২৬. তিনদিন ধরে সমানে বৃষ্টি

সমরেশ মজুমদার

তিনদিন ধরে সমানে বৃষ্টি চলছে জলপাইগুড়িতে। আকাশ জুড়ে মেঘ। রাস্তায় একটাও রিকশা নেই। মেয়েরা কেউ আজ হস্টেল থেকে বেরিয়ে কলেজে যাওয়ার নাম করছে না। দীপার কিছু ভাল লাগছিল না। জানলায় বসে সে শূন্য চোখে রাস্তা, একতলা বাড়িগুলো ভিজতে দেখছিল। আর এক মাস বাদে ফাইনাল পরীক্ষা। সবকটা পেপারের নোটস নেওয়া শেষ। শুধু পড়া আর লেখার বাইরে অন্য কিছুতে সে মন দেবার আগ্রহ পায় না আজকাল। তার বিরুদ্ধে এতদিনের যে অভিযোগ তা এখন একদম মিইয়ে গিয়েছে। দীপা আর ছেলেদের সঙ্গে আড্ডা মারে না, রাস্তায় দাঁড়িয়ে গল্প করে না, অদ্ভুত গাম্ভীর্য ওকে সবসময় ঘিরে থাকে। ওর এই পরিবর্তন ছেলেরা বুঝতে পারে না, মেয়েরা জল্পনা করে। নতুন রুমমেট পর্যন্ত কথা বলার বেশি চেষ্টা করে না। প্রয়োজনের বাইরে কথা বলতে যে চায় না তার সঙ্গে আড্ডা। মারতে কে চায়।

টিপুস টিপুস বৃষ্টি পড়তে পড়তে একসময় থমকাল। মেঘ নেমে এসেছে নীচে। রাস্তায় কয়েকটা মানুষ। দিনদুপুরেই সন্ধে হামা দিচ্ছে। এইসময় দারোয়ান এসে খবর দিল, ‘দীপা দিদি, আপনার গেস্ট।’

দীপা মুখ ফেরাল। এই কয়মাসে কোনও গেস্ট তার কাছে আসেনি। এমনকী অমরনাথও নিতান্ত বাধ্য না হলে আসেন না। প্রতুলবাবুর মৃত্যুর দিন সাতেক বাদে সে যখন আবার হস্টেলে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছিল, তখন একদিন হরদেব ঘোষাল এসেছিলেন। কলেজ থেকে ফিরে দীপা শুয়েছিল খাটে। খবর পেয়ে নীচে নেমে এসেছিল খোলা চুলে আঁচল গলায় জড়িয়ে। হরদেব বসেছিলেন গেস্টরুমে। তাকে দেখামাত্র বলেছিলেন, ‘এসো মা, তোমাদের বাগানের বাড়িতে গিয়ে শুনলাম তুমি হস্টেলে ফিরে এসেছ। দরকারটা খুবই জরুরি। শোক তো কম না। আর কার জন্যে শোক তাও দেখতে হবে। শহরের কোনও মানুষ নেই যিনি ওঁকে চিনতেন না। তাঁর কাজ বলে কথা।’

দীপা স্থির চোখে তাকাল। কোনও কথা বলল না। হরদেব সেটা লক্ষ করে জিভে ঠোঁট চাটলেন, ‘না, মানে, তুমি তো ও-বাড়ির বউ। অস্বীকার যতই করো আইন মানবে না যতক্ষণ ডিভোর্স না হচ্ছে। আমি অবশ্য জানি না স্বামী মারা যাওয়ার পর স্বামীর সংসারের সঙ্গে সম্পর্ক অস্বীকার করতে আদালতে গিয়ে ডিভোর্স চাইতে হয় কিনা। পাঁচজনেও কথা শোনাতে ছাড়বে না।’

দীপা এবারও জবাব দিল না। হরদেব অস্বস্তিতে পড়লেন। শেষপর্যন্ত তিনি বলেই ফেললেন, ‘শোনো মা, তুমি ও-বাড়ির বউ। তোমার শ্বশুরের কাজের সময় তোমার গিয়ে দাঁড়ানো উচিত।’

‘উচিত? আজ যাঁর কাজের ব্যাপারে আমাকে বলতে এসেছেন তিনি কিন্তু তাঁর ছেলের কাজের সময় আমাদের কাউকে বলার প্রয়োজন মনে করেননি।’

‘ও। আসলে তখন তো প্রথম প্রথম, রক্তও গরম ছিল। আজ আমাকে আনা পইপই করে বলে দিয়েছে তোমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্যে।’

‘আমার রক্ত এখন ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে আপনাকে কে বলল?’

‘মানে?’ হরদেব থতমত।

‘শুনুন। ওই মানুষটিকে আমি কোনওদিন শ্রদ্ধা করতে পারব না। তাই তাঁর শ্রাদ্ধের সময় আমি অশ্রদ্ধা নিয়ে উপস্থিত থাকতে চাই না। তা ছাড়া এইসব ব্যাপার নিয়ে কেউ আমার কাছে আসুক তা আমি একদম চাই না।’ দীপা ফেরার জন্য পা বাড়াল।

হরদেব উঠে দাঁড়ালেন, ‘শোনো।’

দীপা দাঁড়াল। মুখ ফেরাল, চোখে জিজ্ঞাসা এবং কিছুটা বিরক্তি।

‘প্রতুলের সম্পত্তির দাবি কি তুমি করছ না?’

‘না।’

‘কিন্তু সেটা কাগজে কলমে হলে ভাল হয় না?’

‘না।’ দীপা মাথা নাড়ল, ‘আমি যদি লিখে দিই ওই সম্পত্তি আমি চাই না তার মানে দাঁড়াবে ওই সম্পত্তির মালিকানা আমার ছিল। আমি সেটুকুও ভাবতে চাই না। আমি লিখে দেব না কিন্তু কোনওদিন দাবি করতেও আসব না।’

‘তা হলে কেউ তো বিক্রি করতে পারবে না। মানে যেই মালিকানা নিক আইনসম্মত করতে তোমার লেখা কাগজ তো দরকার হবে।’

‘আমি অপারগ।’

‘কিন্তু ধরো, পরে যদি তোমার মতের পরিবর্তন হয়?’

‘হবার কোনও সম্ভবনাই নেই।’

হরদেব হাসলেন, ‘উত্তম। তোমার অহংকার দেখে বেশ ভাল লাগছে। কিন্তু প্রতুল জীবিত থাকতে তোমার বাবা যে-টাকা তার কাছ থেকে নিয়ে ব্যাঙ্কে রেখেছিলেন, যার সুদের টাকায় তোমার এই পড়াশুনা চলছে, সে ব্যাপারে কী সিদ্ধান্ত নিয়েছ জানতে ইচ্ছে করছে।’

‘টাকাটা বাবা নিয়েছিলেন, আমি নিইনি। আমি জানলাম বাবা আমার পড়ার খরচ দিচ্ছেন। তা তিনি চুরি করে না ডাকাতি করে দিচ্ছেন তা আমার জানার দরকার আছে বলে মনে করি না। এই ঋণ আমি শোধ করব এমন অহংকার আমার নেই। তবে যে-টাকা আমার পড়ার জন্যে উনি দিচ্ছেন তা ভবিষ্যতে ফিরিয়ে দেব এমন আস্থা নিজের ওপর আছে।’

‘ব্যানার্জিবাড়ির বউ হয়ে তুমি চাকরি করবে?’ আঁতকে উঠলেন হরদেব।

‘প্রথম কথা আমি আর কারও বাড়ির বউ নই। আর শিক্ষা যদি চাকরির উপযুক্ত হয় তা হলে চাকরি করতে কোনও লজ্জা নেই। বাড়ির বউরা চাকরি করলে দোষ হবে কেন?’

‘পাঁচটা বাইরের লোকের সঙ্গে কাজ করতে হবে না? তাদের দৃষ্টিতে কু থাকতে পারে!’

‘চমৎকার। বাড়ির ছেলে যদি সারাজীবন লাম্পট্য করে তাতে কোনও দোষ নেই, বাড়ির মান যায় না, না? তার চোখে যদি নিজের বউমা পর্যন্ত একটা ভোগের সামগ্রী হয় তাতে কোনও দোষ হয় না, না? আপনাদের এই প্রাগৈতিহাসিক কথাবার্তা শুনলে আমার বমি পায়। আপনি আসুন।’ সে আর দাঁড়ায়নি। বড় বড় পা ফেলে ওপরে উঠে এসেছিল।

হরদেব তারপরে আর আসেননি। কোনও গেস্ট এরপরে দেখা করতে আসেনি তার সঙ্গে। আজ এই ভিজে মেঘের দুপুরে কে আসতে পারে! অমরনাথ নিশ্চয়ই এই আবহাওয়ায় এতদূর ঠেঙিয়ে আসবেন না। দীপা ধীরে ধীরে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এল। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বড়দির সঙ্গে দেখা হয়ে গেল তার। বড়দি বললেন, ‘দুটি ছেলে এসেছে তোমার সঙ্গে দেখা করতে। কী ব্যাপার?’

দীপা বুঝতে পারছিল না। বড়দি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আমি কিছু জিজ্ঞাসা করিনি, যদি প্রয়োজন মনে করো তবেই কথা বলতে পারো।’

মাথা নেড়ে নীচে এল দীপা। গেস্টরুমে ঢুকে সে তাজ্জব হয়ে গেল।

ওরা বসে ছিল। দেখামাত্র প্রায় লাফিয়ে উঠল। দু’জনের মুখেই হাসি।

দীপা জিজ্ঞাসা করল, ‘তোরা!’

বিশু বলল, ‘তোর সঙ্গে দেখা করতে এলাম।’

খোকন হাসল, ‘লেডিস হস্টেলে কখনও আসিনি তো, কেমন লজ্জা লজ্জা করছিল।’

দীপা ওর বলার ধরনে হেসে ফেলল, ‘কেন?’

‘বাঃ, এত মেয়ে একসঙ্গে কখনও দেখেছি নাকি?’ খোকন জবাব দিল।

বিশু ঘাড় ঘুরিয়ে তাকে প্রশ্ন করল, ‘এসে অবধি ক’টা মেয়ে দেখেছিস?’

খোকন মাথা নাড়ল, ‘তা সত্যি। মেয়েরা সব কোথায় রে। কাউকে চোখে পড়ছে না। শুধু বিশাল এক ভদ্রমহিলা চোখ পাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, দীপাবলীর সঙ্গে জরুরি দরকার আছে? আমি কোনওমতে হ্যাঁ বলতেই চলে গেলেন।’

দীপা বলল, ‘বড়দি। বস তোরা।’

ওরা মুখোমুখি বসলে বিশু পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করল, ‘এখানে ধরানো যাবে? একটাও অ্যাশট্রে দেখতে পাচ্ছি না।’

‘না ধরানোই ভাল।’

‘সেকী রে? এটা কলেজ না স্কুল হস্টেল?’

‘মেয়েদের তো কখনও এদেশে অ্যাডাল্ট ভাবা হয় না। এলি কেন?’

খোকন জবাব দিল, ‘তোকে দেখতে।’

‘ভ্যাট! নিশ্চয়ই কোনও কারণ কাছে। সেকী রে, তুই দাড়িগোঁফ কামিয়েছিস?’

খোকন আবার লাজুক লাজুক হাসি হাসল, ‘আমরা চলে যাচ্ছি।’

‘কোথায়?’

‘মিলিটারিতে।’

দীপা অবাক হয়ে গেল, ‘কী বাজে কথা বলছিস?’

এবার বিশু বলল, ‘না রে কথাটা সত্যি। আমাদের পড়াশুনা হবে না। বাবার পয়সা নষ্ট করে কোনও লাভ নেই। পরের ভাইবোনদের জন্যে ওটা খরচ হোক। এমনিতে কোথাও চাকরি পাব না। স্কুল ফাইন্যাল পাশ বলে হয়তো অনেক কষ্টে শ্যামলদার মতো একটা চাকরি জুটতে পারে চা-বাগানে। কিন্তু তার জন্যে হাঁ করে পড়ে থাকার কোনও মানে হয় না। বাড়িতে দিনরাত খোঁচাচ্ছে একটা কিছু যেন করি। তাই দু’জনে ঠিক করেছিলাম মিলিটারিতে জয়েন করব। তিন-চার দিন এসে পরীক্ষাটরিক্ষা দিয়ে পাশ করে অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার পেয়ে গেছি। আজ সন্ধেবেলার নর্থবেঙ্গল এক্সপ্রেসে রওনা হব। ভাবলাম, তোকে জানানো দরকার, কবে দেখা হবে কে জানে, তাই চলে এলাম।’

খোকন প্রশ্ন করল, ‘আমরা না বলে চলে গেলে তুই দুঃখ পেতিস না?’

‘দুর! আমি বিশ্বাসই করি না তোদের। মিলিটারিতে যাবি, বললেই হল?’ কথা বলতে বলতে দীপার নজরে পড়ল দরজার গোড়ায় দুটো পুরনো সুটকেস রয়েছে। বিশু সেটা লক্ষ করে বলল, ‘এবার বিশ্বাস হয়েছে। ওর মধ্যে সমস্ত কাগজপত্র আছে, সন্দেহ না গেলে দেখাতে পারি।’

দীপা গালে হাত দিল। ওরা এখনও সেই অর্থে বড় হয়নি। বিশু যদিও কিছুটা ব্যক্তিত্ব পেয়েছে খোকন মোটেই নয়। ওর মুখে এখনও সারল্য লেগে আছে। মিলিটারিতে জয়েন করার বয়স হয়েছে কিনা তাতেও সন্দেহ আছে। পড়াশুনায় ভাল ছিল না, দু’-এক বছরের বড় হতে পারে। কিন্তু তাই বলে কোনও কিছু না ভেবে একেবারে মিলিটারিতে! দীপার মন খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। আংরাভাসা নদীতে মাছ ধরতে যাওয়া, হাটে ঘুরে বেড়ানোর ছবিগুলো, চট করে মনের সামনে চলে এল। সে জিজ্ঞাসা করল, ‘বাবা মা আপত্তি করেনি?’

বিশু বলল, ‘দিন রাত যারা বকর বকর করত ভবিষ্যৎ অন্ধকার বলে, খবরটা পেয়ে যদি একটু মন খারাপ অথবা কান্নাকাটি করে তা হলে তা নিয়ে মাথা ঘামিয়ে কী হবে। যাক, যে জন্যে এসেছি। আমাদের ট্রেন সন্ধেবেলায়। তুই কি আজ কলেজে যাবি?’

‘মাথা খারাপ? কলেজে আজ রেইনি ডে।’

‘এটা আবার বৃষ্টি নাকি! চা-বাগানে এর চেয়ে বেশি বৃষ্টি দেখিসনি? তুই হস্টেল থেকে আমাদের সঙ্গে বাইরে বেরুতে পারবি?’

‘কোথায় যাব?’

‘এখানে ওখানে। আমরা তিনজন একসঙ্গে দুপুরে কোনও হোটেলে খাব।’ বিশু বলল।

‘দারুণ।’ খোকন হাসল, ‘তোর সঙ্গে কোনওদিন হোটেলে গিয়ে বসিনি। সেটা আজ হয়ে যাবে। তুই আমাদের ফেয়ারওয়েল দিবি। দীপু, চল।’

হঠাৎ দীপা তীব্র আকর্ষণ বোধ করল। এই দুটি ছেলের সঙ্গে সে জ্ঞান হবার পর থেকে একসঙ্গে বড় হয়েছে। অনেক ঝগড়াঝাঁটি মান অভিমান আনন্দের শরিক হয়েছে। একটু বড় হবার পর এদের সঙ্গে মেশার কারণে বাড়ির লোকের কাছে বকুনি খেতে হয়েছে। এরাই তার বিয়ের রাত্রে শ্বশুরবাড়িতে যাওয়ার সময় শব্দ করে কেঁদে উঠেছিল। এখন এই যৌবনের প্রথম প্রহরেও এরা তার বন্ধু। আর এই বন্ধুত্বে কোনও স্বার্থ নেই। প্রেম-ভালবাসা যা দুটি নারীপুরুষের মধ্যে এই বয়সে গড়ে ওঠে তা কখনও মাথায় আসেনি। জলপাইগুড়ির রাস্তায় ছেলেদের সঙ্গে সাদামাটা কথা বলার দায়ে তাকে অনেক অভিযোগের সামনে দাঁড়াতে হয়েছে। এখন কলেজে কোনও ছেলের দৃষ্টি দেখলেই অস্বস্তি হয়। ছেলেরা এই বয়সে সহজ চোখে তাকাতে পারে না। অথচ দু’জন একই রকম রয়ে গেছে। ওরা মিলিটারিতে চলে গেলে সে দু’জন ভাল বন্ধুকে হারাবে। এতদিন সে এদের কোনও খোঁজখবর করেনি। চিঠি দেওয়ার কথা মনে আসেনি। অথচ চলে যাওয়ার মুহূর্তে ওরা তো মনে করে এসেছে। দীপা মাথা নাড়ল, ‘চল তা হলো আমি বড়দিকে বলে আসি। তোদের কাছে টাকাপয়সা আছে?’

‘একশো টাকা করে আছে।’ খোকন জানাল।

‘থাক। আমি দেখছি কী আনতে পারি। আজ আমি তোদের খাওয়াব।’ দীপা উঠে পড়ল।

বড়দির মুখোমুখি হয়ে দীপা খুব সহজ গলায় বলল, ‘আমি একটু বেরুব।’

ভদ্রমহিলা শরৎচন্দ্র পড়ছিলেন। চোখ তুলে জানতে চাইলেন, ‘কোথায়?’

‘ওই যাদের দেখলেন ওদের সঙ্গে। চা-বাগানে আমাদের বাড়ির গায়ে থাকে। ওরা আজ মিলিটারিতে চাকরি নিয়ে চলে যাচ্ছে। যাওয়ার আগে কিছু কেনাকাটা করতে চায়।’

‘মিলিটারিতে! ওইটুকু ছেলে! নিশ্চয়ই বদ। পড়াশুনায় ইতি দিয়েছে। কোনও গতি নেই তাই। ঠিক আছে, যা ভাল বোঝো করো। কিছুদিন তো বেশ লক্ষ্মী মেয়ের মতো ছিলে। যাও, কেউ জিজ্ঞাসা করলে বলবে ভাই, বন্ধু বলার দরকার নেই।’ বড়দি বইয়ের পাতায় চোখ রেখে হঠাৎ মুখ তুলে দীপাকে ডাকলেন, ‘শোনো।’

দীপা দাঁড়াল।

বড়দি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বন্ধু বললে, কী ধরনের বন্ধু?’

দীপা বড় চোখে তাকাল। তারপর বলল, ‘আমরা কখনও ভাবিনি কে ছেলে কে মেয়ে।’

বড়দি হতবাক। কথা না বলে ঘাড় নাড়তে পারলেন শুধু। দীপা বেরিয়ে এল।

বুদ্ধি করে রুমমেটের কাছ থেকে ছাতা চেয়ে এনেছিল দীপা। রাস্তায় বেরিয়ে বলল, ‘যাচ্চলে, আবার বৃষ্টি আসছে। তোদের সঙ্গে ছাতা নেই, ভিজে যাবি।’

বিশু বলল, ‘ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে বৃষ্টি নামবে না।’

‘কী করে বুঝলি?’

‘মেঘেদের চরিত্র আমি জানি।’

‘বাপস।’ দীপা শব্দ করে হাসল। এবং তখনই তার মনে পড়ল অনেক মাস পরে সে এভাবে হাসতে পারল। সে জিজ্ঞাসা করল, ‘মিলিটারিতে গিয়ে তোরা কোথায় থাকবি?

‘জানি না। কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে দেখা করতে বলেছে।’

‘তোরা দু’জন একসঙ্গে থাকবি?’

কী জানি! হয়তো না। কিছুদিন একসঙ্গে থাকতে পারি। ওই যখন ট্রেনিং হবে। তারপর আমি হয়তো আসামে আর ও পাঞ্জাবে।

দীপা নিশ্বাস ফেলল, ‘তোদের সঙ্গে আমার আর দেখা হবে?’

খোকন বলল, ‘বাঃ, কেন হবে না। বছরে ছুটি পাব তো। বাবা যদ্দিন চা-বাগানে চাকরি করবে তদ্দিন দেখা হবেই। আর তুই যদি অনেক পড়াশুনা করে মাস্টারনি হয়ে যাস আর তখন যদি আমাদের মতো অশিক্ষিত মানুষের সঙ্গে কথা না বলিস।’

খোকন কথা শেষ করতে পারল না, তার আগেই দীপা প্রায় চিৎকার করে উঠল, ‘এক থাপ্পড় খাবি।’ বলেই চারপাশে তাকাল। ওরা এখন রূপশ্রী সিনেমার সামনের রাস্তায়। ভাগ্যিস এখন পথে তেমন মানুষ নেই নইলে এই নিয়ে আবার গল্প চালু হত।

বিশু বলল, ‘তুই জলপাইগুড়ির রাস্তাঘাট চিনে গিয়েছিস, না রে?’

‘কিছুটা। কয়েকদিন থাকলেই জানা যায়।’

বৃষ্টি পড়া শুরু হল আচমকা। ওরা দৌড়ে থানার সামনে রুবি বোর্ডিং-এর বারান্দায় উঠে পড়ল। দীপা এল ধীরে সুস্থে। এসে জিজ্ঞাসা করল, ‘ভিজেছিস তো?’

ওরা অল্প ভিজেছিল। বিশু রুমালে চুল মুছে চিরুনি চালাল। এবার বৃষ্টি জোর পেয়েছে। দীপা বলল, ‘মেঘেরা তা হলে মেঘেদের মতো চলে।’

খোকন এপাশ ওপাশে তাকিয়ে বলল, ‘বৃষ্টি এখনই থামবে বলে মনে হয় না। খেয়ে নিলে হয়। তোর খিদে পায়নি বিশু?’

‘এখানে ভাত পাওয়া যায়? বিশু জিজ্ঞাসা করল।

উত্তরটা দীপারও জানা নেই। সে ভেতরে পা বাড়াল। বেশ কয়েকটা টেবিল চেয়ার, অনেকটা রেস্টুরেন্টের মতো, একটা কাউন্টারও রয়েছে। কিন্তু কোথাও কোনও মানুষ নেই। একটা অদ্ভুত গন্ধ ভাসছে বাতাসে। অনেকটা রসুনের মতো মনে হল দীপার। সে এপাশ ওপাশে তাকাচ্ছে এমন সময় একটি প্রৌঢ় লোক সামনে এসে দাঁড়াল, ‘কিছু বলবেন দিদি?’

‘আপনাদের এখানে ভাত পাওয়া যায়?’

‘অবশ্যই। বোর্ডাররা তো এখানে এসে খান। ক’জন আছেন?’

‘তিনজন।’

‘কী খাবেন বলুন? ভাত, ডাল, এঁচোড়ের তরকারি, বেগুন ভাজা, ভেন্ডি, রুই, কাতলা, চিতল মাছ, এমনকী কই মাছ পর্যন্ত পাবেন এখানে।’

ভাত ডাল ভাজা তরকারি আর চিতল মাছের কত দাম?’

‘রিপিট না হলে আড়াই টাকা।’

‘তাই দিন। তিন জায়গায়।’ দীপা দশ টাকা নিয়ে বেরিয়েছিল হস্টেল থেকে।

খুব তৃপ্তি করে খেল ওরা দু’জন। চিতল মাছের পেটি প্লেট ছাপিয়ে গিয়েছে। খোকন বলল, ‘এরকম মাছ জীবনে বাড়িতে খাইনি রে।’

দীপার খুব ভাল লাগছিল। ওরা ভাত এবং ভাজা আবার নিলে ওর মনে ভয় ঢুকল। যদি দশ টাকার বেশি খরচ হয়ে যায় তা হলে মুশকিলে পড়তে হবে। কিন্তু বিল এল মাত্র সাড়ে আট টাকার।

বিশু বলল, ‘দীপা, আজকের এই দুপুরের খাবার আমি চিরকাল মনে রাখব।’

দীপা বলল, ‘বাড়িয়ে বলিস না। তোরা যখন প্রথম মাইনে পাবি তখন আমার নাম করে খেয়ে নিস। তা হলেই আমার ভাল লাগবে।’

হঠাৎ বিশু ঝুঁকে পড়ল, ‘দীপা, তোকে একটা কথা বলব?’

‘বল।’ দীপার মনে হল বিশু খুব একটা স্বাভাবিক নয়।

‘আমরা তোর বন্ধু। আমাদের কথা শুনবি?’

‘বল না!’

‘তুই আবার বিয়ে থা করে সংসারী হবি। বুঝলি। তুই তো নিজেকে কখনও বিধবা বলে মনে করিসনি, তাই চাকরি পেলে কাউকে বিয়ে করে ফেলিস।’

‘না পেলে করব না বলছিস?’

‘টাকা না থাকলে কেউ পাত্তা দেয় না, বুঝলি।’ খোকন বলল, ‘আমরা যখন চাকরি করে টাকা জমাব তখন সবাই আমাদের পাত্তা দেবে।’

বৃষ্টি আবার বন্ধ হল। দীপা দাম মিটিয়ে দিচ্ছিল। বিশুর প্রবল আপত্তি, সে কিছুতেই রাজি নয়। হস্টেলে তারা নিছক ঠাট্টা করেছিল। কিন্তু দীপা ওকে আমলই দিচ্ছিল না। এখন কাউন্টারে ক্যাশিয়ার। এসেছেন। দীপার হাত থেকে টাকা নিয়ে ভদ্রলোক বললেন, ‘তোমাকে খুব চেনা মনে হচ্ছে! কোন পাড়ায় থাকো?’

দীপা গম্ভীর হয়ে গেল, ‘কদমতলায়।’

‘হ্যাঁ। এদিক দিয়েই তো তোমাকে রোজ কলেজে যেতে দেখি। কলেজে পড়ো তো? বাবার নাম কী, বাড়ির ঠিকানাটা বলো তো!’

‘কেন আপনার কী দরকার?’

‘বলছি। এরা তোমার আত্মীয়!’

‘হ্যাঁ।’

‘জলপাইগুড়ির কোনও মেয়ে আমাদের হোটেলে এসে খাওয়াদাওয়া করে না। কোনও চায়ের দোকানে একটা মেয়েকেও দেখবে না ছেলেদের সঙ্গে বসে চা খেতে। সবাই ভাবে বদনাম হয়ে যাবে, লোকে ছি ছি করবে। তুমি যেভাবে ওদের সঙ্গে এসে এখানে খাওয়াদাওয়া করলে তাতে আমার ভাল লাগল। তোমার বাবার সঙ্গে একটু কথা বলব।’

‘বদনাম করতে পারবেন বলে?’ ফেরত-পয়সা নিয়ে দীপা ঘুরে দাঁড়াল। ওরা রাস্তায় পা দিতেই খোকন বলল, ‘যাঃ মৌরি নিলাম না।’ বলে সে দৌড়ে ভেতরে চলে গেল। রাস্তা ভিজে, মেঘেরা আরও ঘন, এমন সময় হাওয়া বইল। দীপা দেখল শোঁ শোঁ করে মেঘেদের নাকাল করছে ওপরের বাতাস। মুখ নামিয়ে বলল, ‘বাঙালিরা চল্লিশ পেরিয়ে গেলেই কেমন খেকুরে হয়ে যায়। কারও ভাল দেখতে পারে না।’

বিশু জিজ্ঞাসা করল, ‘হঠাৎ?’

‘ওই দেখলি না, আমার ঠিকুজি চাইছিল!’

‘এই দাঁড়া।’ পেছন থেকে চিৎকার করল থোকন। সে হোটেল থেকে বেরিয়ে দৌড়ে আসছিল। বাবুপাড়ার মুখে এসে ধরে ফেলে জোরে জোরে নিশ্বাস নিল, ‘ওঃ, দারুণ ব্যাপার, দীপার একটা হিল্লে হয়ে গেল।’

‘মানে?’ দীপার কপালে সঙ্গে সঙ্গে ভাঁজ জমল।

‘হোটেলের ওই লোকটা তোর ঠিকানা জানতে চাইছিল কেন জানিস? ওর এক ভাইপো নাকি দিল্লিতে চাকরি করে। স্মার্ট, সংস্কারবিহীন, অথচ ভদ্র বাঙালি মেয়ে না পেলে বিয়ে করবে না বলে প্রতিজ্ঞা করেছে। তোকে দেখে কাকার খুব পছন্দ হয়েছে। আমাকে তোর কথা জিজ্ঞাসা করছিল।’

‘তুই কী বললি?’

‘তুই বাঙালি ছেলেকে বিয়ে করবি না।’

বিশু শব্দ করে হেসে উঠল৷ খোকন বলল, ‘আর কিছু মাথায় এল না যে।’

দীপা বলল, ‘তোর মাথাটা বড্ড ছোট। কোথায় যাবি বল?’

এইসময় একটা রিকশাওয়ালা নেতাজি পুলের দিক থেকে দ্রুতগতিতে আসতে আসতে থানার সামনে দাঁড়ানো একজনকে চেঁচিয়ে বলে গেল, ‘ঘাট বন্ধ হো গিয়া।’

দীপা বিশুকে জিজ্ঞাসা করল, ‘ঘাট বন্ধ হয়ে গেছে মানে? তোরা আজ আসিসনি?’

থোকন জবাব দিল, ‘হ্যাঁ। কিন্তু খুব ভয় করছিল। তিস্তা কত চওড়া হয়ে গিয়েছে, কী কালো কালো ঢেউ। দু’-দু’বার উলটে যেতে যেতে বেঁচে গেছে নৌকো।’

দীপা পা চালাল। রাস্তায় এখন কিছু লোক। বৃষ্টি নেই বলেই যে যার কাজ সারতে বেরিয়েছে। মিনিট আটেকের মধ্যে তিস্তার পাড়ে পৌঁছে ওর চক্ষুস্থির। তিস্তা এখন সমুদ্রের মতো হয়ে গিয়েছে। শুধু জল আর জল। খেয়া পারাপার তো বন্ধ হয়েই গেছে, কাছারির ঘাট থেকে দোকানদাররা জিনিসপত্র সরাতে আরম্ভ করেছে। পুলিশের লোক চোঙা নিয়ে ঘোষণা করছে যে-কোনও মুহূর্তে বন্যা আসতে পারে। সবাই যেন সতর্ক থাকে। একটা নদীর চেহারা এমন হিংস্র হতে পারে না দেখলে কল্পনা করতে পারত না দীপা। সে বলল, ‘ভাগ্যিস তোরা সকাল সকাল পার হয়ে এসেছিলি।’

বিশু ততক্ষণ একটা বুড়োমতো লোকের সঙ্গে কথা বলতে চলে গিয়েছিল। ফিরে এসে বলল, ‘তাড়াতাড়ি পা চালা।’

খোকন জানতে চাইল, ‘কেন?’

‘জল বাড়লে ট্রেন বন্ধ হয়ে যেতে পারে। মণ্ডলঘাটের ওদিকে অলরেডি লাইনের ওপর জল উঠে গেছে। খুব মুশকিলে পড়ে যাব তা হলে।’

‘কিন্তু এখন তো কোনও ট্রেন নেই।’

‘আমরা বাসে যাব। বাসে শিলিগুড়ি, ওখান থেকে নর্থবেঙ্গল এক্সপ্রেস ধরব।’ ঘাটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা দুটো রিকশা ধরতেই বৃষ্টি নামল ইলশেগুঁড়ি। সামনের রিকশায় দীপা বসেছিল একা। হস্টেল থেকে সুটকেস নিয়ে ওরা কদমতলার মোড় থেকে বাসে উঠবে। প্রায় সমবয়সি ওই দুটো ছেলের যে স্বাধীনতা এ-দেশে আছে তার সেটা নেই। রাস্তা খারাপ হবে এই আশঙ্কায় ওরা স্বচ্ছন্দে পথ বদল করে ফেলতে পারল আগাম। হয়তো তাতে নিশ্চিত দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। মেয়েদের সেই স্বাধীনতা না থাকলে জেনেশুনে নিশ্চিত আত্মহত্যার দিকে এগোতে হয়। একা রিকশায় ত্রিপলঘেরা সিটে বসে হঠাৎ খুব বিষন্ন বোধ করছিল দীপা। ওরা চলে যাবে। মিলিটারিতে গিয়ে ওরা কি এমন সহজ থাকবে। বরেন বসুর লেখা ‘রঙরুট’ পড়েছে সে।

হস্টেল থেকে সুটকেস নিয়ে কদমতলার মোড়ে বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছে দেখা গেল খবর এখানেও পৌঁছেছে। সন্ধেবেলার লোকাল ট্রেন ধরে শিলিগুড়িতে পৌঁছে যারা নর্থবেঙ্গল এক্সপ্রেসে উঠে কলকাতায় যাবে বলে ঠিক করেছিল, তাদের কিছু কিছু চলে এসেছে এখনই বাস স্ট্যান্ডে। বৃষ্টি পড়ছিল। বিশু আর খোকন এর মধ্যে ভিজে একসা। ছাতি মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল দীপা। দু’-দুটো বাস একসঙ্গে শিলিগুড়িতে যাচ্ছে। সুযোগ পেয়ে ট্যাক্সিওয়ালারা দর হাঁকছে। চিৎকার চেঁচামেচিতে কান পাতা যাচ্ছে না। প্রায় মারপিট করেই ড্রাইভারদের কেবিনে ওরা দুটো জায়গা করে নিয়ে জানলা দিয়ে মুখ বের করল। ওরা কী বলল দীপা শুনতে পাচ্ছিল না। কাদা বাঁচিয়ে ও একটু এগিয়ে গেল।

খোকন চিৎকার করল, ‘কখনও ভুলে যাবি না তো?’

দীপা মাথা নাড়ল। আর সঙ্গে সঙ্গে বিশু ধমকে উঠল, ‘অ্যাই, খবরদার, এখন তুই কাঁদবি না।’

হাসতে গিয়ে দীপা আবিষ্কার করল ঝড়ের মতো সমস্ত শরীর কাঁপিয়ে কান্না উঠে আসছে গলায়। সে ঠোঁট কামড়াল। সে ওদের দিকে তাকাতে পারছিল না এবং তখনই বাসটা চলতে শুরু করল। ওরা কিছু চেঁচিয়ে বলল। কিন্তু দীপা মুখ তুলে তাকাল না। বাস যখন শিল্পসমিতি পাড়ার দিকে বাঁক নিয়েছে তখনও মুখ ঘোরাল না। কোনওমতে নিজেকে সামলে ছাতি মাথায় সে হস্টেলে ফিরতে লাগল। আর তখনই চেঁচামেচি শুরু হল। রাস্তার সামান্য লোকজনও দৌড়ে পালাচ্ছে। দু’পাশের বাড়িগুলোয় ব্যস্ততা শুরু হয়ে গেছে। দীপা প্রথমে কারণটা বুঝতে পারছিল না। এইসময় একজন চিৎকার করে উঠল, ‘তাড়াতাড়ি বাড়ি যান, বন্যা আসছে।’

শহরের মাঝখানে বন্যা। হঠাৎ নজরে পড়ল দু’পাশের ড্রেনদুটো ঘোলা জলে ভরতি হয়ে গিয়েছে। এই জল তিস্তার। দীপা দৌড়াতে লাগল। পাহাড়ি পাড়ার মোড় থেকে ওদের হস্টেলে আসতেই একদম ভিজে গেল সে। হস্টেলের গেটের কাছে ড্রেন উপচে জল জেগেছে। পার হতে গিয়ে পায়ে নোংরা লাগল। দারোয়ান গেট বন্ধ করতে আসছিল। ওকে দেখে থমকে গিয়ে বলল, ‘জলদি আইয়ে দিদি।’

বাথরুম থেকে শুকনো কাপড় পরে চুল মুছতে মুছতে ঘরে ঢুকে দেখল জানলায় বেশ ভিড়। নীতা বলল, ‘তোমার সাহস খুব, এই ওয়েদারে বেরিয়েছিলে?’

দীপা জবাব না দিয়ে চুল আঁচড়াল। যাদের ঘর রাস্তার দিকে নয় তারা এখানে ভিড় করেছে। এখন বিকেল অথচ মনে হচ্ছে সন্ধে হয়ে গেছে। সে আলো জ্বালল। তারপর জানলার দিকে এগিয়ে গেল। রাস্তার যেটুকু নজরে এল তাতেই তার চক্ষুস্থির। জলের স্রোত বইছে এখন। সে যদি পাঁচ মিনিট দেরি করত তা হলে ওই স্রোতের মধ্যে পড়তে হত তাকে। খুব কপালজোর তাই বিশুরা শহর ছেড়ে বেরিয়ে যেতে পেরেছে। কিন্তু পথে যদি তিস্তার জল চলে আসে? না, তিস্তা থেকে বাসটা দূরে সরে সরে যাবে। আর তখনই নীতা বলে উঠল, ‘উঃ, কী দৃশ্য! যেন ভেনিসে আছি আমরা।’

সন্ধে সাড়ে ছ’টায় জলপাইগুড়ি শহর নিপ্রদীপ হল। পাওয়ার হাউসের ভেতর জল ঢুকে গিয়েছে। শহরের কোথাও আর বিদ্যুৎ নেই। খানিক আগে বৃষ্টির তেজ বেড়েছে। মুষলধারে শুরু হয়ে গিয়েছে এখন। জানলা বন্ধ করতে হয়েছে অনেকক্ষণ। মাঝে মাঝে বাজ পড়ছে আশেপাশে। বড়দি এসে ঘরে ঘরে বলে গিয়েছেন ন’টার মধ্যে শুয়ে পড়তে। একতলার মেয়েদের দোতলায় তুলে দেওয়া হয়েছে। দীপাদের ঘরেও দু’জন এসেছে। তারা মাটিতে বিছানা করে শোবে। রাত্রের খাবার ইতিমধ্যেই খাওয়া হয়ে গিয়েছে সবার। বড়দি বললেন, তিস্তার জল নাকি করলা দিয়ে ঢুকে শহরে আসছে। হাকিমপাড়া ইতিমধ্যে জলের তলায় কারণ তার দু’দিকে দুটো নদী।

রাত বাড়ছে। সেইসঙ্গে চিৎকার। সমস্ত জলপাইগুড়ির মানুষ আর্তনাদ করছে যেন। যাদের বাড়ি একতলা তারা দোতলায় আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করছে জল ভেঙে। কেউ কেউ এই হস্টেলের গেটে এসেছিল আশ্রয়ের জন্যে। কিন্তু গেট তালা বন্ধ থাকায় তারা ঢুকতে পারেনি। উৎসাহীরা খবর আনল জল ঢুকে গিয়েছে নীচের গেস্টরুমে, একতলার ঘরগুলোতে। জল্পনা হচ্ছিল জল যদি আরও বাড়ে, যদি দোতলায় উঠে আসে, তা হলে এই বৃষ্টিতেও ছাদে যেতে হবে। মানুষ যে প্রকৃতির কাছে কত অসহায় তাই নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছিল।

দীপা চুপচাপ বসে ছিল চেয়ারে। খোকনরা কি ঠিক সময়ে শিলিগুড়িতে পৌঁছে যেতে পেরেছে। মাঝ রাস্তায় যদি ওদের বাস আটকে যায় আর সেই ফাঁকা জায়গায় যদি জল বাড়তে থাকে, দু’হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে উঠল সে। নীতারা গল্প করছিল, ‘কী হল? অ্যাই দীপা, কী হয়েছে?’

দীপা কান্না থামাল। মাথা নেড়ে বলল, ‘কিছু না।’

নীতা এক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে বলল, ‘অদ্ভুত।’

জল নামল পরদিন বিকেলে। কিন্তু শহরময় রেখে গেল পুরু পলিমাটি, মরা গোরুবাছুর, ছাগল, কিছু মৃত মানুষ আর অর্ধমৃত মানুষের ভিড়। পরদিন বিকেল থেকেই হস্টেলে খাবারের টান। রাত্রে শুধু খিচুড়ি। বড়দি বলে দিলেন যে যার বাড়িতে চলে যাক। কিন্তু যাওয়ার পথটাই বন্ধ। শহর থেকে জল নামলেও ফেরিঘাট বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছে। ডুয়ার্সের দিকে ব্রিজ ভেঙেছে কয়েকটা। হস্টেলের বেশিরভাগ মেয়েই এসেছে চা-বাগানগুলো থেকে। তাদের ফিরে যাওয়ার সহজ পথ বন্ধ। যেতে হলে আট মাইল হেঁটে শিলিগুড়ির রাস্তায় যে-সাঁকোটা ভেঙেছে, সেখান থেকে বাস ধরতে হয় শিলিগুড়ির। তারপর সেবক হয়ে ডুয়ার্সে। মেয়েদের মধ্যে কান্নাকাটি পড়ে গেল। জলপাইগুড়ি শহরের জন্যে প্রথম ত্রাণসামগ্রী এল শিলিগুড়ি থেকে। সেটা চাহিদার তুলনায় খুবই অল্প। রাজনৈতিক দলগুলো উদ্ধার কাজে নেমে পড়েছে। দীপারা ঠিক করল হস্টেলেই থাকবে। দু’বেলা শুধু খিচুড়ি খাবে তবু এখান থেকে যাবে না। বড়দির সঙ্গে মেয়েদের হয়ে কথা বলতে গিয়ে ঝগড়া হয়ে গেল তার। ভদ্রমহিলার যুক্তি ছিল শহরে যখন কোনও বাজার নেই তখন চাল ডালই বা আসবে কোত্থেকে?

দীপা বলল, ‘আপনি যদি থাকতে পারেন তা হলে আমরাও পারব। শহরের অন্য মানুষ তো পালিয়ে যাচ্ছে না।’

কিন্তু থাকব বলা সহজ, থাকার সমস্যাটার সমাধান সহজে হচ্ছে না। যে-সব দোকানে জিনিসপত্রের স্টক ছিল, যারা বাঁচাতে পেরেছিল, তারা দাম বাড়িয়ে দিয়েছে দ্বিগুণ। শহরের মানুষ তাই কিনছে। এইসময় হস্টেলের একটি মেয়ে, যার নাম গোপা, খুবই সাধারণ চেহারার শান্ত মেয়ে, জানাল তার দাদার শ্বশুর থাকেন জেলা স্কুলের পেছনে। ভদ্রলোকের চাল ডালের ব্যাবসা আছে। গোপাকে নিয়ে তৎক্ষণাৎ দীপারা বেরিয়ে পড়ল। করলার জল নামেনি। দীনবাজার হয়ে কাদা মাড়িয়ে ওরা কোনওমতে সেনপাড়া দিয়ে সেই ভদ্রলোকের দোতলা বাড়িতে যখন পৌঁছাতে পারল তখন কাউকেই ঠিকঠাক বোঝা যাচ্ছে না। জল পলি লেগে শাড়ির রং পালটে গিয়েছে।

ভদ্রলোক মেয়ের ননদকে এতগুলো মেয়ের সঙ্গে দেখে আঁতকে উঠলেন। প্রথমে কুশল সংবাদ নিয়ে বললেন, ‘বুঝতে পারছি। তোমরা বরং এক কাজ করো। দু’বেলা এখান থেকেই খিচুড়ি যাবে তোমাদের হস্টেলে। যদ্দিন সব নর্মাল না হয় তদ্দিন এই ব্যবস্থাটা চলুক। যা ন্যায্য দাম তা দিয়ে দিয়ো।’

‘খিচুড়ির আবার কোনও দাম ঠিক করা যায়?’ দীপা জিজ্ঞাসা করল।

‘দ্যাখো মা, লোকে সন্দেহ করছে আমার কাছে চাল ডাল লুকোনো আছে। আমি বলছি নেই। হাওয়া না বুঝে মুখ থেকে সত্যি কথা বলতে রাজি নই। এখন যদি তোমাদের জন্যে চাল ডাল বের করি তা হলে এ-বাড়ি লুট হয়ে যেতে পারে। আমার ক্ষতি হোক তা নিশ্চয়ই তোমরা চাও না।’

‘সেটা তো খিচুড়ি গেলেও বুঝতে পারবে।’

‘পারবে না। বলব রিলিফ পাঠাচ্ছি। এতে আমার সুনাম বাড়বে। কতজন?’

দীপা সংখ্যাটা বলল। ভদ্রলোক বললেন, ‘আজ রাত্রে তোমাদের হস্টেলের ঠাকুর যেন রান্নার জিনিসপত্র নিয়ে এখানে আসে। রাত ন’টার পরে। এই ক’দিন সে আমার কাছেই থাকবে। রিলিফ নিয়ে দু’বেলা আমার জিপ তোমাদের হস্টেলে যাবে। টাকাপয়সার ব্যাপার নিয়ে আমি তোমাদের সুপারিনটেনডেন্টের সঙ্গে পরে কথা বলব।’

তবু একটা সুরাহা হল। হঠাৎ প্রতুলবাবুর কথা মনে এল দীপার। এই লোকটা রিলিফ দেবার নাম করে সুনাম কিনবে আবার রোজগারও হবে। রান্নাকরা খাবারের দাম নিশ্চয়ই বেশি। ঠিক প্রতুলবাবুর চরিত্র। ওরা হাঁটতে হাঁটতে হাকিমপাড়া দিয়ে আসছিল। রাস্তায় একহাঁটু পলিমাটি। ডুবে যাওয়া পা তোলাই মুশকিল। আশেপাশের একতলা বাড়িগুলো মুখ থুবড়ে পড়েছে। কান্নাকাটি থামেনি এখনও। হঠাৎ বাড়িটাকে চিনতে পারল সে। কয়েক হাজার বুনো মোষ যেন বাগানটাকে মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে। পলির স্তূপ জমেছে। বাড়িটার একাংশ ধসে গিয়েছে। কিছু মানুষের ভিড় সেখানে। দীপাকে দাঁড়াতে দেখে নীতা জিজ্ঞাসা করল, ‘এই বাড়ির লোকদের চেনো তুমি?’

দীপা জবাব দিতে গিয়ে থেমে গেল। দু’জন মানুষ পলি মাড়িয়ে বেরিয়ে আসতে আসতে বলল, ‘দু’দিন ধরে পচেছে। জল বাড়লে বেরুতে পারেনি। মেয়েছেলেটা ঢোল হয়ে গিয়েছে। হরদেবদাকেও চেনা যাচ্ছে না। পাপের বেতন মৃত্যু, বুঝলে।’

সঙ্গীরা এগিয়ে যাচ্ছিল। দীপা কোনওমতে তাদের অনুসরণ করল।

সকল অধ্যায়

১. ১. আজ সারাটা দিন সূর্যদেব উঠলেন না
২. ২. মেয়েরা কি ভূত হয়
৩. ৩. ভালো-মন্দ বোঝার বয়স
৪. ৪. রমলা সেন
৫. ৫. সত্যসাধন মাস্টার
৬. ৬. বৃষ্টিটা চলে যাওয়ার পরে
৭. ৭. চারদিন পৃথিবীটাকে দ্যাখেনি দীপা
৮. ৮. দীপাবলীর বিয়ে
৯. ৯. বাসর এবং বউভাত
১০. ১০. দীপাবলীর ফুলশয্যা
১১. ১১. পুত্ৰটি দেহ রেখেছে
১২. ১২. রমলার চিঠি
১৩. ১৩. প্ৰাপ্তবয়স্কতা শরীরের না মনের
১৪. ১৪. চাবাগানের আশেপাশে
১৫. ১৫. আসাম রোড
১৬. ১৬. একটি মানুষের চেহারা
১৭. ১৭. জলপাইগুড়ি শহরে
১৮. ১৯. রমলা সেনের কাছে
১৯. ১৮. পুলিশের লাঠিচার্জ
২০. ২০. জলপাইগুড়ির হোস্টেলের মেয়ে
২১. ২১. দুশ্চিন্তার ছাপ
২২. ২২. একতারা বাজিয়ে গান
২৩. ২৩. দুর্দান্ত ব্যবসাদার প্রতুল বন্দ্যোপাধ্যায়
২৪. ২৪. সত্যসাধন মাস্টার এসে পড়বেন
২৫. ২৫. অমরনাথ হতভম্ব
২৬. ২৬. তিনদিন ধরে সমানে বৃষ্টি
২৭. ২৭. অমরনাথের শরীর
২৮. ২৮. কলকাতা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে
২৯. ২৯. প্রৌঢ় ভদ্রলোকটি হাঁটছিলেন
৩০. ৩০. এক অদ্ভূত অভিজ্ঞতা
৩১. ৩১. বাড়িটা শুধু পুরনো নয়
৩২. ৩২. উত্তর কলকাতার পথে পথে
৩৩. ৩৩. কলেজ এবং হোস্টেলের বাইরে
৩৪. ৩৪. দীপা অঞ্জলির দিকে তাকাল
৩৫. ৩৫. অমরনাথ শুয়ে আছেন
৩৬. ৩৬. ভবিষ্যৎ সম্পর্কে প্ৰচণ্ড অসহায়তাবোধ
৩৭. ৩৭. তিনতলার ব্যালকনি
৩৮. ৩৮. দীপা চুপ করে আছে
৩৯. ৩৯. সুভাষচন্দ্র এগিয়ে এলেন
৪০. ৪০. মেয়েটির নাম লাবণ্য
৪১. ৪১. বিছানায় টান টান দীপা
৪২. ৪২. কলেজের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে
৪৩. ৪৩. কিছু মানুষ খুন হলেন
৪৪. ৪৪. কেমন একটা সংসার-সংসার ভাব
৪৫. ৪৫. রাধা চলে এল সেজেগুজে
৪৬. ৪৬. দ্বিতীয় অভিনয় হয়ে যাওয়ার পরে
৪৭. ৪৭. কলোনি থেকে কলেজ পাড়ায়
৪৮. ৪৮. স্কটিশ চার্চ কলেজে জানাজানি হয়ে গেল
৪৯. ৪৯. একদম লেডি
৫০. ৫০. রমলা সেন চোখ ছোট করলেন
৫১. ৫১. সাতকাহন প্ৰথম পর্ব সমাপ্ত

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন