২৯. প্রৌঢ় ভদ্রলোকটি হাঁটছিলেন

সমরেশ মজুমদার

ফুল হাতা শার্ট, ধুতির কোঁচা বাঁ হাতের মুঠোয় তুলে নাকের প্রান্তে চাপা, ডান হাতে বড় ছাতার বাঁট উঁচিয়ে ধরে প্রেীঢ় ভদ্রলোকটি হাঁটছিলেন। তাঁর ছাতার নীচে গোলগাল ফরসা লাজুক মুখের মেয়েটি পা ফেলছিল শামুকের মতো। মাঝে মাঝে কোঁচার খুঁট সরিয়ে প্রৌঢ় কথা বলছিলেন, ‘কোনওদিকে তাকাবে না। মাস্টার যখন ডাকবে তখন তার পেছন পেছন অন্য মেয়েদের সঙ্গে ক্লাসে ঢুকে মাঝখানে বসবে। আবার ক্লাস শেষ হলে মাস্টারের পেছন পেছন মেয়েদের ঘরে এসে বসবে। কলেজ ছুটি হলেই আমি গেটে এসে দাঁড়াব। দেখো, বেশিক্ষণ যেন আমাকে দাঁড়াতে না হয়।’

মেয়েটি ঘাড় নাড়ল। তার মুখ থেকে কোনও কথা বের হল না।

হেদুয়ার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় প্রৌঢ় বাঁদিকে তাকালেন। সেখানে বসন্ত কেবিন নামে একটি রেস্টুরেন্ট রয়েছে। কিছু এঁচোড়ে পাকা ছেলের সারাদিনের আড্ডা মারার জায়গা ওটা। তারপরেই কসমস নামে আর একটি রেস্টুরেন্ট। এ দুটির সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় অনেক মন্তব্য বাতাসে উড়ে আসে। প্রৌঢ় আবার কোঁচার খুঁট সরালেন, ‘কোনও বদ ছেলে যদি আগ বাড়িয়ে কথা বলতে আসে তা হলে তাকে বলে দেবে যে তোমার বাবা ওসব পছন্দ করেন না। মিত্তির বংশের কোনও মেয়ে অপরিচিত ছেলেদের সঙ্গে কথা বলে না। বুঝলে?’

মেয়েটি এবারও ঘাড় নাড়ল। ইতিমধ্যে তারা কলেজের গেটের সামনে পৌঁছে গিয়েছিল। কলেজটি খুবই প্রাচীন। বিবেকানন্দ এবং সুভাষচন্দ্র ওই কলেজেই একদা পড়াশুনা করেছিলেন। এখন কলেজের প্রিন্সিপ্যাল একজন সাহেব। কলেজের গেটের ভিতরে কার্তিক সেজে আসা ছেলেরা ভিড় করে বসে আছে সিঁড়ি দখল করে। প্রৌঢ় মেয়েটিকে নিয়ে গেলেন লেডিস কমনরুমের দরজা পর্যন্ত। ছাতাটা সামান্য সরিয়ে নিতেই মেয়েটি সুইংডোর ঠেলে ভেতরে ঢুকে গেল। সেখান থেকে ভেসে আসছে মেয়েদের হাসি, কথাবার্তা। প্রৌঢ় ঘুরে দাঁড়াতেই সিঁড়িতে বসা কোনও ছেলে মন্তব্য করল সজোরে, ‘হিপোর গার্ড জিরাফ।’

প্রৌঢ় রাগত চোখে সেদিকে তাকাতে সবাই মুখ নিরীহ করল। তিনি গেটের বাইরে আসবার জন্যে পা বাড়াতেই পেছনে যেন হাসির তুবড়ি ফাটল। যেন খুব মজার কথা শুনল সবাই। গেটের বাইরে এসেই প্রৌঢ় বাঁদিকে তাকালেন। সেখানে কিছু অভিভাবক মেয়েদের পৌঁছে দেবার পর কিছুক্ষণ নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলেন। ইতিমধ্যে আলাপ হয়ে গিয়েছে তাঁদের সঙ্গে।

পাঞ্জাবি ধুতি পরা বসুবাবু ডাকলেন, ‘আসুন মিত্তিরবাবু।’

প্রৌঢ় মিত্তির কাছে পৌঁছে চাপা গলায় বললেন, ‘অসম্ভব, এই কলেজে মেয়েকে পড়ানো যাবে না। আবহাওয়া খুব বদ হয়ে গিয়েছে।’

বসুবাবু মাথা নাড়লেন, ‘এই কথাই হচ্ছিল। মেয়ের মায়ের মন্ত্রণা শুনে বি এ ক্লাসে ভরতি করেছিলাম। এখন ঠিক করেছি বিয়ে দিয়ে নিস্তার নেব।’

ঘোষবাবু কথা বলেন স-স করে। বললেন, ‘আবহাওয়া এমন ছিল না। আজ ট্রাম রাস্তাটা পার হবার পর থেকেই ব্যাটারা আওয়াজ দিয়ে কান ঝালাপালা করে ফেলল। দুধের মেয়েকে কোলে নিয়ে যান দাদু, ও খুকি দুদু খাবি? এসব কী কথা, অ্যাঁ?’

বসুবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কটিশের ছেলে সব?’

‘নয়তো কী?’

‘তা হলে এক কাজ করলে হয়। চলুন সবাই মিলে প্রিন্সিপ্যালের কাছে নালিশ করি। কটিশের একটা ইজ্জত আছে। এখানে যদি মেয়েদের সম্মান না থাকে তা হলে আমরা তাদের পড়তে পাঠাব না।’

চ্যাটার্জিবাবু মুখ খুললেন, ‘গতকাল বাড়িতে তুলকালাম কাণ্ড। মেয়ে তার মাকে বলেছে বাবাকে নিষেধ করো আমার সঙ্গে কলেজে যেতে। সবাই ঠাট্টা করে, বলে আমি এখনও দুধের মেয়ে, খুব লজ্জা করে।’

মিত্তিরবাবু চোখ কপালে তুললেন, ‘বলেন কী? আইবুড়ো মেয়ে একা কলেজে আসতে চাইছে? উঃ, দেশ স্বাধীন হবার ফলটা দেখছেন?’

বসুবাবু চোখ তুলে বললেন, ‘ওই যে, এনাদের জন্যে। দেখছেন?’

প্রৌঢ় এবং বৃদ্ধরা একসঙ্গে তাকালেন। একটি মেয়ে দুটি ছেলের সঙ্গে কথা বলে কলেজের গেট দিয়ে ঢুকে গেল। মিত্তিরবাবু বললেন, ‘নিশ্চয়ই রিফ্যুজি।’

‘তা নয়তো কী!’ চ্যাটার্জি মুখ বেঁকালেন, ‘এই বাঙালগুলো এসে দেশটাকে উচ্ছন্নে নিয়ে গেল। পাকিস্তানিরা পেঁদিয়েছে আর হুড়মুড় করে চলে এল এদেশে। জওহরলাল আর বিধান রায় যে কেন এদের ঢুকতে দিল।

বসুবাবু বললেন, ‘বিধান রায়কে দুষছেন কেন মশাই, হাজার হোক এরা বাঙালি!’

‘বাঙালি।’ মিত্তিরবাবু গর্জে উঠলেন, ‘বাঙালির কোনও ঐতিহ্য এদের মধ্যে আছে? বাপ বসে গেছে ফুটপাতে কাটা কাপড় বিক্রি করতে, যাদবপুর গড়িয়ায় যান, দেখবেন জমি দখল করে কলোনি বানাচ্ছে সব। তাদের ঘরের মেয়েরা স্কুল পার হতেই মেমসাব হয়ে গেছেন সব। ড্যাংডেঙিয়ে কলেজে ঢুকছেন বর খুঁজতে। আর এরাই আমাদের মেয়েগুলোর মাথা খাবে মশাই। চলুন, যাবেন তো প্রিন্সিপ্যালের কাছে?’

অতএব যাওয়া হল। সাতজন অভিভাবক মিনিট পাঁচেক অপেক্ষার পর তাঁর ঘরে ডাক পেলেন। এই কলেজের প্রিন্সিপ্যালের খ্যাতি আছে প্রশাসক হিসেবে। কখনও কোনও অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ করেন না। রাশভারী ভদ্রলোকটি অভিভাবকদের আসন গ্রহণ করতে বলে আগমনের কারণ জানতে চাইলেন। অভিভাবকদের মধ্যে বসুবাবু আবাল্য ইংরেজি খবরের কাগজ পড়ছেন। অন্যদের পৈতৃক অবস্থা ভাল থাকায় বেশিদূর পড়াশুনার সুযোগ হয়নি। তা ছাড়া বাঙালির সঙ্গে ইংরেজি বলতে বাঙালি যে সুবিধে পায় ইংরেজের সঙ্গে তা পাওয়া যায় না। অতএব দলের হয়ে বসুবাবু কথা শুরু করলেন, ‘স্যার, আমাদের মেয়েরা আপনার কলেজের ছাত্রী। স্কটিশ কলেজের একটা সুমহান ঐতিহ্য আছে। আমরা সবাই উত্তর কলকাতার অত্যন্ত ঐতিহ্যশালী পরিবারের মানুষ। ইচ্ছে করলে আমরা বেথুন কলেজে মেয়েদের ভরতি করাতে পারতাম। কিন্তু সেখানকার পড়াশুনার আবহাওয়া ঠিক না থাকায় আমরা আপনাদের এই কলেজে ভরতি করেছিলাম।’ বসুবাবু খুব ভেবেচিন্তে ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করছিলেন এবং সেটা করতে পেরে আনন্দবোধ হচ্ছিল তাঁর।

প্রিন্সিপ্যাল গম্ভীর গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনার সমস্যাটা কী?’

বসুবাবু চটপট জবাব দিলেন, ‘ছেলেরা।’

‘ছেলেরা মানে?’

‘আপনার কলেজের ছেলেরা মেয়েদের সঙ্গে অশ্লীল আচরণ করছে।’

‘সেকী? কোন ছেলেরা?’ তৎক্ষণাৎ উত্তেজিত হলেন প্রিন্সিপ্যাল।

‘নাম জানি না স্যার। কিন্তু কলেজ শুরু হবার সময় আপনি যদি মেইন গেটে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে লক্ষ করেন তা হলে বুঝতে পারবেন।’

‘নাম বললে আমার সুবিধে হত। আচ্ছা কী ধরনের অশ্লীল আচরণ করে?’

‘খারাপ খারাপ মন্তব্য দূর থেকে ছুড়ে দেয়। একা পেলে কথা বলতে চায়।’

‘কী কথা বলে?’

‘তা জানি না স্যার। মানে আমাদের মেয়েরা ওদের কথা বলতে সুযোগ দেয়নি।’

প্রিন্সিপ্যাল অবাক হলেন, ‘আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। এটা কো-এডুকেশনাল কলেজ। ছেলেমেয়েরা স্বাভাবিকভাবে কথা বলবে এটাই স্বাভাবিক। আমি নিজে ওদের কথা বলতে দেখেছি। কিন্তু সেই মেয়ে তো কোনও কমপ্লেন করেনি।’

মিত্তিরবাবু আর পারছিলেন না, এবার বলে ফেললেন, ‘ওরা বাঙাল স্যার।’

‘বাঙাল?’

‘রিফ্যুজি ফ্রম ইস্ট বেঙ্গল। নো কালচার নো ব্যাকগ্রাউন্ড।’

প্রিন্সিপ্যাল মাথা নাড়লেন, ‘আপনাদের এইসব কথা খুবই অযৌক্তিক। যখন মেয়েকে এই কলেজে পড়তে পাঠিয়েছেন তখন জানতেন যে এখানে ছেলেরা পড়ে। ছেলেদের সঙ্গে কথা বললে যদি আপনাদের আপত্তি হয় তা হলে আপনারা মেয়েদের এই কলেজ থেকে নিয়ে যেতে পারেন। আর যদি সত্যি কোনও ছেলে আপনাদের মেয়েদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে তা হলে প্রমাণ দিন, আমি ব্যবস্থা নেব। আর হ্যাঁ, আমি কাল কলেজ গেটে থেকে দেখব কে কী করছে। এবার আসতে পারেন আপনারা?’ যে-স্লিপে। নিজেদের নাম লিখে দিয়েছিলেন অভিভাবকরা সেটি তুলে নিয়ে বেল বাজালেন প্রিন্সিপ্যাল।

এর একঘণ্টা পরে প্রতিটি ক্লাসে নোটিশ গেল। এই এই নামের অভিভাবক অভিযোগ করছেন যে এই কলেজের ছাত্ররা তাঁদের মেয়েদের বিরক্ত করে। যদি এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে তা হলে কলেজ কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নেবেন।

ছাত্রদের মধ্যে হইচই পড়ে গেল। যেসব ছেলে নিতান্ত নিরীহ তারা গা করল না। কিন্তু ব্যাপারটা ছাত্র-ইউনিয়ন পর্যন্ত পৌঁছে গেল। তারা সিদ্ধান্ত নিল দোষী ছেলেদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। এখন পর্যন্ত ছাত্র ইউনিয়নে মেয়েদের প্রতিনিধিত্ব বড় চোখে পড়ে না। মায়া চ্যাটার্জি নামের একটি মেয়ে, যে পড়াশুনায় যথেষ্ট ভাল এবং উত্তর কলকাতার মানুষ হয়েও ব্যতিক্রম, ছেলেদের সঙ্গে নানা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা নেয়, তার ওপর দায়িত্ব পড়ল ওই অভিভাবকদের মেয়েদের সঙ্গে কথা বলে বিস্তারিত জানার। মায়া সম্পর্কে বেশিরভাগ মেয়ে এক ধরনের ঈর্ষা লালন করে। চোখেমুখে কথা বলে যে-মেয়ে, বামপন্থী মানসিকতায় যে উজ্জীবিত, ছাত্র অধ্যাপকদের সঙ্গে অত্যন্ত সাবলীল কথা বলতে যার অসুবিধে হয় না, তার সম্পর্কে উত্তর কলকাতার একান্নবর্তী প্রাচীন ঘরানায় মানুষ হওয়া মেয়েরা কিছুতেই সহজ হতে পারে না। তারা যখন কমনরুমে বসে শাড়ি রান্না এবং ছেলেদের চাহনি নিয়ে পরস্পরের মত বিনিময় করে তখন মায়া ছেলেদের সঙ্গে মিছিল করে ইনকিলাব জিন্দাবাদ বলে, ইউনিয়ন অফিসে বসে তুই তোকারি করে। মায়াকে নাকি রাত আটটাতেও ট্রামে দেখা গেছে। সন্ধের পর কলকাতার বাসে-ট্রামে মহিলাদের একা দেখতে পাওয়া এখনও বিরল ঘটনা। দিনের বেলায় মা-মাসিমার সঙ্গে দরজিপাড়া থেকে ঝামাপুকুর ট্রামে যাওয়া চলতে পারে; কিন্তু আলো নিভলেই একজন ব্যাটাছেলে সঙ্গে না থাকলে কেউ পথে নামবে না। এরকম পরিস্থিতিতে মায়া নাকি রাত্রে একাই যাওয়া-আসা করে। এমনকী কলকাতার সবচাইতে খারাপ জায়গা ধর্মতলাতেও মায়া একা যায়। মায়ার সঙ্গে মেয়েদের কিছু অংশের ভাব আছে। এরা পাকিস্তান থেকে আসা মেয়ে। অবশ্য মায়ার মতো সাহসী নয় এরা, কিন্তু মায়া ওদের পছন্দ করে।

পাকিস্তান থেকে আসা মেয়েদের কথা শুনলে ভীষণ মজা পায় সবাই। তাদের ব্যঙ্গ করতে চেষ্টা করে সময় পেলেই। অনেকে পাকিস্তানের মেয়েদের বাঙালি বলতে রাজি নয়। যারা লিখিত বাংলা ভাষায় কথা বলে না তারা বাঙালি নয়, এইরকম একটা ধারণা তাদের মধ্যে জেঁকে বসেছে। এখনও সংখ্যায় পাকিস্তানের মেয়ে খুব কম। দলে যারা ভারী তাদের শাসন চলে কমনরুমে। কিন্তু যেসব পাকিস্তানি মেয়ে এই কলেজে ইতিমধ্যে দুটি বছর পড়ে ফেলেছে তারা অনেক অভিজ্ঞ হয়ে উঠেছে। আজ তারাই সেই মেয়েদের পেছনে লেগেছিল যাদের অভিভাবকরা প্রিন্সিপ্যালের কাছে অভিযোগ জানাতে এসেছিলেন। মেয়েগুলো মুখ-চোখ লাল করে বসে ছিল। ওদের মনে হচ্ছিল পৃথিবীর সব মেয়ে কত সুবিধে ভোগ করে থাকে শুধু তারাই যেন এক বন্দিদশায় দিন কাটাচ্ছে। এইসময় মায়া এল কমনরুমে। এসে টেবিল বাজিয়ে চিৎকার করে বলল, ‘বন্ধুগণ, তোমরা একটু মন দিয়ে শোনো! কয়েকজন অভিভাবক প্রিন্সিপ্যালের কাছে অভিযোগ করেছেন যে, এই কলেজের ছাত্ররা তাঁদের মেয়েদের সঙ্গে অশালীন ব্যবহার করেছে। এ-ব্যাপারে ছাত্র-ইউনিয়ন ব্যবস্থা নিতে চায়। আমি সেইসব মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে চাই যাদের অভিভাবকরা অভিযোগ করেছেন।’

কিন্তু দেখা গেল কেউ জানে না কার অভিভাবক এই কাণ্ডটি করেছেন। তবে কেউ মনে করতে পারল না কোনও ছেলে তাদের অপমান করেছে কিনা। মায়া হাসল, ‘তোমরা ছেলেদের সঙ্গে যত দূরত্ব রাখবে তত তাদের খারাপ বলে মনে হবে। এব্যাপারে মেয়েদের মধ্যে যারা কলকাতায় জন্মেছ এবং বড় হয়েছ তাদের নতুন করে ভাবার সময় হয়েছে।’

এই আটটি মেয়ে সেদিন বাড়ি ফিরে যাওয়ার পর নিশ্চয়ই কিছু ঘটনা ঘটেছিল। দেখা গেল বসুবাবু আর চ্যাটার্জিবাবু তাঁদের মেয়েদের ছাতির আড়াল দিয়ে কলেজে নিয়ে আসছেন। তিনটি মেয়ে একা একাই কলেজে ঢুকছে। আর বাকি তিনজন কলেজে আসাই বন্ধ করে দিয়েছে। তাদের অভিভাবকরা ট্রান্সফার সার্টিফিকেট নিয়ে হয়তো অন্য কলেজে মেয়েদের ভরতি করিয়েছেন। মাসখানেকের মধ্যে জানা গেল ওই তিনজনের একজনের বিয়ে।

প্রেসিডেন্সি কিংবা ব্রেবোর্ন নয়, দীপা ভরতি হয়েছিল স্কটিশ চার্চ কলেজে। সুভাষচন্দ্রই ব্যবস্থা করেছিলেন। মিশনারি স্কুল, পড়াশুনার আবহাওয়া রয়েছে, বিখ্যাত মানুষরা পড়েছেন এককালে। তা ছাড়া সুভাষচন্দ্রের এক পরিচিত ভদ্রলোকের সূত্রে অধ্যাপক কনক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে বলে তিনি দীপাকে রাজি করিয়েছেন স্কটিশে পড়তে। সুবিধে এই যে স্কটিশের নিজস্ব মেয়েদের হস্টেল রয়েছে যা হাটাপথে কলেজ থেকে মিনিট পাঁচেকের। আর সুভাষচন্দ্রের বাসা এই তল্লাটেই, বিপদে আপদে চটপট যোগাযোগ হবে।

কলেজে ভরতি হবার পর এইসব নাটক দেখে কলকাতা সম্পর্কে অন্যরকম ধারণা তৈরি হচ্ছিল দীপার। জলপাইগুড়ির মতো মফস্সল শহরে মেয়েরা অভিভাবকদের যতটুকু আস্থা বা বিশ্বাস পেয়ে থাকে কলকাতায় তা পায় না দেখে সে অবাক হল। জলপাইগুড়ির রাস্তায় খুব খারাপ দেখাত যদি কোনও মেয়ে ছেলেদের সঙ্গে পাঁচ মিনিট দাঁড়িয়ে কথা বলত, তা হলে তার বদনাম হত। ছেলেটি হত ঈর্ষার বস্তু, কিন্তু তার গায়ে বদনামের গন্ধ বড় একটা লাগত না। কিন্তু কখনই কোনও অভিভাবক বি এ ক্লাসের ছাত্রীকে ছাতা মাথায় করে কলেজে পৌঁছোতে যেত না। ব্যাপারটা স্কুলের শেষ ক্লাসেই শেষ হয়ে যায়। অথচ কলকাতায় এখনও সেটা হচ্ছে আর তাই নিয়ে কলেজে তোলপাড়ও হয়। কলকাতার ছেলেমেয়েরা খুব আধুনিক, নিত্যনতুন স্টাইলের জন্ম এই শহরে, শিল্প সংস্কৃতির পীঠস্থান ইত্যাদি গল্প তারা ছেলেবেলা থেকে শুনেছিল। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে এর অনেকটা সত্যি হলেও পাশাপাশি একটা অন্ধকূপ মানসিকতা কলকাতা বহন করে চলেছে। কয়েক বছর আগের মনোরমার মানসিকতার সঙ্গে যার কোনও তফাত নেই। এইরকম অবস্থায় মায়া তার দৃষ্টি আকর্ষণ করছিল। কোনওরকম আড়ষ্টতা ছাড়াই একটি মেয়ে ঘুরে বেড়ায়, স্পষ্ট কথা বলে এবং তার জন্যে কোনও অনুশোচনা করে না, রমলা সেনের পরে এমন কাউকে তো সে দ্যাখেনি।

হস্টেলের নাম ডান্ডাস। বাঙালি মেয়েরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ কিন্তু বেশ কিছু শিলং এবং গ্যাংটকের মেয়েও স্কটিশে পড়তে এসেছে। অবশ্য তারা বেশিরভাগ সময় থাকে দল বেঁধে, কথা বলতে চায় ইংরেজিতে। বাঙালি মেয়েরা এদের সঙ্গে কথা বলতে চায় না ইংরেজি বলতে হবে বলে। বাঙালি মেয়েরা এসেছে বিভিন্ন জেলা অথবা অন্য প্রদেশ থেকে। তাদের প্রত্যেকের অবস্থা যে ভাল তা জিনিসপত্র এবং সাজগোজ দেখলেই বোঝা যায়। এই হস্টেলের কেউ গামছা ব্যবহার করে না। কিন্তু শৈশব থেকে তোয়ালে ব্যবহার করার অভ্যেস দীপার হয়নি। দ্বিতীয় দিনেই স্নানের ঘরে যাওয়ার সময় নীনা নামের একটি মেয়ে ঠোট বেঁকিয়ে বলেছিল, ‘এম্মা, তুমি গামছা ব্যবহার করো?’

‘হ্যাঁ, কেন?’

‘ইস। চটচটে লাগে না? মুখ ঘষে যায় না? ওটা তো একটুও সফ্ট নয়।’

‘আমার অভ্যেস হয়ে গেছে।’

‘আমি বাবা মরে গেলেও গামছায় মুখ মুছতে পারব না।’

দীপার তোষক খুবই পাতলা, সেই জলপাইগুড়ির কলেজে যাওয়ার সময় অঞ্জলি একটা পুরনো তোষক দিয়েছিল ব্যবহার করতে, সেটাকেই কলকাতায় নিয়ে এসেছে। তার ওপর যে-সুজনি দু’দিন অন্তর পালটায় সে দুটোও সাধারণ। এসব নিয়ে কখনও মাথা ঘামানোর চিন্তাও হয়নি। যারা ঘামায় তাদের সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই একটা দূরত্ব তৈরি হল তার। হস্টেলের প্রথমদিন তার সঙ্গে যে-মেয়েটিকে থাকতে দেওয়া হয়েছিল সে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘তোমার বাবা কী করেন?’

‘চা-বাগানে চাকরি করেন।’

‘চা-বাগান? মানে টি-এস্টেট? তোমার বাবা টি-এস্টেটের মালিক? দারুণ ব্যাপার। আমি একবার দার্জিলিং-এ যাওয়ার সময় টি-এস্টেট দেখেছি।’

‘না, মালিক নন, আমার বাবা একটা চা বাগানে চাকরি করেন। আমরা বড়লোক নই, তুমি যা ভাবছ।’

‘তা হলে তুমি কলকাতায় পড়তে এলে কী করে?’

‘এলাম।’ দীপা হেসেছিল, ‘আসা হয়ে গেল।’

‘কলকাতায় এর আগে এসেছ?’

‘না। পরীক্ষার পর বাবার অসুখের সময় প্রথম এলাম।’

‘কী অসুখ?’

‘হার্টের গোলমাল।’

মেয়েটি খুব গম্ভীর হয়ে গেল। এবং তারপরেই সে ঘর পালটাল। মুখে বলল, ‘আমি রাস্তার দিকের ঘরে যাচ্ছি। এখানে একদম আলো ঢোকে না।’

দীপা কিছু বলেনি। কথাটা নেহাতই মিথ্যে তা মেয়েটিও জানে। সে ইতিমধ্যে জেনে গিয়েছে এই মেয়েটি এক অত্যন্ত বড়লোকের মেয়ে এবং তার বাবা শিক্ষা দিয়েছেন অসমশ্রেণির কোনও মেয়ের সঙ্গে না মিশতে।

প্রথমদিনেই আর একটি ঘটনা ঘটেছিল। দীপার ডাক পড়েছিল সুপারের ঘরে। তিনি সুভাষচন্দ্রের ভরতি করা ফর্মটি এগিয়ে দিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘বি এ ক্লাসে পড়তে এসেছ, মন দিয়ে ফর্ম ফিল-আপ করতে পারো না?’

ফর্ম তুলে নজর বুলিয়ে ভুল ধরতে পারেনি দীপা। মাথা নেড়ে বলেছিল, ‘আমি কোনও ভুল পাচ্ছি না। ঠিকই তো রয়েছে।’

‘তোমার নাম কী?’

‘দীপাবলী বন্দ্যোপাধ্যায়।’

‘তা হলে তোমার বাবার উপাধি মুখোপাধ্যায় হয় কী করে?’

দীপা ঠোঁট কামড়াল। এই প্রশ্নটি তাকে জলপাইগুড়ির কলেজে হস্টেলে কখনও শুনতে হয়নি। হয়তো ভরতির সময় অমরনাথ বড়দির সঙ্গে কথা বলেছিলেন। কিন্তু যতই সে ভুলে যাক, সত্য সত্য হয়েই বেরিয়ে এসে সামনে দাঁড়ায়। গম্ভীর মুখে দীপা বলল, ‘এখানে কোনও ভুল নেই।’

‘মানে?’ সুপার অবাক, তুমি, তুমি ম্যারেড?’

‘আমাকে বিয়ে দেওয়া হয়েছিল।’

‘তা হলে লেখোনি কেন তুমি ম্যারেড?’

‘বিয়ের একদিন পরে সেই ছেলেটি মারা যায়।’

‘আই সি। আই অ্যাম সরি। আমি তোমাকে আঘাত করতে চাইনি, কিন্তু সত্যি কথাটা লিখতে পারতে, তুমি উইডো।’

‘আমি নিজেকে সেটা মনে করি না।’

‘বুঝতে পারছি না তোমার কথা।’

‘আপনাকে বললাম, আমার বিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আমার তখন এগারো বছর বয়স। বোঝার আগেই সব ঘটনা ঘটে গেল। যেহেতু বাবা স্কুল ফাইনাল সার্টিফিকেটে বন্দ্যোপাধ্যায় রেখেছিলেন তাই এখনও আমাকে ওটা লিখতে হচ্ছে। কিন্তু আমি এখনও কুমারী, মনের দিক থেকেও তাই।’

ফর্ম ড্রয়ারে রেখে সুপার বললেন, ‘লেইস ফরগেট দিস। তোমার রুমমেট দু’ঘণ্টার মধ্যে কেন রুম চেঞ্জ করতে চাইল?’

‘আমি জানি না, এটা ওর সমস্যা।’

‘হঁ। ঠিক আছে যাও।’ কথাটা শোনামাত্র দীপা পা বাড়াচ্ছিল, পেছন থেকে আবার ডাক এল, ‘শোনো, রুমমেট হিসেবে একটি বিদেশি মেয়েকে পেলে তোমার কি খুব অসুবিধে হবে? আমি সাধারণত ওদের এক ঘরে রাখতে চেষ্টা করি, কিন্তু এই মেয়েটি একা হয়ে গিয়েছে।’

‘আমার কোনও অসুবিধে হবে না যদি কেউ অসুবিধে তৈরি না করে।’

সন্ধের মুখে চুপচাপ নিজের বিছানায় শুয়ে ছিল দীপা। পাশের তক্তপোশ খালি। এখনও হস্টেলের কোনও মেয়ের সঙ্গে তার আলাপ ঘনিষ্ঠ হয়নি। জলপাইগুড়ির হস্টেলের থেকে এখানকার আবহাওয়া একটু আলাদা। মেয়েদের মধ্যে একটা স্বাধীন স্বাধীন ভাব দেখা যাচ্ছে। কথাবার্তা বলছে উঁচু গলায়। স্বভাবতই এরা পুরনো মেয়ে। আর একটা তফাত পোশাকের। জলপাইগুড়িতে কুড়ি-একুশ বছরের কোনও মেয়ে স্কার্ট পরত না।

হঠাৎ দীপার মন ভারী হয়ে উঠল। কবেকার সেই ব্যাপারটা এখনও তার পিছু ছাড়ছে না। চোখ বন্ধ করল দীপা। এই হস্টেলের অন্য মেয়েদের সঙ্গে তার পার্থক্য, সে বিধবা। যতই অস্বীকার করুক, নিজের মনে ব্যাপারটাকে গুরুত্ব না দিক, সমস্ত অতীত তার দিকে আঙুল উঁচিয়ে বলছে, তুমি বিধবা। আর পাঁচটা মেয়ে এখন যে হালকা মনে ঘুরে বেড়াবে, নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে নানান রঙিন স্বপ্ন দেখবে—তার ক্ষেত্রে সেসব ভাবাই যেন অনুচিত। আর যদি সে ভাবতেও চায়, দীপা কেঁপে উঠল। একসময় সুভাষচন্দ্র তার জন্যে সম্বন্ধ খুঁজেছিলেন। বেশিরভাগ পাত্র বয়স্ক, স্ত্রী মরে গেছে সন্তান রেখে। একটা স্বাভাবিক ছেলে যার সঙ্গে এই হস্টেলের যে-কোনও মেয়েকে যুক্ত করা যায়, দীপা যেন আশা করতে পারে না। আর আশা করলেও ছেলেটি যখন জানবে তার বিয়ে হয়েছিল তখন অবশ্যই প্রতিক্রিয়া হবে। সে যে কুমারী, স্বামীর সঙ্গ তাকে কোনওভাবেই নষ্ট করেনি, এ-কথা বোঝাবে কে? বন্ধ চোখের পাতায় চলকে উঠল সে অসুস্থ তরুণের মুখ। কী যন্ত্রণা নিয়ে পিতৃ-আদেশ পালন করতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল ফুলশয্যার রাত্রে। দীপার ধাক্কায় ছিটকে পড়েই আহত টিকটিকির মতো নেতিয়ে গিয়েছিল। যার শরীরে কয়েকটা হাড় চামড়ায় আটকানো রয়েছে, শেষ অবস্থায় তাকে অনুরোধ করেছিল প্রতুলবাবুকে মিথ্যে কথা বলতে। কেন? নিজের অক্ষমতার লজ্জা ঢাকার জন্য? হঠাৎ দীপার আর একটা কথা মনে এল। অতুল কি তাকে বাঁচাবার চেষ্টা করেছিল? প্রতুলবাবুর স্বভাব জানা থাকায় সে কিছুদিন ওইকথা বলে তাকে নিশ্চিন্ত থাকার ইঙ্গিত দিয়েছিল?

কিন্তু আজ নতুন করে এই চিন্তাটা মাথায় এল কেন? সে কি নিজেই নিজের অতীতটাকে ভুলতে পারছে না! যে-জীবন সেই ফুলশয্যার রাত্রেই শেষ হয়ে যাওয়ার কথা ছিল তাকে অনেক বাঁক পেরিয়ে আজ কলকাতায় এনেও কেন অস্বস্তি হচ্ছে। এক ঝটকায় সে উঠে বসল। তার বয়সের একটি মেয়ে যদি ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখে তা হলে সেই স্বপ্নে কেন একটি সহজ ছেলের সঙ্গে বিবাহিত জীবন-যাপন করার কথা আসবে! বিয়ে ছাড়া কি মেয়েদের কোনও কিছুতেই পূর্ণতা নেই? একটি মানুষের অনেক কাজ থাকে, সেই কাজে আনন্দ আসে সার্থক হলে, সেই সার্থকতার জন্যে কি বেঁচে থাকা যায় না! আর তখনই তার রমলা সেনের কথা মনে পড়ল। পঞ্চাশের দশকেও শিলিগুড়ির মতো শহরে বিবাহিতা না হয়েও একজন পুরুষ বন্ধুর সঙ্গে বাস করতে কতখানি সাহসের দরকার হয়! এটা সাহস না ব্যভিচার এ নিয়ে তর্ক উঠতে পারে। দীপার সেই মুহূর্তে মোটেই পছন্দ হয়নি ব্যাপারটা। তার দেখাশোনা জগতের নিয়মের এটা ব্যতিক্রম। দীপার প্রশ্নের উত্তরে রমলা সেন জবাব দিয়েছিলেন, ‘আমাদের যেমন অনেক ব্যাপারে মিল তেমন বহু ব্যাপারে আকাশ পাতাল ফারাক। এই অবস্থায় কিছুদিন ভাল থাকা যায় কিন্তু চিরকাল থাকতে গেলে অশান্তির আগুনে জ্বলতে হবে।’ তাই যদি হয় তা হলে কিছুকালের জন্যেও একসঙ্গে থাকা কেন? শুধু বন্ধুত্ব কি একসঙ্গে থাকার অধিকার দেয়? তৎক্ষণাৎ একটা বিপরীত চিন্তা মাথায় এল। দুটি পুরুষ অথবা দুটি মেয়ে যদি বন্ধুত্বের সুবাদে একসঙ্গে থাকতে পারে এবং তাতে ন্যায়নীতি গোল্লায় না যায়, তা হলে একই বন্ধুত্ব নিয়ে দুটি নারীপুরুষ যদি একসঙ্গে থাকে তা হলে অপরাধটা কোথায়? শিলিগুড়িতে রমলা সেনের সঙ্গে দেখা করে ফেরার সময় মনে যে বিরূপ ভাবনা এসেছিল এতদিন নিজের অজান্তে সে তাকেই লালন করে চলেছিল। আজ মনে হচ্ছে বিপরীত দিকও আছে। সত্যি, আজ যে-ধারণাটিকে সঠিক বলে মনে হয় সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কোনদিন তাই বেঠিক হয়ে যেতে পারে। হয়তো এরই নাম আধুনিকতা, সময়ের সঙ্গে পা মিলিয়ে চলা।

দীপার মনে হল বাইরের পৃথিবীর কৌতূহল থেকে অমরনাথ তাকে রক্ষা করতে পারতেন। বিয়ে এবং বিধবা হবার পর তিনি যদি মুখার্জি পালটে ব্যানার্জি না করতেন তা হলে আজ সুপারের ঘরে তার ডাক পড়ত না। সঙ্গে সঙ্গে বিপরীত ভাবনা এল। যা হবার হয়েছে, সত্যিটাকে মেনে নিয়ে এগিয়ে যেতে অসুবিধে কোথায়? কে কী বলল তাই নিয়ে মন খারাপ করার মতো মন না রাখলেই হয়। সুপারের কাছ থেকে যদি হস্টেলের মেয়েরা ঘটনাটা জেনেও যায় তাতেই বা তার কী এসে যাবে। যার মনে হবে তার সঙ্গে মেশা যায়, সে মিশতে পারে।

একটু হালকা হল মন। অমরনাথের নামটা আসতেই অঞ্জলির কথা ভাবল দীপা। এতদিনের সম্পর্ক, তাকে এই জায়গায় পৌঁছে দেওয়ার জন্যে যে-মহিলার কৃতিত্ব সবচেয়ে বেশি, আজ তার সঙ্গেই দূরত্ব তৈরি হয়ে গেল। জলপাইগুড়ি কলেজ থেকে মার্কশিট নিয়ে একা চা-বাগানে ফিরে গিয়ে সে অনেক কান্নাকাটি করেছিল অঞ্জলির মন পেতে। প্রতুলবাবুর দেওয়া ব্যাঙ্কে জমা রাখা টাকার জন্যে তার কোনও লোভ নেই। অমরনাথ তাকে জানিয়ে ব্যাঙ্ককে ওই নির্দেশ দেননি। এইসব কথা অনেকবার বলেও বিশ্বাস করাতে পারেনি সে অঞ্জলিকে। তার বদ্ধ ধারণা মেয়ে বাপকে দিয়ে এই কাজটা করিয়েছে বিদ্যেধরী হবার জন্যে। শেষপর্যন্ত দীপা বলেছিল, ‘আমি চেক বইতে সই করে দিচ্ছি কিন্তু তাতে বাবারও সই লাগবে। তুমি কলকাতা থেকে বাবার সই নিয়ে এসে টাকা তুলে নাও।’

অঞ্জলি মুখ বিকৃত করে বলেছিল, ‘আমি বিধবা হয়ে লোকের বাড়িতে দাসীগিরি করে দুই ছেলেকে মানুষ করব তাও ভাল, কিন্তু ওই টাকা পায়ের নখ দিয়েও স্পর্শ করব না। ষড়যন্ত্র। আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছিস তোরা! কী পেয়েছি আমি এই সংসার থেকে?’

দীপা বলে ফেলেছিল, ‘এটা ঠিক বলছ না। এতদিন তো তোমাকে খুব কষ্টে দিন কাটাতে দেখিনি। তখন যে ব্যবস্থা মেনে নিয়েছিলে আজ হঠাৎ সেটাকে খারাপ বলার কোনও মানে হয় না।’

‘ও তা তো বলবি। তোর মা যখন মারা গেল, বাপ যখন দায় নামাল, তখন কাকের ডিম ভেবে নিয়ে এসেছিলাম, আজ তো কোকিল হয়ে আমাকে উপদেশ দিবি! তোর কী! পাশ করেছিস, চাকরি জুটিয়ে নিয়ে ফুর্তি করবি। আর আমার ছেলেদুটো লোফার হবে, ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়াবে উনি চলে গেলে। ওই মানুষটা তোর জন্যে এত করল আর তাকে বাঁচাবার জন্যে তুই কিছু করেছিস? পরের সন্তান চিরদিনই পর তাকে আপন করতে যাওয়া বোকামি।’

সেই রাত্রে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছিল দীপা। অঞ্জলির মতো শান্ত ভালবাসাময় মানুষ আচমকা আমূল পালটে গেল। কোনও কথাতেই তার মন ভিজল না। স্পষ্ট বলে দিল, ‘মার্কশিট পেয়ে গেছ, তোমার মামা তোমাকে কলেজে ভরতি করে দেবে বলেছে, আর কী চাই। দয়া করে কালই কলকাতায় চলে যাও। আমাকে আমার মতো থাকতে দাও।’

কীভাবে দীপা কলকাতায় এসেছিল তা অন্য কথা। কিন্তু যে-সত্যটা সে আবিষ্কার করল, তা তার কাছে সারাজীবনের শিক্ষা হয়ে গেল। স্বামী স্ত্রী সন্তান অথবা বন্ধুর মধ্যে যতক্ষণ অল্পস্বল্প সংঘাত হচ্ছে ততক্ষণ তারা একটা মানিয়ে নেবার আবহাওয়া তৈরি করে বাস করতে পারে। কিন্তু যখন ভবিষ্যৎ সম্পর্কিত স্বার্থে আঘাত লাগে, নিজের অস্তিত্ব বিপন্ন হচ্ছে বলে ধারণা তৈরি হয়, তখন তার মানিয়ে চলার মুখোশটাকে একটানে ছিঁড়ে ফেলতে সে একটুও দ্বিধা করে না। নিজের শরীর এবং মনের বাইরে আর একটি মানুষের অস্তিত্ব সে স্বীকার করে কিছু সম্পর্কের ভিত্তিতে। স্ত্রী যখন বাথরুমে একা থাকেন তখন তিনি তাঁর মতো। স্বামীর অনেক আচরণ শুধু স্বামী বলেই মেনে নিচ্ছেন এমন ভাবনা সেখানে বসে লালন করতে করতেও বিরক্ত হতে পারেন। সেই বিরক্তিটা ওই মুহূর্তে কারও নজরে পড়ার কথা নয়। বাইরে বেরিয়ে এসে সামান্য মান অভিমানের মাধ্যমে একটা সেতু হয়তো তৈরি হয়ে যায়। কিন্তু আমার শরীর আমার মন একান্ত আমারই এই বোধ তো আমৃত্যু দূর হবার নয়। যে-মানুষটির শরীরে জন্ম হয়, যার কাছে জীবনধারণের কৃতজ্ঞতা আকাশ ছোঁয়া, বয়স হলে শরীরের অন্য কোষগুলো জাগ্রত হলে তাকে সরিয়ে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি যে-আসক্তি তৈরি হয় তাও ওই নিজের মন আর শরীরের সুখের কারণে। সেই সুখ বিপন্ন হতে চললে প্রতিটি মানুষের মুখে ড্রাকুলার মতো দুটি ধারালো দাঁত মাথা চাড়া দেয়।

অমরনাথ আপাতত সুস্থ! দিন সাতেক আগে সুভাষচন্দ্র তাঁকে এবং মনোরমাকে নিয়ে চা-বাগানের বাড়িতে রেখে এসেছেন। জলপাইগুড়ি থেকে আসার পরে সে মনোরমার কাছে সমস্ত ঘটনা বলে কেঁদে ফেলেছিল। মনোরমা চুপ করে গিয়েছিলেন। অনেকক্ষণ বাদে বলেছিলেন, তুই কোনও অন্যায় করিসনি।’

যাওয়ার দু’দিন আগে দীপা অমরনাথকে জিজ্ঞাসা করেছিল সে কলকাতায় পড়বে কিনা। চিকিৎসার জন্যে যে-অর্থ ব্যয় হয়েছে, যে-ঋণ করতে হয়েছে তা ওই ব্যাঙ্কের টাকায় শোধ দিতে সে আগ্রহী। অমরনাথ বলেছিলেন, ‘তা হলে এত কষ্ট করে তোমরা আমাকে এখানে নিয়ে এলে কেন? চা-বাগানেই আমি স্বস্তিতে মরতে পারতাম।’

‘মানে?’ অবাক হয়ে গিয়েছিল দীপা।

‘আমি যা করেছি তা অনেক ভেবেচিন্তে করেছি। তুমি কলকাতার কলেজে ভরতি হবে আর এ-ব্যাপারে আমি কোনও আলোচনা করতে চাই না। তুমি আমার হাতে ব্যাঙ্ককে নির্দেশ দিয়ে চিঠিটা লিখে দাও।’

চুপচাপ শুয়ে থাকল দীপা। সুভাষচন্দ্র ফিরে এসে জানিয়েছিলেন অমরনাথ খুব ভাল নেই। এখনও চাকরিতে যোগ দেননি। কিছুদিনের মধ্যে যোগ দিতে পারবেন কিনা সন্দেহ। বারংবার বলে দিয়েছেন দীপা যেন মন দিয়ে পড়াশুনা করে। অন্য কোনও ব্যাপারে তার চিন্তা করার দরকার নেই। অমরনাথের মানসিকতা বুঝতে পারছে দীপা। কৃতকর্মের প্রায়শ্চিত্ত করার জন্যে ভদ্রলোক কোনও বাধা মানবেন না।

হঠাৎ ঘরের দরজায় শব্দ হল। হস্টেলের বুড়ো বেয়ারা রেডিয়ো আর স্যুটকেস নামিয়ে রেখে চলে গেল। এবং তারপরেই বাইরে একটি মেয়ের গলা শোনা গেল, ‘দিস ইজ মাই রুম?’

‘জি মেমসাব।’

চোখ মেলে তাকাল দীপা। ঘরের দরজায় যে দাঁড়িয়েছে এসে তার উচ্চতা অন্তত পাঁচ ফুট আট। সুন্দর ফিগার। পরনে প্যান্ট শার্ট, কাঁধে ব্যাগ। গায়ের রং কুচকুচে কালো। মাথার চুল কুঁকড়ে এঁটে বসেছে। নাক চ্যাপটা কিন্তু দাঁতে সহজ হাসি। মেয়েটি এগিয়ে এল, ‘হ্যালো। আই অ্যাম গ্লোরিয়া। ইউ লিভ হিয়ার?’

উঠে বসে দীপা মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল। গ্লোরিয়া হাত বাড়াল, ‘দেন আই অ্যাম ইয়োর রুমমেট। আই অ্যাম ফ্রম জাম্বিয়া।’

নরম হাতে হাত মেলাল দীপা। তারপর বলল, ‘আই অ্যাম দীপাবলী।’

‘দী-পা-বলী! হাউ সুইট। হোয়াটস দ্য মিনিং অফ ইট?’

সকল অধ্যায়

১. ১. আজ সারাটা দিন সূর্যদেব উঠলেন না
২. ২. মেয়েরা কি ভূত হয়
৩. ৩. ভালো-মন্দ বোঝার বয়স
৪. ৪. রমলা সেন
৫. ৫. সত্যসাধন মাস্টার
৬. ৬. বৃষ্টিটা চলে যাওয়ার পরে
৭. ৭. চারদিন পৃথিবীটাকে দ্যাখেনি দীপা
৮. ৮. দীপাবলীর বিয়ে
৯. ৯. বাসর এবং বউভাত
১০. ১০. দীপাবলীর ফুলশয্যা
১১. ১১. পুত্ৰটি দেহ রেখেছে
১২. ১২. রমলার চিঠি
১৩. ১৩. প্ৰাপ্তবয়স্কতা শরীরের না মনের
১৪. ১৪. চাবাগানের আশেপাশে
১৫. ১৫. আসাম রোড
১৬. ১৬. একটি মানুষের চেহারা
১৭. ১৭. জলপাইগুড়ি শহরে
১৮. ১৯. রমলা সেনের কাছে
১৯. ১৮. পুলিশের লাঠিচার্জ
২০. ২০. জলপাইগুড়ির হোস্টেলের মেয়ে
২১. ২১. দুশ্চিন্তার ছাপ
২২. ২২. একতারা বাজিয়ে গান
২৩. ২৩. দুর্দান্ত ব্যবসাদার প্রতুল বন্দ্যোপাধ্যায়
২৪. ২৪. সত্যসাধন মাস্টার এসে পড়বেন
২৫. ২৫. অমরনাথ হতভম্ব
২৬. ২৬. তিনদিন ধরে সমানে বৃষ্টি
২৭. ২৭. অমরনাথের শরীর
২৮. ২৮. কলকাতা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে
২৯. ২৯. প্রৌঢ় ভদ্রলোকটি হাঁটছিলেন
৩০. ৩০. এক অদ্ভূত অভিজ্ঞতা
৩১. ৩১. বাড়িটা শুধু পুরনো নয়
৩২. ৩২. উত্তর কলকাতার পথে পথে
৩৩. ৩৩. কলেজ এবং হোস্টেলের বাইরে
৩৪. ৩৪. দীপা অঞ্জলির দিকে তাকাল
৩৫. ৩৫. অমরনাথ শুয়ে আছেন
৩৬. ৩৬. ভবিষ্যৎ সম্পর্কে প্ৰচণ্ড অসহায়তাবোধ
৩৭. ৩৭. তিনতলার ব্যালকনি
৩৮. ৩৮. দীপা চুপ করে আছে
৩৯. ৩৯. সুভাষচন্দ্র এগিয়ে এলেন
৪০. ৪০. মেয়েটির নাম লাবণ্য
৪১. ৪১. বিছানায় টান টান দীপা
৪২. ৪২. কলেজের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে
৪৩. ৪৩. কিছু মানুষ খুন হলেন
৪৪. ৪৪. কেমন একটা সংসার-সংসার ভাব
৪৫. ৪৫. রাধা চলে এল সেজেগুজে
৪৬. ৪৬. দ্বিতীয় অভিনয় হয়ে যাওয়ার পরে
৪৭. ৪৭. কলোনি থেকে কলেজ পাড়ায়
৪৮. ৪৮. স্কটিশ চার্চ কলেজে জানাজানি হয়ে গেল
৪৯. ৪৯. একদম লেডি
৫০. ৫০. রমলা সেন চোখ ছোট করলেন
৫১. ৫১. সাতকাহন প্ৰথম পর্ব সমাপ্ত

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন