সমরেশ মজুমদার
সারাটা সকাল একা এই ঘরে, দুপুর এখন খানখান।
দীপার কাছে কেউ আসেনি। এমনকী মুখ ধুতে অথবা বাথরুমে পৌঁছে দিতেও না। পুরো বাড়িটাই যেন মূক হয়ে রয়েছে সেই সকাল থেকে যখন অতুলচন্দ্রকে ওরা হাসপাতালে নিয়ে গেল। ঘরের এক কোণে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল দীপা। প্রথমে প্রতুলবাবু ছুটে এসেছিলেন। আর সেইসময় অতুলচন্দ্র কথা বন্ধ করেছিল। গায়ে হাত দিয়ে চমকে উঠে চোখ ঘুরিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘কখন থেকে এমন হয়েছে?’
নলিনী ঠেস দিয়ে বলেছিলেন, ‘উনি তো ঘুমে কাদা, খেয়াল করলে তো?’
‘তোমার সঙ্গে শেষ কখন কথা বলেছিল?’ বাজখাঁই গলায় ঘর কেঁপে উঠল।
অজান্তেই গলা থেকে স্বর বেরিয়ে এসেছিল, ‘রাত্রে।’
নলিনী বললেন, ‘শরীরের সুখ নিলেই হয় না ছুঁড়ি। যার কাছ থেকে নিলি তার শরীরটাকেও যত্নে রাখতে হয়। এখন কী হবে গো? ডাক্তার এল না এখনও!’
প্রতুলবাবু আনাকে বলেছিলেন, ‘চটপট কিছু একটা পরিয়ে দাও। হাসপাতালে নিয়ে যাব।’
ওরা ওকে হাসপাতালে নিয়ে গেল। বোধহয় এই প্রথম নলিনীও আনাকে সঙ্গে নিয়ে হাসপাতালে গেলেন এক মাথা ঘোমটা দিয়ে। যাওয়ার আগে কেউ ডাকেনি দীপাকে। তারপর থেকে কেউ আসেওনি এ-ঘরে। বাসিমুখ, বাথরুমের জন্য ভার হয়ে যাওয়া শরীর আর সেইসঙ্গে খিদে বোধ হওয়া এবং মিলিয়ে যাওয়া, এই নিয়ে চুপচাপ বসে ছিল দীপা। সে বুঝতে পারছিল না অতুলচন্দ্রকে নিয়ে যাওয়ার সময় ওঁরা ওর দিকে অমন জ্বলন্ত চোখে তাকাচ্ছিলেন কেন। অতুলচন্দ্র কি মারা যাবে? মরে গেলে তাকে বিধবা হতে হবে। বিধবা হবার পর ওঁরা তাকে এ-বাড়িতে রাখবেন? নাকি চা-বাগানে পাঠিয়ে দেবেন? সিদ্ধান্তটি সে আন্দাজ করতে পারছিল না।
খাটের অবস্থা একই আছে। কেউ বিছানা তোলেনি। দীপার একবার মনে হয়েছিল কিন্তু সাহস পায়নি। শুধু ফুলের পাপড়িগুলো শুকিয়ে গেছে। শরীরের চাপে সেগুলোর অবস্থা খুব করুণ। সে খুঁটে খুটে সবকটাকে এক জায়গায় জমা করে রাখল। বিশ্রী দেখাচ্ছে ওগুলোকে। চোখের আড়াল করার জন্যেই সে একটা বালিশ চাপিয়ে রাখল ওপরে। এইসময় গাড়ির আওয়াজ হল। আর তার কিছুক্ষণ বাদেই প্রতুলবাবু ঘরে ঢুকলেন, ‘ডাক্তাররা বলে দিল তোমার স্বামীর বাঁচার সম্ভাবনা নেই। কথাটা তুমি বুঝতে পারছ?’
দীপা মুখ নিচু করল। প্রতুলবাবু বললেন, ‘গতরাত্রে খোকার সঙ্গে তোমার শারীরিক সম্পর্ক হয়েছিল কিনা জবাব দাও।’
দীপার মুখ বুকে ঠেকল। প্রতুলবাবু আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন এইসময় আনার গলা পাওয়া গেল, ‘এখন ওসব বলে কী হবে? কত করে বললাম একটু বড়সড় মেয়ে আনতে যার নিজেরই তাগিদ আছে। তা না, একটা কুঁড়িকে তুলে আনল। বাড়িতে একটা গৌরী ঘুরে বেড়াবে আবার সে পেটে বাচ্চাও ধরবে। এখন যা হবার হয়ে গিয়েছে। ওদিকে ওনার আবার দাঁতকপাটি লেগেছে।’
প্রতুলবাবু জুতোয় শব্দ করে অন্য ঘরে চলে যেতে আনা জিজ্ঞাসা করল, ‘বাথরুম হয়েছে?’ দীপা মাথা নাড়ল, না। আনা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ, তারপর বলল, ‘এসো।’ পাশের ঘরে নলিনী ডুকরে ডুকরে কাঁদছেন। আনা বাথরুম দেখিয়ে দিল। সহজ হয়ে ফিরে আসার সময় শুনল সে নলিনী কাঁদতে কাঁদতে বলছেন, ‘তুমি ছেলেটাকে মেরে ফেললে। এত তাড়াতাড়ি ও মরত না। তুমি একটা রাক্ষুসির কাছে জোর করে ওকে ঠেলে দিলে! আমি কী নিয়ে থাকব। আমার যে কোনওদিন ছেলে হবে না। ও মা গো !’
ঘরে ফিরে আনা বলল, ‘চটপট ওই জামাকাপড় খোলো। এইসময় অত সাজগোজ করে কেউ থাকে না। আটপৌরে জামাকাপড় তো ওই সুটকেসে আছে।’ কথা শেষ করে নিজেই সে সুটকেস খুলে জামা শাড়ি বের করল, ‘শাড়ি পরিয়ে না দিলে তো ভাল করে পরতেও পারো না। সকালে দেখেই সন্দেহ হয়েছিল আমার। খোকাকে বলেছিলাম শাড়ি খুলে নিবি। খুলে নিলে অত মজবুত করে পরা থাকে কী করে।’ ঝটপট শাড়ি খুলে আটপৌরে শাড়ি পরিয়ে দিল আনা। তারপর বলল, ‘জামাটা নিজে পরে নাও। একবার চোখেও দেখল না শরীর ডাঁটো হয়েছে কিনা ঝট করে বিয়ে দিয়ে নিয়ে এল। শোনো আশা, আজ আর খাবারের নাম মুখেও নিয়ো না। তিনি খাবি খাচ্ছেন হাসপাতালে আর তুমি ভাতমাছ খাচ্ছ এটা কেউ ভাল চোখে দেখবে না। তা ছাড়া আমার মনে হচ্ছে এ-বাড়ি থেকে তোমার ভাত উঠল বলে।’ আনা দরজার দিকে এগিয়ে গেল।
তখনই জুতোর শব্দ উঠল। প্রতুলবাবু এলেন, ‘ভাল করে জিজ্ঞাসা করেছ? ডাক্তার কিন্তু অন্য রিপোর্ট দিয়েছে। ওর শাশুড়ি সকালে যা বলেছে তা ঠিক নয়। তুমি যাচাই করো। আমার হাতে বেশি সময় নেই। যেমন করেই হোক আমি উত্তরাধিকারী চাই।’ প্রতুলবাবু একটু থেমে বললেন, আমি আবার হাসপাতালে চললাম আনা। সন্ধের পর ফিরব।’
জুতোর শব্দ মিলিয়ে গেল। গাড়ি বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে। আনা মুখে আঁচল দিয়ে দাঁড়িয়েছিল। সেই অবস্থায় বলল, ‘তোমার মাকে আমি সাবধান করে দিয়েছিলাম, কথাটা তিনি কানেই নিলেন না। নিজের মেয়ে হলে ঠিক নিতেন।’
এইসময় আলুথালু অবস্থায় নলিনী এসে দাঁড়ালেন, ‘আনা, ওকে বুঝিয়ে দে কী সর্বনাশ হতে যাচ্ছে ওর। ওর মুখে চোখে তার কোনও ছাপ নেই রে।’
‘বুঝতেই পারছে না বেচারা।’
‘বুঝতে পারছে না? হুম। রাত্রে বুঝেছিল কী করে?’
‘রাত্রে কিছুই বোঝেনি।’ ঠান্ডা গলায় জানিয়ে দিল আনা।
‘আঁ?’ চোখ বড় হয়ে গেল নলিনীর।
‘ও এখনও কুমারী আছে।’
টলতে টলতে ছেলের ফুলশয্যার বিছানায় বসে পড়লেন নলিনী। আনা বলল, ‘খোকা এখনও বেঁচে আছে। তিনি বলে গেলেন উত্তরাধিকারী চাই। তোমার কী মত?’
নলিনী মুখে কাপড় চাপা দিয়ে কেঁদে উঠলেন। আনা বলল, ‘যা বলার তা চটপট বলে ফেলো। মতলব একটা কিছু করতে হবে।’
‘তুই বল। আমার মাথায় কিছু ঢুকছে না।’ ফ্যাসফেসে গলায় বললেন নলিনী।
‘মেয়েটাকে ওর বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দাও। এক্ষুনি।’
‘সেকী? উনি জানলে, মানে ওঁকে না বলে— ।’
‘উনি জানলে অন্তত আজ রাত্রে পাঠাতে দেবেন না। মেয়েটার এত বড় সর্বনাশ করবে?‘
‘সর্বনাশ?
‘সর্বনাশ নয়? খোকার পরে তোমার গর্ভ নষ্ট হয়েছিল। আর কোনওদিন পারোনি মা হতে। কিন্তু আমি তো তোমার মুখ চেয়ে নিজের সর্বনাশ সহ্য করে গেছি এতদিন। আজ তাই মুখ খুলছি। তুমি মুখ বন্ধ করে থাকবে?’ আনাকে হঠাৎ খুব উত্তেজিত দেখাচ্ছিল। তার দিকে তাকিয়ে নলিনী বললেন, ‘বেশ। তাই কর।’
সুটকেসটা এক হাতে তুলে নিয়ে দীপার হাত ধরে টেনে ভেতরের বারান্দায় নিয়ে এল আনা। কিছু লোক এপাশে ওপাশে কাজ করছে। বারান্দা থেকে এপাশে সরে এল আনা। তার হাতের মুঠো দীপাকে ছাড়েনি। এদিকটায় বড় বড় নারকেল সুপারির গাছ। তার ভেতর দিয়ে সে প্রায় ছুটে চলল দীপাকে নিয়ে। ঘুরে ঘুরে পেছনের একটা ছোট দরজা খুলে সে পাঁচিলের বাইরে চলে এল। এপাশ ওপাশ দেখে বলল, ‘তুমি একা বাপের বাড়িতে যেতে পারবে?’
কিছু না বুঝেই দীপা মাথা নাড়ল, হ্যাঁ। আনা তার মুখের দিকে তাকাল। তারপর হাত নেড়ে দূরে দাঁড়ানো একটা রিকশাকে ডেকে জামার ভেতর থেকে একটা দু’টাকার নোট বের করে দীপার হাতে দিল, ‘এই নাও গাড়িভাড়া। এই রিকশাওয়ালা, জলদি একে ঘাটে নিয়ে যাও। ওঠো। বাড়িতে গিয়ে যা দেখলে সব বোলো। যাও।’
রিকশায় উঠে পেছন দিকে যখন তাকাল দীপা তখন ছোট দরজাটা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। আনা নেই। তিন চাকার রিকশায় আড়ষ্ট হয়ে বসে হঠাৎ দীপার সমস্ত শরীরে কাঁটা দিল। কোনওদিন সে একা যাওয়া আসা করেনি। কবে শেষ জলপাইগুড়িতে এসেছিল তাও তার মনে নেই। যদি সে হারিয়ে যায়? শহরে নাকি আজেবাজে লোক থাকে অনেক, তারা যদি তাকে ধরে নিয়ে যায় তা হলে কোনওদিন কাউকে দেখতে পাবে না। সে কিছুতেই বুঝতে পারছিল না আনা কেন তাকে এভাবে বাড়ি থেকে বের করে দিল। কেন নলিনীও তাতে সম্মতি দিলেন। সে সুটকেসটা সিটের পাশে চেপে ধরে কাঁটা হয়ে বসে রইল যতক্ষণ না রিকশাওয়ালা বলল, ‘দিদি, ঘাট আ গিয়া।’ কখন শহরটাকে পার হয়ে এসেছে তা টের পায়নি দীপা। রিকশা থেকে নেমে সে বুঝতে পারছিল না কী করবে। রিকশাওয়ালা বলল, ‘ঘাট ওহি দিকে আছে দিদি। আমাকে এক সিকি দিন।’
দুটো টাকা এগিয়ে দিল দীপা। লোকটা সেটাকে ভাঙিয়ে এক টাকা বারো আনা ফেরত দিল। সুটকেসটা তুলতে গিয়ে দীপার মনে হচ্ছিল হাত ছিঁড়ে যাবে। ঘাটের দিকে কোনওমতে এগিয়ে গেল সে। এর মধ্যে অনেকেরই নজর পড়ছে তার ওপর। যে-কেউ একনজরে ভেবে নিতে পারছে তার সবে বিয়ে হয়েছে এবং সঙ্গে কেউ নেই বুঝে বিস্মিত হচ্ছে। দীপা দেখল সবাই একটা ছোট কাঠের ঘর থেকে টিকিট কিনে নৌকায় উঠছে। সুটকেস রেখে সে দু’আনা দিয়ে টিকিট কিনে আনল। বিয়ের রাত্রে দু’-দুটো নদী পার হতে হয়েছিল তাদের। প্রায় হিঁচড়ে হিঁচড়ে সুটকেসটাকে টেনে নৌকোয় উঠল সে। প্রচুর লোকজন উঠেছে। তারা সবাই এখন দীপাকে দেখছে। দীপা জলের দিকে তাকিয়ে বসে রইল। সে ঠিক যাচ্ছে তো? তার পাশে দাঁড়ানো একজন গলা নামিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘কোথায় যাচ্ছ দিদিভাই?’ দীপা জবাব দিল না।
নৌকো ওপারে পৌঁছাল। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হচ্ছে। এখন বিরাট চর পার হতে হবে। পঙ্খিরাজ ট্যাক্সিগুলো চিৎকার করে লোক ডাকছে। যারা এই পয়সা খরচ করতে চায় না তারা হন্টন দিয়েছে। কাশগাছ আর বালিয়াড়ি ভেঙে বার্নিশের কাছে পৌঁছে আবার নৌকোয় চাপবে তারা। দেখতে দেখতে জায়গাটা ফাঁকা হয়ে গেল। দীপার খুব কান্না পাচ্ছিল। সে এখন কী করবে? সুটকেস বয়ে নিয়ে যেতে পারবে না সে। শেষ পঙ্খিরাজটা দাঁড়িয়ে ছিল। মোট দশ জন প্যাসেঞ্জার নেয় ওরা। কিন্তু পাঁচ জন জুটেছে তার। ওপারের যাত্রী নিয়ে নৌকো ফিরে গিয়েছে।
‘কোথায় যাবে খুকি? বার্নিশে?’
দীপা মুখ তুলে দেখল ময়লা শার্ট প্যান্ট পরা একটা আধবুড়ো লোক তার সামনে দাঁড়িয়ে। সে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল।
লোকটা জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমার কাছে একটা টাকা আছে? তা হলে আমার গাড়িতে উঠতে পারো। পাচ জন আছে, ছয় জন হলেই ছাড়ব।’
দীপাব হাতের মুঠো খুলে এক টাকা দশ আনা দেখাল।
লোকটা এবার জিজ্ঞাসা করল, ‘কোথায় যাবে বলো তো?’
দীপা চা-বাগানের নাম বলল। তার হাত তখনও বাড়ানো। লোকটা সেখান থেকে একটা আধুলি নিয়ে সুটকেস তুলে নিল, ‘এসো।’
গাড়িতে আড়ষ্ট হয়ে বসল দীপা। কোনও গদি নেই। স্প্রিংগুলোর ওপর দুটো বস্তা পেতে দেওয়া হয়েছে। বসামাত্র লাগছিল। গাড়ি চলা শুরু করলে অসহ্য হয়ে উঠল। দীপার পাশে-বসা লোকটা বলল, ‘একটু রবার লাগাতে পারো না ভাই। পাছা গেল!’ গাড়িটা থেমে গিয়েছিল। স্টার্ট নিচ্ছিল না। ড্রাইভার লাফিয়ে নেমে একটা কাশগাছ ছিঁড়ে বনেট খুলে ইঞ্জিনের একটা জায়গায় ঢুকিয়ে দিল। ফিরে এসে একবার চেষ্টা করতেই স্টার্ট নিল গাড়ি। একমুখ থুতু বাইরে ফেলে লোকটা বলল, ‘এক টাকায় বস্তাই হয়। রবার চাইলে দেড় টাকা দিতে হবে।’
ঘাটে নামিয়ে দিতেই সবাই ছুটল দাঁড়িয়ে-থাকা নৌকো ধরতে। লোকটা দীপাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘যাচ্ছ যেখানে সেখানে কে থাকে?’
‘বাবা-মা। ভাই। ঠাকুমা।’
‘শ্বশুরবাড়ি থেকে পালাচ্ছ মনে হচ্ছে। আমার কী! বাসুদেব বলে বাসায় উঠবে। চলো।’
লোকটা সুটকেস তুলে দিল নৌকোয়। শীতশীত করছিল দীপার। এখন রোদ ছড়ানো রয়েছে আকাশে। কিন্তু চওড়া নদীর ওপর দিয়ে বাতাস বয়ে যাচ্ছিল। দুটো হাত বুকের ওপর ভাঁজ করে রেখেও কনকনানি থামাতে পারছিল না। সারাটা দিনের অস্নাত অভুক্ত শরীরটা টলছিল। নৌকোয় যাত্রীরা নিঃশব্দে ছিল শুধু মাঝিরা চিৎকর করে গুন টানছে। হাওয়ার বিপরীতে যাওয়ায় ঠান্ডাটা লাগছে জব্বর। পাশে বসা এক মহিলা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘গরমজামা আনোনি সঙ্গে?’
দীপা মাথা নেড়ে না বলল। মহিলা বললেন, ‘সঙ্গে তো দেখছি কেউ নেই। যাচ্ছ কোথায়? বাপের বাড়ি না শ্বশুরবাড়ি?’
দীপা গম্ভীর মুখে জবাব দিল, ‘বাপের বাড়ি।’
‘কবে বিয়ে হয়েছে?’
‘তরশু।‘
‘ইয়ারকি মারছ? এট্টুকুনি মেয়ে, নাক টিপলে দুধ বের হবে, ইয়ারকি মারছ?’
দীপা জবাব দিল না। সে কঠিন মুখে বসে রইল। মহিলা তাঁর পাশের সঙ্গীর সঙ্গে ফিসফিস করে কিছু বললেন। দীপা শুনল লোকটা বলছে, ‘পুলিশে ধরিয়ে দেওয়া উচিত।’
মহিলা ধমকালেন, ‘তোমার কী! পুলিশে ছুঁলে আঠারো ঘা। যে পালাচ্ছে তাকে পালাতে দাও। থাক, ওদিকে আর তাকিয়ো না তুমি।’
মাঝি হাত না লাগালে টলায়মান নৌকো থেকে সুটকেস নিয়ে নামতে পারত না দীপা। ঘাটের দোকানগুলোতে খদ্দেরদের ঢোকার জন্যে হাঁকাহাঁকি চলছে। পরশু রাত্রে এই ঘাটেই ওরা জোড়া-নৌকোতে উঠেছিল। তখন অন্ধকারে কিছুই নজরে আসেনি। এখন দেখল গোটাপাঁচেক বাস দাঁড়িয়ে। কনডাক্টর খালাসিরা চিৎকার করে যাত্রী ডাকছে। শহরে যাওয়ার যাত্রীতে ভরে গেল নৌকো। বাসুদেব বাসটা কোথায়। কোয়ার্টার্সের সামনে দাঁড়িয়ে বা স্কুলে যাওয়ার সময় ওই নামের বাসটাকে দেখেছে। পেটের কাছে বড় করে লেখা থাকে বাসুদেব। দীপা সুটকেসটা তুলল। একটানে যতটা সম্ভব হেঁটে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। একটা কুলি ছুটে এল তার কাছে, ‘কোথায় যাবেন দিদি? কোন বাস?’ দীপা জবাব দিল, বাসুদেব।’
‘দ্যান আমারে। দু’আনা দিবেন। আসেন জলদি। বাস ছাড়বার টাইম হইছে।’
দীপা দেখল লোকটা অবলীলায় সুটকেস তুলে দৌড়াতে লাগল। বালির ওপর দিয়ে শাড়ি পরে হাঁটতে অসুবিধে হচ্ছিল। চটিতে বালি ঢুকে যাচ্ছে, কাপড়ে টান পড়ছে। সে দেখল চারপাশের লোকজন, মায় খাবারের দোকানের বেঞ্চিতে বসেও সবাই তার দিকে হাঁ করে দেখছে। এবং তখনই তার খেয়াল হল বাঁ হাতের মুঠোয় ঘোমটার আঁচল ধরা আছে। সেই যে ফুলশয্যার ঘরে ঘোমটা দিয়ে আঁচল ধরেছিল আর তা খোলা হয়নি। এতক্ষণ মনেও ছিল না। সে চট করে হাত নামাতেই ঘোমটা সবল এবং কানে ঠান্ডা হাওয়া লাগল। সঙ্গে সঙ্গে আবার ঘোমটার প্রান্ত মুঠোয় ধরল দীপা। যে যাই ভাবুক, এতে তার ঠান্ডা কম লাগবে।
খালাসিটা সুটকেস বাসের মাথায় তুলে দিচ্ছে। দীপা বাসুদেব লেখাটা দেখতে পেল। সঙ্গে সঙ্গে এতক্ষণ যে উদ্বেগ বুকের পাঁজরায় ভার বাড়াচ্ছিল সেটা উধাও হয়ে গেল। এই বাস রোজ তাদের কোয়াটার্সের সামনে দিয়ে যাওয়া-আসা করে যখন তখন সে ঠিকঠাক পৌঁছে যাবে। লোকটাকে দু’আনা দেওয়ার পর তার হাতে একটা টাকা রইল। গাড়িভাড়া কত? দীপার গলা শুকিয়ে গেল। এক টাকায় হয়ে যাবে? মনে পড়ল ট্যাক্সিওয়ালা ভাড়া চেয়েছিল একটা টাকা কিন্তু তার হাত থেকে নিয়েছিল আট আনা। ওপর থেকে নেমে এসে খালাসিটা ধমকাল, ‘এখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? গাড়িতে উঠুন। কোথায় যাবেন?’
দীপা চা-বাগানের নাম বলল। খালাসি বলল, ‘উঠন জলদি। লেডিস সিটে বসে পড়ুন। গাড়ি এখনই ছাড়বে। ’
শাড়ি সামলে বাসের সিঁড়ি ভাঙতে বেশ কসরত করতে হল। খুব ভিড় নেই। লেডিস লেখা একটা খালি সিটে বসে পড়ল সে। এবং তার কিছুক্ষণ বাদেই ঝিমুনি এল। বাস যখন চলতে শুরু করল, যখন ঠান্ডার কামড় আরও বাড়ল, যখন রোদুর টুপ করে সরে গিয়েই অন্ধকার নামল ময়নাগুড়ির ওপর, তখন কনডাক্টর এসে দীপার পাশের জানলা বন্ধ করে দিল। দীপা চোখ মেলল। তার খুব কাঁপুনি আসছিল। ঠোট শুকনো। গলার ভেতরটা শুকিয়ে যাচ্ছে। তার দুটো হাঁটু কাপছিল। সে ঝাপসা দেখল। কনডাক্টর একটু ঝুঁকে জিজ্ঞাসা করল, কোথায় যাবেন?
দীপার ঠোঁটে হাসি ফুটল। কী আশ্চর্য। আজ সবাই তাকে আপনি বলছে কেন? সে কি দু’দিনেই এত বড় হয়ে গেল! দীপা হঠাৎ কনডাক্টরকে ঝাপসা দেখল। কনডাক্টর বলল, ‘আরে, সঙ্গে কেউ নেই নাকি! চোখ দেখে মনে হচ্ছে জ্বর হয়েছে খুব। যাবেন কোথায়?’
দীপা কোনওমতে চা-বাগানের নামটা উচ্চারণ করল। গলার স্বর নিজের কাছেই অচেনা মনে হল। উচ্চারণ করেই সে মুঠো খুলে টাকাটা তুলে ধরল। কনডাক্টর সেটা খপ করে তুলে নিয়ে একটা টিকিট গুঁজে দিল। জানলায় মাথা হেলিয়ে দিল সে। বড্ড শীত করছে। বুকের পাঁজর পর্যন্ত কেঁপে উঠল। অন্ধকার চিরে ছুটে যাওয়া বাসে চোখ বন্ধ করতেই একটি নগ্ন হাড়জিরজিরে শরীর দেখতে পেল সে। কী বীভৎস ভঙ্গিতে হাঁপাচ্ছে সে। দীপা কেঁদে উঠল। কনডাক্টর মুখ ফিরিয়ে তাকে দেখল। যাত্রীরাও। কেউ কিছু বলল না।
প্রায় কানের কাছে মুখ এনে কনডাক্টর কিছু চেঁচিয়ে বলতে চোখ খুলল দীপা। লোকটা আবার বলল, ‘চা-বাগান আসছে। কোথায় নামবেন?’ জিজ্ঞাসা করেই পেছনের জানলা খুলে দিল দেখার জন্যে। শীতল বাতাসের স্পর্শে কুঁকড়ে গেল দীপা। কোনওমতে মুখ ফিরিয়ে সে বাইরে তাকাতেই ঘন অন্ধকার ছাড়া কিছু দেখতে পেল না। কনডাক্টর জিজ্ঞাসা করল, ‘বাগানে না চৌমাথায়?’
দীপা জবাব দিতে পারল, ‘বাগানে।’
সঙ্গে সঙ্গে মাথার ওপরের দড়ি ধরে টান দিল লোকটা। বেল বাজল এবং বাসটা গতি কমিয়ে থেমে গেল। দীপা উঠে দাঁড়াল। পা বাড়াতেই মনে হল সে পড়ে যাবে। কনডাক্টর সেটা বুঝতে পেরে খপ করে কনুই ধরল। লোকটার সাহায্যে সে কোনওমতে নীচে নামতে পারল। খালাসি সুটকেস নামিয়ে দিলে আলোটুকু নিয়ে চলে গেল বাসটা। মুহূর্তেই চারধার অন্ধকারে একাকার। দীপা দাঁড়াতে পারছিল না। এরই মধ্যে মনে হল সে ঠিক জায়গায় এসেছে তো? ওরা তাকে ভুল করে অন্য কোথাও নামিয়ে দেয়নি তো? সে যে কিছুই চিনতে পারছে না। সমস্ত শরীর টলতে লাগল। সুটকেসের ওপর বসে পড়ে হাউহাউ করে কেঁদে উঠল দীপা। এইসময় তার শীতবোধও ছিল না।
রাস্তার দু’পাশে লম্বা লম্বা দেওদার গাছ আকাশ ঢেকে রয়েছে। এইসব গাছে বাদুড়েরা আরামে ঝোলে। কুলি লাইনের মদেশিয়া ছেলেমেয়েরা টর্চ আর গুলতি নিয়ে চলে আসে সন্ধে পার হলেই। একজন টর্চ ধরে রাখে বাদুড়ের শরীরে আর একজন গুলতি ছোড়ে তাক করে। ঝুপ শব্দ হয়। বাদুড়টা পড়ে যায় মাটিতে। সেটাকে ভরে নেয় ওরা ঝোলায়। ওদেরই দু’জন কান্নাটা শুনল। শুনে ছুটে এল। টর্চের আলো ফেলে তারা কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আলোর স্পর্শ পেয়ে দীপা চোখ খুলল। তার কান্না বাগ মানছিল না। কিন্তু টর্চের ওপাশে কে আছে তা সে বুঝতে পারছিল না।
নিজেদের মধ্যে কথা বলাবলি করে ছেলেদুটো দৌড়ে সিঁড়ি টপকে মাঠে নামল। দীপার খুব ভয় করতে লাগল। কাপড়টাকে ভাল করে জড়িয়ে মাথা তুলে সে উঠে দাঁড়াল। আর তারপরেই যেন দেখতে পেল দূরে আবছা আলো পরপর কয়েকটা। এবং তখনই সে শিউলি ফুলের গন্ধ পেল। সঙ্গে সঙ্গে বুকের মধ্যে বাজনা বাজতে লাগল যেন। শিউলির গন্ধটা তাকে উল্লসিত করল। ছুটতে গেল সে। এবং দু’পা যাওয়ামাত্র আছাড় খেয়ে পড়ল মাটিতে।
ঠিক সেইসময় অমরনাথ বারান্দায় দাঁড়িয়ে মদেশিয়া ছেলেদুটোর সঙ্গে কথা বলছিলেন। তাঁর কোয়ার্টার্সের মুখোমুখি মাঠ পার হলেই সিঁড়িটা। ছেলেদুটো তাই তাকে দরজা খুলতে বাধ্য করেছিল। ওরা জানিয়েছে একটি মেয়ে সুটকেস নিয়ে রাস্তায় বসে একা কাঁদছে। অঞ্জলি পেছনে এসে দাঁড়িয়েছিল, ‘ওমা, এই রাত্রে আবার কে কাঁদবে?’
অমরনাথ জ্যাম্বো হ্যারিকেনটা একটি ছেলের হাতে তুলে দিয়ে বললেন, ‘চল দেখি।’
কৌতূহল নিয়ে অঞ্জলি দাঁড়াল বারান্দার প্রান্তে। ভেতরের ঘর থেকে সুভাষচন্দ্রের গলা ভেসে এল, ‘এসব ফালতু ঝামেলায় কেন যে যায়!’ অঞ্জলি জবাব দিল না। সে দেখল হ্যারিকেনটা সিঁড়ি পেরিয়ে আসাম রোডের কাছে চলে গেল। এবং তারপরেই অমরনাথের আর্ত চিৎকারে সমস্ত চরাচর জেগে উঠল। দূর থেকেই অঞ্জলি অস্পষ্ট দেখল অমরনাথ মাটিতে বসে পড়েছেন। সব বিস্মৃত হয়ে সে তিরের মতো অন্ধকার মাঠ ডিঙিয়ে ছুটে এল। অমরনাথ তখন দু’হাতে দীপার শরীর আঁকড়ে ধরেছেন, ‘দীপা, দীপু, দীপুমা, তুই এখানে? দীপা তুই কথা বল। ও দীপু!’
অঞ্জলি ঝাঁপিয়ে পড়ল। স্বামীর হাত থেকে মেয়েকে টেনে নিলে, ‘কী হল! ও এখানে কেন? জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। চিৎকার করে না কেঁদে তোলো ওকে। ঘরে নিয়ে চলো।’
দু’হাতে মেয়েকে বুকে তুলে নিয়ে অমরনাথ দৌড়ালেন। তাঁর বুক হাত যেন উত্তাপে পুড়ে যাচ্ছিল। খোলা দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে হতবাক সুভাষচন্দ্রের সামনে এক মুহূর্ত দাঁড়ালেন। তারপর ভেতরের ঘরে নিজেদের বিছানায় শুইয়ে দিয়ে চিৎকার করলেন, ‘মা, তাড়াতাড়ি এসো। আমরা কী করেছি নিজের চোখে দ্যাখো!’
সঙ্গে সঙ্গে পেছনে দাঁড়িয়ে ধমকে উঠল অঞ্জলি, ‘আঃ। পাগল হয়ে গেলে নাকি। মাথা ঠান্ডা করে ডাক্তারবাবুকে ডেকে আনো৷’ এইসময় মনোরমা প্রায় দৌড়েই ঘরে ঢুকলেন। অমরনাথ তখন লেপ টেনে দিচ্ছিলেন দীপার শরীরে। মনোরমা গলা থেকে শব্দগুলো ছিটকে এল, ‘ও এখানে কেন?’ অমরনাথ মাথা নাড়লেন উন্মাদের মতো, ‘জানি না। বাস রাস্তায় সুটকেস নিয়ে বসে ছিল। দ্যাখো তোমরা, আমি ডাক্তারের কাছে যাচ্ছি।’ অমরনাথ টর্চ তুলে নিয়ে ছুটলেন। মনোরমা ততক্ষণে বিছানায় বসে পড়েছেন। বিকেলের পর তিনি অমরনাথের বিছানায় সচরাচর বসেন না। ঝুঁকে পড়ে মনোরমা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হ্যাঁরে, তুই কার সঙ্গে এলি? ও দীপা! ওমা, এ যেন শরীরে উনুন জ্বলছে। ও বউমা, জল আনো, তাড়াতাড়ি জল আনো।’
অঞ্জলি ততক্ষণে একটা বাটিতে জল নিয়ে ন্যাকড়া ভিজিয়ে ফেলেছিল। তাই ভাঁজ করে শাশুড়ির হাতে তুলে দিল। মনোরমা সেটি দীপার কপালে চেপে ধরলেন। এপাশ ওপাশ করতেই পট্টি শুকিয়ে গেল। মনোরমা ক্রমাগত জলপট্টি দিয়ে চললেন। মাথার পেছনে বসে অঞ্জলি পাখা নিয়ে বাতাস করতে লাগল। এই ঠান্ডায় বাতাস করা উচিত হচ্ছে কিনা বুঝতে না পেরে সে একবার শাশুড়ির দিকে তাকাল। মনোরমা ঠোঁট টিপে কাজ করে যাচ্ছেন। তাঁর মুখ এখন কঠিন দেখাচ্ছে। ছোট দুই ছেলে দূরে আলোয়ান গায়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে দৃশ্যটি দেখছে। এমনকী উঠোনের বারান্দার দরজায় বুধুয়া কখন এসে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মিনিট পাঁচেকের পর অমরনাথ ডাক্তারবাবুর সঙ্গে ফিরে এলেন। সুভাষচন্দ্র গিয়েছিলেন তাঁর সঙ্গে। ব্যাগটি তিনিই বহন করছিলেন।
অমরনাথ একটা চেয়ার এনে বিছানার পাশে রাখলে ডাক্তারবাবু সেটায় বসে প্রথমে নাড়ি দেখলেন। বুকে স্টেথো দিয়ে পরীক্ষা করলেন কয়েকবার। তারপর থার্মোমিটার বের করে ঠোঁট ফাঁক করে জিভের তলায় ঢুকিয়ে মুখ চেপে ধরলেন। ঘরে কেউ কোনও কথা বলছিল না। পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলে ডাক্তারবাবু সোজা হয়ে বসলেন। তাঁকে খুব ভাবিত দেখাচ্ছিল। অমরনাথ বললেন, ‘আমি কিছুই। বুঝতে পারছি না। কত জ্বর দেখলেন?’
‘একশো চার। নার্ভ খুব উইক। মনে হয় পেটে কিছু নেই। বুকে ঠান্ডা বসেছে বেশ। আমি ওষুধ দিচ্ছি। এখনই খাইয়ে দেবেন। ঘুমাতে দিন ওকে। রাত্রে বাড়াবাড়ি হলে আমাকে ডাকবেন। আর মাথাটা ভাল করে ধুইয়ে দিন।’
‘মাথা বোয়াতে গেলে ঘুম ভাঙবে না?’ অঞ্জলি জিজ্ঞাসা করল।
‘এখন ভাঙুক। অবশ্য বেহুঁশ হয়ে আছে। টের পাবে বলে মনে হয় না। আচ্ছা, এক বালতি জল আর মগ নিয়ে আসুন।’
বুধুয়া ছুটল। সঙ্গে সঙ্গে ফিরে এল বালতি আর মগ নিয়ে। তোয়ালে গলায় চেপে ডাক্তারবাবু নিজের হাতে মাথা ধুইয়ে দিলেন। অঞ্জলি মুছিয়ে দিচ্ছেন যখন তখন ডাক্তারবাবু বললেন, ‘মনে হচ্ছে মেয়েটার ওপর দিয়ে বিরাট ঝড় বয়ে গিয়েছে। শুধু ঠান্ডা লেগে জ্বর এলে নার্ভ এত উইক হয় না। একজন কেউ আসুন, আমি ওষুধ দিয়ে দিচ্ছি।’ ডাক্তারবাবু চলে গেলেন। অমরনাথ তাঁকে অনুসরণ করলেন।
শীতের রাতটা কেটে গেল। সুভাষচন্দ্রকে জোর করে ঘুমাতে পাঠিয়েছিল অঞ্জলি। এক ফাঁকে তাকে খাবারও এনে দিয়েছিল সে। কিন্তু বাকি তিনজনের খাওয়া তো দূরের কথা কেউ বিছানায় শরীরও এলাতে পারেনি। ডাক্তারবাবু অমরনাথকে বলে দিয়েছিলেন ঘুম না ভাঙিয়ে দু’ঘণ্টা পরপর জ্বর দেখে লিখে রাখতে, ঘড়ির কাঁটা ধরে ওষুধ খাওয়াতে। এ সবই ঠিকঠাক চলেছিল।
এখনও এ-বাড়ির চারপাশে বিয়ের গন্ধ ছড়ানো। তিনদিন আগে যাকে ঘিরে সবাই হইচই করেছে, শঙ্খ বেজেছে, খাওয়াদাওয়া নিয়ে হাঁকাহাঁকি হয়েছে, সে প্রায় অসাড় হয়ে পড়ে আছে বিছানায়। একশো চার ছাড়িয়ে যখন থার্মোমিটারের কাঁটা উঠল তখন মনোরমা কথা বলেছিলেন, ‘ডাক্তারকে খবর দাও। আমার ভাল ঠেকছে না। শরীর গরম অথচ হাত-পায়ের তলা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। তিন রাতেই মেয়েটা একেবারে শেষ হয়ে গেল।’
মধ্যরাত্রে অমরনাথ শাল মুড়ি দিয়ে আবার ডাক্তারবাবুর বাড়িতে দৌড়ে গিয়েছিলেন। জ্বর বেড়েছে শুনে ভদ্রলোক ছুটে এসেছিলেন বিছানা ছেড়ে। দ্বিধা সরিয়ে রেখে ইঞ্জেকশন দিয়েছিলেন। আধঘণ্টা বাদে জ্বর সাড়ে তিনে নামতে বলেছিলেন, ‘তিনজনে একসঙ্গে রাত জাগলে রোগীর সেবা করবে কে? পালা করে ঘুমিয়ে নিন।’
কথাটা কারও কানে ঢোকেনি। বাইরের ঘরে এসে সিগারেট ধরিয়েছিলেন ডাক্তারবাবু। তারপর আচমকা প্রশ্ন করেছিলেন, ‘ওর ফুলশয্যা যেন কবে ছিল?’
‘গতরাত্রে।’
‘হুম! কী হয়েছিল কিছুই বুঝতে পারছেন না?’
‘না। আমি কাল সকালে জলপাইগুড়িতে যাব।’
‘একটা কথা, আপনার মেয়ের পিরিয়ড শুরু হয়েছে?’
‘হ্যাঁ।’
‘মনে হচ্ছে ওর ওপর একটা সেক্স-অ্যাটেম্পট হয়েছিল। ঠান্ডা যতটা নয়, মনের ওপর চাপ বেশি, খুব বেশি। নার্ভ মনে হচ্ছে শ্যাটার্ড। অবশ্য এ সবই আমার অনুমান। এর ওপর ভিত্তি করে কিছু করা যায় না। ওর সেন্স না এলে বোঝাও যাবে না। একজন বিয়ে হচ্ছে না বলে আত্মহত্যা করতে গিয়েছিল আর একজনকে বিয়ে দিয়ে হত্যা করা হচ্ছিল। অদ্ভুত জীবন! চলি!’
অমরনাথ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন। টর্চ জ্বেলে অন্ধকার কাটতে কাটতে ডাক্তারবাবু চলে গেলেন। বিয়ে দিয়ে হত্যা করা হচ্ছিল! হঠাৎ ভেতর থেকে একটা কাঁপুনি এবং সেইসঙ্গে বুক মুচড়ে একটা কান্না ছিটকে এল গলায়। প্রাণপণে শব্দটাকে চাপতে চেষ্টা করলেন অমরনাথ। তিনিই হত্যাকারী। যে-মেয়ে ধূপগুড়ি পর্যন্ত একা কখনও যায়নি সে অতবড় সুটকেস নিয়ে জলপাইগুড়ি থেকে একা এল কী করে? অসুখটা নিশ্চয়ই এখানে নামার পর হয়নি। প্রতুলবাবুও তাঁর পুত্রবধূকে ছাড়লেন কী করে? এইসময় অঞ্জলি তাঁর পাশে এসে দাঁড়াল। বাইরের দরজাটা তখনও খোলা। দ্রুত বন্ধ করে অঞ্জলি স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বাড়িতে আর একটা রোগী বাড়িয়ে তোমার কী লাভ বলতে পারো? তুমি শুয়ে পড়ো ওদের বিছানায়। আমরা জাগছি।’
কিন্তু অমরনাথ কথা শোনেননি। সকাল হল। হয়তো ডাক্তারবাবুর বাড়ি থেকেই খবরটা ছড়িয়েছে চা-বাগানে। প্রথমে এলেন বড়বাবুর বাবা তেজেন্দ্র। তারপর একে একে সবাই, শুধু পাতিবাবু বা মালবাবুর বাড়ির লোকজনের অবশ্য আসার মতো অবস্থা ছিল না। প্রত্যেকের কৌতূহল, মেয়েটা কেন ফুলশয্যার পরের রাত্রে একা ফিরে এল? অমরনাথ যতই বলেন তিনি কিছুই জানেন না তবু তেজেন্দ্রর কৌতূহল শেষ হয় না। তিনি বললেন, ‘আগে এমন হত শুনেছি। ফুলশয্যায় স্বামীর চেহারা দেখে কচি বউ পরের দিন ধানখেতে লুকিয়ে বসে থাকত। সেরকম ঘটনা কিনা বলতে পারো?’
নবনী অফিসে যাওয়ার আগে সাতসকালেই খবর পেয়ে এসেছিল, এবার না বলে পারল না, ‘কিছু মনে করবেন না আপনি কিন্তু সীমারেখা অতিক্রম করছেন।’
তেজেন্দ্র হতভম্ব, ‘কী! তুমি, তুমি আমাকে বললে একথা?’
‘না বলে পারলাম না।’
‘কী আম্পর্ধা। সেদিনের ছেলে, সবে এই বাগানে এসেছ, যেখানে দাঁড়িয়ে আছ সেই জায়গাটাকে আমি তৈরি হতে দেখেছি, জানো? আমাকে সীমা দেখাচ্ছ।’
নবনী বিচলিত না হয়ে বলল, ‘জন্মদাতাও যখন অপ্রকৃতিস্থ হন তখন তাঁকে সতর্ক করে দেওয়া দরকার। অমরদা, আপনার পক্ষে তো আজ যাওয়া সম্ভব নয়। আমি সাহেবকে বলে দেব। তবে বাইরের লোকের এত ভিড়ও ঠিক নয়। বুঝতেই পারছেন সবাই, কাল সারারাত এঁদের ওপর ঝড় বয়ে গিয়েছে। যান সবাই এখান থেকে।’ কথাগুলো বলে সে আর দাঁড়াল না। সাইকেলে চেপে ফ্যাক্টরির দিকে চলে গেল। ভিড়টা এর পরই কমতে আরম্ভ করল। এমনকী তেজেন্দ্রও গজগজ করতে করতে নিজেদের কোয়ার্টার্সে ফিরে গেলেন।
ঘরে ঢুকে অমরনাথ দেখলেন অঞ্জলি নেই, তার জায়গায় সুভাষচন্দ্র বসেছেন। সারারাত ঘুমিয়ে এখন সুভাষচন্দ্রকে তরতাজা দেখাচ্ছে। মনোরমা পাথরের মতো বসে আছেন দীপার পায়ের পাশে। অমরনাথ বললেন, ‘মা, এবার তুমি ওঠো। সারারাত একভাবে বসে আছ। শরীর খারাপ হয়ে গেলে গেলে—’
সুভাষচন্দ্র বললেন, ‘হ্যাঁ। আপনি যান। জ্বর তো কমে এসেছে।’
মনোরমা গম্ভীর স্বরে বললেন, ‘ওর সঙ্গে কথা না বলে আমি কোথাও যাব না।’
অমরনাথ অসহায়ের মতো সুভাষচন্দ্রের দিকে তাকালেন। সুভাষচন্দ্র বললেন, ‘বাড়িতেই তো আছে। কথা তো বলতেই পারবেন। কিন্তু ওর জ্ঞান কখন ফিরে আসবে, কথা বলার মতো জোর কতক্ষণে হবে, তার তো ঠিক নেই।’
‘এ-ব্যাপারে কথা বাড়িয়ো না। কাল রাত্রে ঠাকুরের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছি যতক্ষণ ওর মুখে কথা না। শুনব ততক্ষণ এখান থেকে উঠব না।’
সুভাষচন্দ্র অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করেন, ‘কিন্তু আপনি কলটলে যাবেন তো?’
‘ওটা আমাকে বুঝতে দাও। অমর, ডাক্তারবাবু কি সকালে আসবেন বলেছেন?’
‘হ্যাঁ মা।’
শুকনো মুখ প্রায় সাদা। গলা পর্যন্ত কম্বল টানা। নিশ্বাস পড়ছে দ্রুত। চোখ বন্ধ। সিঁথি সিঁদুরে লাল। মনোরমা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন। এখন অঞ্জলি তাঁর পাশে বসে। অমরনাথকে জোর করে শুতে পাঠানো হয়েছে ডাক্তার চলে যাওয়ার পর। ভদ্রলোক নাড়ি দেখেছেন। ঘুম ভাঙাননি। বলেছেন, ‘যতক্ষণ ঘুমাতে পারে ঘুমিয়ে নিক। ঘুম ভাঙলে একটু গরম দুধ আর বিস্কুট দেবেন। খেতে চাইবে না তবু যেটুকু পারেন খাওয়াবেন। আর আজ কোনও প্রশ্ন করবেন না। কিছু জানতে চাইবেন না।’
অঞ্জলি বলল, ‘মা, আপনি সত্যি উঠবেন না?’
মনোরমা মাথা নাড়লেন, ‘মানত করেছি বউমা।’
একটু ইতস্তত করে অঞ্জলি বলল, ‘ও আজ জলপাইগুড়িতে যেতে চাইছে।’
মনোরমা বললেন, ‘কেন?’
অঞ্জলি জবাব দিল, ‘কী ঘটেছিল তা জানতে। মেয়েকে তো বিশ্বাস নেই। যা ডানপিটে। হয়তো শরীর খারাপ করতেই এখানকার কথা মনে এসেছিল আর তাই কাউকে না বলে চলে এসেছে। আমার তো এরকমটাই মনে হচ্ছে।’
‘তা হলে সুটকেস আনতে যাবে কেন? না, অমরনাথের যাওয়ার দরকার নেই। তুমি বরং ওকে বলো, চিঠি লিখে কাউকে দিয়ে পাঠিয়ে দিতে। সকাল ন’টা বেজে গেছে। বাড়ির বউ না বলে চলে গেলে নিশ্চয়ই ওর শ্বশুরবাড়ি থেকে এতক্ষণ খবর এসে যেত। একটা রাত জ্বর গায়ে বউ বাড়িতে থাকল না আর ওরা চুপ করে বসে থাকবে?’ কথা বলতে বলতে মনোরমার চোখ দীপার মুখের ওপর স্থির হল। ঠোঁট নড়ছে। মুখ হাঁ হল। অঞ্জলি মেয়ের ওপর ঝুকে পড়ল, ‘দীপা, দীপা! এই মেয়ে?’
দীপা ধীরে ধীরে চোখ মেলল। চোখে এখনও লালচে ভাব। ঠোঁট চাটল সে। দৃষ্টি ছাদ থেকে ধীরে ধীরে নামল। মনোরমার মুখের ওপর আসামাত্র তিনি হাসবার চেষ্টা করলেন। কিন্তু তখনই বুঝতে পারলেন মেয়েটা তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে বটে তবে দেখছে না কিছুই। তিনি ডাকলেন, ‘দীপু!’
সঙ্গে সঙ্গে চোখ বন্ধ হল। আর তারপরেই ডান চোখের বন্ধ পাতার ভাঁজ গলে একটা জলের ধারা গড়িয়ে পড়ল কানের লতির দিকে। সেইসময় বুধুয়া এসে দাঁড়াল, ‘এক আদমি আয়া হ্যায় জলপাইসে। বাবুকো মাংতা হ্যায়।’
অঞ্জলি একবার মেয়েকে দেখে দৌড়ে বাইরের ঘরে চলে এল। বারান্দায় একটি লোক দাঁড়িয়ে। মনে পড়ল একেই তারা প্রথম দিন প্রতুলবাবুর অফিসে দেখেছিল। লোকটি হাত জোড় করল, ‘আমি জলপাইগুড়ির প্রতুলবাবুর বাড়ি থেকে আসছি। একটা দুঃসংবাদ আছে। গতরাত্রে অতুলচন্দ্র, মানে ওঁর একমাত্র পুত্র দেহ রেখেছে। উনি পরে আপনাদের চিঠি দেবেন। নমস্কার।’
পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইল অঞ্জলি। ভেতরের ঘরে তখন মনোরমা পরম যত্নে দীপার চোখের কোল থেকে শেষ জলের দাগটি মুছে দিচ্ছিলেন।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন