সমরেশ মজুমদার
মনোরমা একটা মোড়ায় বসেছিলেন। অঞ্জলি ভেতরের দরজায় দাঁড়িয়ে। সমস্যায় পড়লেই তার হাত আঁচল তুলে ঠোঁটে চাপা দেয়। অমরনাথ তাঁর চেয়ারে। সত্যসাধন মাস্টার এসে পড়বেন এখনই।
সত্যসাধন মাস্টারকে খবর দিয়ে এসেছিল বুধুয়া। মনোরমা তাকে পাঠিয়েছিলেন। বিকেলের একটু আগে অমরনাথ জলপাইগুড়ি থেকে মেয়েকে নিয়ে বাড়ি ফিরে এলেন। মেয়ের সঙ্গে তার যাবতীয় সম্পত্তি। পরনে কলেজে যাওয়ার শাড়ি। আর বাড়িতে ফিরেই সে মনোরমার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করেছিল। অনেক ডাকাডাকিতেও খোলেনি।
অঞ্জলি এবং মনোরমা অমরনাথকে কারণ জিজ্ঞাসা করেছিলেন। বাইরের ঘরে বসে অমরনাথ ধীরে ধীরে সব কথা খুলে বলেছিলেন। এর অনেকটাই অঞ্জলির জানা কিন্তু মনোরমা প্রথম শুনলেন। তাঁর খেয়াল হল না যে ছেলে এতদিন কথাগুলো তাকে জানায়নি। বরং মনে হল দীপা খুব বোকামি করছে। তিনি বলেছিলেন, ‘সমস্ত সম্পত্তি এমনি এমনি রেখে লোকটা চলে গেল ভাবতে কেমন লাগছে। সব দীপা পাবে?’
অমরনাথ হাত নাড়লেন, ‘আমাকে আর জিজ্ঞাসা কোরো না। আমি খুব ছোট হয়ে গেছি।’
‘কেন? ছোট হবি কেন? তুই তো আর হাত পেতে কিছু নিতে যাসনি। আইন যা বলে তাই হবে। তুই দীপার গার্ডেন। ওর ভালর জন্যে করেছিস!’ মনোরমা গজগজ করতে লাগলেন, ‘ওইটুকুনি পুঁচকে মেয়ে মুখের ওপর বলল লাগবে না আর তুই চুপ করে রইলি? কেমন বুদ্ধি তোর?’
অমরনাথ লক্ষ করেছিলেন মনোরমা বাবা না বলে গার্জেন বললেন। খট করে লেগেছিল শব্দটা। কিন্তু তিনি উপেক্ষা করলেন, ‘প্রতুলবাবুকে শ্মাশানে নিয়ে যাওয়ার পর আনা ওকে ভেতরে ডেকে পাঠিয়েছিল। কী বলেছিল জানি না।’
‘তুই যেতে দিলি কেন ওকে ওই নষ্ট মেয়েছেলেটার কাছে? বাড়ির ঝি হয়ে বাবুর সম্পত্তির দিকে হাত বাড়াচ্ছে। সাহস কী!’ মনোবমা মুখ ঘুরিয়ে নিলেন।
অঞ্জলি এই প্রথম কথা বলল, ‘আপনি তাকে দ্যাখেননি মা। আমি দেখেছি। কে বলবে বাড়ির ঝি। পোশাক, ঠমক দেখে যে-কোনও পুরুষের মাথা ঘুরে যাবে। উনি যে ওখানে যেতেন তাতেই আমার আপত্তি ছিল।’
‘আঃ বাজে বোকো না তুমি।’ মনোরমা ধমক দিলেন। তারপর গলা নামিয়ে বললেন, ‘তারপর কী হল?’
আনার ব্যাপার নিয়ে অঞ্জলির দেওয়া খোঁচাটা ভুলতে চাইলেন অমরনাথ। হ্যাঁ, আনার শরীরে একটা আকর্ষণ শক্তি আছে। অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে তিনি নিজেকে খুব সংযত রেখেছেন। মায়ের প্রশ্নের জবাব দিলেন তিনি, ‘অনেকক্ষণ বাদে ও ভেতর থেকে বেরিয়ে এল। কেমন অসুস্থ দেখাচ্ছিল ওকে। আমি ছুটে গিয়ে কারণ জিজ্ঞাসা করতে মেয়ে বলল, তুমি কেন এত লোভী হলে, ছিঃ। আমি মাটিতে মিশে গেলাম মা। যাকে এইটুকুনি থেকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছি তার মুখ থেকে আমাকে ওই কথা শুনতে হল? আমি কার জন্যে লোভ করেছি? নিজের জন্যে?’ দু’হাতে মুখ ঢাকলেন অমরনাথ। প্রতুলবাবুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে দীপা তাঁর দিকে যে-দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল তা কিছুতেই মন থেকে সরিয়ে ফেলতে পারছেন না তিনি।
বাড়ির সামনে তখন কেউ নেই। প্রশ্নটা শুনে কিছুই জবাব দিতে পারেননি অমরনাথ। হয়তো জবাব আশাও করেনি দীপা। কারণ খানিক দাঁড়িয়ে সে ধীরে ধীরে হাঁটতে আরম্ভ করেছিল। অমরনাথ বুঝতে পারছিলেন না তাঁর কী করা উচিত। অসহায়ের মতো তিনি মেয়েকে অনুসরণ করতে বাধ্য হলেন। আনা দীপাকে ভেতরে ডাকিয়ে নিয়ে গিয়ে ঠিক কী কথা বলেছে তার কোনও আন্দাজ করা সম্ভব ছিল না। কিন্তু যে-সব তথ্য এতদিন মেয়ের কাছে তিনি লুকিয়ে রেখেছিলেন তা প্রকাশ পেয়ে যাওয়াতে একধরনের সংকোচবোধ তাঁকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল যা নাড়া খেয়ে গেল দীপার একটি বাক্যে। ক্রমশ তিনি উষ্ণ হতে আরম্ভ করলেন। তাঁর মনে এমন ভাবনা ছিল যে অল্প বয়সের স্পর্ধায় দীপা তার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটি অস্বীকার করছে। ওই বয়সে অনেকেই ন্যায়নীতি নিয়ে বাড়াবাড়ি করে থাকে। কিন্তু বয়স বাড়লে, বাস্তববুদ্ধি প্রখর হলে, অমরনাথ যখন ঘটনাটা প্রকাশ করবেন তখন প্রতুলবাবুর সম্পত্তি গ্রহণ করতে হয়তো আপত্তি থাকবে না। অভাবের আঁচ যার গায়ে লাগেনি সে অনেক ত্যাগ করতে পারে। কিন্তু সত্যিকারের অভাবীর পক্ষে সংসারে থেকে ত্যাগের কথা বলা খুব নির্মম ব্যাপার।
অমরনাথ দ্রুত পা চালিয়ে মেয়ের সঙ্গ নিলেন। কিন্তু প্রশ্ন করতে গিয়েও সামলে নিলেন তিনি। কী প্রশ্ন করবেন? কী বলল আনা? কেন দীপা তার মুখের ওপর অমন ভয়ানক কথাটা বলল? মেয়ের মুখের দিকে আড়চোখে তাকিয়েই তিনি বুঝে গেলেন প্রশ্নগুলো করা নিরর্থক। একদম পাথরের মতো মুখ হয়ে গেছে মেয়েরা চুপচাপ তাঁরা হেঁটে এসেছিলেন করলা নদী পর্যন্ত। তিনি ভেবে পাচ্ছিলেন না এখন দীপা কোথায় যাবে। কলেজে যাওয়ার মানসিকতা নিশ্চয়ই থাকতে পারে না। তাঁর মনে হল ওকে চা বাগানে নিয়ে যাওয়া উচিত। এই মানসিক টালমাটালের সময় অঞ্জলির উপস্থিতি ওকে সাহায্য করবে। কিন্তু কলেজ খোলা থাকলে হস্টেল থেকে ছুটি পাওয়া যায় কিনা তা তাঁর ধারণায় ছিল না। ঝুলন ব্রিজের ওপর উঠে তিনি কথা বললেন, ‘এখন হস্টেলে গেলে বড়দিকে পাওয়া যাবে?’
দীপা দাঁড়িয়ে পড়েছিল, ‘কেন?’
‘না, মানে, আমি ভাবছি, তুই যদি ক’দিন বাড়ি থেকে ঘুরে আসতিস ভাল হত।’
‘আমি চা-বাগানেই যাচ্ছি।’ দীপা আবার হাঁটা শুরু করল।
বাকি পথটা কোনও কথা হয়নি। হস্টেলে পৌঁছে গেস্টরুমে বসেছিলেন অমরনাথ। যেন একটা বিরাট ঝড় আজ বয়ে গেল। আর যাই হোক মেয়ের মুখে নিজের সম্পর্কে অমন কথা শোনার পর থেকেই ক্রমশ শূন্যতাবোধ ঘিরে ধরছে তাঁকে। অমরনাথ দেখলেন, বড়দি বের হচ্ছেন তাঁর কাজে। তিনি চটজলদি সামনে গিয়ে নমস্কার করলেন, ‘নমস্কার। আমার মেয়ে দীপাকে একটু বাড়িতে নিয়ে যেতে চাই যদি আপনার আপত্তি না থাকে।’
‘এখন তো কলেজ খোলা। কোনও জরুরি কারণ আছে?’
‘হ্যাঁ। আমাদের এক—।’ নিজেকে সামলে নিলেন অমরনাথ। আত্মীয় শব্দটা ব্যবহার করলে যদি আবার দীপার কাছে বিপাকে পড়তে হয়। তিনি বললেন, ‘একজন খুব কাছের মানুষ মারা গিয়েছেন—।’
‘ও হো। তা হলে তো নিশ্চয়ই যাবে। ও আছে হস্টেলে?’
‘হ্যাঁ।’
‘সেকী। কলেজে যায়নি?’
‘যাচ্ছিল। পথে আমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল।’
‘ও। ঠিক আছে। নিয়ে যান। তবে এখন তো রোজ ক্লাস হচ্ছে। বেশিদিন অ্যাবসেন্ট থাকলে ও পিছিয়ে যেতে পারে।’ বড়দি চলে গেলেন।
জিনিসপত্র নিয়ে দীপা যখন নেমে এল নীচে তখন অমরনাথ অবাক হয়েছিলেন। টিনের ট্রাঙ্কটাতে না হয় জামাকাপড় বইপত্তর নিচ্ছে, কিন্তু বিছানা নিয়ে যাওয়ার তো কোনও কারণ নেই। তিনি একটু বিরক্তগলায় কারণটা জানতে চেয়েছিলেন।
দীপা অমরনাথের মুখের দিকে না তাকিয়ে জবাব দিয়েছিল, ‘এগুলো বাড়ি থেকেই এনেছিলাম। এখানে রেখে যাওয়ার তো কোনও মানে হয় না।’
‘মানে হয় না। ফিরে এসে শোবে কোথায়?’
‘আমি তো ফিরে আসব না।’
‘ফিরে আসব না মানে?’ প্রায় আকাশ থেকে পড়েছিলেন অমরনাথ।
‘আমি আর পড়ব না।’ এবার তাঁর মুখের দিকে তাকিয়েছিল দীপা।
‘পড়বে না? সে কী?’ কথা খুঁজে পাচ্ছিলেন না তিনি।
‘হ্যাঁ। চলো।’
‘আমি বুঝতে পারছি না তুমি কী বলছ!’
‘তুমি এতদিন আমাকে সত্যি কথা বলোনি। তুমি বলেছিলে মিস্টার রায় আমার রেজাল্ট দেখে ওঁর ফান্ড থেকে পড়াশুনার খরচ দিচ্ছেন। এত টাকা ভাল অবস্থার মেয়েরাই পায় না বলে আমার কেমন লেগেছিল কিন্তু তোমার কথা আমি বিশ্বাস করেছিলাম। এখন যখন জানতে পেরেছি তুমি ওদের কাছ থেকে হাত পেতে টাকা নিয়ে ব্যাঙ্কে রেখে আমাকে পড়াচ্ছ, তখন আর সেই টাকায় পড়ার কোনও ইচ্ছে আমার নেই।’
ফাঁপরে পড়লেন অমরনাথ। এবং সেটা ঢাকতে প্রায় চিৎকার করেই উঠলেন, ‘তুমি বড্ড বাড়াবাড়ি করছ। কে টাকা দিচ্ছে, কোত্থেকে টাকা আসছে, এসব তোমার ভাবার কোনও দরকার নেই। তোমার কাজ পড়াশুনা করা, সেইটেই করো।’
দীপা তাকিয়ে দেখল হস্টেলের কাজের লোকেরা অমরনাথের কথা বলার ধরনে আকৃষ্ট হয়ে উঁকিঝুঁকি মারতে আরম্ভ করেছে। সে বলল, ‘এসব কথা এখানে দাঁড়িয়ে না বললেই ভাল হয়। তুমি কি যাবে?’
ওই প্রশ্নের পর আর কথা বাড়াননি অমরনাথ। দুটো রিকশা ডেকে তার একটায় মালপত্তর সমেত মেয়েকে তুলে দিয়েছিলেন। দ্বিতীয়টিতে উঠে বসে রাগ অভিমান আর অসহায়তার মিশেল নিয়ে দিশেহারা হয়ে চলেছিলেন তিস্তার ঘাটের দিকে।
অঞ্জলি ইতিমধ্যে আলো জ্বেলে দিয়েছে। ছেলেরা বড় হয়ে গেছে। তাদের কৌতূহল এখন স্বাভাবিক। দিদি বাক্স-প্যাঁটরা নিয়ে কলেজ থেকে ফিরে এসেছে কেন সেটা জানতে চেয়েছে মায়ের কাছে। দিদি ঠাকুমার ঘরের দরজা বন্ধ করে রেখেছে। তার কাছে পৌঁছানোর উপায় নেই। তা ছাড়া তার গাম্ভীর্যের কারণে সব কথা জিজ্ঞাসা করা যায় না। ভেতরের বারান্দায় হ্যারিকেন জ্বালাতে জ্বালাতে অঞ্জলি বলেছিল, ‘সব ব্যাপারে এত আগ্রহ কেন? তোমরা তোমাদের মতো থাকো।’
বড়টা জিজ্ঞাসা করল, ‘দিদির শ্বশুর মরে গেছে?’
‘হ্যাঁ। কেউ মারা গিয়েছে শুনলে এভাবে প্রশ্ন করতে নেই।’
‘দিদি কি আর পড়বে না?’
‘জানি না।’
‘না পড়লে দিদি কী করবে? দিদির কি আবার বিয়ে হবে?’
সঙ্গে সঙ্গে ছোটটা বলল, ‘এম্মা। দিদি তো বিধবা। বিধবার বিয়ে হয়?’
বড় জবাব দিল, ‘হয়। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিধবাবিবাহ প্রবর্তন করেছেন।’
ছোট জানতে চাইল, ‘তা হলে ঠাকুমার বিয়ে হয়নি কেন?’
অঞ্জলি এবার কড়া ধমক দিল। এ-ব্যাপারে আর কোনও কথা ওদের মুখ থেকে শুনতে চায় না জানিয়ে বাইরের ঘরে চলে এল আলো নিয়ে। আবছা অন্ধকারে মা আর ছেলে বসে ছিলেন। আলো টেবিলে রেখে অঞ্জলি বলল, ‘মাস্টারমশাই এখনও এলেন না কেন?’
অমরনাথ ভাঙা গলায় বললেন, ‘ওঁকে কেন খবর দিতে গেলে।’
মনোরমা বললেন, ‘পারলে একমাত্র উনিই পারবেন। পড়াশুনার ব্যাপারে মাস্টারের কথাই দেখেছি ও বেদবাক্য বলে মনে করে।’
অমরনাথ তাঁর আপত্তি জানালেন, ‘ঘরের কেচ্ছা বাইরের লোকে জানবে।’
‘কেচ্ছা আবার কী! এ তো ঘরে ঘরেই হয়। তা ছাড়া মাস্টার সেরকম মানুষ নয়। হাজার হোক মেয়েটাকে খুব স্নেহ করে।’ মনোরমা দৃঢ় গলায় বললেন।
এইসময় বাইরের বারান্দায় পায়ের শব্দ হল। এবং সেইসঙ্গে সত্যসাধন মাস্টারের গলা ভেসে এল, ‘অমরনাথবাবু আছেন নাকি?’
অঞ্জলি চটপট এগিয়ে গিয়ে ভেজানো দরজা খুলে বলল, ‘আসুন।’
‘কী ব্যাপার? হঠাৎ জরুরি তলব। দীপার কিছু হইছে নাকি?’ বলতে বলতে সত্যসাধনবাবু ঘরে ঢুকলেন। অমরনাথ ওঠার একটু চেষ্টা করে আবার গা এলিয়ে দিলেন। মনোরমা বললেন, ‘বসুন মাস্টারমশাই। আপনার সঙ্গে কথা আছে।’
সত্যসাধনবাবু বসলেন। তাঁর লংক্লথের পাঞ্জাবি থেকে ঘামের গন্ধ পেল অঞ্জলি দরজা বন্ধ করে পাশ দিয়ে আসার সময়। সত্যসাধনবাবু অমরনাথের দিকে তাকালেন, ‘দীপামায়ের কিছু হইছে নাকি? সে আছে কেমন?’
অমরনাথ জবাব দিলেন না। মনোরমা বললেন, ‘দীপা এখানে চলে এসেছে।’
‘তার কলেজ বন্ধ?’ সত্যসাধন মাস্টার ব্যাপারটা বুঝতে পারছিলেন না।
মনোরমা মাথা নাড়লেন, ‘না। আপনাকে সব কথা খুলে বলি। ব্যাপারটা আমাদের পরিবারের গোপন বিষয়। কিন্তু আপনাকে আমি বিশ্বাস করছি কারণ আপনি দীপাকে ভালবাসেন। আপনি জানেন ওর বিয়ে এবং বিধবা হবার ঘটনা। সে সব মন থেকে সরিয়ে ফেলেছিল। আপনি তখন ওকে সাহায্য করেছিলেন। জলপাইগুড়ির কলেজে যখন পড়তে যাওয়ার কথা হল তখন ওর শ্বশুরমশাই নিজে অমরকে ডেকে অনুনয় করলেন যেন দীপার পড়ার খরচ তাকে দিতে দেওয়া হয়। তিনি প্রায়শ্চিত্ত করতে চান। তা সরাসরি না দিয়ে টাকাটা তিনি ব্যাঙ্কে অমর আর দীপার নামে রেখেছিলেন। ব্যাঙ্ক থেকে প্রতি মাসে হস্টেলে পাঠিয়ে দিত। অমর একথা দীপাকে বলেনি। মেয়ের যা জেদ তাতে বললেও শুনত না। এই চলছিল। ওর শ্বশুর খুবই অসুস্থ ছিলেন। আজ সকালে মারা গিয়েছেন। তা তাঁর উত্তরাধিকারী বলতে দীপা। অমর দীপাকে নিয়ে গিয়েছিল সেই বাড়িতে। সেখানে গিয়ে মেয়ের মাথা বিগড়ে গিয়েছে। অমরকে অপমান করেছে। আর সব জিনিসপত্র নিয়ে হস্টেল ছেড়ে চলে এসেছে পড়াশুনা করবে না বলে।’
সত্যসাধন মাস্টার চুপচাপ শুনছিলেন। এবার নিচু গলায় জানতে চাইলেন, ‘কেন?’
এবার অমরনাথ আচমকা গলা তুলে বললেন, ‘তার মান গিয়েছে। প্রতুলবাবুর টাকায় তিনি পড়বেন না। আমাকে লোভী বললেন। লোভ? আরে কার জন্যে আমি করছি? নিজের জন্যে না ছেলেদুটোর জন্যে? তোরই তো ভাল চাই।’
অঞ্জলি চাপা গলায় ধমকে ওঠে, ‘আঃ। কী হচ্ছে কী? এসব কী বলছ চিৎকার করে? মেয়েটা শুনতে পেলে ভাল হবে?’
‘পাক। এ-বাড়িতে ওর ভয়ে আমাকে চুপ করে থাকতে হবে? হস্টেলে থেকে মেয়ে বিদ্যেধরী হবে, আমার পয়সায় পড়লে বাকিদের বঞ্চিত করা হবে এ-চিন্তা তার মাথায় কখনও এসেছে? এত জেদ কীসের, অ্যাঁ?’ ক্ষিপ্ত দেখাচ্ছিল অমরনাথকে।
মনোরমা শান্ত গলায় বললেন, ‘অমর, তুই যদি এমন করবি তা হলে আর কথা বলে লাভ কী! মাস্টারমশাইকে কষ্ট দিয়ে ডেকে আনলাম।’
অমরনাথ হাত নাড়লেন অসহায়ভাবে কিন্তু মুখে কোনও কথা বললেন না।
সত্যসাধন মাস্টার চুপচাপ শুনছিলেন এতক্ষণ। এবার বললেন, ‘আমি একটা কথা সাপোর্ট করি না। অমরনাথবাবু তার গুরুজন। উনারে সে যদি অপমান কইরা থাকে তা হলে এতদিনের সব শিক্ষা বৃথা। পিতা ও মাতা দেবতার মতো।
‘হয়তো হত। যদি আমি নিজের বাবা হতাম। আমি কাক, কোকিলের ডিমকে নিজের ডিম ভেবে এতকাল তা দিয়েছি।’ অমরনাথ আক্ষেপ করলেন।
হঠাৎ অঞ্জলি চাপা গলায় ধিক্কার দিয়ে উঠল, ‘ছিঃ।’
শব্দটা এমন জোরালো ছিল যে ঘরের সবাই একই সঙ্গে তার মুখের দিকে তাকাল। অঞ্জলি বলল, ‘তুমি ওই কথাটা উচ্চারণ করতে পারলে?’
অমরনাথ স্ত্রীর চোখে চোখ রাখতেই কুঁকড়ে গেলেন। দু’হাতে কপাল চেপে ধরলেন তিনি। সত্যসাধন মাস্টার উঠে এলেন তাঁর পাশে, ‘ঠিক আছে, আপনার মনের অবস্থায় মাথা ঠান্ডা রাখা সত্যই মুশকিল। কিন্তু সে অনেক ছোট। আমাদের তো একটু উদার হতেই হয়। আপনি নিজেকে সংযত করেন অমরনাথবাবু।’
অমরনাথ কোনও জবাব দিলেন না। কিন্তু তাকে খুবই অনুতপ্ত দেখাচ্ছিল।
সত্যসাধন মাস্টার ঘুরে দাঁড়ালেন, ‘সে কোথায়?’
মনোরমা গালে হাত দিয়ে বসেছিলেন, ‘আমার ঘরে বসে আছে দরজা বন্ধ করে।’
সত্যসাধন মাস্টার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তার লগে তো কথা কওয়া দরকার।’
মনোরমা অঞ্জলির দিকে মুখ ফেরালেন, ‘যাও, বলো মাস্টারমশাই দেখা করতে এসেছেন।’ অঞ্জলি পা বাড়াচ্ছিল, মনোরমা আবার ডাকলেন, ‘বউমা। আজ তোমরা মাথা গরম করছ। কিন্তু যেদিন ওই একদিনের বাচ্চাকে নিয়ে এসে তুমি আমার অনুমতি চেয়েছিলে সেদিন আমি কী বলেছিলাম মনে আছে?’
অঞ্জলি জবাব দিল না।
মনোরমা অপেক্ষা করলেন না, ‘আমি আপত্তি করিনি। শুধু বলেছিলাম আমৃত্যু মাথায় এই চিন্তা এনো না যে সে তোমাদের রক্তে জন্মায়নি। আজও বলি, চিন্তাটা মাথায় এলে তোমরা যেমন কষ্ট পাবে সেও তা থেকে বাদ যাবে না। এতদিনের পরিশ্রম তো মিথ্যে ছিল না। তা হলে আজ কেন ওসব কথা তুলছ তোমরা।’
অঞ্জলি একবার শাশুড়ি আর একবার স্বামীর দিকে তাকাল। তার মনে হল এই কথাগুলো মনোরমা অমরনাথকে শোনানোর জন্যই বলছেন। মনটা খানিক হালকা হল তার। সে কোনও কথা না বলে ভেতরে চলে এল।
মনোরমার বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে অঞ্জলি ডাকল, ‘দীপা।’
প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ভেতর থেকে জবাব এল, ‘আমাকে এখন বিরক্ত কোরো না।’
বলার ভঙ্গি এবং কথাগুলো শুনে অত্যন্ত বিরক্ত হল অঞ্জলি। সে উষ্ণ গলায় বলল, ‘তোমাকে বিরক্ত করার বিন্দুমাত্র বাসনা আমার নেই। সত্যসাধন মাস্টার এসেছেন, তিনি তোমাকে ডাকছেন বলেই আমাকে আসতে হল। কী বলব দয়া করে বলে দাও।’
এতেই কাজ হল। ধীরে ধীরে দরজা খুলল। কিন্তু মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে সমস্ত উষ্ণতা উধাও হয়ে গেল অঞ্জলির। দীর্ঘ সময় ধরে কাঁদলে কোনও মানুষের মুখ এমন ফুলে যায়। কিন্তু নিজেকে সংযত করল সে। কোনও কথা না বলে মেয়ের আগে আগে বাইরের ঘরের দরজা পর্যন্ত এসে ইঙ্গিতে মনোরমাকে জানাল দীপা আসছে।
সত্যসাধন মাস্টার দেখলেন অত্যন্ত কুণ্ঠিত ভঙ্গিতে দীপা এসে দরজায় অঞ্জলির পাশে দাঁড়াল। তিনি ডাকলেন, ‘এখানে আসো। এই খাটের উপরে বসো।’
দীপা চোখ তুলে মাস্টামশাইকে দেখল। তারপর হঠাৎই সব কুণ্ঠা ঝেড়ে ফেলে ঘরের এ-প্রান্তে খাটের কাছে এসে ঠেস দিয়ে দাঁড়াল। সে ভুলেও একবারও অমরনাথের দিকে তাকাল না। সত্যসাধন তাঁর ছাত্রীর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়েছিলেন। এবার বললেন, ‘তোমাকে একটা প্রশ্ন করি। কোনও বস্তু গ্রহণ করার সময় লজ্জা, মান সম্মান, দারিদ্র্য, অর্থকে প্রতিবন্ধক হিসাবে কল্পনা করে নির্বোধরা?’
দীপা জবাব দিল না। তার ঠোট মৃদু নড়ল মাত্র।
সত্যসাধন মাস্টার মাথা নাড়লেন, ‘জবাব দাও। তোমারে এতকাল যা শিক্ষা দিলাম তার কতটা গ্রহণ করছ দেখি।’
‘ভালবাসা।’ দীপা জবাব দিল নিচু গলায়।
সম্ভবত এই উত্তরটা আশা করেননি সত্যসাধন। তিনি সোজা হয়ে বসলেন। তারপর হেসে বললেন, ‘ঠিক। কারেক্ট। আর?’
দীপা মাথা নাড়ল। সে জানে না।
‘শিক্ষা।’ সত্যসাধন নিজেই উত্তরটা দিলেন, ‘শিক্ষিত হইতে চাইলে কোনও লজ্জা মান সম্মান অভিমানকে প্রশ্রয় দেওয়া বোকামি।’
‘আত্মসম্মান?’
‘হ্যাঁ। আত্মসম্মানও। কারণ এটি এমন এক বস্তু যে চিরকাল একই চেহারায় থাকে না। তোমার আত্ম কাজ যে-সকল জিনিসের দ্বারা অপমানিত বোধ করতেছে তা আগামীকাল সেইভাবে না-ও ভাবতে পারে। বয়স অভিজ্ঞতা এবং শিক্ষা মানুষকে উদার করে। উদারতা অনেক সময় মান অপমান বোধকে চালিত করে। আজ যে-ব্যাপারে তোমার আত্মসম্মানে আঘাত লাগতেছে কাল সেটা গুরুত্বহীন হইতে পারে। কিন্তু শিক্ষা কখনওই বৃথা যায় না। বিদ্যার জন্য মানুষ, প্রকৃত মানুষ চিরকাল নত মস্তকে থাকে। বিদ্যা বিনয় দান করে। আবার বিনীত না হইলে বিদ্যার্জন সম্ভব নয়। আশা করি আমার কথা তোমার বোধগম্য হইতেছে?’
‘আমি ওদের বাড়ির টাকায় পড়াশুনা করব না।’
‘কারণ?’
‘ওদের সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্ক স্বীকার করি না।’
‘তাঁরা তো কেউ জীবিত নাই।’
‘কিন্তু আমার কাছে সমস্ত ব্যাপারটা লুকিয়ে রাখা হয়েছিল।’
‘স্নেহ অতি বিষমবস্তু। অমরনাথবাবু তোমার মানসিকতা বুঝিয়াই তোমারে তখন কিছু জানান নাই। হ্যাঁ, সেই কাজটা ঠিক হয় নাই।’
‘কিন্তু কেউ করুণা করে আমাকে টাকা দিয়েছে পড়াশুনা করতে—।’
‘করুণা? এটা কী বললা? তুমি জানতা কোনও এক বড়লোক তাঁর ট্রাস্টি হইতে তোমার পড়াশুনার খরচ দিতেছে। সেইটারে করুণা ভাবো নাই কেন?’
‘ভেবেছিলাম এটা অনেকেই পেয়ে থাকে?’
‘খোঁজ নিছিলা তোমাদের কলেজের আর কেউ ওই টাকা পায় কিনা?’
‘না।’
‘কেন? এ-ব্যাপারে আগ্রহ হয় নাই কেন?’
‘টাকাপয়সার ব্যাপারে আমার কখনও আগ্রহ হয়নি।’
‘চমৎকার। আজ নতুন কইরা আগ্রহের কী দরকার! শোনো মা, টাকার গায়ে কারও নাম লেখা থাকে না। পাপীর টাকা যদি পুণ্যের জন্য ব্যয় হয় তাইলে সেটায় আর পাপের গন্ধ থাকে না।’
দীপা জবাব দিল না। কিন্তু তার ভঙ্গি দেখে বোঝা যাচ্ছিল এসব কথায় সিদ্ধান্ত বদল করতে রাজি নয়। সত্যসাধন মাস্টারও ব্যাপারটা বুঝতে পারলেন। একটু হেসে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আচ্ছা, ধরো তোমার কথাই ঠিক। তাইলে এখন তুমি কী করবা?’
মাথা নাড়ল দীপা, ‘জানি না।’
‘চমৎকার। এত দিন এত বছর যত পরিশ্রম করছ সব জলাঞ্জলি দিয়া যদি ঘরে বইস্যা থাকো তাইলে তো তুমি আমার মুখ সত্যি উজ্জ্বল করবা।’
দীপা কথাগুলো শুনে করুণ চোখে তাকাল। একটু ভেবে বলল, ‘আমি না হয় প্রাইভেটে পরীক্ষা দেব।’
‘না হয়! যেন কোনও কিছু করার নাই বইল্যাই পরীক্ষা দেবা? ছি ছি। এই চা-বাগানে কার কাছে তুমি পড়বা? প্রাইভেটে পরীক্ষা দেওয়া যদি সোজা হইত তাইলে কেউ কলেজে ভরতি হইত না।’
এবং এই প্রথম কান্নায় ভেঙে পড়ল দীপা। সত্যসাধন মাস্টার এবার অপেক্ষা করলেন। যতক্ষণ দীপা শান্ত না হয় ততক্ষণ তিনি চুপ করে রইলেন। নিশ্বাস খানিক স্বাভাবিক হয়ে এলে দীপা বলল, ‘ওদের টাকায় পড়াশুনা করার কথা ভাবলে মনে হয় গায়ে নোংরা লাগল। বিয়ের দু’দিনের কথা তখন কিছুতেই ভুলতে পারি না। তা ছাড়া বাবা কেন আমার কাছে সব লুকিয়ে রাখল। একদিন-না-একদিন আমি নিশ্চয়ই জানতে পারতাম। লুকিয়ে রেখে কী লাভ হল!’
সত্যসাধন মাস্টার বললেন, ‘আমি তো প্রথমেই বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করছি। অমরনাথবাবু কাজটা ঠিক করেন নাই। কিন্তু তুমিও খুব অন্যায় করতেছ দীপা।’
‘অন্যায়?’ দীপা চোখ তুলল।
‘নিশ্চয়। বিদ্যার গায়ে কাদা লাগে না। কেউ যদি কোনওদিন কোনও খারাপ কাজ করে তাইলে নিজেকে রেক্টিফাই করা চলবে না, এ কী ধরনের কথা? তুমি তো অনেক সময় ভুল কইর্যা পরে আমার কাছে ক্ষমা চাইছ, আমি যদি ক্ষমা না করতাম? আমি যদি আর তোমারে পড়াইতে আসতাম? তোমার শ্বশুর প্রায়শ্চিত্ত করবার চেষ্টায় ছিলেন। সেইটা তো মিথ্যা নয়। সেই চেষ্টারে তুমি কেন অসম্মান করবা। যাও, ঘরে যাও, এখনই তোমার মতামত দিতে হইব না। আমার কথাগুলান ভাবো। কাল সক্কালে আসবা আমার কাছে। যাও।’
দীপা মাস্টারমশাইয়ের দিকে একবার তাকিয়ে ধীরে ধীরে ঘর ছেড়ে ভেতরে চলে গেল। মনোরমা অঞ্জলিকে ইশারা করতেই সে মেয়ের সঙ্গ নিল। সত্যসাধন মাস্টার উঠে দাঁড়ালেন, ‘এখন চলি অমরনাথবাবু, চলি মা।’
মনোরমা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী বুঝলেন?’
‘কাল সকাল পর্যন্ত ওরে কিছু না বলাই ভাল। কিন্তু একটা কথা অমরনাথবাবু, ইউ শুড বি প্রাউড অফ ইয়োর ডটার। দীপার মতো ছাত্রী পাইছি বইল্যায় আমিও আজ গর্বিত। নমস্কার।’ ব্যাগ থেকে টর্চ বের করে বাইরের দরজা খুলে বারান্দায় পা রাখলেন সত্যসাধন মাস্টার।
মাঠের ভিতর দিয়ে আসাম রোডে পৌঁছানো পর্যন্ত তিনি অন্যমনস্ক ছিলেন। ওইটুকুনি একটি মেয়ে এতখানি আত্মসম্মানবোধ কী করে অর্জন করল? এতক্ষণ যত উপদেশই তিনি দিয়ে থাকুন সেগুলো যে খুব জোরালো নয় তা তাঁর চেয়ে আর কে বেশি জানে। এখন মনে হচ্ছে দীপারও সেটা বুঝতে অসুবিধে হয়নি। কিন্তু তিনি কী করতে পারতেন? সংগত কারণেই জেদ দেখিয়ে সরে দাঁড়ালে মেয়েটা সারাজীবন মুখ থুবড়ে পড়ে থাকবে। নিজের পায়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার চেষ্টা ও ক্ষমতা আছে এমন ছাত্রছাত্রী তিনি কখনওই পাননি। দীপা ব্যতিক্রম। সেই দাঁড়াবার মুহূর্তে যদি অভিমান বা আত্মসম্মানবোধ এসে আঘাত করে তা হলে তিনি সমর্থন করতে পারেন না। ভাল কাজের জন্যে কখনও কখনও মন্দের সঙ্গে সমঝোতা করতে হয়। তিনি দীপাকে তাই করার উপদেশ দিয়েছেন।
আসাম রোড নির্জন। দু’পাশে বড় বড় দেওদার গাছে ঝিঁঝি ডাকছে। বেশ কিছুটা দূরে চা-বাগানের বাবুদের কোয়ার্টার্সে জ্বলা হ্যারিকেনের টিমটিমে আলো অন্ধকারকে আরও ঘন করে তুলেছে। টর্চের আলো মিইয়ে এসেছে। এ-মাসে স্কুলে মাইনে হয়নি। এমনিতে হাতে যা পান তাতে দু’বেলা ভাত-ডালের বেশি কিছু জোটে না। ব্যাটারি কেনার টাকা এখনই জোগাড় করার কথা চিন্তা করতে পারেন না তিনি। তাই পথ চলতে মাঝে মাঝে সুইচ টিপে টর্চ নিবিয়ে রাখছিলেন। একবার জ্বেলে যতটা হাঁটা যায়।
আংরাভাসার পুলের কাছে এসে তিনি মানুষটাকে দেখতে পেলেন। টর্চের আলো পায়ের কাছে ফেলে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কে?’
‘আমাকে তো চেনার কোনও কারণ নেই।’ গলার স্বরে বোঝা গেল বক্তার বয়স হয়েছে কিন্তু ব্যক্তিত্ব অটুট। কাছাকাছি হতেই সত্যসাধন আবিষ্কার করলেন মানুষটির পরনে গেরুয়া লুঙ্গি এবং ফতুয়া, কাঁধে ব্যাগ আর মুখে সাদা দাড়ি। তাঁকে এটা দেখার জন্যে টর্চ জ্বালাতে হয়েছিল।
‘আপনাকে এর আগে তো দেখি নাই।’
‘হ্যাঁ। আমি এইমাত্র পৌঁছেছি। চা-বাগানটা কি ওই দিকে?’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ। কার কাছে যাইবেন? মানে, এই অন্ধকারে তো ঠাওর করা মুশকিল। আপনি আগে আসেন নাই, আপনার তো অসুবিধা আরও বেশি।’
‘অমরনাথ মুখোপাধ্যায়। সে তো এই চা-বাগানেই চাকরি করে?’
‘হ্যাঁ। আমি তাঁর কোয়ার্টার্সে ছিলাম এতক্ষণ। ঠিক আছে, চলেন আমি আপনারে নিয়া যাই।’ সত্যসাধন মানুষটিকে নিয়ে হাঁটা শুরু করলেন। বেশ কৌতুহল হচ্ছিল তাঁর। হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি সন্ন্যাসী বইল্যা মনে হয়!’
‘হ্যাঁ। যোশীমঠের কাছে আমার আশ্রম। নিজের প্রয়োজনেই অনেক খোঁজাখুঁজি করে এখানে এসেছি। আপনি ওদের ভাল করে চেনেন?’
‘ঘনিষ্ঠভাবে চিনি। অমরনাথবাবুর কন্যার গৃহশিক্ষক ছিলাম আমি।’
‘ছিলেন মানে?’
‘ছাত্রী বড় হইয়া কলেজে ভরতি হইছে।’
‘ও। আর কে কে আছে ওদের বাড়িতে?’
‘অমরনাথবাবুর স্ত্রী, দুই পুত্র, মা।’
‘সন্ন্যাসী নিশ্বাস ফেললেন, ‘অমরনাথের জননী জীবিত?’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ। তাঁকে তো তেমন বয়স্কা মনে হয় না। কিছু যদি মনে করেন, আপনার লগে ওঁদের কী সম্পর্ক?’
‘এখন কোনও সম্পর্ক নেই। বুঝতেই পারছেন, আমি কিছুই জানি না।’
আসাম রোড ছাড়িয়ে মাঠের ভেতর দিয়ে ততক্ষণে তাঁরা অমরনাথের কোয়ার্টার্সের সামনে পৌঁছে গিয়েছেন। সত্যসাধন মাস্টার দরজার কড়া নাড়তেই ভেতর থেকে অঞ্জলির গলা পাওয়া গেল, ‘কে?’
সত্যসাধন বললেন, ‘আমি মাস্টারমশায়। একটু দরজাটা খোলেন।’
অঞ্জলি হ্যারিকেন হাতে দরজা খুলতেই সত্যসাধন মাস্টার বললেন, ‘ইনি আপনাদের লগে দেখা কইরতে আইছেন। আমি কোয়ার্টার্স চিনাইয়া দিলাম।’
অঞ্জলি হ্যারিকেন ওপরে তুলতেই গেরুয়াবসনধারী সন্ন্যাসীকে দেখতে পেল। সে খুব আশ্চর্য হয়ে বলল, ‘বলুন।’
সন্ন্যাসী বললেন, ‘তোমার পরিচয় জানতে পারি?’
সত্যসাধন জবাব দিলেন, ‘উনি অমরনাথবাবুর পরিবার।’
‘ও। সে কোথায়?’
অঞ্জলি বলল, ‘উনি খুব ক্লান্ত। শুয়ে আছেন।’
‘অ। অমরনাথের জননীকে ডেকে দেওয়া যেতে পারে?’
‘আপনি ভেতরে এসে বসুন।’
সন্ন্যাসী একটু ইতস্তত করে বাইরের ঘরে ঢুকে নিজেই মোড়া টেনে নিলেন। অঞ্জলি দশাসই মানুষটির দিকে সভয়ে তাকাল। খুব সাধারণ চেহারার মানুষ নন ইনি এমন ধারণা জন্মাল। সত্যসাধন মাস্টার বললেন, ‘আমি তাইলে চলি। নমস্কার।’
বাইরের দরজাটা বন্ধ না করে অঞ্জলি ভেতরে এল। শোওয়ার ঘরে অমরনাথ তখন খাটে লম্বা হয়ে চোখে হাত চাপা দিয়ে পড়ে আছেন। অঞ্জলি তাঁর কাছে এসে চাপা গলায় বলল, ‘শুনছ, একজন সন্ন্যাসী এসে প্রথমে তোমার, তারপর মায়ের খোঁজ করছেন। বাইরের ঘরে বসে আছেন।’
হাত সরালেন চোখ থেকে অমরনাথ, ‘সন্ন্যাসী? ধুত। চলে যেতে বলল।’
‘কী করে বলব?’
‘কী করে বলবে মানে? রাত দুপুরে সন্ন্যাসীর সঙ্গে কথা বলার মেজাজ এখন আমার নেই। বলে দাও ধর্মটর্মে আমার কোনও আস্থা নেই।’ মুখ ব্যাজার করলেন অমরনাথ, ‘শুধু পয়সা বাগাবার ধান্দা।’
‘উনি মায়ের সঙ্গে দেখা করতে চাইছেন।’
‘বেশ তো। মাকে গিয়ে বলো।’
‘মেয়েটার এই অবস্থা আর বাড়িতে সন্ন্যাসী এল, কোনও যোগাযোগ আছে কিনা কে জানে?’ বিড়বিড় করতে করতে অঞ্জলি মনোরমার ঘরের দিকে পা বাড়াল। দরজা ঠেলে দেখল দীপা খাটের ওপর চুপচাপ বসে আছে। মনোরমা তাঁর ঠাকুরের সামনে বাবু হয়ে বসে জপ করছেন। অঞ্জলি মৃদু গলায় ডাকল, ‘মা’
মনোরমা প্রথমবারে সাড়া দিলেন না। দ্বিতীয়বারে নিঃশব্দে তাকালেন।
অঞ্জলি বলল, ‘একজন সন্ন্যাসী এসেছেন। আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাইছেন।’ মনোরমার মুখে বিরক্তি ফুটে উঠল। জপের সময় তিনি কথা বলতে চান না। আজ বিকেল থেকে বাড়িতে যে-ঝড় বইছে তাতে ঠাকুরের সামনে নিশ্চিন্তে বসার সুযোগ পাননি। তিনি মুখ ঘুরিয়ে আবার জপে মন দিলেন।
অঞ্জলি বুঝল শাশুড়ি উঠবেন না এখন। সে বলল, ‘ওঁকে বসিয়ে রাখছি।’
মনোরমা ঈষৎ ঘুরে দীপাকে ইঙ্গিত করলেন। ইঙ্গিতটা দীপা বুঝল। সে খানিকটা অনিচ্ছা নিয়ে খাট থেকে নেমে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এল। ব্যাপারটা অঞ্জলিকে আহত করল। দীপাকে না পাঠিয়ে মনোরমা তাকেই ইশারাটা করতে পারতেন। দীপা ততক্ষণে ভেতরের ঘরের দিকে পা বাড়িয়েছে। কৌতূহল নিয়ে অঞ্জলি অভিমান সত্ত্বেও মেয়েকে অনুসরণ করল।
বাইরের ঘরে পৌঁছে দীপা দেখল সন্ন্যাসী তার দিকে তাকিয়ে আছেন। লোকটির চাহনি অত্যন্ত সতেজ। দীপা বলল, ‘ঠাকুমা এখন ব্যস্ত। কী বলবেন আমাকেই বলতে পারেন।’
সন্ন্যাসী হাসলেন, ‘সব পাত্রে কি সব জিনিস রাখা যায়? তোমার ঠাকুমা কখন ব্যস্ততামুক্ত হবেন?’
দীপা জিজ্ঞাসা করল, ‘কী ব্যাপার বলুন তো? আপনি কি ঠাকুমাকে চেনেন?’
‘এ-প্রশ্নও অবান্তর। চিনতে পারা খুব কঠিন কর্ম। তোমার নাম?’
‘দীপাবলী?’
‘তুমি, তোমার বিবাহ হয়েছিল?’
‘একথা সবাই জানে।’
‘কিন্তু তুমি খুব তেজি মেয়ে। ভাল, খুব ভাল। দ্যাখো, আমি তোমাদের এখানে ভবিষ্যদ্বাণী করতে আসিনি। আমি এসেছি আমার প্রয়োজনে। তোমার বাবা কি একবার এখানে আসতে পারবেন না?’
এইসময় পেছনে চটির আওয়াজ হল। দীপা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল অমরনাথ দরজায় এসে বলছেন, ‘কী ব্যাপার বলুন! রাত দুপুরে কারও কাছে আসা ঠিক নয়।’
সন্ন্যাসী হাসলেন, ‘তোমার নাম অমরনাথ?’ তিনি একবার তাকিয়ে মুখ সরিয়ে নিলেন, ‘বসো। তোমাদের সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।’
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন