২৭. অমরনাথের শরীর

সমরেশ মজুমদার

অমরনাথের শরীর বয়সের তুলনায় বেশি বুড়িয়ে যাচ্ছিল। আজকাল একটুতেই মাথা ঘোরে, প্রেশার বেড়ে গিয়েছে খুব। চিন্তা করলেই মাথার যন্ত্রণা শুরু হয়। বাগানের ডাক্তার ছুটি নেবার পরামর্শ দিয়েছিলেন, পনেরো দিন একদম বিশ্রামে থাকতে হবে, চিন্তা করলে চলবে না। দীপাকে নিয়ে যে-সমস্যা তিনি তৈরি করেছিলেন তার ধাক্কা সামলানোই যখন মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছিল, ঠিক তখনই মৃত পিতা ফিরে এলেন সন্ন্যাসের শেষ বাধা পার হতে। ব্যাপারটাকে মেনে নিতে তাঁর খুব কষ্ট হয়েছিল। পরেরদিন সকালে সর্বত্র খোঁজ করেও তিনি সন্ন্যাসীর দর্শন পাননি। অথচ মনোরমার দিকে তাকিয়ে তিনি অবাক হয়ে যান। মনোরমা যেন ঘটনাটা সম্পর্কে একদম নির্বিকার। তিনি মানতেই রাজি নন যে তাঁর স্বামী জীবিত, এবং এই বাড়িতে এসেছিলেন। বিধবার যা যা করণীয় তাই নিষ্ঠার সঙ্গে করে চলেছেন তিনি।

এখন অনেকটা অজান্তেই দীপার কাছ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন অমরনাথ। চিঠিপত্র আর লেখেন না। সেই ভার দিয়েছেন অঞ্জলিকে। সে-ই মেয়ের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখে। জলপাইগুড়িতে বন্যার খবর পেয়ে অত্যন্ত বিচলিত বোধ করেছিলেন। খবরটা এসেছিল সন্ধেবেলা। সেদিন রেডিয়োতে শুনেছিলেন। সন্ধে নামলে যাওয়ার উপায় নেই। সারারাত ছটফট করেছিলেন। সক্কালবেলায় বানারহাট মালবাজার সেবক হয়ে শিলিগুড়িতে পৌঁছে শুনেছিলেন সেদিন যাওয়া হবে না। পরের দিন মেয়ের কাছে এক হাঁটু কাদা মেখে পৌঁছে বলেছিলেন, ‘তোমার মা বললেন এখানে অসুবিধে হলে আমার সঙ্গে চা বাগানে চলে আসতে।’

দীপা মাথা নেড়ে বলেছিল তার কোনও অসুবিধে হচ্ছে না। অমরনাথ সেদিনই আবার ঘুরপথে ফিরে গিয়েছিলেন চা বাগানে। মাথা ঘোরা আরম্ভ হয়েছিল তখন থেকেই। দীপা এবার ফাইন্যাল পরীক্ষা দিচ্ছে। অঞ্জলি একাই দু’দিন ঘুরে এসেছে। বাগানের ডাক্তারের ওষুধে অমরনাথের শরীর ভাল হচ্ছে না। বাঁদিকের বুকে প্রায়ই ব্যথা হচ্ছে। বাগানের ডাক্তার এবার পরামর্শ দিলেন কোনও স্পেশালিস্টকে একবার দেখাতে।

জলপাইগুড়ি শহরে এইসময় বুকের বিশেষজ্ঞ তেমন কেউ নেই, শিলিগুড়িতে আছেন। কিন্তু অনেক আলোচনার পর স্থির হল শিলিগুড়িতে যাওয়ার চেয়ে কলকাতায় গিয়ে চিকিৎসা করানো ঢের ভাল। থাকা খাওয়ার খরচ এক, তা ছাড়া আরও ভাল চিকিৎসকের কাছে পৌঁছানো যাবে। অঞ্জলি তার দাদা সুভাষচন্দ্রকে চিঠি লিখল। দীপার পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলেই তারা দিন সাতেকের জন্যে অমরনাথকে নিয়ে কলকাতায় যেতে চায় তার চিকিৎসার জন্যে। সুভাষচন্দ্র চটপট উত্তর দিলেন, ‘সাত দিনের জন্যে কোনও অসুবিধে নেই।’

এই লাইনটা অমরনাথ অপছন্দ করলেন। চিকিৎসার প্রয়োজনে সাত দিনের বেশি থাকলে সুভাষচন্দ্র যে অসুবিধায় পড়বেন তা লাইনটিতে স্পষ্ট! কলকাতায় সাধারণ মানুষের বাসস্থানের সমস্যা প্রকট তা তিনি জানেন। যদিও সুভাষচন্দ্র যখন এখানে আসেন এবং বেশ কিছুদিন থেকে যান, তখন তাঁর আচরণে সেটা বোঝা যায় না। অঞ্জলি তাঁকে লিখেছে যদি অল্প ভাড়ায় মাসখানেকের জন্যে একটা বাড়ি পাওয়া যায় তা হলে খুব ভাল হয়।

ছেলের জন্যে মনোরমাও উদ্বিগ্ন হয়েছেন। যদিও কলকাতায় চিকিৎসার জন্যে যাওয়ার প্রস্তাবে তাঁর কিছুটা অস্বস্তি হয়েছে। বউমার দাদার বাড়িতে গিয়ে থাকার বাসনা বিন্দুমাত্র নেই। অবশ্য এখনও কেউ তাঁকে যেতে বলেনি। সমস্ত কিছুর উদ্যোগ অঞ্জলিই নিচ্ছে ডাক্তারবাবুর সঙ্গে আলোচনা করে। ইতিমধ্যে বাড়িতে সবাই বুঝতে পেরেছে যে করেই হোক অমরনাথকে সুস্থ করা দরকার। এই পরিবারের প্রতিটি মানুষের ভবিষ্যৎ ওই একটি জীবনের ওপর নির্ভর করছে। মনোরমার উদ্বেগ তাই মাঝে মাঝে মাত্রা ছাড়াচ্ছে। অঞ্জলির কাছে সেটা এখন বিরক্তিকর মনে হচ্ছে। শেষপর্যন্ত অঞ্জলি মনোরমাকে বলতে বাধ্য হল, ‘মা, ওঁকে নিয়ে কলকাতায় কতদিন থাকতে হবে বুঝতে পারছি না। ওখানে তো আপনার জন্যে আলাদা ব্যবস্থা করা যাবে না।’

মনোরমা চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, ‘জলপাইগুড়িতে ভাল ডাক্তার নেই?’

‘থাকলে কেউ সাধ করে অতদূর যায়?’ অঞ্জলি তখনই কথা শেষ করেছিল। তার হঠাৎই মনোরমার জন্যে কষ্ট হল। অমরনাথ ওঁর একমাত্র পুত্র। অঞ্জলি নিজের দুই ছেলের একজনের এমন হলে ছেড়ে দিয়ে দূরে থাকতে পারত? অসম্ভব। অঞ্জলির সন্ন্যাসীর কথাও মনে পড়ল। এ-ব্যাপার নিয়ে আর কোনও আলোচনা এই বাড়িতে না হলেও অঞ্জলির বিশ্বাস, ভদ্রলোককে মনোরমা চিনতে পেরেও না চেনার ভান করেছেন। কেন করেছেন সেটা বুঝতে অসুবিধে হয় না। কিন্তু করার সময় এবং তার পরে বুকের মধ্যে যে-যন্ত্রণা নিয়ে উনি আছেন তার কোনও বিকল্প নেই। কিন্তু কোথায় ওঠা হবে, কীরকম পরিবেশ হবে, না জেনে ওঁকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব?

বিকেলের ডাকে দুটি চিঠি এল। দীপার পরীক্ষা সামনের সপ্তাহে। সে তৈরি। দ্বিতীয় চিঠিটা লিখেছেন সুভাষচন্দ্র। কলকাতার মেডিকেল কলেজের হার্ট স্পেশালিস্টের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করা হয়েছে। এখানে নামকরা ডাক্তারদের দেখা একমাস আগে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। সুভাষচন্দ্রের এক পরিচিত ভদ্রলোক মির্জাপুর স্ট্রিটে থাকেন। তাঁর বাসায় দুটো ঘর পাওয়া যাবে। তবে তাঁকে অন্তত দু’মাসের ভাড়া দিতে হবে। মাসিক দেড়শো টাকা। কলকাতায় পৌঁছাবার দিন জানালে সুভাষচন্দ্র স্টেশনে থাকতে পারবেন।

চিঠিটা পড়ে অমরনাথ স্বস্তি পেলেন। যদিও দেড়শো টাকা মাসিক ভাড়া তাঁর কাছে যথেষ্ট বেশি তবু এই টাকা কোনওমতে ব্যবস্থা করা যাবে। যাতায়াতের ভাড়া অফিস থেকে পাওয়া যাবে। দু’বছর অন্তর বেড়ানোর জন্যে একটা নির্দিষ্ট টাকা পাওয়া যায় অফিস থেকে। অনেকেই সেটা নিয়ে বাড়িতে বসে থাকে। চিকিৎসার খরচ চেষ্টা করলে কিছুটা অন্তত পাওয়া যাবে। বেশিরভাগ চা-বাগানগুলোর হেডঅফিস কলকাতায়। এখন যিনি হেডঅফিসের মেজকর্তা তিনি একসময় এই চা-বাগানে নিয়মিত ট্যুরে আসতেন। ভাল আলাপ আছে অমরনাথের সঙ্গে। মিস্টার মুখোপাধ্যায় বলে সম্বোধন করেন তাঁকে। গিয়ে দাঁড়ালে তিনি নিশ্চয়ই না বলতে পারবেন না। নিজের শরীরের বদলে অমরনাথের এবার দীপার জন্যে চিন্তা শুরু হল। যা ঝড় গেল মেয়েটার ওপর দিয়ে তাতে পরীক্ষার ফল আর কত ভাল হতে পারে। জলপাইগুড়ি থেকে গ্র্যাজুয়েট হলে স্কুলে একটা চাকরি পেতে পারে মেয়েটা। কলকাতায় ডাক্তার স্থির হবার খবর পেয়েই মনে হতে লাগল শরীর অনেক ভাল হয়ে গিয়েছে।

রাত্রে খাওয়াদাওয়ার পর অঞ্জলি মনোরমার ঘরের দরজায় শব্দ করল। দীপা না থাকলে রাত ন’টার মধ্যে দরজা বন্ধ করেন তিনি। চাপা গলায় প্রশ্ন এল, ‘কে?’

‘আমি।’ অঞ্জলি নিচু গলায় জানান দিল।

মনোরমা দরজা খুলে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী হয়েছে?’

অঞ্জলি ভেতরে ঢুকল, ‘দাদার চিঠি এসেছে আজ। আমাদের জন্যে দুটো ঘর ভাড়া করেছেন। আমার একার পক্ষে সবদিক সামলে চলা মুশকিল হবে—।’

‘দীপা তো যাচ্ছে। সে বেশ বড় হয়ে গিয়েছে আজকাল।’

‘কিন্তু আমার ইচ্ছে আপনি আমার সঙ্গে চলুন। আমি ভরসা পাই তা হলে।’

‘আমাকে কেন যেতে বলছ? তোমাদের সমস্যা বাড়বে।’ মনোরমা মুখ ফেরালেন।

‘দুটো ঘর আছে। আপনি আপনার ছেলের সঙ্গে একটা ঘরে থাকবেন। এতে কোনও সমস্যা হবে না। বরং আমাকে যদি বেরুতে হয় আপনি ওঁর পাশে থাকতে পারবেন।

মনোরমা চুপ করে রইলেন। অঞ্জলি তাঁর দিকে তাকিয়েছিল। উত্তর না পেয়ে বলল, ‘মা, আপনি চলুন। এখানে একা থাকলে চিন্তাই করে যাবেন, কষ্ট বাড়বে। ওখানে আমি চেষ্টা করব আপনার জন্যে আলাদা ব্যবস্থা করে দিতে।’

মনোরমা মাথা নাড়লেন, ‘আমার জন্যে আলাদা ব্যবস্থা করতে হবে না।’

‘মানে?’ অঞ্জলি অবাক।

‘বিদেশে গিয়ে নিয়ম মানার কোনও দরকার নেই।’

‘কিন্তু আপনার ছেলের জন্যে মাছ মাংস রাঁধতে হতে পারে।’

‘আগে নিরামিষ করে নিয়ে পরে ওসব কোরো।’

অঞ্জলি মাথা নাড়ল। তার খুব অবাক লাগছিল। মনোরমা এত পালটে গেলেন কী করে? নাকি নিজের বাসনা পূর্ণ করতে শেষপর্যন্ত এইটুকু মেনে নিলেন। এখন এখানে যে ছোঁয়াছুঁয়ি বাঁচানোর চেষ্টা করে চলেছেন সেটাও স্বচ্ছন্দে বিস্মৃত হলেন। স্বচ্ছন্দে কি? অঞ্জলি বুঝতে পারল না।

‘কবে যাবে?’ মনোরমা প্রশ্ন করলেন।

‘দীপার পরীক্ষার পরেই।’

‘এ-বাড়ির কী হবে?’

‘বুধুয়া আছে। ওই দেখাশোনা করবে। পাশের বাড়িকেও বলে যাব।’

‘খোকা কি চাইছে আমি যাই?’

‘ওঁর সঙ্গে আমার এ ব্যাপারে কথা হয়নি। কলকাতায় যেতে গেলে আপনার কী কী জিনিস কিনতে হবে তার একটা ফর্দ করে রাখবেন। আমি দীপার পরীক্ষার দিন জলপাইগুড়িতে যাব, তখন কিনে আনব।’ অঞ্জলি ঘর থেকে বেরিয়ে এল। ওর মন এখন ভাল।

পরীক্ষার শেষ দিনে হস্টেলে ফিরে এসে দীপা দেখল অঞ্জলি তার জন্যে বসে আছে। পরীক্ষার আগেই তার আসার ইচ্ছে ছিল কিন্তু সেইসময় অমরনাথ আবার অসুস্থ হয়ে পড়েন। একটু ভাল লাগলেই ছুটি বাঁচাতে কাজে বেরুতেন তিনি। দিন পাঁচ-ছয় মোটামুটি চলত। তারপর আর পারতেন না। এ-ব্যাপারে অঞ্জলির নিষেধ শোনার মানুষ তিনি নন। এইরকমটাই হয়েছিল কয়েকদিন আগে। ফলে অঞ্জলির আর জলপাইগুড়িতে আসা হয়নি। কিন্তু এই খবর মেয়েকে না জানিয়ে অন্য কথা লিখেছিল চিঠিতে। আজ মাকে দেখে খুশি হল দীপা। দ্রুত কাছে এসে জিজ্ঞাসা করল, ‘বাবা কেমন আছে মা?’

অঞ্জলি বলল, ‘ভাল না। বুকের ব্যথাটা কিছুতেই কমছে না। ওষুধ খেলে ভাল থাকছে, না খেলে যে-কে সেই। তোর পরীক্ষা কেমন হল?’

‘হল। আমরা কলকাতায় যাচ্ছি কবে?’

অঞ্জলি যা যা ঘটেছে তা দীপাকে খুলে বলল। বলতে বলতে হঠাৎ তার ধারণা হল সেই একদিনের বাচ্চা মেয়ে আজ অনেক বড় হয়ে গিয়েছে। ঠিক মেয়ে নয়, বন্ধুর মতো এর সঙ্গে সব কথা খুলে বলা যায়। সংসারের যাবতীয় অর্থচিন্তা, অমরনাথের কিছু হয়ে গেলে যে বিপর্যয় আসবে সেসব ভাবনাও অকপটে বলতে পারল সে।

দীপা গম্ভীর হয়ে মাথা নাড়ল, ‘তুমি আগ বাড়িয়ে এতসব ভাবছ কেন? ভাল চিকিৎসা হলে বাবা ঠিক হয়ে যাবে। আমার মনে হচ্ছে কলকাতায় গিয়ে মামার ওখানে না উঠে সোজা ওই ভাড়াবাড়িতে উঠলে ভাল হয়।’

‘কেন?’

‘এতে মামার সঙ্গে সম্পর্ক ভাল থাকবে।’

অঞ্জলির ব্যাপারটা পছন্দ হল না। একথা ঠিক সুভাষচন্দ্র নিজেই তার সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছেন। প্রতি নববর্ষে এবং বিজয়াতে অঞ্জলি চিঠি দিয়েছে এই বছরগুলো ধরে এবং সেইসব চিঠিতে বউদিকেও প্রণাম জানিয়েছে। কিন্তু সেই মহিলার কাছ থেকে কোনও চিঠি আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। যেহেতু অঞ্জলির মা একসময় ওই মহিলাকে অপছন্দ করতেন তাই তিনি নিজেকে নির্লিপ্ত রেখেছেন। আর অমরনাথও গায়ে পড়ে ওঁদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে যাননি। অঞ্জলি দু’-একবার বলেছিল কিন্তু অমরনাথ উৎসাহিত হননি। কথাটা অপছন্দ হলেও মেয়ের বুদ্ধিতে আস্থা বাড়ল তার। সেইদিন বিকেলে যা-কিছু কেনাকাটা করে মেয়েকে নিয়ে ফিরে এল সে চা-বাগানে।

বাড়িতে ঢুকে অমরনাথের সামনে দাঁড়াল দীপা। অমরনাথ ইজিচেয়ারে শুয়ে জানলা দিয়ে লিচুগাছের দিকে তাকিয়ে ছিলেন, পায়ের শব্দে মুখ ফেরালেন। মুখ সহজ করে জানতে চাইলেন, ‘কেমন হল?’

‘পাশ করব।’

‘একবার সত্যসাধন মাস্টারের সঙ্গে দেখা করে এসো। কাল শ্যামল এসে বলল ওঁর শরীর খুব খারাপ। তোমার পড়াশুনার পেছনে ওঁর দান সবচেয়ে বেশি।’

দীপা মাথা নাড়ল। তারপর জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি কেমন আছ?’

‘আমি ভাল আছি। তোমার মা ঠাকুমা অনর্থক চিন্তা করছেন। তুমি তো এঁদের মতো মানুষ হওনি, তুমি নিশ্চয়ই বুঝবে এসব চিন্তার কারণ কী।’

‘তুমি কী ভেবেছ?’

‘শিবপরের বোটানিক্যাল গার্ডেনে একটা বটগাছ আছে। গাছটা যখন প্রথম বড় হয়েছিল তখন তার মূল গুঁড়ির ওপর সমস্ত শরীরটা দাড়িয়েছিল। আস্তে আস্তে বিভিন্ন ডাল থেকে ঝুরি নামতে নামতে সেগুলো মাটিতে শেকড় ছড়িয়ে নিজেরাই এক একটা গাছ হয়ে গেল। কিন্তু যতদিন সেটা হয়নি ততদিন মূল গাছটির গোড়ার ওপর তার জীবন নির্ভর করত। আমি জানি আমার বেঁচে থাকার প্রয়োজন অনেকটা এই কারণেই। তুমি এবং তোমার ভাইরা যতদিন পায়ের তলায় মাটি না পাবে ততদিন আমাকে বেঁচে থাকতে হবে। এটা শুধু এঁদের আকাঙক্ষা নয়, আমারও। যাও বিশ্রাম করো। দীপার মনে হল বিশ্রামটা অমরনাথের দরকার। একটানা কথা বলে তিনি কাহিল হয়ে পড়েছেন। মুখে ক্লান্তি জমেছে, নিশ্বাস দ্রুত হল। সে আর দাঁড়াল না।

দুই ভাই এখন পূর্ণ কিশোর। একসঙ্গে থেকেও ওরা চিরকালই দীপার থেকে আলাদা স্বভাব নিয়ে রয়েছে। দু’জনেই খুব উত্তেজিত হয়ে রয়েছে। কলকাতার দ্রষ্টব্য স্থানগুলোর লিস্ট করে রেখেছে। এই বয়সে বাবার অসুখ নিয়ে ভাবার মতো মানসিকতা এদের তৈরি হয়নি। অথচ ওই বয়সে তার বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। ছেলেরা সম্ভবত অনেক সময় নেয় প্রাপ্তবয়স্ক হতে।

মনোরমার ঘরে ঢুকে সে বিছানায় ধপ করে বসেই আবার লাফিয়ে উঠল, ‘এই যাঃ।’

মনোরমা নাড়ু বানাচ্ছিলেন। অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী হল?’

‘বাইরের কাপড়ে বিছানায় বসে পড়েছিলাম।’

‘ও।’ মনোরমা মুখ ফেরালেন, ‘এখন তো ভেতর বাইরে বিচার করলে চলবে না। বসেছ যখন তখন বসো। বিদ্যাধরীর বিদ্যা কতদূর হল?’

‘ইন্টারমিডিয়েটটা পাশ করে যাব মনে হচ্ছে।’

‘গ্রাজুয়েট হতে হলে আর কতদিন পড়তে হবে?’

‘দু’বছর।’

‘ওরে বাবা। তা যাই বলিস, তুই যে পরীক্ষা দিলি আমাদের বংশের কোনও মেয়ে দূরের কথা ছেলেরাই ওই পরীক্ষা দেয়নি।’ গর্বের হাসি হাসলেন মনোরমা।

দীপা এক পলক দেখল। তারপর ইচ্ছে করেই বলল, ‘আমি তোমাদের বংশের কেউ নই।’

‘তা তো বলবেই। নিজের ছানা ভেবে বড় করে এখন তো কোকিলের ডাক শুনব।’

শব্দ করে হেসে উঠল দীপা। এবং হাসতে হাসতে প্রায় চিৎকার করে উঠল, ‘ও ঠাকুমা, তুমি এটা কী বললে?’

‘কী হল, চেঁচাচ্ছিস কেন? তোর বাবার অসুখ খেয়াল নেই?’ মনোরমা অপ্রস্তুত।

‘আমি কোকিল হলে তোমরা, তুমি নিজেকে কাক বলছ।’

এইসময় অঞ্জলি এসে দাঁড়ায় দরজায় চিৎকার এবং হাসি শুনে। মনোরমা তাকেই সাক্ষী মানলেন, ‘দ্যাখো বউমা, কলেজ থেকে ফিরে আমাকে জ্বালাতে এল।’

অঞ্জলি ভ্রূ কোঁচকাল, ‘কী বলছিস তুই?’

জবাবটা মনোরমাই দিলেন, ‘পড়াশুনো করে ওঁর শিক্ষা হয়েছে যে উনি আমাদের বংশের নন।’

দীপা বড় চোখে তাকাল, ‘কথাটা মিথ্যে, বলো মা?’

‘এসব কথা উঠছে কেন?’ অঞ্জলির মুখ গম্ভীর হল।

‘কথার কথা। আমি তোমাদের বংশের নই কিন্তু আমার চেয়ে আপন তোমাদের কেউ নেই। আচ্ছা, আমরা কবে রওনা হচ্ছি?’ প্রশ্নটি মনোরমাকে। কারণ অঞ্জলি তাকে আগেই জানিয়েছিল বাগানের ম্যানেজার তাদের জন্যে টিকিট কাটতে শিলিগুড়িতে লোক পাঠিয়েছেন। খবরটা আজ দুপুরেই বাড়িতে পৌঁছে যাওয়ার কথা।

মনোরমা মাথা নাড়লেন, ‘আমি জানি না তো। কেউ কিছু বলেনি।’

দীপা অঞ্জলিকে বলল, ‘আমি একটু মাস্টারমশাইয়ের কাছ থেকে ঘুরে আসছি।’

‘কাল সকালে যাস না। এখনই সন্ধে হয়ে যাবে।’

‘যাব আর আসব।’ দীপা উঠোনে নেমে এল। সে দেখল বুধুয়া তার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। বুধুয়ার এখন মধ্যবয়স। দীপা জিজ্ঞাসা করল, ‘কেমন আছ?’

বুধুয়া মাথা নাড়ল, ‘ভাল না। বউ ভেগে গিয়েছে।’

‘মানে?’ দীপা অবাক।

‘ছয় মাস আগে শাদি হয়েছিল। বানারহাটের মেয়ে। আমি চা-বাগানে কাজ করি না, বাবুবাড়িতে নোকর হয়ে আছি বলে থাকল না।’ বুধুয়া বিমর্ষ মুখে বলল।

‘তুমি তো বাবাকে বলে চা বাগানে চাকরি নিতে পারো?’

‘নাঃ। আমার ওইসব কাজ ভাল লাগে না?’

দীপার কৌতূহল বাড়ছিল, ‘বউয়ের জন্যে তোমার মন কেমন করে না?’

বুধুয়া দ্রুত মাথা নেড়ে নিঃশব্দে হ্যাঁ বলল।

‘তা হলে তুমি চা-বাগানে কাজ নিয়ে নাও।’

বুধুয়া উদাস চোখে কাঁঠাল গাছের মাথায় তাকাল। সেখানে দুটো শালিক তর্ক জুড়েছে। দীপা আর দাঁড়াল না। খিড়কি দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল। এখন ঘন বিকেল। মাঠে ছেলেরা খেলছে। বাগানের মেয়েরা সেজেগুজে দলবেঁধে মাঠের একধারে পাক খাচ্ছে। এরা নিতান্তই ঘোট। কিন্তু ভাবভঙ্গিতে ইতিমধ্যেই পাকামি এসে গিয়েছে। ওরা দূর থেকে দীপাকে দেখে দাড়িয়ে পড়ল। দীপা যেন ওদের লক্ষ করেনি এমন ভঙ্গিতে হেঁটে আসাম রোডে উঠে এল।

মসৃণ পিচের রাস্তার দু’ধারে ছায়া টেনে আনা দেওদার গাছের সারি। এই রাস্তায় হাঁটতে দীপার খুব ভাল লাগছে আজ। কয়েকটি মদেশিয়া কামিন ওর দিকে তাকাতে তাকাতে চলে গেল। এবং তখনই সে বিশুর বাবা আর মাকে আসতে দেখল। এই চা-বাগানে যে রক্ষণশীল মানসিকতা এখনও চলে আসছে তাতে কোনও স্বামী-স্ত্রী, তা যে-বয়সেরই হোক না কেন, একসঙ্গে পথে হাঁটতে বড় একটা দেখা যায় না। মুখোমুখি হতেই দীপা দাঁড়িয়ে পড়ল, ‘কেমন আছেন জেঠিমা?’

বিশুর মা মাথা নাড়লেন, ‘ভাল না। তুমি নিশ্চয়ই জানো বিশু মিলিটারিতে গিয়েছে।’

‘হ্যাঁ! ওরা যেদিন যায় সেদিনই বন্যা এসেছিল জলপাইগুড়িতে।’

‘ও, তুমি জানো তা হলো দুটো ছেলে একসঙ্গে গেল, খোকন ফিরে এল কিন্তু বিশু এল না। সে শুনেছি কাশ্মীর না কোথায় এখন আছে। দেড়মাস চিঠি পাইনি। তাই তোমার জ্যাঠামশাইকে নিয়ে তেলিপাড়ায় গিয়েছিলাম।’

‘তেলিপাড়ায় কেন?’

‘ওখানে একজন কাপালিক এসেছেন। ত্রিকালজ্ঞ। মারণ-উচাটন সবরকম বিদ্যে জানেন। তাঁর পায়ে পড়ে বললাম ছেলেটাকে ফিরিয়ে আনতে। উনি কথা দিয়েছেন। এখন কী আছে বরাতে কে জানে!’

দীপা হাসি সামলাল বেশ চেষ্টা করে, ‘কিন্তু ফিরিয়ে আনতে চাইছেন কেন? ওর যদি ওই চাকরি ভাল লাগে তা হলে করতে দিন না।’

‘তারপর কোথায় শত্রুর গুলি খেয়ে মরে থাকুক, আমরা জানতেও পারব না। এ কী কথা বলছ তুমি?’ ভদ্রমহিলার গলার স্বর পালটে গেল।

‘মিলিটারিতে যদি কেউ চাকরি নিয়ে না যায় তা হলে আমাদের দেশকে শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করবে কারা?’

‘ওসব কথা ভাবার লোক আছে, আমি চাই বিশু ফিরে আসুক।’ ওঁরা আর দাঁড়ালেন না। দীপা লক্ষ করল বিশুর বাবা তাকে কোনও প্রশ্ন করলেন না। বিশু নিশ্চয়ই ফিরে আসবে না। কিন্তু খোকন ফিরে এসেছে কেন? খোকনের চরিত্রের মধ্যে একটা মেয়েলি নরম ভাব ছিল। কিন্তু তাই বলে ভয় পেয়ে ফিরে আসবে সেটা কখনও মনে হয়নি।

বাজারের রাস্তায় পৌঁছে দীপা দেখল প্রচুর অচেনা ছেলে এসে গিয়েছে এখানে। তারা শহরের ছেলেদের মতো রাস্তার মোড়ে দাড়িয়ে আড্ডা মারছে। এরকম দৃশ্য আগে এখানে দেখা যেত না। একটি ছেলেকে বলতে শুনল, ‘দারুণ জিনিস।’

দীপা এক মুহূর্ত থমকে দাঁড়াল। ছেলেগুলোর দিকে তাকাল। ওরা সঙ্গে সঙ্গে মুখ ফিরিয়ে নিল। এদের সঙ্গে কথা বলতে যাওয়ার কোনও মানে হয় না বলে মনে হল দীপার। সে আবার হাঁটতে আরম্ভ করল।

সত্যসাধন মাস্টারের বাড়ি স্কুল পেরিয়ে কলোনির মধ্যে। এলাকাটা ছাড়ালেই খুঁটিমারি ফরেস্ট। কাঠের বাড়ি। ছোট উঠোন, টিনের বাউন্ডারি দেওয়া। টিনের গেট খুলতেই একজন বয়স্কা মহিলা মাথায় ঘোমটা টেনে উঠে দাঁড়ালেন। রোদে শুকুতে দেওয়া কাঠের টুকরো ঝুড়িতে ভরছিলেন তিনি।

দীপা জিজ্ঞাসা করল, ‘মাস্টারমশাই আছেন?’

মহিলা মাথা নাড়লেন, ‘তুমি দীপা, না?’

‘হ্যাঁ।’ দীপা এগিয়ে এসে প্রণাম করল। মহিলার দিকে তাকালেই বোঝা যায় অভাব তাঁর নিত্যসঙ্গী। তিনি আর্শীবাদ করলেন, ‘আয়ুষ্মতী হও মা। যাও ভিতরে যাও, তিনি শুইয়া আছেন।’ দীপা কাঠের সিঁড়ি বেয়ে দরজায় গিয়ে দাঁড়াল।

‘পরীক্ষা কেমন দিলা?’ চিনচিনে গলায় একটা প্রশ্ন ভেসে এল ঘরের কোনা থেকে। এখনও আলো জ্বালা হয়নি। জিনিসপত্রে ঠাসা ঘরটিতে চিমসে গন্ধ ভাসছে। দীপা সেখানে দাঁড়িয়েই জানতে চাইল, ‘আপনি, আপনার কী হয়েছে?’

‘পেটে বড় যন্ত্রণা হয়, আর কিছু না। এখানে আসো, পরীক্ষা কেমন দিলা?’

দীপা এগিয়ে খাটের পাশে দাঁড়াল। খাট বলতে তক্তপোশ এবং তার ওপর প্রায় শতরঞ্চি হয়ে যাওয়া তোষক। সত্যসাধন মাস্টার চিত হয়ে শুয়ে আছেন। এই আধা-অন্ধকারে বোঝা যাচ্ছিল তাঁর মুখ চোখ ভেঙে গিয়েছে। অত্যন্ত শীর্ণ হয়েছেন তিনি, চোখ কোটরে ঢুকে গিয়েছে। দীপা খাটের পাশে রাখা কাঠের চেয়ারে বসতে বসতে বলল, ‘পরীক্ষা ভালই দিয়েছি। কিন্তু এ কী চেহারা হয়েছে আপনার?

প্রশ্নের জবাব না দিয়ে চোখ বন্ধ করে সত্যসাধন জিজ্ঞাসা করলেন, ‘সিক্সটি পার্সেন্ট নম্বর পাইবা তো? ইউ মাস্ট রিমেম্বার দ্যাট ইউ আর ফাইটিং এগেইনস্ট ডেস্টিনি। ইউ আর টু মেক ইয়োর ওন ফিউচার। ভুলবা না কখনও কথাটা।’

‘আমি চেষ্টা করব।’

‘না। বলল, তোমারে জয়ী হইতে হইব।’

‘কিন্তু আপনি ডাক্তার দেখাচ্ছেন?’

‘কবিরাজি করাইতেছি। কলোনিতে একজন ভাল কবিরাজ আছেন। রাজশাহীর মানুষ। মাঝে মাঝে একটু উপকার দেয়।’ নিশ্বাস ফেললেন সত্যসাধন। তারপর যেন মনে পড়ল এমন ভঙ্গিতে বললেন, ‘তোমার বাবার তো খুব অসুখ। কেমন আছেন?’

‘ভাল না। কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হবে।’

‘তুমি যাইবা সঙ্গে?’

‘হ্যাঁ।’

‘গুড। শোনো, যখনই টাইম পাইবা তখনই কয়েকটা জায়গায় যাইবা। ধরো, প্রেসিডেন্সি কলেজ, ন্যাশনাল লাইব্রেরি। ওইসব জায়গায় কিছুক্ষণ থাকলেই মনের পরিবর্তন হয়। আমার ইচ্ছা ছিল তুমি প্রেসিডেন্সি কলেজে ভরতি হও।’

এইসময় একটা হ্যারিকেন নিয়ে সত্যসাধনের স্ত্রী প্রবেশ করলেন, ‘অল্প কথা কইলে ভাল হয়। কবিরাজমশাই রাগ করবেন।

‘আরে রাখো তোমার কবিরাজ। এরে চেনো তুমি?’

মহিলা হাসলেন, ‘তোমারে দেইখ্যা ওনার মুখে কথা ফুটতেছে।’

‘শোনো, সারাজীবন অনেক ছাত্রছাত্রী দেখলাম। কিন্তু এ হল আমার বেস্ট স্টুডেন্ট। কিছু খাইতে দাও এরে।’

দীপা তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ‘না না। আমার একটুও খিদে নেই। কিন্তু ডাক্তার, মানে কবিরাজ কী বলছে? অসুখটা কী?’

‘লিভারে পচন ধরছে। মদ্যপান করলে নাকি এই রোগ হয়। দু’বেলা ভাত জোটে নাই ঠিকমতো, মদ্যপান করার মতো মনও হয় নাই কখনও। অথচ দ্যাখো, আমার লিভারে সেই রোগ বাসা বাঁধল। এরেই বলে কপাল।’

‘আপনি কপালকে মেনে নিচ্ছেন কেন? লড়াই করছেন না কেন?’

‘ওরে মা, লড়াই করনের একটা বয়স থাকে। যখন রক্ত গরম তখন দুনিয়া পায়ের তলায়। জীবন থিকা আমার আর পাওনের কিছু নাই।’

‘এসব কথা শুনতে চাই না। বাগানের ডাক্তারকে আপনি দেখিয়েছেন?’

‘না। তিনি আমারে দেখবেন কেন?’

‘আমি বলব। আপনাকে সেরে উঠতেই হবে।’

দীপা যখন উঠে দাঁড়াল তখন বাইরে ঘন অন্ধকার। একটু আগে বুধুয়া হাজির হয়েছে টর্চ নিয়ে। অঞ্জলি তাকে পাঠিয়েছে। দীপার কেবলই মনে হচ্ছিল মাস্টারমশাই আর বেশিদিন বাঁচবেন না। এই একটু কথা বলেই কেমন হাঁপিয়ে পড়েছেন। বোঝা যাচ্ছে তাঁর পেটে আবার যন্ত্রণা শুরু হয়েছে। শায়িত মানুষকে প্রণাম করতে নেই। সে মাস্টারমশাইয়ের কপালে হাত রাখল, ‘আপনাকে বাঁচতে হবে। আমার জন্যে আপনাকে বাঁচতে হবে।’

সত্যসাধন বললেন, ‘পাগল। তোমার জীবনে আমার প্রয়োজন আর নাই। আমার যা ছিল, আমি দিতে পারি, তার সব নিয়া তুমি রান শুরু করছ। তোমারে পড়ানোর যোগ্যতা আর আমার নাই। শিশু যখন মায়ের কোলে থাকে তখনই তার স্তন্যদুগ্ধের প্রয়োজন হয়। কিন্তু যেই সে অন্য খাদ্য গ্রহণ করতে শেখে তখন মায়ের স্তন্যের দুগ্ধ শুকাইয়া যায়। এইটাই জীবনের নিয়ম। শোনো মা, তোমারে একটা কথা বলি, কখনও পিছনদিকে তাকাইবা না। তোমার চেয়ে নীচে যার স্থান তার সঙ্গে হৃদয়ের কথা বলবা না। তুমি যতক্ষণ নিজে না মনে করো অন্যায় ততক্ষণ পাঁচজনে যাই বলুক, তুমি কথা কানে তুলবা না। তোমার বিচারক তুমি।’

আগামীকাল আবার আসবে বলে দীপা বাইরে বেরিয়ে এল। বুধুয়া দাঁড়িয়ে ছিল গেটের সামনে। ওকে দেখামাত্র টর্চ জ্বালল। এই অন্ধকারে পথ হাঁটা সত্যি মুশকিল। দীপা অঞ্জলির কাণ্ডজ্ঞানে কৃতজ্ঞ হল। দূরে শেয়াল ডাকছে। বুধুয়া টর্চ হাতে আলো ফেলতে ফেলতে পেছনে আসছে। সত্যসাধন মাস্টারের জন্যে দীপার খুব কষ্ট হচ্ছিল। বাজার পেরিয়ে বাগানে এসে সে বুধুয়াকে নিয়ে ডাক্তারবাবুর কোয়ার্টার্সে চলে এল। লুঙ্গি পরে হ্যারিকেনের আলোয় খবরের কাগজ পড়ছিলেন ডাক্তারবাবু বাইরের ঘরে বসে। দীপাকে দেখে অবাক হলেন, ‘কী ব্যাপার, তুমি? পরীক্ষা কেমন হল?’

‘ভাল। আপনাকে একবার যেতে হবে।’

‘কেন? বাবার কি শরীর আবার খারাপ হয়েছে?’

‘না। বাবার না। মাস্টারমশাই, সত্যসাধনবাবুর।’

‘হ্যাঁ, শুনেছিলাম বটে উনি অসুস্থ। কিন্তু উনি তো চা-বাগানের স্টাফ নন।

‘কিন্তু কোনও মানুষ অসুস্থ হলে এসব বিচার কি সবসময় করা উচিত?’

‘বেশ, তুমি চাইছ যখন তখন আমি যাচ্ছি। কিন্তু ওঁর বাড়ি আমি চিনি না।’

‘আমি আপনাকে নিয়ে যেতে পারি।’

‘দরকার হবে না। তোমাদের কাজের লোক চেনে? ও সঙ্গে গেলেই হবে।’

‘খোকন বাড়িতে আছে?’

‘না হে। সে আজ আলিপুরদুয়ারে চলে গেল। মাসির বাড়িতে। আর তো কিস্যু হবে না জীবনে। যে-ছেলে মিলিটারিতে গিয়ে পরিশ্রম সহ্য না করে পালিয়ে আসে তার জন্যে ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হয় না। হঠাৎ লাস্ট বাসে আলিপুরদুয়ারে চলে গেল। তুমি বাড়িতে যাও, আমি মাস্টারকে দেখে আসছি।’

বুধুয়াকে নির্দেশ দিয়ে অন্ধকার মাঠের মধ্যে দিয়ে কোয়ার্টার্সে ফিরতে ফিরতে দীপার মনে হল, খোকন কি তার সঙ্গে দেখা হওয়া এড়াতেই মাসির বাড়িতে চলে গেল? নইলে হুট করে লাস্ট বাস কেউ ধরে না। অন্তত একটু আত্মসম্মানবোধ এখনও ওর মধ্যে কাজ করছে মনে হতে ভাল লাগল দীপার।

রাত আটটার মধ্যেই রাতের খাবার ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়েন অমরনাথ। দীপা পরিষ্কার হয়ে তাঁর ঘরে গেল। মশারি এখনও ফেলা হয়নি। অমরনাথ চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিলেন। মেয়ে পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই চোখ মেললেন। দীপা জিজ্ঞাসা করল, ‘কেমন আছ?’

অমরনাথ হাসলেন। কিন্তু তৎক্ষণাৎ হাসিটা কাঁপতে লাগল। তাঁর ঠোঁট মুচড়ে উঠল। চোখ বন্ধ হল। চোখের দুই কোণ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। দীপা ধীরে ধীরে ওঁর মাথার পাশে উঠে বসল। আঙুলের ডগায় জলের ধারা মুছিয়ে দিয়ে বলল, ‘কেঁদো না। কাঁদলে তোমার শরীর আরও খারাপ হবে।’

অমরনাথ একটা বড় নিশ্বাস ফেললেন। দীপা ওঁর মাথায় গালে হাত বুলিয়ে দিতে আরম্ভ করল। ধীরে ধীরে অমরনাথ নিজের ডান হাত দীপার কোলের ওপর রাখলেন। অঞ্জলি কাজ সেরে ঘরে ঢুকতে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। দৃশ্যটি সে দেখল, দেখে খুশি হল। ওরা কেউ কোনও কথা বলছে না। অন্যদিন ঘুমের ওষুধ না খেলে অমরনাথের কিছুতেই ঘুম আসে না। আজ পনেরো মিনিটের মধ্যে তিনি নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়লেন। অঞ্জলির মনে পড়ল, ঠিক এইভাবেই অনেক অনেক বছর আগে মেয়েকে পাশে নিয়ে শুয়ে অমরনাথ নিজেই ঘুমিয়ে পড়তেন আর মেয়ে চুপিচুপি উঠে আসত।

রান্নাঘরে গিয়ে দীপা জানতে পারল তাদের টিকিট হয়েছে পরশু। ম্যানেজার বলে পাঠিয়েছেন এখান থেকে বাগানের গাড়িতে সবাইকে পৌঁছে দেওয়া হবে শিলিগুড়িতে। বেলা একটায় বেরিয়ে পড়তে হবে। মনোরমা আর অঞ্জলির ব্যস্ততা বেড়ে গিয়েছে। পরশু যেন আগামীকাল। বুধুয়া ফিরে এল। সে বলল ডাক্তারবাবু থেকে গিয়েছেন মাস্টারমশাইয়ের বাড়িতে। ওঁর নাকি ব্যথা খুব বেড়েছে। দীপা অঞ্জলিকে সব বলল। কাল সকালে চা খেয়েই দীপা মাস্টারমশাইয়ের কাছে যাবে।

অঞ্জলি দরজায় শব্দ করতে মনোরমার ঘুম ভাঙল। তখন রাত শেষ হয়েছে কিন্তু দিন আরম্ভ হয়নি। মনোরমা দরজা খুলতেই অঞ্জলি বলল, ‘ডাক্তারবাবু এইমাত্র বাড়ি ফিরলেন।’

কেন, মনোরমা বুঝতে পারলেন না।

‘আমার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। বাইরের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। দেখি উনি ফিরছেন।’ কথাগুলি বলার সময় অঞ্জলি দেখল দীপা বিছানা ছেড়ে উঠে এসেছে। সে পরিষ্কার গলায় প্রশ্ন করল, ‘উনি কী বললেন?’

‘আজ ভোরে সাড়ে তিনটের সময় মাস্টারমশাই চলে গিয়েছেন।’

হঠাৎ একটা কান্না ছিটকে বেরুল দীপার গলা থেকে। আর সঙ্গে সঙ্গে তার মুখে আঁচল চেপে ধরলেন মনোরমা, ‘মুখপুড়ি, করছিস কী? বাড়িতে একটা রুগি রয়েছে না? খবরটা পেলে তার কী অবস্থা হবে কেউ বলতে পারে?’

কান্না চেপে ছটফট করতে লাগল দীপা। তারপর ছুটে চলে গেল বাথরুমে। মুখে জল দিয়েই সে ছুটল উঠোন পেরিয়ে খিড়কির দরজার দিকে। প্রায় পাগলের মতো সে দৌড়াতে লাগল খালি পায়ে আসাম রোড ধরে। এখন রাস্তায় একটিও লোক নেই। প্রতিদিনের মতো পাখিরা ডাকছে গাছের ডালে ডালে। ভোর হচ্ছে। স্কুলবাড়ির সামনের মাঠের কাছে পৌঁছে থমকে গেল দীপা। তারপর হাঁটুমুড়ে বসে হাউহাউ করে কাঁদতে লাগল। যে-কান্নাটা এতক্ষণ বুকের পাঁজরায় পাক খাচ্ছিল তা ভোরের শূন্য প্রান্তরে উগরে দিতে পেরে স্বস্তি হল। একসময় সম্মোহিতের মতো সে মাস্টারমশাইয়ের বাড়ির সামনে পৌঁছাল, সেখানে কিছু ছাত্র, পাড়ার লোকজন ইতিমধ্যে ভিড় জমেছে। স্কুলের অন্যান্য মাস্টারমশাই, কিছু ছাত্র, পাড়ার লোকজন ওরা দীপাকে দেখল। দীপা উঠোনের একপাশে আঁচল দাঁতে চেপে দাঁড়িয়ে রইল। মাস্টারমশাইয়ের মৃতদেহ নিয়ে স্কুলে যাওয়া হবে কিনা এইসব কথা হচ্ছিল। শুধু ভেতর থেকে মাস্টারমশাইয়ের স্ত্রীর ভাঙলায় কান্না ভেসে আসছিল। পরিবেশের সঙ্গে একটু অভ্যস্ত হয়ে গেলে দীপা ধীরে ধীরে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে ঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়াল। সেখানে চার-পাঁচ জন মানুষ চুপচাপ বসে আছে। একজন মহিলা মাস্টারমশাইয়ের স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে আছেন। আর মাস্টারমশাই নিশ্চিন্তে শুয়ে আছেন। জীবনের সমস্ত সমস্যার বাইরে। মুখে এক অদ্ভুত প্রশান্তি। হঠাৎ দীপার কানের কাছে কেউ বলে উঠল, ‘ইউ মাস্ট রিমেম্বার দ্যাট ইউ আর ফাইটিং এগেইনসট ডেস্টিনি। কখনও পিছন দিকে তাকাইবা না।’ দীপা বিড়বিড় করল, ‘কখনও না।’

বেলা বারোটা নাগাদ সবাই তৈরি। ডাক্তারবাবু তেজেনবাবু শ্যামল এসেছে বিদায় দিতে। জিনিসপত্র ভোলা হয়ে গিয়েছে গাড়িতে। অমরনাথ ধীরে ধীরে গাড়িতে উঠলেন। তাঁর পাশে মনোরমা অঞ্জলি আর দীপা। দুই ছেলে সামনে। বুধুয়া দাঁড়িয়ে ছিল করুণ মুখে।

গাড়ি চলতে শুরু করল। কোয়ার্টার্সের সামনের মাঠ পেরিয়ে আসাম রোড ধরতেই দীপার মনে সত্যসাধন মাস্টারের মুখ ভেসে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে ঠোঁট চাপল দাঁতে, মুখে মেঘ জমল। অমরনাথ সেটা দেখতে পেয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘মন খারাপ করছে? তোর তো মন খারাপ করার কথা না। জলপাইগুড়িতে থেকে এ জায়গা ছেড়ে যাওয়া অভ্যেস হয়ে যায়নি?’ দীপা জবাব দিল না। সত্যসাধন মাস্টারের মৃত্যুর কথা অমরনাথকে জানানো হয়নি। সহজ হতে চেষ্টা করল দীপা। হঠাৎ তার মনে হতে লাগল তার জীবন এবার অন্য বাঁক নিতে যাচ্ছে।

সকল অধ্যায়

১. ১. আজ সারাটা দিন সূর্যদেব উঠলেন না
২. ২. মেয়েরা কি ভূত হয়
৩. ৩. ভালো-মন্দ বোঝার বয়স
৪. ৪. রমলা সেন
৫. ৫. সত্যসাধন মাস্টার
৬. ৬. বৃষ্টিটা চলে যাওয়ার পরে
৭. ৭. চারদিন পৃথিবীটাকে দ্যাখেনি দীপা
৮. ৮. দীপাবলীর বিয়ে
৯. ৯. বাসর এবং বউভাত
১০. ১০. দীপাবলীর ফুলশয্যা
১১. ১১. পুত্ৰটি দেহ রেখেছে
১২. ১২. রমলার চিঠি
১৩. ১৩. প্ৰাপ্তবয়স্কতা শরীরের না মনের
১৪. ১৪. চাবাগানের আশেপাশে
১৫. ১৫. আসাম রোড
১৬. ১৬. একটি মানুষের চেহারা
১৭. ১৭. জলপাইগুড়ি শহরে
১৮. ১৯. রমলা সেনের কাছে
১৯. ১৮. পুলিশের লাঠিচার্জ
২০. ২০. জলপাইগুড়ির হোস্টেলের মেয়ে
২১. ২১. দুশ্চিন্তার ছাপ
২২. ২২. একতারা বাজিয়ে গান
২৩. ২৩. দুর্দান্ত ব্যবসাদার প্রতুল বন্দ্যোপাধ্যায়
২৪. ২৪. সত্যসাধন মাস্টার এসে পড়বেন
২৫. ২৫. অমরনাথ হতভম্ব
২৬. ২৬. তিনদিন ধরে সমানে বৃষ্টি
২৭. ২৭. অমরনাথের শরীর
২৮. ২৮. কলকাতা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে
২৯. ২৯. প্রৌঢ় ভদ্রলোকটি হাঁটছিলেন
৩০. ৩০. এক অদ্ভূত অভিজ্ঞতা
৩১. ৩১. বাড়িটা শুধু পুরনো নয়
৩২. ৩২. উত্তর কলকাতার পথে পথে
৩৩. ৩৩. কলেজ এবং হোস্টেলের বাইরে
৩৪. ৩৪. দীপা অঞ্জলির দিকে তাকাল
৩৫. ৩৫. অমরনাথ শুয়ে আছেন
৩৬. ৩৬. ভবিষ্যৎ সম্পর্কে প্ৰচণ্ড অসহায়তাবোধ
৩৭. ৩৭. তিনতলার ব্যালকনি
৩৮. ৩৮. দীপা চুপ করে আছে
৩৯. ৩৯. সুভাষচন্দ্র এগিয়ে এলেন
৪০. ৪০. মেয়েটির নাম লাবণ্য
৪১. ৪১. বিছানায় টান টান দীপা
৪২. ৪২. কলেজের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে
৪৩. ৪৩. কিছু মানুষ খুন হলেন
৪৪. ৪৪. কেমন একটা সংসার-সংসার ভাব
৪৫. ৪৫. রাধা চলে এল সেজেগুজে
৪৬. ৪৬. দ্বিতীয় অভিনয় হয়ে যাওয়ার পরে
৪৭. ৪৭. কলোনি থেকে কলেজ পাড়ায়
৪৮. ৪৮. স্কটিশ চার্চ কলেজে জানাজানি হয়ে গেল
৪৯. ৪৯. একদম লেডি
৫০. ৫০. রমলা সেন চোখ ছোট করলেন
৫১. ৫১. সাতকাহন প্ৰথম পর্ব সমাপ্ত

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন