সমরেশ মজুমদার
এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। এতকালের চেনাজানা মানুষ এবং তাদের আচরণে যে-অভ্যাস তৈরি হয়েছিল তার সঙ্গে কোনও সাযুজ্য নেই গ্লোরিয়ার আচরণে। এতকাল দীপার মনে হত বাঙালি মেয়ে হিসেবে এত অল্প বয়সে সে এমন অনেক কাজ করেছে যা সাধারণ নিয়মের মধ্যে পড়ে না। স্বাধীনতার দশ-বারো বছর পরেও মেয়েরা শুধু মেনে নিয়ে বেঁচে থাকতেই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে। অনেক ব্যাপারে জিভে ‘কেন’ শব্দটি উঠে এলেও তারা সেটাকে গিলে ফেলতে পারলে বেঁচে যায়। মাঝে মাঝে এই ধারণাও তীব্র হয়েছে যে মেয়েদের বড় শত্রু হল মেয়েরাই। নলিনী কিংবা আনা জানত কীজন্যে তাকে ওই বয়সে বউ করে আনছেন প্রতুলবাবু। তারা এও জানত অতুলচন্দ্রের স্বাস্থ্য কীরকম সুস্থ। তবু তারা প্রতিবাদ করেনি। নিজের স্বার্থে আনা তার উপকার করেছে, মেয়ে হিসেবে আর একটি মেয়েকে সম্মান জানাতে নয়। মনোরমা তার ওপর বৈধব্যের নিয়মাবলি চাপিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। সে প্রতিবাদ করেছিল পরে কিন্তু প্রাথমিক অবস্থায় মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল। সে বিধবার মতো জীবন যাপন করুক তা অন্তত অমরনাথ মুখ ফুটে কখনও বলেননি। অঞ্জলিও মনোরমাকে বোঝাতে এগিয়ে যায়নি। সে নিজে একটু একটু করে যখন ওইসব নিয়মের পাঁচিল ভেঙে স্বাভাবিক হয়েছিল তখন চা-বাগানের বিভিন্ন কোয়ার্টার্সের বয়স্করা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কথা বলতেন এই নিয়ে। রমলা সেন ব্যতিক্রম। তিনি ঔদ্ধত্য এবং স্বাধীনতা একসঙ্গে ব্যবহার করেছেন। এখন মনে হয় তাঁর অনেক কাজের পেছনে কোনও যুক্তি নেই। যেভাবে মাঝরাত্রে জঙ্গলের রাস্তায় তিনি অমরনাথের সাইকেলে চেপে অচেনা বাড়িতে এসে রাত কাটিয়েছিলেন সেটা কোনও অবস্থাতেই সমর্থনযোগ্য নয়। একটা রাত গাড়ির মধ্যে কাটালে তাঁর যে ক্ষতি হত সেই একই ক্ষতি অচেনা লোকের সাইকেলে উঠলেও হতে পারত। কলকাতায় এসে বাসাবাড়িতে ওঠার পর যে-মেয়েটির সঙ্গে তার আলাপ হয়েছিল সে কিছুটা স্বাধীনতার সুযোগ চুরি করে নিয়েছিল। সিনেমা এবং লুকিয়ে-চুরিয়ে ছেলেদের সঙ্গে মেশার মধ্যে সেই স্বাধীনতার আনন্দ উপভোগ করে তৃপ্তি পায় সে। কিন্তু তার বাইরে এই কলকাতার মেয়েরা এখনও পরদাপ্রথায় বিশ্বাস করে। রিকশায় উঠেই মধ্যবয়সি মহিলারাও পরদা ফেলে দেন সামনে। মির্জাপুর স্ট্রিটে উলটোদিকের বাড়িতে এক মহিলা সারাদুপুর খড়খড়ি ফাঁক করে রাস্তা দেখতেন, জানলা খুলে দেবার সাহস তাঁর ছিল না। মাঝে মাঝে মনে হয় সাহস নয়, সংস্কারে জড়ানো মন প্রতিটি পায়ে আটকে যায়। এই যে অভিভাবকরা ছাতা মাথায় করে কলেজে ছাত্রী পৌঁছে দিচ্ছেন, ছেলে হলে দিতেন না। হয় তাঁরা মেয়েটিকে সাবালিকা ভাবেন না অথবা সাবালিকা ভাবেন বলেই ভয় করেন। যেন পৃথিবীর সমস্ত পুরুষ তাঁর মেয়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে একা পেলেই এবং সেই ননির পুতুল তাদের হাতে নিজেকে তুলে দেবে। অথবা এমনও হতে পারে এঁরা নিজেদের মেয়েকেই সন্দেহ করেন যেন ফাঁক পেলেই মেয়েটি কোনও গর্হিত কর্ম করতে ছটফট করবে।
হ্যাঁ, ব্যতিক্রম নিশ্চয়ই আছে কিন্তু এখনও তার চোখে পড়েনি। বাসে-ট্রামে তার বয়সি মেয়ে একা ঘোরে না। সে শুনেছে ঘটিদের বাড়িতে নাকি এ ব্যাপারে আরও কড়াকড়ি। সেখানে দাদার বন্ধুদের দিকেও চোখ তুলে তাকানো নিষেধ। মা মাসি না থাকলে সিনেমায় যাওয়ার কথা কেউ ভাবতে পারে না। এখন অবশ্য বারোতে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয় না, কিন্তু এ-দেশের নব্বইভাগ মেয়ে কুড়িতে পড়তে-না-পড়তেই কোনওরকমে শ্বশুরবাড়িতে চলে যায়।
প্রথম রাতে গ্লোরিয়ার সঙ্গে কথা বলতে বেশ অসুবিধেয় পড়েছিল দীপা। ইংরেজি বলার একদম অভ্যেস নেই, তার লিখতে আটকায় না। তার ওপর গ্লোরিয়ার কথা বলার ধরন একদম অন্যরকম, একটু জড়ানো আর উচ্চারণও আলাদা। কর্তার পর ক্রিয়া এবং তার কাল নিয়ে মোটেই মাথা ঘামায় না সে। মাঝে মাঝে কর্তা ব্যবহার না করে দু’-তিনটি শব্দে মনের কথা বোঝায়। বিছানাপত্র সাজিয়ে জুতো খুলে বিছানায় বাবু হয়ে বসতেই ওর কাছে আর দুটি মেয়ে এসেছিল। তিনজনই লিভিংস্টোন নামে একটা শহরে থাকত। নিজেদের মধ্যে চিৎকার চেঁচামেচি হাসাহাসি করল ঘণ্টাখানেক। গ্লোরিয়া তার সঙ্গে ওদের আলাপ করিয়ে দিয়েছিল। যে-মেয়েটির নাম লুসাকা সে বলল, ‘ইয়োর নেম বিউতিফুল।’ গ্লোরিয়া তাকে দীপাবলী শব্দটির অর্থ বুঝিয়ে দিয়েছিল। দীপা জানতে চাইল লুসাকা শব্দটির মানে কী? মেয়েটি হেসে গড়িয়ে পড়ল। তারপর হাত নাড়তে নাড়তে বলল, আমি জানি না। আসলে জাম্বিয়াতে একটা শহর আছে যার নাম লুসাকা। আমার মা সেই শহরের মেয়ে। তাই আমার নাম রেখেছিল লুসাকা।’
এইসময় গ্লোরিয়া একটা সিগারেটের প্যাকেট বের করল। করে প্রথমে দীপার দিকে সেটা এগিয়ে ধরল। দীপা মাথা নাড়ল, ‘আমি সিগারেট খাই না।’
‘গুড গার্ল। আমার মনে হয় ইন্ডিয়ান মেয়েরাই সিগারেট খায় না।’ গ্লোরিয়া বন্ধুদের মধ্যে সিগারেট বিতরণ করে নিজেরটা ধরাল, ‘কেন বলো তো?’
‘কোনও বিশেষ কারণ নেই। ব্যাপারটা চালু হয়নি তাই।’
এইসময় লুসাকা বলল, ‘কিন্তু আমি দিল্লি স্টেশনে একটা মেয়ে ভিখিরিকে সিগারেট খেতে দেখেছি। হ্যান্ডমেড সিগারেট।’
গ্লোরিয়া অবাক হল, ‘তাই? তুমি শিয়োর যে মেয়েটা ভারতীয়?’
‘নিশ্চয়ই। দিল্লির স্টেশনে কি বিদেশি মেয়ে ভিখিরি ভিক্ষা করবে?’
দীপা বলল, ‘এটা হতে পারে। এদেশের একদম নিচুতলার বিত্তহীন মেয়েদের মধ্যে সিগারেট বিড়ি খাওয়ার রেওয়াজ আছে।’
তৃতীয় মেয়েটি, যার নাম খুব খটমটে, হেসে বলল, ‘দিল্লিতে একটা একজিবিশনে আমি তিনশো বছর আগের এক রেসপেক্টবল ইন্ডিয়ান লেডির ছবি দেখেছি যিনি স্মোক করছিলেন পাইপের সাহায্যে। লম্বা পাকানো পাইপ।’
গ্লোরিয়া দীপাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘তা হলে তোমার ব্যাখ্যায় গোলমাল থাকছে। বাড়িতে ছেলেরা যদি চোখের সামনে সিগারেট খায়, প্যাকেট টেবিলে ফেলে রাখে, কলেজে ছেলেরা যদি একসঙ্গে আড্ডা মারতে মারতে সিগারেট ধরায়, মেয়েরা কি হাত গুটিয়ে থাকবে? ফিফটি পার্সেন্টের হয়তো সিগারেটের টেস্ট খারাপ লাগে বলে খায় না কিন্তু বাকিরা? সিগারেট খেলে মেজাজ ভাল হয় না?’
দীপা তখন বোঝাতে বসল। এ-দেশের বড়দের সামনে ছোটরা সিগারেট ধরায় না কারণ তারা মনে করে নেশার জিনিস বড়দের সামনে খাওয়া অভদ্রতা।
‘নেশার জিনিস?’ কথার মাঝখানে বাধা দিল গ্লোরিয়া। ‘সিগারেট খেলে কি নেশা হয়? মাথা ঘোরে? পা টলে? কথা জড়িয়ে যায়?’
‘যায় না। কিন্তু এ-দেশের ছেলেরা কোনও যুক্তি ছাড়াই বড়দের সামনে খায় না। আর মেয়েরা তো ভাবতেই পারে না খাবার কথা। যেসব মেয়ে খায় তাদের হয় নিচু শ্রেণির বলে উপেক্ষা করা হয় নয় বদচরিত্রের বলে এড়িয়ে যায়।
লুসাকা চেঁচিয়ে উঠল, ‘গুড গড! তা হলে কি আমাদের সিগারেট খেতে দেখে তুমি খুব খারাপ। ভাবছ?’
দীপা ওর কথা বলার ধরনে হেসে ফেলল, ‘আমার কিছুই মনে হচ্ছে না। তবে এই হস্টেলের কী নিয়ম আমি জানি না। রাস্তায় যদি সিগারেট খাও তা হলে লোকে ফিরে ফিরে তাকাবে। অবশ্য বিদেশি। বলে তোমরা কিছুটা ছাড় পেতে পারো।’
গ্লোরিয়া বলল, ‘এটা খুব ফালতু ব্যাপার। তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি খুব বাস্তব মেয়ে। তুমি। কেন সবাইকে বোঝাতে চেষ্টা করো না। আমাদের দেশে এখনও পড়াশুনার চল বেশি হয়নি। বেশিরভাগ মানুষই দারিদ্র্যসীমার নীচে। কিন্তু তারাও অযৌক্তিক কিছু আঁকড়ে বসে থাকে না।’
দীপা বলল, ‘তোমাদের দেশ সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না। শুধু শুনেছি আফ্রিকার মানুষরা। মানুষের মাংস খেত।’
তিনটে মেয়ে একসঙ্গে চিৎকার করে উঠল। খটমটে নামের মেয়েটি একটু রেগে গিয়ে বলল, ‘তোমার কি আমাদের দেখে ক্যানিবাল বলে মনে হচ্ছে?’
দীপা লজ্জা পেল, ‘আমি বলেছি এমন ঘটনা শুনেছি।’
গ্লোরিয়া বলল, ‘খুব মিথ্যে শোনোনি। একসময় জঙ্গলে এই ধরনের কিছু আদিবাসী ছিল। এখন সেটা ভাবাই যায় না। তা ছাড়া আফ্রিকা একটা বিশাল মহাদেশ। মরোক্কো আলজেরিয়া থেকে সাউথ আফ্রিকার কেপ প্রভিন্স পর্যন্ত গাদা গাদা দেশ। আচার ব্যবহারে জীবনযাত্রায় প্রচুর পার্থক্য। তাই আফ্রিকার মানুষকে তুমি একই চেহারায় ফেলতে পারো না।’
রাত্রে দীপা ওদের সঙ্গে খেতে নামল। সে লক্ষ করল অন্য বাঙালি মেয়েরা তার দিকে অদ্ভুত চোখে তাকাচ্ছে। তিনটে জাম্বিয়ান মেয়ের সঙ্গে তার কী করে ভাব হল এমন প্রশ্ন সবার মনে। একজন মন্তব্য করব, ‘উরিব্বাস, কী কালো, অন্ধকারে খালি গায়ে হেঁটে গেলে বোঝাই যাবে না কেউ যাচ্ছে।’
আর একজন মন্তব্য করল, ‘কালো মেমসাহেবের সঙ্গে একজন ভিড়ে গেছে। বাব্বাঃ, আমি মরে গেলেও ওদের সঙ্গে একঘরে থাকতে পারব না।’
খাওয়ার টেবিলে বসে লুসাকা ঝুঁকে পড়ে দীপাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘ওরা কি আমাদের সম্পর্কে কিছু বলছে?’
দীপা অস্বস্তিতে পড়ল। দূরের মেয়েগুলোর দিকে তাকাল সে। তারপর গলা তুলে জিজ্ঞাসা করল, ‘শোনো, এরা জিজ্ঞাসা করছে তোমরা কি এদের নিয়ে কিছু আলোচনা করছ? কী জবাব দেব বলে দাও।’
দুটো মেয়ে একই সঙ্গে মাথা নামিয়ে খেতে লাগল। দীপা মাথা নাড়ল, ‘না। ওরা কোনও জবাব দিল। না’
ভাত ডাল তরকারি আর মাছ খেতে তিনজনের খুব অসুবিধে হচ্ছিল। হাতে করে খেতে পারবে না বলে চামচ চেয়ে নিল তিনজনেই। কিন্তু খাওয়ার শেষে অর্ধেক খাবারই পড়ে রইল। গ্লোরিয়া বলল, ‘প্রথমবার তো, দিন তিনেকের মধ্যেই এই খাবার অভ্যেস করে ফেলব।’
লুসাকা বলল, ‘আমার গলা পেট জ্বলছে। প্রচুর মশলা। আমাদের সুপারের সঙ্গে কথা বলা উচিত। ওরা তো আমাদের সেদ্ধ খাবার দিতে পারে।’
খটমটে নামের মেয়েটি বলল, ‘না না এখনই নয়। গ্লোরিয়া ঠিকই বলেছে, আগে চেষ্টা করা যাক এই খাবার অভ্যেসে আসে কিনা। না পারলে দেখা যাবে। যখন রোমে এসেছ তখন রোমানদের মতো বিহেভ করো।’
দীপা হেসে ফেলল। লুসাকা জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি হাসছ কেন?’
দীপা জবাব দিল, ‘তা হলে তোমাদের শাড়ি পরতে হয় আর প্রকাশ্যে সিগারেট খাওয়াও চলবে। না’
গ্লোরিয়া হেসে বলল, ‘আমি যেদিন শাড়ি পরব সেদিন সিগারেট খাব না, প্রমিস। শুধু তোমাকে কপি করে যাব সেইদিন।’
শুভরাত্রি জানিয়ে মেয়েরা চলে গেল নিজেদের ঘরে। নিজের টেবিলে বসে দীপা ভাবল বাবাকে প্রথম দিনের ঘটনা জানিয়ে চিঠি লিখবে। হঠাৎ তার চোখ পড়ল গ্লোরিয়ার ওপরে। একটানে ওপরের জামা খুলে বিছানায় ছুড়ে দিয়ে ফ্যানের রেগুলেটার বাড়িয়ে দিল গ্লোরিয়া। হকচকিয়ে গেল দীপা। আজ পর্যন্ত কোনও মেয়েকে নগ্ন শরীরে শুধু ব্রা পরা অবস্থায় দেখেনি সে। ওই অবস্থায় কিছু গোছগাছ করছে। গ্লোরিয়া। দীপা চোখ বন্ধ করল৷ গ্লোরিয়া বলছিল, আমরা ভাবতাম ক্যালকাটাতে বেশ ঠান্ডা পড়ে। একগাদা গরম জামাকাপড় মিছিমিছি বয়ে আনলাম।
দীপা চোখ বন্ধ করল। এটা কি স্বাভাবিক আচরণ? সে কি ওইভাবে দাঁড়াতে পারত? নিজের কাছে উত্তরটা স্পষ্ট কিন্তু তবু তো গ্লোরিয়াকে খারাপ মনে হচ্ছে না। কোনওরকম আড়ষ্টতা নেই, সংকোচ নেই। আচ্ছা, নিজের মনে যদি কোনও পাপবোধ না থাকে তা হলে সেই কাজটা কি অন্যায় নয়?
প্রায় সেমিজের মতো অথচ কাঁধে সরু স্ট্র্যাপের একটা জামা যার প্রান্ত হাঁটু পর্যন্ত পৌঁছেছে, শরীরে জড়িয়ে শুয়ে পড়ল গ্লোরিয়া। বিছানায় মাথা রেখে বলল, ‘তুমি মর্নিং ওয়াক করো?’,
দীপা মাথা নাড়ল, ‘না।’
‘কিন্তু করা উচিত। শরীর ভাল থাকে, মন আরও ভাল হয়ে যায়। তা ছাড়া খুব ভোরে পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষের মন প্যাঁচালো হয় না। যেসব জায়গায় প্রচুর বদনাম আছে, যেখানে দিনেরবেলায় কোনও মেয়ে নিশ্চিন্তে হাঁটতে পারে না, সেখানে সকাল হবার সময়টায় যদি হাঁটো তা হলে ঝামেলা হবে না। কারণ বদমায়েশি করার জন্য মানুষের মন তখনও তৈরি হয় না। আমার ভোরে ওঠার অভ্যেস আছে। তোমাকে ডাকব?’
‘ডেকো।’ দীপা বড় আলো নিবিয়ে টেবিল ল্যাম্প জ্বালল।
গ্লোরিয়া জিজ্ঞাসা করল, ‘কী লিখছ তুমি?’
‘চিঠি।’
‘বয়ফ্রেন্ডকে?’
দীপা হাসল, ‘আমার বাবাকে।’
‘বাবা?’ শব্দটি মৃদু স্বরে উচ্চারণ করল গ্লোরিয়া, ‘তোমার বাবাকে খুব ভালবাসো তুমি?’ প্রশ্ন কানে যেতে দীপা মুখ ফিরিয়ে দেখল। টেবিল ল্যাম্পের আলো ঘরের ওদিকে যাচ্ছে না। প্রায়ান্ধকারে মিশে। আছে গ্লোরিয়া বিছানায়। চট করে জবাব দিতে পারল না দীপা। সে কি অমরনাথকে ভালবাসে? ভালবাসা কাকে বলে? সে যেদিন স্কুল ফাইনাল পাশ করেছিল সেদিন চা বাগানের স্কুলের মাঠে। অমরনাথ অনেক ছেলেমেয়ে মাস্টারমশাইদের সামনে তাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠেছিলেন। কেন! যে-অমরনাথ প্রায় ঘাড় থেকে নামানোর জন্যে বালিকা অবস্থায় তার বিয়ে দিয়েছিলেন তিনি কেন কাদবেন? তার রুচি এবং মনের গড়ন বুঝেও প্রতুলবাবুর হাত থেকে তার জন্যেই টাকা নিতে যে-লোকটা দ্বিধা করেনি, ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে যাওয়ার পর যার সঙ্গে সে কথা বন্ধ করে দিয়েছিল, নিজের অসুস্থ অবস্থাতেও সেই একই তোক কেন ব্যাঙ্ককে নির্দেশ দেবে কলকাতার হস্টেলের ঠিকানায় টাকা পাঠাতে? অমরনাথের জন্যে মন কেমন করে উঠল। একেই কি ভালবাসা বলে? না। অবশ্যই নয়। চোখের সামনে কোনও মানুষ দুর্ঘটনায় মারা গেলে মনে ব্যথা জমে, সেখানে ভালবাসা কোথায়? সত্যি, ভালবাসা কারে কয়! দীপা মাথা নাড়ল, ‘আমি জানি না। আমি এও জানি না ভালবাসা কাকে বলে?’
গ্লোরিয়া মাথা তুলল, ‘অদ্ভুত! তুমি বলতে চাইছ এই বয়স পর্যন্ত কোনও ছেলেকে তুমি ভালবাসোনি? তোমার কোনও বয়ফ্রেন্ড নেই?’
দীপা মাথা নাড়ল, ‘না।’
‘অসম্ভব! তোমার মতো সুন্দর দেখতে মেয়ে সম্পর্কে ছেলেরা উদাসীন থাকতে পারেই না। দীপাবলী, তুমি আমার কাছে সত্যি বলছ না।’
‘গ্লোরিয়া, আমাদের দেশে বিয়ের আগে কোনও ছেলেমেয়ের বন্ধুত্ব এখনও প্রকাশ্যে স্বীকৃতি পায়।না কোনও অভিভাবক এটা করতে অনুমতি দেন না। আমি বললাম বন্ধুত্ব, আর তার বেশি এগিয়ে যেতে চাইলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে হয়।’
গ্লোরিয়া উঠে বসল, ‘আমি তোমার কথা বুঝতে পারছি না। ভালবাসতে হলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে হবে? কীরকম সংখ্যায় এমন ঘটনা ঘটে?’
‘দশ হাজারে একজন মেয়ে সাহসী হলেও হতে পারে।’
‘কিন্তু কেন?’
‘আমাদের এখানে মেয়েরা বিয়ে করে না, তাদের বিয়ে দেওয়া হয়।’
‘তার মানে তোমরা মন থেকে শরীরে পৌঁছাও না, একটা অজানা অচেনা লোকের সঙ্গে প্রথমেই শরীরের সম্পর্ক তৈরি করে মনে পৌঁছাতে চাও। তা সম্ভব?’
‘এও আমি জানি না। সারাজীবন পাশাপাশি থেকেও হয়তো হুকুম মেনে চলাটাই এ-দেশের বিবাহিত মেয়েরা দাম্পত্য জীবনযাপন করা বলে মনে করে।’
গ্লোরিয়া ধীরে ধীরে শুয়ে পড়ল। দীপা আবার ঘুরে বসল। কলম খুলে সে লেখা শুরু করল, ‘শ্রীচরণেষু বাবা, তোমার শরীর এখনও ভাল হয়নি বলে মামা বললেন। তুমি নিশ্চয়ই যত্নে আছ কিন্তু চিন্তাভাবনা করলে শুধু যত্নে শরীর সারবে না। আমার মনে হয় তুমি আমার জন্যেও চিন্তা করো। আমি বলি কী, আমি এখন অনেক বড় হয়েছি, আমার জন্যে দুশ্চিন্তা করার কোনও কারণ নেই।
‘আমি স্কটিশচার্চ কলেজে ভরতি হয়েছি তা তুমি জানো। আমার হস্টেলের নাম ঠিকানা পেছনে দিলাম। মামাই সব ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। আজ এখানে আমার প্রথম রাত। আমার রুমমেট হিসেবে আছে আফ্রিকা মহাদেশের জাম্বিয়া বলে একটি দেশের মেয়ে। আমরা যাকে নিগ্রো বলি এ তাই। কিন্তু এত পরিষ্কার কথা এবং আচরণ যে আমি মুগ্ধ হয়ে গেছি। ওর গায়ের রং গাঢ় তামাটে, কথা বলে ইংরেজিতে। আমরা যেভাবে ইংরেজি বলতে এ-দেশে শুনেছি তা থেকে একটু আলাদা। একদম অজানা দেশের কোনও মানুষের সঙ্গে এক ঘরে রাত কাটানোর অভিজ্ঞতা আমার এই প্রথম, তুমি জাননা। কিন্তু অন্য মেয়েরা একে এড়িয়ে চললেও আমার শুধু কৌতূহল হচ্ছে। ক্লাস শুরু হবে আগামীকাল। তুমি ভেবো না, আমি মন দিয়ে পড়াশুনা করব। মাকে আমার প্রণাম ভাইদের স্নেহ আর তোমাকে আমার—।’ দীপা কলম তুলল। ভক্তিপূর্ণ প্রণাম শব্দদুটি অভ্যেসে এসে যাচ্ছিল। সে গ্লোরিয়ার দিকে তাকাল। গ্লোরিয়া এখন চুপচাপ। হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে। ও জিজ্ঞাসা করেছিল বাবাকে ভালবাসে কিনা। ভক্তিপূর্ণ প্রণামে কি ভালবাসা থাকে? দীপা ঠোঁট কামড়াল।
গত বছর থেকে আফ্রিকার কিছু দেশের সঙ্গে ভারতবর্ষের সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান প্রকল্পমতো ছেলেমেয়েরা এখানে পড়তে আসছে। সংখ্যায় তারা খুব অল্প এবং তাদের মেলামেশার চৌহদ্দিটা খুবই সীমিত। গ্লোরিয়া তাদের ব্যতিক্রম। দীপা লক্ষ করছিল ওর মধ্যে কেমন একটা একরোখা ভঙ্গি আছে? কেন নয়? এই প্রশ্নটা শুধু মুখে বলে ক্ষান্ত হয় না, শরীরের ভঙ্গিতেও ফুটে ওঠে। প্রথমদিন ভোের চারটের সময় ঘুম ভাঙিয়েছিল সে দীপার। একমাত্র পরীক্ষার আগে ছাড়া ওই সময়ে চোখ মেলার অভ্যেস নেই। কিন্তু মেনে নিয়েছিল সে। শাড়ি পালটে চুল আঁচড়ে বেরোবার জন্যে তৈরি হতেই দেখতে পেল গ্লোরিয়া কেড্স শর্টস আর জামা পরে তৈরি। সে আঁতকে উঠেছিল, এম্মা!’ গ্লোরিয়া অবাক হয়ে একান্ত বাঙালি শব্দটি শুনে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘ওটার মানে কী?’
‘তুমি কি ওই হাফপ্যান্ট পরে বাইরে বেরুবে?’
‘হাফপ্যান্ট? এটা তো শর্টস। জগিং কিংবা দৌড়োবার সময় সারা পৃথিবীর মেয়েরা পরে থাকে। তোমার নেই?
‘না। কিন্তু সবাই তোমার পায়ের দিকে তাকিয়ে থাকবে।’
‘থাকুক। মাই লেগস আর নট ব্যাড।’
সত্যি, এত ভাল পা দীপা কখনও দেখেনি। অবশ্য এ-দেশে বাঙালি মেয়েদের পা বারো বছরের পর দেখা সম্ভবও নয়। সে নিজের পা বাথরুমের বাইরে কোনওদিন দেখেছে কি? আর বাথরুমের ভেতরেও পা দেখার কথা কখনও খেয়ালে থাকে? কিন্তু গ্লোরিয়ার পায়ের গড়ন এত চমৎকার, একটুও মেদ নেই, দীর্ঘ পা দুটি যেখানে যেমন হওয়া উচিত, মা কালীর পা থেকেও সুন্দর। দীপা ভেবেছিল বলে, তুমি ঠিক করেছিলে রোমে থাকতে হলে রোমানদের মতো আচরণ করা উচিত। অতএব ওই বস্তুটি খুলে। পায়ের পাতা ঢাকা প্যান্ট পরে বের হও। কিন্তু সে কিছু বলেনি। এখন এই সময়ে রাস্তায় নিশ্চয়ই মানুষ নেই। গ্লোরিয়া যদি এতে স্বস্তি পায় পাক না।
মুশকিল হয়েছিল হস্টেলের মেইন গেট নিয়ে। সেটি তালা মারা। সাধারণত আলো ফুটলে দারোয়ান চাবি বের করে। গ্লোরিয়া তালা দেখে জিজ্ঞাসা করল, ‘গেটকিপার কোথায়? তাকে ডাকতে হবে।’
দীপা একটা ঝামেলার গন্ধ পেল। সাড়ে চারটের সময় বেচারার ঘুম ভাঙালে সুপারের কাছে। অভিযোগ পৌঁছাতে পারে। সে ডাকাডাকি করতে নিষেধ করল। গ্লোরিয়া জিজ্ঞাসা করল, ‘কেন? আমরা কি গেট টপকে বাইরে যাব? মর্নিং ওয়াক করার রাইট আমাদের থাকবে না কেন?’
দারোয়ানের দরজায় ধাক্কা দিয়ে সে ঘুম ভাঙিয়েছিল লোকটার। এমন অদ্ভুত পোশাকের মহিলার দর্শন পেয়ে লোকটা হতভম্ব। গ্লোরিয়া যা বলছে তা তার মাথায় ঢুকছে না। দীপা একটু পিছিয়ে ছিল। এবার এগিয়ে গিয়ে বুঝিয়ে বলল ব্যাপারটা।
লোকটা বলল, ‘রাত ন’টার পর সুপারের পার্মিশন ছাড়া দরজা খোলা নিষেধ?’
দীপা বলল, ‘ঠিক। কিন্তু এখন আর রাত কোথায়? দিন তো ফুটল বলে। আর এই মেমসাহেবের সকালবেলায় না হাঁটলে শরীর খারাপ হয়।’
কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে লোকটা দরজার তালা খুলেছিল। দীপা লক্ষ করেছিল তারা বাইরে বেরিয়ে আসামাত্র সে আবার তালা দিয়ে ভেতরে চলে গেল। এখনও অন্ধকার ফিকে হয়ে মাখামাখি কলকাতার শরীরে। গ্লোরিয়ার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারছিল না দীপা। একেই সে অনেক লম্বা, তারপর ক্ষিপ্র পায়ে চটপট এগিয়ে যাচ্ছিল হাঁটার ভঙ্গিতেই। হেদুয়ার মুখে পৌছেই সে চিৎকার করে উঠল, আঃ দারুণ! ওর ভেতরে দৌড়ানো যাবে।’
দীপা দেখল ওই সময়েও কিছু বৃদ্ধ প্রাতভ্রমণ করতে এসে হতভম্ব ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে পড়েছেন গ্লোরিয়াকে দেখে। গ্লোরিয়া তখন কোমরে হাত রেখে একই জায়গায় সোজা হয়ে লাফাচ্ছে। কুড়িবার লাফিয়ে গ্লোরিয়া থামল, ‘চলো দৌড়াই।’
দীপা হাত নাড়ল, ‘না বাবা এই শাড়ি পরে দৌড়োতে পারব না।’
‘তুমি কালকে শর্টস পরবে। আমার কাছে একটা নতুন আছে।’
দীপা মনে মনে বলল, ‘পাগল।’
ওরা হেদুয়ার ভেতরে ঢুকে পড়ল। পেছন পেছন বৃদ্ধরাও আসছেন। তাঁদের সংখ্যা এখন বেড়েছে।
গ্লোরিয়া বলল, ‘তুমি জোরে হাঁটো, আমি দৌড়াই।’ বলেই সে দৌড়োতে লাগল। এখন অন্ধকার যাব যাব করছে। গ্লোরিয়ার শরীরটা একটা কালো চিতার মতো ক্ষিপ্র ভঙ্গিতে এগিয়ে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে হেদুয়ায় বেড়াতে আসা কিছু মানুষ থমকে ওর ছোটা দেখতে আরম্ভ করল।
একা হাঁটতে আরম্ভ করতেই দীপার বেশ ভাল লাগল। অল্প হাওয়া বইছে। আকাশটা পরিষ্কার হচ্ছে। অনেক অনেক আগে চা-বাগানের এমন ভোরে সে বিছানা ছেড়ে উঠে শিউলি ফুল কুড়োতে ছুটে যেত। তখন কি আকাশ আরও উজ্জ্বল, আরও নীল থাকত! বয়সের সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতিও কি ঔজ্জ্বল্য হারায়। হঠাৎ পেছন থেকে গ্লোরিয়ার গলা ভেসে এল, ‘হ্যারি আপ গার্ল, এক রাউন্ড কমপ্লিট।’ পাশ কাটিয়ে সে ছুটে গেল আবার। একটু একটু করে শরীরে ঝরঝরে ভাব এল দীপার। মন ভাল।
দু’বার পাক খেয়ে দীপার পাশে এসে দাঁড়াল গ্লোরিয়া। এর মধ্যে বেশ ঘেমে গেছে সে। হেদুয়ায় সাঁতার কাটতে ক্লাব মেম্বাররা চলে এসেছে। সেদিকে তাকিয়ে গ্লোরিয়া বলল, কম আনলে একটু সাঁতার কাটা যেত।’
দীপা বলল, ‘রক্ষে করো। তোমার এই পোশাক দেখার জন্যেই পেছনে দর্শক জমে গিয়েছে।’ গ্লোরিয়া পেছনে ফিরে লোকগুলোকে দেখল। তারপর হাসল, এদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই। কারণ এদের দাত নেই নখ নেই শুধু চোখ আছে। আমাকে কেউ যদি চোখ দিয়ে রেপ করে খুশি হয় আমি শুধু তাকে করুণা করতে পারি, তার বেশি কিছু না। পুরুষমানুষ যে কত খারাপ হতে পারে তা আমার চেয়ে বেশি কেউ জানে না দীপাবলী।’
কলেজে মায়ার সঙ্গে চমৎকার সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেল দীপার। এত অকপট কথাবার্তা, খামোকা লজ্জা না টেনে আনা, ছেলেদের সঙ্গে প্রকাশ্যে তুই তোকারি করে নিজের মতামত জানিয়ে দেওয়াও—ও যেন পঞ্চাশ দশকের বাঙালি মেয়ে নয়। মায়া বলছিল, ‘আমাদের দেশের মেয়েরা এককালে স্বাধীনতা সংগ্রাম করেছে। মাতঙ্গিনী হাজরা, প্রীতিলতা ওয়াদ্দার, এমন কত মহিলা। কিন্তু এখন চারপাশে তাকালে কেউ কি সেকথা বিশ্বাস করবে?’
দীপা জবাব দিয়েছিল, ‘যেসব ছেলে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আড্ডা মারে, মেয়েদের সিটি দেয়, যেসব লোক ব্যাগ হাতে করে অফিসে কেরানিগিরি করতে যায় অথবা যে-বাঙালিরা টাকা রোজগারের ধান্দায় ছুটে বেড়াচ্ছে তাদের দেখে কেউ কি বলবে একজন সুভাষচন্দ্র এদের মধ্যে থেকেই উঠে এসেছিলেন?’
‘ওয়েল সেইড।’ মায়া ওর হাত চেপে ধরেছিল, ‘আমি একচোখা হয়ে গিয়েছিলাম। আচ্ছা দীপা, তোমার এ-দেশের রাজনীতি সম্পর্কে কী ধারণা।’
‘কোনও ধারণা নেই।’
‘তুমি কমিউনিজম নিয়ে পড়াশুনা করেছ কখনও?’
‘না। সেই সুযোগ পাইনি।’
‘পড়তে চাও?’
‘আপত্তি নেই।’
‘আমি তোমাকে পড়তে দেব। আমি বিশ্বাস করি ভারতবর্ষের মানুষের স্বাধীনতা উনিশশো সাতচল্লিশের পনেরোই আগস্ট হয়নি। একমাত্র কমিউনিজমের আদর্শ এ-দেশে প্রতিষ্ঠা হলেই মানুষের প্রকৃত স্বাধীনতা আসবে।’
‘কমিউনিস্টরা দেশকে স্বাধীন করবে?
‘মানুষকে। তুমি আমাদের ইউনিয়ন অফিসে এসো না।’
‘না মায়া, আমি রাজনীতিতে জড়াতে চাই না।’
‘কিন্তু রাজনীতি ছাড়া কোনও আধুনিক মানুষ বাঁচতে পারে না। ধরো, তুমি কোনও সৃষ্টি করতে চলেছ এবং তার জন্যে তোমার একটা অনুকূল পরিবেশ পাওয়া দরকার। স্বার্থান্বেষী কোনও দল ক্ষমতায় থেকে সেই পরিবেশ তৈরি করতে দিচ্ছে না। তোমার সক্রিয় সমর্থনে কমিউনিজম সেই। পরিবেশ এনে দিতে পারে। অর্থাৎ মানুষ তার অধিকার অর্জন করতে পারে কমিউনিজমের মাধ্যমেই।’
‘এ নিয়ে তর্ক করা যায়। আমি কমিউনিজমবিরোধী নই। তবে এ-দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করেছিল মহাত্মা গান্ধীকে। কারণ কমিউনিজমে বিশ্বাসীরা এ-দেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে তেমন অংশ নেয়নি। কংগ্রেস খারাপ ভাবলে মানুষ তখন তার ডাকে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসত না। মানুষ ভেবেছিল তাদের মুক্তি আসবে কংগ্রেসের মাধ্যমেই। রাজনীতি বড় গোলমেলে জিনিস, আমার এ নিয়ে ভাবতে ভাল লাগে না। বরং মেয়ে হয়ে জন্মেছি বলেই আমার অনেক কিছু নিয়ে ভাবার আছে।’
‘যেমন?’ মায়া উৎসুক হল।
‘আমরা এমন কিছু সংস্কার বা ধারণা নিয়ে যুগ যুগ ধরে জীবনযাপন করছি যার পেছনে কোনও যুক্তি নেই। আমি মফস্লের মেয়ে সেখানকার পরিবেশে অনেক কিছু করা এখনও সম্ভব নয়। কিন্তু কলকাতার মতো বড় শহরে সেটা কেন মানা হবে? এখানে তো কেউ কাউকে চেনে না, তা হলে লোকলজ্জা বাধা হয়ে দাঁড়াবে কেন?’
‘তুমি কী ব্যাপারে কথা বলছ দীপাবলী?’
‘মেয়েদের জীবনযাত্রা নিয়ে। কয়েকজন অভিভাবক প্রিন্সিপ্যালের কাছে অভিযোগ করলেন তাঁদের মেয়েদের বিরক্ত করা হয়েছে। প্রিন্সিপ্যাল সেই মেয়েদের ডেকে জানতে চাইলেন না কেন? তোমরা আবার সেইসব মেয়ের খোঁজ করতে এলে ইউনিয়ন থেকে। আর সবকিছুর ফল হল কয়েকজনের বিয়ে হয়ে গেল।’
‘বিয়ে যেমন হল তেমনি কয়েকজন অভিভাবক ছাড়াই কলেজে আসার স্বাধীনতা পেল! পেল না? ইউনিয়ন থেকে আমরা কী করতে পারতাম?’
‘কিছু না। অবহেলা করতে পারতে। কলেজে ছেলেমেয়েরা যে বেলেল্লাপনা করতে আসে না, একটা ছেলের সঙ্গে দুটো কথা বললে যে চরিত্র নষ্ট হয়ে যায় না, এই বোধ অভিভাবকদের মনে সঞ্চারিত হবার আগে মেয়েদের মনে সেটা ঢোকানো উচিত। জানো, আমার রুমমেট গ্লোরিয়া জাম্বিয়ার মেয়ে—।’
‘গ্লোরিয়াকে আমি চিনি। কলেজ স্পোর্টসে নাম দিয়েছে।’
‘আমাদের জীবনের এইসব গল্প আর সমস্যা শুনে ও হতভম্ব হয়ে যায়। ব্যাপারটা যেন ওর মাথায় ঢুকতেই চায় না। কেউ এসে যদি আমাদের বলে সূর্য পৃথিবীর চারপাশে ঘুরছে তা হলে তাকে যা মনে হবে ওরও যেন এইসব কথা শুনে তাই মনে হচ্ছে। অথচ জাম্বিয়া মোটেইউন্নত দেশ নয়। বিলেত ফ্রান্স নয়। ওদের দেশেও গরিব মানুষের সংখ্যা খুব বেশি। কিন্তু মোটা দাগের কতগুলো ব্যাপার ওরা ঝেড়ে ফেলেছে অনেকদিন।’
মায়া চুপচাপ দীপার কথা শুনছিল। এবার সে ঘড়ি দেখল, ‘তুমি এখন কী করছ।’
‘হস্টেলে ফিরে যাব। কিছু তো করার নেই।’
‘তা হলে আমার সঙ্গে চলো। আটটার মধ্যে ফিরে আসবে।’
‘রাজনীতির মধ্যে আমাকে টানবে না।’
‘আরে না না। আমি তোমাকে বুঝে গিয়েছি।’
দীপা হেসে ফেলল। সে নিজেকেই এখনও বুঝতে পারল না আর মায়া তাকে এত অল্প দেখে বুঝে গেল! কিন্তু মুখে কিছু বলল না।
হেদুয়ার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় উলটো ফুট থেকে ডাক ভেসে এল, ‘এই মায়া।’
দীপা দেখল দু’জন দাড়িয়ে আছে। একজনের পরনে পাজামা পাঞ্জাবি, গালে দাড়ি, কাঁধে কাপড়ের ব্যাগ। মায়া ওকে ইশারা করে রাস্তা পার হল।
‘কী ব্যাপার? তুমি এখানে?’
দাড়িওয়ালা ছেলেটি বলল, ‘সুজয়ের কাছে এসেছিলাম। চা খাবে?’
‘না। এর নাম দীপাবলী, আমাদের কলেজে এসেছে জলপাইগুড়ি থেকে, ওকে নিয়ে একবার বাড়িতে যাব। দীপা, আলাপ করিয়ে দিচ্ছি, শমিত, মণি কলেজে পড়ে। দারুণ নাটক করে। আমাদের একটা গ্রুপ আছে, মানে গ্রুপটা নতুন ফর্ম করেছি, সুজয়ের লেখা নাটক শমিত পরিচালনা করছে।’
সুজয় ছেলেটি ছিমছাম, বলল, ‘একটু ভুল হল, আমি একটি বিদেশি নাটকের ভাবানুবাদ করেছিলাম, শমিত মেজেঘষে তার চেহারা পালটে দিয়েছে।’
শমিত একদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ দীপার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘একদিন আসুন না, আমাদের গ্রুপে। বুড়োহাবড়া কেউ নেই, ভাল লাগবে।’
দীপা হাসল শুধু। এরই মধ্যে পথচারীরা ঘুরে ঘুরে তাদের দেখে যাচ্ছে। মায়া ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে হাঁটা শুরু করল। দীপা জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি ছেলেদের সঙ্গে নাটক করো নাকি?’
‘হ্যাঁ। নাটক আমার সেকেন্ড লাভ। ফার্স্ট লাভ অবশ্যই রাজনীতি।’
‘বাড়িতে কিছু বলে না?’
‘কে বলবে? মা আর আমি, মা আমার বন্ধু।’
‘আত্মীয়স্বজন?’
‘আই ডোন্ট কেয়ার।’
‘তুমি কি নাটক করে টাকা পাও?’
‘দুর। আমরা যে-থিয়েটার করছি তাতে ঘর থেকে পয়সা ঢালতে হয়। এ কি আর বোর্ডের নাটক! কিন্তু আমরা ভাল নাটক করতে চাই। শিল্পের জন্যে জীবন। এ-দেশের মানুষের রুচি নষ্ট হয়ে গিয়েছে একগাদা বাজে নাটক দেখে দেখে। আমরা এমন নাটক করতে চাই যাতে সততা থাকবে, যা দেখার পর মানুষ ভাববে। এই যে শমিতকে দেখলে, ওর প্রাণশক্তি খুব বেশি। ওর কাছে থাকলে একটা আলাদা উৎসাহ আপনা আপনি তৈরি হয়ে যায়।’
‘তার মানে তোমরা রাজনৈতিক নাটক করো?’
‘না হে। মানুষের নাটক। মানুষের কথা।’
একটা পুরনো বাড়িতে ওরা ঢুকল। বাড়িটির শরীর থেকে প্লাস্টার খসে খসে পড়ছে। বোঝাই যায় অনেকগুলো পরিবার এখানে বাস করছে। মায়া হেসে বলল, ‘দেড়শো বছরের বাড়ি, এরও বোধহয় আমাকে সহ্য হচ্ছে না, গা থেকে চুনবালি খসিয়ে ফেলছে।’
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন