সমরেশ মজুমদার
সত্যসাধন মাস্টার প্রতি সন্ধ্যায় দীপাকে পড়াতে আসবেন। মাসান্তে তাঁকে দশ টাকা দিতে হবে ব্যাপারটা মনোরমার পছন্দ হয়নি। তাঁর স্মরণে পড়ে না কখনও পরিবারের কাউকে পড়ানোর জন্যে মাস্টার এসেছে কিনা। এমনকী অমরনাথের ছাত্রাবস্থায়ও মাস্টারের প্রয়োজন হয়নি। ব্যাপারটা তিনি সরাসরি অঞ্জলিকে জানিয়েছিলেন। যে-মেয়ে পনেরোতে পড়তেই গোত্রান্তরিত হবে তাকে মাস্টার রেখে বিদ্যাধরী করে লাভ কী! ওই টাকা প্রতি মাসে জমিয়ে রাখলে বিয়ের সময় কাজে দেবে। মনোরমা না বলে পারলেন না, ‘তা ছাড়া তোমরা একটু বাড়াবাড়ি করছ বউমা।’
অঞ্জলি ঠোঁট টিপে বসে ছিল। দশ টাকা খরচ করতে তার সত্যি গায়ে লেগেছিল। কিন্তু তার কমে যেসব মাস্টার পাওয়া যায় তারা সবাই ছেলেছোকবা। সত্যসাধনের নাম আছে পড়ানোতে। কয়েকটা খরচ কমাতে হবে। আসাম রোড থেকে মাছমারাদের হুটহাট ডাকা যাবে না। কিন্তু পড়াশুনায় মাথা আছে মেয়েটার, সত্যসাধন ওর সম্পর্কে খুব আশাবাদী, যেটুকু করা যায়। সেটুকু না করলে মনে খচখচে কাঁটা ফুটেই থাকবে। যদিও রমলা সেন মেয়েটাকে যেমন কথা বলে গিয়েছেন তা শোনার পর—! অঞ্জলি মুখ নিচু করল।
ওরা বসে ছিল বারান্দায়। একটু আগে দুপুরের খাওয়া সেরে বিশ্রাম নিয়ে অমরনাথ ফিরে গিয়েছেন কাজে। দীপার ফেরার সময় হয়নি স্কুল থেকে। ছোট দুটোকে নিয়ে ওর ফিরতে এখনও ঘণ্টাখানেক দেরি। অবশ্য বুধুয়া যায় ওদের আনতে। আর এই নিয়ে দীপার সঙ্গে বুধুয়ার নিত্য লেগে আছে। এই সময়টায় অঞ্জলি মনোরমার সঙ্গে বারান্দায় বসে আসাম রোডের গাড়ি যাওয়া আসা দ্যাখে। মনোরমা বললেন, ‘অনেকদিন বাদে লক্ষ্মী আসছে। ভেতর থেকে দুটো মোড়া নিয়ে এসো।’
অঞ্জলি দেখা কদম গাছের পাশ কাটিয়ে পরিষ্কার সাদা শাড়ির ঘোমটা মাথায় তুলে আসছেন লক্ষ্মীবউদি। খুব ঠান্ডা মানুষ। পঞ্চাশ পেরিয়েছেন কিন্তু অসুখবিসুখে বয়স আরও বেশি দেখায়। লক্ষ্মীবউদি একা নন। বাগানের কোয়ার্টার্সগুলোতেও তিনি একা যাওয়া আসা করেন না। সম্ভবত আসবার সময় ছোট পাতিবাবুর স্ত্রী বীণাবউদিকে ডেকে নিয়েছেন। বীণাবউদিরও বয়স হয়েছে, শরীর ভারী, একটু বেশি কথা বলেন। অঞ্জলি ভেতর থেকে দুটো মোড়া তুলে নিয়ে আসতে আসতে শুনল মনোরমা বলছেন, ‘কেমন আছ লক্ষ্মী, এতদিনে একটু সময় পেলে?’
লক্ষ্মীবউদি হাসলেন, জবাব দিলেন না। বীণাবউদি বললেন, ‘তা মাসিমা, আমরা তো সংসারে বিনিপয়সার ঝি, খাটতে খাটতে চোখে ধুতরো ফুল দেখছি, পান থেকে চুন খসল তো চোখ রাঙানি, আপনার তো ঝাড়া হাত পা, আপনি তো যেতে পারেন।‘
অঞ্জলি হেসে ফেলল। মোড়া এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘বসুন। মা অবশ্য গতকাল গিয়েছিলেন বড়বাবুর বাড়িতে ঠাকুর গড়া দেখতে।’
বীণাবউদি বললেন, ‘ওমা! ঠাকুরের গায়ে তো এখন ভাল করে দড়ি বাঁধাই হয়নি। তা অতটা দূর যখন যেতে পারলেন তখন আর একটু এগিয়ে আমাদের বাড়িতে যেতে কী অসুবিধে ছিল? বিজয়ার পরেও তো যাননি।’
‘বিজয়ার পরে কি তোমরাও এসেছ? লক্ষ্মীপুজো পেরিয়ে যেতেও না।’ মনোরমা বললেন।
লক্ষ্মীবউদি আঁচল টেনে বসলেন, ‘আপনি এখন কেমন আছেন মাসিমা?’
‘আছি।’ মনোরমা হাসলেন।
‘অঞ্জলি বলল, ‘গতকাল যদি আপনারা মায়ের মুখ দেখতেন!’
বীণাবউদি অবাক হল, কেন, কী হয়েছিল আপনার?’
অঞ্জলি বলল, ‘আহা, আমার কাছে শুনুন না। আমরা তো গিয়েছি ঠাকুর গড়া দেখতে। তা বড়বাবুর বাবা গেঞ্জি আর লুঙ্গি পরে বসে ছিলেন। দেখামাত্র ধড়মড় করে উঠে পাঞ্জাবি চাপিয়ে ফিরে বকর বকর আরম্ভ করলেন। আমি ওঁকে এড়াতে ভেতরে গেলাম ছোট লক্ষ্মীদির সঙ্গে কথা বলতে। গিয়ে দেখি তিনি কলঘরে। কী আর করি! ফিরে আসছি, ভেতর থেকেই শুনলাম বড়বাবুর বাবা মাকে বলছেন—’ মুখে আঁচল দিয়ে হেসে গড়িয়ে পড়ল অঞ্জলি।
মনোরমা ধমকে উঠলেন, ‘আঃ বউমা, বুড়োমানুষকে নিয়ে মশকরা করা ঠিক নয়।’
অঞ্জলি হাসতে হাসতেই বলল, ‘না মা, উনি বুড়োমানুষের মতো কথা বলেননি।’
বীণাবউদির আর তর সইছিল না, ‘বলো না অঞ্জলি কী বলছিল বুড়ো?’
অঞ্জলি বলল, ‘হরিদ্বারে যাওয়ার বাসনা হয়েছে, কিন্তু একা যান কী করে, তাই মাকে সাধছেন সঙ্গে যেতে। মায়েরও তো কোথাও যাওয়া হয় না।’
বীণাবউদি উঁচু গলায় এমন হেসে উঠলেন যে সামনের মাঠে ঘাস খেতে খেতে একটা গোরু মুখ তুলে তাকাল। লক্ষ্মীবউদি নরমগলায় বললেন, ‘হয়তো সরল মনেই বলেছেন।’
‘সরল মন?’ বীণাবউদি হাসি থামালেন, ‘নাম যাঁর তেজেন্দ্র তাঁর স্বভাবে নরমভাব থাকবে কী করে! কাকিমা মারা যাওয়ার পর সেই তেজ সংবরণ করেছিলেন না তা অনেকেই জানে। আসলে পুরুষমানুষ চিতায় উঠলেও যদি চোখ মেলার সুযোগ পায় তবে সেটা মেলবে মেয়েমানুষের দিকে। একদম বিশ্বাস করবেন না মাসিমা!’
মনোরমা বললেন, ‘আমি তোমাদের চেয়ে অনেক আগে পৃথিবীতে এসেছি বীণা।’
হাসি মশকরা একটু যেন থিতিয়ে গেল। লক্ষ্মীবউদি আবার আঁচল টানলেন, ‘মাসিমা, আপনারা কী ভাবলেন? উনি দুপুরে যাওয়ার আগে বললেন আপনার সঙ্গে কথা বলতে।’
‘কী ব্যাপার বলো তো?’
‘বেয়াইমশাই আপনার ছেলের সঙ্গে যে-কথা বলেছিলেন— ।’
‘তোমার বেয়াই? কী প্রস্তাব? কই, আমি জানি না তো!’ মনোরমা অবাক হলেন।
লক্ষ্মীবউদি অঞ্জলির দিকে তাকালেন। অঞ্জলি বলল, ‘কাল রাত থেকে এত ঝামেলা গেল যে ও সময় পায়নি। রাত্রে ঘুমানোর সময় কীসব বলছিল যেন।’
মনোরমা বললেন, ‘কী বলছিল অমর?’
অঞ্জলি মাথা নাড়ল, ‘আমি ভাল করে শুনিনি।’
বীণাবউদি বললেন, ‘পুরুষমানুষের যা বলার তা ওরা রাতে শোওয়ার সময় বলে। তখন তো মন দিয়ে শুনতে হয়। তুমি কী গো!’
অঞ্জলি বলল, ‘ব্যাপারটা এমন যে আমি কান দিইনি।’
মনোরম বিরক্ত হলেন। লক্ষ্মীবউদির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী ব্যাপার বলো?’
লক্ষ্মীবউদি বললেন, ‘বেয়াইমশাই এসেছিলেন হঠাৎই। একটা রাত ছিলেন। অমন নামী মানুষ, আমি কী করব কী করব না এই ভয়েই মরি। তা উনি সকালে ওঁর সঙ্গে বসেছিলেন বাইরের বারান্দায়। সেইসময় দীপাকে দেখতে পান বিশুর সঙ্গে বাজারে যেতে।’
অঞ্জলি হাঁ হয়ে গেল, ‘দীপা আর বিশু বাজারে গিয়েছিল?’
মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললেন লক্ষ্মীবউদি। মনোরমা জিজ্ঞেস করলেন, ‘তারপর?’
‘দীপাকে দেখে খুব পছন্দ হয়েছে বেয়াইমশাইয়ের। উনি তখন শ্যামলকে দিয়ে আপনার ছেলেকে ডেকে পাঠালেন, বেয়াইমশাই তখন প্রস্তাবটা করেছিলেন। গতকাল সকালেই তো ব্যাপারটা হল।’
লক্ষ্মীবউদি আঁচল তুললেন আবার। বীণাবউদি বললেন, ‘ওমা! দীপার বিয়ের সম্বন্ধ এল? পাত্র কী করে, কোথায় থাকে?’
লক্ষ্মীবউদি হাসলেন, ‘আমার বেয়াইয়ের ভাই খুব অবস্থাপন্ন মানুষ। ব্যাবসা করেন। ওঁর স্ত্রীর ইচ্ছে অল্প বয়সে ছেলের বিয়ে দেন। বাড়িতে গৌরী আনেন। কিন্তু মেয়েকে হতে হবে খুব মিষ্টি দেখতে। তা বেয়াইমশাইয়ের নজর দীপার ওপর পড়তেই তিনি আপনার ছেলের সঙ্গে আলাপ করতে চাইলেন ওঁদের মধ্যে তো অনেকক্ষণ কথাবার্তা হয়েছিল।’
মনোরমা চিন্তিত মুখে বললেন, ‘সেকী কথা! অমর তো আমায় কিছু বলেনি।’
বীণাবউদি বললেন, ‘এ ভারী অন্যায় কথা। মেয়ের বিয়ে দিতে নাভিশ্বাস ওঠে। বাড়ি বয়ে সম্বন্ধ এল আর তাকে গুরুত্ব না দেওয়াটা ভাল কথা নয়। তা ছেলে করে কী?’
লক্ষ্মীবউদি বললেন, ‘শুনেছি এবার ফাইনাল দেবে। অত বড় ঘরের ছেলে, অগাধ বিষয়সম্পত্তি, সবই তো ছেলে পাবে, উনি বলছিলেন একেবারে হিরের টুকরো।’
মনোরমা গম্ভীর গলায় বললেন, ‘ঠিক আছে। আজ অমর আসুক, আমি ওর সঙ্গে কথা বলি আজকাল অবশ্য ওই বয়সে কেউ মেয়ের বিয়ে দেয় না। কিন্তু তেমন সম্বন্ধ এলে— !’
লক্ষ্মীবউদি বললেন, ‘আপনারা খোঁজখবর নিয়ে দেখুন। জলপাইগুড়িতে তো এ-বেলায় গিয়ে ও-বেলায় আসা যায়। তবে যা করবেন তাড়াতাড়ি করুন।’
বীণাবউদি বললেন, ‘পরের ঘরে তো একদিন যাবেই, আগে যদি ভালয় ভালয় যায় তো মন্দ কী। মেয়ের ওপর বেশি মায়া রাখতে নেই নইলে মালবাবুর মেয়ের দশা হবে।’
অঞ্জলির এসব কথা শুনতে মোটেই ভাল লাগছিল না। হঠাৎ মালবাবুর মেয়ের প্রসঙ্গ এসে পড়তেই সচকিত হল, ‘মালবাবুর মেয়ে? ললিতা?’
‘হ্যাঁ।’ বীণাবউদি মাথা নাড়লেন, ‘দেখলে মনে হয় দেবদারু গাছে নাক তুলে বসে আছেন। রোজ বিকেলে ফুলবিবিটি সেজে বারান্দায় বসে না থাকলে চলে না। এদিকে বেলা যে বয়ে যাচ্ছে। মেয়েছেলে সকালবেলায় বেশ ভাল কিন্তু বিয়ের আগেই যদি দুপুর আসে তা হলেই বিপদ।’
মনোরমা এক মুহূর্ত চিন্তা করলেন। শেষপর্যন্ত কথাটা বললেন, ‘লক্ষ্মী, তোমার শ্যামলের সঙ্গে ললিতা মেলামেশি করে?’
লক্ষ্মীবউদি আবার আঁচল টানলেন, ‘ওমা, এ-কথা বলছেন কেন?’
মনোরমা কথা ঘোরান, ‘আমি ভুল দেখতে পারি, একদিন যেন ওদের ওপাশের রাস্তা দিয়ে আসতে দেখেছিলাম। যদি তেমন কিছু হয় তা হলে হয় তোমরা দুঃখ পাবে নয় মেয়েটা কেঁদে মরবে। দ্যাখো বাবা, আমি ভুলও দেখতে পারি, এই কথাটা উঠল তাই বলে ফেললাম।’
লক্ষ্মীবউদি ঠোঁট কামড়ালেন। বীণাবউদি তাঁর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘না না শ্যামল সেরকম ছেলেই না। দিনরাত যারা খেলাধুলা নিয়ে থাকে তাদের মাথায় ওই বদমতলব আসার সময়ই হবে না। তুমি এ নিয়ে মন খারাপ কোরো না।’
লক্ষ্মীবউদি বললেন, ‘তেমন কিছু যদি করে বসে তা হলে উনি ছেলের মুখ আর দেখবেন না বাগানের চাকরিটাও যদি হয়ে যেত— ।’
অঞ্জলি খুব অবাক। শ্যামলের সঙ্গে ললিতাকে যদি মনোরমা দেখে থাকেন তা হলে কথাটা তিনি তাকে বলেননি কেন? এই বারান্দার বাইরে কদাচিৎই নামেন মনোরমা। ওরা নিশ্চয়ই এই অবধি সবাইকে দেখিয়ে আসবে না। মনোরমা কি প্রসঙ্গ থামানোর জন্যে বানিয়ে গল্পটা বললেন। তা যদি হয় তা হলে খুব খারাপ করেছেন। বীণাবউদি এখন যতই শান্ত মুখ করে থাকুন না, ওঁর কাছ থেকেই গল্পটা ছড়াবে। শাশুড়ির এই স্বভাবটা অঞ্জলি কখনই মানতে পারে না। অনেকসময় স্রেফ অনুমানের ওপর নির্ভর করে এমনভাবে কথা বলেন যেন তিনি নিজের চোখে দেখেছেন। হয়তো ঘটনাটা বাস্তবে ঘটেইনি। সে বলল, ‘শ্যামল ওরকম ছেলেই নয়। মা নিশ্চয়ই ঠিক দ্যাখেননি।’
এরপর কথা আর বেশি গড়াল না। সেইসময় বুধুয়াকে দেখা গেল দু’জনকে সামলাতে সামলাতে আসাম রোড থেকে বাড়ির দিকে আসছে। দু’জনই সমানে দৌড়াচ্ছে, বুধুয়ার নিষেধ কানেই নিচ্ছে না বীণাবউদি বললেন, ‘নাও, তোমার গৌর-নিতাই বাড়ি ফিরল। সে কোথায়?’
যার কথা বলা হল সে উদয় হচ্ছে না তখনও। বীণাবউদি বললেন, ‘আর একটা কথা। দীপা এখনও বাচ্চা কিন্ত আর ক’দিন বাদেই তো ঠিক বাচ্চা থাকবে না। বিশু খোকনদের সঙ্গে যেভাবে মেশামেশি করে তা ঠিক নয়। এইবার একটু রাশ টানো। সংসারের কাজকর্ম শেখাও। একেই চা-বাগানে থাকি বলে শহরের লোকজন আমাদের গেঁয়ো বলে ভাবে।’
বুধুয়া এসে পড়েছিল। বাচ্চাদুটো হইহই করে ভেতরে ঢুকে গেল। অঞ্জলি বুধুয়াকে জিজ্ঞাসা করল, ‘দিদি কোথায়?’
বুধুয়া মাথা নাড়ল, ‘ছুটি নেহি হুয়া। মাস্টারজি সাজা দিয়েছে।’
‘সাজা দিয়েছে? কেন?’ প্রশ্নটা মনোরমার।
‘হামি জানি না।’ বুধুয়া লাল দাঁত বের করে হাসল।
‘যা গোরুগুলোকে ঘাস দে।’ অঞ্জলি ওকে ভেতরে পাঠিয়ে দিল। এরপরে কিছুক্ষণ কী কারণে দীপা সাজা পেতে পারে সেই বিষয়ে আলোচনা চলল। দুই ছেলেকে খাবার দিতে হবে এই অজুহাতে অঞ্জলি ভেতরে চলে এল। দু’জনের হাত পায়ের ধুলো পরিষ্কার করিয়ে দুধ-মুড়ির বাটি হাতে ধরিয়ে দিয়ে অনর্গল প্রশ্ন করেও নতুন কোনও তথ্য দীপা সম্পর্কে আবিষ্কার করতে পারল না অঞ্জলি। মেজাজটা খুব চড়ে গিয়েছিল। সামান্য বাঁদরামি করতে গিয়ে বড়টা বেদম মার খেল। দু’জনকেই ভেতরের উঠোনের বাইরে খেলতে যেতে নিষেধ করে সে আবার বাইরের বারান্দায় এসে দেখল একা মনোরমা চুপচাপ বসে আছেন। অঞ্জলি দুটো মোড়া ভেতরে ঢুকিয়ে শাশুড়ির পাশে এসে বসল, ‘ওরকম বানিয়ে বানিয়ে শ্যামলদের কথা বলা উচিত হয়নি মা।’
‘বানিয়ে বানিয়ে?’ মনোরমা মুখ না-ফিরিয়ে বললেন, ‘আমি সত্যি বলেছি এটা ভাবছ না কেন? হ্যাঁ, এটা বলতে পারো আমি নিজের চোখে দেখিনি। তাই বলে ঘটনাটা মিথ্যে হয়ে যেতে পারে না। লক্ষ্মীকে সতর্ক করে দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেছি।’
‘কিন্তু আপনাকে কে বলল কথাটা?’
‘দীপা।’
‘দীপা?’ অঞ্জলি হতভম্ব, ‘কবে বলেছে আপনাকে?’
‘গতকাল। ওরা নদীতে মাছ ধরতে গিয়েছিল। সেই বাগানের ভেতর দিয়ে ফরেস্টের পাশে। হাতি দেখে ভয় পেয়ে ফিরে আসছিল এমন সময় শ্যামল আর ললিতার গলা চা-বাগানের ভেতরে শুনতে পায়।’ মনোরমা মুখ ফেরালেন।
‘চা-বাগানের ভেতরে? সেখানে ওরা কী করছিল?’ অঞ্জলি যেন নিজেকেই প্রশ্ন করল।
মনোরমা উত্তর দিলেন না। আর তার ফলে উত্তরটা পেয়ে গেল অঞ্জলি। তার দুই কান আচমকা গরম হয়ে উঠল। সে বলল, ‘দীপা কি ওদের কথাবার্তা শুনেছে?’
‘হ্যাঁ।’ মনোরমা গম্ভীর গলায় বললেন।
‘কী বলেছিল ওরা দীপা আপনাকে বলেছে?’
‘হ্যাঁ। কথাগুলোর অর্থ দীপা পরিষ্কার বুঝতে পারেনি। তবে অনুমান করেছে ওগুলো বলা ঠিক নয়। বউমা, শ্যামল আর ললিতা শারীরিক সম্পর্কের কথা বলছিল। ললিতা আপত্তি করেছিল। তোমার মেয়ে এসব এখনও বোঝে না। তবে আর বেশিদিন ওকে তো না বুঝিয়ে রাখতে পারবে না। লক্ষ্মীকে এত কথা বলা উচিত নয়। সে আরও ভেঙে পড়বে। তবে বিশুরা যদি বাড়িতে এসব আলোচনা করে তা হলে খবরটা আর চাপা থাকবে না। মালবাবুরও জানা উচিত। নইলে বিপদ আসতে বাধ্য।’
‘অন্যের ব্যাপারে আমাদের নাক গলিয়ে কী লাভ?’
‘অন্যের ব্যাপার? এই চা-বাগানের কয়েকটা পরিবার সুখে-দুঃখে একসঙ্গে আছি, অন্যের বিপদে যদি পাশে গিয়ে না দাঁড়াই তা হলে কি চলে!’
‘দেখুন, এই নিয়ে আবার বদনাম না রটে।’
‘তুমি বাপু বড্ড ভাবছ! কিন্তু মেয়েটাকে সাজা দিচ্ছে কেন? তুমি একবার যাবে?’
‘আমি যাব কেন?’ অঞ্জলির গলায় রাগ স্পষ্ট, ‘নিশ্চয়ই অন্যায় করেছে তাই শাস্তি পাচ্ছে। আসুক বাড়িতে আজ।’
মনোরমা বললেন, ‘ভাল করে জিজ্ঞাসা না করে মারধর কোরো না।’
অঞ্জলি নিশ্বাস ফেলল। তার কেবলই মনে হতে লাগল দীপা তাকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। নইলে চা-বাগানের ভেতরে যে-কাণ্ডটা ঘটল তা মনোরমাকে বলতে পারল, তাকে নয়। ওইটুকুনি মেয়ে একেবারে ঠোঁট টিপে রইল তার কাছে! অদ্ভুত। নির্জন চা-গাছের ভেতর বসে শ্যামল কী কথা বলতে পারে ললিতাকে? অঞ্জলির খুব রাগ হচ্ছিল। যে যাই বলুক তোর সে কথা শোনার কী দরকার? আবার ঘটা করে ঠাকুমাকে বলা হয়েছে। নিশ্চয়ই রাত্রে শোওয়ার সময় পুটুর পুটুর করে এইসব গল্প করা হয়। আর এনাকেও বলিহারি, নাতনির সঙ্গে এসব কথা আলোচনা করতে একটু বাধে না। নাতনি বলল আর উনি হজম করে গেলেন। বাইরের লোকের সামনে তাকে কীরকম বেইজ্জত হতে হল। হঠাৎ অঞ্জলির জেদ চেপে গেল। প্রাইভেট টিউটর রাখার দরকার নেই। পাত্র যদি ভাল হয় এই বয়সেই ওই মেয়েকে বিদায় করে দেওয়া ভাল। একবার যখন কানে গিয়েছে কথাগুলো তখন উনিই কখন চা-বাগানের ভেতর কোনও ছেলের সঙ্গে ঢুকে ওসব যে আওড়াবেন না তার ঠিক কী!
অঞ্জলি বলল, ‘লক্ষ্মীবউদির কথাটা নিয়ে কিছু ভাবলেন?’
মনোরমা বললেন, ‘ওরা প্রস্তাব দিয়েছে, অমর কী চিন্তা করছে সেটা আগে জানি।’ অঞ্জলি মুখ ফেরাল, ‘আপনার ছেলের এসব নিয়ে চিন্তা করার সময় আছে?’
মনোরমা বললেন, ‘তুমি তো নিশ্চয়ই আপত্তি করবে। মেয়েকে পড়াশুনা করানোর দাবি তোমার। লোকে শুনলেও বলবে সাততাড়াতাড়ি দায় নামাল কাঁধ থেকে। কিন্তু আমি বলি বউমা, যদি পরিবার ভাল হয় তা হলে বিয়েটা দিয়ে দেওয়াই ভাল। আজকাল চাবপাশে যা অবস্থা দেখছি—! মেয়ের শরীরে যৌবন এলে পাঁচজনের চোখের আড়াল রাখতে হিমসিম খেতে হয়। আর পড়াশুনার কথা যদি বলো, তা হলে কথাবার্তা বলে নিলেই তো হয়, বিয়ের পর মেয়েকে পড়াতে হবে। জলপাইগুড়িতে থাকলে আরও ভাল পড়াশুনা হবে। এটা আমার কথা, তোমরা যা ভাবো তা হবে।’
‘আমি ভাবাভাবির মধ্যে নেই, আপনার ছেলেকে বোঝান।’ অঞ্জলির মুখ দেখে মনোরমা বুঝতেই পারলেন না যে তাঁর মতামতে সে খুব খুশি হয়েছে। অঞ্জলি উঠে দাঁড়াতেই দেখতে পেল দীপা আসছে। একা একা, খুব ঝড়ো চেহারা। অঞ্জলির মনে হল মেয়েটা বেশ বড় হয়ে গিয়েছে।
‘এত দেরি হল কেন?’ অঞ্জলির গলা এতটা জোরে যে হাত আটেক দূরেই দীপা দাঁড়িয়ে পড়ল। সে মাটির দিকে তাকাল। মনোরমা বললেন, ‘মা যা জিজ্ঞাসা করছে তার জবাব দে।’
দীপা মুখ না তুলে বলল, ‘পানিশমেন্ট হয়েছিল।’
‘কী করেছিলি তুই?’
‘আমি কিছু করিনি।’
‘কিছু না করলে তোকে শাস্তি দেবে কেন?’
‘আমার খাতা দেখে বিশু লিখছিল বলে আমাকে আধঘণ্টা নিলডাউন করে রেখেছিল আর বিশুকে দেড়ঘণ্টা। আমি অনেক নিষেধ করেছিলাম কিন্তু বিশু শোনেনি।’
‘তুই বিশুকে তোর খাতা দিয়েছিলি?’
‘না। ও জোর করে নিয়েছিল।’
‘কাল থেকে তোমার স্কুল যাওয়া বন্ধ।’
‘বা রে? আমি তো কোনও অন্যায় করিনি।’ প্রতিবাদ করে উঠল দীপা, ‘তুমি স্কুলে গিয়ে জিজ্ঞাসা করে দ্যাখো, আমি তো নকল করিনি।’
‘কোনও কথা শুনতে চাই না। তোমার খুব বাড় বেড়েছে। আমাকে না জানিয়ে মাছ ধরতে ফরেস্টের নদীতে গিয়েছিলে? সাহস দেখে আমি হাঁ। সাপের পাঁচ পা দেখেছ তুমি? বদমাশ মেয়ে। সবাই জানল আমাদের বাড়ির মেয়ে শাস্তি পেয়েছে। এতে তোমার বাবার মুখ খুব উজ্জ্বল হবে, না? যাও ভেতরে। আজ তোমার খাওয়া বন্ধ।’ একনাগাড়ে কথাগুলো বলে গেল অঞ্জলি। মনোরমা একটা কথাও বললেন না। দীপা গোঁজ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। অঞ্জলি আবার বলল, ‘কথাগুলো কানে ঢুকল না? যা ভেতরে!’
‘আমি আর মাছ ধরতে যাব না।’
‘যাও না। আরও বেশি করে যাও। হাতির পায়ে চাপা পড়ো। আমার কী!’
‘আমি আর যাব না।’
‘আর কী কী করবে না লিস্টিটা শুনি।’
‘আমি আর কাউকে নকল করতে দেব না।’ দীপার চোখ উপচে জল এল, ‘কিন্তু আমাকে স্কুলে যেতে দাও। মাস্টারমশাই একটু পরে পড়াতে আসবেন।’
‘আমি এখন তোমার সঙ্গে কোনও কথা বলব না। দয়া করে সামনে থেকে বিদায় হও।’ অঞ্জলির কথা শেষ হতে দীপা ভেতরে পা বাড়াল। চোখের আড়াল হতেই তার মনে হল সাপের কোনও পা নেই। তা হলে মা কেন পাঁচটা পায়ের কথা বলল? সাপের কি লুকোনো পা আছে? সবাই দেখতে পায় না? সেই পাঁচটা পা দেখতে পেলে কী হয়? সে মাকে একটা কথা বলেনি। বিশু খুব পিটুনি খেয়েছে আজ। তাকে শুধু নিলডাউন হয়ে থাকতে হয়েছে। বইপত্র রাখতে রাখতে তার খেয়াল হল আজ মা খেতে দেবে না। কথাটা ভাবতেই খুব খিদে পেয়ে গেল। মনে মনে মতলব আঁটতে লাগল সে।
বিকেল আর সন্ধেয় বড় গলাগলি ভাব এখানে। কখন যে মিলে মিশে যায় তা পাখিরাও টের পায় না। চা বাগানের বুক চেরা নুড়ি পাথরের রাস্তা বেয়ে সেইসময় সাইকেলগুলো ফিরে আসে কোয়ার্টার্সে। তাদের টর্চের আলোয় গাছের পাতাগুলো রহস্যময় হয়ে ওঠে। মদেশিয়া কুলি কামিনরা কাজ সেরে বাড়ি ফেরে রাঁচি-হাজারিবাগের গান গাইতে গাইতে। কয়েক পুরুষ ধরে এইসব গান মুখে মুখে চলে আসছে। একটু বাদেই কুলি লাইনে লাইনে মাদল বাজবে। হাঁড়িয়ার সঙ্গে সেই গানগুলো গাইবে যা একদা রাঁচি-হাজারিবাগের গ্রামে গাওয়া হত। তখন চা-বাগান ঘুমোবে নতুন পড়া হিম মাখতে মাখতে পৃথিবীটা হয়ে যাবে শুধু তারা আর জোনাকিদের রাজত্ব।
অমরনাথ সাইকেল ঘুরিয়ে মাঠে চলে এলেন। বড়বাবুর বারান্দায় হ্যাজাক জ্বলছে। শ্যামাপোকা ভিড় করেছে সেখানে। অনন্ত ঠাকুর এখনও কালীমূর্তি তৈরি করে চলেছে। নিজের কোয়ার্টার্সের সামনে পৌছাতেই অমবনাথ সত্যসাধনবাবুকে দেখতে পেলেন। পাতলা অন্ধকারে ছোট টর্চ জ্বেলে আসছেন। সাইকেল থেকে নামতেই ভদ্রলোক টর্চের আলোয় তাঁকে দেখে নিয়ে নমস্কার করলেন, ‘নমস্কার। আজ প্রথমদিন। ছাত্রী কোথায়?’
একটু ব্যস্ত হলেন অমরনাথ। সত্যসাধনকে দাঁড়াতে বলে তিনি বারান্দায় উঠে পাশের ঘরটির দরজা ধরে টান দিতেই সেটা খুলে গেল। ঘর অন্ধকার। সাইকেল এক পাশে রেখে তিনি ভেতরের ঘরের দরজা ঠেললেন। সেটাতেও খিল নেই। অনেকবার বলেছেন এই দুটো দরজা যেন ভাল করে বন্ধ রাখা হয় অথচ কারও খেয়াল থাকে না। উষ্ণ হতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলেন তিনি। সত্যসাধনবাবু আজ প্রথম পড়াতে এলেন, এসেই যদি ধারণা করেন তাঁর মেজাজ খুব উগ্র, তা হলে খারাপ লাগবে। বাইরের ঘরে হ্যারিকেন জ্বলছে। অমরনাথ সত্যসাধনকে আপ্যায়ন করে সেখানে বসালেন। তারপর দ্বিতীয় ঘরে পা দিয়ে গলা তুলে ডাকলেন, ‘দীপা, দীপা, কোথায় গেলি।’
কেউ সাড়া দিল না। ভেতরের বারান্দায় পৌঁছে তৃতীয়বার ডাকতেই রান্নাঘর থেকে অঞ্জলির গলা ভেসে এল, ‘কেন, তাকে কী দরকার?’
‘দরকার আছে। এতবার বলেছি একবার ডাকলেই সাড়া দিবি তবু অবাধ্য হবে। কোথায় সে? প্রশ্ন করামাত্র পেছনের দরজায় শব্দ হল। অমরনাথ ঘুরে হ্যারিকেনের আলোয় দেখলেন মেয়ে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আর দাঁড়াবার ভঙ্গি দেখেই মনে হল একটা কিছু ঘটেছে। এখন সেটা শুনতে ইচ্ছে করছিল না। গম্ভীর গলায় তিনি বললেন, ‘তোমাকে পড়াতে মাস্টারমশাই এসেছেন। যাও বইপত্র নিয়ে। কোথায় ছিলে তুমি?
‘অত্যন্ত মিনমিনে গলায় জবাব এল, ‘ঠাকুর ঘরের সামনে।’
‘দাঁড়িয়ে আছ কেন, যাও।’
‘মা আমাকে আর পড়তে নিষেধ করে দিয়েছে। স্কুলে যখন যাব না তখন মাস্টারমশাইয়ের কাছে পড়ার কী দরকার!’ মাথা নিচু করে সেই একই স্বরে কথা বলল দীপা।
‘তার মানে?’ অবাক হলেন অমরনাথ, ‘স্কুলে যাবে না মানে? যত্ত সব বাজে কথা।’
এইসময় মনোরমা তাঁর ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন, ‘বাড়িতে মাস্টার পড়াতে এসেছে যখন তখন পড়তে যাও। তাকে আর বাইরের ঘরে বসিয়ে রেখো না।’
‘আমার যে খিদে লেগেছে। খিদে নিয়ে পড়া যায়?’
অমরনাথ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘স্কুল থেকে এসে খাসনি?’
‘না।’
‘কেন?’
‘আমি জানি না।’
‘ঠিক আছে। তুই পড়তে বস, মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে তোরও খাবার যাবে। ‘কথা শেষ হওয়ামাত্র দীপা ছুটল। অমরনাথ এবার বেশ বিরক্ত হলেন, ‘বাড়ির অবস্থা দিনদিন হচ্ছে কী! ওইটুকুনি মেয়েকে সকালে খাইয়ে স্কুলে পাঠিয়েছ আর তারপর কিছু দাওনি? যা করবে তা একটু ভেবেচিন্তে করলে খুশি হব।’
অঞ্জলি রান্নাঘরে বলেই গলা তুলে বলল, ‘গুণধরী মেয়ে পুটুস পুটুস করে কী লাগাল আর তাতেই গলে গেলেন উনি। আমি যা করি তা ভেবেচিন্তেই করি।’
‘তার নমুনা তো দেখলাম। বাইরের দরজা হাট করে খোলা। যেদিন সর্বস্ব চুরি যাবে সেদিন বুঝবে। হাজারবার বললেও তো হুঁশ হয় না। ভেবেচিন্তে করি!’ অমরনাথ ফিরলেন।
সঙ্গে সঙ্গে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এল অঞ্জলি, ‘দেখলেন মা, গায়ে পড়ে ঝগড়া করছে। যা ইচ্ছে মুখে বলছে। কখনই আসল ঘটনাটা শুনতে চায় না।’
অমরনাথ বারান্দা থেকেই বললেন, ‘আস্তে কথা বলো, বাড়িতে মাস্টারমশাই আছেন।’
মনোরমা বললেন, ‘বউমার সঙ্গে পরে আলোচনা করিস অমর।’
অমরনাথ বললেন, ‘এ নিয়ে আলোচনা করার কী আছে। মেয়েটা হয়তো কোনও অন্যায় করেছিল আর তাই উনি রেগেমেগে খাওয়া বন্ধ করেছেন, স্কুলে যেতে নিষেধ করেছেন।’
মনোরমা বললেন, ‘দীপাকে আজ স্কুলেই শাস্তি দিয়েছে।’
‘সেকী? কেন?’ অমরনাথ এবার অবাক।
মনোরমা বললেন, ‘বিশু ওর খাতা দেখে লিখেছিল বলে শাস্তি পেয়েছে দু’জনেই।’
‘নকল করছিল দীপা!’ হতভম্ব হয়ে গেলেন অমরনাথ।
অঞ্জলি বলল, ‘হয়ে গেল! তিলকে তাল ভাবতে শুরু করে দিলেন উনি।’
অমরনাথ আর দাঁড়ালেন না। সোজা বাইরের ঘরে চলে এলেন। সেখানে হ্যারিকেনের সামনে সত্যসাধন বই খুলে বসেছেন। উলটোদিকে দীপা সাগ্রহে বসে। অমরনাথকে দেখে সে যেন একটু গুটিয়ে গেল। অমরনাথ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আজ স্কুলে কী হয়েছিল?’
সত্যসাধন জবাব দিলেন, ‘কিছু হয় নাই তো!’
‘শুনলাম দীপা নাকি শাস্তি পেয়েছে।’
‘ওহো! ওর খাতা জোর জবরদস্তি দেইখ্যা বিশ্বনাথ নকল করতেছিল। অ্যাসিস্টেন্ট হেডমাস্টারমশাই ব্যাপারটা না বুইঝাই শাস্তি দিছিলেন। পরে সব শুইন্যা দীপারে আদরও করছেন। কী দীপা, ঠিক না?’ দীপা সঙ্গে সঙ্গে মাথা নাড়ল।
অমরনাথ আর রাগতে পারলেন না। শুধু বললেন,’ নিজের খাতা অন্যকে দেখাও কেন? এইসব বন্ধুদের সঙ্গ এবার ছাড়ো। দেখুন মাস্টারমশাই, গাধা পিটিয়ে ঘোড়া করতে পারেন কিনা।’
সত্যসাধনবাবু হা হা করে হাসলেন, ‘কী যে কন। দীপা খুব ভাল ছাত্রী। দ্যাখেন, অরে ফাস্ট ডিভিশনে পাশ করাইয়া ছাড়ুম।’ তারপর দীপার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘পাঠ্যপুস্তকের বাইরে তুমি কী কী বই পড়ো?’
দীপা তার বইয়ের স্তুপ থেকে রমলা সেনের পাঠানো বইটি বের করল। সেটা হাতে নিয়ে সত্যসাধন উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন, ‘চমৎকার।’ অমরনাথ আর দাঁড়ালেন না।
আজ ভেতরের বারান্দায় মনোরমা ছেলেকে চা খেতে বললেন! মাস্টারমশাই আর ছাত্রীকে চা-জলখাবার পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে পর্যাপ্ত পরিমাণে। মোড়া টেনে ছেলের খানিকটা দূরে বসলেন মনোরমা, ‘তোর সঙ্গে কয়েকটা কথা ছিল?’ ছেলেদুটোকে ভেতরের ঘরে পড়তে বসিয়ে অঞ্জলি এসে দাঁড়াল দরজায়। চায়ে চুমুক দিয়ে অমরনাথ বললেন, ‘এখানে চা দিয়েছ যখন তখন বুঝতেই পেরেছি। কী ব্যাপার?’
‘তোর সঙ্গে হরিদাসবাবুর বেয়াই কথা বলেছেন?’
‘হ্যাঁ। অঞ্জলিকে তো বলেছি।’
‘বাঃ। ঘুমের ঘোরে কী বলেছ আমার কি খেয়াল আছে?’ অঞ্জলি বলে উঠল।
‘আমাকে তো কিছু বলিসনি।’ মনোরমার গলায় অভিমান বাজল।’
‘ওটা কি কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার?’ অমরনাথ হাসলেন, ‘দীপাকে দেখে ওঁর খুব পছন্দ হয়েছে। ভাইয়ের ছেলের জন্যে অল্পবয়সি পাত্রী খুঁজছেন। ওসব তোমাদের আমলে হত। এখন ওর বয়সে মেয়ের বিয়ে দিয়েছি শুনলে লোকে পাগল ভাববে।’
‘তোমার মেয়ের যখন বিয়ের বয়স হবে তখন লোকে এসে বিয়ে দিয়ে যাবে?’
‘তার মানে? তোমরা কী বলতে চাইছ?’
মনোরমা ছেলের মন বুঝতে পারলেন, ‘জন্ম-মৃত্যু-বিয়ে কার কপালে কখন লেখা আছে তা কেউ কি বলতে পারে। মেয়ের তো একদিন বিয়ে হবেই। চিরকাল তো আর এখানে রাখতে পারবি না। আমি বলি কী, খোঁজখবর নে, পরিবার কেমন দ্যাখ।’
‘ধরো, পরিবার ভাল, ছেলে যেহেতু ছাত্র তাই ভাল, তখন কী করবে?’
‘সবই যদি ভাল হয় তা হলে আর আপত্তি করিস না।’
‘তোমরা ভুলে যাচ্ছ দীপা এখনও বাচ্চা!’
‘হ্যাঁ, তুমি ওই ভাবনা নিয়েই থাকো।’
অমরনাথ হকচকিয়ে গেলেন। মেয়েরা কোন বয়সে নারী হয়ে যায় সে সম্পর্কে তাঁর একটা আন্দাজ আছে। দীপা তার অনেক নীচে। তা ছাড়া মেয়েটার আচরণে কোনও পার্থক্য দেখতে পাননি তিনি। একটু আমতা আমতা করে তাই বললেন, ‘আমি অবশ্য কিছু জানি না।’
মনোরমা বললেন, ‘না না সেসব কিছু না। তবে চেহারা তো ওর বড়সড়।’
অমরনাথ বললেন, ‘আমার এতে সায় নেই। মেয়েটা পড়াশুনায় ভাল। মাস্টারমশাই বললেন, ফাস্ট ডিভিশন পেতে পারে। এখন বিয়ে দিলে ভবিষ্যৎ বারোটা বেজে যাবে।’
অঞ্জলি বলল, ‘তুমি কথা বলো ওদের সঙ্গে। বিয়ের পর পড়াতে হবে।’
‘তোমরা এসব জানলে কী করে?’
‘হরিদাসবাবুর বউ লক্ষ্মী এসেছিল।’ মনোরমা জানালেন, ‘তুই বিয়ে দিস না দিস একবার ওঁর সঙ্গে কথা বল। আগ বাড়িয়ে খবরটা দিয়েছেন আর তুই যদি চুপচাপ থাকিস তা হলে খারাপ দেখায়।’
চা শেষ করে অমরনাথ উঠে গেলেন। আজ ক্লাবে গিয়ে তাস খেলতেও তাঁর ইচ্ছে করছিল না। দীপার মুখটা মনে পড়লেই বুকের ভেতরটা টনটন করছিল। বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে তিনি চিরকাল। বিধবা বিবাহ এখনও সমাজ মেনে নেয়নি। কিন্তু ক্রমশ বাল্যবিবাহের সংখ্যা কমে আসছে। মনোরমা এটাকে সমর্থন করতে পারেন কিন্তু অঞ্জলির মুখে তিনি এসব কথা আশা করেননি। অঞ্জলির কি খুব মেজাজ খারাপ? সেই রমলা সেন আসার পর থেকেই ওর ধরনটা বদলে গিয়েছে। অমরনাথ নিশ্বাস ফেললেন। তারপর ঠিক করলেন একদিন না হয় জলপাইগুড়ি যাবেন। ব্যবসায়ী লোকের খুঁত বের করতে বেশি কষ্ট করতে হবে না। সেই খুঁতটাকে বড় করিয়ে দেখে সম্বন্ধ ভেঙে দিলেই চলবে।
রাত নিশুতি হলে অঞ্জলি বিছানায় এল। এসে জিজ্ঞাসা করল, ‘এখনও ঘুমাওনি?’
অমরনাথ বললেন, ‘ঘুম আসছে না।
‘কেন?’
‘আমার ভাল লাগছে না।’
‘কী ব্যাপার?’
‘মেয়েটাকে এত অল্প বয়সে বিয়ে দেওয়াটা পাপ হবে।’
‘আজ যেটাকে পাপ বলছ কাল সেটাকে পুণ্য বলবে। তোমার মেয়ের অবস্থা যদি মালবাবুর মেয়ের মতো হয় তা হলে শান্তি পাবে? তা ছাড়া এখানে থাকলে ওর ছেলে বন্ধুদের সঙ্গে মেশা বন্ধ করতে পারবে? হঠাৎ যদি কিছু হয়ে যায় তা হলে নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে?’ অঞ্জলি স্বামীর বুকে হাত রাখল।
তবু উসখুস করতে লাগলেন অমরনাথ। শেষপর্যন্ত চাপা গলায় বললেন, ‘বিয়ে যদি দিতে হয় অঞ্জলি তা হলে ওর শ্বশুরকে সত্যি কথাটা বলতে হবে, এটা ভেবেছ তোমরা?’
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন