৫০. রমলা সেন চোখ ছোট করলেন

সমরেশ মজুমদার

রমলা সেন চোখ ছোট করলেন, ‘ওয়ার্কিং গার্লস হস্টেল? তার মানে?’ দীপা বলল, ‘আলাপ করিয়ে দিই। ইনি রমলা সেন। আমার জীবনে ইনি প্রথম বড় হবার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। কলেজে পড়ান। আর ইনি শমিত, স্কুলে পড়ান, কিন্তু আসল পরিচয় একটি শিক্ষিত নাটকের দলের পরিচালক। নাটক নিয়ে থাকেন, স্বপ্ন দ্যাখেন। নাটকই এঁর সব।’

রমলা সেন বললেন, ‘ওমা, এমন নাটুকে লোকের সঙ্গে তোর আলাপ হল কী করে?’

দীপা হেসে ফেলল, ‘হয়ে গেল।’

শমিত চুপচাপ শুনছিল, ‘আপনারা দু’জনেই একটু বাড়িয়ে বললেন।’

রমলা সেন হোঁচট খেলেন, ‘আমি আবার কী বাড়িয়ে বললাম!’

‘সত্যি যদি নিজেকে নাটুকে ভাবতে পারতাম তা হলে খুশি হতাম। সেটা ভাবতে গেলে দিনরাত তাই নিয়ে ডুবে থাকতে হয়। আসলে নাটক এমন একটা শিল্প যা একক চেষ্টায় করা সম্ভব নয়। সহ-অভিনেতা থেকে শুরু করে আলো, এমনকী যে উইংস টানবে তাকেও নাটকের লোক হতে হবে। ডুবে থাকলে সেসব চোখ মেলে দেখার সুযোগ পাওয়া যাবে না। যাঁরা লেখেন বা ছবি আঁকেন তাঁদের সেই সুযোগ আছে।’ শমিত হাসল।

রমলা সেন সোজা হয়ে বসলেন, ‘এ ছেলে তো বলে ভাল। বাঃ, চমৎকার।’

শমিত বলল, ‘যদি কিছু মনে না করেন তো একটা প্রশ্ন করব?’

রমলা সেন নীরবে মাথা নাড়লেন।

শমিত বলল, ‘সেদিন আপনাকে এক পলক দেখলেও আমার মনে হচ্ছে কিছু পরিবর্তন ঘটেছে আপনার। সেদিন ওই রুমালটা নিশ্চয়ই মাথায় বাঁধেননি।’

‘উঃ, এই এক প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে আমার প্রাণ বেরিয়ে গেল!’

‘আমি কিন্তু প্রথমেই বলেছি আপনি কিছু মনে করলে বলব না।’ বিব্রত হল শমিত।

দীপা শব্দ করে হেসে উঠল। গম্ভীর হয়ে গেলেন রমলা সেন। সঙ্গে সঙ্গে দীপা থেমে গেল। ওর মনে হল যেসব কথা উনি তাকে বলতে পেরেছেন তা নিশ্চয়ই শমিতকে শোনাতে চান না। রমলা সেন শমিতকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি মেয়েদের খুব খুঁটিয়ে দ্যাখো।’

‘মেয়েদের বললে ঠিক বলা হবে না। আমি রাস্তাঘাটে মানুষের চালচলন চেহারা দেখি। নাটকের কোনও চরিত্রের সঙ্গে মিল আছে এমন চেহারার মানুষ দেখলে আরও ভাল করে তাকে লক্ষ করি। এটা খুব কাজে লাগে।’

‘তোমার নাটকে আমার মতো কোনও চরিত্র আছে নাকি!’

‘না। তাই সেদিন ভাল করে দেখিনি।’

‘রিয়েল ইনটেলিজেন্ট। ভাল লাগল। হ্যাঁ, সেদিন তুমি আমার মাথায় রুমাল দ্যাখোনি। কেন দ্যাখোনি বলতে পারব না, এটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার।’

দীপা সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞাসা করল, ‘হস্টেলটা কোথায়?’

‘বাগবাজারে। একটা সিট এ-মাসের শেষে খালি হচ্ছে। আমি বলে রেখেছিলাম। তোমার দরখাস্ত কালকের মধ্যে জমা দিতে হবে।’

‘টার্মস কী?’

‘তেমন কিছু না।’

‘আমি চাকরি করছি বলতে হবে তো?’

‘না। আমি বলেছি তুমি কলেজে পড়ো আর প্রাইভেট টিউশনি করো। চাকরি ঠিক আছে, ফাইনাল দিয়েই জয়েন করবে!’

‘সেকী! এ তো একদম মিথ্যে কথা।’

‘মিথ্যে নয়। আমি যে-স্কুলে পড়াই তার মর্নিং সেকশনে কিছুদিন পরেই ডেপুটেশন ভ্যাকেন্সিতে লোক নেবে। ইচ্ছে করলে তুমি করতে পারো।’

‘গ্রাজুয়েট না হয়েই!’

‘প্রাইমারি সেকশনে অসুবিধে হবে না।’

‘হস্টেলে কত টাকা লাগবে?’

‘মনে হয় এখানে যা দিচ্ছ তার থেকে বেশি নয়।’

রমলা সেন চুপচাপ কথাগুলো শুনছিলেন। এবার প্রশ্ন না করে পারলেন না, ‘তোর এখানে কী অসুবিধে হচ্ছে। এখানে সবাই ছাত্রী, পড়াশুনার আবহাওয়া আছে—!’

‘সবই ঠিক। মুশকিল হয় ছুটি পড়লে সবাই যে যার বাড়িতে চলে যায়। এমনকী ঠাকুর চাকরও। তখন হস্টেলে থাকা যায় না। তারপর পরীক্ষা হয়ে গেলে এই হস্টেল ছাড়তে হবে। তখন কোথায় যাব?’

‘তুই বাড়িতে যাস না?

‘কোন বাড়ি?

‘আঃ, তোর বাবার বাড়ি।’

‘বাবা মারা যাওয়ার পর যাওয়ার সম্পর্ক নেই।’

‘সেকী? কেন?’

‘অনেক গল্প। শোনাতে গেলে অনেক কথা বলতে হবে।’

‘সেদিন বলছিলি বটে তুই তোর গার্জেন কিন্তু আমি ব্যাপারটা ধরতে পারিনি। কী করে এমন হল? তোর মা কি চাননি যে তুই পড়াশুনা করিস?’

‘বললাম তো আরও জটিল ব্যাপার।’ দীপা গম্ভীর হল।

শমিত জিজ্ঞাসা করল, ‘আজ অ্যাপ্লিকেশনটা পেলে ভাল হত। যাওয়ার পথে জমা দিয়ে যেতাম। কাল আসতে পারব না।’

‘তা হলে আমাকে ঠিকানাটা বলুন আমি পৌঁছে দিয়ে আসব।’

‘কাকে?’

‘মানে?’

‘দিতে হবে সেক্রেটারির হাতে। ঠিক আছে, আমাকে একটা ভাল কাগজ এনে দাও, আমি লিখে দিচ্ছি, তুমি সই করে দেবে।’

মাথা নেড়ে রমলা সেনকে ‘আসছি’ বলে বেরিয়ে গেল দীপা। রমলা সেন বললেন, ‘তুমি অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছ। বসো।’

‘ধন্যবাদ। শমিত চেয়ার টেনে বসল।

‘তোমরা কী ধরনের নাটক করো?’

‘সাধারণত অ্যাডপটেশন।’

‘কেন?’

‘তাতে দর্শকরা ভাল বিদেশি নাটক সম্পর্কে ধারণা তৈরি করতে পারেন। আর আমরাও ভাল নাটকে কাজ করার সুযোগ পাই।’

‘আমার মনে হচ্ছে দীপাকে তুমি খুব পছন্দ করো।’

‘হ্যাঁ। ওর মধ্যে তেজি ভাব আছে যা আমি পছন্দ কর।’

‘বাঃ, এভাবে উত্তর দিতে পারলে তুমি?’

‘আপনি আমাকে প্রশ্ন যখন করতে পারলেন তখন উত্তর দিতে বাধা কী!’

‘তুমি দীপাকে কতটুকু জানো?’

এইসময় দীপা কাগজ নিয়ে ঢুকল। ঢুকে বলল, ‘আমার কথা কী বলা হচ্ছিল!’

রমলা সেন বললেন, ‘আমি ওকে জিজ্ঞাসা করছিলাম তোকে কতটা জানে!’

দীপা শমিতের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কী জবাব দেবেন?’

শমিত হাসল, ‘এখনও তো হিসাব করিনি। দাও কাগজটা।’ সে কাগজ নিয়ে ঝটপট লিখে ফেলল লাইনগুলো। লিখে বলল, ‘পড়ে সই করো।’

ঠোঁট উলটে দীপা চোখ বোলাল, তারপর সই করে দিল। কাগজটা নিয়ে শমিত উঠে দাঁড়াল, ‘চলি, আপনারা কথা বলুন। আজ পুরো রিহার্সাল আছে।’ শমিত চলে গেল। ওর যাওয়া দেখলেন রমলা সেন। তারপর বললেন, ‘বেশ বুদ্ধিমান ছেলে। স্কুলে পড়ায় বলল, না?’

“হ্যাঁ। একটা কাজ করতে হয় বলে করছে।’

‘হ্যাঁরে, তুই কি ওকে ভালবাসিস।’

দীপা রমলা সেনকে এক মুহুর্ত দেখল। তারপর বলল, ‘মাথায় আসেনি।’

‘মানে?’

‘ভালবাসার যেসব গল্প এতদিন পড়েছি তার নায়িকার মনের ভাব আমার কখনও হয়নি।’

‘এ তুই ফাঁকিমারা কথা বললি।’

‘সত্যি কথা কিন্তু। আমার চেয়ে বয়সে বড় হলেও শমিতকে বন্ধু হিসেবে পছন্দ হয় আমার। মনে হয় ওর ওপর আস্থা রাখা যায়। হয়তো ওর বয়সি ছেলেদের তুলনায় ব্যক্তিত্ব বেশি বলেই এটা মনে হয়। কিন্তু ওর জন্যে আমার মনে কখনও তোলপাড় হয়নি। তাই তোমাকে কী করে বলব ওকে ভালবাসি!’ দীপা অকপটে বলল।

অমলকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের চিঠি এল। আগের চিঠির বক্তব্যে যদি কোনও অসংগতি থাকে তা হলে দীপা যেন তাকে মার্জনা করে। সেইসঙ্গে জানাননা, যদি এ-ব্যাপারে দীপা মনে করে তার কোনও সাহায্য প্রয়োজন তা হলে তা সে করতে প্রস্তুত। চিঠি পড়ে দীপার ভাল লাগল৷ সে চিঠি লিখে জানাল, সুভাষচন্দ্র যে-সব কাগজপত্র উদ্ধার করেছেন তাতে তার হিসেব অনুযায়ী বারো লক্ষ টাকা হবে। বাস্তবে এই অঙ্ক কম বা বেশি হতে পারে। এখন কোনও জনহিতকর প্রতিষ্ঠানকে দান করতে হলে প্রথমে দান করার অধিকার তাকে অর্জন করতে হবে। যেহেতু এই কাজ জলপাইগুড়ির আদালত বা সরকারি অফিসেই করতে হবে তাই যদি অমলকুমার সাহায্য করেন তা হলে সে চিরকৃতজ্ঞ থাকবে। চিঠির উত্তর কলেজ হস্টেলের ঠিকানায় না দিয়ে নতুন ঠিকানায় যেন দেওয়া হয়। দীপা ওয়ার্কিং গার্লস হস্টেলের ঠিকানাটা জানিয়ে লিখল সামনের মাসের এক তারিখে সে ওই ঠিকানায় উঠে যাচ্ছে।

কিন্তু ওই চিঠির উত্তর এত তাড়াতাড়ি এল যে নতুন ঠিকানার প্রয়োজন হল না। চিঠিতে অমলকুমার লিখেছে যে সে জলপাইগুড়ির প্রোথিতযশা উকিল জীবনগতি রায় মহাশয়ের সঙ্গে কথা বলেছে। রায় মহাশয় খুব বড় মাপের মানুষ। সব শুনে বলেছেন এমন একটা কাজ যে মেয়ে করতে পারে তাকে তিনি একটি পয়সা পারিশ্রমিক না নিয়ে সাহায্য করবেন। কিন্তু এসব করতে হলে দীপাকে দিনকয়েক জলপাইগুড়িতে থাকতে হবে আইনগত কারণে। দীপা যত তাড়াতাড়ি আসতে পারে তত ভাল হয়।

দীপা ঝুঁকি নিল। সুভাষচন্দ্রের দেওয়া সমস্ত কাগজ সে পার্সেল করে পাঠিয়ে দিল অমলকুমারের নামে। সেইসঙ্গে জানাল সামনের মাসের শেষদিকে সে যেতে পারবে। কারণ তার তখন ছুটি থাকবে। সমস্যা হল জলপাইগুড়ি শহরে কোনও থাকার জায়গা নেই। সেখানকার হোটেলের ব্যবস্থা কীরকম অথবা তারা একা মেয়েকে থাকতে দেয় কিনা তাও সে জানে না। অতএব একটা নিশ্চয়ই সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে।

কলেজ হস্টেল ছেড়ে সে যখন ওয়ার্কিং গার্লস হস্টেলে এল তখন শমিত আর মায়া সঙ্গে ছিল। এখানকার বেশিরভাগ মেয়েই শিক্ষিকা। দু’-চারজন অফিসে কাজ করে। তাদের সঙ্গে শিক্ষিকাদের মেলামেশা কম। শমিতের ভেতরে ঢোকা নিষেধ, মায়া ওকে ঘরে পৌঁছে দিল। দীপার রুমমেট এক মধ্যবয়সি মহিলা। আর জি কর হসপিটালে নার্সের চাকরি করেন। যেমন কালো তেমন ভারী শরীর। দিনটা ছিল রবিবার। মহিলা নিজের খাটে বসে টেবিলে আয়না রেখে সন্না দিয়ে পাকা চুল তুলছিলেন। ওবা ঢুকতেই হাতের আড়ালে সন্না লুকিয়ে জিনিসপত্র নামাতে দেখলেন। ঘরে ঢোকার আগে দীপা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দেখা করে টাকাপয়সা জমা দিয়ে এসেছিল। মহিলা আচমকা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কোন জেলা?’

মায়া জবাব দিল, ‘জলপাইগুড়ি। আপনি এ-ঘরে থাকেন বুঝি?’

‘হ্যাঁ, এটা আমারই ঘর। কত রুমমেট এল গেল আমি কিন্তু রয়েই গেছি। এই হস্টেলে যে-কেউ দেবিকার ঘর বললে এই ঘরটাই দেখিয়ে দেবে।’

মায়া হাসল, ‘তা হলে তো আমার বন্ধু এখানে আপনার সঙ্গে ভালই থাকবে।’

দেবিকা বললেন, ‘ও, তুমি থাকবে ভাই?’

দীপা বেশ চটে গেল। একে কথায় মাতব্বরির ভাব স্পষ্ট তার ওপর সরাসরি তুমি বলা তার মোটেই পছন্দ নয়। বয়সে বড় হলেও জিজ্ঞাসা করে তুমি বলা উচিত। সে জবাব দিল না। মায়া ওকে বিছানা পাততে সাহায্য করল। সেটা দেখতে দেখতে দেবিকা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বিয়েথা হয়ে গেছে না হয়নি!’

মায়া জবাব দিল, ‘ওমা, আপনি চোখে দেখে বুঝতে পারেন না?’

‘চোখে দেখে? সেদিন চলে গিয়েছে। হাসপাতালে চাকরি করছি। যা সব কেস দেখছি রোজ মাথা ঘুরে যাচ্ছে। মাথায় সিঁদুর দিয়ে খালাস করতে এল, স্বামীর নাম দেখাল। স্বামী দেবতাটিকেও দেখলাম। অল্প বয়স দু’জনের। বাচ্চা হল সন্ধেবেলায়, ভোরবেলায় মায়ের পাত্তা নেই। খোঁজ খোঁজ। বেড খালি, কোথাও পাওয়া গেল না। পুলিশে খবর গেল। তারা খবর নিয়ে বলল ঠিকানাটা মিথ্যে। ওই নামে কেউ থাকে না। বাচ্চাটার কী হবে? তা এক দারোয়ানের বউ চেয়ে নিল, তার বাচ্চা হচ্ছে না দশ বছর। তবে?’

দীপা মায়ার দিকে তাকাল, ‘কেন কথা বাড়াচ্ছিস?’

মায়া আবার হাসল ‘তা হলে আজ চলি। নীচে শমিত দাঁড়িয়ে আছে। কাল কলেজে দেখা হবে।’ বলে দরজা পর্যন্ত গিয়ে ঘুরে বলল, ‘আমার বন্ধু খুব গম্ভীর, কম কথা বলে, আপনিও বেশি কথা বলবেন না।’ বলে বেরিয়ে গেল।

দীপা অনেক কষ্টে হাসি চাপল। সে দেবিকার দিকে পেছন ফিরে বালিশ ঠিক করল। টুকিটাকি কাজ সারল। দেবিকা বিছানায় বসে চুপচাপ ওকে দেখছিলেন এবার নিশ্বাস ফেলে বললেন, ‘তা হলে তো ভাই তোমাকে অন্য ঘরে যেতে হবে।’

‘কেন?’ ঘাড় বেঁকিয়ে তাকাল দীপা।

‘আমি তো কথা না বলে থাকতে পারি না।’ মাথা নাড়লেন তিনি।

‘ঠিক আছে, আপনি কথা বলবেন।’ দীপা একটা বই নিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল।

‘তা হলে ঠিক আছে। হ্যাঁ, যে-কথা বলছিলাম, দেখে মনে হয় বিয়েথা হয়নি। বিপদ বলো ভয় বলো এখানেই। মা-বাবা সম্বন্ধ করছে না তো?’

দীপা কথা বলল না। দেবিকা বললেন, ‘করবে না। মেয়ে চাকরি করলে কোন মা-বাপ চায় তাকে খরচ করে বিয়ে দিই। যে-গোরু দুধ দেয় তাকে কেউ বিক্রি করতে চায়? আর এই করতে করতে দেখবে একসময় তোমার আমার মতো বয়স হয়ে যাবে, আর তখন বিয়ে হবে না। আমি তো এর আগের দুই রুমমেটকে বলে বলে বিয়ে করালাম।’

কথা না বলে পারল না দীপা, ‘আপনার খুব বিয়ের শখ ছিল বুঝি?’

‘খুউব। সেই ছেলেবেলায় যখন রান্নাবাটি খেলতাম তখন থেকে। সময়ে কেউ বিয়ে দিল না। দু’বার যে নিজে চেষ্টা করিনি তা নয়। কিন্তু ডাক্তার বলো আর রুগি বলো, হাসপাতালে ঢুকলে কত মিষ্টি কথা, হাসপাতালের বাইরে চোখ উলটে দেয়। তাই বলছিলাম, বিপদ বলো, ভয় বলো, এখানেই।’ দেবিকা গলা নামালেন, ‘কোথায় চাকরি করো?’

‘করি না, করব! স্কুলে।’

‘অ। আমার এক পেশেন্ট ছিল স্কুলের মাস্টারনি। অমন খেঁকুরে মেয়েমানুষ আমি বাবা জীবনে দেখিনি। যেমন রোগা তেমনি খেঁকুরে। রোজ বিকেলে আয়না বের করে বেডে বসে পাউডার মাখত। এক রাত্রে আমায় বলে কিনা, জানান দিয়ে তবে রাত্রে আসবেন নইলে অন্ধকারে আপনাকে বোঝা যায় না। কী আস্পদ্দা!’

দীপা হাসি চাপল। হঠাৎ দেবিকা লাফিয়ে উঠলেন, ‘ওরে বাবা রে!’ কথা বলতে বলতে কী দেরি না হয়ে গেল। আমার ডিউটির সময় হয়ে গেছে। আজ আবার নার্সিং সুপার দাঁত দেখাবে।’ দীপা মুখ ফিরিয়ে চোখ বইতে রাখল। মহিলা এই ঘরেই জামাকাপড় পরিবর্তন করছেন। দীপা যে রয়েছে তা যেন খেয়ালেই নেই। পোশাক পালটে চুল আঁচড়ে দেবিকা বললেন, ‘কাল সকালে আবার দেখা হবে। কী যেন নাম তোমার? নাম না জানলে কথা বলা যায় নাকি!’

‘দীপাবলী।’

‘আমি ওই বলীটলি বলতে পারব না। শোনো দীপু, আমি চলে যাচ্ছি, আজ রাত্রে তুমি আমার মাছটা খেয়ে নিয়ো। চেয়ে খেয়ো নইলে ঠাকুর দেবে না।’

‘আপনি রাত্রে ফিরবেন না?’

‘না। নাইট ডিউটি। নাইট ডিউটি নিই কেন বলো তো? রাত দশটার পর পাঁচটা পর্যন্ত টানা ঘুম। এদিকে সারাদিনেও বিশ্রাম। রাতে হাসপাতালে কপাল খারাপ না হলে কোনও ঝামেলা থাকে না তো। চলি।’ দুদ্দাড় করে ঘরের বাইরে চলে গিয়েও ফিরে এলেন তিনি। মুখ ঢুকিয়ে বললেন, ‘মাছটা মনে করে খেয়ো। টাকা যখন রিফান্ড দেবে না তখন মাছটা আর ছাড়ব কেন? রোজ ছাড়ি, আজ টাইট।’ শব্দ তুলে চলে গেলেন দেবিকা। দীপা উঠে বসল। অদ্ভুত মহিলা। এতক্ষণ ওঁর ওপর তার বেশ রাগ হচ্ছিল। নিজের বা অন্যের ব্যক্তিগত ব্যাপার বলে কিছু থাকতে পারে তা এই ধরনের মহিলা ভাবতেও পারেন না। কানের পোকা বের করে দেবার পক্ষে যথেষ্ট। আবার মাছ খেতে বলে যাওয়াটা ওঁর ছবিটাকে পালটে দিল। সে ওইভাবে চেয়ে মাছ খেতে আগ্রহী নয়। কিন্তু ওই বলার মধ্যে সহজ মন ছিল, এটাও ঠিক।

নতুন হস্টেলে অসুবিধা হচ্ছে না দীপার একমাত্র দেবিকাদেবীর কথার তুবড়ি ছাড়া। কলেজ হস্টেলের সঙ্গে এখানকার একটা বড় তফাত বাসিন্দাদের বয়স হয়েছে। সেই কারণে হাঁটা চলায় ব্যবহারে একটা ভারী ব্যাপার আছে। দু’দলের আলোচনার বিষয়ও আলাদা। বড়রা অনেকেই স্নেহ করে দলে টানতে চাইছেন। এঁদের মধ্যে যেমন অবিবাহিতার সংখ্যা বেশি তেমনি স্বামী পরিত্যক্তা অথবা অর্থের কারণে স্বামী-সংসার ছেড়ে আসা মহিলাও আছেন। সমস্ত পশ্চিমবাংলায় এঁদের সংখ্যা যদিও হাতে গোনা যায় যাঁরা নিজের উপার্জন করে দাড়িয়ে আছেন, তবু কথা বললে এঁদের হা হুতাশ বুঝতে অসুবিধে হয় না।

পরীক্ষার জন্যে তিনমাসের ছুটি আরম্ভ হতেই অমলকুমারের চিঠি এল জলপাইগুড়ি থেকে নতুন ঠিকানায়। অমলকুমার জানিয়েছে, জলপাইগুড়ির হস্টেলে কোনও মহিলা সাধারণত একা থাকেন না। হোটেলদুটি খুব উঁচু মানেরও নয়। তা ছাড়া জলপাইগুড়িতে এসে হস্টেলে ওঠার কথা না ভাবলেই ভাল হয়। পুরনো আত্মীয়তার কথা যদি না তোলা হয় তা হলে যেমন নিয়ে চিঠির জবাব দীপা দিয়েছে সেই মনেই রায়কতপাড়ায় অমলকুমারের বাড়িতে সে থাকতে পারে। এ-ব্যাপারে অমলকুমারের মায়ের কোনও আপত্তি নেই। অমলকুমার উকিলবাবুকে সমস্যাটা জানিয়েছিল। তিনিও বলেছেন, থাকার জায়গার কোনও অভাব হবে না। তাঁর বাড়িতেও বহু জায়গা আছে। জলপাইগুড়ির বিখ্যাত চা-শিল্পপতি শ্রীযুক্ত বীরেন ঘোষ তাঁদের পাড়ার লোক। ঘোষমহাশয়ের একটি ভাল গেস্ট হাউস আছে। উকিলবাবু তার সঙ্গে কথা বলে সেখানে থাকার ব্যবস্থা করে দিতে পারেন। পত্রপাঠ কবে আসছে জানালে অমলকুমার স্টেশনে অপেক্ষা করবে।

লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে শমিতের রিহার্সাল রুমে গেল দীপা। গিয়ে দেখল দরজায় তালা ঝুলছে। তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে পাড়ার একটি ছেলে বলল, ‘রিহার্সাল পার্টিদের খুঁজছেন? পাবেন না। বাড়িওয়ালা ঘর বন্ধ করে দিয়েছে।’

‘সেকী? কেন?’

‘ভাড়া দিতে পারেনি, তাই।’

‘কতদিন এমন হল?’

‘দিন চারেক। তবে ওদের সামনের পার্কে পাবেন।’

‘পার্কে?’

‘হ্যাঁ। ওখানে কালকেও রিহার্সাল দিয়েছে জানি।’

পার্কে নাটকের রিহার্সাল দেওয়া যায় স্বপ্নেও ভাবেনি দীপা। বেশ কৌতুহলী হয়ে সে ছেলেটির দেখানো পথ দিয়ে পার্কে এল। তখন সন্ধে হ্বহ্ব। আলো জ্বলে গিয়েছে। পার্কের মাঝখানে অন্ধকার। এদিকে বৃদ্ধ এবং মাঝবয়সিরা আড্ডা মারছে আলোর তলায়। ঘুরতে ঘুরতে এক কোণে সুদীপ এবং আরও চারটে ছেলেকে দেখতে পেল। বেঞ্চি দখল করে তারা বসে আছে। তাকে দেখে সুদীপ বলল, ‘আরে, কী ব্যাপার?’

‘এখানে রিহার্সাল হচ্ছে শুনলাম!’

‘হ্যাঁ। চার মাস ঘরভাড়া দিতে পারিনি বলে বাড়িওয়ালা বের করে দিয়েছে।’

‘চার মাস? কত ভাড়া ছিল?’

‘পনেরো টাকা করে, ষাট টাকা।’

‘ষাট টাকা। দেননি কেন?’

‘কত লস হচ্ছে এক একটা শো করে জানা আছে?’

দীপার মুখে এসেছিল, লসই যখন হচ্ছে তখন নাটক করছেন কেন? কিন্তু সে কিছুই বলল না। সুদীপ হাসল, ‘এই পার্কে রিহার্সালের আইডিয়া খারাপ না। ওপেন এয়ারে অভিনয় করলে গলা ভাল হয়, গরমে কম ঘামতে হয়। শুধু বৃষ্টি নামলে প্রবলেম।’

দীপা জানতে চাইল, ‘ষাট টাকা পেলে বাড়িওয়ালা ঘর খুলে দেবেন?’

‘জানি না দেবে কিনা। খুব রাগারাগি হয়ে গেছে। কিন্তু—।’

‘আপনি আমার সঙ্গে চলুন৷’

‘কোথায়?’

‘আপনাদের আগের রিহার্সাল রুমে। কাল টিউশনির টাকা পেয়েছি। এখন দিয়ে দিচ্ছি পরে আপনারা আমাকে শোধ করে দেবেন।’

‘অসম্ভব।’

‘মানে?’

‘শমিত আমাকে শেষ করে ফেলবে। ও গিয়েছে এক জায়গায় টাকা জোগাড় করতে। ও ফিরে না আসা পর্যন্ত—, ওই যে, এসে গিয়েছে।’ সুদীপের দৃষ্টি অনুসরণ করে দীপা দেখল শমিত আরও দুটো ছেলের সঙ্গে কথা বলতে বলতে আসছে। সঙ্গে মায়াও আছে। দীপার খেয়াল হল মায়া তাকে এ-ব্যাপারে কোনও কথা বলেনি। তাকে দেখে শমিত খুবই সাধারণ গলায় বলল, ‘কতক্ষণ?’

‘একটু আগে।’ দীপা কথাদুটো বলে মায়ার দিকে তাকিয়ে হাসল।

এদিকে শমিত গলা তুলেছে ততক্ষণে, ‘বন্ধুগণ! একটা সুখবর আছে। আমরা আমাদের ঘর ফিরে পাচ্ছি! এই যে চাবি ফিরে পেয়েছি।’ সে চাবি দেখাল।

সুদীপ অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘কী করে হল ব্যাপারটা?’

‘বাড়িওয়ালার স্ত্রীর জন্যে। আমি তো মাঝেমধ্যে মাসিমা বলে জল চেয়ে খেয়েছি। স্বামী আমাদের তাড়িয়ে দিয়েছেন শুনে উনি তাঁকে খুব তিরস্কার করেছেন। আর তাই স্বামীর মনে হয়েছে কাজটা ঠিক হয়নি। হয়তো পাড়ায় রটে গিয়েছে যে তিনি যেহেতু আমাদের তাড়িয়ে দিয়েছেন তাই আমরা পার্কে রিহার্সাল দিচ্ছি। এতে পাড়ার পাঁচজনের কাছে উনি বোধহয় ছোট হয়ে যাচ্ছিলেন। যা হোক, ওসবে আমাদের প্রয়োজন নেই। আমি বাড়িওয়ালাকে কথা দিয়েছি এখন থেকে নিয়মিত ভাড়া দেবই আর বকেয়াটা প্রতি কল শো পিছু এক মাসের করে দেব।’

শমিতের কথা শেষ হওয়ামাত্র হাততালি পড়ল। সুদীপ বলল, ‘বাঁচা গেল। তা হলে কি আজ রিহার্সাল এখানে হবে?’

‘সবাই এসেছে?’ শমিত জানতে চাইল।

‘না, এখনও আসেনি। আমি বলি কী এখন ঘরে ফিরে যাওয়া যাক।’

সুদীপ প্রস্তাব দিতে সবাই তাকে সমর্থন করল। দল যখন ঘরে ফিরছে তখন শমিত দীপাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘কী ব্যাপার?’

‘আপনার সঙ্গে কথা ছিল।’

‘কোনও অসুবিধে হয়েছে?’

‘না। কিন্তু এত ব্যাপার ঘটল আমাকে বলেননি কেন?’

‘শুনলে কী করতে?’

‘কিছু একটা সাধ্যমতো চেষ্টা করতাম।’

‘তুমি যদি আমাদের দলের একজন হতে তা হলে নিশ্চয়ই বলতাম।’

‘ও।’ দীপা চুপচাপ হাঁটল। মায়া সুদীপের সঙ্গে কথা বলতে বলতে আগে আগে যাচ্ছে। দীপা বলল, ‘এসেছিলাম কারণ আমাকে জলপাইগুড়িতে যেতে হচ্ছে।’

‘কেন?’

‘ওখানকার সব সম্পত্তি, যা আমার নয়, অথচ আমার বলে সবার ধারণা, তা আইনসংগত করে কোনও দাতব্য প্রতিষ্ঠানকে দান কবে দিতে যাচ্ছি।’

‘যদি আইনসংগত হবার পরে দানের ইচ্ছেটা চলে যায়?’

‘আপনি আমাকে এখনও চেনেননি।’

‘হুম। কবে যাওয়া হচ্ছে।’

‘আগামীকাল।’

‘ওখানে থাকার ব্যবস্থা?’

‘হয়ে যাবে।’

‘আমি কীভাবে সাহায্য করতে পারি? সঙ্গে গেলে কাজ হবে?’

‘না!’ হঠাৎ চাপা চিৎকার করে উঠল দীপা।

‘কী হল?’ অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে গেল শমিত।

সঙ্গে সঙ্গে ধাতস্থ হল দীপা। এবং সেইসঙ্গে লজ্জা পেল। বলল, সরি।’

শমিত অদ্ভুত চোখে তাকাল। দীপা বলল, ‘আমি চলি।’

‘তা হলে এলে কেন?’

‘আপনাকে জানাতে?’

‘চলো ঘরে গিয়ে বসবে?’

‘অসম্ভব!’

‘কেন?’

‘আমি দলের একজন নই।’ দীপা উলটো রাস্তা ধরল।

নর্থবেঙ্গল এক্সপ্রেস জলপাইগুড়িতে যায় না। কিন্তু একটা লোকাল ট্রেন পেয়ে গেল সে শিলিগুড়ি থেকে সেটা হলদিবাড়ি যাবে জলপাইগুড়ি ছুঁয়ে। ট্রেনে আসতে আসতে কেবলই মনে হয়েছে অসীমের কথা! শমিত সঙ্গে আসতে চাওয়ামাত্র সে যেভাবে চেঁচিয়ে উঠেছিল তার জন্যে কোনও প্রস্তুতি ছিল না। অসীম যা করেছিল তা শমিতকে করতে দিতে চায় না সে।

আসার আগে সময় ছিল না। অমলকুমারকে চিঠি দিলে সেটা এখানে পৌঁছানো হত না তার আসার আগে। চটজলদি সিদ্ধান্ত নিতে বেলাকোবা পার হওয়ামাত্র চিন্তা শুরু হল। কোথায় উঠবে! কোনও ব্যবস্থাই নেই। কী করা যায়? হঠাৎ মাথায় একটা বুদ্ধি উঁকি মারল। বেলা দশটা নাগাদ স্টেশন থেকে রিকশা নিয়ে সে সোজা কলেজের হস্টেলে চলে এল। রিকশা থেকে নামামাত্র দারোয়ান তাকে দেখল দেখে চিনতে পারল। তার মুখে হাসি ফুটল। দীপা জিজ্ঞাসা করল, ‘বড়দি আছেন?’ দারোয়ান মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলতে তাকে সুটকেসটা দেখতে বলে সে ভেতরে ঢুকল।

বড়দি তাকে দেখে অবাক হলেন। সবকিছু জানার পর বললেন সে স্বচ্ছন্দে দিন পাঁচেক হস্টেলের গেস্টরুমে থাকতে পারে। খাওয়াদাওয়া এখানেই। পাঁচ দিনের জন্যে গেস্ট ফি বাবদ পনেরো টাকা দিতে হবে। টাকার পরিমাণটা শুনেই মনে পড়ল তার শমিতদের কথা। ওরা এই টাকাটা দিতে পারলে লজ্জায় পড়ত না।

রিকশা নিয়ে দুপুরের পরে সে রায়কতপাড়ায় এল দিনবাজার ঘুরে। করলা নদীটা দেখে মনটা ভারী হয়ে গেল। রায়কতপাড়ায় ঢুকে অমলকুমারের নাম বললে কেউ চিনতে পারছিল না। দীপা ইচ্ছে করেই অমলকুমারের বাবার নাম বলছিল না। শেষপর্যন্ত সে জীবনগতি রায় মশাইয়ের বাড়িতে উপস্থিত হয়ে জানল তিনি এখন আদালতে। বাড়িতে ফিরে চেম্বারে বসতে সন্ধে হয়ে যাবে। কিন্তু সেখানে অমলকুমারের খবর পাওয়া গেল। উমাগতি স্কুলের পাশেই ওদের বাড়ি। একটুও ইতস্তত না করে সে অমলকুমারের বাড়িতে এল। রাস্তার ধারে টিনের দরজা। দরজাটি ভেজানো, ঠেলতেই খুলে গেল। ভেতরে চওড়া পরিষ্কার উঠোন। এক বয়স্কা বিধবা মহিলা উঠোনে মোড়া পেতে রোদ্দুরে চুল শুকোতে শুকোতে বই পড়ছেন। শব্দ শুনে অবাক চোখে তাকালেন। দীপা এগিয়ে গেল, ‘অমলবাবু আছেন?’

‘না। ও বাড়িতে নেই। ময়নাগুড়ি গিয়েছে। বিকেলে ফিরবে।’

‘ও, আচ্ছা! আপনি?’

“আমি ওর মা।’ ভদ্রমহিলা বলতে বলতে চেনার চেষ্টা করছিলেন। একটু থেমে প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি নিশ্চয়ই দীপাবলী?’

‘হ্যাঁ।’

‘ওমা, কখন এসেছ? তোমার তো সোজা আমাদের বাড়িতে ওঠার কথা!’

‘না, ঠিক সেরকম কথা হয়নি।’ দীপার ভাল লাগল মহিলার বলার ধরন, ‘আমি আমার পুরনো হস্টেলে উঠেছি।’

‘কেন? আমার কুঁড়েঘর কি খুব খারাপ। অন্যায় করেছ।

‘আমি তো আপনাকে আগে চিনতাম না।’

‘তা ঠিক।’ প্রৌঢ়া মাথা নাড়লেন, ‘তা অবশ্য বলতে পারো। এসো ভেতরে এসো। কখন এলে? আজ সকালের ট্রেনে?’

‘হ্যাঁ। দীপা ওঁকে অনুসরণ করল।

এক ঘণ্টা ধরে বারান্দায় পাশাপাশি বসে অনেক কথা হল। ভদ্রমহিলা একবারও ভুলেও প্রতুল বন্দ্যোপাধ্যায় বা তার পরিবার সংক্রান্ত কোনও কথা বললেন না। তিনি শুধু দীপার কলকাতার জীবনযাপন সম্পর্কে জানতে চাইছিলেন। সেসব নিয়েই কথা হচ্ছিল। একসময় জলখাবারের কথা উঠতে মহিলা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি মিষ্টি খাও তো?’

দীপা হাত নাড়ল, ‘না মাসিমা, মিষ্টিতে আমার আপত্তি আছে।’

চা এল, সঙ্গে বিস্কুট আর ডিমের ওমলেট। ডিম দেখে দীপা মহিলার দিকে তাকাল একবার। প্রতুলবাবুর দাদার স্ত্রী ইনি। সঙ্গে সঙ্গে শ্রদ্ধা বাড়ল।

পাঁচটার কিছু বাদে অমলকুমার ফিরল। লম্বা, সুগঠিত বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা। চোখদুটো আলাদা ধরনের। গভীর। মাসিমা জিজ্ঞাসা করল, ‘বল তো এ কে?’

অমলকুমার ভাবতে চাইল। কিন্তু দীপা সুযোগ দিল না, ‘আমি দীপা।’

‘আরে! আপনি? কখন এলেন?’

‘ও আজ সকালে এসে পুরনো হস্টেলে উঠেছে।’ মাসিমা বললেন।

‘সেকী! মা তো আপনাকে এখানেই রাখতে চেয়েছিল।’

মাসিমা মাথা নাড়লেন, ‘না, থাক। এ নিয়ে জোর করিস না। তুই বরং ওকে একবার জীবনগতিবাবুর । বাড়িতে নিয়ে যা। যে-কাজের জন্যে এসেছে সেটাই আগে করা দরকার।’

টিনের দরজা পেরিয়ে দীপা বলল, ‘আপনি খেটেখুটে এলেন, জিরোবার সময় পেলেন না। খারাপ লাগছে খুব।’

‘একদম খাটিনি। ময়নাগুড়িতে গিয়েছিলাম ব্যাবসার কাজে। কাজ হয়নি।’

‘আপনি ব্যাবসা করেন?’

‘হ্যাঁ।

জীবনগতি রায় মহাশয় অত্যন্ত সজ্জন লোক। দীপার এই ভাবনার প্রচুর প্রশংসা করলেন। খুব কম মানুষ পৃথিবীতে আছে যারা এমন কাজ করতে পারে। আগামীকাল তাকে এগারোটার সময় কোর্টে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে বললেন। দিন চারেকের মধ্যে যাতে সব হয়ে যায় তার চেষ্টা করবেন। সেখান থেকে বেরিয়ে দীপা বলল, ‘একটা রিকশা ডেকে দেবেন?’

‘আমাদের বাড়িতে যাবেন না আজ?’

‘সন্ধে হয়ে গিয়েছে। কাল না হয় যাওয়া যাবে।’

‘চলুন, আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসি বউঠান।’

‘শুনুন। আপনাকে একটা অনুরোধ করব?’

‘নিশ্চয়ই।’

‘আমায় দীপা বলে ডাকবেন।’

অমলকুমার মুখ তুলে তাকাল। তারপর গম্ভীর গলায় বলল, ‘আমি আজ পর্যন্ত আপনার বয়সি কোনও সদ্যপরিচিতা মহিলাকে নাম ধরে ডাকিনি।’

‘ডাকতে আপত্তি আছে?’

‘না। তবে সেক্ষেত্রে আমাকে অমল বলতে হবে।’

‘বেশ। তা হলে আজ থেকে আমরা বন্ধু হলাম।’

‘আমি আমৃত্যু এর মর্যাদা রাখব।’ অমলকুমার হাত তুলে রিকশা ডাকল।

সকল অধ্যায়

১. ১. আজ সারাটা দিন সূর্যদেব উঠলেন না
২. ২. মেয়েরা কি ভূত হয়
৩. ৩. ভালো-মন্দ বোঝার বয়স
৪. ৪. রমলা সেন
৫. ৫. সত্যসাধন মাস্টার
৬. ৬. বৃষ্টিটা চলে যাওয়ার পরে
৭. ৭. চারদিন পৃথিবীটাকে দ্যাখেনি দীপা
৮. ৮. দীপাবলীর বিয়ে
৯. ৯. বাসর এবং বউভাত
১০. ১০. দীপাবলীর ফুলশয্যা
১১. ১১. পুত্ৰটি দেহ রেখেছে
১২. ১২. রমলার চিঠি
১৩. ১৩. প্ৰাপ্তবয়স্কতা শরীরের না মনের
১৪. ১৪. চাবাগানের আশেপাশে
১৫. ১৫. আসাম রোড
১৬. ১৬. একটি মানুষের চেহারা
১৭. ১৭. জলপাইগুড়ি শহরে
১৮. ১৯. রমলা সেনের কাছে
১৯. ১৮. পুলিশের লাঠিচার্জ
২০. ২০. জলপাইগুড়ির হোস্টেলের মেয়ে
২১. ২১. দুশ্চিন্তার ছাপ
২২. ২২. একতারা বাজিয়ে গান
২৩. ২৩. দুর্দান্ত ব্যবসাদার প্রতুল বন্দ্যোপাধ্যায়
২৪. ২৪. সত্যসাধন মাস্টার এসে পড়বেন
২৫. ২৫. অমরনাথ হতভম্ব
২৬. ২৬. তিনদিন ধরে সমানে বৃষ্টি
২৭. ২৭. অমরনাথের শরীর
২৮. ২৮. কলকাতা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে
২৯. ২৯. প্রৌঢ় ভদ্রলোকটি হাঁটছিলেন
৩০. ৩০. এক অদ্ভূত অভিজ্ঞতা
৩১. ৩১. বাড়িটা শুধু পুরনো নয়
৩২. ৩২. উত্তর কলকাতার পথে পথে
৩৩. ৩৩. কলেজ এবং হোস্টেলের বাইরে
৩৪. ৩৪. দীপা অঞ্জলির দিকে তাকাল
৩৫. ৩৫. অমরনাথ শুয়ে আছেন
৩৬. ৩৬. ভবিষ্যৎ সম্পর্কে প্ৰচণ্ড অসহায়তাবোধ
৩৭. ৩৭. তিনতলার ব্যালকনি
৩৮. ৩৮. দীপা চুপ করে আছে
৩৯. ৩৯. সুভাষচন্দ্র এগিয়ে এলেন
৪০. ৪০. মেয়েটির নাম লাবণ্য
৪১. ৪১. বিছানায় টান টান দীপা
৪২. ৪২. কলেজের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে
৪৩. ৪৩. কিছু মানুষ খুন হলেন
৪৪. ৪৪. কেমন একটা সংসার-সংসার ভাব
৪৫. ৪৫. রাধা চলে এল সেজেগুজে
৪৬. ৪৬. দ্বিতীয় অভিনয় হয়ে যাওয়ার পরে
৪৭. ৪৭. কলোনি থেকে কলেজ পাড়ায়
৪৮. ৪৮. স্কটিশ চার্চ কলেজে জানাজানি হয়ে গেল
৪৯. ৪৯. একদম লেডি
৫০. ৫০. রমলা সেন চোখ ছোট করলেন
৫১. ৫১. সাতকাহন প্ৰথম পর্ব সমাপ্ত

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন