২৩. দুর্দান্ত ব্যবসাদার প্রতুল বন্দ্যোপাধ্যায়

সমরেশ মজুমদার

খুব দ্রুত থানার পাশ দিয়ে হাঁটছিলেন অমরনাথ।

চোখের সামনে এখনও প্রতুলবাবু। কিংবা বলা যেতে পারে একটি মৃত নগ্ন শরীর, বিছানায় শুয়ে শুয়ে যার সর্বাঙ্গে ক্ষত দগদগ করছে, জীয়নকালে যিনি ছিলেন দুর্দান্ত ব্যাবসাদার প্রতুল বন্দ্যোপাধ্যায়, এখন অসহায় অবস্থায় খাটের ওপর পড়ে আছেন। মাথার পাশে বসে আনা যে কাঁদছিল, তাতে বানানো ব্যাপার কিছু ছিল না। আনার কান্না এত স্বাভাবিক যে অমরনাথও ভাবাবেগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। হরদেব ঘোষাল ঘরে ঢুকে একপলক দৃশ্যটি দেখলেন। তারপরে ছুটে গেলেন খাটের পাশে, কবজি টেনে পালস দেখার চেষ্টা করলেন, চোখের পাতা ধরে টানাটানির পর উদোম শরীর থেকে খসে পড়া চাদরটিকে স্বস্থানে ফিরিয়ে দিলেন। দিয়ে বললেন, ‘যাই, ডাক্তার ডেকে আনি।’

কান্না থামিয়ে আনা ফ্যালফ্যাল করে তাকাল, ‘ডাক্তার?’

‘নিশ্চয়ই। প্রাণ আছে কি নেই বোঝার যোগ্যতা একমাত্র ডাক্তারের আছে। থাকলে তিনি চিকিৎসা করবেন, গেলে একটা সার্টিফিকেট দেবেন। ততক্ষণ গলা সাধা বন্ধ রাখো। এভাবে ফট করে মরে গেলে তোমার কোনও লাভ হবে না।’ ঘুরে দাঁড়িয়ে হরদেব অমরনাথকে দেখলেন। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মুখে যেন দুশ্চিন্তা খেলে গেল, ‘অমরনাথবাবু, মনে হচ্ছে খুব দুর্বলভাবে নাড়ি চলছে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে ডান দিকের মোড়ের মাথায় সন্তোষ ডাক্তার থাকেন। তাঁকে ডেকে আনবেন একবার?’

অমরনাথ ব্যস্ত হয়ে বললেন, ‘নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই।’

প্রায় ঝড়ের মতো দৌড়ে গেলেন অমরনাথ। সন্তোষ ডাক্তার সব শুনে বললেন, ‘প্রাণ যদি থেকেও থাকে তা হলেও কিছু করার নেই। আপনি এগোন, আমি যাচ্ছি।’

ব্যানার্জিবাড়িতে ফেরার পথে হঠাৎ মনে হল হরদেব তাঁকে ইচ্ছে করে ওইসময় সরিয়ে দিল না তো! আত্মীয়স্বজনরা আসার আগে কিছু হাতিয়ে নিতে পারে। মৃতদেহ খুব বেশি দেখেননি অমরনাথ এ-জীবনে, কিন্তু প্রতুলবাবুর শরীরের দিকে একটুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মনে হয়েছিল তাঁর প্রাণ নেই। বাড়ির সেই বুড়ো চাকর অথবা নিজে ডাক্তারের কাছে না গিয়ে কেন তাঁকে পাঠালেন হরদেব?

সদর দরজা দিয়ে না ঢুকে বাগানের পথে পা রাখলেন অমরনাথ। বুড়ো চাকরটা চুপচাপ বসে ছিল। একবার চোখ তুলে মুখ নামিয়ে নিল। খুব বিষণ্ণ দেখাচ্ছিল লোকটাকে। অমরনাথ প্রায় নিঃশব্দে পেছনের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকলেন। প্রতুলবাবুর ঘরের দিকে পৌঁছানো মাত্র হরদেবের গলা কানে এল, ‘তাড়াতাড়ি করো। প্রত্যেক পাতায় ছাপ দাও। যেসব জায়গায় পেনসিলের টিক আছে তার ওপরে। উইলে সই না করলে কী আছে, টিপসই দিয়েছে তো! যে মানবে না সে করুক কেস।’

অমরনাথ দরজায় দাঁড়ালেন। ভূত দেখার মতো চমকে উঠল আনা। এবং হরদেব কিছু বলার আগেই সে দুই হাতে উইলটাকে মুচড়ে ফেলল।

হবদেব খুব দুঃখিতভাবে বললেন, ‘প্রতুল যা করতে চেয়েছিল তা সুস্থ অবস্থায় করে যেতে পারেনি। বিছানায় পড়ে রইল কত বছর। আমায় বলেছিল যদি টুপ করে সে মরে যায় তা হলে অন্তত এই উইলে ওর টিপছাপ তুলে রাখি। দুর্জনের তো অভাব নেই। ওর শেষ ইচ্ছা পূর্ণ করছি এখন।’ হেঁ হেঁ করে একটু হেসে আরও যোগ করলেন, ‘কিন্তু কার জন্যে করব? স্ত্রীবুদ্ধির নমুনা দেখলেন? আপনাকে দেখে ও এমন ঘাবড়ে গেল যেন চুরি করছে। উইলটার কী অবস্থা করল দেখুন! আরে অমরনাথবাবু যখন পৌঁছে গিয়েছেন তখন সাক্ষী হিসেবে ওঁর সই নিতে হবে না? দাও উইলটা।’ হরদেব হাত বাড়ালেন।

সত্যি চোরের মতো দাঁড়িয়ে ছিল আনা। এবার হরদেব হাত বাড়ানোমাত্র সে সচল হল। কোনও কথা না বলে মুচড়ে-ফেলা উইলটাকে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। হরদেব চিৎকার করলেন, ‘আরে? কী হল? সব ছাপ দেওয়া হয়ে গিয়েছে। আনা? ও আনু!’

আর এইসময় ডাক্তারবাবুর গলা পাওয়া গেল সদর দরজায়। তাঁকে দরজা খুলে দিয়ে আর দাঁড়ালেন না অমরনাথ। আর সেইসময় পেছন থেকে আনা তাঁকে ডাকল, ‘শুনুন।’

থমকে দাঁড়িয়ে মুখ ফেরালেন অমরনাথ। আনার হাতে তখনও গোল করে পাকানো উইল ধরা, ‘একটা অনুরোধ রাখবেন?’

অমরনাথ জবাব দিলেন না। আনা বলল, ‘আমাকে যত খারাপ ভাবেন তাতে আমার কিছু এসে যায় না। ওঁর শেষ ইচ্ছে ছিল আশালতাকে দেখা। হল না। আপনি ওকে একবার নিয়ে আসবেন?’

‘কী দরকার?’ অমরনাথ শক্ত হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন।

‘বললাম তো, ওঁর ইচ্ছা পূর্ণ করতে।’

‘যেভাবে হরদেব শেষ ইচ্ছা পূর্ণ করছিলেন!’

‘বাড়িতে মড়া পড়ে আছে। এই অবস্থায় তর্ক করবেন?’

অমরনাথ আর দাঁড়াননি। হনহনিয়ে বেরিয়ে এসে করলা নদী পেরিয়ে থানার রাস্তা ধরেছিলেন। লোভ মানুষকে কত নীচে নামাতে পারে তার সবচেয়ে নগ্ন উদাহরণ দেখে উদ্ভ্রান্ত হয়ে পড়ছিলেন বারংবার। কোনওদিকে নজর ছিল না তাঁর। হঠাৎ কানে গেল ‘বাবা’ শব্দটি। দ্বিতীয়বারে মনে হল গলাটি তাঁর চেনা। মুখ ফিরিয়ে তিন-চারটি মেয়েকে দেখলেন। তিনটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে চুপটি করে, একটি এগিয়ে আসছে। এবার দীপা স্পষ্ট হল। অমরনাথ যেন হুঁশ ফিরে পেলেন।

সামনে দাঁড়িয়ে দীপা জিজ্ঞাসা করল, ‘কী হয়েছে তোমার? তিনবার ডাকলাম, শুনতেই পাচ্ছ না।’

‘তুই এখানে?’ অমরনাথ স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করছিলেন।

‘বাঃ আমরা কলেজে যাচ্ছি। তুমি কখন এসেছ জলপাইগুড়িতে?’

‘আজ সকালে।’ অমরনাথ সত্যি কথাই বললেন।

‘তা হলে আমার কাছে যাওনি কেন?’ দীপা জিজ্ঞাসা করল। অমরনাথ ঘুরে দাঁড়ানো মেয়েদের দিকে তাকালেন। তারপর বললেন, ‘দীপু, তুমি তোমার বন্ধুদের বলো কলেজে চলে যেতে। তোমাকে আমার সঙ্গে যেতে হবে।’

‘কোথায়?’ দীপা অবাক হচ্ছিল।

‘বলছি। আগে ওদের ছেড়ে দাও। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রয়েছে।’

দীপা মেয়েদের কাছে গিয়ে কিছু বলল। তারা অমরনাথকে দেখতে দেখতে পোস্ট অফিসের দিকে হাঁটতে লাগল। ফিরে এসে দীপা জিজ্ঞাসা করল, ‘কী হয়েছে বাবা?’

অমরনাথ এ প্রশ্নের জবাব না দিয়ে জানতে চাইলেন, ‘এইসময় কলেজে না গিয়ে অন্য কোথায় যাওয়ার জন্যে কি হস্টেল থেকে অনুমতি নিতে হয়?’

‘না।’ দীপা মাথা নাড়ল।

‘সেকী! তা হলে তো তোমরা যেখানে ইচ্ছে যেতে পারো!’

‘আমরা কলেজে পড়ছি বাবা। স্কুলে নয়। খারাপ জায়গায় যাবই বা কেন?’ দীপা হেসে ফেলেই গম্ভীর হবার চেষ্টা করল, ‘কিন্তু তোমার কী হয়েছে বলো তো? কিছু লুকিয়ে যাচ্ছ!’

এইসময় একটা খালি রিকশা সামনে দেখে অমরনাথ সেটাকে দাঁড় করালেন, ‘ওঠো।’

দীপা আদেশ মান্য করল। অমরনাথ পাশে বসে রিকশাওয়ালাকে হাত তুলে ইশারা করলেন রাস্তা দেখিয়ে। এবং তখনই তাঁর মনে হল মেয়ে অনেক বড় হয়ে গিয়েছে। একজন ভদ্রমহিলার পাশেই বসে। আছেন এমন অনুভূতি হচ্ছিল।

থানার পাশ দিয়ে রিকশা ঝুলনা পুলের গায়ে এসে থামল। অমরনাথ বুঝলেন তিনি ভুল রাস্তায় রিকশাওয়ালাকে আসতে বলেছেন। করলা নদীর ওপর ঝুলনা পুলে রিকশা উঠবেই না। সেই সুভাষ বোসের স্ট্যাচু অথবা দীনবাজার ঘুরে আসতে হবে। তাতে সময় লাগত বেশি। এইটুকু রাস্তা পেরিয়ে ঝুলনা পুলে আসতে রিকশার কোনও প্রয়োজন ছিল না। পয়সা দিয়ে মেয়েকে বললেন, ‘চলো।’

ঝুলনা পুলে উঠে দীপা জিজ্ঞাসা করল, ‘আমরা কোথায় যাচ্ছি বাবা?’

‘ব্যানার্জি বাড়িতে।’

‘না।’

‘দীপা, জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপ একভাবে মাপতে যেয়ো না।’

‘আমি ওই বাড়িতে যাব না।’

‘আমি তোমাকে কখনও যেতে বলিনি। কিন্তু আজ বলছি।’

‘কেন? ওদের সঙ্গে তো আমার কোনও সম্পর্ক নেই।’

‘ইচ্ছে না করলেও কোনও কোনও কাজ করতেই হয়। সম্পর্ক তুমি স্বীকার না করলেও আমাদের মানতে হয়। তোমাকে এখন ব্যানার্জি লিখতে হচ্ছে। আর সম্পর্ক যে-মানুষগুলোকে কেন্দ্র করে ও-বাড়িতে তৈরি হয়েছিল তারা কেউ আর আজ বেঁচে নেই। প্রতুলবাবু আজ সকালে পরলোক গমন করেছেন।’

সেই ভয়ংকর রাগী মানুষটির মুখ মনে পড়ল দীপার। মুখের সবকিছু আর তেমন স্পষ্ট নয় কিন্তু আদলটি মুছছে না এখনও। মেয়েকে চিন্তিত দেখে অমরনাথ বললেন, ‘আমরা আর ক’দিন! সবাইকেই যেতে হবে। প্রতুলবাবুও গেলেন। মৃতের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো যে-কোনও জীবিত মানুষের কর্তব্য। চলো।’

‘না।’ শক্ত হয়ে দাঁড়াল দীপা। নীচে করলার কালো জল স্থির। দুই-একজন লোক যারা ঝুলনা পুল দিয়ে যাতায়াত করছে তারা কৌতূহলী হয়ে এদের দিকে তাকিয়ে যাচ্ছিল। অমরনাথ বলে ফেললেন, ‘বেয়াদপি কোরো না দীপা।’

দীপা জবাব দিল না। নদীর দিকে তাকাল। এবং তখনই তার দু’চোখ ঝাপসা হয়ে গেল। অমরনাথ সেটা দেখতে পেলেন না। তিনি গম্ভীর গলায় বললেন, ‘আমি তোমাকে আদেশ করছি তাই তুমি যাবে।’

চোখ মোছার চেষ্টা করল না দীপা। অমরনাথকে সে অনুসরণ করল। বাতাস বইছে। তার ছোঁয়ায় চোখের জল গালে শুকিয়ে যাচ্ছে। সমস্ত শরীর জুড়ে কাঁপুনি, ইচ্ছের বিরুদ্ধে অমরনাথ তাকে দিয়ে যে-কাজ করাচ্ছেন তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের বাসনা ক্রমশ তাকে শক্ত করল। দীপা মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল, এই শেষ। যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন ইচ্ছের বিরুদ্ধে কোনও কিছুর সঙ্গে সমঝোতা করবে না। অমরনাথ কিংবা অঞ্জলি যদি অন্যায়ভাবে কিছু তার ওপর চাপিয়ে দেবার চেষ্টা করেন তা হলে সেটা ঝেড়ে ফেলতে দ্বিধা করবে না। এই শেষ, শেষবার।

এর মধ্যে বেশ কিছু লোকজন এসে গিয়েছে। পাড়া-প্রতিবেশীরা আছেনই, আত্মীয়স্বজনরাও আসতে শুরু করেছেন। মেয়েকে নিয়ে অমরনাথ ঘরের এককোণে দাঁড়িয়েছিলেন। আনা ইতিমধ্যে প্রতুলবাবুকে পাঞ্জাবি পরিয়ে বুক অবধি চাদরে ঢেকে রেখেছে। হরদেব ঘোষাল অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে সব তদারকি করছিলেন। আনা বসে আছে প্রতুলবাবুর পায়ের কাছে। যাঁরা এসেছেন তারা নিচু গলায় কথা বলছিলেন। জেলার কংগ্রেস-কর্তারা মালা ফুল নিয়ে পৌঁছে গেলেন। দেখতে দেখতে প্রতুলবাবু এতকালের একাকিত্ব কাটিয়ে তাঁর কর্মময় জীবনের প্রাপ্য সম্মান অর্জন করতে চললেন। জলপাইগুড়ি শহরের একজন প্রথিতযশা মানুষ চলে গিয়েছেন এবং তাঁকে বিদায় জানাবার ব্যাপারটা যাতে সম্মানের সঙ্গে হয় তার আয়োজন চলছিল। এইসময় হরদেব প্রতুলবাবুর দাদাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে এলেন। বয়স বেড়েছে। হাতে লাঠি। অমরনাথ দেখলেন ভদ্রলোক খুব একটা বদলাননি। এই মানুষটি যদি হরিদাসবাবুর বাড়িতে তাঁকে ডাকিয়ে নিয়ে গিয়ে দীপার বিয়ের প্রস্তাব না দিতেন তা হলে মেয়েটাকে বিধবা হতে হত না। অমরনাথ অনেক কষ্টে নিজেকে সংবরণ করলেন।

প্রতুলবাবুর দাদা দরজায় দাঁড়িয়ে প্রথমে মৃতদেহের দিকে তাকালেন, তারপর তাঁর চোখ ঘরের মানুষগুলোর ওপর ঘুরতে লাগল। অমরনাথ অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়েছিলেন। প্রতুলবাবুর দাদা কয়েক পা এগিয়ে এসে বললেন, ‘হরদেববাবু, প্রতুল আমার নিজের ভাই নয় কিন্তু রক্তের সম্পর্ক রয়েছে। সে মারা না গেলে আমি এই বাড়িতে পা দিতাম না। আজ এসেছি ওই রক্তের সম্পর্কের জন্যে। আসতে বাধ্য হয়েছি।’

হরদেব নিচু স্বরে বললেন, ‘অত্যন্ত সত্যি কথা।’

‘খাটের ওপর কে বসে আছেন?’

‘আনা।’

‘আনা’! মানে প্রতুলের—।’ ওঁকে কথা শেষ করতে দিলেন না হরদেব, ‘হ্যাঁ।’

‘ওকে নেমে আসতে বলুন। ব্যাপারটা অসম্মানজনক।’

হরদেব মিনমিন করে বললেন, ‘উনিই এতদিন সব সেবাযত্ন একা করে এসেছেন।’

‘ভাল কথা। কিন্তু সেবিকা সেবিকাই। সে কখনও আত্মীয়ের মর্যাদা পেতে পারে না।’

হরদেব ছুটে গেলেন আনার কাছে। কথাগুলো সে-ও শুনেছিল। কিন্তু তার কোনও প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। হরদেব আনার কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বললেন, ‘ঝামেলা না করে নেমে আসাই ভাল। পাঁচজন চেয়ে দেখছে।’

আনা তবু নড়ল না। তার মুখ নিচু। অধৈর্য হরদেব ডাকলেন, ‘আনা!’

আনা উত্তর দিল না। প্রতুলবাবুর দাদা গলা তুললেন, ‘আশ্চর্য! এ তো দেখছি কান-কাটা মেয়েছেলে! অমরনাথবাবু, আপনি একটু শুনবেন?’

অমরনাথ চমকে উঠলেন। হঠাৎ যে তাঁর নাম উচ্চারণ করবেন ভদ্রলোক তিনি ভাবতে পারেননি। সেই অবস্থায় দাঁড়িয়ে বললেন, ‘আমাকে কিছু বলছেন?’

‘হ্যাঁ।’ প্রতুলবাবুর দাদা দরজায় দাঁড়িয়েই কথা বলছিলেন, ‘যতদূর মনে হচ্ছে আপনি এখানে কন্যাকে নিয়ে এসেছেন। তাই তো?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’ অমরনাথ ব্যাপারটা বুঝতে পারছিলেন না।

প্রতুলবাবুর দাদা যেন খুব স্বস্তি পেলেন। অমরনাথরা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন সেখানে এগিয়ে এসে বললেন, ‘এসো মা, দূরে দাঁড়িয়ে থেকো না, তুমি এই বাড়ির বউ। প্রতুলের স্ত্রী-পুত্র নেই, তুমিই তার পরিবারের একমাত্র জীবিত মানুষ। ওর এই সময়ে তুমি তোমার কর্তব্য পালন করো।’

অমরনাথ কিছু বলার আগেই দীপা পরিষ্কার গলায় জিজ্ঞাসা করল, ‘কীভাবে?’

প্রতুলবাবুর দাদা বললেন, ‘অত দূরে দাঁড়িয়ে থেকো না। মৃতের পাশে তার নিকট আত্মীয়রা থাকবে। সেটাই স্বাভাবিক।’

দীপা ঠোঁট কামড়াল। ঘরের সমস্ত মানুষ তার দিকে তাকিয়ে আছে।

অমরনাথ মেয়ের অবস্থা বুঝতে পেরে বললেন, ‘আসলে এ-বাড়িতে ওর আসা-যাওয়া নেই তাই সংকোচ—।’

প্রতুলবাবুর দাদা কথাটা থামিয়ে দিলেন, ‘সংকোচের কোনও কারণ নেই। আসা-যাওয়া বন্ধ হওয়ার যথেষ্ট কারণ ছিল। এখন সেই প্রসঙ্গ তোলার কোনও যুক্তি নেই। হিন্দু বিধবা পুনর্বিবাহ না করা পর্যন্ত বৈবাহিক সম্পর্ক বাতিল হয় না। আর ওর না হয় আসা-যাওয়া ছিল না কিন্তু আপনি তো নিয়মিত এসেছেন।’

‘আমি!’ অমরনাথ হতভম্ব।

‘সব খবর কানে এসেছে আমার। এতদিন বলার দরকার মনে করিনি। তা ছাড়া এখানে এসে আপনি অন্যায় কিছু করেননি। এসো মা।’

দীপা মাথা নাড়ল, ‘না। উনিই ওখানে বসার যোগ্য মানুষ।’

‘মানে?’ প্রতুলবাবুর দাদা চমকে উঠলেন, ‘এর পরিচয় তুমি জানো?’

‘হ্যাঁ। উনি আমাকে রক্ষা করেছিলেন।’

‘আমি বুঝতে পারছি না।’

‘বোঝার কি খুব দরকার আছে? ওই মহিলা যখন জীবন দিয়ে সেবা করে গেছেন বছরের পর বছর তখন আপনারা কেউ বাধা দেননি। সাহায্য করতেও আসেননি। আজ কেন গায়ে পড়ে নিজের মতামত চাপিয়ে দিচ্ছেন।’

প্রতুলবাবুর দাদা অবাক হয়ে তাকালেন। তারপর ধীরে ধীরে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। অমরনাথ দেখলেন হরদেব খুব খুশি হয়েছেন। শোকসংবাদ পেয়ে যারা এসেছে তারা গুঞ্জন শুরু করল। আনা ওই একই অবস্থায় বসে আছে। তার দিকে তাকিয়ে বিস্ময় বাড়ছিল অমরনাথের। ওই মহিলা প্রতুলবাবুর মৃত্যুর পরে হরদেবের নির্দেশ যখন মান্য করছিল তখন অন্য চেহারা ছিল। কোনটে সত্যি আর অভিনয় বোঝা অসম্ভব।

এইসময় একটি যুবক এসে অমরনাথের সামনে দাঁড়াল, ‘আপনাদের বাবা ডাকছেন।’

চেহারা দেখে অমরনাথ অনুমান করলেন ছেলেটি প্রতুলবাবুর দাদার ছেলে। তিনি দীপাকে বললেন, ‘আয় মা।’

এই ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেয়ে দীপা যেন বেঁচে গেল। যে-মানুষটি খাটের ওপর শুয়ে আছে তার সঙ্গে বিয়ের সময় দেখা প্রতুল বন্দ্যোপাধ্যায়ের কোনও মিল নেই। কিন্তু তা সত্ত্বেও ওদিকে তাকালে তার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল।

অমরনাথের সঙ্গে ঘর থেকে বেরিয়ে দীপা দেখল শ্মশানযাত্রীরা প্রস্তুত। ভিড় আরও বাড়ছে। শুধু হাকিমপাড়া নয়, জলপাইগুড়ির অনেক মানুষ এসেছেন এখানে। বাগানের মধ্যে একা দাঁড়িয়ে ছিলেন প্রতুলবাবুর দাদা। সামনে যেতেই তিনি বললেন, ‘অমরনাথবাবু, আমি আমার বেয়াইয়ের বাড়িতে গিয়ে আগ বাড়িয়ে আপনাকে বিয়ের সম্বন্ধটা দিয়েছিলাম। এই কারণে আমি পরে অনুতপ্ত হয়েছি। এখন বললে কেউ বিশ্বাস করবে না অতুলের অসুস্থতার পুরো ব্যাপারটা আমার জানা ছিল না। তারপর অনেক বছর কেটে গেছে। আপনার মেয়ে কলেজে ভরতি হয়েছে। তার আচরণ নিয়ে যখন নানান কথা আমার কানে এসেছে তখন ভেবেছিলাম মেয়েটা সেই আঘাত ভুলতে পেরেছে। কিন্তু তাই বলে আজ সবার সামনে আপনার মেয়ে আমাকে অপমান করার সাহস পায় কোত্থেকে? সেদিনের অন্যায়ের প্রায়শ্চিত্ত করতে চেয়েছিলাম আজ। এই বাড়ির, প্রতুলের সম্পত্তির অধিকার তাকে দিতে চেয়েছি সর্বসমক্ষে। কিন্তু তার বদলে—! ছি ছি ছি।’

অমরনাথ বললেন, ‘আপনি ভুল বুঝছেন। ও আপনাকে ভাল করে চেনেই না। খামোকা অপমান করতে যাবে কেন?’

‘অপমান নয়? আপনি এ কী বলছেন? ওই নষ্ট মেয়েটাকে সমর্থন করল, আমাকে বলল গায়ে পড়ে চাপিয়ে দিচ্ছি, এসব শুনতে পাননি?’

দীপা শুনছিল এতক্ষণ। এবার অমরনাথকে বলল, ‘বাবা, আমরা কি যাব?’

‘যাবে মানে?’ প্রতুলবাবুর দাদা আঁতকে উঠলেন, ‘এখন শুশানযাত্রা শুরু হয়নি আর তুমি যেতে চাইছ? না, বাড়ির বউকে শ্মশানে যেতে বলছি না। কিন্তু এখানে এসেছ ঘোমটা না দিয়ে, তার ওপর এখন বেরিয়ে গেলো আমাদের সম্মান থাকবে?’

দীপা ভদ্রলোকের মুখের দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট বলল, ‘দেখুন, আমি এখানে নিজের ইচ্ছায় আসিনি। বাবা জোর করেছিলেন বলেই আসতে হল।’

‘তুমি কি নির্বোধ?’

‘মানে?’

‘এসব কথা বলার অর্থ কী জানো?’

‘যা সত্যি তাই আমি বলছি।’

‘অমরনাথবাবু, আপনার মেয়েকে বুঝিয়ে বলুন, এসব কথা উচ্চারণ করার অর্থ এই পরিবারের সমস্ত সম্পত্তি থেকে সরে দাঁড়ানো।’

দীপা হাসল, ‘এখানেও আপনি ভুল করেছেন।’

‘ভুল?’

‘যে-সর্বনাশ একদিন আপনারা আমার করেছিলেন আজ তার প্রায়শ্চিত্ত করার জন্যে ব্যাকুল হয়েছেন। খুব ভাল। কিন্তু এ বাড়ির একটা টুকরোকেও নিজের করে ভাবার কোনও প্রবৃত্তি আমার নেই। বাবা, বলল।’

‘দাঁড়াও। ছোট মুখে অনেক বড় কথা বললে।’

‘বড় কথা কিনা জানি না, এটা আমার বিশ্বাসের কথা।’

‘যারা দিনের আলোয় উপদেশ দেয় আর রাতের অন্ধকারে চুরি করে, এই বয়সে তুমি তাদের দলে পৌঁছে যেতে পেরেছ দেখে অবাক হচ্ছি!’

‘কী বলছেন আপনি?’

‘তুমি কি ভাবছ আমি জানি না যে তোমার বাবা ওই মেয়েছেলেটার সঙ্গে এক হয়ে তোমাকে সম্পত্তির ভাগ দেবার চেষ্টা করছে?’

‘সেকী!’

‘অথচ সেটা তুমি নিজেই একা অধিকার করতে পারতে। আমি ব্যাপারটার কোনও অর্থ বুঝতে পারিনি এতকাল। আজ যখন ওই মেয়েছেলেটাকে তুমি সমর্থন করলে তখন অর্থটা হৃদয়ঙ্গম হল।’

‘আপনি আমার বাবার নামে মিথ্যে বদনাম দিচ্ছেন।’

অমরনাথ কিন্তু কিন্তু করে বললেন, ‘প্রতুলবাবু চেয়েছিলেন বলে—।’

‘মিথ্যে বদনাম! কী অমরনাথবাবু, ব্যাপারটা কি মিথ্যে?’

‘তুমি আমাকে এসব কথা কখনও বললানি বাবা?’ দীপার গলার স্বর কেঁপে উঠল। তার প্রশ্ন শুনে অমরনাথ মাথা নিচু করলেন।

প্রতুলবাবুর দাদা বললেন, ‘যাচ্চলে! ঠিক আছে, বিষয়সম্পত্তির ব্যাপারটা না হয় তোমার বাবা তোমাকে বলেননি। কিন্তু চা বাগান থেকে জলপাইগুড়ি শহরে এসে হস্টেলে বাস করে এই যে পড়াশুনা করছ—।’

এইসময় শ্মশানযাত্রীরা হরিধ্বনি দিতে দিতে প্রতুলবাবুর দেহ খাটে চাপিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল। একটি মাত্র কণ্ঠের কান্না শোনা যাচ্ছিল। সেদিকে তাকিয়ে প্রতুলবাবুর দাদা বললেন, ‘থাক। আর কিছু বলার নেই।’

দীপা বাধা দিল, ‘দাঁড়ান। আমার পড়াশুনার ব্যাপারে কী বলছিলেন?’

যেতে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন ভদ্রলোক, ‘এতক্ষণ তুমি অনেক বড় কথা বললে মা। তোমার অপমানিত হবার কারণ যথেষ্ট আছে। তবু দু’রকম আচরণ করা ঠিক নয়। তুমি এবাড়ির সম্পত্তি, এ-বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক যদি অস্বীকার করে তা হলে প্রতুলের দেওয়া টাকায় পড়াশুনা করা ঘোরতর অন্যায়।’

প্রতুলবাবুর দাদা আর দাঁড়ালেন না। শব মিছিলের সঙ্গী হতে ছেলেকে নিয়ে দ্রুত হাঁটতে লাগলেন। তখন চারধার হরিধ্বনিতে উচ্চকিত। মিছিল একটু একটু করে বেরিয়ে গেল বড় রাস্তায়। বলহরি-হরিবোল শব্দদুটো আর দীপার কাছে পৌছাচ্ছিল না। সে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে ছিল। প্রতুলবাবুর দাদা কথাগুলো বলার পর থেকেই তার সমস্ত অনুভূতি লোপ পেয়ে গিয়েছিল।

অমরনাথ অত্যন্ত অসহায় বোধ করছিলেন। মেয়ের কাছে লুকিয়ে রাখা খবরগুলো প্রতুলবাবুর দাদা যে এভাবে বলে যাবেন তা তাঁর ধারণার বাইরে ছিল। ঠিক করেছিলেন, মেয়ে গ্র্যাজুয়েট হবার পর একসময় নিজেই খুলে বলবেন। এমন হবে জানলে তিনি নিশ্চয়ই জোর করে দীপাকে নিয়ে আসতেন না। এখন মাথা তুলতেও তার সংকোচ হচ্ছিল। কিন্তু প্রতুলবাবু, হরদেব ঘোষাল আর তিনি ছাড়া একমাত্র আনা আর অঞ্জলি ব্যাপারটা জানে। আনা জানে কিনা সে ব্যাপারেও তিনি নিঃসন্দেহ নন। ব্যাপারটা গোপন রাখতে তিনি প্রতুলবাবুকে সেইসময় অনুরোধ করেছিলেন। তা হলে এই ভদ্রলোক খবরটা পেলেন কী করে? তিনি যে মাঝেমধ্যে এ বাড়িতে আসা-যাওয়া করেছেন তাও ভদ্রলোকের অজানা নয়। অমরনাথের মনে হল আর কিছু করার নেই। তিনি মেয়ের মুখের দিকে তাকাতে ভরসা পাচ্ছিলেন না।

এইসময় সেই বুড়ো কর্মচারীটি এগিয়ে এসে দীপার সামনে দাঁড়াল। খুব বিনীত গলায় বলল, ‘আপনাকে ডাকছে!’

দীপা তাকাল। কিন্তু কোনও প্রশ্ন করল না। লোকটি আবার বলল, ‘আনাদি আপনাকে একবার আসতে বলল।’

এবার দীপা সচল হল। অমরনাথ দেখলেন তাঁকে কোনও কথা না বলে দীপা ধীরে ধীরে লোকটির সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছে। কিছু প্রতিবেশী মহিলা তখনও দাঁড়িয়ে ছিলেন বাড়ির সামনে। তাঁরা সকৌতুহলে তাকিয়ে আছেন দীপার দিকে। অমরনাথ এগোতে পারলেন না। দীপা ধীরে ধীরে বাড়ির ভেতর ঢুকে গেলে তিনি পায়চারি করতে লাগলেন বাগানে।

শূন্য বাড়ি। প্রতুলবাবুর শরীর বের করে নিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যারা জড়ো হয়েছিল তারাও বেরিয়ে এসেছিল। বৃদ্ধ একটি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দীপাকে ইশারা করল, ‘ভিতরে।’ দীপা ঘরে ঢুকল। লোকটি চলে গেল।

আনা বসে ছিল তক্তাপোশের ওপর। তার হাতের মুঠোয় আঁচল এবং সেটি মুখে চাপা। পিঠ ফুলে ফুলে উঠছে। দীপা কিছুটা দূরত্বে দাঁড়িয়ে দৃশ্যটি দেখল। তারপর কথা বলল, ‘কিছু বলবেন?’

আনা মুখ তুলল। তার কান্না সোচ্চার হওয়ামাত্র সে সামলাবার চেষ্টা করল। তারপর জড়ানো গলায় জিজ্ঞাসা করল, ‘আমার কী হবে?’

দীপার বোধগম্য হল না, সে প্রশ্ন করল, ‘কী ব্যাপারে?’

‘তোমরা কি আমাকে তাড়িয়ে দেবে?’ কান্না গলার দখল ছাড়ছিল না।

‘আমি তো তাড়াবার কেউ নই।’

‘তুমিই সব। বলল, তুমি কি আমাকে এ-বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলবে?’

‘আবার বলছি আমি কেউ নই। কিন্তু আপনার চলে যাওয়ার কথা হচ্ছে কেন?’

‘আজ সবার সামনে আমাকে জানিয়ে দেওয়া হল আমি ওর দাসী।’

‘আপনি কি নিজেকে তার চেয়ে বেশি ভাবেন?’

‘হ্যাঁ। শুধু দাসী হলে এতগুলো বছর আমি মানুষটাকে বাঁচিয়ে রাখতে চাইতাম না। খুব খারাপ, বদ লোক ছিল, তবু—।’ কান্নাটা বন্ধ করতে আনা মুখে আঁচল চাপা দিল।

‘আমি যাই?’

‘না।’ আনা হঠাৎই উঠে দাঁড়িয়ে করুণ স্বরে বলল, ‘তুমি যেয়ো না, তুমি না থাকলে ওরা আমাকে এ-বাড়ি থেকে দূর করে দেবে।’

‘কেউ আপনাকে সেটা করতে পারবে না। আচ্ছা, ওঁর স্ত্রী কোথায়?’

‘সেকী! তুমি জানো না?’

‘না।’

‘তিনি নেই। পাগলা গারদেই মারা গিয়েছেন।’

‘পাগলা গারদ!’

‘হ্যাঁ। শোনো আশালতা—।’

‘আপনি আমাকে ওই নামে ডাকবেন না।’

‘ও। তুমি একটু বসো। তোমাকে আমি সব কথা বলব।’

‘আমার কোনও কথা শোনার একটুও ইচ্ছা নেই।’

‘না। শুনতে হবে। একদিন আমি তোমার উপকার করেছিলাম, সেই অধিকারে তোমাকে বলছি, একটু বসো।’ কথা বলতে বলতে আনা দরজার কাছে পৌঁছে সেটাকে ভেজিয়ে দিল। আমাকে হঠাৎ উন্মাদিনীর মতো দেখাচ্ছিল। তার আঁচল মাটিতে লুটোচ্ছে, চুল আলুথালু। দীপা হতাশ ভঙ্গিতে খাটে এসে বসল। আনার মুখ দেখে মনে হল এতে সে একটু সন্তুষ্ট হয়েছে।

হঠাৎ দীপার সামনে মেঝেতে বসে পড়ল আনা। দীপা প্রতিবাদ করতে গিয়েও থেমে গেল। আনা বলল, ‘উনি তো মানুষ ভাল ছিলেন না। সারাজীবন টাকা আর মেয়েমানুষ নিয়ে ফুর্তি করেছেন। ঘরের বউয়ের ক্ষমতা ছিল না তাঁকে সুখী করে। কোনও কোনও পুরুষমানুষের চাহিদা বাক্ষসের মতো, একমাত্র রাক্ষুসি না হলে সেটা মেটাতে পারে না। সেই কাজটা করেছিলাম আমি। তাঁকে ঘরে ফিরিয়েছিলাম। গিন্নিই আমাকে লেলিয়ে দিয়েছিলেন। ছেলের অসুখের পর তার মাথা সবসময় ঠিক কাজ করত না। যাক এসব কথা। গিন্নি চলে গেছেন পাগলা গারদে থাকার সময়। খবরটা তোমার বাবা জানতেন। কর্তাকে জানানো হয়নি। কর্তা যখন প্রথম বিছানায় পড়লেন তখন থেকেই তাঁর বিবেক দংশন আরম্ভ হল। তোমার প্রতি যে-অন্যায় করেছেন তার প্রায়শ্চিত্ত করতে চাইলেন।’

আনা নিশ্বাস নিতে একটু চুপ করতেই দীপা জিজ্ঞাসা করল, ‘উনি কি আমার পড়াশুনোর জন্য টাকা দিয়েছেন?’

‘হ্যাঁ। জোর করেই। তোমার বাবা নিতে চাইছিলেন না। ওই হরদেব শকুনটা জোর করে নেওয়ালেন। নিশ্চয়ই সে ভাগ নিতে ছাড়েনি। তবে, শুনেছি টাকাটা ব্যাঙ্কে আছে, তা থেকে সুদ যায় তোমার কাছে।’

‘কত টাকা?’

‘ঠিক জানি না। কর্তা আমাকেও বিশ্বাস করে পুরোটা বলেননি।’

‘তারপর?’

‘উনি চাইতেন তুমি এ বাড়িতে এসে থাকো। ওঁর শরীর আরও খারাপ হতে লাগল। এই সম্পত্তি তোমাকে দিতে চেয়েছিলেন। আমি বলতাম, আমার কী হবে? তিনি বলতেন, তোকেও কিছু দেব। শেষদিকে যখন বুঝে গেলেন তুমি আসবে না তখন আর সম্পত্তির ব্যাপারে কিছু বলতেন না। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। তোমার বাবার সঙ্গে কথা বলে একটা উইল তৈরি করলাম। আমি খুব চেষ্টা করেছিলাম ওঁকে দিয়ে সই করাতে। কিন্তু তখন ওঁর হাত উঠত না। এইসময় হরদেব শেয়াল আমাকে কুমতলব দিল। আমি একা মেয়েমানুষ। শরীর এখনও শুকিয়ে যায়নি। পুরুষমানুষের কুনজর চিতায় না-ওঠা পর্যন্ত মরে না। ভাবলাম, এতদিন বাঘের হাতে ছিলাম এখন না হয় শেয়ালের হাতে থাকি। প্রশ্রয় পেয়ে হরদেব মাথায় উঠল। সে তোমাকে ঠকাতে বলল। নতুন উইল হল। সব সম্পত্তি বিষয়-আশয় আমার নামে। তদারকি করবে হরদেব। দিনরাত বলত সই করাতে। যিনি করবেন তাঁর তখন আঙুল সরে না। বলল, টিপসই করাতে। করব করব করে যখন হুঁশ হল তখন তিনি নেই। ওই মরা মানুষটার আঙুলে কালি মাখিয়ে ছাপ লাগাতে চেয়েছিল শেয়ালটা। আর তখন ভগবান আমাকে সংবিৎ ফিরিয়ে দিলেন। সব ছিঁড়ে ফেলেছি। কিন্তু কে জানত ওঁর আত্মীয় এসে পাঁচজনের সামনে আমাকে খাট থেকে টেনে নামাতে চাইবে! তুমি বলছ সম্পত্তি চাই না, আমাকে কুকুর বেড়ালের মতো তাড়াবে আর পাঁচভূতে সব দখল করবে। করুক। কিন্তু তুমি বলো, আমার অপরাধ কোথায়?’

দীপা কোনও জবাব দিল না। সে অবাক হয়ে আনার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। যা শুনছে তা কি সত্যি? হরদেব ঘোষ তাকে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে যে কথাগুলো বলেছিলেন, তা মনে পড়ল। চা-বাগানে চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন ব্যাপারটা। কিন্তু অমরনাথ এখনও সেই প্রসঙ্গ তোলেননি। আনা যা বলছে তাতে কি মিথ্যে আছে? দুটো যোগ করলে তো—! এমনকী প্রতুলবাবুর দাদাও একই কথা বলে গেলেন। কেঁপে উঠল দীপা। সে কী করবে বুঝতে পারছিল না। অমরনাথ তাকে মিথ্যে কথা বলেছেন? জলপাইগুড়ির বিখ্যাত চা-বাগানের রায়পরিবার থেকে তাকে তার মেধার জন্য বৃত্তি দেওয়া হচ্ছে না?

আনা দীপার হাত ধরল, ‘শোনো, তুমি আমাকে রক্ষা করো।’

‘কীভাবে?’ দুর্বল গলায় বলল দীপা।

‘ওদের বললা আমি এ-বাড়ি ছেড়ে যেতে পারব না।’

‘আপনার কেউ নেই?’

‘আছে। একটা ছেলে। আমাদের দেশে। হাওড়ায়। সেখানে আমার যাওয়ার মুখ নেই। কর্তার টাকায় সে বড় হচ্ছে।’

‘ওর বাবা নেই?’

‘না। সে কর্তাবাবুর ছেলে। এখন হরদেব শেয়াল ছাড়া একথা কেউ জানে না। আমি বলতেও চাই না। এই পরিচয় দেবার তো উপায় নেই। আইন মানবে না।’ আনা আরও ঘনিষ্ঠ হল, ‘তুমি হস্টেলে থেকো না। এই বাড়িতে চলে এসো। তোমার মধ্যে এক ধরনের তেজ আছে। কেউ কাছে ঘেঁষতে পারবে না।’

‘আপনি আমাকে বাঁচাতে এ-বাড়ি থেকে একদিন চলে যেতে সাহায্য করেছিলেন। আজ কেন—।’ দীপা মাথা নেড়ে উঠে দাঁড়াল।

‘সত্যি কথা বলব? তোমাকে বাঁচাবার চেয়েও সেদিন আমার মনে হয়েছিল তুমি চলে গেলে কর্তাবাবুকে আমি নিজের মতো করে পাব।’ কেঁদে উঠল আনা।

সেই মহিলার দিকে কয়েক সেকেন্ড অপলক তাকিয়ে ধীরে ধীরে বাইরে বেরিয়ে এল দীপা। দরজার বাইরে সেই বৃদ্ধ চাকরটি অসহায় চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। দীপা কোনওদিকে লক্ষ না করে হাঁটছিল। মৃত্যুশোক নয়, একটি নির্মম সত্যের শোষণ তার জীবনকে নীরক্ত করে দিয়েছে কয়েক মিনিটে।

অমরনাথ মেয়েকে দেখে চমকে উঠলেন। দ্রুত পা চালিয়ে কাছে এসে তিনি উদ্বেগে প্রশ্ন করলেন ‘কী হয়েছে দীপু?’

দীপা অমরনাথের দিকে তাকাল। সেই দৃষ্টির সামনে তিনি কেঁপে উঠলেন। দীপা নিচু গলায় বলল, ‘তুমি কেন এত লোভী হলে! ছিঃ!’

সকল অধ্যায়

১. ১. আজ সারাটা দিন সূর্যদেব উঠলেন না
২. ২. মেয়েরা কি ভূত হয়
৩. ৩. ভালো-মন্দ বোঝার বয়স
৪. ৪. রমলা সেন
৫. ৫. সত্যসাধন মাস্টার
৬. ৬. বৃষ্টিটা চলে যাওয়ার পরে
৭. ৭. চারদিন পৃথিবীটাকে দ্যাখেনি দীপা
৮. ৮. দীপাবলীর বিয়ে
৯. ৯. বাসর এবং বউভাত
১০. ১০. দীপাবলীর ফুলশয্যা
১১. ১১. পুত্ৰটি দেহ রেখেছে
১২. ১২. রমলার চিঠি
১৩. ১৩. প্ৰাপ্তবয়স্কতা শরীরের না মনের
১৪. ১৪. চাবাগানের আশেপাশে
১৫. ১৫. আসাম রোড
১৬. ১৬. একটি মানুষের চেহারা
১৭. ১৭. জলপাইগুড়ি শহরে
১৮. ১৯. রমলা সেনের কাছে
১৯. ১৮. পুলিশের লাঠিচার্জ
২০. ২০. জলপাইগুড়ির হোস্টেলের মেয়ে
২১. ২১. দুশ্চিন্তার ছাপ
২২. ২২. একতারা বাজিয়ে গান
২৩. ২৩. দুর্দান্ত ব্যবসাদার প্রতুল বন্দ্যোপাধ্যায়
২৪. ২৪. সত্যসাধন মাস্টার এসে পড়বেন
২৫. ২৫. অমরনাথ হতভম্ব
২৬. ২৬. তিনদিন ধরে সমানে বৃষ্টি
২৭. ২৭. অমরনাথের শরীর
২৮. ২৮. কলকাতা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে
২৯. ২৯. প্রৌঢ় ভদ্রলোকটি হাঁটছিলেন
৩০. ৩০. এক অদ্ভূত অভিজ্ঞতা
৩১. ৩১. বাড়িটা শুধু পুরনো নয়
৩২. ৩২. উত্তর কলকাতার পথে পথে
৩৩. ৩৩. কলেজ এবং হোস্টেলের বাইরে
৩৪. ৩৪. দীপা অঞ্জলির দিকে তাকাল
৩৫. ৩৫. অমরনাথ শুয়ে আছেন
৩৬. ৩৬. ভবিষ্যৎ সম্পর্কে প্ৰচণ্ড অসহায়তাবোধ
৩৭. ৩৭. তিনতলার ব্যালকনি
৩৮. ৩৮. দীপা চুপ করে আছে
৩৯. ৩৯. সুভাষচন্দ্র এগিয়ে এলেন
৪০. ৪০. মেয়েটির নাম লাবণ্য
৪১. ৪১. বিছানায় টান টান দীপা
৪২. ৪২. কলেজের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে
৪৩. ৪৩. কিছু মানুষ খুন হলেন
৪৪. ৪৪. কেমন একটা সংসার-সংসার ভাব
৪৫. ৪৫. রাধা চলে এল সেজেগুজে
৪৬. ৪৬. দ্বিতীয় অভিনয় হয়ে যাওয়ার পরে
৪৭. ৪৭. কলোনি থেকে কলেজ পাড়ায়
৪৮. ৪৮. স্কটিশ চার্চ কলেজে জানাজানি হয়ে গেল
৪৯. ৪৯. একদম লেডি
৫০. ৫০. রমলা সেন চোখ ছোট করলেন
৫১. ৫১. সাতকাহন প্ৰথম পর্ব সমাপ্ত

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন