৪৮. স্কটিশ চার্চ কলেজে জানাজানি হয়ে গেল

সমরেশ মজুমদার

খবরটা কে কাকে বলেছিল ঈশ্বর জানেন, কিন্তু স্কটিশ চার্চ কলেজে জানাজানি হয়ে গেল বিখ্যাত চিত্রপরিচালক সুবিনয় সেন দীপাবলী ব্যানার্জিকে নায়িকা করতে চেয়েছিলেন তাঁর পরের ছবিতে কিন্তু সে রাজি হয়নি। ছেলেমেয়েদের কাছে এক লহমায় যেন সে নায়িকা হয়ে গেল। কালচারাল সেক্রেটারি এসে ক্লাসের বাইরে তাকে একদিন বলল, ‘আপনি নিশ্চয়ই জানেন সামনের শনিবার মহাজাতি সদনে কলেজ সোশ্যাল। সবাই চাইছে আপনি এই অনুষ্ঠানটা কনডাক্ট করুন। মানে, যেসব শিল্পী গান গাইবেন তাঁদের নাম ঘোষণা করবেন।’

‘সেকী! আমি তো এমন কাজ কখনও করিনি। তা হলে আমাকে বলছেন কেন?’

‘কাউকে তো করতে হবে। আর এই মুহুর্তে আপনি খুব উপযুক্ত।’

‘কেন?’

‘সুবিনয় সেনের ব্যাপারটার জন্যে।’

‘এসব কথায় আপনি কেন কান দেন। আমাকে মাপ করবেন।’

মুখে যাই বলুক সহপাঠিনীরা যে তাকে ঈর্ষা করছে বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না। নিজের ভাগ্য ক্রমশ নিজের কাছেই বিস্ময়ের বস্তু হয়ে উঠছে। যে-কোনও সাধারণ অসাধারণ মেয়ের চেয়ে ঈশ্বর তাকে অনেক বেশি শাস্তি দিয়েছেন। কষ্ট কী জিনিস তার মতো আর ক’টি মেয়ে বুঝতে পেরেছে কে জানে। অন্তত এই বয়সে। কলেজে এমন কোনও মেয়ে পাওয়া যাবে না যে পৃথিবীতে তার মতো একা। অথচ মাঝে মাঝে তাকে নিয়ে এমন এক একটা ঘটনা ঘটে যাচ্ছে যে সে সবার আলোচনার অথবা ঈর্ষার বস্তু হচ্ছে।

হস্টেলে ফিরতেই সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে দেখা। এত ঝড় জল বয়ে গেল তবু কখনও সুভাষচন্দ্র বা তার জন্মদাতার কথা মনে আসেনি। সুভাষচন্দ্র আজ অন্যরকম। বেশ হাসিখুশি। বললেন, ‘তোর মামিমা প্রায়ই বলেন মেয়েটা কেন আসে না, এত কাছে থাকে। তুই তো মাঝে মাঝে যেতে পারিস।’

‘আমাকে আপনি এর আগে কখনও বলেননি।’ দীপা হাসল।

‘যাক গে! শোন, তোর পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি নিয়ে প্রতুল বাঁড়ুয্যের সম্পত্তি উদ্ধার করতে অনেকটা এগিয়েছি, বুঝলি? লাখ লাখ টাকার ব্যাপার। স্বনামে যা রেখেছিল তাই এই, বেনামে যা ছিল তা আর উদ্ধার করা যাবে না। এখন তুই মন খুলে বল তো, তোর কী ইচ্ছা?’

‘আপনি একটু পরিষ্কার করে বলুন, আমি কিছু বুঝতে পারছি না।’

‘ব্যাপার হল, তুমি প্রতুল বাঁড়ুয্যের উত্তরাধিকারিণী। সব সম্পত্তি তোমার। কিন্তু তুমি বলেছ ওসব নেবাব ইচ্ছে নেই। তা হলে কে নেবে? এই কিছুদিন আগে যখন জলপাইগুড়িতে গিয়েছিলাম তখন ভাবলাম চা-বাগানে গিয়ে ওদের দেখে আসি। তোমার মা ঠাকুমা যে কষ্টে আছে তা চোখে দেখা যায় না। মনে হল তোমার আপত্তি না থাকলে ওদের কিছু দেওয়া উচিত। আমারও বয়স বেড়েছে। কিছুই জমাতে পারিনি এ-পর্যন্ত। অথচ দায়দায়িত্বও কম নয়। কী করে সেসব মাথা থেকে নামাব বুঝতে পারছি না। তা ছাড়া এসব কাজে যাওয়া আসা কোর্ট কাছারিতে কম খরচ হচ্ছে না।’

‘আমি কিন্তু আপনাকে বলিনি খরচ করতে।’

‘আহা! তুমি বলবে কেন? আমি আমার গরজেই করেছি। বলছিলাম কী, তরী প্রায় কুলে এনে ফেলেছি। এখন তোমার কি ইচ্ছে আছে ওদের কিছু দেওয়ার?’

‘কাদের কথা বলছেন?’

‘তোমার জন্মদাতা বাবা আর সৎমায়ের কথা বলছি।’

‘আপনিই ওঁদের নিয়ে এসেছিলেন আমার কাছে।’

‘হুঁ। পরে ভেবে দেখলাম ঠিক হয়নি। তোমার মা মারা যাওয়ার পরই তো আমাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছিল সে। আবার বিয়ে করে সে নিজেই সব সম্পর্ক অস্বীকার করেছে। আমার নিজের বোন যখন নেই আর তার স্মৃতি যখন মানুষটা নষ্ট করেছে তখন তাকে কেন তুমি আর এখন অনুগ্রহ করবে?’

‘কী ব্যাপার বলুন তো?’

‘মানে?’

‘আপনার সঙ্গে কি ওদের ঝগড়া হয়েছে।’

‘না না, ঝগড়াঝাঁটি নয়। আমার বুঝতে একটু সময় লাগল।’

‘আপনার এই মত ওঁরা জানেন?’

‘না, আমার জিনিস নয়, আমি কেন বলব? বলবে তুমি!’

‘ওঁরা যদি বলেন আপনাকে কিছু না দিতে। ভাগনির সম্পত্তিতে মামার কোনও অধিকার নেই। এ-কথা তো আইনও বলবে।’

‘বলতে আরম্ভ করেছে। তোমার বাবা যাকে বিয়ে করেছেন, মানে যাকে নিয়ে আমি এখানে এসেছিলাম, তার কথাবার্তায় আমি ভুলে গিয়েছিলাম সব। কিন্তু তোমার সম্মতি পাওয়ার পর তার ব্যবহার পালটে গিয়েছে। আমাকে তো বলেই দিল বাবার চেয়ে মামা বড় হতে পারে না।’

‘তাই বলুন। আপনারা এখন আর এক দলে নেই। ঠিক আছে, আপনি যা করছেন করুন। এ-ব্যাপারে যত খরচ হচ্ছে লিখে রাখবেন। যখন আমাকে প্রয়োজন হবে খবর দেবেন। ঠাকুমা এখন কেমন আছেন?’

‘ওই আর কী।’

‘আপনি বললেন চা-বাগানের বাড়িতে গিয়েছিলেন?’

‘হ্যাঁ। তোমার মায়ের সঙ্গে কথা বলেছি এসব ব্যাপার নিয়ে।’

‘ঠাকুমাকে দ্যাখেননি?’

‘শুনলাম ওঁর শরীর খারাপ। বৃদ্ধা মানুষ। নিজের ঘরে ছিলেন। তাই আর বিরক্ত করিনি। কেন, কী হয়েছে বলো তো?’

দীপা জবাব দেবার প্রয়োজন বোধ করল না। ঠাকুমার পা ভাঙার খবরটা নিয়ে সে আর কিছু ভাবতে চাইল না। সুভাষচন্দ্র সেটা ধরতে পারলেন না। দীপা বলল, ‘আপনি ওখানে গিয়ে ঠিক কী কী কাজ করেছেন বলুন তো?’

সুভাষচন্দ্র যেন এবার বলার মতো বিষয় খুঁজে পেলেন। সোৎসাহে বলতে লাগলেন, ‘প্রথমে পাড়ায় গিয়ে কয়েকজনকে জিজ্ঞাসা করলাম। ঠিকঠাক সম্পত্তির পরিমাণ কেউ বলতে পারল না। প্রতুল বাঁড়ুয্যের বাড়ির তো অবশিষ্ট কিছু নেই। বন্যায় পলি পড়ে সব নষ্ট হয়ে গিয়েছে। পাড়ার লোকে জানলা দরজাও খুলে নিয়ে গিয়েছে। গাছগাছালিরও খারাপ অবস্থা। প্রতুল বাঁড়ুয্যের ছোট ভাইপোর সঙ্গে দেখা করলাম। সে তো প্রথমে আমায় সাফ কথা বলতেই চায় না। তোমার সই করা কাগজ দেখাতে বলল তার কোনও ইন্টারেস্ট নেই, সে জানেও না কী কী সম্পত্তি আছে। উঃ, সে যে কী হ্যাপা তা তোমাকে কী বলব।’ মাথা নাড়লেন সুভাষচন্দ্র। দীপা কথা বলল না। কিন্তু লক্ষ করল হঠাৎ হঠাৎই সুভাষচন্দ্র তুই থেকে তুমিতে উঠে যাচ্ছেন।

সুভাষচন্দ্র আবার শুরু করলেন, ‘আমি তো ছাড়ার পাত্র নই। গেলাম জলপাইগুড়ির কোর্টে। জমিজমার রেকর্ড দেখতে চাইলাম। সে তো হিমালয়ের একটা লতা খোঁজার মতো ব্যাপার। কিন্তু খুঁজতে জানলে কী না হয়। যে-ভদ্রলোক প্রতুলবাবুর বিষয়সম্পত্তি দেখাশোনা করতেন, মানে ওঁর উকিলবাবু, তিনি তো সব মেরে দেবার তালে ছিলেন। আমায় দেখে মোটেই খুশি হলেন না। কিন্তু তার মূহুরিকে টাকাপয়সা দিয়ে ম্যানেজ করে সব বের করলাম রেকর্ড থেকে। বুঝতেই পারছ যা ছিল ও তার অর্ধেকও না। ওঁর সম্পত্তির বেশির ভাগই তো বেনামে। কোর্টে তার রেকর্ড থাকবে কেন? যা পেয়েছি সব লিখে নিলাম। এরপর গেলাম ব্যাঙ্কে। অ্যাকাউন্ট নাম্বার জানি না, কোন ব্যাঙ্কে টাকা রাখতেন তাও না। যে ক’টা ব্যাঙ্ক জলপাইগুড়িতে আছে সব চরতে লাগলাম। সেখান থেকে তিনটে অ্যাকাউন্টের সন্ধান পেলাম। তার ব্যালান্স অ্যামাউন্ট, অ্যাকাউন্ট নম্বর লিখে এনেছি। তুমি চাও তো তার কপি দিতে পারি তোমাকে।’

‘দেবেন তো!’

‘ও, আচ্ছা, দেব।’ একটু হকচকিয়ে গেলেন সুভাষচন্দ্র, ‘এখন কোর্ট থেকে অর্ডার বের করতে হবে যে তুমিই তাঁর উত্তরাধিকারিণী। অর্ডার পেলে ওগুলো তোমার নামে ট্রান্সফার করা যাবে। মুশকিল হল, এসব সময়সাপেক্ষ ব্যাপার আর তা করতে আমাকে জলপাইগুড়িতে গিয়ে কিছুদিন থাকতে হবে।’ সুভাষচন্দ্র মুখ বিমর্ষ করলেন।

‘ও, আচ্ছা!’ মাথা নাড়ল দীপা।

‘ইয়ে, তোমার জন্মদাতা তো কোনওকালে দায়িত্ব নেননি। এতে যে পয়সাকড়ি খরচ হচ্ছে তা যাচ্ছে আমার পকেট থেকেই। অথচ পড়ে পাওয়া চৌদ্দআনা নিতে তার জিভ লকলক করছে। এসব আমার সহ্য হয় না। আর তাঁর স্ত্রীর কথাবার্তা শুনলে মনে হয় তিনি যেন কুইন ভিক্টোরিয়া।’ সুভাষচন্দ্র আক্রোশ বোঝালেন, ‘কিন্তু মুশকিল হল আমার তো অবস্থা ভাল নয়। কলকাতায় সংসার রেখে জলপাইগুড়িতে যাওয়া মানে একই সঙ্গে দু’জায়গায় খরচ চালানো। এ আমি পারব কী করে? তা ছাড়া কোর্ট কাছারির খরচাও আছে। তাই আমি বলছিলাম যদি তুমি এখন হাজার টাকা আমাকে দাও, মানে তাতেই সব হয়ে যাবে, তা হলে প্রতুল বাঁড়ুয্যের টাকা পাওয়ামাত্রই তোমাকে শোধ করে দেব।’

এরকম প্রস্তাব যে সুভাষচন্দ্র করতে পারেন চিন্তাও করেনি দীপা। মামার মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সে বলল, ‘আমি কী করে দেব?’

‘আমি সব জানি। অঞ্জলি বলেছে আমাকে। অমরনাথ যাওয়ার আগে প্রতুল বাঁড়ুয্যের টাকা থেকে তোমার ভবিষ্যতের ব্যবস্থা করে গিয়েছে। বিচক্ষণ মানুষ ছিল তো! তা বেশি দিন তো নয়, কয়েক মাসের মধ্যেই টাকাটা ফেরত পাচ্ছ মা!’

দীপা মাথা নাড়ল, ‘আপনি ভুল শুনেছেন। তা ছাড়া যে-সামান্য টাকা আমাকে দেওয়া হয়েছিল তা থেকেও আমি চা-বাগানে সাহায্য করেছি। এখন আমাকে টিউশনি করতে হয় নিজের খরচ চালানোর জন্যে। আপনার যদি খুব অসুবিধে হয় তা হলে এসব করার দরকার নেই। আপনারা নিজেরাই এমন প্রস্তাব নিয়ে এসেছিলেন, আমার এতে কোনও আগ্রহ ছিল না, এখনও নেই।’

সুভাষচন্দ্র যখন দেখলেন দীপা নরম হবার পাত্রী নয় তখন দেখি কী করা যায় গোছের কথা বলে বিদায় নিয়েছিলেন। হস্টেলে নিজের খাটে শুয়ে দীপা নিঃসাড়ে হাসল। যতই সে ভাবুক অতীত ভুলে গেছে তার বিবাহিত দু’দিনের স্মৃতি কি তাকে চিরকাল এভাবে বিব্রত করে যাবে? তার মনে হল সম্পত্তির বিলিব্যবস্থা হয়ে গেলে সে রক্ষা পেতে পারে। সুভাষচন্দ্রের মুখের ওপর কিছু বলতে পারেনি সে। চারপাশের আত্মীয়স্বজনের অর্থনৈতিক অবস্থা এত খারাপ যে তাঁরা কিছু চাইলে সরাসরি না বলা মুশকিল হয়ে ওঠে। ওই সম্পত্তিটাকে ওঁরা পড়ে পাওয়া চৌদ্দআনা বলে মনে করছেন। যদি সম্পত্তি না থাকত, যদি দীপা নিজের পরিশ্রম এবং বুদ্ধিতে খুব বিত্তশালী হয়ে উঠত, তা হলেও ওঁরা একইভাবে সাহায্যের জন্যে আসতেন। মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্তের কোনওকালেই বিনাশ্রমে পাওয়ার লোভ দূর হবে না। হঠাৎ ভাবনাটা মাথায় এল। প্রতুল বাঁড়ুয্যের ভাইয়ের ছেলে সুভাষচন্দ্রকে বলেছেন ওইসব সম্পত্তিতে তাঁর আগ্রহ নেই। বংশের সূত্র ধরলে তিনিই প্রকৃত উত্তরাধিকারী। দীপা দু’রাতের বৈবাহিক সম্পর্কের ভিত্তিতে সেই উত্তরাধিকার অর্জন করতে বাধ্য হয়েছে। সে যদি ভদ্রলোককে সমস্ত দাবি লিখিতভাবে প্রত্যাহার করে অনুরোধ জানায় তিনি তাঁর ইচ্ছেমতন বিলিব্যবস্থা করুন তা হলে আর এইসব অনুরোধ-উপরোধের মুখোমুখি হতে হবে না দীপাকে। কিন্তু ভদ্রলোকের নাম ঠিকানা সে জানে না। শুধু রায়কত পাড়ার কথা মনে আছে। দীপার মনে পড়ল রায়কত পাড়ায় তার এক সহপাঠিনী থাকত। প্রতুলবাবুর দাদা তো জেলার নামকরা কংগ্রেস নেতা। তাই সেই সহপাঠিনীকে লিখলে নাম ঠিকানা পেতে অসুবিধে হবে না। যেন মাথার ওপর থেকে একটা বিরাট বোঝা নেমে গেল এমন একটা অনুভূতি হচ্ছিল দীপার।

দু’দিন বাদে বিকেলে, হস্টেলে বসে বইয়ের পাতা ওলটাচ্ছিল দীপা, এমন সময় খবর এল তার ভিজিটার এসেছে। নীচে নেমে দেখল শমিত আর একজন ভদ্রলোক।

শমিত ওকে দেখেই বলল, ‘কী ব্যাপার, একদম ডুমুরের ফুল, মায়ার কাছেও খবর পাচ্ছি না। আমাদের একদম ত্যাগ করলে?’

শমিতকে দেখামাত্র কেমন একটা ঝিমঝিমে ভাব চলে এল শরীর এবং মনে৷ যেন একটা ভারী কিছু হঠাৎই ঝুলে পড়ল সেখানে। সে হাসার চেষ্টা করল, ‘তা কেন? অসুখের জন্যে অনেক পিছিয়ে পড়েছিলাম, তাই—।’

শমিত বলল, ‘আগে এই ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা শেষ করো। ইনি আমাকে খুঁজে বের করেছেন তোমার সঙ্গে কথা বলার জন্যে।’

দীপা ভদ্রলোকের দিকে তাকাল। শমিত যখন নিয়ে এসেছে তখন নিশ্চয়ই আনার পেছনে যুক্তি আছে। সে বলল, ‘বলুন।’

ভদ্রলোক দু’হাত জড়ো করে নমস্কার করলেন, ‘আমাকে সুবিনয় সেন পাঠিয়েছেন। উনি চেষ্টা করেও অনেকদিন যোগাযোগ করতে পারেননি। উনি আপনার সিদ্ধান্তের জন্যে এখনও অপেক্ষা করছেন।’

দীপা মাথা নাড়ল, ‘না। সিনেমায় অভিনয় করার কোনও বাসনা আমার নেই।’

ঠোঁট কামড়ালেন ভদ্রলোক, তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কারণটা জানতে পারি?’

‘এটা আমার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত।’

ভদ্রলোক যেন স্বস্তি পেলেন। তিনি বারংবার দীপার মুখ শরীর দেখছিলেন। এবার ঘুরে দাঁড়িয়ে তিনি শমিতকে বললেন, ‘অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। আসলে সুবিনয়বাবু এত ব্যস্ত হয়েছিলেন যে আমাকেই আসতে হল। আসলে উনি বোঝেন না ভদ্রঘরের সব মেয়েই যে ফিল্মে অ্যাক্টিং করার সুযোগ পেলেই চলে আসবে তা নয়। আপনাকে বিরক্ত করলাম বলে দুঃখিত। চলি।’

ভদ্রলোক চলে গেলে শমিত হাসল, ‘ব্যাপারটা লক্ষ করলে?’

‘কী ব্যাপার?’ দীপা এত সহজে নিষ্কৃতি পেয়ে খুশি হয়েছিল।

‘সুবিনয়বাবুর আগামী ছবির প্রযোজক যেন তোমার না শুনে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। একটু আগে আমার সঙ্গে কথা বলার সময় উনি বলেছিলেন এত টাকা খরচ করে ছবি তৈরি হবে, নতুন নায়ক নায়িকা নিলে বেশ ঝুঁকি হয়ে যায়। নেহাত সুবিনয়বাবু খুব নামজাদা পরিচালক তাই তিনি কিছু বলতে পারছেন না। নইলে সুচিত্রা সেনকে নেওয়া পাকা হয়ে গিয়েছিল।’

দীপার মুখে রক্ত জমল, ‘যাঃ। যে-চরিত্রে আমায় ভেবেছে সেই চরিত্রে উনি করবেন কী করে? মানাবেই না। উনি আমার থেকে কত বড়!’

শমিত মাথা নাড়ল, ‘ওটা ফিল্ম লাইন। চল্লিশ বছরেও নায়ক নায়িকা কলেজের ফার্স্টইয়ারের ছাত্রছাত্রী হয়। নাটকে তো আকছার। সেদিন কম্বাইন শো বিষবৃক্ষের বিজ্ঞাপন দেখলাম। কুন্দনন্দিনীর চরিত্রে পঞ্চান্ন বছরের এক বৃদ্ধা নায়িকা নামছেন। অতএব সব হয়। কিন্তু তুমি করছ না বলে প্রযোজক যেন বেঁচে গেলেন।’

‘বেঁচে গেলেন!’

‘হুঁ। তার আর কোনও ঝুঁকি রইল না।’

‘আমি করলে ঝুঁকি হত?’

‘হত না! তোমাকে কে চেনে? এক পয়সাও টিকিট বিক্রি হত না তোমার নামে। লোকে অন্য কারণে হলে এসে তোমার অভিনয় দেখে ভাল লাগলে তোমাকে নিয়ে কথাবার্তা বলত। না লাগলে তোমার কপাল পুড়ল। সবাই বলত তোমার জন্যেই ছবি ফ্লপ করেছে। যাক, ছেড়ে দাও এসব কথা।’

‘না, দাঁড়ান। আপনার মনে হয়েছে লোকটি আমায় অবহেলা করল?’

‘অবহেলা করেছে কিনা জানি না তবে বেঁচে গিয়েছে। ভাবখানা দেখে তাই তো মনে হল।’ শমিত হাসল।

দীপা আচমকা গম্ভীর হয়ে গেল। শমিত জিজ্ঞাসা করল, ‘এখন তোমার শরীর কেমন আছে? বেশ। রোগা হয়ে গিয়েছ।’

‘ভালই তো আছি। আচ্ছা, সেই ওয়ার্কিং গার্লস হস্টেলের কোনও খবর পাওয়া গেল? আমি মানিকতলায় একটা হস্টেলের খবর পেয়েছি কিন্তু ওখানে কোনও সিট খালি নেই।’

‘তুমি কবে থেকে যেতে চাও?’

‘এমন করে বলছেন যে এখনই যেতে পারি?’

‘আমি বলে রেখেছি। মাস তিনেক বাদে একটা সিট খালি হবে বাগবাজারের একটা হস্টেলে। ওখানকার ব্যবস্থা খুব ভাল।’

‘আমি কিন্তু চাকরি করি না।’

‘চাকরির সংজ্ঞা কী? তুমি তো টিউশনি করেও রোজগার করো। আর এ নিয়ে ওরা কোনও কড়াকড়ি করবে না। হস্টেলের কিছু স্বাভাবিক নিয়ম আছে। এক মাস ওরা দেখবে তুমি সেই নিয়ম মেনে চলছ কিনা। তারপর বোর্ডার হিসেবে পার্মানেন্ট করে নেবে।’ শমিত বলল।

‘আপনি আমার একটা বড় উপকার করলেন।’

‘তুমি আমাকে না বললে করতাম না।’

‘ঠিক হল না। ওয়ার্কিং গার্লস হস্টেলের প্রস্তাব আপনিই দিয়েছিলেন।’

‘ও, হ্যাঁ, তাই তো।’ বলেই হাসতে শুরু করল শমিত। দীপাও সেই হাসিতে যোগ দিল। এটা এল খুব স্বতঃস্ফুর্ত ভাবেই। হাসি থামলে দীপা বলল, ‘আপনাকে আর একটা উপকার করতে হবে আমার।’

‘শোনা যাক।’

‘আজ কি রিহার্সাল আছে আপনার?’

‘কেন বলো তো?’

‘জিজ্ঞাসা করছি।’

‘রিহার্সাল নেই। তবে গ্রুপে যাব। সাতটা নাগাদ যাওয়ার কথা।’

‘তা হলে এখনও অনেক সময় আছে। আপনি আমার সঙ্গে যাবেন?’

‘কোথায়?’

‘সুবিনয় সেনের বাড়িতে।’

‘সেকী? সেখানে যাবে কেন?’

‘ভদ্রলোকের সঙ্গে কিছু কথা আছে আমার।’

‘আশ্চর্য! সেটা ওই ভদ্রলোককে বলে দিতে পারতে।’

‘ওঁকে তো বলার নয় কথাগুলো।’

‘দ্যাখো দীপা, আমি সুবিনয় সেনের বাড়ি চিনি না। খোঁজ করে বের করতে হবে। আজ না গিয়ে কাল যদি যাও তা হলে ভাল হয়।’

‘না, আজই। কাল গেলে ব্যাপারটার গুরুত্ব থাকবে না।’

‘বেশ চলো। স্টুডিয়ো পাড়ায় গিয়ে খোঁজ করতে হবে।’

‘আমি আপনার বেশ অসুবিধে করলাম—।’

‘দীপা, দূরত্ব নিয়ে কথা বললে আমাকে অনুরোধ কোরো না।’

সুবিনয় সেনের বাড়িতে যেতে হল না। নিউ থিয়েটার্স স্টুডিয়োতে ঢুকে শমিত এবং দীপা এক ঝাঁক দ্বিতীয় শ্রেণির শিল্পীদের দেখতে পেল। সবাই এমন ভাবভঙ্গি করছেন যেন সবে মর্ত্যে পা দিয়েছেন। গেটে দারোয়ানকে সুবিনয় সেনের কথা জিজ্ঞাসা করেছিল শমিত। জেনেছিল তিনি এই স্টুডিয়োতে একটা অফিসঘর ভাড়া নিয়ে রোজ সন্ধে ছ’টা অবধি কাজ করেন।

দোতলা বাড়ির একতলায় সুবিনয় সেনের অফিস। বাইরে নেমপ্লেট এবং পিয়ন আছে। দেখা করতে। চায় জেনে সে জেরা করতে লাগল। ফিল্মে নামতে চাইলে সেনসাহেব দেখা করবেন না। এইসময় একটি লোক দীপাকে দেখে এগিয়ে এল, ‘আরে আপনি! আসুন আসুন, দাদার সঙ্গে দেখা করতে চান?’

ওরা চিনতে পারল। সুবিনয় সেনের সহকারী ইনি, শো দেখতে গিয়েছিলেন।

পিয়ন আর কথা বাড়াল না।

সুবিনয় সেন একজনকে কিছু বোঝাচ্ছিলেন। হঠাৎ ওদের ঢুকতে দেখে চোখ ছোট করলেন, কথা থামালেন। সহকারী তাঁর কাছে ছুটে গিয়ে পরিচয় দিতেই তিনি সামনে বসা লোকটিকে ছেড়ে দিয়ে ওদের বসতে বললেন, ‘বলুন কী ব্যাপার?’

দীপা চেয়ারে বসে বলল, ‘আজ এক ভদ্রলোক আমার কাছে গিয়েছিলেন, বোধহয় আপনার ছবির তিনি প্রযোজক—’।

‘হ্যাঁ। উনি আমাকে এসে বলেছেন আপনার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তের কথা। কিন্তু ওঁকে তো আপনি জানিয়েই দিয়েছেন, তারপর—। আপনি কি মত পরিবর্তন করেছেন?’

‘আমি আপনার কাছে একটা অনুরোধ নিয়ে এসেছি।’

‘কী ব্যাপার?’

‘দেখুন, এখন এই মুহূর্তে আমার পক্ষে পড়াশুনা ছাড়া আর কিছু করা একেবারেই অসম্ভব। আমাকে রেজাল্ট ভাল করতেই হবে।’

‘তা করুন। তবে থিয়েটার করলে রেজাল্ট ভাল থাকবে আর ফিল্ম করলে খারাপ হয়ে যাবে এটা আমি মেনে নিতে পারছি না। তা ছাড়া আপনার অভিনয় দেখার পর আমি কয়েকজন সাংবাদিককে বলি যে পরের ছবিতে নতুন মেয়েকে নায়িকা করব। বুঝতেই পারছেন এ নিয়ে এখন কথা হবে।’

‘পরীক্ষা পর্যন্ত আমি নাটকও করছি না।’

‘বলুন, আপনার অনুরোধ কী?’

‘পরীক্ষার পরে যদি আমাকে একটা সুযোগ দেন তা হলে কৃতজ্ঞ থাকব।’

শুধু সুবিনয় সেনই নন শমিত পর্যন্ত চমকে উঠল। ও যে এই কথা বলতেই এতদূরে আসতে পারে এমন ভাবনা শমিত ভাবতেই পারেনি।

‘তুমি বলছি’, সুবিনয় সেন বাঁ হাতে চশমা খুললেন, ‘তুমি তো ফিল্মে অভিনয় করতে চাও না, তা হলে আর পরীক্ষার পরে আসতে চাইছ কেন?’

‘প্রথমে বলুন, একবছর বাদে আপনি আমাকে সুযোগ দিতে পারেন কিনা। তা হলে আমি আমার কথা বলব।’

‘দিতে পারি না বলব না, পারি তাও না। সামনের বছর যে-ছবি করব সেখানে তোমার বয়সি কোনও মেয়ের ভূমিকা না-ও থাকতে পারে।

‘এই ছবিতে এখন যিনি আমার ভূমিকায় করবেন তাঁর বয়স কত?’

‘ও হো! তুমি বড্ড বেশি কথা বলো। একজন বড় অভিনেত্রী জানেন বেমানান-বয়সি কোনও চরিত্রে অভিনয় করতে গেলে কী করতে হয় যাতে দর্শক তাঁর অভিনয়টাই দেখবে, বয়সটা বিচার করবে না। এটা করতে গেলে অভিজ্ঞতা দরকার হয়। তবে, এ-কথা বলছি, যদি ঠিকঠাক চরিত্র পাই, যদি প্রযোজক আমার বিরোধিতা না করেন, তা হলে তোমার কথা নিশ্চয়ই ভাবব। সেদিন তোমার অভিনয় ভাল লেগেছিল, শুধু এই কারণেই ভাবব।’

‘এতেই হবে। আজ আপনার এই ছবির প্রযোজক গিয়েছিলেন আমার কাছে। আমি করব না শুনে তিনি যেন নিষ্কৃতি পেলেন। নতুন একজনকে নিয়ে ছবি করার ব্যাপারে ওঁর অনাগ্রহ হয়তো স্বাভাবিক, কিন্তু আমি একটি ছবিতে অভিনয় করে প্রমাণ করতে চাই যে আপনি ভুল নির্বাচন করেননি।’

মনে হচ্ছে ওঁর ব্যবহারে তুমি একটু ধাক্কা খেয়েছ। গুড। মানুষের যদি আত্মসম্মানবোধ না থাকে তা হলে সে কীসের মানুষ। আর শিল্পীর তো সেটা আরও বেশি থাকা উচিত। আমি মনে রাখব তোমার কথা। তুমি তোমার পরীক্ষা শেষ হলেই আমার সঙ্গে যোগাযোগ কোরো।’

সুবিনয় সেনের অফিস থেকে বেরিয়ে স্টুডিয়োর মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময় ওরা একটাও কথা বলল না। স্টুডিয়োর বাইরে এসে বাস স্টপে দাঁড়িয়ে শমিত মুখ খুলল, ‘আমি এমন অবাক খুব কম হয়েছি।’

‘ওমা, কেন?’

‘তুমি যে এই কথা বলতে আসবে কে জানত!’

‘আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গিয়েছিল। কেউ আমায় উপেক্ষা করছে দেখলে আমি স্থির থাকতে পারি না।’

‘বাঃ, তা হলে কাজ হাসিল করতে হলে তোমায় উপেক্ষা করতেই হবে।’

‘ভ্যাট, ইয়ারকি হচ্ছে!’

‘তবে তুমি অতবড় একটি নামী মানুষের সঙ্গে যেভাবে কথা বলে গেলে তা অনেক ছেলে পারত না।’ শমিত দেখল দূরে বাস আসছে, ‘চলো, ওঠা যাক, রিহার্সাল না থাকলেও তো যেতে হবে।’

বাসটি এসপ্লানেড পর্যন্ত এল। শমিত ঘড়ি দেখল, এখনও কিছুটা সময় আছে। জিজ্ঞাসা করল, ‘চা খাবে? খিদে পেয়েছে।’

‘আমি খাওয়াব।’

‘কারণ?’

‘কোনও কারণ নেই।’

ধর্মতলা স্ট্রিটের মুখটায় একটি বাঙালি-রেস্টুরেন্টে ঢুকল ওরা। বেশ ভিড়। দোতলায় জায়গা মিলল। এখানে মিষ্টি খুব বিক্রি হয়। ওরা নোনতা আর চা বলল। শমিত মিষ্টি খেতে চাইল না। ছোট টেবিলে মুখোমুখি বসে শমিত বলল, ‘ভুল করেছি। তোমাকে অবহেলা করে কিছু বললে অন্তত পরীক্ষার পর নাটক করতে। জানা ছিল না তাই ভুলটা হল।’

দীপা চোখ তুলে উজ্জ্বল হাসল। তারপর বলল, ‘এই যে তুমি দিনরাত নাটক নিয়ে থাকো, তোমার অ্যাম্বিশন ভাল নাটক করা, এটাই তোমাকে আর পাঁচজনের থেকে আলাদা করেছে। স্বপ্নেও তুমি নাটকের ছবি দ্যাখো, না?’

‘এটা নিন্দে না প্রশংসা বুঝতে পারছি না।’

‘মানে?’

‘হঠাৎ তুমি বলতে আরম্ভ করলে?’

দীপা জিভ বের করল, মাথা নাড়ল শমিত, ‘দয়া করে আর আপনি বোলো না। তা হলে সেটাই প্রমাণ করবে তুমি আমার নিন্দে করছিলে।’

দীপা আর কথা বলল না। খাবার এলে চুপচাপ খেতে লাগল। মিনিট পাঁচেক বাদে ওরা যখন চায়ের জন্যে অপেক্ষা করছে তখন শমিত বলল, ‘মনে হচ্ছে তুমি না জেনে বিরাট একটা অপরাধ করে ফেলেছ।’

‘না, তা কেন?’ দীপা ওপর থেকে নীচের কাউন্টারের দিকে তাকাল।

‘তা হলে এমন মুখ করে আছ কেন? আমাকে বন্ধু ভাবতে পারো না?’

‘ভাবি না কে বলল?’

‘কী আনন্দ!’

‘শুধু ইয়ারকি!’

‘কীরকম বন্ধুত্ব বলল! ইয়ারকি তো আসবেই। আমি কেরিয়ারের কথা না ভেবে আজ নাটক নিয়ে পড়ে থাকতে চাই। এতেই আনন্দ পাই। সুদীপ ইংরেজিতে এম এ করছে, কলেজে পড়াবে। সেইসঙ্গে নাটক। অর্থাৎ পাশাপাশি অন্যকিছু ভাবছে। আমাকে মা মাসিরা বাউন্ডুলে বলেন। এক কাকা ঘোষণা করেছেন যে আমার ভবিষ্যৎ ঝরঝরে। আর তুমি সিরিয়াসলি পড়াশুনা করে কেরিয়ার তৈরি করতে চাও। আই এ এস-এ বসতে যাচ্ছ। জিরো আর একশোতে বন্ধুত্ব হল। দুটোতেই অবশ্য জিরো আছে, অবস্থান এদিক ওদিক।’

‘এতে তোমার আফশোস হচ্ছে?’

‘নাঃ। যাই বলল, পাওয়াটাই বড় কথা, কতটা পাচ্ছি সেই বিচার করতে গেলে কষ্ট বাড়ে। আমি যেচে কষ্ট পেতে রাজি নই?’

‘আর যার ওপর কষ্ট চাপিয়ে দেওয়া হয়? অনবরত যার ওপর কষ্টের বৃষ্টি হচ্ছে আর যে দুটো হাত মাথার ওপর তুলে তার আড়ালে নিজেকে বাঁচাতে চেষ্টা করছে তাকে কী বলবে?’

‘আমি জানি।’

‘কী জানো? চমকে যেয়ো না, তুমি জানো, আমি বিধবা?’

‘এটাকে কি তুমি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করো?’ শমিত গম্ভীর হল।

‘মানে!’ দীপা অবাক হয়ে গেল।

‘তোমার সমস্ত ঘটনা আমি মায়ার কাছে শুনেছি। বিধবা বলে ঘোষণা করলে অনেকের কৌতুহল থেকে আড়াল নিশ্চয়ই করতে পারো। কিন্তু সত্যি কথাটা বলো তো, তুমি নিজেকে বিধবা ভাবো?’

এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে দীপা মাথা নাড়ল, না।

‘তা হলে? কথাটা আমাকে শোনালে কেন? শুনে আমি তোমার সঙ্গে আর মিশতে চাই কিনা পরীক্ষা করতে?’

‘যদি বলি তাই!’

‘তা হলে ভুল হয়েছে তোমার।’

‘আর পাঁচটা অবিবাহিতা মেয়ের সঙ্গে আমার কোনও মিল নেই!’

‘সেটা তোমার আচরণে বোঝা যায়!’

‘তার মানে?’

‘ওরা কেউ তোমার মতো প্রতিবাদী নয়। বোধহয় এই কারণেই নাটক করবে না জানার পরেও আমি তোমার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে পারিনি।’

চা এল। ওরা চুপচাপ খেল। দীপাকে দাম দিতে দিল শমিত। বাইরে বেরিয়ে এসে শমিত জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি কি হস্টেলে যাবে?’

‘হ্যাঁ।’

‘তা হলে ট্রামে ওঠো। আমি বাস ধরি। আর বেশি সময় নেই।’

‘ঠিক আছে। তুমি এগোও, সামনেই তো ট্রাম গুমটি, আমি উঠে যাব। তোমাকে সময় নষ্ট করতে হবে না।’ দীপা হাসল।

‘কবে দেখা হবে?’

‘টিউশনির দিনগুলোর বাইরে হস্টেলেই থাকব।’

‘কী হয়েছে তোমার? এমন গম্ভীর হয়ে কথা বলছ?’

‘কেমন যেন গোলমাল হয়ে গেল আজ। ভাবনাটাবনাও যেন আচমকা হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে। কিছু নয়, সামলে নেব।’ দীপা কথা শেষ করামাত্র একটি মেয়েলি গলা ভেসে এল, ‘আরে, দীপাবলী না?’

ওরা দু’জনেই মুখ ফিরিয়ে দেখল এক মধ্যবয়সি মহিলা এগিয়ে আসছেন। তাঁর হাতে সদ্য কেনা জামাকাপড়ের প্যাকেট। দীপার গলা একদম পালটে গেল। উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল, ‘ওমা, আপনি! এখানে!’

‘আমি তো এখন কলকাতায়।’ কাছে এসে হাত ধরলেন মহিলা।

শমিত বলল, ‘তা হলে আজ আমি চলি দীপা।’ শমিত দাঁড়াল না। দীপা তার চলে যাওয়া দেখল। এভাবে না গেলে সে আলাপ করিয়ে দিত। ভদ্রমহিলা ততক্ষণে দীপাকে প্রায় জড়িয়ে ধরেছেন, ‘তুই কী বড় হয়ে গেছিস।’

দীপা ওঁর মুখের দিকে তাকাল। রমলা সেনের সিঁথিতে সিদুরের লম্বা দাগ।

সকল অধ্যায়

১. ১. আজ সারাটা দিন সূর্যদেব উঠলেন না
২. ২. মেয়েরা কি ভূত হয়
৩. ৩. ভালো-মন্দ বোঝার বয়স
৪. ৪. রমলা সেন
৫. ৫. সত্যসাধন মাস্টার
৬. ৬. বৃষ্টিটা চলে যাওয়ার পরে
৭. ৭. চারদিন পৃথিবীটাকে দ্যাখেনি দীপা
৮. ৮. দীপাবলীর বিয়ে
৯. ৯. বাসর এবং বউভাত
১০. ১০. দীপাবলীর ফুলশয্যা
১১. ১১. পুত্ৰটি দেহ রেখেছে
১২. ১২. রমলার চিঠি
১৩. ১৩. প্ৰাপ্তবয়স্কতা শরীরের না মনের
১৪. ১৪. চাবাগানের আশেপাশে
১৫. ১৫. আসাম রোড
১৬. ১৬. একটি মানুষের চেহারা
১৭. ১৭. জলপাইগুড়ি শহরে
১৮. ১৯. রমলা সেনের কাছে
১৯. ১৮. পুলিশের লাঠিচার্জ
২০. ২০. জলপাইগুড়ির হোস্টেলের মেয়ে
২১. ২১. দুশ্চিন্তার ছাপ
২২. ২২. একতারা বাজিয়ে গান
২৩. ২৩. দুর্দান্ত ব্যবসাদার প্রতুল বন্দ্যোপাধ্যায়
২৪. ২৪. সত্যসাধন মাস্টার এসে পড়বেন
২৫. ২৫. অমরনাথ হতভম্ব
২৬. ২৬. তিনদিন ধরে সমানে বৃষ্টি
২৭. ২৭. অমরনাথের শরীর
২৮. ২৮. কলকাতা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে
২৯. ২৯. প্রৌঢ় ভদ্রলোকটি হাঁটছিলেন
৩০. ৩০. এক অদ্ভূত অভিজ্ঞতা
৩১. ৩১. বাড়িটা শুধু পুরনো নয়
৩২. ৩২. উত্তর কলকাতার পথে পথে
৩৩. ৩৩. কলেজ এবং হোস্টেলের বাইরে
৩৪. ৩৪. দীপা অঞ্জলির দিকে তাকাল
৩৫. ৩৫. অমরনাথ শুয়ে আছেন
৩৬. ৩৬. ভবিষ্যৎ সম্পর্কে প্ৰচণ্ড অসহায়তাবোধ
৩৭. ৩৭. তিনতলার ব্যালকনি
৩৮. ৩৮. দীপা চুপ করে আছে
৩৯. ৩৯. সুভাষচন্দ্র এগিয়ে এলেন
৪০. ৪০. মেয়েটির নাম লাবণ্য
৪১. ৪১. বিছানায় টান টান দীপা
৪২. ৪২. কলেজের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে
৪৩. ৪৩. কিছু মানুষ খুন হলেন
৪৪. ৪৪. কেমন একটা সংসার-সংসার ভাব
৪৫. ৪৫. রাধা চলে এল সেজেগুজে
৪৬. ৪৬. দ্বিতীয় অভিনয় হয়ে যাওয়ার পরে
৪৭. ৪৭. কলোনি থেকে কলেজ পাড়ায়
৪৮. ৪৮. স্কটিশ চার্চ কলেজে জানাজানি হয়ে গেল
৪৯. ৪৯. একদম লেডি
৫০. ৫০. রমলা সেন চোখ ছোট করলেন
৫১. ৫১. সাতকাহন প্ৰথম পর্ব সমাপ্ত

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন