেষ্টা নেই।
তিনদিনের মাথায় পড়াশুনা শুরু করেছিল দীপা। কলেজের পড়ায় তার কোনও অসুবিধে হচ্ছে না। কিন্তু সে আবিষ্কার করল মাথার ভেতর থেকে আই এ এস-এর চিন্তাটা অনেক সরে গিয়েছে। কলোনিতে ঝগড়া হয়, এর সঙ্গে ওর মারপিটও হচ্ছে। এই মানুষই এখন পশ্চিমবঙ্গের গরিষ্ঠ প্রতিনিধি। শমিতের দেওয়া আই এ এস-এর ব্যাখ্যাটা এখন বড় সত্য বলে মনে হচ্ছে। নিজেকে যাচাই করার সহজ রাস্তাটা ছেড়ে দিতেও তার মন চাইছিল না। শেষপর্যন্ত সে ঠিক করল ফর্ম ভরতি করে পরীক্ষায় বসবে। নিজের যোগ্যতা দেখবে। তারপর ঠিক করবে চাকরি করবে কি করবে না।
কিন্তু চাকরি দরকার। এ-দেশে যেসব চাকরি গ্রাজুয়েট হয়েই করা যায় সেগুলোর জন্যে চেষ্টা করতে হবে। তদ্দিন খরচ চালানোর জন্যে রোজগারের পথ হিসেবে টিউশনি তো রয়েছেই। লাবণ্যকে পড়াবার দায়িত্ব নেবার পরও তার কাছে অন্তত সাত-আটজন ওই প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল। অতএব না খেয়ে মরে যেতে হবে না।
ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় আসতেই চোখে পড়ল বাড়িওয়ালা তাঁর বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন। এই মানুষটাকে তার আর পছন্দ হচ্ছে না। ওঁর চোখের দৃষ্টিতে কেমন একটা চটচটে ব্যাপার আছে, চোখ ফিরিয়ে নিতে হয়। দেখামাত্র ভদ্রলোক বললেন, ‘কিছু লাগে নাকি? এনি প্রবলেম?’
দীপা মাথা নেড়ে না বলে ভেতরে ঢুকে গেল।
দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর পরিষ্কার হয়ে দীপা দরজায় তালা লাগিয়ে বের হল। উঠোন পেরিয়ে রাস্তায় নামার মুখে বাড়িওয়ালার সঙ্গে আবার দেখা, ‘কই যাও?’
‘কাজ আছে।’ দীপা গতি কমাল সামান্য।
‘অ। বেশি রাত না করাই ভাল, বুঝো না? মাইয়া মানুষেরে রাতের বেলায় লোকে ঠিক চোখে দ্যাখে না। কথাটা বুঝো না?’
‘একা এসে থাকতে পারি যখন তখন এটুকু নিশ্চয়ই বুঝি।’ দীপা আর দাঁড়াল না। রাধা বলেছে লোকটার স্বভাবই এই। আগ বাড়িয়ে কথা বলে। আর তাতেই নাকি মনের সুখ মেটায়। আসলে মনে মনে বেজায় ভিতু। ওঁর স্ত্রীর সঙ্গে এই সাতদিনে তার একবারও দেখা হয়নি। দু’-একবার চোখে পড়েছে চোখ পর্যন্ত ঘোমটা টেনে কাজ করছেন। বারো-তেরো বছরের মেয়েদের খুব ভিড় হয় বাড়িওয়ালার কাছে। স্ত্রীর তৈরি মোয়া নাড়ু নিজের হাতে খাওয়ান তাদের। অবশ্য আজ পর্যন্ত কেউ কোনও অভিযোগ করেনি ওঁর বিরুদ্ধে। বরং কলোনির মানুষ এই স্বভাবের জন্যে হাসাহাসি করে। করুক। কিন্তু যে-মানুষের চোখের দৃষ্টি অত চটচটে তার সামনে দাঁড়াতে গা ঘিনঘিন করে।
রাধাদের বাড়িতে ঢুকে ওর দাদার সঙ্গে দেখা। পাজামা আর হ্যান্ডলুমের পাঞ্জাবি পরে বের হচ্ছে। দেখলেই বোঝা যায় পরিশ্রম করে। কাঁঠাল গাছের সামনে ওকে দেখেই বলল, ‘রাধা নেই। টিউশনিতে গিয়েছে।’
‘এইসময়?’
‘ওর ছাত্রীর বাড়িতে সন্ধেবেলায় সত্যনারায়ণ পূজা তাই।’
দীপা লক্ষ করেছে তার সঙ্গে কথা বলার সময় রাধা আজকাল কলকাতার ভাষা ব্যবহার করে। রাধার দাদাও দু’একবার যা বলেছে তা এ-দেশের ভাষায়। কিন্তু নিজেদের মধ্যে ওরা দেশের ভাষা ব্যবহার করে। রাধার মা কিন্তু এই চেষ্টা করে না।
‘ও। তা হলে ঠিক আছে।’ দীপা পেছন ফিরল। এখান থেকে স্টেশনে হেঁটে যাবে সে। ট্রেন ধরে শিয়ালদায়। শিয়ালদায় নেমে সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউতে, লাবণ্যদের বাড়ি। সে বুঝতে পারল রাধার দাদা যেহেতু বেরিয়েছে তাই খানিকটা তফাতে আসছে। ভদ্রলোকের নাম অনিল। পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের কোনও যুবককে অবশ্য ভদ্রলোক বলা যায় কিনা তা বুঝতে পারল না দীপা, কিন্তু পরিচিত একজন একই রাস্তায় যাচ্ছে অথচ সে কথা বলছে না—এটা ভাবতে খারাপ লাগল। সে ঘুরে পেছন ফিরে তাকিয়ে হাসল।
অনিল সামান্য এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করল,‘কোথায় যাচ্ছেন?’
‘পড়াতে। সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউতে।’
‘সে তো অনেক দূর।’
দীপা জবাব না দিয়ে আবার হাসল। অনিল বলল, ‘আপনার সাহস আছে। মাকে এ-কথাই বলছিলাম। একা এসে থাকছেন। কোনও অসুবিধা হচ্ছে না তো?’
‘না না। রাধা যা সাহায্য করেছে তারপর আর অসুবিধে থাকে।’
মাটির রাস্তা ধরে আরও খানিকটা পথ চুপচাপ চলা। আশেপাশের বাড়ির মানুষজন তাদের দেখছে। অবশ্য এর মধ্যেই দীপা বেশ দ্রষ্টব্য হয়ে গিয়েছে।
অনিল জিজ্ঞাসা করল,‘আপনি কীসে যাবেন?’
‘ট্রেনে। আপনি?’
‘আমি তো গড়িয়াহাটে যাব। বাসে। ওখানে আমার দোকান, জানেন তো!’
‘হ্যাঁ, শুনেছি। কীসের দোকান যেন?’
‘কাটা কাপড়ের। চার বছর ধরে অনেক চেষ্টা করে একটু দাঁড় করিয়েছি। এখানে জায়গা পাওয়া খুব মুশকিল। ঘর ভাড়া করার পয়সা কোথায়? যা সেলামি চায়। তাই ফুটপাতের ওপর কোনওরকমে…মূলধনও তো কম।’
‘খুব খাটতে হয়।’
‘খাটনির জন্যে ভাবি না। সাড়ে আটটায় যাই, সাড়ে বারোটায় ফিরি। ভাত খেয়ে এই যে যাচ্ছি ফিরতে ফিরতে রাত সাড়ে দশটা। এমনিতে খারাপ না, শুধু ঝামেলা করে দুটো জিনিস। বৃষ্টি আর পুলিশ।’
কথাটা এমন ভঙ্গিতে বলা যে হেসে ফেলল দীপা, ‘বৃষ্টির ব্যাপারটা না হয় বুঝলাম কিন্তু পুলিশ কেন? আপনাদের ব্যাবসা কি আইনসংগত নয়?’
‘ফুটপাত দখল করা দোকান তো৷ আসবেন একদিন দেখে যাবেন।’ তারপরেই খেয়াল হল যেন, ‘আপনি সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউতে যাবেন বলছিলেন না?’
‘হ্যাঁ।’
‘তা হলে ট্রেনে কেন যাচ্ছেন? বারবার গাড়ি বদলানো। এখান থেকে নয় নম্বর বাসে উঠে বসুন, সোজা সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউতে নামবেন। ভাড়াও কম পড়বে।’
ট্রেনে তাড়াতাড়ি কলকাতার মাঝখানে পৌঁছানো যায়। কিন্তু আজ তো তার তেমন তাড়াহুড়ো নেই। অতএব সে স্টেশনের পথ ছেড়ে দিল। অনিলের পাশাপাশি সে বাস স্ট্যান্ডের দিকে হাঁটতে হাঁটতে ভাবল, একসঙ্গে যাওয়ার ইচ্ছায় অনিল তাকে বাসে যাওয়ার প্রস্তাব দিল না তো। সঙ্গে সঙ্গে চিন্তাটাকে বাতিল করল সে। কলেজে বা রাস্তাঘাটে যে-সব ছেলে মেয়েদের সঙ্গে মতলব নিয়ে মেশে, তাদের সঙ্গে কথাবার্তা এবং চেহারায় অনিলের আকাশ পাতাল পার্থক্য। ওকে দেখলেই মনে হয় একজন সৎ মানুষ সংসার বাঁচানোর জন্যে মরণপণ পরিশ্রম করে যাচ্ছে। ফুটপাতের দোকান এমন কিছু দর্শনীয় নয়, মনে মতলব থাকলে সেই দোকান দেখতে যেতে বলত না।
‘রাধা বলছিল আপনি আর এখানে এসে পড়াশুনা করেননি।’
‘আর পড়াশুনা! এখানে আসার পর পেটের ভাত জোগাড় করতেই হিমসিম খাচ্ছিলাম। দেশে আই এ পাশ করেছিলাম ফার্স্ট ডিভিশনে। এর মধ্যেই সব ভুলে গিয়েছি। রাধাকে তাই বলেছি, খাওয়াপরার চিন্তা করতে হবে না, টিউশনির টাকায় তুই তোর পড়া চালিয়ে যা।’ অনিল হাসল।
‘আপনি এত পরিশ্রম করেন, আপনার রিক্রিয়েশন কী?’
‘রিক্রিয়েশন?’ হাসল অনিল, ‘সারাদিন দোকানে এত লোক আসে, কতরকমের লোক, তাদের সঙ্গে কথা বলেই সময় কেটে যায়।’
ওরা বাসস্ট্যান্ডে এসে গিয়েছিল। দোতলা বাস। দীপা একতলার লেডিস সিটে বসল। জনা দশ-বারো যাত্রী এখন। অনিল সামনের দিকের একটা সিটে বসে পড়ল। মিনিট পাঁচেক বাদে বাস ছাড়ল। দীপার মনে পড়ল এই রাস্তায় সেদিন তারা ট্যাক্সি করে এসেছিল। মিনিট তিনেকের মধ্যে বেশ ভিড় হয়ে গেল বাসে। ঢাকুরিয়া, গোলপার্ক ইত্যাদি জায়গার নাম কনডাক্টরের মুখে শুনে দেখে নিচ্ছিল দীপা। হঠাৎ দেখল একটা হাত সামনে দাঁড়ানো মানুষের ফাঁক গলে তার দিকে এগিয়ে আসছে আর সেই হাতের আঙুলে টিকিট ধরা। সে মুখ তুলে অনিলকে দেখতে পেল। অনিল বলল, ‘আমার নামার জায়গা এসে গিয়েছে। এটা রাখুন।’
‘ওমা, আপনি আমার টিকিট কাটলেন কেন?’
‘রাখুন তো। একসঙ্গে বাসে উঠে একটা টিকিট আলাদা কাটা যায় নাকি? চলি।’ টিকিটটা নিতেই অনিল সরে গেল সামনে থেকে। দীপা জানলা দিয়ে তাকাল। এইভাবে অনিলের পয়সা, তা যত সামান্য হোক, খরচ করতে ভাল লাগছিল না তার। কিন্তু সেইসঙ্গে আর একটা কথা মাথায় এল। অনিল খুব সহজ। এত সহজভাবে নিজের কথা বলতে কাউকে শোনেনি। অসীম বন্ধু হিসেবে ভাল কিন্তু কেমন একটা ব্যবধান রেখে চলত। শমিতের উত্তাপ আছে। ও যখন কথা বলে তখন খুব সিরিয়াস হয়ে বলে। বক্তব্যের মধ্যে হালকা কিছু থাকলেও তাতে বুদ্ধি ব্যবহার করতে চায়। পিরানদেল্লো থেকে শম্ভু মিত্র, আলোচনায় যেন স্বস্তি পায়। কিন্তু ব্যক্তিগত সমস্যার কথা কখনও বলে না। বলার কথা ভাবেও না। যে-যার গণ্ডিতে নিশ্চয়ই ভাল। কিন্তু অনিলের সঙ্গে এই এতটুকু কথা বলার মধ্যেই যেন ওর দোকানের কাটা কাপড়ের যে ওম পাওয়া গেল তা অন্যদের কাছে পাওয়া যায়নি।
প্রায় সমস্ত কলকাতা ঘুরেই বাস ধর্মতলা পার হচ্ছিল। স্টেটসম্যান অফিসের উলটোদিকে বাস থামতেই শমিতকে দেখতে পেল সে। শমিত আর একটা মেয়ে। বাসের দিকে তাকিয়ে তাকে দেখতে পেয়েই শমিত চিৎকার করল, ‘আরে, এই দীপা। নেমে পড়ো। নেমে এসো। চটপট।’
ডাকটা এমন যে বাসের অন্য যাত্রীরা তার দিকে তাকাল। প্রায় বাধ্য হয়েই দীপা নেমে এল। শমিত হাসল, ‘একেই বলে যোগাযোগ। তোমার কথা একটু আগে ভাবছিলাম আর অমনি তুমি চলে এলে এখানে।’
‘কী ব্যাপার? ডাকলেন কেন?’
‘যাচ্ছ কোথায়?’
‘ছাত্রী পড়াতে।’
‘ও। ঘণ্টাখানেক বাদে গেলে অসুবিধে হবে না। কফি খাবে?’
দীপা দেখল মেয়েটি অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শমিতের কথাবার্তায় বোঝাই যাচ্ছে না ওরা একসঙ্গে ছিল কিনা। শমিত সেটা বুঝতে পেরে বলল, ‘এসো, আলাপ করিয়ে দিই। ইনি শেফালি দত্ত। অ্যামেচারে অ্যাক্টিং করেন। অফিস ক্লাব। আর এ হল দীপা। কলেজে পড়ে।‘ শেফালি মুখ ফিরিয়ে হাসল। নমস্কারের চেষ্টা করল না। দীপা চুপ করে রইল। শমিত বলল, ‘চলো, কফি খাই।’
দীপা মাথা নাড়ল, ‘না। আপনারা যান। আমি এইমাত্র ভাত খেয়ে আসছি।’
শমিত বলল, ‘আমি গিয়েছিলাম শেফালি দেবীর বাড়িতে। যদি এই তিনটে শো করে দেন। গিয়ে শুনলাম ওই অফিসে রিহার্সাল দিতে এসেছেন। বলে এলাম। আর আসামাত্র এখানেই দেখা হয়ে গেল।’
‘তা হলে তো আপনার সমস্যার সমাধান হয়ে গিয়েছে।’
‘আরও বাড়ল।’
‘মানে?’
‘উনি তিনটের বেশি রিহার্সাল দিতে পারবেন না আর চারশো তিরিশ দিতে হবে। একটা কথা ওঁকে বোঝাতে পারছি না যে আমরা ফুর্তি করার জন্যে নাটক করছি না।’
এইসময় শেফালি কথা বলল। গলার স্বর বেশ মোটা, ‘আমি চলি। দেরি হয়ে গেছে। যদি আপনার পোষায় তা হলে আজ রাত্রে বাড়িতে খবর দেবেন।’ শেফালি চলে গেল। ফরসা কিন্তু শুকনো চেহারা। মুখে পুরু পাউডার।
তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে দীপা জিজ্ঞাসা করল, ‘এনারা মাসে ক’টা শো করেন?’
‘জানি না। চার পাঁচ ছ’টা হবে। অফিস ক্লাবে ওঁরা বেশি টাকা পান। আগে অফিসের নাটকে ছেলেরা মেয়ে সাজত। এখন এরা সুযোগ পাচ্ছে। তাই যারা একটু ভাল করে তাদের ডিম্যান্ড বাড়ছে।’ ক্লান্ত গলায় বলল শমিত।
‘কিন্তু আমায় ডাকলেন কেন?’
‘তোমার কি মনে হয় সময় দিতে পারবে না?’
‘সময় দেবার প্রশ্ন নয়। আসলে পুরো ব্যাপারটা নির্ভর করছে আমার এলেমের ওপর। কোনওদিন নাটক করিনি, সেভাবে নাটক দেখিনি। নাটক নিয়ে একটুও পড়াশুনা নেই। একদম নভিস আমি। এক্ষেত্রে প্রথমেই বড় চরিত্রে অভিনয় করতে গিয়ে একটা হাস্যকর কিছু করে ফেলা নির্বোধের ব্যাপার হবে।’
‘তুমি আত্মবিশ্বাস পাচ্ছ না?’
‘এ নিয়ে আপনার সঙ্গে আমার কথা হয়ে গিয়েছে একদিন।’
‘তা হলে আর কী করা যাবে।’ নিশ্বাস ফেলল শমিত, ‘শো তিনটে ক্যানসেল করে দিতে হবে। ধার করে টাকা এনে শেফালিকে দিয়ে হয়তো করাতে পারতাম, কিন্তু তাতে না ভরত মন আর কল শো করারও কোনও মানে থাকত না।’
দীপার খুব খারাপ লাগতে আরম্ভ করল। শমিতের অন্য সময়ের কথাবার্তার সঙ্গে এখন কোনও মিল নেই। ভেঙে না পড়লে কেউ এভাবে কথা বলতে পারে না। সে জিজ্ঞাসা করল, ‘টাকার কথা না হয় বাদ দিলাম, আপনি যে আমাকে করতে বলছেন আমি তো এই ভদ্রমহিলার ধারে কাছে যেতে পারতাম না। উনি তো প্রফেশন্যাল।’
শমিত মাথা নাড়ল, ‘আমি ভেবেছিলাম তুমি যদি সিনসিয়ার হও তা হলে তোমার এই স্বাভাবিক কথা বলার ভঙ্গিটাকেই কাজে লাগাব। অভিনয় মানে গলা কাঁপিয়ে সুর করে কথা বলা নয়। চরিত্রটি যে-কথা বলছে তার মানে বুঝে সেইমতো প্রকাশ করতে হবে। শুধু কথায় নয়, মঞ্চে যতক্ষণ চরিত্রটি থাকবে তার যেভাবে চলাফেরা করা উচিত, হাত-পা নাড়া উচিত, সেই ভাবটাকেই স্পষ্ট করতে হবে। চেষ্টা করবে?’
দীপা হেসে ফেলল, ‘জানি না কী হরে! কিন্তু আমি যেখানে থাকি সেখান থেকে রিহার্সাল করতে অসুবিধে হবে না?’
‘একটু হবে। তবে তোমাকে সাড়ে আটটার মধ্যে ছেড়ে দেব যাতে দশটার আগে বাড়ি ফিরে যেতে পারো। শুধু শোয়ের দিন একটু অ্যাডজাস্ট করতে হবে।’ শমিতের মুখের চেহারা পালটে যাচ্ছিল। খুব। উজ্জল লাগছিল ওকে, ‘আজ চলে এসো।’
‘আমি তো টিউশনিতে যাচ্ছি।’
‘কখন ছাড়া পাবে?’
‘সাড়ে ছ’টা।’
‘সাড়ে পাঁচ করো। ছ’টা থেকে তোমাকে নিয়ে বসব।’
কথা ছিল বিডন স্ট্রিট আর সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউর মোড়ে শমিত অপেক্ষা করবে। লাবণ্যকে পড়িয়ে দীপা ঠিক সময়ে পৌঁছে গিয়েছিল। সেখান থেকে রিহার্সাল রুম। রাস্তা থেকে বেশ ভেতরে ঢুকে মাঝারি ঘর। দশ জন ছেলে এর মধ্যে এসে গিয়েছে সেখানে। শমিত বলল, ‘এ হচ্ছে দীপা, মায়ার বন্ধু। আজ ওকে নিয়ে বসব। যদি দীপা পারে তা হলে কল শোগুলো হবে নইলে নয়। চা খাবে?’
দীপা মাথা নাড়ল। ঘরে শতরঞ্চি পাতা। শমিতের সামনে সেখানেই সে হাঁটু মুড়ে বসল। ঘরের অন্য ছেলেরা তার দিকে কৌতুহলী চোখে তাকিয়ে আছে। বেশ অস্বস্তি হচ্ছিল দীপার। এইসময় মনে হচ্ছিল এখানে আর একজন মহিলা থাকলে সুবিধে হত। সময় নষ্ট করল না শমিত। নাটকের খাতা খুলে বলল, ‘দীপা, প্রথমে আমি তোমাকে চরিত্রটা কী, তার অভ্যেস চলাফেরা মানসিকতা কীরকম বলে নিই। তারপর এই নাটকে তার ভূমিকা কী এবং কোন সমস্যায় সে পড়েছে। শোনার পর তোমার যদি প্রশ্ন করার কিছু থাকে করতে পারো।’
দীপা মাথা নাড়ল। শমিত শুরু করল। ওর বলার ধরন এত সহজ এবং স্পষ্ট যে সেই মেয়েটির ছবি পরিষ্কার হয়ে উঠল দীপার সামনে। চুপচাপ সে শুনে গেল। শমিত শেষ করে জানতে চাইল, ‘বুঝতে অসুবিধে হল?’
‘না। কিন্তু—।’ দীপা চুপ করে গেল।
‘হ্যাঁ। বলো। প্রবলেমটা কী?’
‘এই মেয়ে কাঁদবে না কেন?’
‘কারণ ভেঙে পড়তে সে পারে না। তার আত্মমর্যাদায় লাগবে।’
‘ঠিকই। কিন্তু তা সত্ত্বেও ওর কাঁদা উচিত।’
‘ওহো, দীপা, যেসব মেয়ে অল্পে কেঁদে ভাসায় ও তাদের দলে নয়। আমি জানি বাংলা নাটকের দর্শক স্টেজে কান্না দেখতে ভালবাসে। কিন্তু আমরা—।’
মাঝপথেই থামিয়ে দিল দীপা। সঙ্গে সঙ্গে অন্য শ্রোতাদের মধ্যে গুঞ্জন উঠল। শমিত হাত তুলতে ওরা থেমে গেল। শমিত বলল, ‘আমাদের এখানে ডিসিপ্লিনটা মেনে চলা হয়। যে-সময়ে দলে আসতে বলা হয় তারপরে এলে সেদিন বাইরে থাকতে হবে। কেউ কথা বললে তাকে সেটা শেষ করতে দিতে হয়। এইগুলো আমরা সবাই মেনে চলি।’
‘ও।’ দীপা লজ্জা পেল।
‘ঠিক আছে, এবার বলো।’
‘হ্যাঁ। আমি বুঝতে পারছি মেয়েটি সবার সামনে কেঁদে পড়তে পারে না। কিন্তু ও কাঁদবে ভেতরে ভেতরে। যদি তেমন কোনও সুযোগ থাকে যখন মঞ্চে ও একা তখন এক মুহুর্তের জন্যেও যদি দর্শক সেই ভেতরের কান্না দেখতে পান তা হলে খুব ভাল হবে।’
শমিত মুখ ঘুরিয়ে ঘরের কোনায় তাকাল, সেখানে সুদীপ বসে ছিল চুপচাপ। শমিতের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই বলল, ‘উনি খুব ভাল বলেছেন কিন্তু মুশকিল হল পরের দৃশ্যে ঘটনা অন্যদিকে বয়ে গেছে।’
‘তা যাক। দীপার আইডিয়াটা আমার ভাল লাগছে। আমরা নাটক করছি দর্শকের জন্যে। দর্শককে যদি বুঝতে না দিই চরিত্রটির মনের চেহারা কী, তা হলে ঠিক কাজ হবে না। দেখা যাক কোনও নতুন দৃশ্য বের করা যায় কিনা। থ্যাঙ্ক ইউ দীপা, তুমি ব্যাপারটা ভেবেছ বলে খুশি হলাম।’
রাত আটটায় তাকে ছুটি দিল শমিত। এর মধ্যে পুরো নাটকটা গড়গড় করে পড়ে গিয়েছে সে। একবার দেখা ছিল তাই বুঝতে অসুবিধে হল না। শেষ আধঘণ্টায় ওর হাতে খাতা দিয়ে শমিত বলল, ‘তুমি মেয়েটির সংলাপ বলল। দেখে দেখেই বলবে। আমাদের মুখস্থ আছে।’
সংলাপে চোখ রেখে দীপা আবিষ্কার করল তার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। কান গরম হয়ে উঠল। বসে বসেই শমিতরা যেখানে সংলাপ শুরু করল সেখানে মেয়েটি নেই। হয়তো দীপাকে তৈরি হতে সময়টা দিল। কিন্তু দীপার মনে হল কথা বলতে গেলেই গলায় স্বর ফুটবে না। তার জায়গা এসে গেলেও সে চুপ করে রইল কিছুক্ষণ। অন্য সবাই অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। দীপা মুখ তুলল, ‘আমি এটা নিয়ে গিয়ে বাড়ি থেকে যদি তৈরি হয়ে এসে বলি?’
বিরক্ত হল শমিত, ‘তার জন্যে অনেকটা সময় পরে পাবে। এখন যা বললাম তাই করো।’ দীপার খেয়াল হল শমিতকে প্রশ্নটা করার সময় তার গলা আটকে যায়নি। কিন্তু একটু যেন কাঁপুনি এসেছিল। আবার নতুন করে পড়া শুরু হল। তিনটে পুরুষ চরিত্র কথা বলছে। হঠাৎ হাত তুলল শমিত, ‘বাসব। হোয়াট ইজ দিস?’
‘ভুল হল?’ রোগামতো একটি ছেলে জিজ্ঞাসা করল।
‘আমি হাজারবার বলেছি কারও গলা নকল করবে না। ক’টা শো করেছ এর মধ্যে? এখনও নিজের গলায় কথা না বললে তো মুশকিল।’
ছেলেটি মাথা চুলকে বলল, ‘তা হলে এসে গিয়েছে।’
‘আসে কেন? এর কোনও ক্ষমা নেই কিন্তু। যাঁর গলা নকল করছ সেটা তাঁকেই মানায়। অন্য কেউ বললে ক্যারিকেচার বলে মনে হয়। আমি কিন্তু পরের বার এটা মেনে নেব না। নাও, আবার আরম্ভ করো।’
দীপা ব্যাপারটা ধরতে পারল না। যদিও ছেলেটির সংলাপ বলার ধরনের সঙ্গে ওর কথা বলার কোনও মিল নেই। সংলাপে একটা সুর আনছিল।
আবার বলা শুরু হল। পরপর চোখ রেখে নিজের জায়গায় এল দীপা: ‘আপনি জানেন না, জানার আগ্রহও যখন হয়নি তখন আপনাকে নিজে থেকে বলার প্রয়োজন বোধ করছি না।’
‘এরকম নাটুকে ভাষায় কথা বলছ কেন?’ শমিত জিজ্ঞাসা করল।
‘নাটক! তার আলাদা কোনও ভাষা থাকে নাকি। নাটক তো জীবন থেকেই নেওয়া।’
‘কিন্তু জীবন মানেই নাটক নয়।’
‘মানছি। কিন্তু আমি আমার কথা বলছি।’
‘বেশ। তুমি আমার সামনে এসে দাঁড়াও। হ্যাঁ, এবার বলো, তোমার কষ্ট কী? কী তোমার দুঃখ? আমি সব জানতে চাই।’
‘কী আশ্চর্য। আমি খামোকা আপনাকে আমার কথা বলতে যাব কেন?’
হঠাৎ একটা হাততালি বাজল। দীপা খাতা থেকে চোখ সরাল। শমিত বলল, ‘গুড। এই তেজটা চাই। উইদ দিস ডিগনিটি। দীপা, তোমার গলা ঠিক আছে কিন্তু রেওয়াজ করতে হবে।’
‘রেওয়াজ?’ দীপা অবাক।
‘হ্যাঁ। শুধু গায়কদের গলা ঠিক করার জন্যে রেওয়াজ করতে হয় এই ধারণা ভুল। অভিনয়ের জন্যেও ওটা দরকার। তোমার গলার স্বর মিষ্টি এবং পরিষ্কার। কিন্তু গলায় কাজ আনতে গেলে অনুশীলন দরকার। বাড়িতে সঞ্চয়িতা আছে?’
‘আছে।’
‘বিদায় অভিশাপ আর কর্ণকুন্তী সংবাদ রোজ সকালে জোরে জোরে পড়বে। গলা যতটা তুললে কষ্ট হয় না ভেঙে পড়ে না ততটা তুলে অর্থ অনুযায়ী সংলাপ বলবে। যেখানে বেস ভয়েস দরকার সেখানে সামান্য নীচে গলা নামাবে। পড়ার সময় মনে রাখবে চরিত্রটি যে কথা বলছে তার ভেতরের আবেগ যেন তোমার বলায় স্পষ্ট হয়।’
দীপা হেসে বলল, ‘পাড়ার লোকজন চলে আসবে যে।’
বিরক্ত হল শমিত, ‘প্রথম দিন আসবে, হয়তো দ্বিতীয় দিনেও। কিন্তু তারপর আর আসবে না। সবাই জেনে যাবে তুমি অনুশীলন করছ। কোনওদিন হারমোনিয়াম বাজিয়েছ?’
‘না। সেই সুযোগ পাইনি।’
‘ঠিক আছে, আপাতত দরকার নেই। তোমার দেরি হয়ে গেছে তুমি যেতে পারো। আর হ্যাঁ, কাল ছ’টায় আসবে। ঠিক ছ’টা।’
‘আমাকে কি রোজ আসতে হবে?’
এমন নির্বোধের মতো প্রশ্ন যেন কখনও শোনেনি শমিত, ‘না এলে তুমি পারবে কী করে? মাত্র তো দু’ঘণ্টা, বাইশ ঘণ্টা অন্য কাজ করো। নাটক হবে দলগত শিল্প। প্রত্যেকে সমান ছন্দে বাজবে। তাল কেটে গেলেই ঝুল। তোমাকে এই চরিত্রে নিয়ে আমি বিরাট ঝুঁকি নিচ্ছি। দিনে অন্তত দশ ঘণ্টা রিহার্সাল দিলে হয়ত একটা আদল পেতাম। কী আর করা যাবে।’ অখুশি মনে কথাগুলো বলল শমিত।
দীপা বলতে যাচ্ছিল, আমি কিন্তু যেচে আপনার কাছে আসিনি, আপনি জোর করে ধরে নিয়ে এসেছেন। যেহেতু কথাটা বলা মানে পরিবেশটাকে নষ্ট করা তাই সে উঠে দাঁড়াল। শমিত বলল, ‘সুদীপ, ওকে বাস স্ট্যান্ডে পৌছে দিতে হবে।’
‘না না। কোনও দরকার নেই।’
‘বাজে বোকো না। প্রথম দিন কেউ যাক।’
সুদীপ বলল, ‘আমিই যাচ্ছি।’
ওরা রিহার্সালের ঘর থেকে বেরিয়ে এল। হাঁটতে হাঁটতে সুদীপ জিজ্ঞাসা করল, ‘চরিত্রটা আপনার ভাল লাগেনি?’
দীপা মাথা নাড়ল, ‘ভালই তো।’
‘আসলে যে-দৃশ্যটা অ্যাড করার কথা আপনি বললেন সেটা প্রথমে আমি ভেবেছিলাম, কিন্তু শমিতের তখন পছন্দ হয়নি। আপনি এত ভাল ভাবতে পারেন দেখে খুশি হলাম।’
দীপা সুদীপের দিকে তাকাল, কিছু বলল না। বাস স্ট্যান্ডে এসে সুদীপ বলল, ‘ঘাবড়াবেন না, আমি শুধু বলতে পারি প্রথমবারে আপনার মতো ভাল মায়াও করতে পারেনি।’
‘দীপা হাসল, ‘আমাকে এখন অনেক দূরে যেতে হবে।’
‘ও। এই কদিন না-হয় একটু কষ্ট করুন। আমরা তো সন্ধেটা কীরকম তা ভুলেই গিয়েছি রিহার্সাল রুমে থেকে। আপনার বাস আসছে।’
দীপা মাথা নাড়ল, ‘না, এই বাস নয়, অত দূরে এই বাস যাবে না।’
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন