সমরেশ মজুমদার
চারদিন পৃথিবীটাকে দ্যাখেনি দীপা। এই চারদিনে কালীপুজো হয়ে গেল, তার ভাসানও শেষ হল। অথচ একটি বারের জন্যেও দীপা যেতে পারেনি মণ্ডপে মণ্ডপে কেন, দিনের আলোয় সে বেরিয়ে আসেনি মনোরমার ঘর থেকে। প্রথম দিন প্রচুর কান্নাকাটি, চিৎকার করেও যখন কাজ হয়নি তখন চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল সে।
অঞ্জলি একটু আপত্তি তুলেছিল। এখন তো কেউ এসব মানে না। সে নিজেও এইসময় ঠাকুরঘরে যাওয়া ছাড়া প্রায় সব কাজই করে থাকে। শুভকাজ বা পুজোআর্চাতে সক্রিয় অংশ না নিলেই হল। কিন্তু মনোরমা এসব কথায় কান দেননি। তাঁর বক্তব্য হিন্দু মেয়েকে যে-নিয়মটা মানতে হয় প্রথমবার থেকেই দীপাকে সেটা শেখানো উচিত। তা ছাড়া বিয়ের পর যে-বাড়িতে ও যাবে সেখানে যদি পুরনো নিয়মকানুন মানা হয় তা হলে তা না জানলে মেয়েই বিপাকে পড়বে। অঞ্জলি আর কথা বাড়ায়নি। তবে সে নিজেও আর কালীপুজোর মণ্ডপে যায়নি এবার। মাটিতে কম্বল পাতা হয়েছে পাটি ছড়িয়ে। সন্ধের পর সে বাথরুমে যেতে পারে। স্নান করবে সেইসময় তেল সাবান না মেখে। এমনকী খুদে দুটোরও এই ক’দিন নিষেধ ছিল মনোরমার ঘরে ঢোকার। সত্যসাধন মাস্টার এসে এসে ফিরে যাচ্ছেন। আজ সকালে তিনি জানতে চেয়েছিলেন কী ধরনের অসুখ মেয়েটার যে তাকে দেখাই যাচ্ছে না। কঠোর মুখে মনোরমা জানিয়েছিলেন, ওইটা মেয়েলি ব্যাপার। বয়স্ক মানুষটি বুঝে নিয়ে আর কথা বাড়াননি। কালীপুজোর গভীর রাত্রে অমরনাথ মনোরমাকে ঘুম থেকে তুলে বলেছিলেন, ‘এখন তো গভীর অন্ধকার। যদি অনুমতি দাও তা হলে ওকে দূর থেকে মাকে দেখিয়ে নিয়ে আসি। পুজো শুরু হয়ে গিয়েছে।’
মনোরমা মাথা নেড়েছিলেন, ‘ওর খুব যন্ত্রণা হচ্ছে। হাঁটতে পারবে না।’
বিচলিত অমবনাথ জিজ্ঞাসা করেছিলেন, যন্ত্রণা হচ্ছে! ডাক্তার ডাকব?’
‘না না। ও নিয়ে তোকে চিন্তা করতে হবে না।’
মনোরমা মুশকিলে পড়েছিলেন তার পরেই। দরজা থেকে বাবা চলে যাওয়ার পর সে প্রথম কথা বলল। সারাদিনে অনেক কেঁদেছে, ঝামেলা করেছে, কিন্তু তাতে মনোরমা একটুও বিচলিত হননি। বিছানায় উবু হয়ে বসে দীপা জিজ্ঞাসা করল, ‘ঠাকুমা, আমার যা হয়েছে তা কি নিজের ইচ্ছেয় হয়েছে?’
‘এসব কি ইচ্ছেয় হয়? বিধাতা পুরুষ সৃষ্টি করেছেন যেমন প্রকৃতিও তিনিই সৃষ্টি করেছেন। তোর যা হয়েছে তা না হলে নারী প্রকৃতি হয় না। ওটা হয় আপনা আপনি, সময় হলেই।’ মনোরমা শান্ত গলায় বলে ঘুমাবার উদ্যোগ নিলেন।
‘তা হলে আমাকে ঘরে বন্দি হয়ে থাকতে হবে কেন? আমার তো দোষ নেই।’
‘দোষগুণের ব্যাপার নয়। এইসময় রোদ হাওয়া শরীরে লাগা ঠিক নয়।’
‘যাদের লাগে তাদের কী হয়?’
‘শরীর খারাপ করে।’
‘মা’র তো করে না।’
মনোরমা ঠোঁট কামড়ালেন, ‘বড়দের কথা আলাদা।’
‘আমাকে তেল সাবান মাখতে নিষেধ করেছ কেন?’
‘ওগুলো মাখলে চিত্ত চঞ্চল হয়। এইসময় মন শান্ত রাখা দরকার।’
‘চিত্ত চঞ্চল মানে?’
‘সে তুই বুঝবি না।’
‘মা তো সারামাস তেল সাবান মাখে, মায়ের চিত্ত চঞ্চল হয় না?’
‘এত কথা আমি বলতে পারব না। এবার ঘুমাতে দাও।’
‘তুমি আমাকে নিরামিষ খেতে দিচ্ছ কেন?’
‘এখন খেতে হয়।’
‘কেন খেতে হয়?
‘শরীর ঠান্ডা থাকে।’
‘আমার শরীরকে ঠান্ডা করার কোনও দরকার নেই।’
‘সেটা আমি বুঝব।’
‘আমার শরীর আর তুমি বুঝবে?’
‘যদ্দিন তুমি বড় না হও তদ্দিন বুঝব।’
‘আমি বড় হয়ে তোমার এইসব নিয়মকানুন একদম মানব না। সব বাজে। খুব খারাপ।’
পঞ্চম দিনে মেয়ে যখন স্নান করল তখন অমরনাথ খুব অবাক হলেন। এই কদিনের অন্ধকার ঘরে বাস করে মেয়েটা যেন নিস্তেজ হয়ে গিয়েছে। মুখে একটা কালচে গাম্ভীর্য এসে গেছে এর মধ্যে। হাঁটা চলায় ছটফটানি উধাও। রাত্রে অঞ্জলির মুখে শুনলেন আজ সত্যসাধনবাবু পড়াতে এসে খুব বকাঝকা করেছেন দীপাকে অন্যমনস্ক হবার জন্যে। আর বিকেলবেলাতেও মেয়ে বারান্দা থেকে নামেনি। ওর বন্ধুরা মাঠে বসে ছিল, একবারও যায়নি তাদের কাছে। অঞ্জলি বলল, ‘এত তাড়াতাড়ি মেয়েটা পালটে যাবে ভাবিনি। তোমার মা বাপু খুব বাড়াবাড়ি করেছেন। আমার নিজের ব্যাপারটা এত সাধারণ ছিল যে তখন কী ঘটেছিল আজ মনেই নেই। এ যেন জোর করে ওইটুকুনি মেয়ের মনে সব ঠেসে দেওয়া।’
অমরনাথ মুখ ফেরালেন, ‘ওইটুকুনি মেয়েকে বিয়ে দিতে তো তোমার আপত্তি নেই।’
হকচকিয়ে গেল অঞ্জলি, ‘আমি ওর ভাল চাই। পরে বড় হলে ভাল বিয়ে যে হবেই তা তুমি নিশ্চয় করে বলতে পারো? তখন মনে হবে আমরাই ওর ক্ষতি করলাম।
‘এখনই বিয়ে দিয়ে যে উপকার করবে তাই বা বলছ কী করে? যা হোক, কাল সকালে একবার ফ্যাক্টরি থেকে ঘুরে এসে আমি জলপাইগুড়িতে যাচ্ছি।’ অমরনাথ চোখ বন্ধ করলেন বিছানায় শুয়ে
অঞ্জলি আর একটা কথা বলতে গিয়ে কিন্তু কিন্তু করল খানিক। তারপর বলেই ফেলল, ‘যদি আমি তোমার সঙ্গে যাই খুব অসুবিধে হবে?’
‘তুমি যাবে মানে?’
‘নিজের চোখে দেখে আসি। তুমি তো একটা দেখলে আর একটা দেখবে না।’
সাইকেল থেকে নেমে সেটাকে স্ট্যান্ডে রেখে অমরনাথ ফ্যাক্টরির দরজায় পৌঁছে দেখলেন তুলকালাম কাণ্ড চলছে। কুলিকামিনরা ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে দূরে। সাহেব চিল-চিৎকার করছেন। তাঁর সামনে একটা চৌদ্দ-পনেরো বছরের মদেশিয়া মেয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে। ওপাশে ইঞ্জিন চলছে তাই সাহেবকে চিৎকার করতে হচ্ছে আরও জোরে।
অমরনাথকে দেখে সাহেব গলা তুলেই বললেন, ‘কাম হিয়ার। এই মেয়েটা চা চুরি করে বাড়ি যাচ্ছে। শরীর খারাপ বলে ছুটি নিয়েছিল। তোমার ফ্যাক্টরিতে রোজ এসব হচ্ছে আর তুমি খবরই রাখছ না। পুরো ব্যাপারটার জন্যে তোমাকে দায়ী করব আমি।’
সাহেব সেটা করতে পারেন। বিশাল ফ্যাক্টরির পূর্ণ দায়িত্ব অমরনাথের ওপর। তিন শিফটে কাজ হচ্ছে এখন, অমরনাথের পক্ষে চব্বিশঘণ্টা পাহারা দেওয়া সম্ভব নয়। তার জন্যে দু’জন অ্যাসিন্টেন্ট আছে, দারোয়ান আছে। অমরনাথ তাঁর সহকারীর দিকে তাকালেন। মনে হল বেচারা কিছু বলতে চাইছে কিন্তু সাহস পাচ্ছে না। অমরনাথ মেয়েটাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুই চা চুরি করেছিস। তুই তো বয়রার মেয়ে, না?’
মেয়েটা মাথা নাড়ল। সাহেব বললেন, ‘ওর বাবাকে ডাকো।’
এইসময় সহকারী ছুটে এসে অমরনাথের কানে কানে বলল, ‘সাহেব ভুল বুঝেছেন। মেয়েটা পেটে চা বাঁধেনি। ও গর্ভবতী।’
চোখ কুঁচকে মেয়েটাকে দেখে অমরনাথ বিরক্তি প্রকাশ করলেন, ‘সাহেবকে বলোনি কেন?’
‘কী করে বলব। গর্ভবতীর ইংরেজিটা এতক্ষণ মনেই আসছিল না। এইমাত্র এল।’
অমরনাথ সাহেবের পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন, ‘স্যার। কোথাও একটা ভুল হচ্ছে। এইমাত্র শুনলাম মেয়েটি প্রেগন্যান্ট। ওর পেটে চা বাঁধা নেই।’
‘ইম্পসিব্ল। তা হলে এই লোকগুলো এতক্ষণ বলত।’ সাহেব মাথা নাড়লেন।
অমরনাথ মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করলেন, এই, তোর বাচ্চা হবে?’
মেয়েটা চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। অমরনাথ রেগে গেলেন, ‘জবাব দে।’
এবার মেয়েটা মাথা নেড়ে নিঃশব্দে হ্যাঁ বলল।
অমরনাথ সমবেত জনতার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তোরা এতক্ষণ সাহেবকে বলিসনি কেন ওর বাচ্চা হবে?’
লোকগুলো প্রশ্নটা শুনে ফ্যাকফ্যাক করে হাসতে লাগল। সাহেব কিন্তু তখনও বিশ্বাস করতে পারছেন না, ‘নো মিস্টার মুখার্জি, এরা সবাই আমাদের ব্লাফ দিচ্ছে। শি শ্যুড বি একজামিনড বাই দ্য ডক্। আমি হাত দিলে তো অপমান করা হবে। তুমি কি বলতে চাও ওইটুকুনি মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে?’
হঠাৎ অস্বস্তি শুরু হল অমরনাথের। দীপা যদি বছর দুই-তিনের মধ্যে সন্তানসম্ভবা হয়? মন থেকে চিন্তাটা সরাবার জন্যেই তিনি মেয়েটাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোর স্বামীর নাম কী? এই, তোরা বল তো কে ওর স্বামী।’
একটা বুড়ি কামিন খ্যাখ্যান গলায় বলে উঠল, ‘ভাগলবা।’ জানা গেল মেয়েটির বিয়েই হয়নি। একজন পরবের সময় এসেছিল অন্য বাগান থেকে। সে প্রেমের নামে মেয়েটির সঙ্গে এইসব কাণ্ড করে সরে পড়েছে। পরে যখন জানাজানি হল তখন বয়রা গিয়েছিল ছেলেটার বাবার কাছে। ছেলেটার বাবা অস্বীকার করেছে। শেষপর্যন্ত অনেক তর্কাতর্কির পর স্থির হয়েছে বাচ্চাটা হোক। তারপর ওর মুখ দেখে যদি পাঁচজনে সাব্যস্ত করে ছেলেটার মুখের সঙ্গে মিল আছে তা হলেই বিয়ে দেওয়া হবে।
হিন্দি মেশানো মদেশিয়া বুঝতে সাহেবের অসুবিধে হয় না। শুনে ফিসফিস করে বললেন, ‘আমি বিশ্বাস করতে পারছি না ওইটুকুনি মেয়ে কারও সঙ্গে শুতে পারে অ্যান্ড দিজ পিপল আর অ্যাকসেপ্টিং দ্যাট।’
অমরনাথ জনতাকে কাজে ফিরিয়ে দিলেন জোর করে। মেয়েটার শরীর সত্যি খারাপ করছিল। তাকে ছুটি দেওয়া হল। সাহেব বললেন, ‘আই অ্যাম সরি বাট আই ফিল পিটি ফর দ্য গার্ল।’
অঞ্জলির সঙ্গে বাসে চেপে বার্নিশঘাটে যাওয়ার সময় অমরনাথের কথাটা কেবলই মনে হচ্ছিল। ‘মেয়েটার জন্যে আমার অনুকম্পা হচ্ছে।’ দাঁতে দাঁতে চাপলেন তিনি। আজ সাহেবের কাছে ছুটি নিয়েছেন অন্য কথা বলে। মেয়ের জন্য পাত্র দেখতে জলপাইগুড়ি যাচ্ছেন বলার সাহস হয়নি। বিয়ে ঠিক হলে জানাতেই হবে। নেমন্তন্নও করবেন। তখন সাহেবের কী প্রতিক্রিয়া হবে? এইভাবেই কি বলবেন, ‘মেয়েটার জন্যে আমার অনুকম্পা হচ্ছে।’ চা-বাগান ছাড়িয়ে ডুডুয়ার ব্রিজে উঠল গাড়ি। অমরনাথ অঞ্জলির দিকে তাকালেন। ইস্ত্রি-ভাঙা শাড়ির রং হালকা নীল হলেও ওকে শাশুড়ি বলে কিছুতেই মেনে নেওয়া যাচ্ছে না। এমনিতে অঞ্জলির শরীরের বাঁধুনি ভাল। সামান্য সাজলেই বয়সটা আরও কমে যায়। কেবলই মনে হচ্ছে ঠিক করছেন না কাজটা। চোখ বন্ধ করলেন অমরনাথ। আর তারপরই শিউরে উঠলেন। দীপা দিনরাত ছেলেগুলোর সঙ্গে মেশে। এখন ক’দিন পরিবর্তনের ধাক্কায় হয় ব্যাপারটা চাপা আছে। আবার যে শুরু হবে না তা কে বলতে পারে। হঠাৎ যদি খবর পান ওর বাচ্চা হবে, তা হলে। মাথার ভেতরটা গরম হয়ে গেল। বয়রার মতো তাঁকেও যদি ছেলের বাবা বাচ্চার জন্ম পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলে, ফ্যাক্টরির দরজায় দাঁড়ানো মাথা নিচু করা মেয়েটার ভঙ্গি মনে পড়ে গেল তাঁর। সঙ্গে সঙ্গে সোজা হয়ে বসলেন। দিনরাত বারুদ আগলে বসে না থেকে বাক্সে পুরে দেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। এরকম মনে হতেই মন অনেক হালকা হয়ে গেল।
বাসগুলোর ছোটা শেষ হয় বার্নিশঘাটে। একপাশে কিছু অস্থায়ী হোটেল, চায়ের দোকান, আর বাসের ভিড়। নদীর জল যেমন কমে বাড়ে তেমন ঘাট পালটায়। বালিতে পা দিয়ে অঞ্জলি বলল, ‘শুনেছি এখানকার রসগোল্লা খুব ভাল। খালি হাতে তো যাব না, এখান থেকেই না হয় মিষ্টি নিয়ে নাও।’
অমরনাথ মাথা নাড়লেন, ‘না না। এখানকার রসগোল্লা লালচে। দিশি গন্ধ। বড়লোক কুটুমের বাড়িতে হাতে করে বয়ে নিয়ে যাওয়া যায় না। মিষ্টি নেব কাঁটালতলা থেকে।’
নৌকোয় পাশাপাশি বসতে গিয়েও উঠে দাঁড়ালেন অমরনাথ। সিগারেট ধরানোর নাম করে খানিকটা সরে গেলেন। রাজবংশী কিছু মহিলা অঞ্জলির পাশে জায়গা নিল। এখনও এই অঞ্চলে স্বামী-স্ত্রী পাশাপাশি নৌকোয় চেপে যাচ্ছে দেখলে অনেকের নজর টাটাবে। কী দরকার। অস্বস্তিটা অঞ্জলিরও হত। অমরনাথ সরে যাওয়ায় সে গ্রাম্য রাজবংশী মহিলাদের মধ্যে রাজেন্দ্রাণীর মতো বসে রইল। তিস্তায় এখন টান ধরেছে। জল আর ভয় জাগায় না। দুই মাইল চওড়া নদী এখন দুশো গজেই শেষ। তারপর বিশাল চর হয় হেঁটে নয় পঙ্খিরাজে চেপে পেরিয়ে যাও। উপায় ছিল না বলে পঙ্খিরাজে পাশাপাশি বসতে হল তাঁদের। যেখানে ছয় জন আরামে যেতে পারে সেখানে মানুষ তুলেছে পনেরো জন। লম্বা পাদানিতেও দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। শব্দ করছে কানে তালা ধরিয়ে। সিটগুলোয় গদি নেই। বসতে অস্বস্তি। তার ওপর মানুষের চাপে অমরনাথ দরজা ঠাসা করে দিয়েছেন অঞ্জলিকে। স্বামীর শরীরের সঙ্গে মিশে গিয়েও এক ফোঁটা আবেগের বদলে এক রাশ বিরক্তি আসে তা এর আগে এত ভাল করে বোঝেনি অঞ্জলি। পুরনো আমলের জান্তব গাড়ি চলার সময় যে-পরিমাণ ধুলো ওড়াচ্ছে তাতে ভাবী কুটুমের বাড়িতে পৌঁছাবার সময় কাপড়ের অবস্থা কীরকম থাকবে তাই ভেবে উদ্বিগ্ন অঞ্জলি। অমরনাথের সেই চিন্তা নেই। দেখে মনে হচ্ছে যাওয়াটা উপভোগ করছেন যেন।
কাঁটালতলা থেকে দশটাকায় বড় বড় কুড়িটা সন্দেশ কিনে সাইকেল রিকশায় চেপে ওঁরা যখন হাকিমপাড়ায় এলেন তখন ঘড়িতে বারোটা। ভেবেছিলেন এগারোটার মধ্যে পৌঁছে যাবেন, কিন্তু সময়টা এমন যে অচেনা ভদ্রলোকের বাড়িতে যাওয়া অশোভন। শেষ বাস বার্নিশঘাট থেকে সাড়ে চারটায়। অন্তত আড়াইটের সময় শহর থেকে রওনা হতে হবে। বারোটা আর দুটোর মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। ভদ্রতার কথা না ভেবে দেখা করবেন বলে ঠিক করলেন অমরনাথ। অঞ্জলি বলল, ‘শোনো, ভরদুপুরে যাচ্ছি। হয়তো ওঁরা খাওয়ার কথা বলবেন, কিন্তু তুমি কিছুতেই রাজি হবে না।’
‘আমার কিন্তু এর মধ্যে খিদে পেয়ে গেছে।’ অমরনাথ হাসলেন।
‘পাক। বলবে ভাত খেয়ে বেরিয়েছি। যাওয়ার সময় ঘাটের হোটেলে খেয়ে নেব না হয়।’
প্রতুল বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি বলতেই রিকশাওয়ালা বলে দিল, ‘কোনও চিন্তা করবেন না বাবু। ঠিক পৌঁছে দেব।’
হাকিমপাড়ায় পৌঁছে একটা পাঁচিল দেখিয়ে রিকশাওয়ালা যখন বলল, ‘এসে গেছি, ওইটে হল ওঁর বাড়ি’— দেখে অঞ্জলির চক্ষু চড়কগাছ। বাড়ি কোথায়? শুধু আম কাঁঠাল জামরুলের বন পাঁচিলের এপাশ থেকে দেখা যাচ্ছে। প্রায় দুশো গজ রাস্তা ঘিরে থাকা পাঁচিলের মাঝখানে এসে ওঁরা গেট দেখতে পেলেন। সাদা গেট বন্ধ। রিকশাটাকে ওখানেই ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন অমরনাথ। কিন্তু রিকশাওয়ালা বলল, যে গেট খুলে ভেতরে যাওয়ার অভ্যেস তার আছে। গেটের মুখে শ্বেতপাথরের দুটো ফলক। একটায় লেখা লক্ষ্মীধাম, হাকিমপাড়া। অন্যটায় প্রতুল বন্দ্যোপাধ্যায়।
ভেতরে ঢোকার পর কয়েকটা ইউক্যালিপটাস গাছ দেখতে পেলেন অমরনাথ। বড়লোক বললে কম বলা হবে। প্রতুলবাবুর দাদাকে দেখে মনেই হয়নি তাঁর ভাই এত অবস্থাপন্ন। শুধু টাকা নয়, রুচিও আছে, নইলে বাগানটাকে কেউ এত যত্নে সাজায় না। বাড়িটাকে দেখতে পেলেন এবার। একতলা বাংলো প্যাটার্নের বাড়ি। সামনে একটা গাড়িও দাঁড়িয়ে আছে।
হঠাৎ অঞ্জলি বলল, ‘ঠিক বাড়িতে এসেছি তো?’
অমরনাথ বললেন, ‘গেটে তো নাম দেখলে।’
‘চলো ফিরে যাই। এত বড়লোকের বাড়ি, আমার খুব ভয় করছে।’
‘বড়লোক তো বটেই। আমার মতো একশোজন লোক কর্মচারী রাখতে পারে।’
‘মালিকের সঙ্গে কুটুম্বিতা করতে যাওয়া ধৃষ্টতা।’
‘এসেছি যখন দেখা করেই যাই। এই কথাটাই না হয় বলব।’
রিকশাওয়ালাকে বসিয়ে রাখলে পয়সা দিতে হবে বেশি। কিন্তু তবু অমরনাথ রাজি হলেন। কয়েক মিনিটের মধ্যে কথা শেষ করে যখন বেরুবেন তখন গেট পর্যন্ত এতটা পথ অঞ্জলিকে নিয়ে হেঁটে যেতে খারাপ লাগবে।
ওদের দেখে ধুতি শার্ট পরা কর্মচারী গোছের একটি লোক বেরিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করল, ‘কাকে চাইছেন?’
‘আজ্ঞে, শ্রীযুক্ত প্রতুল বন্দ্যোপাধ্যায় মশাই আছেন?’
‘হ্যাঁ, আছেন। কী প্রয়োজন?’
‘আমাদের আসার কথা ছিল। ওঁর দাদা বলে রেখেছেন।’
‘উনি তো এখন আহারে বসেছেন।’
‘ও। আহার শেষ হলে বলবেন, আমার নাম অমরনাথ মুখোপাধ্যায়।’
কর্মচারীটি ওঁদের বাঁ দিকের একটা ঘরে বসাল। সেখানে কয়েকটা কাঠের চেয়ার এবং বেঞ্চি পাতা। লোকটা চলে গেলে অমরনাথ বললেন, ‘সত্যি অসময়ে এসে পড়েছি।’
অঞ্জলি ঘরটা দেখছিল। একপাশে টেবিলের ওপর কাগজের স্তূপ। আর একটি টেবিলে একজন বৃদ্ধ একমনে কাজ করছেন। এত বড়লোকের বাড়ির বৈঠকখানা একদম সাজানো নয়। বাগানে দু’-তিনটি ঘুঘু একসঙ্গে ডেকে যাচ্ছে।
মিনিট কুড়ি পরে একজন কেউ চিৎকার করে বলতে বলতে এলেন, ‘ছি ছি ছি। করেছ কী? অফিসঘরে বসিয়ে রেখেছ ওঁদের? মানুষ দেখে চিনতে পারো না। খাচ্ছিলাম তো কী হয়েছে! তখনই গিয়ে বললে না কেন?’
মানুষটি হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকলেন। দামি পাঞ্জাবি, ধুতি। গোটা ছয়েক আংটি আঙুলে। গায়ের রং বেশ কালো। মোটাসোটা, মাথায় ঈষৎ টাক। বিশাল দুটো হাত জোড় করে অমরনাথের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘মার্জনা করুন। আমার কর্মচারীটি বুঝতে না পারায় আপনাদের অনাবশ্যক কষ্ট করতে হল। লজ্জায় মরে যাচ্ছি আমি। ছি ছি ছি। আসুন আসুন।’
আপ্যায়নের বহর দেখে অমরনাথ অভিভূত। অঞ্জলি মাথার আঁচল আরও টেনে দিল। প্রায় হাত ধরে প্রতুলবাবু অমরনাথকে নিয়ে এলেন যে-ঘরে সেটি অবশ্যই বসবার ঘর এবং বিত্তবান বাড়িওয়ালার সব পরিচয় সেখানে ছড়ানো। অমরনাথের বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল প্রতুলবাবুর অমায়িক আচরণে। বারংবার ক্ষমা চেয়ে নেওয়ার পর বললেন, ‘এখন কোনও কথা নয়। আপনারা হাতমুখ ধুয়ে খাওয়াদাওয়া করুন তারপর আলাপ করব।’
অমরনাথের শক্তি সঞ্চয় করতে হল কথা বলতে, ‘আজ্ঞে, আমরা খাওয়াদাওয়া করে এসেছি।’
‘অ্যাঁ। সেকী? না না। এ আপনারা ঠিক করেননি। অতিথি নারায়ণ। নারায়ণের সেবা থেকে আমাকে বঞ্চিত করবেন? পাপ হবে যে। আপনি আসুন আমার সঙ্গে? আমার গৃহিণী আপনার সঙ্গে আলাপ করবেন বলে ব্যস্ত হয়েছেন শোনামাত্র।’
অঞ্জলি কী করবে বুঝতে না পেরে অমরনাথের দিকে তাকাল। প্রতুলবাবু সেটা লক্ষ করেই বললেন, ‘আচ্ছা ঠিক আছে। ভেতরের ভার যাঁর ওপর তাঁকেই ডেকে আনাচ্ছি। আসলে এখনও আমরা কয়েকটা পুরনো নিয়ম মেনে চলি। বাড়ির মেয়েরা চট করে পরপুরুষের সামনে বেরুতে চান না। অবশ্য আপনাকে পরপুরুষ তো বলা যাবে না। আজ বাদে কাল আমরা তো আত্মীয় হয়ে যাচ্ছি।’ প্রতুলবাবু ব্যস্ত ভঙ্গিতেই ভেতরে চলে গেলেন।
অমরনাথ এবার কথা বলার শক্তি ফিরে পেলেন, ‘কী অমায়িক ব্যবহার দেখেছ!’
অঞ্জলি কিছু বলল না। নিজেকে নিয়েই যেন সে বিব্রত হচ্ছিল। যে-সোফায় বসেছে তা যেন শরীরটাকে ভেতরে টানছে। এত বৈভবের মধ্যে কিছুক্ষণ থাকলেই অস্বস্তি হয়। দীপা কি এদের সঙ্গে মানিয়ে থাকতে পারবে?
অমরনাথ আবার বললেন নিচু গলায়, ‘কী করা যায় বলো তো! খাওয়ার কথা বলছেন, না খেলে দুঃখ পাবেন— !’
‘আমি আজ খাব না।’ চাপা গলায় অঞ্জলি বলল।
সেইসময় ফিরে এলেন প্রতুলবাবু, ‘আসছেন তিনি। আপনার সামনে আসতে হবে বলে সাজতে বসে গেছেন। মেয়েমানুষের যা হয়! আহা, আপনি আবার কিছু মনে করবেন না।’
প্রতুলবাবু বসলেন আরাম করে। এবার অমরনাথ বললেন, ‘আপনারা তো এখনও মেয়েকে দ্যাখেননি, চোখে দেখে কথা বলে পছন্দ অপছন্দের ব্যাপারটা নিয়েও ভাবতে হবে তো।’
‘আপনার মেয়ের বয়স কত?’
‘আজ্ঞে এগারো হয়ে গেছে।’
অঞ্জলি চাপা গলায় বলল, ‘এগারো বছর পনেরো দিন।’
‘গুড। চোখ মুখ?’ প্রতুলবাবু হাসিমুখে জিজ্ঞাসা করলেন।
অমরনাথ জবাব দিলেন, ‘পাঁচজনে তো ভালই বলে।’
‘গায়ের রং?’
‘ধবধবে ফরসা নয়, উজ্জ্বল বর্ণ বলতে পারেন।’
‘হয়ে গেল। দেখুন অমরনাথবাবু, আমার দাদাকে আমি চিনি। নিজের ব্যাপারে উদাসীন কিন্তু অন্যের ব্যাপারে পান থেকে চুন খসবে না। বছরখানেক আগে ওঁকে বলেছিলাম যে ঘরে গৌরী আনব। এতদিন কিছু বলেননি। হঠাৎ চা-বাগান থেকে ঘুরে এসে বললেন, প্রতুল, তোর ছেলের বউকে দেখে এলাম। সঙ্গে সঙ্গে আমি লোক পাঠালাম। সে ঘুরে এসে বলল, ডানাকাটা নয় তবে ভারী মিষ্টি মেয়ে। আর কী দরকার বলুন?’
অমরনাথ বললেন, ‘তবু আপনারা নিজেরা চোখে না দেখে— ।’
‘দেখব। যদি তাতে আপনারা শান্তি পান তা হলে দেখতে আপত্তি কী! আমি মশাই ব্যবসায়ী মানুষ। সব তো চোখে দেখা যায় না, কানেও দেখতে হয়। সেই দেখাটা যাতে ভুল না হয় তাই দু’বার যাচাই করে নিই। তবু যখন বলছেন— ।’
অমরনাথ এবার কথাটা বলেই ফেললেন, ‘প্রতুলবাবু, আমি সামান্য চাকরি করি। ভাত কাপড়ের অভাব হয় না বটে কিন্তু—! আপনার তুলনায় আমার অবস্থা, তুলনা করাই যায় না। এই অসম অবস্থায় সম্পর্ক করার ধৃষ্টতা আমার নেই। আমি শুনেছিলাম আপনি ব্যাবসা করেন, কিন্তু চোখে দেখার পর— ।’
হো হো করে হেসে উঠলেন প্রতুলবাবু। যেন এমন মজার কথা খুব কম শুনেছেন। তারপর গাঢ় গলায় বললেন, ‘আরে মশাই, টাকা পয়সা বিষয় সম্পত্তি এই আছে এই নেই। কিন্তু মনুষ্যত্ব ভদ্রতা আন্তরিকতা এসবের মৃত্যু নেই। মানুষকে এইজন্যেই মানুষ মনে রাখে। আর এগুলো তো টাকাপয়সা থাকা-না-থাকার ওপরে নির্ভর করে না।’
এইসময় ভিতরের দরজার বাইরে শব্দ বাজল চুড়ির। প্রতুলবাবু বললেন, ‘এসো।’
যে-মহিলা ঘরে এলেন তাঁর বয়স বোঝা যাচ্ছে না। ঘোমটা কপালের ওপর। শাড়ি দেখেই অবাক হয়ে গেল অঞ্জলি। বাড়িতে যে-শাড়ি ইনি পরেছেন তার অর্ধেক দামের শাড়ি পরে এসেছে সে। দুটো হাত ভরতি সোনার চুড়ি, আঙুলের হিরের আংটি থেকে দ্যুতি ছড়াচ্ছে। তবে মহিলার গায়ের রং কালো। মোটাসোটা চেহারায় গিন্নিভাবটি স্পষ্ট। অমরনাথ নমস্কার করছে দেখে অঞ্জলিও করল। মহিলা বসলেন না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘মেয়ের ছবি আছে সঙ্গে? দেখার বড় ইচ্ছে হচ্ছে।’
অমরনাথ উঠে দাঁড়িয়ে কথা বলতে গিয়েও সামলে নিলেন, ‘না, মানে, এখনকার ছবি তোলা হয়নি তাড়াহুড়োয়। তবে বছরখানেক আগে ওদের তিনজনের ছবি তুলেছিলাম আমি। পকেট থেকে একটা হাফ সাইজের ফোটোগ্রাফ বের করলেন তিনি। ক্যামেরা কেনার পর বই পড়ে পড়ে ডার্করুমের কাজ শিখে ছবির প্রিন্ট বের করেছেন বাড়িতেই। নেহাতই শখ ছিল। কিন্তু খরচের জন্যে সেই শখ আপাতত ঘুচেছে। ছবির প্রিন্ট খুব উচ্চ মানের নয়। প্রতুলবাবু তাই মনোযোগ দিয়ে দেখলেন তারপর স্ত্রীর দিকে এগিয়ে দিলেন। প্রতুলবাবুর স্ত্রী ছবি দেখে বলে উঠলেন, ‘ওমা, এ তো দেখছি গায়ের রং কালো!’
অমরনাথ তড়িঘড়ি জবাব দিলেন, ‘না না। প্রিন্টের দোষে এমন হয়েছে। দুধেআলতা নয় তবে মেয়েকে কালো বলবে না কেউ।’
প্রতুলবাবুর স্ত্রী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘মাথায় চুল আছে তো?’
প্রশ্নটা অঞ্জলির উদ্দেশে তাই সে কোনওমতে মাথা নাড়ল, ‘হ্যাঁ।’
প্রতুলবাবুর যেন মনে পড়ে গেল, ‘ও হ্যাঁ, আর একটা চাহিদা আছে আমাদের, মেয়েকে লক্ষ্মীময়ী হতে হবে। যা বলব শুনবে। দস্যিপনা চলবে না। অবাধ্যতা আমি সহ্য করতে পারি না। মেয়ের মতো থাকবে, বুকে করে রাখব।’
অমরনাথ বললেন, ‘ছেলেমানুষ তো, তবে বিয়ের পর নিশ্চয়ই যা চাইবেন তা করবে।’
প্রতুলবাবু বললেন, ‘শোনো, এঁরা চাইছেন আমি মেয়েকে একবার চোখে দেখি। দাদা দেখার পর আর আমার দেখার কী দরকার তাই এঁদের বোঝাতে পারছি না।’
অমরনাথ বললেন, ‘আর একটা কথা, বিয়েতে কী দিতে হবে?’
প্রতুলবাবু সোজা হয়ে বসলেন, ‘আরে মশাই, বাড়িতে এসে আমাকে অপমান করবেন না। আপনি কী দেবেন সেটা আমি ঠিক করব? আমি কি ভিক্ষুক যে আপনার কাছ থেকে দান গ্রহণ করব? আপনার সামর্থ্য অনুযায়ী যা পারবেন তাই দেবেন। শাঁখা সিঁদুরটা অবশ্য চাই।’
অমরনাথ মাথা নাড়লেন, ‘আমার সাধ্যমতো সব দেব তবে সেটা আপনার সম্মানের তুলনায় অতি অল্প।’
প্রতুলবাবু মাথা নাড়লেন, ‘সে আমি বুঝব। হ্যাঁ, বিয়েটা হবে কিন্তু আপনার চা-বাগানে। জলপাইগুড়ি থেকে যারা যাবে তারা সেইরাত্রে ফিরে আসবে। যদি তিস্তার ফেরি বন্ধ হয়ে যায় সেবক হয়ে ঘুরে আসবে। আমি বাসি বিয়ে এ-বাড়িতেই করব।’
‘সেকী!’ অঞ্জলির মুখ ফসকে বেরিয়ে এল।
‘কিছু মনে করবেন না। আমাদের পরিবারে এই বাসি বিয়ের সময় একটা দুর্ঘটনা ঘটেছিল। পাত্র ফিরে এসেছিল কনেকে দাহ করে।’
‘কিন্তু হরিদাসদার মেয়ের বাসি বিয়ে তো ওভাবে হয়নি।’
‘ও, আপনি জানেন না যিনি আপনার সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি আমার মামাতো ভাই। নিজের ভাইয়ের চেয়ে যদিও অনেক কাছের তবে বংশ তো এক নয়।’ প্রতুলবাবু হাসলেন, ‘এটা অবশ্য এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার নয়। বিয়ের পরেই সিঁদুর পরিয়ে দিলেই চলবে। বরযাত্রী বেশি হবে না। এসব পরে আলোচনা করা যাবে।’
অমরনাথ বললেন, ‘আমার মেয়ের বড় পড়াশুনার শখ।’
‘বেশ তো। তাকে এখানে সংসারের কাজ করতে হচ্ছে না। গাড়ি করে গার্লস স্কুলে যাবে। আমি যা ডোনেশন দিই তাতে বছরের যে-কোনও সময়ে ভরতি করে নেবে। অবশ্য আমার কথা যদি বলেন তা হলে বলব, মেয়েছেলে বেশি পড়াশুনা করুক তা আমি চাই না। তাতে সংসারে শান্তি থাকে না। আপনি যখন বলছেন, তখন না হয়— ।’
অমরনাথ মিষ্টির প্যাকেটটা কিন্তু কিন্তু করে তুলে ধরলেন।
প্রতুলবাবু স্ত্রীকে বললেন, ‘নাও নাও, ভালবাসার দান নিতে হয়।’
প্রতুলবাবুর স্ত্রী সেটি নিয়ে অঞ্জলিকে বললেন, ‘আপনি একটু আসবেন?’
অঞ্জলি উঠলে তিনি পথ দেখিয়ে ভেতরে নিয়ে এলেন। বাইরে থেকে বোঝা যায় না কিন্তু ঘরের সংখ্যা অনেক। যে-ঘরে ওকে বসতে বলা হল সেটি সাধারণ। একটা তক্তপোশের ওপর বিছানা পাতা। আলনায় অনেকগুলো শাড়ি ঝুলছে। মিষ্টির প্যাকেট কাজের মেয়ের হাতে দিয়ে কিছু নির্দেশ দিলেন প্রতুলবাবুর স্ত্রী। তারপর ফিরে এসে অঞ্জলির মুখোমুখি বসলেন।
অঞ্জলি জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনার ছেলে কোথায়?’
‘ঘুমোচ্ছে। পড়াশুনা না থাকলেই ঘুমোয় পড়ে পড়ে। আমার তো ওই একটাই, আপনার শুনেছি তিনটে। ওনার ইচ্ছে ছিল কিন্তু পরেরটা নষ্ট হয়ে যেতে আর হয়নি। বাড়িতে মেয়ে বলতে আমি একা, খুব খারাপ লাগে।’
অঞ্জলি বলে ফেলল, দেখুন দিদি, মেয়ের বিয়ে দেব বলে ভাবিনি এখন। সম্বন্ধটা আসতে সব এলোমেলো হয়ে গেল। আপনাদের সঙ্গে আমাদের কোনও তুলনাই হয় না। আমার ভয় এখানেই। মানিয়ে নেওয়া যদি মুশকিল হয়— !’
প্রতুলবাবুর স্ত্রী হাসলেন, ‘এঁদের ধরনটাই এই। আমার বাবা ছিলেন গ্রামের স্কুলের মাস্টার অবস্থা বুঝতেই পারছেন। এঁরা কিছুতেই সমান ঘর থেকে মেয়ে আনেন না।’
‘ওমা, কেন?’
‘কী জানি বাবা। হয়তো যে-মেয়ে আসবে সে বেশ সংকোচে থাকবে তাই এঁরা চান। আজকাল মেয়েরা ডানা উঠলে বিয়ে করে। সমান ঘর হলে সে পোষ মানবে কেন? একটা কথা জিজ্ঞাসা করতে আপনাকে ডেকে আনলাম। মেয়ের কি ঋতু হতে দেরি আছে?’
অঞ্জলির মুখে রক্ত জমল। সে ঘাড় নাড়ল, ‘না। এই কালীপুজোর আগের রাত্রে প্রথম হল।’
প্রতুলবাবুর স্ত্রীর মুখে হাসি ফুটল। তিনি বললেন, ‘ওইটে নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিলেন উনি।’
অঞ্জলির মনে পড়ল ভদ্রমহিলা যখন তাকে ভেতরে আসতে বলছিলেন তখন প্রতুলবাবু তাঁকে কিছু ইশারায় বলছিলেন। সম্ভবত এটিই জানতে বলেছেন।
অঞ্জলি বলল, ‘আমার তো আর আসা সম্ভব হবে না। একবার ছেলেকে দেখা যাবে না?’
প্রতুলবাবুর স্ত্রী একটু ভাবলেন। তারপর উঠে দরজার দিকে যেতে যেতে বললেন, ‘বড় লাজুক। দেখি আসতে চায় কিনা।’
তিনি বেরিয়ে গেলে অঞ্জলি একা বসে ছিল। এইসময় কাজের মেয়েটি এক প্লেট মিষ্টি নিয়ে ফিরল৷ অঞ্জলি দেখল তাঁদের আনা মিষ্টি প্লেটে নেই। সে মাথা নাড়ল, ‘এত মিষ্টি আমি খেতে পারব না ভাই। আমি বরং একটা তুলে নিচ্ছি।’
কাজের মেয়েটি বয়স্কা। সে মাথা নাড়ল, ‘তা কি হয়। এতবড় কুটুম হতে যাচ্ছেন— ।’
অঞ্জলি হাসল, ‘এখনও তো হইনি!’
মেয়েটি এপাশ ওপাশ তাকিয়ে বলল, ‘না হলেই কি নয়!’ বলে প্লেট নামিয়ে রেখে চলে গেল ঘর ছেড়ে। অঞ্জলি হতভম্ব। মেয়েটি কথাগুলো বলেছিল চাপা গলায়। এবং বলার সময় একটা ঝাঁঝ চাপা ছিল না। বুকের মধ্যে দুম করে লাগল যেন। এ কী কথা! মেয়েটা কি কোনও ব্যাপারে তাকে সাবধান করে দিচ্ছে? এইসময় প্রতুলবাবুর স্ত্রী ফিরে এলেন, ‘লজ্জায় মরে যাচ্ছে। ছেলে না হয়ে মেয়ে হওয়া উচিত ছিল। আসছে।’ তারপরেই প্লেটের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ওমা, সব যে পড়ে রয়েছে। খেয়ে নিন।’
অঞ্জলি হাতজোড় করল, ‘খেয়ে এসেছিলাম। এখনও পেট ভারী। আমি একটা তুলে নিচ্ছি।’ মনের ভেতর সদ্য-ঢোকা কাঁটাটাকে কিছুতেই সরাতে পারছিল না সে। মিষ্টিটা দাঁতে কেটে জিজ্ঞাসা করল, ‘আজকাল তো এই বয়সে কেউ ছেলেমেয়েদের বিয়ে দেয় না। আপনারা কেন স্থির করলেন?’
প্রতুলবাবুর স্ত্রী বললেন, ‘ওই যে বললাম, একা থাকি। উনি কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা রোজগার করছেন, ব্যাবসার কাজে প্রায় বাইরে থাকেন, আমি কী করি তখন? ঘরে তাই বাচ্চা মেয়ে আনতে চাইছি যার সঙ্গে খুনসুটি করে বেশ সময় কেটে যাবে।’ এইসময় সেই কাজের মেয়েটি ঘরে ঢুকতেই তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বাইরে বেয়াইমশাই বসে আছেন, তাঁকে খাবার পাঠিয়েছিস?’
মেয়েটি ঘাড় নাড়ল, ‘প্লেট এর মধ্যেই শেষ হয়ে গেছে।’
‘খোকাকে একটু তাড়া দে। বল আমরা বসে আছি।’
কাজের মেয়েটি চলে গেল। কিন্তু প্রচণ্ড রাগ হয়ে গেল অঞ্জলির অমরনাথের ওপর। এমন পেটুক হবে কেন মানুষ। বারংবার বলে দেওয়া সত্ত্বেও প্রথমদিনেই ভরা প্লেট খালি করে দিল। কীভাবে বলল মেয়েটা! যেন একটা ভিখিরিকে খাবার দেওয়া হয়েছিল। সে জিজ্ঞাসা করল, ‘ওই মেয়েটি বুঝি অনেকদিন ধরে আছ এখানে?’
‘কে? ও, আনা! হ্যাঁ, খোকার জন্মের আগে থেকে আছে। কেন, কিছু বলেছে নাকি?’
‘না না। এমনি জিজ্ঞাসা করলাম।’
এইসময় দরজায় একটি তরুণ এসে দাঁড়াল। মাঝারি উচ্চতা, গায়ের রং শ্যামলা, মুখটি মিষ্টি, চোখ দুটি বড় বড়। কিন্তু রোগা, বেশিমাত্রায় রোগা। চোখে একটু বিস্ময়।
প্রতুলবাবুর স্ত্রী বললেন, ‘এই আমার ছেলে।’
অঞ্জলি দেখল ছেলেটি দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। এ যদি জামাই হয় তা হলে কেমন লাগবে তা সে বুঝতে পারছিল না। জামাই না ভেবে ছেলে ভাবলেই আরাম লাগত। সে জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমার নামটা যেন কী?’
‘অতুল বন্দ্যোপাধ্যায়।’ মেয়েদের মতো গলার স্বর, মোলায়েম, সরু।
প্রতুলবাবুর স্ত্রী বললেন, ‘যাও, ঘুমাও গিয়ে। দেখা হয়ে গিয়েছে।’ ছেলেটি আবার ধীরে ধীরে চোখের আড়ালে চলে গেল। এবার তিনি অঞ্জলির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘বড় অভিমানী। মেয়েকে বুঝিয়ে দেবেন। কেমন লাগল?’
‘বড় রোগা।’ সত্যি কথাটা বলেই ফেলল অঞ্জলি।
‘বড় হলে ঠিক হয়ে যাবে। বিয়ের পরেই দেখবেন আর চেনা যাচ্ছে না। আমি যখন এ-বাড়িতে এসেছিলাম তখন হাওয়ার ধাক্কায় পড়ে যেতাম। আর এখন দেখুন, তিনটে বাঘেও খেতে পারবে না। ও নিয়ে চিন্তা করবেন না।’
ব্যানার্জিবাড়ি থেকে বিদায় নিয়ে ওঁরা যখন রিকশায় চেপে ঘাটের দিকে এগোচ্ছেন তখনও অঞ্জলির মাথায় কাজের মেয়েটির কথা ছোবল মারছে। অমরনাথ বললেন, ‘বেলা পড়তে বেশি দেরি নেই। তুমি কি কিছু খাবে?’
সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁঝিয়ে উঠল অঞ্জলি, ‘তোমার লজ্জা বলে কিছু নেই? এত করে বললাম তবু গন্ডেপিন্ডে খেলে?’
অমরনাথ বললেন, ‘প্রতুলবাবু যে জোর করে খাওয়ালেন। বড়লোক, কিন্তু মানুষ খুব ভাল। একটুও অহংকার নেই। প্রথম যে অস্বস্তি ছিল সেটা কেটে গেল। দীপা এখানে এলে সুখী হবে, বুঝলে। আহা খেয়েছি বলে রাগ করছ কেন?’
‘আসল কথাটা বললে কী রূপ ধরবেন তা কে জানে?’
‘বলেছি।’ অমরনাথ হাসিমুখে বললেন।
‘বলেছ?’ অঞ্জলি সন্দেহের চোখে তাকাল।
‘হুঁ। শুনে বললেন, এ কোনও সমস্যাই নয়। সীতা কার মেয়ে? না দশরথের।’
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন