২৫. অমরনাথ হতভম্ব

সমরেশ মজুমদার

অমরনাথ হতভম্ব। সন্ন্যাসীর বয়স অনুমান করা সম্ভব নয়। তবে তাঁর দীর্ঘ দেহের গৌরবর্ণ ত্বক যেরকম কুঁচকে গিয়েছে তাতে আশির কাছাকাছি হওয়াই সংগত। মাথার জটা প্রায় সাদা, দাড়িতে লাল ছাপ লেগেছে সাদার গায়ে। সন্ন্যাসী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কত বছর বয়সে এই চাকরিতে যোগ দিয়েছ তুমি?’

অমরনাথ জবাব না দিয়ে পারলেন না, ‘অল্প বয়সেই। এখন বলুন কী করতে পারি আপনার জন্যে। রাত অনেক হয়েছে।’

‘তোমার জানতে নিশ্চয়ই কৌতূহল হচ্ছে আমি কী বলতে এসেছি?’

‘স্বাভাবিক।’

‘আমি যা বলব তার আগে আমার কয়েকটা তথ্য জানা দরকার। তুমি কি তোমার মাতুলালয়ে বড় হয়েছ?’ সন্ন্যাসী অমরনাথের মুখের দিকে তাকালেন।

‘হ্যাঁ। সেখানে থেকেই আমি স্কুলে পড়েছি।’

‘তোমার পিতা—?’

‘তিনি আমার জন্মের আগেই দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছেন।’

‘কীরকম দুর্ঘটনা?’

‘নৌকোডুবি।’

‘তোমার পিত্রালয়ের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ নেই?’

‘না। কিন্তু আপনি এইসব তথ্য জানতে চাইছেন কেন?’

‘প্রয়োজন আছে।’ সন্ন্যাসী হাসলেন, ‘এটি কে?’

‘আমার মেয়ে।’ অমরনাথ বুঝতে পারছিলেন যে তিনি সন্ন্যাসীর ব্যক্তিত্বের কাছে পরাস্ত হচ্ছেন। মানুষটির দৃষ্টিতে এমন সম্মোহনী শক্তি রয়েছে যে তিনি ওঁর আদেশ পালন করতে বাধ্য হচ্ছেন। অমরনাথ ঘাড় ঘুরিয়ে অঞ্জলি এবং দীপাকে দেখলেন।

‘তোমার সংসারে এখন ক’জন মানুষ?’

‘ছয় জন। আমার দুটি পুত্রসন্তান, এরা, আর আমার মা।’

‘তোমরা কি সুখে দিনযাপন করছ?’

অমরনাথ উত্তর দিলেন না। আজ দুপুরের পর থেকে ঈশ্বর তাঁর জীবন থেকে সমস্ত সুখ কেড়ে নিয়েছেন। দিনযাপন করতে হয় বলেই করা।

সন্ন্যাসী বললেন, ‘তুমি আমার প্রশ্নের উত্তর দাও।’

‘গৃহী মানুষের জীবন কি সুখে বাঁধা থাকে?’

‘থাকে না। তবু গৃহী পার্থিব সুখের চেষ্টা করে। তুমি করেছ নিশ্চয়!’

‘করেছিলাম।’

‘পাওনি? ব্যর্থ হয়েছ?’

হঠাৎ দীপা জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনি কী চান?’

সন্ন্যাসী হাসলেন, ‘উত্তরটা তোমার ঠাকুমা থাকলে দিতে ভাল লাগত।’

‘তিনি এখন পুজো করছেন?’

‘পুজো? তিনি কি দীক্ষা নিয়েছেন?’

‘হ্যাঁ।’ দীপা উত্তরটা দেওয়ামাত্র অঞ্জলি ফিসফিস করে বলল, ‘দ্যাখ, ঠাকুমার বোধহয় পুজো হয়ে গিয়েছে। হলে ওঁকে এখানে ডেকে আন।’

দীপা একটু জেদ দেখিয়ে বলল, ‘দাঁড়াও, আগে শুনি ওঁর কথা।’

সন্ন্যাসী দীপার দিকে তাকালেন, ‘তুমি ছাত্রী?’

‘হ্যাঁ। আমি কলেজে পড়ি।’

‘হুঁ। অনেক পড়াশুনা হবে তোমার।’

অঞ্জলি এতক্ষণ উসখুস করছিল। এবার সুযোগ পেয়ে বলে ফেলল, ‘দেখুন তো, ইনি আবার জেদ ধরেছেন জলপাইগুড়ির কলেজে পড়তে যাবেন না।’

‘জেদ? না-পড়ার জন্যে জেদ! কেন? নিজের স্বভাবের উলটো আচরণ করছ কেন?’

‘আমার কী স্বভাব তা আপনি জানেন?’ দীপা জিজ্ঞাসা করল।

‘তোমাদের বংশে কি কোনও মেয়ে কলেজে ভরতি হয়েছে?’

প্রশ্নটার উত্তর দিলেন অমরনাথ, ‘না। ও প্রথম। অবশ্য—!’

‘অবশ্য কী?’

‘দীপা আমাদের মেয়ের চেয়ে আপন। জন্মমাত্র ওকে আমরা সন্তানের মতো লালন করেছি। আমার শ্যালিকা ওকে জন্ম দিয়েই মারা গিয়েছিল। সেই দিন থেকে, যদিও রক্তের কোনও সম্পর্ক নেই, কিন্তু আমরা মনে করি হৃদয়ের সম্পর্ক রক্তের চেয়ে মূল্যবান।’

সন্ন্যাসী দীপার মুখের দিকে আবার তাকালেন, ‘পড়াশুনা তোমাকে করতে হবেই মা। তা থেকে তোমার নিষ্কৃতি নেই। কিন্তু একটা কথা, অন্তত তিরিশ বছর না হলে বিবাহ কোরো না। বাঙালি মেয়েদের পক্ষে বয়সটা যদিও খুব বেশি তবু তিরিশ পর্যন্ত অপেক্ষা করা উচিত।’

অঞ্জলি কৌতূহল দমন করতে পারল না, ‘কেন?’

‘শুনতে খারাপ লাগবে কিন্তু এ-মেয়ের কপালে বৈধব্য লেখা আছে যদি অল্প বয়সে বিবাহ হয়। এ ছাড়া মেয়েটি নিজের ভাগ্য নিজে গড়ে নেবে।’

অঞ্জলি জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনি হাত দেখতে পারেন?’

সন্ন্যাসী সশব্দে হেসে উঠলেন, ‘না মা। ওসব বিদ্যে আমার জানা নেই। তবে গুরুর আশীর্বাদে কখনও কখনও কারও মুখের দিকে তাকালে কেউ যেন কানে কানে আমাকে তার সম্পর্কে কিছু বলে যায়।’

দাপা হেসে ফেলল, ‘এই বাড়িতে আসার আগে বুঝি আপনি এখানকার কারও সঙ্গে আমাদের বিষয়ে আলোচনা করেছেন?’

সন্ন্যাসী অবাক হলেন, ‘মানে?’

দীপা বললে, ‘আপনি যেসব কথা বলছেন তা এখানকার সবাই জানেন।’

সন্ন্যাসীর মুখ গম্ভীর হয়ে গেল, ‘কারও সঙ্গে এ-বিষয়ে আলোচনা করার সৌভাগ্য আমার হয়নি। তা ছাড়া তোমার ভবিষ্যতে কী ঘটবে তা সবাই জানবে কী করে?’

‘আপনি যা ভবিষ্যতে হবে বলছেন তা অতীতে ঘটে গিয়েছে।’

সন্ন্যাসী অবাক হয়ে গেলেন। অমরনাথ চুপচাপ শুনছিলেন। দীপাকে তাঁর বেশ বাচাল বলে মনে হচ্ছিল। অনর্থক কথা বাড়াচ্ছে সে। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি বলছিলেন আমার সঙ্গে আপনার কিছু কথা আছে। সেটা যদি শেষ করেন তা হলে ভাল হয়। রাত বাড়ছে। আমি খুব ক্লান্ত।’

সন্ন্যাসী বললেন, ‘এ-সময়ে এসেছি বলে আমি দুঃখিত। বেশ, আমার কথা শেষ করি।’

এইসময় অঞ্জলি মুখ ঘুরিয়ে দেখল মনোরমা আসছেন। সে বলল, ‘মা এসে গিয়েছেন। আসুন মা!’ সন্ন্যাসী মুখ খুলতে গিয়েও থেমে গেলেন। তাঁর চোখ এখন অঞ্জলির পাশে, দরজার দিকে। মনোরমা ধীরে ধীরে সেখানে এসে দাঁড়ালেন।

মনোরমা সন্ন্যাসীকে দেখলেন। এত রাত্রে একজন সন্ন্যাসী কখনও কারও বাড়িতে আসে বলে তিনি শোনেননি। অমরনাথ বললেন, ‘ইনি আমার মা।’

‘হ্যাঁ। ওঁর চেহারার সামান্যই পরিবর্তন হয়েছে।’ সন্ন্যাসী মৃদুস্বরে বলতেই মনোরমা চমকে উঠলেন। তাঁর নিশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল। দু’চোখে অন্ধকার দেখলেন তিনি। তাঁর সমস্ত চেতনা লোপ পেয়ে গেল। শেষবার চেষ্টা করলেন দরজা আঁকড়ে ধরতে। সন্ন্যাসী বলে উঠলেন, ‘ওঁকে ধরো।’ তাঁর গলার স্বর এত উচ্চগ্রামে ছিল যে অঞ্জলি চমকে গিয়ে শাশুড়িকে পড়ে যেতে দেখে দু’হাতে জড়িয়ে ধরল। অমরনাথ ছুটে এলেন। তিনিও মনোরমাকে আর এক পাশে ধরলেন। সন্ন্যাসী বললেন, ‘ওঁকে ওখানে শুইয়ে দাও।’

মনোরমাকে খাটের ওপর শুইয়ে দেওয়া হল। ঘরের কেউ মনোরমার এই আকস্মিক পরিবর্তনের কারণ বুঝতে পারছিল না। অঞ্জলি দ্রুত পাখা নিয়ে এসে বাতাস করা শুরু করল। অমরনাথ মনোরমার ওপর ঈষৎ ঝুঁকে ডাকতে লাগলেন, ‘মা, মা, তোমার কী হয়েছে?’

অঞ্জলি বলল, ‘তুমি ডাক্তারবাবুকে খবর দাও।’

সন্ন্যাসী বললেন, ‘মুখে একটু জল দাও। ডাক্তারের প্রয়োজন হবে না।’

দীপা এতক্ষণ চুপচাপ সব লক্ষ করছিল। সন্ন্যাসীর উপদেশ শেষ হওয়ামাত্র সে জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনাকে দেখামাত্র ঠাকুমার এমন হল কেন?’

সন্ন্যাসী গম্ভীর মুখে বললেন, ‘এ থেকে প্রমাণিত হল মনের সঙ্গে শরীরের সম্পর্ক রয়েছে। আমার ভাবতে ভাল লাগছে তোমার ঠাকুমার মনের কোনও পরিবর্তন হয়নি।’

এইসময় মনোরমা চোখ মেললেন। অঞ্জলি ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘মা, কী হয়েছে আপনার? শরীর খারাপ লাগছে?’

মনোরমা জবাব দিলেন না। তাঁর নিশ্বাস দ্রুত পড়ছিল। অঞ্জলি আবার হাওয়া করতে চাইলে তিনি নিষেধ করলেন, ‘থাক।’ তারপর চোখ বন্ধ করলেন। ঘরের কেউ কোনও কথা বলছিল না। মিনিটখানেক চুপচাপ শুয়ে থাকার পর মনোরমা উঠে বসলেন অঞ্জলির আপত্তি সত্ত্বেও। তাঁর চোখ এবার সন্ন্যাসীর দিকে। সন্ন্যাসীও চোখ ফেরাচ্ছিলেন না। মনোরমা বেশ রুগ্ণ গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি কে?’

‘আমাকে দেখে যা মনে হয় আমি তাই?’

‘তা হলে এখানে এসেছেন কেন?’

‘তুমি অসুস্থ। কথা বললে আরও উত্তেজিত হয়ে পড়বে।’

‘সেটা আমি বুঝব। কেন এসেছেন?’

‘সন্ন্যাসীরও সংসারের প্রতি কিছু দায় থাকে। সেই দায় মেটানোর প্রয়োজন হয় পঞ্চাশ বছর সাধনার পর। তবে আমার আসার জন্য কারও কোনও ক্ষতি হোক আমি চাই না।’

মনোরমা বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ সন্ন্যাসীকে দেখলেন। তারপর অঞ্জলির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তোমরা সবাই এই ঘর থেকে যাও তো। আমি একা ওঁর সঙ্গে কথা বলতে চাই। আমি ডাকলে এ-ঘরে এসো।’

অঞ্জলি অমরনাথের দিকে তাকালে তিনি ইশারা করলেন আদেশ মান্য করতে। যদিও তাঁর এই রহস্যময় ব্যাপারে কৌতূহল বেড়ে যাচ্ছিল। অঞ্জলি দীপাকে ডাকলেন ঘর থেকে চলে আসবার জন্যে। ওরা সবাই চলে গেলে মনোরমা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘না, আমার ভুল হতে পারে না। আপনার প্রকৃত পরিচয় জানতে চাই। বলুন?’

সন্ন্যাসী বললেন, ‘প্রথমে বলে রাখি তুমি খেয়াল রাখবে যে হিন্দুঘরের বিধবা হিসেবে তোমার যা করণীয় তা থেকে সরে আসার কোনও কারণ ঘটেনি। কোনও গৃহী যখন সন্ন্যাসীর জীবন যাপন করেন তখন সংসারী মানুষের কাছে তিনি মৃত হয়ে যান। মনোরমা, তোমার অনুমান অভ্রান্ত। নৌকোডুবিতে আমার শারীরিক মৃত্যু ঘটেনি, আমাকে তুমি ঠিকই দেখছ। নদীতে ডুবে যাওয়ার পর কোথায় ভেসে উঠেছিলাম, কোন সাধুর প্রভাবে পড়ে আমি হিমালয়ে গেলাম, সেসব কথা এখন অবান্তর। নৌকাডুবিতে আমার সাংসারিক অস্তিত্বের মৃত্যু ঘটেছে। এবং সেই কারণেই তোমার এই বৈধব্যজীবন ধর্মমতে সংগত।’

মনোরমা থরথর করে কেঁপে উঠলেন। তারপর দু’হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে উঠলেন। তাঁর কান্নার শব্দ সম্ভবত ভেতরের ঘরেও যাচ্ছিল। এবং আচমকা তিনি হাত সরিয়ে ভেজা চোখে বলে উঠলেন, ‘বিশ্বাস করি না। আমার বাবা সব জায়গায় খবর নিয়েছিলেন। আমি যাঁকে বিয়ে করেছিলাম তিনি অনেকদিন আগে ঈশ্বরের পায়ে চলে গিয়েছেন।’

‘বেশ তো! আমি তোমাকে কিছুই বিশ্বাস করতে বলিনি। তোমাকে নিজে থেকে কোনও কাহিনি শোনাইনি। আমার গলার স্বর শোনামাত্র তুমি চৈতন্য হারালে—!’

এইসময় ভেতর থেকে অমরনাথের গলা পাওয়া গেল, ‘মা, কী হয়েছে, কাঁদছ কেন?’

মনোরমা জবাব দিলেন না। সন্ন্যাসী বললেন, ‘তোমার ছেলেকে এখানে আসতে বলল।’

মনোরমা দ্রুত মাথা নাড়লেন, ‘না! আপনি বুজরুক। আপনাকে আমি চিনি না।’

সন্ন্যাসী মাথা নাড়লেন, ‘না, আমি বুজরুক নই। চিনতে চাইছ না সেটা তোমার ইচ্ছে। পঞ্চাশ বছর পর সন্ন্যাসীকে এক দিনের জন্যে তার গৃহে ফিরে আসতে হয়—।’

‘এসব কথা আমি শুনতে চাই না।’ মনোরমা উঠে দাঁড়ালেন। তারপর গম্ভীর ভঙ্গিতে ঘর থেকে বেরিয়ে ভেতরের ঘরে পা দিতেই অমরনাথের মুখোমুখি হলেন। অমরনাথ অত্যন্ত বিস্মিত। আজ পর্যন্ত তিনি মায়ের এই চেহারা দেখেননি। ইতস্তত না করেই তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘কী হয়েছে তোমার? কাঁদছিলে কেন? খারাপ কিছু বলেছে নাকি?’

মনোরমা নিঃশব্দে মাথা নেড়ে না বললেন।

‘আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। ঠিক আছে, দেখছি।’ অমরনাথ মনোরমার পাশ কাটিয়ে বাইরের ঘরে এসে হাত জোড় করলেন, ‘কিছু মনে করবেন না। আপনার আচরণ আমাদের কাছে রহস্যময় ঠেকছে। আপনি বৃদ্ধ এবং সন্ন্যাসী। কিন্তু এর বেশি আমাদের পক্ষে সহ্য করা সম্ভব নয়। তা ছাড়া রাতও অনেক হয়েছে, এবার আপনি চলে গেলে খুশি হব।’

সন্ন্যাসী বললেন, ‘আমি এখানে থাকার জন্যে আসিনি। পথেঘাটে রাত কাটানোর অভিজ্ঞতা আমার আছে। সেই যোশীমঠ থেকে অনেক ঘুরে তোমাদের ঠিকানা বের করে শেষপর্যন্ত যে-কারণে পৌঁছাতে পেরেছি তা সম্পূর্ণ হলেই আমি চলে যাব।’

‘কারণটা তাড়াতাড়ি বলুন।’

‘তুমি ঈশ্বরের নামে যে-কোনও খাদ্যবস্তু আমাকে দান করো।’

‘মানে?’ অমরনাথ আবার হতভম্ব।

‘তুমি মনোরমার পুত্র। অতএব এই দানের অধিকারী তুমিই।’

‘কেন আমি আপনাকে দান করতে যাব? আপনি যদি অভুক্ত থাকেন তা হলে আমার স্ত্রীকে বলছি আপনাকে কিছু খাবার দিতে। অঞ্জলি—।’ স্ত্রীকে গলা তুলে ডাকলেন অমরনাথ। অঞ্জলি কাছাকাছি ছিল। ডাক শুনে চটপট চলে এল। তাকে দেখে অমরনাথ বললেন, ‘কিছু খাবার এনে ওঁকে দাও। নাটকটা শেষ হোক।’

‘নাটক!’ সন্ন্যাসী হাসলেন, ‘ঠিকই বলেছ, জীবন থেকে নাটক তৈরি হয় কিন্তু অনেক সময় জীবন নাটককে ছাপিয়ে যায়। মা, তোমার বাড়িতে কোনও ফল আছে?’

অঞ্জলি মাথা নাড়ল, ‘না।’

সন্ন্যাসী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘অন্ন? ভাত?’

‘শুধু ভাত?’

‘হ্যাঁ।’

‘সকালের রাঁধা কিছুটা রয়েছে।’

‘তাই হবে। একটা পাত্রে তার সামান্য কিছু নিয়ে এসো।’

হঠাৎ অমরনাথ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন, ‘দাঁড়ান। আপনি কী করতে চাইছেন?’

‘আমার চাওয়াটা খুবই সামান্য অমরনাথ। সন্ন্যাস নিয়ে সংসার ত্যাগ করে গেলে কোনও কোনও গোষ্ঠীর সন্ন্যাসী যদি পঞ্চাশ বছর জীবিত থাকেন তা হলে তাঁকে একদিনের জন্যে তাঁর সংসারে ফিরে এসে পুত্র কন্যা অথবা স্ত্রীর হাতের দান গ্রহণ করতে হয়। নইলে তার সাধনা সম্পূর্ণ হয় না। বলতে পারো নিজের স্বার্থেই আমি তোমাদের কাছে এসেছি।’ সন্ন্যাসী খুব ধীর গলায় কথাগুলো বলে গেলেন।

অমরনাথের দুই চোখ বিস্ফারিত। তাঁর কথা বলার শক্তি লোপ পেয়ে গেল কয়েক মুহূর্তের জন্যে। এইসময় অঞ্জলি চিৎকার করে উঠল, ‘এ আপনি কী বলছেন?’

‘আমি সত্যি কথাই বলছি মা।’

‘না!’ তীব্র স্বরে শব্দটি উচ্চারণ করে মনোরমা দরজায় ছুটে এলেন, ‘ওঁর কথা বিশ্বাস কোরো না বউমা, মিথ্যে মিথ্যে, সব বুজরুকি।’

সন্ন্যাসী চোখ বন্ধ করলেন। সাদা দাড়ি গোঁফ সত্ত্বেও তাঁকে পাথরের মতো দেখাচ্ছিল। অমরনাথ এবার চেতনায় এলেন, আপনি যা বলছেন তা দায়িত্ব নিয়ে বলছেন!’

‘দ্যাখো, তোমাদের কাছে আমার অন্য কিছু চাওয়ার নেই। না টাকাপয়সা, না বিষয় সম্পত্তি। মিথ্যাচার করে আমি কী পেতে পারি? এখনই এই রাত্রে আমি চলে যাব। হয়তো এই জীবনে তোমাদের সঙ্গে আমার আর দেখা হবে না। আমার গোষ্ঠীর নিয়ম পালন করতেই তোমাদের বিরক্ত করতে এসেছি। তোমরা অসংযত হয়ো না।’

হঠাৎ অত্যন্ত অসহায় হয়ে পড়লেন অমরনাথ। তিনি বুঝতে পারছিলেন না কী করবেন! এই বৃদ্ধ সন্ন্যাসী তাঁর পিতা? যে-মানুষটিকে জন্মইস্তক মৃত বলে জানেন, তিনি তাঁর সামনে বসে দান চাইছেন? পিতৃস্নেহের প্রতি তার লোভ ছিল ছেলেবেলা জুড়ে। বন্ধুদের প্রত্যেকের বাবা ছিল শুধু তাঁর নয়। সেই মানুষটিকে আজ সামনে পেয়ে—। না, মনোরমা স্বীকার করেননি এখনও। বাবার চেহারার যে-বর্ণনা তিনি শুনেছেন তার সঙ্গে সন্ন্যাসীর বয়স সত্ত্বেও কিছু মিল রয়েছে। তিনি চোখে দেখেননি। কিন্তু চিনতে যদি কেউ পারেন তিনি হলেন মনোরমা। অমরনাথ মায়ের দিকে ঘুরে কাঁপা গলায় প্রশ্ন করলেন, ‘মা, তুমি বলো, ইনি আমার বাবা?’

মনোরমা মুখে আঁচল চাপা দিলেন।

অমরনাথ বললেন, ‘মা, তুমি চুপ করে থেকো না। যদি ইনি মিথ্যা কথা বলেন তা হলে যাতে এই চা বাগান থেকে সশরীরে না বেরুতে পারেন তার ব্যবস্থা আমি করব।’

মনোরমা অফুটে বললেন, ‘না।’

অমরনাথ উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি স্পষ্ট বলো মা, এটা সত্যি?’

মনোরম সেই অবস্থায় মাথা নাড়লেন, ‘আমি জানি না।’ তাঁর মুখ থেকে আবার কান্না ছিটকে উঠল। এবং এতক্ষণ চুপচাপ দেখে গিয়ে দীপা ঘবের মাঝখানে এগিয়ে এল, ‘তোমরা একটু চুপ করো। শুনুন, আপনি যে পরিচয় দিচ্ছেন তার সপক্ষে কোনও প্রমাণ আছে?’

সন্ন্যাসী মাথা নাড়লেন, ‘না নেই। ধরো মা, তোমাকে এখান থেকে তুলে যোশীমঠে নিয়ে যাওয়া হল। সেখানে কেউ কখনও তোমাকে দ্যাখেনি। হঠাৎ যদি কেউ তোমাকে সেখানে বলে যে তুমি কে প্রমাণ দাও তা হলে দিতে পারবে? তোমার ঠিকানা নাম যতই বললো তাতে তো তুমি এই তুমি প্রমাণিত হবে না যতক্ষণ না সেটার সত্যাসত্য পরীক্ষা করতে কেউ এখানে আসে। তাই না? পরিচিত মানুষ-সমাজ থেকে আমরা চলে গেলে পরিচয় প্রমাণ করা বড় শক্ত হয়ে পড়ে।’

দীপা সন্ন্যাসীর কথা মন দিয়ে শুনে জিজ্ঞাসা করল, ‘তা হলে আপনার পরিচয় জানতে যোশীমঠে যেতে হবে আমাদের? ব্যাপারটা কি আদৌ বাস্তব?’

‘ঠিকই, বাস্তব নয়। তা হলে আর একটা উপায় থেকে যাচ্ছে। সেটা হল যিনি চিনতে পারবেন, অর্থাৎ একমাত্র পূর্বপরিচিত ব্যক্তিই শনাক্ত করতে পারেন।’

‘এখানে আপনার পূর্বপরিচিত কেউ নেই। বাবাও পঞ্চাশ বছর আগে জন্মাননি৷ ঠাকুমাও যে কথা বললেন, তা আপনি শুনেছেন।’

‘শুনেছি।’

‘এত রাত্রে আপনি কোথায় যাবেন?’

‘পথে বের হবার আগে পথ নিয়ে কি কোনও সন্ন্যাসী চিন্তা করে মা? যিনি সম্পূর্ণ বর্জন করতে পারেন—।’

‘সন্ন্যাসীদের স্বার্থপর হতে হয়?’

‘এক অর্থে তুমি সত্যি বলছ।’

‘নিজের স্বার্থ ছাড়া যারা চিন্তা করতে পারে না তারা কী ধরনের মানুষ?’

‘বিচার করতে হবে কোন স্বার্থ? ঈশ্বরচিন্তায় মগ্ন হয়ে পার্থিব সম্পর্ক থেকে যিনি গুটিয়ে নেন নিজেকে তাঁর সঙ্গে ধনলোভী স্বার্থান্বেষীর তুলনা করা কি ঠিক?’

‘ঈশ্বরচিন্তায় মগ্ন থেকে যিনি নিজের পরিবারের থেকে বিচ্ছিন্ন হন তিনি কি একাই ঈশ্বরকে পেতে চান না? তাঁর স্ত্রীপুত্র যদি ভেসে যায় তবু তিনি নিজের পুণ্যের জন্যে সন্ন্যাসী হয়ে দিন কাটান না? অর্থাৎ ঈশ্বরকে পেতে তিনি একাই চান নিজের স্বার্থসিদ্ধি করতে। তফাতটা কোথায় আমি বুঝতে পারছি না।’

এইসময় অমরনাথ ধমকে উঠলেন, ‘দীপা! এত কথা বলার কোনও দরকার নেই।’

আর মনোরমা বললেন, ‘না অমর। দীপা ঠিকই বলছে।’

খুব অবাক হয়ে গেল দীপা। যে-ঠাকুমা দিনরাত ঠাকুর পুজো করে বস্তাপচা সংস্কার আঁকড়ে থাকেন তাঁর মুখ থেকে এমন কথা সে শুনবে ভাবতে পারেনি। সে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, ‘ঠাকুমা, ভাল করে চেয়ে দ্যাখো তো, ইনি তোমার স্বামী ছিলেন?’

মনোরমা জবাব দিলেন না। দীপা একবার বাবার দিকে তাকাল। তারপর বলল, ‘বাবা, ঠাকুমার কাছে ঠাকুরদার অনেক গল্প শুনেছি। ওঁর বাঁ দিকের বুকে একটা বড় আঁচিল ছিল। ছোটবেলায় সেটা কাটতে গিয়ে ঘা করে ফেলেছিলেন। এই নিয়ে ঠাকুমা তাঁকে খুব খ্যাপাতেন। তুমি দেখবে সেই দাগটা ওঁর শরীরে রয়েছে কিনা?’

মনোরমা বললেন, ‘আঃ, তোমরা থামবে? আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না কেন?

অমরনাথ এক পা-ও এগোলেন না। সন্ন্যাসী হাসলেন। তারপর তাঁর আলখাল্লার বাঁধন খুলে উর্ধবাঙ্গের কিছুটা উন্মুক্ত করে বললেন, ‘সম্ভবত এই দাগটির কথাই উনি তোমাকে বলেছিলেন।’

তাঁর কথা শেষ হওয়ামাত্র মনোরমা ছিটকে বেরিয়ে গেলেন ঘরের বাইরে। অমরনাথ কাঁপতে কাঁপতে বসে পড়লেন চেয়ারে। অঞ্জলি দ্রুত শাশুড়িকে অনুসরণ করল।

দীপা বলল, ‘আপনি আমাকে ক্ষমা করবেন।’

‘ঠিক হল না। এই চিহ্ন যে-কোনও মানুষের শরীরে থাকতে পারত। কাকতালীয় ভাবে সে যদি তোমাদের কাছে মিথ্যে বলতে এসে সেটা দেখাত, তা হলে এত তাড়াতাড়ি তাকে স্বীকার করা কি ঠিক?’

দীপা মাথা নাড়ল, ‘না। আর কোনও প্রমাণের দরকার নেই।’

‘কেন?’ সন্ন্যাসীর চোখে কৌতুক।

‘ঠাকুমার আচরণ প্রমাণ করছিল তিনি আপনাকে চিনতে পেরেছেন?’

‘তুমি তো অসাধারণ বুদ্ধিমতী।’

‘তাতে কিছু লাভ হচ্ছে না। কিন্তু এটা কি আপনি ঠিক করলেন! একটি মানুষ এতকাল ধরে জেনে এসেছেন যে তিনি বিধবা। তাঁর সমস্ত সত্তায় সেই ধারণা বসে গিয়েছে। এতদিন বাদে তিনি এই আঘাত কী করে সহ্য করবেন?’

‘আমি তো তাঁর কাছে মৃত।’

‘কিন্তু সেটা এখন তো সত্যি নয়।’

‘কেন নয়! আমার সাংসারিক সত্তা তো সেই কবে মরে গিয়েছে।’

‘এটা আপনি যেভাবে ভাবতে পারেন ঠাকুমা তা পারবেন কেন? তিনি আপনার শ্রাদ্ধ পর্যন্ত করেছেন। আমি বুঝতে পারছি না কী হবে?’

‘ঠিকই বলছ তুমি। মৃত মানুষ ফিরে এলে মানুষের সুখের বদলে দুঃখ বাড়ে। আমি নিজের কথাই ভাবতে গিয়ে এ-দিকটা চিন্তা করিনি।’

‘কিন্তু নৌকোডুবির পরে আপনি কী করে সন্ন্যাসী হলেন? ঠাকুমার কথা আপনার মনে পড়েনি? তাঁকে বঞ্চিত করে যাচ্ছেন একথা মনে হয়নি?’

‘না। কারণ যে-সাধু আমাকে প্রাণে বাঁচিয়েছিলেন, দীর্ঘদিন অসুস্থ হয়ে তাঁর কাছে থাকার পরে জানতে পেরেছিলাম তিনি হিমালয়ে ফিরে যাচ্ছেন। আমি তাঁর অনুমতি নিয়ে গ্রামে ফিরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করে জেনেছিলাম তোমার ঠাকুমা ইতিমধ্যে শ্রাদ্ধ করে বৈধব্যজীবন যাপন করতে আরম্ভ করেছেন। কেমন ধিক্কার এল মনে। আমি পৃথিবীতে বেঁচে আছি, অথচ আমার প্রিয়জনেরা মৃত ভেবে নিয়ে তাঁদের মতো জীবনযাপন করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। সেই মানসিকতায় আমি সাধুর কাছে ফিরে গিয়েছিলাম। তিনি আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন হিমালয়ে। ওঁকে যদি কেউ বঞ্চিত করে থাকেন তা হলে তিনি ঈশ্বর। আমি নই।’ সন্ন্যাসী কথা শেষ করতেই ঘড়িতে শব্দ বাজল। রাত গভীর হচ্ছে। সন্ন্যাসী অমরনাথের দিকে তাকালেন।

অমরনাথ বিস্ময়াবিষ্ট হয়ে এতক্ষণ কথাবার্তা শুনছিলেন। এবার চোখাচোখি হতে কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়ালেন, ‘বাবা!’

সন্ন্যাসী উত্তর দিলেন না। অমরনাথ এগিয়ে এলেন দুই হাত জোড় করে, ‘বাবা, আমাকে ক্ষমা করুন।’

‘তুমি স্বাভাবিক আচরণ করেছ অমরনাথ। এখন কি তোমার কাছে দান পেতে পারি?’

‘বাবা, আপনি যেতে পারবেন না।’

‘মানে?’

‘আপনাকে আমাদের কাছে থাকতে হবে।’ অমরনাথের গলার স্বর কাঁপছিল।

‘অসম্ভব। সন্ন্যাসী কখনও গৃহবাসী হতে পারে না।’

‘আপনাকে আমরা পেতে পারি না বাবা?’

‘না।’ সন্ন্যাসী বললেন, ‘আমার প্রার্থনা এবার পূর্ণ করো অমরনাথ।’

‘বাবা। এ-জীবনে আপনার দর্শন এভাবে পাব কখনও ভাবিনি। আমার অনেক সমস্যা। পিতা হয়ে আমাকে কিছু উপদেশ দিয়ে যান দয়া করে। আজ রাতটা অন্তত থাকুন।

‘না। রাত্রিবাস করা সম্ভব নয়।’

‘কিন্তু এখানে কোনও হোটেল দূরের কথা ধর্মশালা পর্যন্ত নেই।’

‘সেই চিন্তা তোমার নয়।’ সন্ন্যাসী হাসলেন, ‘তোমার নিজস্ব জীবনযাত্রা বলে দেবে সমস্যায় পড়লে তোমার কী ধরনের আচরণ হওয়া উচিত। সংসার জীবন এবং তার সমস্যা সম্পর্কে কোনও আগ্রহ আমার আর অবশিষ্ট নেই।’

অমরনাথ ঠোঁট কামড়ালেন। তারপর ধীরে ধীরে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। সন্ন্যাসী দীপার দিকে তাকালেন, ‘তোমার নামটি কী যেন?’

‘দীপাবলী।’

‘বাঃ। আলোকিত করো। নিজেকে প্রকাশ করো।’

‘কীভাবে?’

‘নিজের চারপাশের অন্ধকার দূর করে। আমি অনুমান করছি তোমার বিবাহ হয়েছিল। তোমার স্বামী বিগত। কিন্তু এখন এই বয়সে—, বিভ্রম হচ্ছে।’

‘আমার বাবা বোধহয় এই ব্যাপারে আপনার উপদেশ চাইছিলেন। ওঁরা কেন যে বালিকা অবস্থায় আমার বিয়ে দিলেন তা এখনও আমি বুঝতে পারিনি। বিয়ের দু’দিন বাদেই সেই ছেলেটি অসুস্থতায় মারা গেল। তার বাবার হাত থেকে আমি কোনওমতে রক্ষা পেয়ে চলে এসেছিলাম। তার দীর্ঘদিন বাদে যখন কলেজে ভরতি হলাম, তখন জানতাম না যে সেই ভদ্রলোক প্রায়শ্চিত্ত করার জন্যে আমার বাবার সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে ব্যাঙ্কে আমার নামে টাকা রেখেছিলেন, যাতে আমি পড়াশুনা চালিয়ে যেতে পারি। খবরটা ওঁর মৃত্যুর পরে আমি জেনেছি। জানার পর ওঁর নোংরা টাকায় আর পড়াশুনা করতে আমি রাজি নই। জলপাইগুড়ি শহরের কলেজ থেকে আজ আমি চলে এসেছি।’

সন্ন্যাসী হাসলেন, ‘যা ভাল মনে করেছ তাই হয়েছে।’

দীপা বলল, ‘কিন্তু আমাকে সবাই বোঝাতে চাইছেন আমি ভুল করছি।’

‘তাদের নিশ্চয়ই বোঝাবার অধিকার আছে।’ সন্ন্যাসী উঠে দাঁড়ালেন, ‘অমরনাথ কী করবে?’ বলতে-না-বলতে অমরনাথ এবং অঞ্জলি ফিরে এলেন। অমরনাথের হাতে একটি থালায় রাতের খাবার। তিনি বললেন, ‘আপনি হাত মুখ ধুয়ে তারপর নিশ্চয়ই এসব গ্রহণ করবেন?’

সন্ন্যাসী বললেন, ‘তার প্রয়োজন হবে না। এত কেন এনেছ? আমি সামান্য অন্ন চেয়েছি তোমার কাছে। তুমি ওই থালা থেকে একমুঠো আমার হাতে তুলে দাও।’

‘আপনি আমার এখানে রাতের খাবার খাবেন না?’

‘না।’ সন্ন্যাসী দুটো হাত অঞ্জলির মতো এগিয়ে ধরেও সরিয়ে নিলেন। তিনি দীপার দিকে তাকালেন, ‘শোনো মা। তুমি পথিক, পথ তোমার। সেই পথ রাজা তৈরি করেছেন না কোনও অসৎ ধনীর টাকায় তৈরি হয়েছে তা তো তোমার জানার কথা নয়। পথিকের কাজ পথ ধরে লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাওয়া। শরীরের জন্যে জীবন নয়, জীবনের জন্যে শরীর। লক্ষ্যে পৌঁছে পথিক পায়ের ধুলো ধুয়ে ফেলে জলে। সেটাই তো উচিত। পথ পড়ে থাকে পথে।’ সন্ন্যাসী আবার অমরনাথের দিকে ফিরলেন, ‘দাও।’

তাঁর বাড়ানো দুই হাতের চেটোয় এক মুঠো অন্ন তুলে দিলেন অমরনাথ। সন্ন্যাসী মনে মনে কিছু বললেন। তাঁর দুটো ঠোঁট কাপঁছিল। সযত্নে ওই অন্ন তিনি নিয়ে বেরিয়ে এলেন বারান্দায়। নেমে দাঁড়ালেন অন্ধকার আকাশের নীচে। তারপর মন্ত্র উচ্চারণ করতে করতে সেই অন্ন ছড়িয়ে দিতে লাগলেন মাটি, জল, আলো, বাতাস এবং আকাশের উদ্দেশে। হ্যারিকেনের আলোর যে সামান্য অংশ বাইরে আসতে পেরেছিল তাতে তাকে খুব রহস্যময় মনে হচ্ছিল। উৎসর্গ শেষ হলে তিনি যখন স্থির হলেন তখন অমরনাথ এবং অঞ্জলি তার পায়ের সামনে নতজানু হলেন। সন্ন্যাসী হাত তুলে আশীর্বাদ করে ধীরে ধীরে অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে আসাম রোডের দিকে এগিয়ে চললেন। আর তখন অমরনাথ ডুকরে কেঁদে উঠলেন। অঞ্জলি তাঁকে বলল, ‘তুমি ওঁকে চলে যেতে দিচ্ছ? তোমার বাবা না? যাও, আটকাও। মায়ের কথা ভাবতে পারছ? উনি চলে গেলে ওঁর কী হবে?’

অমরনাথ বললেন জড়ানো গলায়, ‘থাকলে কী ভাল হবে অঞ্জলি?’

অঞ্জলি সেটা বুঝতে চাইল না, ‘স্বামীকে পঞ্চাশ বছর পরে ফিরে পেতে স্ত্রীর ভাল লাগবে না? কী যা-তা বলছ? তা ছাড়া এত রাত্রে এই জঙ্গুলে জায়গায় উনি কোথায় থাকবেন?

দীপা চুপচাপ শুনছিল। তার চোখের সামনে একটি মানুষ বংশধরের কাছ থেকে অন্নের ডেলা গ্রহণ করে পঞ্চভূতে ছড়িয়ে দিয়ে নির্বিকারভাবে চলে গেলেন। এই সংসার এই অন্ধকার কোনও কিছুই তাঁর প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারল না। সে বলল, ‘মা, বাবা ঠিকই বলেছেন। ওঁকে ডেকে কোনও লাভ হবে না।’

দীপা ভেতরে চলে এল। বসার ঘর শোওয়ার ঘর পেরিয়ে উঠোনের বারান্দায় পৌঁছে মনোরমার ঘরের দিকে তাকাল। দরজা ভেজানো। আলো জ্বলছে। সে নিঃশব্দে দরজা খুলল। মনোরমা বসে জপ করছেন, রোজ যেমন করেন। ঠাকুমার পুজো এর আগেই শেষ হয়ে গিয়েছে বলে সে জানত। দীপা খাটের ওপর বসল।

তার চোখের সামনে এক বৃদ্ধার টানটান শরীর, যে-শরীরে কম্পন নেই। একমাত্র একবার কেঁদে ওঠা ছাড়া ঠাকুমা সমানে অস্বীকার করে গিয়েছেন ঠাকুরদার অস্তিত্ব। যাওয়ার সময় ঠাকুরদা ভুলেও ওঁকে ডাকেননি। উনি জানেন না এখনও, ঠাকুরদা চলে গিয়েছেন। সত্যি কি ঠাকুমা মনে করছেন উনি ঠাকুরদা নন। কিন্তু কী স্বার্থ নিয়ে মানুষটা এখানে আসবেন? মনোরমা যেভাবে বসে আছেন তাতে মনেই হচ্ছে না কোনও কিছু তাঁকে আলোড়িত করেছে। পুজোর সময় তাঁকে ডাকা নিষেধ। দীপা অপেক্ষা করতে লাগল।

এ-বাড়ির কোথাও কারও শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। অন্তত আধঘণ্টা কেটে যাওয়ার পর প্রণাম সেরে মনোরমা উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর নজর পড়ল দীপার ওপর। দীপা তাঁর চোখের দিকে তাকাল। তারপর জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি বিশ্বাস করো উনি ঠাকুরদা নন।’

‘নিশ্চয়ই।’ মনোরমা জবাব দিলেন।

‘কিন্তু উনি তো প্রমাণ দিলেন।’

‘কীসের প্রমাণ? বুকের দাগ আর অতীতের গল্প? তাতে কী হয়েছে? এই যে আমি পঞ্চাশ বছর ধরে বৈধব্যজীবন পালন করছি সেটা মিথ্যে হয়ে যাবে এক নিমেষে? আমার বাবা পঞ্চাশ বছর আগে অনেক খবর নিয়ে জেনেছিলেন তিনি মারা গিয়েছেন। আজ ভূতের মতো বেঁচে ফিরে এলেই হল? উঃ, আর কত বুজরুকি দেখব!’

‘তা হলে তুমি কাঁদলে কেন? কেন চলে এলে?’

‘আমি সহ্য করতে পারছিলাম না।’

‘কিন্তু ধরো ঠাকুরদা তখন মারা যাননি, আজ সত্যি উনি ফিরে এসেছেন!’

‘কে বলল মারা যায়নি! যখন মানুষের মন থেকে টান চলে যায় তখন সে বেঁচে থাকে নাকি! নে ওঠ, খেয়ে নে।’

অবাক হয়ে তাকিয়েছিল দীপা। তার মনে হল ঠাকুমা ঠিকই বলছেন। ঠাকুরদা যদি ঈশ্বরকে পাওয়ার জন্যে পঞ্চাশ বছর ধরে স্বার্থপরতা দেখান, যদি আজ সংসারে এক মুহূর্তের জন্যে এই ফিরে আসাটা স্বার্থের কারণে হয়ে থাকে, তা হলে ঠাকুমা ঠিকই করেছেন তাঁর অস্তিত্ব অস্বীকার করে। সে বলল, ‘দাঁড়াও!’

দীপা মনোরমাকে প্রণাম করল। মনোরমা তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে হঠাৎ থরথর করে কাঁপতে লাগলেন। দীপা ফিসফিস করে বলল, ‘তুমি শক্ত হও ঠাকুমা, তুমি একজন সন্ন্যাসীর চেয়েও অনেক বড়।’ একটু শান্ত হয়ে মনোরমা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুই কলেজে ফিরে যাবি তো?’

দীপা মাথা নাড়ল, ‘যাব।’ মনে মনে সে উচ্চারণ করল, পথ তুমি কার? পথিকের!

সকল অধ্যায়

১. ১. আজ সারাটা দিন সূর্যদেব উঠলেন না
২. ২. মেয়েরা কি ভূত হয়
৩. ৩. ভালো-মন্দ বোঝার বয়স
৪. ৪. রমলা সেন
৫. ৫. সত্যসাধন মাস্টার
৬. ৬. বৃষ্টিটা চলে যাওয়ার পরে
৭. ৭. চারদিন পৃথিবীটাকে দ্যাখেনি দীপা
৮. ৮. দীপাবলীর বিয়ে
৯. ৯. বাসর এবং বউভাত
১০. ১০. দীপাবলীর ফুলশয্যা
১১. ১১. পুত্ৰটি দেহ রেখেছে
১২. ১২. রমলার চিঠি
১৩. ১৩. প্ৰাপ্তবয়স্কতা শরীরের না মনের
১৪. ১৪. চাবাগানের আশেপাশে
১৫. ১৫. আসাম রোড
১৬. ১৬. একটি মানুষের চেহারা
১৭. ১৭. জলপাইগুড়ি শহরে
১৮. ১৯. রমলা সেনের কাছে
১৯. ১৮. পুলিশের লাঠিচার্জ
২০. ২০. জলপাইগুড়ির হোস্টেলের মেয়ে
২১. ২১. দুশ্চিন্তার ছাপ
২২. ২২. একতারা বাজিয়ে গান
২৩. ২৩. দুর্দান্ত ব্যবসাদার প্রতুল বন্দ্যোপাধ্যায়
২৪. ২৪. সত্যসাধন মাস্টার এসে পড়বেন
২৫. ২৫. অমরনাথ হতভম্ব
২৬. ২৬. তিনদিন ধরে সমানে বৃষ্টি
২৭. ২৭. অমরনাথের শরীর
২৮. ২৮. কলকাতা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে
২৯. ২৯. প্রৌঢ় ভদ্রলোকটি হাঁটছিলেন
৩০. ৩০. এক অদ্ভূত অভিজ্ঞতা
৩১. ৩১. বাড়িটা শুধু পুরনো নয়
৩২. ৩২. উত্তর কলকাতার পথে পথে
৩৩. ৩৩. কলেজ এবং হোস্টেলের বাইরে
৩৪. ৩৪. দীপা অঞ্জলির দিকে তাকাল
৩৫. ৩৫. অমরনাথ শুয়ে আছেন
৩৬. ৩৬. ভবিষ্যৎ সম্পর্কে প্ৰচণ্ড অসহায়তাবোধ
৩৭. ৩৭. তিনতলার ব্যালকনি
৩৮. ৩৮. দীপা চুপ করে আছে
৩৯. ৩৯. সুভাষচন্দ্র এগিয়ে এলেন
৪০. ৪০. মেয়েটির নাম লাবণ্য
৪১. ৪১. বিছানায় টান টান দীপা
৪২. ৪২. কলেজের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে
৪৩. ৪৩. কিছু মানুষ খুন হলেন
৪৪. ৪৪. কেমন একটা সংসার-সংসার ভাব
৪৫. ৪৫. রাধা চলে এল সেজেগুজে
৪৬. ৪৬. দ্বিতীয় অভিনয় হয়ে যাওয়ার পরে
৪৭. ৪৭. কলোনি থেকে কলেজ পাড়ায়
৪৮. ৪৮. স্কটিশ চার্চ কলেজে জানাজানি হয়ে গেল
৪৯. ৪৯. একদম লেডি
৫০. ৫০. রমলা সেন চোখ ছোট করলেন
৫১. ৫১. সাতকাহন প্ৰথম পর্ব সমাপ্ত

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন