১৯. রমলা সেনের কাছে

সমরেশ মজুমদার

দীপা সত্যি কথা বলল, ‘রমলা সেনের কাছে।’

অমরনাথ এবার যেন একটু স্বস্তি পেলেন, ‘সেই সকাল থেকে তোর জন্যে বসে আছি। কোথায় যাচ্ছিস হস্টেলে বলে যাবি তো। বন্ধুর বাড়ি বললে কিছু বোঝা যায়! ওঁর কোনও আত্মীয় আছে নাকি জলপাইগুড়িতে!’

‘না, আত্মীয় নেই।’

‘ও, সেই গেস্ট হাউসে, যেখানে থেকে পরীক্ষা দিয়েছিলি! না না, এভাবে হুটহাট গেস্ট হাউসে চলে যাওয়া ঠিক নয়। তোর ঠাকুমা শুনলে ঘুমাতেই পারবে না।’

‘তুমি ভেতরে এসে বসবে?’

দীপা দেখল যাতায়াতের পথে অনেকেই তাদের লক্ষ করছে। উলটোদিকে কয়েকটা ছোকরা দিনরাত আড্ডা মারে, তাদেরও নজর এখন এদিকে।

‘ভেতরেই তো বসেছিলাম এতক্ষণ।’ বলতে বলতে অমরনাথ দীপাকে অনুসরণ করলেন। বড়দির ঘরের পাশে একটা গেস্টরুম আছে। কোনও গার্জেন এলে সেখানেই বসে। আজ যেহেতু হস্টেলে ছাত্রী কম তাই সব ফাঁকা। অমরনাথের হাতে একটা বড় থলি ছিল। সেটা থেকে বই বের করে সামনে রাখলেন তিনি, ‘এগুলো কিনে আনলাম এবার। লিস্টের বাকি বইগুলো সামনের মাসে দেখব।’

‘বাড়ির সবাই কেমন আছে?’

‘ভাল। তা তোর কলেজে শুনলাম গোলমাল হয়েছে, সবাই বাড়ি চলে গিয়েছে, তুইও চল। এখানে পড়ে থাকবি কেন?’ অমরনাথ সস্নেহে বললেন।

‘না। বাড়িতে গেলে পড়াশুনা হবে না। আমি ভালই আছি৷’

অমরনাথ মেয়েকে দেখলেন। এই ক’দিনেই যেন অনেক পালটে গিয়েছে। বিয়ের পর যা হয়নি। হস্টেলে এসে তাই হয়েছে। দীপা আর ছোট নেই। অমরনাথ ঘড়ি দেখলেন, ‘হরদেববাবুর আসার কথা এখানে, দেরি করলে লাস্ট বাস পাব না।’

‘হরদেববাবু কে?’

অমরনাথ কী বলবেন বুঝতে না পেরে জবাব দিলেন, ‘আমার পরিচিত।’

‘তুমি কিছু খাবে? এখানে চা ওমলেট পাওয়া যায়!’

‘ওমলেট? না থাক। আমি দুপুরে বেরিয়ে খেয়ে এসেছি রুবি বোর্ডিং থেকে। হ্যাঁরে, তোর কোনও অসুবিধে হচ্ছে না তো?’

‘না।’

‘কলেজে ছেলেরা পড়ে, তারা কোনওরকম বিরক্ত করছে না তো?’

‘না।’

‘তোর মামা কলকাতা থেকে চিঠি দিয়েছে। লিখেছে আই এ পাশ করলে যদি চাস তা হলে কলকাতার কলেজে ভরতি হতে পারিস। ওর ওখান থেকেই কলেজ করতে পারবি। অবশ্য রেজাল্ট ভাল হলেই—।’ অমরনাথ থেমে গেলেন। তিনি যেখানে বসেছিলেন সেখান থেকে হস্টেলের সদরদরজা দেখা যায়। কথা বলতে বলতে লক্ষ করেছিলেন হরদেব উঁকি মারছেন। ঠিক শেয়ালের মতো দেখাচ্ছে লোকটার মুখ। আজ দুপুরে রুবি বোর্ডিং-এ ভাত খেয়ে হরদেবের বাড়িতে গিয়েছিলেন তিনি। গতকাল ডাকে চিঠি পেয়েছিলেন যেন জলপাইগুড়িতে এলে দেখা করেন। হরদেব তখন বাড়িতে ছিলেন না। কাছারিতে গিয়েছিলেন। লোকটা উকিল নয় অথচ রোজ নাকি কাছারিতে যায়। অমরনাথ বলে এসেছিলেন তিনি মেয়ের হস্টেলে থাকবেন। হরদেবকে দেখামাত্র তাঁর মনে হল দীপার সামনে ওকে না আনাই ভাল। তিনি উঠলেন, ‘উনি এসে গিয়েছেন, আমি তা হলে চলি।’

কিন্তু অমরনাথ সেই সুযোগ পেলেন না। হরদেব ততক্ষণে ভেতরে ঢুকে দারোয়ানের সঙ্গে কথা বলছেন। হদিশ জেনে এগিয়ে এসেছেন গেস্টরুমের দিকে, ‘আরে আপনি যাওয়ার দু’মিনিট আগে আমি বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলাম। ছি ছি ছি! এই প্রথম গেলেন অথচ আপ্যায়ন করতে পারলাম না।’

অমরনাথ এগিয়ে গেলেন, ‘তাতে কী হয়েছে, আর একদিন হবে।’

হরদেব ততক্ষণে দীপার দেখা পেয়ে গিয়েছেন, ‘বউমা?’

‘হ্যাঁ, আমার মেয়ে।’ অমরনাথ সাততাড়াতাড়ি সামাল দিতে চাইলেন।

‘তুমি কি খানিক আগে স্টেশন থেকে এলে?’

‘না, না, ও কেন স্টেশনে যাবে?’ অমরনাথ প্রতিবাদ করলেন।

‘তা হলে আমি ভুল দেখেছি। তা কেমন পড়াশুনা হচ্ছে?’

এবারও উত্তরটা অমরনাথ দিলেন, ‘আর পড়াশুনা! রাজনীতি করে কলেজটাকেই বন্ধ করে দিল নেতারা। স্বাধীনতার আগে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়ার একটা কারণ ছিল। স্বাধীনতা পেয়ে নিজেদের মধ্যেই খেয়োখেয়ি শুরু হয়ে গেল। বলুন।’

‘ওসব বাইরের ব্যাপারে মাথা ঘামিয়ে কোনও লাভ নেই মা।’ হরদেব উপদেশ দিলেন, ‘ছাত্রছাত্রীদের তপস্যা হল পড়াশুনা করা। টাকাপয়সার চিন্তা নেই যখন তখন মন দিয়ে ওইটেই করো। ভালই হল আলাপ হয়ে। মাঝে মাঝে খোঁজ নিয়ে যাব।’

দীপা চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল। লোকটা তাকে বউমা বলল কেন? বউমা বলে শ্বশুরবাড়ির লোকজন। তাদের কারও সঙ্গে তো অমরনাথের সম্পর্ক থাকার কথা নয়। লোকটা তাকে স্টেশনে দেখেছে। সে অমরনাথের কাছে নিজে থেকে মিথ্যে বলেনি। কিন্তু আগ বাড়িয়ে পুরো সত্যিটাও জানায়নি। রাস্তায় একটি অল্পবয়সি মেয়েকে দেখে যে-বৃদ্ধ মনে রাখে তার মানসিকতা কীরকম! আর টাকাপয়সার কথাটাই বা বলল কেন? সেটা তো একদম অমরনাথের ব্যাপার। দীপা বুঝতে পারছিল অমরনাথ লোকটাকে এখান থেকে সরিয়ে নিতে চান। কিছুতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন না তিনি। যাওয়ার আগে জানিয়ে গেলেন যে সামনের রবিবার বাজার করেই চলে আসবেন। আর ইতিমধ্যে যদি কলেজ দীর্ঘ দিনের জন্যে বন্ধ হয়ে যায় তা হলে চিঠিতে যেন সেটা জানায়। কলেজ বন্ধ থাকাকালীন দীপা যেন হস্টেলের বাইরে না বের হয়। এটা ভাল দেখায় না এবং তিনি নিজেও পছন্দ করছেন না।

বাইরে বেরিয়ে একটু স্বস্তি পেলেন অমরনাথ, ‘আপনি দীপাকে বউমা বলে ডাকবেন না। তা হলে ও আপনাকে সন্দেহ করবে।’

‘মানে?’ অমরনাথের দিকে অবাক হয়ে তাকালেন হরদেব।

হাঁটা শুরু করে অমরনাথ বললেন, ‘প্রতুলবাবুর ব্যাপারটা ও মন থেকে মুছে ফেলেছে।’

‘কী আশ্চর্য! মুছে ফেললেই হল? এখন তো ওর ঘনঘন যাওয়া দরকার ওখানে।’

‘কেন?’

‘আপনাকে আর কী করে বোঝাব! হাজার হোক আপনার মেয়ে ওই বাড়ির বউ। একমাত্র উত্তরাধিকারী। সে যদি বাড়িতে যায় তা হলে প্রতুলের মন নরম হবেই। সেই মেয়েছেলেটা যতই জ্বলুক তাড়িয়ে দিতে তো পারবে না। ঘনঘন গেলে পুরো সম্পত্তি হাতে এসে যাবে।’

‘কিন্তু এ-কথাটা আমি ওকে বলব কী করে?’

‘বলতে হবে। বোঝান। নিজে না পারেন পরিবারকে দিয়ে বলান। অমরনাথবাবু, লক্ষ লক্ষ টাকার সম্পত্তির মালিক হতে গেলে একটু মাথা নোয়াতে হয়। আর হ্যাঁ, আমার টাকাটা আমি পেয়ে গেছি।’ হরদেব হাসলেন।

‘পেয়ে গেছেন মানে?’

‘বাঃ, ব্যাঙ্ককে তো তখনই জানিয়ে দিয়েছিলেন আমার অ্যাকাউন্টে ওই পার্সেন্ট টাকা ট্রান্সফার করে দেওয়া যেন হয়। ওরা করে দিয়েছে।’

অমরনাথ কিছু বললেন না। ব্যাপারটা ভাবতেই তাঁর ভাল লাগছিল না। ক’দিন থেকেই মনে হচ্ছে নেপোয় দই মারছে। দীপার ন্যায্য পাওনায় ভাগ বসাচ্ছে হরদেব। কিন্তু মুখের ওপরে কিছু বলতে সাহসও হচ্ছে না। খানিকটা হাঁটার পর তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘দেখা করতে বলেছিলেন কেন? তেমন কিছু ঘটেছে কি?’

‘হ্যাঁ। প্রতুলের শরীর আরও খারাপ হয়েছে। এখনও দূরে দূরে থাকলে পুরো সম্পত্তিটা বেহাত হয়ে যাবে। আপনার লাস্ট বাস কখন?’ হরদেব জিজ্ঞাসা করলেন।

‘বেশি দেরি নেই। ঘাট পার হতে হবে। তিস্তার চরটাও কম নয়। বার্নিশে পৌঁছাতে সময় লাগবে। কী ব্যাপার?’

ওঁরা কথা বলতে বলতে থানার মোড়ে এসে পড়েছেন ততক্ষণে। হরদেব বললেন, ‘আমি বলি কী যাওয়ার আগে আপনি প্রতুলের সঙ্গে দেখা করে যান। অসুস্থ মানুষ, গেলে খুশি হবে। প্রতুল যত খুশি হবে তত আমাদের মঙ্গল।’

এই ‘আমাদের’ শব্দটা মোটেই পছন্দ হল না অমরনাথের। তিনি ঘড়ি দেখলেন। বড়জোর মিনিট পনেরো সময় ব্যয় করা যেতে পারে। লোকটা খুব খারাপ মতলব দিচ্ছে না। প্রথমবার না হয় ওকে টাকা দেওয়া হয়েছে, সম্পত্তি পেয়ে গেলে তো নগদ হাতে আসছে না তেমন। তখন দেওয়ার কথা চিন্তা করা যাবে। কিন্তু হাতে না-আসা পর্যন্ত লোকটাকে চটানো ঠিক হবে না।

করলা নদীর পাড় ধরে তিনি ঝুলনা পুলের দিকে রওনা হলেন। তাঁর সঙ্গে সমান তালে পা চালাতে হরদেবের অসুবিধে হচ্ছিল। কোনওমতে তাল রেখে তিনি বলতে লাগলেন, ‘প্রতুল এখন শোওয়ার ঘরে, বাইরে আসে না। সেই হারামজাদিটা দরজা পাহারা দিচ্ছে। আমাকে ঢুকতে দেয়নি। আপনি কোনও কথা শুনবেন না। বুঝেছেন?’

অমরনাথ ঘাড় নাড়লেন। সেই মেয়েছেলেটাকে দেখার আগ্রহ তাঁর অনেকদিনের।

গেট পর্যন্ত এসে দাঁড়িয়ে পড়লেন হরদেব। বাগানটার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আমি আর এগোব না। তাতে হিতে বিপরীত হতে পারে। আমি অপেক্ষা করছি, আপনি ঘুরে আসুন।’

মনে মনে তাই চাইছিলেন অমরনাথ। কথা না বাড়িয়ে তিনি বাগানের রাস্তায় পা রাখলেন। বেলা পড়ে আসছে। গাছেরা ছায়া বাড়িয়ে দিচ্ছে। বেশি সময় নষ্ট করলে আজ আর চা-বাগানে ফেরা যাবে না। ঘনঘন ছুটি নেওয়া সাহেব পছন্দ করছে না। কাল সকালে তাঁকে কাজে যেতেই হবে। চারপাশে নজর বুলিয়ে হাঁটছিলেন তিনি। শহরের বুকে অনেকখানি জমি নিয়ে বাড়ি। বিক্রি করলে মন্দ দাম আসবে না। কিন্তু এর মধ্যেই বাগানের চেহারা বেশ খারাপ হয়ে উঠেছে। যত্ন নিচ্ছে না কেউ। অসুস্থতা শুধু মালিকের একার নয়।

অফিসঘরের দরজা বন্ধ। তার মানে ব্যাবসা গুটিয়ে গিয়েছে। অমরনাথ বাইরের ঘরের বন্ধ দরজায় শব্দ করলেন। তিনবারের বার ভেতর থেকে সাড়া মিলল। একটি নারীকণ্ঠ জানতে চাইছে কে এল? অমরনাথ গলা তুললেন, ‘দরজাটা খুলুন।’

দরজা খুলল। মধ্যবয়সি এক মহিলা আঁচলে শরীর ঢেকে সামনে এসে দাঁড়ালেন, ‘কী চাই?’ জিজ্ঞাসা করেই বিরাট জিভ বের করে দাঁতে কাটলেন তিনি, ‘ওমা, আপনি? আসুন ভেতরে আসুন।’

অমরনাথ পলকেই বুঝে নিলেন। এরকম এক মহিলা প্রতুলবাবুকে কী করে কবজা করল তা তিনি বুঝতে পারছিলেন না। গায়ের রং এবং মুখচোখের গড়ন দেখলে কারও পুলক জাগবে না। সম্বল বলতে শুধু স্বাস্থ্য। এত শক্ত বাঁধুনি অঞ্জলিরও কোনওদিন ছিল না। অমরনাথ কিন্তু কিন্তু করে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘প্রতুলবাবু শুনলাম অসুস্থ। কেমন আছেন?’

‘একই রকম। আপনি ভেতরে আসুন না!’

অমরনাথ ভেতরে ঢুকলেন। বাড়িটার কোথাও কোনও শব্দ নেই। এই মহিলার নাম আনা। এরকম নাম কোনও মানুষের কী করে হয়? নিশ্চয়ই কোনও গল্প আছে পেছনে। আনা জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনার মেয়ে ভাল আছে?’

‘আছে।’ অমরনাথ উসখুস করলেন। তারপর নিচু স্বরে বললেন, ‘ওর ব্যাপারে আপনি যা করেছেন তার জন্যে–।’

‘কিছুই করিনি আমি। আর যদি কিছু করে থাকি নিজের জন্যেই করেছি। তা উনি অসুস্থ এ-খবর কোথায় পেলেন?’ আনা জিজ্ঞাসা করল।

‘কিছুদিন আগেও তো আমি এসেছিলাম।’

‘তা জানি। কিন্তু তখন তো উনি হাঁটাচলা করতেন। আপনাকে নিশ্চয়ই হরদেব ঘোষাল খবরটা দিয়েছে। শয়তানের জাহাজ।’

অমরনাথ অবাক হলেন। এরা পরস্পরকে হারামজাদি এবং শয়তানের জাহাজ বলছে যখন, তখন মতান্তরের পেছনে নিশ্চয়ই কারণ আছে। তিনি ঘড়ি দেখলেন, ‘আপনি যদি কিছু মনে না করেন, আমার তাড়া আছে, বাস ধরতে হবে, একবার ওঁকে দেখে যেতে পারি কি?

‘কী কাণ্ড! এভাবে বলছেন কেন? আসুন। আপনার বেয়াইয়ের সঙ্গে আপনি দেখা করবেন তাতে আমি আপত্তি করব কেন?’ আনা তাঁকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল। এত সহজে সাক্ষাতের অনুমতি পাওয়া যাবে তা হরদেবের কথা শুনে মনে হয়নি অমরনাথের।

একটা বিশাল পালঙ্কে শুয়ে আছেন প্রতুল বন্দ্যোপাধ্যায়। চট করে চিনে নেওয়া এখন মুশকিল। ভদ্রলোকের গায়ের চামড়ার ওপর যেন কেউ কালো রং মাখিয়ে দিয়েছে। শরীরের বাহার এখন শেষ। চোখ বসে গিয়েছে। আনা ঘরে ঢুকে বলল, ‘চেয়ে দ্যাখো, কে এসেছেন। তোমার বেয়াই, যাঁর মেয়ের সর্বনাশ করেছিলে।’

অমরনাথ হোঁচট খেলেন। আনা যখন কথা শুরু করেছিল তখন মনে হয়েছিল বাইরের কেউ অসুস্থ স্বামীর কাছে এলে স্ত্রী এভাবেই পরিচয় করিয়ে দেয়। আনা এখন তা হলে সেই ভূমিকা নিয়ে নিয়েছে। কিন্তু শেষ চারটে শব্দ কানে যাওয়ামাত্র ধারণাটা পালটে গেল।

প্রতুলবাবু কোনওমতে মুখ ফেরালেন, দেখে বোঝা গেল অমরনাথকে চিনতে তাঁর কোনও অসুবিধে হচ্ছে না। অমরনাথ বিছানার পাশে রাখা চেয়ারে বসে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী হয়েছে আপনার? এখন কেমন বোধ করছেন?’

প্রতুলবাবু মাথা নাড়লেন, ‘প্রায়শ্চিত্ত করছি। পুরোটাই করতে চাই যাতে পরজন্মে কোনও দায় না থেকে যায়। বউমা কেমন আছে?’ গলার স্বর খুবই দুর্বল, কিন্তু কথা বলার ধরনে বোঝা যাচ্ছে যে তাঁর বোধশক্তি চমৎকার রয়েছে।

অমরনাথ বললেন, ‘ভাল। কিন্তু ডাক্তার কী বলছে? রোগটা ধরতে পেরেছে কি?’

প্রতুলবাবু মাথা নাড়লেন, ‘পেরেছে।’

এরপর তিনজনেই কিছুক্ষণ চুপচাপ। অমরনাথ আনাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এর আগে তো দেখে গেলাম হাঁটাচলা করছেন লাঠি নিয়ে। এখন কি—?’

আনা বলল, ‘ধরে ধরে বাথরুমে নিয়ে যাই। ছাই ফেলতে তো ভাঙা কুলো আছিই। জলপাইগুড়ির সব বড় ডাক্তার দেখানো হয়ে গিয়েছে। বললাম, কলকাতায় চলো তা ইনি এখান থেকে নড়বেন না।’

‘অসুখটা কী?’

‘প্রথমে তো সন্ন্যাস রোগ হতে হতে হয়নি। একদিকের কিছুটা পড়ে গিয়েছিল। সেটা সামলে তুলেছিলাম আমি। এখন শুনছি পেটে গলায় ঘা হয়েছে। পাতলা ঝাল নুন ছাড়া খাবার দিতে হচ্ছে।’

‘আর কেউ আসেন না? ওঁর দাদা?’

‘দু’দিন এসেছিলেন। দুই ভাইয়ের মধ্যে ঝগড়া দেখে আমি আসতে নিষেধ করেছি। অসুস্থ মানুষকে দেখতে আসছে না সম্পত্তি হাতাতে? অমন আসার কোনও দরকার নেই। ওঁর বন্ধু হরদেব শয়তানটা আসত আর কানের কাছে গুজুর গুজুর করত। দিনরাত বদ মতলব দিত ওঁকে।’ আনা গড়গড় করে বলে যাচ্ছিল।

এইসময় অমরনাথের কানে প্রতুলবাবুর চিনচিনে গলা এল, ‘হরদেবের সঙ্গে আপনার দেখা হয়? হরদেবের সঙ্গে?’

অমরনাথ ঢোঁক গিললেন! হরদেব সম্পর্কে আনার মনোভাব তিনি জেনেছেন। এমন লোকের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ হয় জানলে এ-বাড়িতে ঢোকা বন্ধ না হয়ে যায়। তিনি দু’দিক বাঁচিয়ে বললেন, ‘সেই যে যেদিন এসেছিলাম সেদিন দেখেছিলাম।’

‘তাকে এড়িয়ে চলবেন। দু’মুখো সাপ।’ প্রতুলবাবু চোখ বন্ধ করলেন।

‘অ্যাদ্দিনে চৈতন্য হল। অনেক বলেকয়ে ব্যাবসা থেকে ভাগিয়েছিলাম।’ আনা বিজয়িনীর গলায় কথাগুলো বলল। অমরনাথের কৌতূহল হল, ‘তিনি তো একসময় খুব বন্ধু ছিলেন প্রতুলবাবুর, মানে এমন শুনেছিলাম।’

‘ঠিকই।’ আনা বলল, ‘এ বাড়িতে আসতেন শুধু ধান্দা নিয়ে। আমার শরীরে দু’-দু’বার হাত দেবার চেষ্টা করেছেন। ওঁর বিয়ে করা বউয়ের সঙ্গে ফস্টিনস্টি করতেন। তারপর যেই ইনি অসুখে পড়লেন অমনি আমার কানে মন্ত্র দিতে এলেন যদি আমি ওঁর সঙ্গে হাত মেলাই তা হলে একেবারে রাজরানি করে দেবেন। বুড়ো শেয়াল।’

অমরনাথ মনে মনে শঙ্কিত হলেন। হরদেবের চরিত্রের এই দিকটা তিনি জানতেন না। এই লোক স্বার্থের জন্যে অনেক দূর যেতে পারে। ওঁকে দীপার হস্টেলে দেখা করতে বলে তিনি অন্যায় করেছেন। আনা ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল। যাওয়ার আগে বলে গেল, ‘আমি না আসা পর্যন্ত উঠে যাবেন না। হাজার হোক কুটুম মানুষ।’

অমরনাথ ঘড়ি দেখলেন। সন্ধের সময়েও নৌকো ওপারে যায়। তখন আর সরাসরি চা-বাগানে যাওয়ার বাস পাওয়া যাবে না। ধূপগুড়িতে গিয়ে বদল করতে হবে। কিন্তু প্রতুলবাবুকে একা পাওয়ার সুযোগ তো আর পাবেন কিনা কে জানে! তিনি বললেন, ‘আপনার ব্যাবসাপাতির কী খবর?’

হাতটা অসহায়ভাবে নাড়লেন প্রতুলবাবু, ‘সব শেষ। এখন দিন গুনছি। এভাবে বেঁচে থাকার কোনও মানে হয়?’

‘এ কথা কেন বলছেন? চিকিৎসা নিশ্চয়ই আছে।’

‘ছাই আছে। দিনরাত ওষুধ গিলছি। কী হচ্ছে?’ প্রতুলবাবু নিশ্বাস ফেললেন, ‘কিন্তু মরতে আমার ইচ্ছে হচ্ছে না। সত্যি বলছি। চারদিকে এত কিছু ছড়ানো, আমার এত টাকা, আর আমি অসময়ে মরে যাব?’

‘মৃত্যুর কথা চিন্তা করবেন না।’

‘করছি কি সাধে। ওই যে মেয়েছেলেটা আমার সেবা করছে, আজকাল তো ওর শরীরটাকেও এক মিনিট ছুঁতে পারি না। সমস্ত শরীরে ব্যথা আমার। কত কী ভোগ করার ছিল মশাই, আর হল না।’ প্রতুলবাবুর চোখের কোল উপচে জল গড়িয়ে এল। স্তম্ভিত হয়ে গেলেন অমরনাথ। এই অবস্থাতে যে-মানুষ বলে দিন গুনছি তার এখনও ভোগের তৃষ্ণা মিটল না? প্রায়শ্চিত্ত আর কবে হবে?

তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তির কোনও বিলিব্যবস্থা করেছেন? একটা কিছু করে রাখা তো উচিত।’

‘হুঁ করব। এখনই তো মরছি না।’ প্রতুলবাবু চোখ বন্ধ করেই বললেন।

অমরনাথ হোঁচট খেলেন। লোকটা বলে কী! তিনি কথা খুঁজে পাচ্ছিলেন না। প্রতুলবাবু এখন অত্যন্ত ক্লান্ত ভঙ্গিতে পড়ে রয়েছেন। হঠাৎ মনে পড়ে যাওয়াতে অমরনাথ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আমি মনে করতে পারছি না আপনাকে জিজ্ঞাসা করেছি কিনা, যখন আমার মেয়ে জলপাইগুড়িতে পরীক্ষা দিতে এসেছিল তখন কি আপনি তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন?’

প্রতুলবাবুর মাথা ঈষৎ নড়ল। অমরনাথ বুঝলেন, উনি হ্যাঁ বললেন। তাই জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনার কি কিছু বলার ছিল?’

প্রতুলবাবু বললেন, ‘ছিল। তবে এখন আর নেই।’

অমরনাথ উঠে দাঁড়ালেন। এরপর আর ফেরার উপায় থাকবে কিনা সন্দেহ। তিনি বললেন, ‘যদি কোনও প্রয়োজন হয় খবর পাঠাবেন, আমি তৎক্ষণাৎ চলে আসব।’

প্রতুলবাবু এবার চোখ খুললেন, ‘আমি একবার বউমাকে দেখতে চাই।’

অমরনাথ দুর্বল বোধ করলেন। প্রতুলবাবু তার দিকে তাকিয়ে। তিনি বললেন, ‘এ তো খুবই ভাল কথা। তবে, আমার মেয়ে বড় জেদি।’

প্রতুলবাবু হাসলেন, ‘এককালে মাংস কেনার আগে খাসিটাকে দেখতাম। যার ঘাড় শক্ত, জেদি, ঢুঁস মারছে, আর গায়ের রং কালো, সেটাকেই কাটতে বলতাম। জেদিদের পোষ মানাতে আনন্দ পেতাম তখন। আজ ক্ষমতা নেই, বিছানায় পড়ে আছি। কিন্তু আপনার মেয়েকে তো ভাল করে মনেও নেই। এই ক’বছরে সে নিশ্চয়ই অনেক বড় হয়েছে। আমার এই বিষয়সম্পত্তির সে একমাত্র উত্তরাধিকারিণী। আর একজন তো পাগল হয়ে হাসপাতালে। ওর সঙ্গে তাই আমি কথা বলতে চাই। যদি সে সারাজীবন বৈধব্য পালন করে তা হলে—।’ ঘনঘন নিশ্বাস নিতে লাগলেন প্রতুলবাবু। অমরনাথ পাথরের মতো দাঁড়িয়ে ছিলেন। পেছনে শব্দ হল। আনা ছোট একটা ট্রে-তে চা আর মিষ্টি রেখে সামনে এসে দাঁড়াল, ‘নিন, এগুলো খেয়ে নিন।’

অমরনাথের যেন সংবিৎ ফিরল, ‘না না। আমার খুব দেরি হয়ে গেছে।’

‘আরও একটু হোক।’ আনা হাসল, “আচ্ছা, আপনি বরং বাইরের ঘরে বসে খাবেন আসুন। রুগির সামনে—।’ আনা ট্রে নিয়ে বেরিয়ে গেল।

অমরনাথের আর দাঁড়াতে ইচ্ছে করছিল না। তিনি প্রতুলবাবুকে বললেন, ‘আচ্ছা, আজ তা হলে চলি। নমস্কার।’ প্রতুলবাবু মাথা নাড়লেন।

বাইরের ঘরে পৌঁছে অমরনাথ দেখলেন টেবিলে চা মিষ্টি রেখে আনা দাঁড়িয়ে আছে। তিনি বললেন, ‘এসবের কী দরকার ছিল। বাড়িতে যখন অসুস্থ মানুষ—।’

‘বাঃ। কুটুম শুকনো মুখে ফিরে যাবে?’ আনা হাসল।

‘আমি তা হলে চা খাচ্ছি।’ দাড়িয়ে দাঁড়িয়েই চা খেয়ে নিতে চাইলেন তিনি। কিন্তু আনা শুনল না, ‘ওমা, বসে খান। এতে এ-বাড়ির অকল্যাণ হবে।’

অগত্যা বসলেন অমরনাথ। আনা খানিকটা তফাতে দাঁড়িয়ে। আনা জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনার মেয়ে তো জলপাইগুড়িতে থেকেই পড়ছে।’

চায়ে চুমুক দিয়ে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললেন অমরনাথ।

আনা বলল, ‘আপনাকে কয়েকটা কথা বলব।’

অমরনাথ তাকালেন।

আনা হাসল, ‘ওঁর অবস্থা তো বুঝতে পারছেন। এখন শুধু দিন গোনা। এত বিষয়সম্পত্তির বিলিব্যবস্থা কিছুই করছেন না। এদিকে শকুনগুলো ওত পেতে রয়েছে। মরলেই ঝাঁপিয়ে পড়বে। আমি একা মেয়েছেলে তাদের সঙ্গে লড়ব কী করে বুঝতে পারছি না। আপনি যদি আমার পাশে দাঁড়ান তা হলে ভাল হয়।’

‘কী করতে হবে আমাকে?’ অমরনাথ সতর্ক হলেন।

‘দেখুন, অল্প বয়সে বিধবা হয়ে এ-বাড়িতে এসেছিলাম। আমার যৌবন দিয়ে শুধু নয়, সেবা দিয়েও ওঁকে শান্তি দিচ্ছি। স্ত্রী ছিল, কিন্তু তার তো কোনও ক্ষমতা ছিল না। আমার জীবনটা এ-বাড়ির জন্যে খরচ করেছি। এই যে এখনও আমি এখানে পড়ে আছি তা শুধু মায়ার জন্যে। আমার শরীর কি বুড়ি হয়ে গিয়েছে, বলুন?’

অমরনাথ মাথা নেড়ে না বললেন।

‘তা হলে নিজেকে আমি বঞ্চিত করব কেন? আমি ওঁর সম্পত্তির ভাগ চাই। তবে একা নিতে চাইলে উনি দেবেন না। কিছুদিন হল খুব বউমা বউমা করছেন। আমি বাধা দিচ্ছি না। আপনি কোনও ভাল উকিলকে দিয়ে একটা উইল করান। সম্পত্তির ভাগ দুটো হবে। একটা আমার আর অন্যটা আপনার মেয়ের। উইলটা তাড়াতাড়ি করিয়ে ওঁকে দিয়ে সই করিয়ে নিতে হবে। ততদিন আমি ওঁকে আগলে রাখব। বুঝেছেন?’

‘যদি প্রতুলবাবু সই না করেন?’

‘বললাম তো, আমি একা চাইলে সই করবেন না। কিন্তু আপনার মেয়ে এলে মনে হয় না বলতে পারবেন না।’

‘কিন্তু উনি শর্ত দিয়েছেন যে দীপাকে বিধবা থাকতে হবে।’

‘থাকবে। হিন্দু বিধবাকে ঘরের বউ করে ক’জন নেয়। আর সে তো আমার মতো অশিক্ষিত নয় যে শুধু দাসীবৃত্তি করবে। সে পড়াশুনা করছে, মাথা উঁচু করে থাকবে। কিন্তু দ্বিতীয় স্বামীর ঝিগিরি করার চেয়ে এত সম্পত্তির দখল নিয়ে মর্জিমতো চলতে পারবে। কেন, আপনার কি মেয়ের আবার বিয়ে দেবার ইচ্ছে আছে?’

‘না না। এখন তো সেই প্রশ্ন উঠতেই পারে না।’

‘দেখুন বেয়াইমশাই, মেয়ে তো আপনার নিজের নয়। আর বয়স এমন কিছু হয়নি আপনার। এই সম্পত্তির আধভাগ পেলে আপনার জীবন বদলে যাবে। মেয়ে তো নামেই, ভোগ করবেন তো আপনিই। শুধু আমার সঙ্গে যুক্তি করে চলুন, কোনও অসুবিধে হবে না।’ আনা মিষ্টি করে হাসল।

চা খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। অমরনাথ উঠলেন, ‘তা হলে আমি চলি।’

আনা অমরনাথকে সঙ্গে নিয়ে বারান্দায় বেরিয়ে এল, ‘তা হলে উইল কবে আনছেন?’

‘দেখি।’ বিড়বিড় করলেন অমরনাথ।

‘কী আশ্চর্য! আপনি এখনও দেখি বলছেন?’

‘না, মানে উকিলের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে হবে তো! ওঁর বিষয়সম্পত্তির পরিমাণ আমি জানিও না। সেসব তো পরিষ্কার করে উইলে লিখতে হবে!’

‘তার জন্যে আপনি চিন্তা করবেন না। প্রথমবার যখন অসুখ থেকে উঠলেন, তখন উনি একটা কাগজে সব লিখে উকিলবাবুকে দেবেন বলে ঠিক করেছিলেন। তারপর আবার অসুখে পড়তে সেটা আর দেওয়া হয়নি। সেই কাগজটা আমি সরিয়ে রেখেছিলাম। ওটা আমি আপনাকে দিতে পারি।’ আনা গম্ভীর গলায় বলল।

‘কাগজটা একবার দেখতে হয়।’

‘আপনাকে আমি কিন্তু বিশ্বাস করছি।’

‘ঠিক আছে।’

আনা সঙ্গে সঙ্গে ভেতরে চলে গেল। হাঁটুর ওপর শিরশির করতে লাগল অমরনাথের। তিনি কি এক ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছেন! তা কেন হবে! প্রতুলবাবু নিশ্চয়ই সজ্ঞানে পড়ে সই করবেন। জালিয়াতির কোনও ব্যাপার নেই। এই বিশাল সম্পত্তির অর্ধেকটা তাঁর হস্তগত হতে যাচ্ছে। মনে হঠাৎ পুলক জাগল তাঁর। এখন আর আগুপিছু কোনও ভাবনা মাথায় আসছে না। আনার সঙ্গে হাত মেলাতে কোনও আপত্তি নেই। হরদেব ঘোষালের চাইতে আনা শতগুণে ভাল। শকুনের মতো দেখতে বুড়োর থেকে স্বাস্থ্যবতী যৌবন যাবযাব মহিলা তো চিরকালই শ্রেয়। এখন ওই কাগজে যদি বিশদ লেখা থাকে তবেই বাঁচোয়া।

উইলের কথা মনে আসতেই উকিলের চিন্তা এল। জলপাইগুড়ির কোনও উকিলকে তিনি চেনেন না। আসলে এতদিন কোর্ট কাছারি করতে হয়নি যাঁকে তিনি কী করে উকিল চিনবেন! কোর্ট কাছারির কথা মনে পড়তেই হরদেবের মুখ যেন দেখতে পেলেন তিনি। অসম্ভব। হরদেবকে এসব কথা বলা যাবে না।

এইসময় আনা ফিরে এল তিন-চারটে ফুলস্কেপ কাগজ হাতে নিয়ে। এক পলক চোখ বুলিয়েই অমরনাথ বুঝতে পারলেন এটা একটা উইলের খসড়া। চটপট ভাঁজ করে সেটাকে পকেটে পুরে রাখলেন তিনি। তারপর বললেন, ‘আমি সাত দিনের মধ্যেই একটা ব্যবস্থা করছি। কোনও চিন্তা নেই।’

আনা বলল, ভাল। তবে এভাবে পিছু টান নিয়ে আসবেন না। উইলের কাজ, হয়তো রাতে থেকে যেতে হতে পারে। সেক্ষেত্রে এই বাড়িতেই থাকবেন। অনেক ঘর পড়ে রয়েছে। কুটুম বলে লজ্জা করবেন না।’

অমরনাথ মাথা নাড়লেন, ‘না না। সে পরে ঠিক করা যাবে।’

পা বাড়াতে গিয়ে অমরনাথ দেখলেন একটা লোক সাইকেলে চেপে বাগানের মধ্যে দিয়ে আসছে। একেবারে তাঁর সামনে পৌঁছে সাইকেল থেকে নেমে লোকটা বলল, ‘টেলিগ্রাম।’

অমরনাথ মুখ ফিরিয়ে আনার দিকে তাকালেন। আনা বারান্দার প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে। সে ইশারায় অমরনাথকে টেলিগ্রাম নিতে বলল। লোকটার এগিয়ে দেওয়া খাতায় সই করে অমরনাথ টেলিগ্রামের পাতাটা আনার দিকে এগিয়ে ধরতে আনা বলল, ‘ওমা, আমি লেখাপড়া জানি নাকি! একটু আধটু বাংলা পড়তে পারি। ওটা কি বাংলায় লেখা?’

অমরনাথ খামের মুখটা খুলে কাগজটা বের করলেন। খবরটা পড়ে তিনি কী করবেন বুঝতে পারছিলেন না। আনা পেছন থেকে জিজ্ঞাসা করল, ‘কী লেখা আছে ওতে?’

অমরনাথ মাথা নাড়লেন, ‘উনি নেই।’

‘কে নেই?’ দ্রুত বারান্দা থেকে নেমে এল আনা।

‘প্রতুলবাবুর স্ত্রী।’

আনা থমকে দাঁড়াল। পলকেই তার মুখ গম্ভীর হয়ে গেল।

অমরনাথ বললেন, ‘হাসপাতাল থেকে টেলিগ্রাম করেছে। মৃতদেহ ওরা আজ বিকেল পর্যন্ত রেখে দেবে বলে লিখেছে।’

‘আজ বিকেল? বিকেল তো শেষ হয়ে গিয়েছে।’

‘হুঁ।’

‘দিন।’ হাত বাড়াল আনা। অমরনাথ টেলিগ্রামটা দিলেন। তারপর বললেন, ‘এখন রওনা হলেও তো মৃতদেহ দেখা যাবে না। টেলিগ্রাম দেরি করে এসেছে। কী হয়েছিল তা অবশ্য লেখা নেই।’

‘যাবে জানতাম। তবে এত তাড়াতাড়ি—।’

‘পাগল মানুষের অবশ্য বেঁচে থাকার চেয়ে যাওয়াই মঙ্গল।’

‘হ্যাঁ। বেঁচে গেল।’

‘কিন্তু এখন তো ওঁর কাজকর্ম করতেই হবে। অশৌচ বলে কথা।’

‘কীসের অশৌচ?’

‘বাঃ। বাড়ির বউ মরে গেলে অশৌচ হবে না?’

‘আপনার মেয়েকেও তা হলে সেসব মানতে হয়। মানবে?’

অমরনাথ আকাশের দিকে তাকালেন। মনে মনে বললেন, না মানার তো কারণ কিছু নেই। জন্ম ও বিবাহসূত্রে যে-আত্মীয়তা তা কি কখনও অস্বীকার করা যায়? তাঁর মনে হল বানার্জিবাড়ির ব্যাপারে দীপার যে তীব্র আপত্তি রয়েছে তা নরম করার জন্যে এই খবরটাকে ব্যবহার করা যায়। যদিও মেয়ের ওপর তিনি এ-ব্যাপারে আস্থা রাখতে পারছেন না কিন্তু সম্পত্তি পাওয়ার ব্যাপারে অশৌচ পালন করাটা অত্যন্ত জরুরি। তিনি জবাব দিলেন, ‘মানতেই হবে।’

‘কিন্তু আমি বলছি মানার কোনও দরকার নেই?’ আনা বলল।

‘মানবে না?’ হতভম্ব অমরনাথ।

‘না। কারণ উনি মারা যাননি।’

‘কী আশ্চর্য! টেলিগ্রাম—।’

‘টেলিগ্রাম এসেছে। কিন্তু তাতে অন্য কথা লেখা আছে। ওঁর শরীর খারাপ হয়েছে। হাসপাতাল থেকে তাই জানিয়েছে। মারা যাওয়ার খবর আপনি আর আমি ছাড়া কেউ জানবে না। যদি তাই হল তা হলে অশৌচ কীসের?’

‘এসব তুমি কী বলছ?’ আর আপনি নয়। কাজের মেয়েছেলেকে তুমি বলা উচিত, অমরনাথের অবচেতন মন জানিয়ে দিল।

‘ঠিকই বলছি। খবরটা কর্তা পেলে আর উইলে সই করা পর্যন্ত বেঁচে থাকবেন ভেবেছেন? সারাজীবন যাদের ওপর অত্যাচার করেছেন এখন তাদের জন্যে ওঁর বুক ফেটে যাচ্ছে। দিনরাত অনুতাপ করছেন। এইসময় খবরটা শুনলে হয়তো হার্ট ফেল করে ফেলবেন। আপনি তা চান?’ আনাকে খুব হিংস্র দেখাচ্ছিল।

‘না না। তা নয়!’

‘আমি ওঁকে মেরে ফেলতে দেব না। আপনি আপনার মেয়ের ভাল না চাইতে পারেন আমি আমার স্বার্থ দেখব।’

‘খবরটা তো একদিন দিতে হবে।’

‘উইল হয়ে যাওয়ার পর। শুনুন, আমি একদিন আপনার মেয়েকে বাঁচিয়েছিলাম। যদি সত্যি সেটা মনে রাখেন তা হলে যা বলছি তাই শুনুন। এই মৃত্যুসংবাদ আমরা দু’জন ছাড়া কেউ জানবে না। কথা দিন!

‘বেশ!’ অমরনাথ সম্মোহিতের মতো উচ্চারণ করলেন।

‘তা হলে সাত দিনের মধ্যে উইল আর উকিল নিয়ে আসুন।’ আনা দ্রুত পায়ে ভেতরে চলে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। মন খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল অমরনাথের। সম্বন্ধ করতে আসার দিন দেখা মহিলাকে মনে পড়ছিল। হাঁটতে হাঁটতে গেটের কাছে আসার সময় ভাবছিলেন অদ্ভুত মানুষের জীবন। বেঁচে থেকে যে স্বীকৃতি পায়নি মরে গিয়েও তা হারাল।

‘এই যে মশাই। আমি তো ভাবলাম ওখানেই রাত কাটাবেন।’ গলা কানে আসতেই অমরনাথ হরদেবকে দেখতে পেলেন। গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন। সঙ্গে সঙ্গে ঘিনঘিনে ভাব এল। তিনি বললেন, ‘চলি। অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে।’

‘কথা হল?’

‘তেমন নয়।’

‘টেলিগ্রামটা কীসের বলুন তো? আপনি তো সই করে নিয়েছেন দেখলাম।’

‘ওঁর স্ত্রী খুব অসুস্থ।’ কথাটা বলেই অমরনাথের মনে হল তিনি পাঁকের মধ্যে নেমে পড়লেন।

হরদেব বললেন, ‘ওই মেয়েছেলেটা কী বলল? ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খেতে চাইছে। আমাকে তো চেনে না বাছাধন।’

অমরনাথ হাত জোড় করলেন, ‘এবার আমাকে যেতে দিন, শেষ নৌকো হয়তো ছেড়ে যাবে।’ উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে তিনি প্রায় দৌড়াতে লাগলেন।

সকল অধ্যায়

১. ১. আজ সারাটা দিন সূর্যদেব উঠলেন না
২. ২. মেয়েরা কি ভূত হয়
৩. ৩. ভালো-মন্দ বোঝার বয়স
৪. ৪. রমলা সেন
৫. ৫. সত্যসাধন মাস্টার
৬. ৬. বৃষ্টিটা চলে যাওয়ার পরে
৭. ৭. চারদিন পৃথিবীটাকে দ্যাখেনি দীপা
৮. ৮. দীপাবলীর বিয়ে
৯. ৯. বাসর এবং বউভাত
১০. ১০. দীপাবলীর ফুলশয্যা
১১. ১১. পুত্ৰটি দেহ রেখেছে
১২. ১২. রমলার চিঠি
১৩. ১৩. প্ৰাপ্তবয়স্কতা শরীরের না মনের
১৪. ১৪. চাবাগানের আশেপাশে
১৫. ১৫. আসাম রোড
১৬. ১৬. একটি মানুষের চেহারা
১৭. ১৭. জলপাইগুড়ি শহরে
১৮. ১৯. রমলা সেনের কাছে
১৯. ১৮. পুলিশের লাঠিচার্জ
২০. ২০. জলপাইগুড়ির হোস্টেলের মেয়ে
২১. ২১. দুশ্চিন্তার ছাপ
২২. ২২. একতারা বাজিয়ে গান
২৩. ২৩. দুর্দান্ত ব্যবসাদার প্রতুল বন্দ্যোপাধ্যায়
২৪. ২৪. সত্যসাধন মাস্টার এসে পড়বেন
২৫. ২৫. অমরনাথ হতভম্ব
২৬. ২৬. তিনদিন ধরে সমানে বৃষ্টি
২৭. ২৭. অমরনাথের শরীর
২৮. ২৮. কলকাতা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে
২৯. ২৯. প্রৌঢ় ভদ্রলোকটি হাঁটছিলেন
৩০. ৩০. এক অদ্ভূত অভিজ্ঞতা
৩১. ৩১. বাড়িটা শুধু পুরনো নয়
৩২. ৩২. উত্তর কলকাতার পথে পথে
৩৩. ৩৩. কলেজ এবং হোস্টেলের বাইরে
৩৪. ৩৪. দীপা অঞ্জলির দিকে তাকাল
৩৫. ৩৫. অমরনাথ শুয়ে আছেন
৩৬. ৩৬. ভবিষ্যৎ সম্পর্কে প্ৰচণ্ড অসহায়তাবোধ
৩৭. ৩৭. তিনতলার ব্যালকনি
৩৮. ৩৮. দীপা চুপ করে আছে
৩৯. ৩৯. সুভাষচন্দ্র এগিয়ে এলেন
৪০. ৪০. মেয়েটির নাম লাবণ্য
৪১. ৪১. বিছানায় টান টান দীপা
৪২. ৪২. কলেজের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে
৪৩. ৪৩. কিছু মানুষ খুন হলেন
৪৪. ৪৪. কেমন একটা সংসার-সংসার ভাব
৪৫. ৪৫. রাধা চলে এল সেজেগুজে
৪৬. ৪৬. দ্বিতীয় অভিনয় হয়ে যাওয়ার পরে
৪৭. ৪৭. কলোনি থেকে কলেজ পাড়ায়
৪৮. ৪৮. স্কটিশ চার্চ কলেজে জানাজানি হয়ে গেল
৪৯. ৪৯. একদম লেডি
৫০. ৫০. রমলা সেন চোখ ছোট করলেন
৫১. ৫১. সাতকাহন প্ৰথম পর্ব সমাপ্ত

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন