সমরেশ মজুমদার
এক দেশলাইবাক্স ফড়িং আর এক কৌটো কেঁচো নিয়ে ওরা তিনজন যখন কোয়ার্টার্সের পেছন দিয়ে নিজেদের লুকিয়ে চা-বাগানের ভেতর ঢুকে পড়ল, তখন আকাশের মেঘের গায়ে ফাটল দেখা দিয়েছে। সূর্যদেবের হদিশ নেই কিন্তু তিনি এখন মধ্যগগন অতিক্রম করেছেন সেটা বোঝা যাচ্ছে। যদিও চা-বাগানের ভেতর এখন একটা স্যাঁতসেঁতে গন্ধ, শেডট্রিগুলোতে ভিজে ছায়া জড়ানো, তবু এখন দিনটার চেহারা একটু পালটাচ্ছে বলে মনে হচ্ছিল। সরু পায়ে চলা পথ দিয়ে ওরা হাঁটছিল। প্রথমে বিশু ছিপ হাতে, মাঝখানে খোকন, সবশেষে দীপা। খোকনকে বিশু বলেছে। ছিপ দুটো লোক তিনজন। দীপা ঠিক করল সে কিছুতেই ছিপ হাতছাড়া করবে না। খোকনের মাছ ধরার ইচ্ছে হলে বিশুরটা নিক।
মাথার ওপর এক ঝাঁক টিয়া শব্দ করে উড়ে গেল। দূরে বড়সাহেবের বাংলো দেখা যাচ্ছে। চা-গাছের সবুজ কার্পেটের ওপর নৌকোর মতো। বাড়িটার আদল ওইরকমই। ওরা তিনজন চটপট পায়ে চলছিল। দূরের আসাম বোড দিয়ে মদেশিয়া মেয়েরা সেজেগুজে হাটে চলেছে। তিনজন কোনও কথা বলছিল না। ক্রমশ গভীর থেকে গভীর চা-গাছের জঙ্গলে ঢুকে গেল ওরা। আর তখনই একটা বীভৎস শব্দ শুনতে পেয়ে বিশু দাঁড়িয়ে পড়ল। দীপা জিজ্ঞাসা করল, কী রে?’ বিশু ঠোঁটে আঙুল চেপে চুপ করতে বলল।
শব্দটা হচ্ছে থেমে থেমে, গোঙানোর মতো। দীপা খোকনের হাত জড়িয়ে ধরল। খোকন বলল, ‘চল ফিরে যাই।’ মাথার ওপর নানান রঙের পাখি সমানে চিৎকার করে যাচ্ছে ঝাঁকে ঝাঁকে। মাঝে মাঝে শেউট্রি থেকে নেমে আবার ওপরে উঠে যাচ্ছে।
বিশু পায়ে পায়ে এগিয়ে চলল। একটু বাঁক নিয়ে সে হাঁ করে থেমে গেল। তারপর হাত নেড়ে ইশারায় ওদের ডাকল। শব্দটা একটু থামতেই ওরা ছুটে এল। বিশু দেখাল হাত তুলে। কয়েকটা চা-গাছ তুলে নেওয়া হয়েছিল কোনও কারণে। সেখানে একটা বিশাল পাইথন সাপ স্থির হয়ে তাদের দেখছে। সাপটা নড়ছে না কারণ ওর মুখের ভেতরে একটা বড়সড় হরিণ ঢুকে আছে। হরিণের সামনের পা দুটো আর শিংওয়ালা মাথাকে গিলতে পারছে না সাপটা। দীপা চিৎকার করে উঠতেই সাপটা নড়বার চেষ্টা করল। খোকন জিজ্ঞাসা করল, ‘কী সাপ রে?’
বিশু বলল, ‘অজগর। হরিণটাকে গিলতে পারছে না। কী বিরাট মুখ, না রে!’
খোকন বলল, ‘আমাকেও গিলে ফেলবে।
বিশু মাথা নাড়ল, ‘এখন পারবে না। শিংদুটো আটকে গেছে না! চল, আমরা এদিক দিয়ে চলে যাই।’ সে আবার হাঁটতে শুরু করলে বাকি দু’জন অনুসরণ করল। দীপা বলল, ‘ফেরার সময় এই রাস্তা দিয়ে আমি মোটেই আসছি না বাবা।’
খোকন জায়গাটা অতিক্রম করে হালকা গলায় বলল, ‘এইজন্যেই তুই মেয়ে।’
সঙ্গে সঙ্গে ভীষণ রাগ হয়ে গেল দীপার। সটান একটা চড় মারল খোকনের মাথায়। মেরে রুখে দাঁড়াল। আচমকা চড় খেয়ে থোকন চিৎকার করে উঠল, ‘তুই আমাকে মারলি কেন?’
দীপা রাগত গলায় বলল, ‘বেশ করেছি। আমি তোকে সাবধান করে দিচ্ছি কখ্খনত্ত আমাকে মেয়ে বলবি না। মেয়ে তো কী হয়েছে? তুই যা পারিস আমি তা পারি না? ঢিসকল!’
‘তুই আমাকে ঢিসকল বললি?’ খোকন প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ল। দীপা ধাক্কা সহ্য করতে না পেরে মাটিতে পড়ে গেল। এবং পড়েই আবার উঠে এগোতে যাওয়ামাত্র পেছনে সাপটা সেই একই গলায় অনেকক্ষণ বাদে গোঙানি শুরু করল। সঙ্গে সঙ্গে থেমে গেল দীপা। খোকনের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। বিশু দূরে দাঁড়িয়ে চুপচাপ ওদের কাণ্ড দেখছিল। এবার বলল, ‘চলে আয়।’ ডাকটায় কাজ হল। ওর পেছন পেছন হাঁটতে হাঁটতে এরা দু’জন কথা বলছিল না।
একসময় নদীটা দেখা গেল। চা-বাগান আর ফরেস্টের মধ্যে দিয়ে বয়ে গেছে। চওড়ায় বড়জোর ফুট তিরিশেক। স্রোত খুব। ওপাশের ফরেস্টের ছায়া পড়ায় জলের রং কালো। মাঝে মাঝে ফুট পাঁচেক জল কিন্তু বেশির ভাগটাতেই নুড়ি দেখা যাচ্ছে। বিশু নিজে বড় ছিপটা নিয়ে কেঁচো পরাতে বসল। দুটো ছিপই সে একসঙ্গে বয়ে এনেছে। খোকন খপ করে দ্বিতীয় ছিপ নিয়ে নিতেই দীপা চেঁচাল, ‘অ্যাই বিশু, আমার ছিপ যেন আর কেউ না নেয়।’
খোকন ছিপ থেকে সুতো খুলতে খুলতে বলল, ‘ছিপের গায়ে কারও নাম লেখা নেই।’
দীপা চেঁচাল, ‘বিশু বলেছে, বঁড়শি কিনতে আমি পয়সা দিয়েছি।’
কথাটা শোনামাত্র খোকন ছিপ ছুড়ে ফেলে দিল। তারপর পকেট থেকে একটা মোটা কাঠি বের করল। দীপা দেখল কাঠির গায়ে বেশ খানিকটা সবুজ সুতো জড়ানো। খোকন বলল, ‘বিশু, আমাকে কেঁচো দে তো। বান ধরব। দেখি আর কেউ কেমন রুই কাতলা মারে!’
দীপা ছিপ তুলে নিয়ে সরে গেল একপাশে। নদীটার মূল স্রোত উলটোদিকে তাই এপারের এখানটায় জল খানিকটা স্থির। সে দেশলাই বাক্স বের করে একটা ছোট্ট ফড়িং বের করল। করে অসহায় চোখে দু’জনের দিকে তাকাল। দু’জনেই বঁড়শিতে কেঁচো গাঁথছে। ফড়িঙের শরীরের ভেতরে বঁড়শি ঢোকানোর সময় একটু লালচে রস বের হয়। কীরকম ঘিনঘিন করে ওঠে শরীরটা তখন। এখন ওদের কাছে সাহায্য চাইলে খোকন নির্ঘাত হাসবে। মরিয়া হয়ে ফড়িংটাকে বঁড়শিতে গাঁথল দীপা। বাঁকানো বঁড়শিটাকে ফড়িঙের শরীর ঢেকে দিতেই মন ভাল হল। এসব জায়গায় বেশি লোকজন আসে না। মাছমারারা অবশ্য মাঝে মাঝে জাল ফেলে তবে সব জায়গায় নয়। ওরা যায় ডুভুয়া নদীতে। এখানে জাল ফেললে তা নদীর বুকে পাথরে আটকে থাকাই স্বাভাবিক। নদীর গা ঘেঁষে খানিকটা হেঁটে একটু গভীর জল দেখে ছিপ ফেলল দীপা। ফাতনাটা সবে ডুবেছে কি ডোবেনি অমনি সেটা জলের তলায় তলিয়ে গেল। ব্যাপারটা বুঝতেই জোরে টান মারল দীপা। আর সঙ্গে সঙ্গে জলের ওপর রুপোলি ঝিলিক। দীপা আনন্দে চেঁচিয়ে উঠল, ‘দ্যাখ, আমিই প্রথম ধরলাম।’ সরপুঁটি। বঁড়শি থেকে ছাড়াতে গিয়ে ইঞ্চি দুয়েক লম্বা মাছটার মুখ থেকে রক্ত বের হল। একটা চোরকাটা গাছ তুলে নিয়ে তার ডগা মাছের কানকো দিয়ে ঢুকিয়ে মুখের ভেতর থেকে বের করে আনল সে। তারপর মাছটাকে ফেলে রাখল ঘাসের ওপর।
আধঘণ্টার মধ্যে বিশু আর দীপা টপাটপ মাছ তুলতে লাগল জল থেকে। দীপা আড়চোখে দেখেছে। খোকন বারংবার জায়গা পরিবর্তন করেও কিছু পায়নি। সে পাড় থেকে ঝুঁকে বঁড়শিটাকে জলের মধ্যে ডুবিয়ে দিচ্ছে যতক্ষণ না ফাতনা ওপরে ভাসে। বঁড়শি থাকছে মাটির ওপর। এবার খোকন ওপর থেকে সুতো নাচাচ্ছে। খাদ্যবস্তুকে জীবন্ত ভেবে কোনও জলচর প্রাণী এসে গিললেই ফাতনা ডুববে এবং খোকন সেটাকে টেনে তুলবে। কিন্তু ব্যাপারটাই ঘটছে না। দীপা চিৎকার করে বিশুকে বলল, ‘আমার ন’টা হল, তোর ক’টা?’
বিশু জবাব দিল, ‘বারোটা।’
‘রুই কাতলা না ধরতে পারি পুঁটি তো ধরছি।’ দীপা হাসল।
খোকন চলে এল ওর নিজের জায়গা ছেড়ে, ‘এঃ, এই জায়গাটা পুঁটিতে পুঁটিতে ছেয়ে গেছে। সব তেতো পুঁটি। অন্ধও ধরতে পারে।’
দীপা নিজের মনে বলল, ‘নাচতে না জানলে উঠোন বাঁকা।’
খোকন সেই কথায় কান না দিয়ে বলল, ‘বিশু, আমি ওপাশ দিয়ে নদী পার হয়ে ফরেস্টের দিকে যাচ্ছি। ওই জায়গায় ভাল মাছ আছে মনে হচ্ছে। অন্ধকার অন্ধকার।’
বিশু আর একটা মাছ তুলতে তুলতে বলল, ‘অন্ধকারেই তো বানমাছ থাকে। তোর বানের বঁড়শি, পুঁটি উঠবে কেন? তাড়াতাড়ি করিস। সন্ধের আগেই ফিরতে হবে।’
খোকন নদীর উজান ধরে এগিয়ে গেল কিছুটা। তারপর নুড়ি দেখতে পেয়ে জলে নামল। দীপার খুব মজা লাগছিল। যেমন পেছনে লাগতে চাওয়া তেমন শাস্তি, জলে নামতে হল তো। সে দেখল, কখনও কখনও জল খোকনের হাঁটুর অনেক ওপরে উঠে যাচ্ছে। হাফপ্যান্ট উঁচু করে ধরে পা মেপে মেপে শেষপর্যন্ত পার হয়ে গেল সে। তারপর খানিকটা নীচে এসে ঠিক ওদের বিপরীত দিকে দাঁড়িয়ে বঁড়শি ফেলল জলে। ওর পেছনদিকে গভীর জঙ্গলের অন্ধকার। দীপা আবার নিজের মাছ ধরায় মন দিল। এখানে বোধহয় আর পুঁটি নেই। বিশুও সরে গেছে অনেকটা। ফাতনাটা নড়ছে অনেক সময় ধরে ভেসে থাকার পরে। হঠাৎ ওপর থেকে খোকন চিৎকার করে উঠল। কিছু একটা টান দিয়ে ওপরে তুলেছে সে। তারপরেই বলল, ‘একটা ইয়া বড় কাঁকড়া, কী করব?’ বিশু দূর থেকে উত্তর দিল, ‘পা দাঁড় ভেঙে রাখ।’
‘অতবড় দাঁড় আমি ভাঙতে পারব না। খেপে গেছে।’
বিশু জবাব দিল না। খোকন আবার জিজ্ঞাসা করল, ‘কী করব বল না। জলে নেমে যাবে।’
অতএব দীপা কথা না বলে পারল না, ‘পাথর দিয়ে মার ওটাকে।’
শোনামাত্র খোকন একটা পাথর তুলে কাঁকড়াটাকে আঘাত করল। দীপা খুশি হল। মেয়ে বলা হয়েছিল, নিজের ঘটে তো একফোঁটা বুদ্ধি নেই। কিন্তু সে আর মাছ ধরতে পারছে না। হঠাৎ মনে হল ওপারে গেলে হত। কিন্তু জল ডিঙিয়ে যেতে সাহস হল না। সে দেখল বিশু জলে নেমে গেল। স্রোতটা হাঁটুর নীচে। সে জিজ্ঞাসা করল গলা তুলে, জলে নামলি কেন?’ ‘পাথরঠোকরা ধরব। স্রোতে পাথরের গায়ে লুকিয়ে থাকে।’ বিশু জবাব দিল।’
এইসময় খোকন আবার চেঁচাল, ‘বান বান বান।’ দীপা দেখতে পেল জলের ওপরে একটা মোটকা সাপের মতো কিছু কিলবিল করছে। লম্বায় দু’ফুট হবে। বানমাছ বাড়িতে আসে না। অতএব সে যদি মাছটাকে ধরত তা হলে কোনও লাভ হত না। দীপা নিশ্বাস ফেলল। আর তখনই তার চোখ বিস্ফারিত হল। খোকন যেখানে দাঁড়িয়ে বানমাছটাকে বঁড়শি থেকে খোলার চেষ্টা করছে তার হাত পনেরো দূরে একটা ছোট্ট হাতি শুড় দোলাচ্ছে। দেখতে মজার, কিন্তু দীপা শুনেছে বাচ্চা হাতির কাছাকাছি মা হাতি থাকবেই। সে চিৎকার করে বলল, ‘খোকন, তাড়াতাড়ি চলে আয়।’
খোকন বঁড়শিতে গেঁথে-থাকা মাছটাকে দেখিয়ে হাসল, ‘এতবড় মাছ জীবনে ধরেছিস?’
আর্তনাদ করল দীপা, ‘তোর পায়ে পড়ি চলে আয়। হাতি।’ সে হাত তুলে দেখাল জঙ্গলটা।
সঙ্গে সঙ্গে খোকন ঘাড় ঘোরাল। আর তারপরেই ওর শরীর জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। খোকনকে লাফাতে দেখে বাচ্চা হাতিটা যেন মজা পেল। ছুটে এল তরতর করে জলের ধারে। আর তখন পেছন থেকে হুংকার ভেসে এল। বিশু ততক্ষণে জল ছেড়ে উঠে এসেছে ডাঙায়, ‘পালা দীপা, হাতির সঙ্গে দৌড়ে পারব না আমরা।’
দীপা ওর হাত ধরে কেঁদে ফেলল, ‘খোকনের কী হবে। ও তো এখনও মাঝখানে। বাচ্চাটা জলে নেমে পড়েছে।’ বিশু কী করবে বুঝতে পারছিল না। খোকন তখন দ্রুত চলার কারণেই বারংবার জলে আছাড় খাচ্ছে স্রোতের ধাক্কায়। আবার পড়ি কি মরি করে ছুটছে। বাচ্চাটার সেই অসুবিধে নেই। সে ব্যবধান কমিয়েছে। খুব মজা পাচ্ছে যেন। পেছনে তখন অন্ধকার পাহাড়ের মতো মা হাতি এসে দাঁড়িয়েছে। শুঁড় তুলে সম্ভবত সন্তানকে এগোতে নিষেধ করছে। সন্তান সেই নিষেধ শোনার পাত্র নয় দেখে সে এবার জলে নামল। তখনই বিপর্যস্ত খোকন এপারে উঠে এল। দীপা ওর হাত ধরে টেনে বলল, ‘দৌড়া।’
ছিপ ফেলে রেখে মাছের কথা ভুলে ওরা দৌড়াতে লাগল। একবার পেছন ফিরে তাকিয়ে দীপা, দেখল বাচ্চাটা উঠে এসেছে এপারে। কিন্তু কী করবে বুঝতে পারছে না। ওর মা-টাকে সে তখন দেখতে পেল না। তিনটে শরীর প্রাণভয়ে দৌড়াচ্ছিল। শুধু খোকন পিছিয়ে পড়ছিল আর চিৎকার করছিল, ‘আমাকে ফেলে যাস না। আমাকে ফেলে যাস না।’
প্রায় মিনিট দশেক দৌড়াবার পর ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে বিশু বলল, ‘ওরা আসছে না।’
ফিরে তাকিয়ে নির্জন চা-বাগান দেখেও বিশ্বাস হচ্ছিল না দীপার। নিশ্বাস নিতে নিতে বলল, ‘বলা যায় না। হাতির অনেক বুদ্ধি। হয়তো অন্য রাস্তা দিয়ে আসছে।’
বিশু চারপাশে তাকিয়ে বলল, ‘হাতি তো শুয়ে শুয়ে দৌড়াতে পারে না। এলে চা-গাছের ওপরে দেখা যেত।’ আর তখন খোকন হাঁপাতে হাঁপাতে ওদের কাছে এসে পৌঁছাল, ‘আমি আর পারছি না।’ বিশু বলল, ‘একটু দাঁড়িয়ে নে।’
আর সেইসময় দীপার নজর পড়ল খোকনের পেছনে। সে চিৎকার করল, ‘ওটা কী?’
খোকনের হাতে কাঠির সুতোটা জড়িয়ে আছে। আর তার আর এক প্রান্তে বানমাছটা এখনও বঁড়শিতে বিদ্ধ অবস্থায় রয়ে গেছে। অবশ্য তাকে আর বানমাছ বলে চেনা যাচ্ছে না। এতটা পথ খোকন যখন ছুটেছে তখন মাছটা মাটিতে ঘষতে ঘষতে এসেছে। মাটি-লাগা একটা মোটকা দড়ি বলে মনে হচ্ছে।
বিশু বলল, ‘সেকী রে! তুই বানমাছটাকে নিয়ে দৌড়ে এলি, বুঝতে পারিসনি?’
‘না।’ খোকন হাত থেকে সুতোর বাঁধন খুলল অনেক চেষ্টার পর। তারপর বানমাছটাকে সুতোয় ধরে তুলে বলল, ‘ধুয়ে নিলে ঠিক হয়ে যাবে।’
দীপা খিলখিল করে হেসে উঠল, ‘তুই কী রে! আমরা মরছি প্রাণের ভয়ে আর তুই মাছটাকে নিয়ে দৌড়ালি!’
‘এতে প্রমাণ হল আমি মাছ ধরতে পারি তোরা পারিস না।’ খোকন বলল। বিশু খেপে গেল, ‘চমৎকার। তোর জন্যে আমরা ছিপ মাছ ফেলে দৌড়ে এলাম আর তুই এই কথা বলছিস! তোকে আমার সঙ্গে আনাই ভুল হয়েছিল।’
খোকন বলল, ‘ঠিক আছে, ছিপ সুতো বঁড়শির দাম চল আমি দিয়ে দেব।’
বিশু চটপট বলল, ‘তিন টাকা।’
দীপা সঙ্গে সঙ্গে ধরিয়ে দিল, কিন্তু মাছগুলো?’
খোকন মুখ বেঁকিয়ে বলল, ‘ধরেছিস তো কয়েকটা পুঁটি, চার আনাও হবে না।
দীপা হাসল, পুঁটিমাছের দাম চার আনা কিন্তু ধরার আনন্দটার দাম? রাতে যখন ভাজা খেতাম তখন ভাবতাম নিজের হাতে ধরা মাছ খাচ্ছি। সেইটের দাম?’
খোকন হঠাৎ ঘুরে দাঁড়াল, ‘ঠিক আছে, আমি ওখান থেকে নিয়ে আসছি।’
দীপা বলল, ‘থাক, অনেক হয়েছে। তোর ঠাকুমা পূর্ণিমার রাতে বাতাবি লেবুর গাছে বসে বাতাবি খায়, ওখানে গেলে তুই অমাবস্যার রাতে গাছে বসবি। নাড়ুগোপাল ছেলেকে হারিয়ে মাসিমা কেঁদে অন্ধ হয়ে যাবে। লাগবে না ছিপ।’
ওরা ঘুরপথে আসাম রোডের দিকে হাঁটছিল। এই পথে ট্রাক্টর আসে পাতি নিয়ে যেতে তাই ঘাসের পথ বেশ চওড়া। সাপটাকে এড়ানো গেল হাতির তাড়া খেয়ে। কিন্তু বিশুর খুব মন খারাপ ধরা মাছ আর ছিপ ফেলে আসার জন্যে। দীপার চোখের সামনে কেবলই মা হাতিটা ভেসে উঠছিল। বুকের মধ্যে হিম ভাবটা ফিরে আসছিল। সে যদি না চেঁচাত তা হলে খোকন বুঝতেই পারত না। তা হলে এতক্ষণে ওর শরীরটা নিয়ে হাতিরা ফুটবল খেলত। অথচ এমন অকৃতজ্ঞ একবারও সেটা স্বীকার করল না। ছেলেরা কি এমন অকৃতজ্ঞ হয়? এইসময় চা-বাগানের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে খোকন বলল, ‘এই, আমার খুব শীত করছে।’
দীপার খেয়াল হল। জলে নাকানি চুবুনি খেয়ে খোকনের জামাপ্যান্ট ভিজে চপচপে হয়ে গিয়েছিল। এখনও জল ঝরছে টপটপ করে। শীত করাটা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। সে বলল, ‘তাড়াতাড়ি পা চালা।’
খোকন বলল, ‘আমি এই অবস্থায় বাড়িতে যেতে পারব না।’
দীপা জিজ্ঞাসা করল, ‘কেন?’
‘বাবা মেরে ছাল ছাড়িয়ে নেবে।’
‘কালো বাঁদর থেকে সাদা বাঁদর হবি, ক্ষতি কী!’ দীপা হাসল।
‘তোরা আমার বন্ধু নস। সবসময় আমার পেছনে লাগিস!’ গাঢ় গলায় বলল খোকন।
‘আর কখনও আমাকে মেয়ে বলে ঠাট্টা করবি?
‘না’।
‘তিনবার বল।
‘না, না, না।’
দীপা খুব ভেবে নিয়ে বলল, ‘ঠিক আছে, তুই বাড়ির পেছনে দাঁড়িয়ে থাকবি, বিশু গিয়ে ওর প্যান্ট আর গেঞ্জি এনে তোকে দেবে। তুই তাই পরে বাড়িতে ঢুকে নিজেরটা পরে নিয়ে বিশুকে ফেরত দিবি। ঠিক আছে?’
‘কিন্তু মা দেখেছিল আমি শার্ট পরে বেরিয়েছি।’
‘মাসিমার মনে নেই। আচ্ছা, সেইসময় আমি মাসিমার সঙ্গে গল্প করব।’
‘তোর খুব বুদ্ধি।’ খোকন আপ্লুত হল।
এইসময় বিশু ঠোঁটে আঙুল চেপে শব্দ করল চুপ করার জন্যে। ওরা দাঁড়িয়ে পড়ল। না, কোনও গোঙানি শব্দ কানে আসছে না। ওরা বিশুকে ইশারায় কারণ জানতে চাইল। বিশু বলল চাপা গলায়, ‘আমি যেন শুনতে পেলাম কেউ সামনে কথা বলছে।’
‘ভূত নয় তো।’ ফিসফিস করে খোকন বলল।
‘ভূত বলে কিছু নেই, মানুষেই ভূত।’ সত্যসাধনবাবুর কাছে শোনা কথা উগরে দিল দীপা নিচু গলায়।
ওরা আর একটু এগোল। এবং তখনই আবার একটা চকচকে শব্দ শুনতে পেল। তারপরই একটি। নারীকণ্ঠ বলে উঠল, ‘তুমি আমাকে কবে বিয়ে করবে বলো?’
পুরুষকণ্ঠটি বলল, ‘কী আশ্চর্য। চাকরি না পেলে বিয়ে করা যায়?’
‘কবে চাকরি পাবে?’
‘চেষ্টা তো করছি। বড়সাহেব যে কী ভাবছে কে জানে। পরশুদিন লক্ষ্মীপাড়া বাগানের সঙ্গে ম্যাচ আছে। যদি জিততে পারি, মানে গোল দিতে পারি, তা হলে চাকরিটা হতে পারে।’
‘আমি শ্মশানের কালীবাড়িতে গিয়ে মানত করব।’
‘যা খুশি করো, এখন একটা চুমু দাও তো অনেকক্ষণ ধরে।’
‘দেব। কিন্তু আমাকে ছেড়ে যাবে না তো!’
‘মরে যাওয়ার আগে না।’
‘যদি তোমার বাবা অমত করে?’
‘চাকরি পেয়ে গেলে কে বাবাকে তোয়াক্কা করে!’
আর একটা দীর্ঘস্থায়ী শব্দ হল। এবং তখনই মেয়েলি গলায় প্রতিবাদ বাজল, ‘না।’
কেন?’
‘এসব করলে যদি বাচ্চা হয়ে যায়!’
‘হবে না।’
‘কী করে বুঝলে।’
বইতে পড়েছি।
তারপর নিঃশব্দ। কথাগুলো ভেসে আসছিল ডানদিকের চা-গাছের ভেতর থেকে। হঠাৎ দীপা দৌড়াতে লাগল। প্রাণপণে। অন্য দু’জন ভ্যাবাচাকা খেয়ে তাকে অনুসরণ করল। একদমে ওরা চা-বাগান ছাড়িয়ে চলে এল আসাম রোডে। এসে দীপা বড় মুখ করে হাঁপাতে লাগল। খোকন জিজ্ঞাসা করল, ‘ওরা চা-গাছের ভেতরে ঢুকে কী করছে রে?’
দীপা মাথা নাড়ল, ‘জানি না।’
খোকন আবার জিজ্ঞাসা করল, ‘যদি সাপে কামড়ায়?’
দীপা বলল, ‘কামড়াক।’
‘ইস। শ্যামলদাকে সাপে কামড়ালে গোল দেবে কে?’
‘আমি জানি না।’
বিশু জানতে চাইল, ‘মেয়েটা কে রে?’
খোকন বলল, ‘মনে হল ললিতা মাসির গলা।’
‘কী করে বুঝলি?’
‘বাঃ, ললিতা মাসি ওইরকম গলায় কথা বলে।’
‘কিন্তু ললিতা মাসি আর শ্যামলদা কত জায়গা থাকতে চা-গাছের ভেতরে লুকিয়ে আছে কেন? ওরা তো একসঙ্গে মাঠেও হাঁটে না।’
‘কী জানি! বড়দের ব্যাপার আমি বুঝতেই পারি না।’
দীপা কোনও কথা বলছিল না। পিচের রাস্তার দিকে তাকিয়ে সে হাঁটছিল। ললিতা মাসি দেখতে মোটেই সুশ্রী নয়। অন্তত ছয়জন পাত্র এসে দেখে গিয়েছে ওকে। মালবাবুর মেয়ে। যে-ছেলেটা এসেছে ওদের বাড়িতে সে ললিতা মাসির আত্মীয়। মুখ চোখ নেপালির মতো। মোটাসোটা। খুব রংচঙে শাড়ি পরে। বিকেলবেলায় চুলে টেরি কেটে বারান্দায় মোড়া পেতে বসে। বাগানের কারও সঙ্গে যেচে কথা বলে না। সেই ললিতা মাসি চা-গাছের ভেতরে শ্যামলদার সঙ্গে কী করছে? কিছুই বুঝতে পারছিল না দীপা, কিন্তু সেই শব্দটা কানে যাওয়ামাত্র মুখে রক্ত জমছিল। মন বলছিল, ব্যাপারটা ভাল নয়। সে হঠাৎ বন্ধুদের বলল, ‘এই, দৌড়াচ্ছি? কে আগে যায় দেখি!’
ওর বন্ধুরা কিছু বলার আগেই সে দৌড় শুরু করল। খোকন একটু চেষ্টা করেই থেমে গেল। দীপা মুখ ফিরিয়ে দেখল না। তার এখন বন্ধুদের সঙ্গে থাকতে ইচ্ছে করছিল না। আকাশে আবার মেঘ আসছে।
বারান্দায় মোড়া পেতে মনোরমা বসে ছিলেন। এখন বিকেল। অমরনাথ একটু আগে বেরিয়ে গেছেন তাস খেলতে। হাট থেকে মানুষজন ফিরতে আরম্ভ করেছে। মনোরমা চুপচাপ দেখছিলেন। হঠাৎ তাঁর ইচ্ছে হল অনন্তর সঙ্গে কথা বলতে। অনেককাল ধরে লোকটাকে তিনি দেখছেন। কী দক্ষতায় কালীঠাকুর তৈরি করে। ওর হাতে দেবী যেন জীবন্ত হয়ে ওঠেন।
মনোরমা উঠলেন। সিঁড়ি ভেঙে নীচে নামতেই অঞ্জলির গলা পেলেন, ‘কোথায় যাচ্ছেন মা?’
মনোরমা ইচ্ছেটা জানালেন। অঞ্জলি বলল, ‘চলুন, আমিও দেখে আসি।’
‘ওদিকে সব বন্ধ আছে?’
‘হ্যাঁ খাওয়াদাওয়ার পর পান মুখে অঞ্জলিকে বেশ সুখীসুখী দেখায়। মোটাসোটা বেঁটে অথচ মুখখানি লাবণ্যে টলটল। মালবাজারের পোস্টমাস্টার ছিলেন ওর বাবা। চারজন ভাইবোন। এখানকার পোস্টমাস্টারের বউ একদিন সম্বন্ধ আনলেন। ছবি দেখে পছন্দ হল। চোখ দেখে মনে হল, এ মেয়ে আর যাই হোক নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাবে না। ছেলের বিয়ে দিয়ে এক পয়সা নেননি শুনে অনেকেই চোখ কপালে তুলেছিল। বউমার পরের বোনের বিয়ের সময় ওর বাবা প্রায় সর্বস্বান্ত হয়েছেন। অনেককাল হয়ে গেল, এখনও এক দিনের জন্যেও বউমার সঙ্গে তাঁর বাক্যালাপ বন্ধ হয়নি। এটাও তো অনেকের কাছে বিস্ময়। নিজেকে পরিস্থিতি হিসেবে বদলে নিতে জানেন তিনি। খুব কষ্ট হয় কিন্তু শেষপর্যন্ত তো পেরে যান। অন্যের মতের ওপর নিজের মত চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা অবিরত করে যাওয়ার ফলেই তো অশান্তি হয়। মনে না নিয়েও তো মেনে নেওয়া যায়। আর সেরকম করলে প্রথমে অস্বস্তি হলেও শেষপর্যন্ত পরিবেশ যদি শান্ত থাকে তা হলেই শান্তি। অন্যের ব্যাপারে নাক বেশি গলান না বলেই তাঁর ব্যাপারে কেউ নাক গলায় না। এটাও তো স্বস্তির। ধীরে ধীরে পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘পায়েস হয়ে গিয়েছে?’
‘হ্যাঁ, বাটিতে ঢেলে এলাম। সর না পড়লে তো আবার মনে ধরবে না।’
‘সে গেল কোথায়?’
‘আছে আশেপাশে কোথাও।’
‘তুমি এবার একটু রাশ ধরো।’
‘আপনি ওকে শাসন করুন মা। আমার মাথা গরম হয়ে যায়। এরকম ব্যাটাছেলের মতো মেয়ে আমি কখনও দেখিনি। কিছু বললেই জিজ্ঞাসা করবে, কেন? কী জ্বালা। ছোট দু’জন ওকে দেখে দেখে সেটা শিখছে।’
‘তাদের ঘুম ভাঙেনি?’
‘আমি ইচ্ছে করেই ডাকিনি। যতক্ষণ ঘুমায় ততক্ষণ শান্তি। ফিরে এসে ডাকব।’
বড়বাবুর বাড়ির বারান্দায় তাঁর বাবা বসে ছিলেন। লুঙ্গি এবং গেঞ্জি পরে। প্রায় পঁচাত্তর বছর বয়স, চোখে ভারী চশমা। ওঁদের দেখামাত্র উঠে চলে গেলেন ভদ্রলোক ভেতরে। একসময় উনি এই বাগানের বড়বাবু ছিলেন। এখন ছেলের আশ্রয়ে আছেন। বেশি কথা বলেন। অঞ্জলি চাপাগলায় বলল, ‘বাঁচা গেল।’
অনন্ত চোখ বন্ধ করে কাঠামোর সামনে বসে ছিল। মনোরমা বললেন, ‘কেমন আছ অনন্ত?’
অনন্ত চোখ খুলল, ‘ভাল মা। আমি ভাল আছি, ঠাকুর গড়তে যখন আসি তখন আমি খুব ভাল থাকি। আপনারা সবাই কুশলে তো?’
‘এই আর কী। তোমার চুল সাদা হয়ে যাচ্ছে যে।’
‘তা বয়স তো এগোচ্ছে।’
‘ও-কথা বোলো না। তোমাকে তো সেই প্রথমদিন থেকে দেখছি।’ মনোরমার নিজের কথা মনে হল। এখনও একটাও দাঁত পড়েনি, চুলে পাক ধরেনি। বরং অমরনাথের চুলের রং পালটাতে শুরু করেছে।
অঞ্জলি জিজ্ঞাসা করল, ‘এবার কি ঠাকুরের মুখ পালটাবে?’
‘সেই কথাই ভাবছিলাম। চোখ বন্ধ করে মুখ কল্পনা করছিলাম। জানেন মা, মনে হল এবার সেই ঠাকুর গড়ি যিনি শিবের গায়ে সবে পা দিয়েছেন কিন্তু তখনও স্বামী বলে বুঝতে পারেননি। মনে মনে সেই মুখটা কল্পনা করছিলাম।’ অনন্ত হাসল।
‘কীরকম?’ অঞ্জলির কৌতূহল হল।
‘ক্রোধ আছে অথচ তার প্রকাশ নেই, দুঃখ আছে অথচ সেটা রয়েছে চাপা, স্নেহ আছে কিন্তু তা বুকের ভেতরে। তাঁর মুখে অনিন্দ্য শ্রী, দেবী দুর্গা যাঁর কাছে ম্লান হয়ে যান। তিনি কোনও অপরাধ করেছেন বলে বুঝতে পারেননি তাই লজ্জিত নন। আর সেই কারণেই তাঁর জিহ্বা বাইরে বেরিয়ে আসেনি। তিনি অগ্নিশিখার মতো গতিময়ী। সেই দেবীকে কল্পনা করতে গিয়ে মা একটু থমকে গিয়েছি।’
মনোরমার খুব ভাল লাগছিল। তৎক্ষণাৎ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কেন অনন্ত?’
‘মা, যাঁকে আমি প্রতিমা গড়ি তিনি রণরঙ্গিণী, ঊর্ধ্বাঙ্গে বসন নেই, কোমর থেকে হাতের মালা তাঁর লজ্জা নিবারণ করছে। অথচ তাঁকে দেখে মোটেই আমাদের খারাপ লাগছে না কারণ তিনি জিহ্বা বের করে আছেন। তাকালেই সেই জিহ্বার দিকে প্রথমে চোখ যায়। ফলে কুভাবনা মনে আসে না। দেবী যদি ঠোঁট টিপে থাকেন তা হলে মানুষের মন যে ছোট হয়ে যাবে। সমস্যাটা তো এখানেই। অথচ ওঁকে তো কোনও পোশাকে বাঁধা যাবে না মা।’ অনন্ত চিন্তিত গলায় বলল।
এইসময় বড়বাবুর বাবা বেরিয়ে এলেন, ‘আসুন আসুন। বাইরে দাঁড়িয়ে কেন?’
মনোরমা দেখলেন উনি এর মধ্যে পাঞ্জাবি চাপিয়ে এসেছেন। অঞ্জলি বলল, ‘লক্ষ্মীদি কি ঘুমাচ্ছেন মেসোমশাই?’
‘না না। বউমাকে দেখলাম উঠোনে। যাও না, ভেতরে যাও।’
অঞ্জলি চটপট মনোরমাকে বলল, ‘মা, আমি একটু লক্ষ্মীদির সঙ্গে কথা বলে আসি।’
মনোরমা বুঝতে পারলেন অঞ্জলি বৃদ্ধকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্যেই ভেতরে চলে গেল। বড়বাবুর বাবার নাম তেজেন্দ্র। বিপত্নীক মানুষ। তেজেন্দ্র বললেন, ‘আহা, আপনি এ-বাড়িতে এসে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবেন তা কি হয়! এখানে বসুন।’ নিজেই একটা চেয়ার ভেতর থেকে টেনে বারান্দায় রাখলেন তিনি। অগত্যা মনোরমাকে সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠতে হল। সাদা থানের ঘোমটা আর একটু টেনে দিলেন। সন্তর্পণে চেয়ারে বসে মায়ের কাঠামোর দিকে তাকালেন। তেজেন্দ্র তাঁর ইজিচেয়ারে।
তেজেন্দ্র জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনার শরীর কীরকম?’
‘এই আর কী!’ মনোরমার কথা বলতে অস্বস্তি হচ্ছিল।
‘সাবধানে থাকবেন। বয়স তো হচ্ছে। খাওয়াদাওয়ার অনিয়ম করবেন না। আমাদের বয়সি মানুষের কাছে গেলেই তো শুধু অসুখের গল্প শুনতে হয়। আমায় দেখুন, একদম ফিট। লাস্ট জ্বর হয়েছিল তিরিশ বছর আগে। তাও সেবার জন সাহেবের সঙ্গে শিকারে গিয়ে সারারাত বৃষ্টিতে ভিজেছিলাম বলেই জ্বরটা এসেছিল। জনের বউ আমাকে বলত, বাবু, তোমার মতো স্বাস্থ্য আমি ব্রিটিশদের মধ্যেও দেখিনি। তাতে জন খুব রেগে গিয়েছিল।’ বলেই হো হো করে হেসে উঠলেন তেজেন্দ্র।
মনোরমা চুপ করে রইলেন। তেজেন্দ্র একটু অপেক্ষা করেই আবার কথা শুরু করলেন, ‘তা চাকরি যখন করেছি তখন একরকম ছিলাম। বউ চলে গেল কিন্তু অভাব বুঝিনি। সবাই বলেছিল, ছেলের বয়স সতেরো হলেও তোমার বিয়ে করা উচিত। সময় পাইনি। এখন মনে হচ্ছে ভুল করেছি। ছেলের বিয়ে দিয়ে চাকরি থেকে অবসর নিয়ে আর সময় কাটতে চায় না। কেমন শূন্য লাগে চারধার। আপনার সেরকম মনে হয় না?’
‘মানিয়ে নিতে হয়।’ এ ছাড়া অন্য জবাব মাথায় এল না মনোরমার।
‘ঠিক। মানিয়ে নেওয়া। কিন্তু কতটা? একটা মানুষ নেই যাকে মনের কথা বলি। আর সবাইকে কেমন যেন পর পর বলে মনে হয়। ধরুন আমার কুঁচকিতে যদি একটা ফোড়া হয় তা হলে তো আর বউমাকে ডেকে বলতে পারি না সেঁক দিতে। এই বয়সে যদি মনের সঙ্গী না থাকে তা হলে বড় কষ্ট।’ তেজেন্দ্র দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
‘কোথাও ঘুরে আসুন।’ ভেতরের দরজার দিকে তাকালেন মনোরমা।
‘এইই। হরিদ্বারে যাব ভেবেছি। কিন্তু কী হবে গিয়ে। মনে শান্তি পাব? মোটেই না। একা একা কোথাও শান্তি পাব না।’ ‘আবার দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তেজেন্দ্র, ‘আপনি কি হরিদ্বারে গিয়েছেন কখনও?’
মনোরমা মাথা নাড়লেন। তেজেন্দ্র ভালভাবেই জানেন মনোরমা যাননি। এই বাগানের কে কবে কোথায় যাচ্ছে তা সবাই জানে। তেজেন্দ্র বললেন, ‘অমরনাথকে সেদিন বললাম, তোমার সংসারের জন্যে মা এত খাটছেন, ওঁকে তীর্থদর্শন করিয়ে আনো। তা সে বলল, বাড়ি ছেড়ে সবাই যাব কী করে! তা আপনি যদি যেতে চান আমার সঙ্গে যেতে পারেন। গুরুদেবের আশ্রম আছে সেখানে, চমৎকার পরিবেশ। কোনও অসুবিধে হবে না।’
‘না!’ মনোরমা হাসবার চেষ্টা করলেন, ‘আমি ভালই আছি।’
‘না না, কোনও সংকোচ করবেন না। আমাদের যা বয়স তাতে একসঙ্গে গেলে কেউ কিছু মনে করবেন না। নিজেরটা তো ভাবতে হবে। আর কতকাল সংসারে জড়িয়ে থাকবেন।’
তেজেন্দ্রর কথা শেষ হওয়ামাত্র মনোরমা নাতনিকে দেখতে পেলেন। আসাম রোড থেকে দৌড়ে মাঠে নামছে। যেন পেতনি তাড়া কবেছে ওকে। তিনি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন, ‘আমি আসছি। বউমাকে বলবেন। মানে দীপা এসে গেছে তো— ।’ মনোরমা আর সেখানে দাঁড়ালেন না। দ্রুত গেটের বাইরে চলে এলেন। তাঁর কান গরম হয়ে যাচ্ছিল। মুখেও তাপ। অনেক অনেকদিন পরে। এ কী অস্বস্তি।
মনোরমাকে দেখে দীপা দাঁড়িয়ে পড়ল। ভয়ার্ত মুখ চোখ, সেই সঙ্গে হাঁপিয়ে যাচ্ছে। মনোরমা কাছে এগিয়ে গেলেন ঘোমটা মাথায়, ‘কী হয়েছে? কোথায় গিয়েছিলি?’
মনোরমার সামনে আর একটু কুঁকড়ে গেল দীপ, ‘মাছ ধরতে।’
‘ওমা! তুই কী করে গেলি? না জানলে কী হবে জানিস না?’ মনোরমা এই মুহুর্তে কঠোর হতে পারলেন না। তিনি জানেন, তেজেন্দ্র তাঁর বাড়ির গেটের সামনে এসে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি চাপা গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী হয়েছে তোর?’
‘কিছু না।’ খুব দ্রুত মাথা নাড়ল দীপা।
‘মিথ্যে কথা বলিস না।’ মনোরমা একবার গেটের দিকে তাকাতে গিয়ে সামলে নিলেন, ‘তুই একা মাছ ধরতে গিয়েছিলি? বিশু খোকন কোথায়?’
‘পেছনে আসছে।’
‘ওরা তোকে কিছু বলেছে?’
‘না।’
‘তা হলে?’
‘শ্যামলদা—!’ ঢোঁক গিলল দীপা, ‘শ্যামলদা আর ললিতা মাসি বাগানের ভেতরে লুকিয়ে বসে আছে। কীসব কথা বলছিল ওরা।’
মনোরমা সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। দীপার কাঁধ ধরে তিনি বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগলেন। কিছুটা যাওয়ার পর চাপা গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, ‘মালবাবুর মেয়ে ললিতা?’
‘হুঁ!’
‘কী বলছিল ওরা?’
‘খারাপ খারাপ কথা।’
মনোরমা নিজেকে সামলে নিলেন, ‘হাত মুখ ধুয়ে নাও। কোন কথা খারাপ কোন কথা ভাল তা বোঝার বয়স তোমার হয়নি।’
‘তুমি বলেছিলে আমার বয়সে তোমার বিয়ে হয়ে গিয়েছিল! বিয়ে হলেই কি সব বোঝা যায়?’ দীপা প্রশ্নটা করতেই মনোরমা চুপসে গেলেন।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন