সমরেশ মজুমদার
কলেজের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে মায়া বলল, ‘দুর, এটা কোনও প্রবলেমই না। তুই ছুটিটা আমাদের বাড়িতে স্বচ্ছন্দে থাকতে পারিস। তুই নিজেই মাকে বল না।’
মায়াদের বাড়িতে থাকার কথা দীপার মাথাতেও এসেছিল। ওদের ভাগে যে-ঘরগুলো তাতে লোক বলতে মাত্র তিনজন। সে থাকতে চাইলে মাসিমা আপত্তি করবেন না। কিন্তু ছুটির অতগুলো দিন ওখানে থাকলেও মাসিমা নিশ্চয়ই তার কাছে টাকা চাইবেন না এবং সে-ও দিতে পারবে না। এইটেই অস্বস্তির। মায়া বলল, ‘তুই সামনের রবিবার বাড়িতে এসে কথা বলে যা।’
‘একটু ভাবি।’দীপা বলল।
‘একটাই শুধু প্রবলেম, সেটা স্নান করা।’
‘কেন?’
‘প্রথমদিকে আমি সবাইকে দেখে মেনে নিতাম। পরে আপত্তি করতেই তুলকালাম কাণ্ড হয়েছিল। এখন যেগুলো না মানলে বাড়ির ইজ্জত নষ্ট হয় সেগুলো মানি।’
‘সেটা কী?’
‘চৌবাচ্চায় বালতি চোবানো যাবে না, ধোয়া মগ দিয়ে জল তুলতে হবে, স্নান করে গায়ে গামছা জড়িয়ে ঘরে এসে কাপড় পালটাতে হবে, পিরিয়ডের সময় বাথরুমে ঢোকা চলবে না।’ মায়া হাসতে লাগল।
‘সেকী?’ দীপা বলল, ‘তোদের কি কমন বাথরুম?’
‘পুরনো বাড়ি। আদ্যিকালের বাথরুম। আগে একটা ছিল, কিছুদিন হল দুটো। নীচতলায়। একটা ছেলেদের আর একটা মেয়েদের। চৌবাচ্চার ওপর থেকে দেখা যায় নীচে এক ইঞ্চি পুরু কাদা পড়ে আছে। সপ্তাহে একদিন পরিষ্কার করা হয়।’
‘তুই গামছা জড়িয়ে বাথরুম থেকে বের হস?’
‘মাথা খারাপ। তিরিশ দিনই সভ্যভব্য হয়ে বাথরুম থেকে বের হই।’
‘ওইসময়ে বাথরুমে যাওয়া বারণ, মানে, আগের নিয়ম এখনও চলছে ও-বাড়িতে।’
‘ইয়েস ম্যাডাম। এসব কলকাতার বনেদি ব্যাপার। আমার জেঠিমা অল্পবয়সে বিধবা। তিনিই নিয়মরক্ষার দায়িত্ব নিয়েছেন। জেঠতুতো দাদার মেয়ে শরীর খারাপ হলে আর স্কুলে যায় না, ঘরে স্নান না করে বসে থাকে।’
‘পাগল নাকি! তুই বোঝাস না কেন?’
‘নিজে মানছি না এটাতেই আমরা মেমসাহেব হয়ে গিয়েছি। ওদের বোঝাতে গেলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তুই বালতি আর মগের ব্যাপারটা মেনে চলবি, তাতেই কাজ হয়ে যাবে।’ মায়া প্রসঙ্গ ঘোরাল, ‘সেদিন নাটক দেখার পর আমরা ভেবেছিলাম তুই নিশ্চয়ই একদিন আসবি।’
‘একদম সময় পাচ্ছি না রে। টিউশনি করছি সন্ধেবেলায়, পড়ার চাপও বেড়েছে।’
‘তোর কথা খুব জিজ্ঞাসা করছিল সুজয়।’
‘কেন?’ দীপা সত্যি অবাক হল।
‘পরের নাটকে তোকে মানাবে এমন একটা রোল আছে।’
‘আমি যে অভিনয় করবই এমন ধারণা ওঁর হল কেন?’ দীপা প্রশ্নটা করতেই মায়া হেসে ফেলল; ‘বাব্বাঃ। তুই সুচিত্রা সেনের ছবি দেখিস, না?’
‘মানে? হঠাৎ কোত্থেকে এ-প্রসঙ্গ এল?
‘তুই যে-ভঙ্গিতে কথাগুলো বললি তা দেখে অবিকল ওরকম মনে হল!’ মায়া ওর হাত ধরল, ‘শোন। একদিন আয় না, রিহার্সাল দে। না পারলে আর যাস না।’
দীপা মাথা নাড়ল, ‘আমি যে-কাজ করব সেখান থেকে হেরে ফিরব না।’
‘বাঃ। খুব ভাল। তা হলে?’
‘দাঁড়া। ভেবে দেখি। মন চাইল যাব।’ দীপা সিঁড়ি ভাঙতে লাগল।
মায়া অবাক হয়ে তাকাল। কলেজের যে-সমস্ত মেয়ের সঙ্গে তার আলাপ আছে তাদের বুঝতে কোনও অসুবিধে হয় না। কিন্তু দীপার কথাবার্তা তার কাছেও বড় বয়স্ক বলে মনে হয়।
ব্যাপারটা জেনে রাধা বলল, ‘তুমি কী করবে ঠিক করেছ?’
‘বুঝতে পারছি না। মাসিমা, মানে মায়ার মা বললেন, ওঁদের ওখানে চলে যেতে। কোনও অসুবিধে হবে না। মায়া পারলে আমিও পারব। তবে টাকাপয়সা নিতে পারবেন না। আর সেইটে হয়েছে মুশকিল। কারও বাড়িতে ওভাবে থাকা আমার পোষাবে না।’ দীপা হেদুয়ার বেঞ্চিতে রাধার পাশে বসে কথাগুলো বলল। রাধা জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি কষ্ট করতে পারবে?’
‘কীরকম কষ্ট?’
‘এই একা থাকা, একা রান্না করে খাওয়া?’
‘এতে কষ্ট কী?’
‘তা হলে আমাদের কলোনিতে আসতে পারো। ঠিক আমাদের ঘরের পাশেই একটা ঘর খালি আছে। এখনও ভাড়া হয়নি। আমরা বললে তোমাকে একমাসের জন্যে ভাড়া দেবে।’
‘অত দূরে?’
‘দূর কোথায়? আমি তো রোজ আসছি।’
‘কত ভাড়া?’
‘পনেরো টাকা।’
‘ঘরের জিনিসপত্র? আমার যে কিছুই নেই।’
‘কিছু লাগবে না। আগের ভাড়াটে খাট টেবিল চেয়ার ফেলে গেছে। মানে ভাড়া দিতে পারেনি বলে বাড়িওয়ালা নিয়ে যেতে দেয়নি।’
‘কিন্তু আমাকে কি ভাড়া দেবে? একা মেয়েকে কলকাতায় কেউ ভাড়া দেয় না।’
‘তুমি নেবে কিনা ভেবে দ্যাখো তারপর ওসব চিন্তা—! তোমাদের এই কলকাতার নিয়মকানুন ওই কলকাতায় চলে না। পেটে ভাত না থাকলে ঠুনকো সম্মান নিয়ে মাথা ঘামাবার সময় কার থাকে বলো? আজ গিয়ে দেখে আসবে?’ রাধা জিজ্ঞাসা করল।
কি এক মুহূর্ত চিন্তা করল দীপা। ছুটির সময় রোজ কলেজে আসার দরকার নেই। শুধু টিউশনিটা নিয়ে মুশকিলে পড়বে সে। সপ্তাহে তিনটে দিন তাকে আসতেই হবে। সন্ধের পরে এখান থেকে বেরিয়ে কলোনিতে ফিরতে রাত হয়ে যাবে। তবু মায়াদের বাড়িতে অত অস্বস্তি নিয়ে থাকার চেয়ে এ ঢের ভাল। সে উঠল। রাধার মুখ খুব শুকনো। ক’দিন থেকেই সেটা লাগছিল। দীপা জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমার কি শরীর খারাপ? কেমন দেখাচ্ছে!’
‘না না। ঠিক আছে। চার আনা পয়সা আছে? বাদাম খাওয়াও।’
উলটোদিকে বেথুন কলেজের ফুটপাতে একটা বাদামওয়ালা দাঁড়িয়ে আছে। রাধার এভাবে বাদাম কিনতে বলা খুব ভাল লাগল দীপার। আজ পর্যন্ত কোনও মেয়ে তাকে সরাসরি কিছু খাওয়াতে বলেনি। বাদাম কিনে ওরা সেখানেই দাঁড়িয়ে খোসা ছাড়াচ্ছে যখন তখন রাধা চাপা গলায় বলল, ‘এই, কনকবাবু আসছেন।’
দীপা দেখল স্কটিশ থেকে বেরিয়ে লম্বা ফরসা প্রৌঢ় মানুষটি ধবধবে পাঞ্জাবি ধুতি পরে রাস্তা পেরিয়ে এদিকে আসছেন। ফুটপাথ বদল করে ওদের দেখতে পেয়ে মিষ্টি হেসে ট্রামের জন্যে দাঁড়ালেন। মানুষটির পোশাক, চেহারা এবং চালচলনে এমন একটা অভিজাত ব্যাপার আছে যে চেয়ে থাকতে হয়। ট্রাম এল। ওরা অবাক হয়ে দেখল ভদ্রলোক সেকেন্ড ক্লাসে উঠলেন। অথচ ফার্স্ট ক্লাসে বসার জায়গা ছিল। সেকেন্ড ক্লাসে উঠে উনি জানলার পাশে বসলেন। রাধা দীপার দিকে তাকাল। মানুষটাকে আরও ভাল লেগে গেল দীপার।
শিয়ালদা স্টেশন থেকে ট্রেনে চেপে দীপার জলপাইগুড়ির কথা মনে এল। সেই ট্রেন আর এই ট্রেন অবশ্য একই চেহারার নয় কিন্তু চলতে আরম্ভ করলে আলাদা অনুভূতি হয় না। স্টেশন থেকে নেমে অনেকটা যাওয়ার পর একতলা বাড়ি মাঠ চোখে পড়ল। এখানে এসে আর কলকাতা বলে মনে হচ্ছে না। জলপাইগুড়ির নতুন গড়ে ওঠা পাড়াগুলোর সঙ্গে ভাল মিল আছে। পিচের রাস্তা পালটে গিয়ে মাটির রাস্তা হয়ে গেল। রাধা বলল, ‘স্টেশন থেকে কিন্তু বেশি সময় লাগে না। ট্রেন ধরার সময় আমি অবশ্য আরও জোরে হাঁটি।’
বাড়িগুলো গায়ে গায়ে নয়। প্রত্যেকেরই একটুখানি জমি আছে। তাতে নতুন গাছ গজিয়েছে। বাড়ির ছাদ টিনের, জলপাইগুড়ির মতনই। রাধা বলল, ‘ওইটে আমাদের বাড়ি।’
দীপা দেখল কয়েকটা বাচ্চা মার্বেল খেলছে কাঁচা রাস্তায়। যে-বাড়িটা রাধা দেখাল তার চারপাশে কোনও দেওয়াল নেই। দুটো কাঁঠাল গাছ ঝাঁকড়া হয়ে উঠছে। বাড়ির পাশ দিয়ে উঠোনে ঢুকতেই সে তিনজন মহিলাকে দেখতে পেল। উঠোনের ওপর একটা চৌকিতে বসে ছিলেন তাঁরা। রাধা বলল, ‘মা, আমার সঙ্গে পড়ে, দীপা।’
‘অ। তোমার কথা খুব শুনছি। আসো। বসো এখানে।’ বয়স্কা রোগা ভদ্রমহিলা মাথায় ঘোমটা তুলে দিয়ে সস্নেহে ডাকলেন। অন্য মেয়েদের সঙ্গে রাধা তার পরিচয় করিয়ে দিল। একজন কাকিমা, অন্যজন পাশের বাড়িতে থাকেন। রাধার মা জিজ্ঞাসা করলেন,’ ‘তুমি তো হোটেলে থাকো?’
‘ওঃ মা, হোটেল নয় হস্টেল। গার্লস হস্টেল।’ রাধা শুধরে দিয়ে ভেতরে পা বাড়াল। এরপর অবধারিত ভাবে এসে পড়ল সেইসব প্রশ্ন যা এখন দীপার কাছে খুব অস্বস্তিকর। বাবা মা ভাই বোন বাড়ি ইত্যাদির খবর নিয়ে ভদ্রমহিলা বললেন, জলপাইগুড়িতে তাঁর বোন থাকেন। পাকিস্তান থেকে আসার সময় তাঁরা এসেছিলেন কলকাতায় আর তাঁর বোন ভগ্নিপতি গিয়েছিল জলপাইগুড়ির দিকে। শুনেছেন জলপাইগুড়ি শরেই বাড়ি ঘর দোকান করে বেশ গুছিয়ে বসেছেন ভগ্নিপতি। নাম বলে জিজ্ঞাসা করলেন দীপা চেনে কিনা। দীপার পক্ষে চেনা সম্ভব নয়। কথা বলার সময় মহিলা ওর একটা হাত আঁকড়ে ধরেছিলেন, ‘কী কষ্ট, বুঝলা! আমরা এখানে কী কষ্ট কইর্যা থাকলাম। আমার মাইয়ার মতো মাইয়া হয় না। সব নিজে করছে। পাঁচজনে কত কী কইল। আমি কই, আমার মাইয়া কোনও অন্যায় কইরতে পারে না। নিজের চেষ্টায় ম্যাট্রিক পাশ করছে, কলেজে পড়তেছে। কী কষ্টই না করে! অথচ দ্যাশে আমাদের কী না ছিল! গোয়ালে আটখান গাই, যা ধান আসত তাতে সারা বৎসর খাওয়াদাওয়া বিক্রি সব হইত। আর মাছ? কত খাইবা তুমি? খাও না। সেসব স্বপ্নের মতো ছিল।’
এইসময় ফিরে এল রাধা। চটপট শাড়ি পালটে নিয়েছে সে। এখন ওর পরনে অনেকটা রং চটা শাড়ি। বোধহয় আজকের পরা শাড়িটাই কাল কলেজে যাওয়ার সময় পরবে। রাধা হেসে বলল, ‘হয়ে গেল। তোমার এইসব গল্প শুনলে দীপা ভাববে ওই কথাটাই ঠিক।’
‘কোন কথা?’ ওর মা অবাক হয়ে জানতে চাইলেন।
‘পাকিস্তানের সমস্ত মানুষের পুকুর-ভরা মাছ আর খেত-ভরা ধান ছিল।’
সঙ্গে সঙ্গে তর্ক উঠে গেল। সমস্ত মানুষের না থাক অনেকের তো ছিল। এই বিতর্কে বাকি দু’জন মহিলাও সোৎসাহে অংশগ্রহণ করলেন। তাঁদের থামিয়ে রাধা দীপার আসার আসল কারণ জানাল। রাধার মা বললেন, ‘একা মাইয়া থাকতে পারবা?’
‘কেন পারব না?’ দীপা পালটা জানতে চাইল।
‘তাইলে তো কোনও মুশকিল নাই। ও আরতি, যাও, তোমার বাপরে কও, দীপা যখন রাধার বন্ধু তখন তো আপত্তির কোনও কারণ দেখি না।’
‘পনেরো টাকা ভাড়া কিন্তু, বাবা ছাড়ব না।’
‘সেটা আমি দিতে পারব।’ দীপা হেসে বলল।
রাধা এবং দীপা আরতিকে অনুসরণ করল। কঁঠাল গাছ পেরিয়ে ওদের এলাকা। সেটা একটা বাখারির বেড়া দিয়ে আলাদা করা। সামনের রাস্তা দিয়ে ঘরে ঢুকতে হয়। এ-বাড়ির সামনে বাখারির আড়াল রয়েছে। ভেতরে বড় উঠোন। বাঁদিকে ইটের দেওয়াল টিনের চালওয়ালা তিনখানা ঘর। ডানদিকে একটা ছোট ঘর। মাঝখানে কুয়ো আর ওপাশে বাথরুম পায়খানা। তিনঘরের বারান্দায় একজন বৃদ্ধ বসে হুঁকো খাচ্ছিলেন। আরতি তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে প্রস্তাবটা রাখল।
বৃদ্ধ একবার দীপাকে আর একবার রাধার মুখের দিকে তাকালেন। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আর কেউ সঙ্গে থাকব না?’
রাধা বলল, ‘না। ও হস্টেলে থাকে। ছুটির সময় একমাস এখানে থাকতে চায়।’
‘একমাসের জন্যে?’ বৃদ্ধ তামাক খেতে খেতে প্রশ্ন করলেন।
‘হ্যাঁ’ বাবা মাথা নাড়ল।
‘ভাড়াটা অগ্রিম দিতে হইব। আমার আর ঝামেলা ভাল লাগে না।’
এবার দীপা বলল, ‘আমি রাধার হাতে কাল পাঠিয়ে দেব।’
‘কী মুশকিল। আগে তো ঘর দ্যাখবা, পছন্দ হইলে তবে তো এসব কথা—।’
আরতি তাদের নিয়ে এল উলটোদিকের একঘরের বাড়িতে। আসতে আসতে বলল, ‘এই ঘর প্রথম হইছিল। আমরা সবাই তখন একসঙ্গে থাকতাম।’ সে ভেজানো দরজার শেকল খুলে ভেতরে ঢুকে জানলায় হাত দিল। মাঝারি সাইজের ঘর। জানলা খুলতেই হাওয়া এল। একটা তক্তাপোশ আর টেবিল চেযার ছাড়া ঘরে কোনও সম্পত্তি নেই। জানলার ওপারে বাখারির বেড়া, বেড়ার ওপরে আকাশ। এই ঘরটা তার একার হবে। আরতি বলল, ‘তুমি কি রান্না করবা এখানে? তাইলে বারান্দায় করতে হবে। রান্নাঘর তা এখন নাই। আর স্টোভে করলে ঘরের ভেতর করতে পারবা। অনেক জায়গা আছে।’
ঘর পছন্দ হল দীপার। এখানে একদম নিজের মতো থাকা যাবে। একমাত্র ঝামেলা রান্নাবান্না করা। অঞ্জলি বা মনোরমা তাকে কখনও রান্না শেখাতে চাননি। কিন্তু ভাত ডাল সেদ্ধর ধারণা যে-কোনও বাঙালি মেয়েরই থাকে। কিন্তু সে রাঁধবে কীসে? তার তো কোনও সরঞ্জমই নেই। এটা নিয়ে অবশ্য চিন্তা করার সময় পাওয়া যাবে। সে বাইরে বেরিয়ে এসে বৃদ্ধকে জানাল, ‘আমার পছন্দ হয়েছে। আমি কালই টাকা পাঠিয়ে দেব।’
‘কবে থেকে আসবা?’
দীপা তারিখটা বলল। বৃদ্ধ মাথা নাড়লেন, ‘ভাঙা মাস। এ-মাসের ভাড়া আর্ধেক, সামনের মাসে পুরা। একটা নিয়ম যখন আছে তখন তো মানতেই হইব।’
আরতি রাধা আর সে ফিরে এল রাধাদের বাড়িতে। সেখানে তখন জলখাবার তৈরি। মুড়ি নারকোল আর চা। খেতে খেতে দীপার মনে হল মায়াদের বাড়ির পরিবেশের সঙ্গে রাধাদের বাড়ির কত পার্থক্য। মায়ার মা অবশ্যই আন্তরিক। কিন্তু প্রথমদিনেই মনে হচ্ছে এখানে সে বাইরের লোক নয়। খাওয়া শেষ হতে রাধার মা বললেন, ‘শোনো, তোমরা এখন গল্প করো। তুমি এখানে ভাত খাইয়া তবে যাইবা।’
‘ভাত। অসম্ভব!’ চেঁচিয়ে উঠল দীপা।
‘মানে? তুমি ভাত খাও না?’
‘খাই। কিন্তু এখন। এই বিকেলে!’
‘এখন কেন? সন্ধ্যার পর খাইবা।’
‘অসম্ভব। তখন খেয়ে আমি আর হস্টেলে ফিরতে পারব না।’
‘ঠিক পারবা। প্রথম দিন এখানে আইয়া ভাত না খাইয়া যাইবা? হয় নাকি?’
দীপা কাতর চোখে রাধার দিকে তাকাল। রাধা হাসল, ‘মা, সত্যি ওর খুব অসুবিধা হইব। হস্টেলের তো নিয়ম আছে। যখন তখন ঢোকা যায় না। ও তো এখানে আসতেছে, তখন একদিন ভাল করে ভাত খাওয়াইও।’
ভদ্রমহিলার মন ভাল হল না। চলে আসার সময় দীপাকে জড়িয়ে ধরে রাস্তা পর্যন্ত এলেন, ‘তোমাদের দেইখ্যা আমার খুব গর্ব হয়। আমার তো বিয়া হইছিল পোলাপান বয়সে। পড়াশুনা কী জিনিস জানি না। স্বামী সংসার কইর্যা বুড়া হইলাম। একা একা আজ পর্যন্ত কোথাও যাইতে পারি নাই। এখন তো আরও না, ভয় লাগে।’
দীপার মন খুব ভাল হয়ে গেল।
অনেক অনেক দিন বাদে এইভাবে কেউ স্নেহ দিয়ে পৃথিবী আড়াল করল। রাধার সঙ্গে স্টেশনের দিকে যাওয়ার সময় তার মনে হল এখানে এসে সে ভাল থাকবে। রাধা বলল, ‘মা ওইরকমই। কেউ এলে তাকে ভাত খাওয়াতে না পারলে ভাবে কিছুই করা হল না। অথচ এইজন্যে মাঝে মাঝে খুব বিপাকে পড়তে হয়। অভ্যেস যাবে কোথায়!’
‘কেন? বিপাক কেন?’
‘ধরো, আজ যদি তুমি খেতে রাজি হতে তা হলে ভাত ডাল পেঁয়াজের বড়া আর চিংড়ি মাছের বাটিচচ্চড়ি ছাড়া মা কিছু দিতে পারত না। এই দিয়ে কোনও নতুন মানুষকে খাওয়ানো যায়?’
দীপার মনে হল ভদ্রমহিলাকে সে যতটা ভাল ভেবেছিল তার চেয়েও ভাল। সে বলল, ‘আমার যদি হস্টেলের ব্যাপারটা না থাকত তা হলে ওই খাবার খেয়ে যেতাম খুশি হয়ে।’
ভ্রূ কুঁচকে দীপাকে একবার দেখে রাধা বলল, ‘তুমি তা হলে আলাদা।’
রাত্রে নিজের বিছানায় শুয়ে দীপা এলোমেলো ভাবছিল। বাঙালদের ওপর মনোরমা বা অমরনাথ কোনওদিনই তুষ্ট ছিলেন না। মনোরমার সুযোগ ছিল না কিন্তু মনে হয় অমরনাথ ওঁদের সঙ্গে মেশেননি। এই উত্তাপ সে কোনও পশ্চিমবঙ্গের মানুষের কাছে গিয়ে পায়নি। আবার সত্যসাধন মাস্টারের মুখ মনে পড়ল। ওই মানুষটির শরীরের ঘেমো গন্ধ ছাপিয়ে আন্তরিকতা এইভাবেই ঝরে পড়ত।
এখন সে একা ঘর ভাড়া নিয়ে কলকাতায় থাকবে! ভাবা যায়! দু’বছর আগে সে ভাবতে পারত। বেঁচে থাকলে অমরনাথ হতভম্ব হয়ে যেতেন। একটা মানুষের খেতে কত খরচ হয়? হিসেবটা কষতে পারল না দীপা। যদি ঘরভাড়া আর খাওয়ার খরচ হস্টেলের দক্ষিণার চেয়ে কম বা সমান হয় তা হলে এক মাসের বদলে অনেকদিন সেখানে থাকতে পারে। তার এখন পয়সা জমানো দরকার। বেশি খরচ করার কোনও সুযোগই তো নেই। কিন্তু জায়গাটা অনেক দূর। রাধার অভ্যেস হয়ে গিয়েছে, সে কি পারবে! আজ সন্ধের পর ট্রেনে উঠে সে বেশ অস্বস্তিতে ছিল। একগাদা লোক সমানে তাকে লক্ষ করে গেছে, ট্রেনের কামরায় দ্বিতীয় কোনও মেয়ে ছিল না। শিয়ালদা স্টেশনে নেমে বাস ধরার জন্যে যখন হাঁটছিল তখন তিনটে লোক পাল্লা দিয়ে তাকে অনুসরণ করেছে। দিনেরবেলায় যে-রাস্তায় সহজ হয়ে হাঁটা যায় রাত্রে তার চেহারা পালটে যায়। ঠিক হল না, রাস্তার মানুষগুলোর আচরণ বদলে যায়। অথচ এরা। কারও দাদা বাবা অথবা ছেলে। রাস্তায় একটা মেয়েকে দেখলে এরা জন্তুর মতো আচরণ করে কেন?
লাবণ্যকে পড়িয়ে উঠে আসার সময় ওর দিদিমা আজ দীপাকে খুব অবাক করে দিলেন। দীপা বলল, ‘একী করছেন আপনি?’
‘না বললে শুনব না। এটুকু নিতেই হবে নইলে মনে খুব কষ্ট পাব।’
‘কিন্তু আমি তো অনেক কম টাকা চেয়েছি।’
‘এটা এমন কিছু বেশি নয়। আসলে নাতনিকে এত যত্ন নিয়ে পড়াতে দেখে আমার প্রাণ ভরে গিয়েছে। এর কম দিলে অবিচার হবে। না বললে শুনছি না।’
অতএব টাকাগুলো নিতে হল দীপাকে। নোটগুলোর চেহারা এবং সংখ্যা দেখে সে অনুমান করছিল লাবণ্যর দিদিমা ভুল করছেন। না গুনেই ব্যাগের ভেতর রেখে দিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসতে আসতে মনে হয়েছিল যোগ্যতার থেকে বেশি সম্মান পেল আজ। যেন অনেক বড় মাপের পোশাক ছোট শরীরে পরিয়ে দেওয়া হয়েছে। কেন? কোনও মধ্যবিত্ত বাঙালির বাড়িতে গেলে তিনি কি এত টাকা দিতেন?’
বিডন স্ট্রিটে পৌঁছে কিন্তু আর এক ধরনের স্বস্তি হল। এই টাকায় তার বাড়িভাড়া, খাওয়াদাওয়া মায় কলেজের মাইনের অনেকটাই মেটানো যাবে। ব্যাঙ্কের টাকা খুব সামান্য তুলতে হবে এই টাকা নিয়মিত পেলে। সেক্ষেত্রে এখনই কোনও আর্থিক বিপদে পড়তে হচ্ছে না। রাধার জন্যে এমনটা হল। ও যে কী উপকার করল তা নিজেও জানে না।
‘এই যে ম্যাডাম! এখানে, এই সময়ে?’
গাঁক গাঁক করে গলাটা এত জোরে বেজে উঠল যে চমকে উঠেছিল দীপা। এমনকী রাস্তার লোকগুলোও। পাজামা পাঞ্জাবি যথেষ্ট কোঁচকানো, চুল উসকোখুসকো, কাঁধে ঝুলে থাকা কাপড়ের ব্যাগ থেকে কাগজ উঁকি মারছে, শমিত হাসিমুখে এগিয়ে এল, ‘ভূত দেখলে নাকি?’
সে একা নয়, রাস্তার লোকজনও ঘাড় ঘুরিয়ে দেখছে, কেউ কেউ দাঁড়িয়ে পড়েছে। শমিত সে-সবের তোয়াক্কা না করে একই গলায় বলল, ‘বাকশক্তি রহিত হয়ে গেছে যে!’
দীপা বলল, ‘আপনি নিচু গলায় কথা বলতে পারেন না?’
আবার শব্দ করে হাসল শমিত, ‘বেস ভয়েসে ওই ফুটপাথ থেকে তোমাকে ডাকলে তুমি শুনতে পেতে? আমি কি শম্ভু মিত্র যে ফিসফিসিয়ে বললেও লাস্ট রো-এর দর্শক প্রতিটি শব্দ বুঝতে পারবে? তার জন্যে প্রতিভা দরকার।’
‘আজ রিহার্সাল নেই?’
‘নাঃ। সন্ধেটা একদম ফাঁকা লাগছে। যে-ঘোড়ার গলায় একবার লাগাম উঠেছে সে যদি টান অনুভব করে তা হলে কী অনুভূতি হয় বুঝতে পারছি!’
‘হল না।’ দীপা হাসল, বলা উচিত ছিল, যে-পাখির ডানা গজিয়েছে তাকে আকাশে উড়তে না দিয়ে বাসায় বসে থাকতে বললে কী হয়—!’
হো হো করে হেসে উঠল শমিত দীপাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে, ‘ওয়েল সেইড। আচ্ছা, এই লাগামের কথাটা বারবার মনে পড়ে কেন বলো তো। শালা, গোলামের জাতে জন্মেছি বলে আকাশের টাকাশের কথা চট করে মাথায় আসে না।’
‘গোলামের জাত!’
‘দুশো বছর ব্রিটিশের, তার আগে মোগলদের, তার আগে, নাঃ, তার আগে বাঙালির কোনও ইতিহাস নেই। চা খাবে?’
‘চা?’ দীপা আপত্তি করতে যাচ্ছিল। ঘণ্টাখানেক আগে লাবণ্যদের বাড়িতে নিয়মিত জলখাবারে তার পেট ভরে গিয়েছে। কিন্তু শমিত যেন উত্তরের জন্যে অপেক্ষা করতে জানে না, ‘হস্টেলের খুকিদের জন্যে গেট কখন বন্ধ হয়।’
‘খুকি! এটা কিন্তু বাড়াবাড়ি হল। এখনও দেরি আছে!’
‘তা হলে বসন্তে চলল। হেভি খিদে লেগেছে।’ হাঁটতে শুরু করল শমিত। হাঁটতে হাঁটতেই জিজ্ঞাসা করল, ‘কী করছিলে এদিকে?’
‘ছাত্রীকে পড়াতে গিয়েছিলাম।’
‘অ্যাঁ! হস্টেলের মেয়ে নর্থ ক্যালকাটার মেয়ে টিউশনি করে নাকি!’
‘পেটে টান পড়লে করে। আপনার পড়েনি বলে নাটক করছেন।’
হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল শমিত, ‘আমার পড়েছে কিনা জানো?’
‘তা হলে আপনিও রোজগারে বেরুতেন।’
‘আমি বেরিয়েছি কিনা সে খবর রাখো?’
‘না।’ থতমত হয়ে গেল দীপা।
‘তা হলে না জেনে মন্তব্য করবে না। এটা তোমার দোষ নয়, বাঙালি জাতটার এটা একটা জন্মগত অভ্যেস। নিজের মনে যা আসে তাকেই সত্যি বলে ভেবে নেয়।’
বসন্ত কেবিনে সন্ধের পরে মেয়েরা ঢোকে না। তখন সেখানে ছাত্র নয়, বয়স্কদের জমাটি আড্ডা। তাঁরা মুখ ঘুরিয়ে এদের দেখলেন। কোনার এক খালি টেবিলের দিকে যেতে যেতে শমিত উঁচু গলায় বলল, ‘গৌরাঙ্গ, দুটো ডাবল হাফ আর চারটে টোস্ট।’ চেয়ারে বসে শমিত হাসল, ‘একমাত্র এখানেই সন্ধের পরে টোস্ট পাওয়া যায়।’
‘বললেন প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে—।’
‘টোস্টেই হয়ে যাবে।’
‘না হবে না। আমি একটু আগে পেট পুরে খেয়েছি। আপনি ভারী কিছু নিন।’
‘পাগল! পকেটে দুটো টাকা পড়ে আছে।’
‘আমি দেব। আজ জীবনের প্রথম রোজগার হল। টিউশনির টাকা পেয়েছি।’
‘আরে কী আশ্চর্য! এতক্ষণ বলোনি কেন! তা হলে এখানে ঢুকতাম না। অবশ্য বড় কোথায়ই বা যেতাম। অভ্যেস নেই।’
‘অর্ডারটা পালটে দিন। আপনার জন্যে রুটি মাংস বলুন।’
‘সত্যি খাওয়াবে? চমৎকার! বেঁচে থাকুন শরৎচন্দ্র। বাঙালি মেয়ের ছবি যা এঁকে গিয়েছেন ভদ্রলোক, যতই ব্যাকডেটেড বলি ঠিক জিতে যাচ্ছেন। গৌরাঙ্গ?’
‘আপনার পকেটে টাকা থাকলে আমাকে খাওয়াতেন না?’
‘ভাবতাম। চা টোস্টের ওপরে উঠতাম কিনা সন্দেহ। খোঁচা লেগেছে নাকি?’
‘স্বাভাবিক। আমি আপনাকে পাত পেতে বসিয়ে পাখার হাওয়া করতে করতে খাওয়াচ্ছি না। আর শরৎচন্দ্র যে-ছবি এঁকেছেন তা কোন ছেলের খারাপ লাগে বলুন তো!’ দীপা হাসল, ‘বউ যদি মায়ের কিছু গুণ পায় তবে ছেলেরা বর্তে যায়। যায় না?’
খাবার এল। বারংবার বলা সত্ত্বেও দীপা চা ছাড়া কিছু নিল না। নিঃশব্দে খাবার শেষ করল শমিত। সেটা দেখে দীপা জিজ্ঞাসা করল, ‘সত্যি কথা বলুন তো, শেষ কখন খেয়েছেন?’
গম্ভীর হতে গিয়েও হেসে ফেলল শমিত, ‘সকাল সাড়ে আটটায় দুটো রুটি খেয়ে বেরিয়েছিলাম। দশটায় স্কুলে ঢুকে সময় পাইনি। আমি বাগুইহাটিতে একটা স্কুলে ডেপুটেশন ভ্যাকান্সিতে ঢুকেছি। তারপর স্কুল থেকে বেরিয়ে সাহিত্য পরিষদ লাইব্রেরিতে গিয়েছিলাম একটা বই খোঁজ করতে। কখন সময় কেটে গিয়েছিল বুঝতে পারিনি।’
‘এখন কোথায় যাচ্ছিলেন? বাড়ি?’
‘নাঃ। সুজয়ের বাড়িতে। ও একটা নাটক লিখেছে, অ্যাডাপ্টেশন, ওটা নিয়ে অনেক আলোচনার আছে। বিদেশি নাটকের পরিবেশ মেজাজ সংলাপ আমাদের মাটির সঙ্গে খাপ খায় না। আক্ষরিক অনুবাদ একদম চলবে না। নাটকের যে-সমস্যা আমাদের ভাবাচ্ছে সেইরকম সমস্যা যদি এ-দেশের মানুষের জীবনেও থাকে, তা হলে শুধু থিমটাকে রেখে এ-দেশের জীবনের সঙ্গে সবকিছু সাজিয়ে নিতে হবে।’
‘সাজানো বলে মনে হবে না।’
‘সেটাই তো নির্ভর করছে এলেমের ওপর। ইবসনের ডলস হাউজ তাই ‘পুতুল খেলা’ হলেও একদম বিদেশি বলে মনে হয় না।’
‘আপনি কি শুধু নাটকই করবেন?’
‘শেষ নিশ্বাস ফেলা পর্যন্ত। বাঙালি লেখক পেয়েছে, অভিনেতা পেয়েছে, গায়ক পেয়েছে অনেক দেরিতে, বেঁচে বর্তে থাকতে হলে এইসব পাওয়াকে কাজে লাগাতে হবে। তুমি ভাবো, রবীন্দ্রনাথ গল্প উপন্যাস কবিতা লিখেও তৃপ্তি পাননি। শেষপর্যন্ত তাঁকে নাটক করতে হল, ছবি আঁকতে হল।’
‘পয়সাকড়ি?’
শমিত সোজা হয়ে বসল, ‘দুর মশাই! তোমাকে দেখে আমার মনে হয়েছিল তুমি শাড়ি গয়নাগাটির দলের মেয়ে নও।’
‘কেন এমন মনে হল?’
‘জানি না। ভুল তো মানুষেরই হয়।’ বলতে বলতে হঠাৎই মনে পড়ে গেল শমিতের। ‘মায়া বলছিল তুমি আই এ এস দেবে।’
‘হঠাৎ এ-কথা কেন?’
‘বোনাফায়েড গোলাম হতে চাইছ কেন?’
‘মানে!’
‘গলায় হিরের বকলশ পরার এই ইচ্ছে কেন হল?’
‘বকালশ পরতে হলে সেটা হিরের হলে ভাল হয় না?’
‘চমৎকার! আই এ এস হয়ে সরকার যেমন চাইবে তেমন করবে। মানুষ খেতে না পেয়ে মিছিল করলে তুমি পুলিশকে বলবে গুলি চালাতে। নিজের সবরকম মনুষ্যত্ব বিবেক শিকেয় তুলে যারা ক্ষমতায় আসবে তার পুতুল হয়ে নাচবে!’
‘আপনি কমিউনিস্ট?’
‘পাগল! সে-যোগ্যতা আমার আছে! আমি যদি মরার আগে একটা মানুষ হতে পারি, একটা গোটা মানুষ, তা হলে খুশি হব।’
‘গোটা মানুষ!’
‘হ্যাঁ।’
‘কিন্তু আমি ওপরে উঠতে চাই। যেখানে উঠলে পুরুষ জাতটা মেয়ে বলে আমাকে অবহেলা করবে না। যেখানে আমি মাথা উঁচু করে থাকব?’
‘আই এ এস হয়ে। ফুঃ। খেতে না পাওয়া মানুষগুলোর সামনে তুমি দৈত্য হবে আর যে-দল ক্ষমতায় থাকবে তার চুনোপুঁটিরা যখন ধমকাবে তখন তোমাকে কেঁচোর মতো নুইয়ে পড়তে হবে। সেটা খেয়াল আছে। নিজের কাছে কী জবাব দেবে মেমসাহেব?’ মুখ বিকৃত করল শমিত, ‘যে-মেয়ে টিউশনি করে নিজের খরচ চালায় তার কি ব্যুরোক্রাট হওয়া মানায়?’
থমথমে হয়ে গেল দীপার মুখ। শমিতের কথাগুলোর জবাব সে দিতে পারছে না। অথচ কথাগুলো মানতে মোটেই ইচ্ছে করছে না। দাম মিটিয়ে দেওয়ামাত্র শমিত বলল; ‘বহুত দেরি হয়ে গিয়েছে। এবার। উঠতে হবে।’
দীপা বলল, “দেশের সেরা ছেলেমেয়েরা আই এ এস হয় দেশকে ভাল করে সেবা করার জন্যে। এটা বলছেন না কেন?’
‘বিশাল কোয়ার্টার্স, বিরাট লন, গেটে পাহারাদার নিয়ে জনসাধারণের থেকে তিন মাইল তফাতে থেকে দেশসেবা! পাগলা সাপে কামড়েছে!’ শমিত বাইরে পা বাড়াল। দীপা অনুসরণ করল তাকে।
খোলা আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে শমিত বলল, ‘চমৎকার খেলাম। সবাইকে বলতে হবে। কিন্তু দীপা, তুমি একটু ভাবো তো। মানুষ হিসেবে অন্য কিছু তুমি করতে পারো কিনা। কোথায় যেন পড়েছিলাম, মানুষ যত ক্ষমতার সিঁড়ি ভেঙে ওপরে ওঠে তত সে বন্ধুহীন হয়ে পড়ে। তুমি তাই হতে চাও? চলি।’ কথা বলার অবকাশ না দিয়ে হনহনিয়ে চলে গেল শমিত।
হস্টেলের দিকে হাঁটতে হাঁটতে দীপা কেঁপে উঠল। কীসে মানায় তাকে? কীসে? শমিত কেন ঝড়ের মতো এসে তার সবকিছু এমনভাবে নাড়িয়ে দিল?
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন