সুন্দরবনের শেষপ্রান্তে

বিশ্বদেব গঙ্গোপাধ্যায়

সুন্দরবনের শেষপ্রান্তে

ধীরেন্দ্রনারায়ণ রায়

 

সুন্দরবনের নাম কে না জানে? শিকারিদের তো কথাই নেই, সাধারণ মানুষের কাছেও তার গুরুত্ব কম নয়। কিন্তু, যেজন্যে সুন্দরবনের এই নামডাক, সেটা হল এই বনের শ্রেষ্ঠ জানোয়ার— দি রয়েল বেঙ্গল টাইগার। এই জাতীয় বাঘ ভারতের আরও কয়েকটি অঞ্চলে দেখা যায় বটে, কিন্তু সুন্দরবনের বাঘ আকারেপ্রকারে সব চাইতে সেরা।

সুন্দরবন বাংলাদেশের দক্ষিণ সমুদ্রের কাছে গিয়ে থেমে গিয়েছে— আর কদম বাড়াবার উপায় নেই। চব্বিশ পরগনা, খুলনা ও বাখরগঞ্জ, এই তিনটি জেলার দক্ষিণাংশে বঙ্গোপসাগরের উপকূলে সুন্দরবন দৈর্ঘ্যে পূর্ব-পশ্চিমে এক-শো আশি মাইল, প্রস্থে, উত্তর-দক্ষিণে ষাট মাইল হতে আশি মাইল। পশ্চিমে ভাগীরথী, পূর্বে মেঘনা, ইছামতী বা যমুনা। কালিন্দী, জয়মঙ্গল, মালঞ্চ, হরিণঘাটা, বলেশ্বর এবং আরও অসংখ্য ছোটো ছোটো নদী, খাল, নালা এই অঞ্চলটিকে চিহ্নিত করে রেখেছে। এরাই ওই অঞ্চলে যাতায়াতের একমাত্র পথ— এবং কলকাতার সঙ্গেও জলপথেই সংযোগ। শোনা যায়, আরব নাবিকরা সমুদ্রপথে যাতায়াতের সময় বঙ্গোপসাগরের তটরেখা বরাবর সবুজ বনানীর অঞ্চলকে নাম দিয়েছিল 'সমুদ্দম বন'।

সুন্দরবনে সুন্দরী গাছের সংখ্যাই বেশি। এ ছাড়া কেওড়া, গরান, গেঁয়ো গর্জন, হেন্তাল, বলা, ঝাউবন, গাব গাছ, হোগলা, গোলপাতার গাছ, ঝাপটা গরান ইত্যাদি গাছ জঙ্গলটাকে দুর্ভেদ্য করে রেখেছে। সুন্দরবনের মাটির উপর ছড়িয়ে আছে একরকম ঘাস— নাম শূলো— দু-ইঞ্চি হতে বারো ইঞ্চি লম্বা হয়— তীক্ষ্নাগ্র, পায়ে কাঁটার মতো ফোটে।

জঙ্গলে কেঁদো বাঘ (রয়েল বেঙ্গল টাইগার), বন্যবরাহ, হরিণ (চিত্রল), 'হগ ডিয়ার' কদাচিৎ, অজগর, বহুজাতীয় সাপ ও কুমির। পূর্বে গণ্ডারও ছিল অপেক্ষাকৃত ছোটো, এক খড়গবিশিষ্ট— 'জাভা দেশীয় রাইনোসিরস'— 'রাইনোসিরস সুমাত্রানেসিস', এখন এ জাত নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে বলে মনে হয়। পঞ্চাশ ষাট বছর আগেও দেখা যেত। পাখিও নানা জাতের। সাদা ও লাল বক, চিল, পানকৌড়ি, বড়ো বড়ো কুন্যা, শামুককুল, কার্লো, গোল্ডেন ক্লভার ইত্যাদি।

এই সুন্দরবনে শিকার করাটা নেশার মধ্যে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। সুযোগ-সুবিধা পেলেই, ওদিকে ধাওয়া করতাম। বন্ধুবান্ধব নিয়ে শিকারপার্টি করা সম্ভব হত না বটে, তবু, স্থানীয় লোকজন সংগ্রহ ইত্যাদি আমার বন্ধু আলতাফ হোসেনের তৎপরতায় সহজ হয়ে উঠত। আলতাফ হোসেন ওখানকার ডি. এফ. ও. লোকজনও হাতে আছে— জানাশোনাও প্রচুর, আর আছে একখানি লঞ্চ— যার সাহায্য ছাড়া ও অঞ্চলে যাতায়াত অসম্ভব। আলতাফ হোসেন নিজেও শিকারি। তার কাছে অনেক গল্পই শুনেছি। আমাকে এই অঞ্চলে শিকারে টেনে নিয়ে যাওয়ার মূলে তার চেষ্টা ও কৃতিত্ব কম ছিল না।

বেশ কিছুদিন আগের কথা বলতে গিয়ে, তখনকার সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পরিস্থিতির কথাই সব চাইতে আগে মনে পড়ে। ১৯৪৬ সালের মার্চ মাস। ভারতবর্ষে তখনও ইংরেজশাসন কায়েম— কিন্তু চতুর্দিকে একটা থমথমে ভাব। ১৯৩৫ সালের গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া অ্যাক্ট অনুসারে বাংলাদেশে লিগশাসন চলছে। হিন্দু-মুসলমানে একটা তীব্র মনকষাকষি আর নিষ্ঠুর প্রতিযোগিতার পালা যেন আগামী দিনের লোমহর্ষক হানাহানি আর রক্তারক্তির সূচনায় উন্মত্ত। কিন্তু শিকারের রাজ্যে এই দলাদলি আর রেষারেষির বালাই নেই। শিকারিদের মধ্যে হিন্দুমুসলমান ইংরেজখ্রিস্টান এসব জাতিভেদ কেউ করে না। তাই, অন্যান্য অসুবিধা থাকলেও, শিকারক্ষেত্রে কোনো ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়নি।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ থেমে গিয়েছে। হিরোশিমায় শোচনীয় ধ্বংসের কথা আলোচনায় আমরা সবাই মুখর হয়ে উঠেছি। নেতাজি সুভাষচন্দ্রের অন্তর্ধান বা তথাকথিত মৃত্যুর কথা নিয়ে আমার বালিগঞ্জের সান্ধ্য আসর বেশ গরম হয়ে উঠেছে— আবাল্যবন্ধু অনিমেষ টুক করে ঘরে ঢুকেই চুপ করে কানে কানে বললে— আলতাফ হোসেন!

নামটি শুনে সচকিত হয়ে উঠলাম। আমার এই পাঁচমিশেলি বৈঠকখানার বাজারে তাকে নিয়ে আসা সমীচীন হবে না মনে করেই দাঁড়িয়ে পড়ি এবং সভার কাছে দু-মিনিটের সময় চেয়ে নিই।

বাইরে এসে দেখি, বন্ধুবর নীচে কামরার বারান্দায় একটি আরামকেদারায় গা হাত পা এলিয়ে শুয়ে আছেন— মুখে অর্ধদগ্ধ সিগারেট। ধোঁয়ার কুণ্ডলী যেন একটা জমাট মেঘ সৃষ্টি করেছে। সামনে এসে দাঁড়াতেই, আলতাফ হোসেন আদাব জানায়, তারপর মিষ্টি হেসে বলে— ভাই, এবার তোমার জন্য পাকা ব্যবস্থা করেছি। এক্কেবারে লম্বা 'ট্যুর'— লঞ্চে করে সেই শেষ ঘাঁটি 'সুপতি' পর্যন্ত যাওয়ার প্রোগ্রাম। এবার চলো, একটা রেকর্ড করে আসা যাক। ক্যানিং-এ আমার লঞ্চ বিলকুল তৈরি।

তার কথা শুনে উল্লসিত হলাম বই কী। ঘরে বসে আর ক-দিন থাকা যায়। তা ছাড়া সুন্দরবনের প্রলোভনও কম নয়।

আলতাফ হোসেনের বিশ্রাম ও আহারাদির যথাযোগ্য ব্যবস্থা করে তখনকার মতো আবার সভায় যোগদান করি। কিন্তু একবার রসভঙ্গ হলে আর বুঝি তেমন জমে ওঠে না— তাই একে একে সবাই কেটে পড়েন।

সভা ভঙ্গ হল। আমিও আলতাফ হোসেনের কাছে গিয়ে জমে বসলাম। অনেক শলাপরামর্শের পর ঠিক হল আমরা পরদিনই রওনা হব। সঙ্গে দিন পনেরোর মতো খাবার যথা— চাল, ডাল, আটা, ঘি, ময়দা, সুজি, কিছু আলু, শুকনো ফল, স্টোভ, কেরোসিন ইত্যাদি আর গোটা তিনেক বন্দুক রাইফেল, পর্যাপ্ত পরিমাণ কার্টিজ, বুলেট, কিটব্যাগ, ছোরা, ছুরি, দড়ি, সুতো সব কিছুই সংগ্রহ করে রাখা হল। সুন্দরবনের নদী ও খালের জল লবণাক্ত, কাজেই লঞ্চে কয়েকটা বড়ো বড়ো ড্রামে খাবার জল বোঝাই করে নেওয়া হবে, আলতাফ হোসেন সেকথা জানালেও, অধিকন্তু ন দোষায়— আমিও একটা বড়ো জলের ড্রাম, ঘটি, মগ নিতে ভুলিনি।

আলতাফ হোসেন ভোরেই ক্যানিং চলে গেলেন। কথা হল, আমরা বিকেলের গাড়িতে রওনা হয়ে সন্ধ্যার পরই ক্যানিং পৌঁছুব এবং রাত্রেই আমাদের লঞ্চ ছাড়বে।

সারা সকাল বেলাটা জিনিসপত্র গোছগাছ করে নিতে কেটে গেল। অনিমেষের উৎসাহ মাঝে মাঝেই ভাটার দিকে যেতে চায়— সুন্দরবনের বাঘ নাকি নৌকোর ওপর থেকে মানুষ তুলে নিয়ে নদী সাঁতরে পার হয়ে যায়— নয়তো কুমিরের হাতে প্রাণ যাওয়াটাও বিচিত্র নয়। তাতে উৎসাহ দিতে ছাড়ি না— আরে এত প্রাণের ভয় কেন? এবারের যুদ্ধে গিয়ে যদি সত্যিই যুদ্ধ করতে, তাহলে কি আর প্রাণ নিয়ে ফিরে আসতে? মনে কর না কনস্ক্রিপশনের আওতায় পড়ে সেই যুদ্ধেই চলেছ। আর প্রাণ যে যাবেই— তারই-বা নিশ্চয়তা কী? প্রাণ নিয়েও তো ফিরে আসতে পারো।

অনিমেষের নিমেষহীন চোখ। কিছুক্ষণ আমার দিকে চেয়ে থাকে, তারপর হর্ঠাৎ যেন চাঙ্গা হয়ে ওঠে।

—বেশ, আমি তৈরি, একটুখানি সময় দাও, বাড়িতে ছুটি নিয়ে আসি।

—যাও, বেশি দেরি কোরো না, বারোটার আগেই এখানে আসা চাই।

আমার নিজের অবশ্য সেসব বালাই নেই— শিকারে যাওয়ার ছুটি আমার অনাদি অনন্ত কালের। সেই যৌবন থেকেই আমার পার্মানেন্ট ছাড়পত্র জোগাড় করা আছে।

অনিমেষ খুব তাড়াতাড়িই বাড়ি থেকে ফিরে এল। বেলা তিনটের সময় বালিগঞ্জ স্টেশনে— সেখান থেকে ট্রেনে ক্যানিং।

পোর্ট ক্যানিং। এখানেই লঞ্চ নোঙর করা আছে। লটবহর নিয়ে আমরা সেখানে পৌঁছোলাম। আলতাফ হোসেন পরম সমাদরে তাঁর লঞ্চে তুলে নিলেন। তারপর আহারাদি, গল্পগুজব, নিদ্রা। রাত্রেই আমাদের লঞ্চ ছেড়ে দিলে। সেদিন ছিল চৈত্র মাসের দশ তারিখ।

এগারোই চৈত্র— বাসন্তী, গোসাবা হয়ে বাগনায় একটু অবস্থান। সেখান থেকে আমাদের লঞ্চ ক্রমে রায়মঙ্গল নদীতে প্রবেশ করে— তারপর চুকুরী খাল হয়ে হরিনগর সিভিল সাপ্লাই স্টেশন— তারপর কদমতলা। এখান থেকে একটু এগিয়ে যেতেই হরিণ দেখা যায়। তার পরদিন, অর্থাৎ ১২ চৈত্র, বুড়ি গোয়ালিনী পৌঁছোলাম। নদীর ভাঙা ভাঙা পাড়ে অসংখ্য কারলো পাখি— এগুলি 'টেবল বার্ড'— লম্বা অর্ধবৃত্তাকার ঠোঁট— খেতে খুব সুস্বাদু— কিছু গোল্ডেন ক্লোভারও দেখতে পাওয়া গেল। এরাও 'টেবল বার্ড'।

উৎসাহের অতিশয্যে ফায়ার করতেই কয়েকটা কারলো পাখি ঠিকরে পড়ে গেল। লঞ্চের সঙ্গে বাঁধা ডিঙি ভাসিয়ে খালাসিদের দিয়ে পাখিগুলো তুলে আনা হল— খাদ্যের একটা সুব্যবস্থা করা চাই তো! অনিমেষ পাখি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠতেই তাকে ডেকে নিলাম।

—ওসব কাজের জন্যে অন্য লোক আছে, তুমি এসো দিকিনি— একবার দু-চোখ ভরে সুন্দরবনের সুন্দর দৃশ্যটা দেখে নাও— নইলে পরে আপশোস করতে হবে।

বুড়ি গোয়ালিনীতে লোকালয় আছে— আর আছে পাখির 'স্যাংচুয়ারি'। লর্ড লিটন নাকি এই 'স্যাংচুয়ারি' প্রবর্তন করেছিলেন— শামুককুল পাখির এত প্রাচুর্য ও প্রসিদ্ধি আর কোথাও নেই। লাটসাহেব নিজেও এর পরিদর্শনে আসতেন। শামুককুল পাখি সুখাদ্য নয়— একটা দুর্গন্ধ আছে এর মাংসে।

এখানে গ্রাম ও জঙ্গল পাশাপাশি— কিছু সুনিপুণ শিকারিও আছে। এ জঙ্গলে বাঘও পাওয়া যায় শুনলাম। শিকারির কথা উঠতেই ভাবলাম, একবার তাদের সঙ্গে মোলাকাত হলে মন্দ হয় না। আলতাফ হোসেনকে সেকথা বলতেই সে একজন খালাসিকে পাঠিয়ে দিলে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই সেও ফিরে এল, সঙ্গে দাড়িশোভিত এক নওজোয়ান— গাঁট্টাগোট্টা চেহারা, চোখে ক্ষুধিত দৃষ্টি। দেখেই মনে হল, জীবনের পরোয়া করে না— দুর্ধর্ষ সাহসী। নাম কুদরত খাঁ।

হ্যাঁ, নামের মতোই চেহারা বটে! তাকে জিজ্ঞেস করি— তোমাদের এ জঙ্গলে বাঘ আছে শুনলাম, শিকার-টিকার হয়?

মিশমিশে কলো কুদরত খাঁ-র ঝকঝকে দাঁতগুলো ঝিকমিক করে ওঠে।

—হয় বই কী! হামেশাই শের পাওয়া যায় না বটে, কিন্তু একবার যদি সে মারি করে, তবে আর তার রেহাই নেই।

—তোমরা কি খেদা কর, না মাচান বেঁধে শিকারই সুবিধে?

—না, না, সুন্দরবনে ওসব চলে না— আমরা ফন্দি করেই বাঘকে বন্দি করি— হয় বন্দুকের ফাঁদ পেতে, নয়তো মাটিতে গর্ত করে তার মধ্যে লুকিয়ে থেকে শিকার করা হয়।

—বন্দুকের ফাঁদ? সেটা আবার কী?

কুদরত খাঁ হো হো হেসে ওঠে, তারপর অঙ্গভঙ্গি করে বলতে থাকে— আপনি কিছু জানো না সাহেব— দেখবে, কেমন করে ফাঁদ পাতা হয়? —এই যে ধর, এই হল একটা ঘায়েল মানুষ— যাকে বাঘ মারি করেছে। আর এটাও নিচ্চয় জানো আপনি যে বাঘ আবার আসবে ওটাকে খেতে। সেই যাতায়াতের পথে একটা ফাঁদ পাতা হয়। গুলিভরা বন্দুকটাকে মারির ওপর আড়াআড়ি বসানো হয়— আর গোটাচারেক কাঠি আর কালো রঙের শক্ত সুতো খানিকটা—

—কালো রঙের সুতো কেন?

—নইলে বাঘ দেখতে পাবে যে—

—বেশ, তারপর?

—তারপর বন্দুকের ঘোড়া তুলে তার সঙ্গে কাঠি আর সুতোর কপিকলের মতো তৈরি করে সুতোটাকে টেনে ওই যাতায়াতের পথের ওপর দিয়ে উঁচু করে বেঁধে রাখা হয়।

—কতটা উঁচু?

—বেশি উঁচু নয়— একটা পুরো বয়সের বাঘ ন-ফুট থেকে দশ ফুট। সেটা যখন চলে, তার কলজেটা মাটি থেকে সতেরো কি আঠারো ইঞ্চির মতো উঁচুতে থাকে—

—সব বাঘই তো অত বড়ো নয়— ছোটোও তো হতে পারে।

—নিশ্চয়ই হতে পারে— তবে হিসেবটাই আপনাকে বলে দিই—

—মেলা বকিসনি তো— তোদের সেই হিসেবটাই তো শুনতে চাই—

কুদরত খাঁ ডি. এফ. ও. সাহেবকে একটা কুর্নিশ করেই শুরু করে দিল— হুজুর, বাঘের সামনের পায়ের থাবা মাটির ওপরে যে ছাপ রেখে যায়— আমরা তার চাদ্দিকের মাপ একটা লতা দিয়ে মেপে নিই— তার দু-ফের নিলেই বাঘের কলজেটা মাটি থেকে কত উঁচুতে তা নিশ্চয় বুঝতে পারা যায়।

অনিমেষের চোখে যেন পলক পড়ে না— হাঁ করে শুনতে থাকে— যেন আজগুবি একটা কিছু শোনা গেল।

আলতাফ কনুই দিয়ে আমাকে ঠেলা দিতেই আমি তাকে বলি— কুদরত খাঁ ঠিক কথাই বলেছে। Double the perimetre of the footprint is the position of the heart—শুধু বাঘের নয়—মানুষেরও।

অনিমেষ সটান দাঁড়িয়ে পড়ে। নিজের পায়ের পাতার চারদিকে একবার ভালো করে মেপে নিজের হৃৎপিণ্ডের উচ্চতার সঙ্গে মিলিয়ে দেখে— তার মুখেচোখে অবিশ্বাসের ছাপ। কুদরতের চোখেও তারই ছায়া।

মাপ করার ফিতে আমার পকেটেই ছিল। সেটা বের করে ফরফর করে খানিকটা ফিতে ছেড়ে দিলাম। অনিমেষকে তার ডান পায়ের পাতার চারদিক গোড়ালি ঘুরিয়ে মাপতে বলি। তারপর তার দ্বিগুণ করে দণ্ডায়মান অনিমেষের পায়ের কড়ে আঙুল থেকে বুক পর্যন্ত তুলতেই দেখা গেল, সেটা ঠিক হৃৎপিণ্ড পর্যন্ত পৌঁছেছে। কুদরতকেও পরখ করে দেখতে বলি। সে এসে সটান যেখানে ফিতে শেষ হয়েছে, সেখানে কান লাগিয়েই অপ্রস্তুতের হাসি হেসে বললে— ঠিকই তো কলজেটা ধুকপুক করতে লেগেছে যে!

কুদরতের কুদরত আছে বলতে হবে। তার কাছেই শুনলাম— দিন কয়েক আগে সে 'গান-ট্রিক' করেই একটা শোলা বাঘ খতম করেছে।

'গান-ট্রিক' এর কায়দাকানুন সবই জেনে নিলাম। তারপর আবার লঞ্চে যাত্রা শুরু। কুদরতের সঙ্গে কথা বলে বেশ ভালো লাগল। তাকে আমাদের সঙ্গী করে নিলাম। অবশ্য মজুরি দিতে হবে— প্রত্যেক দিন দু-টাকা।

বুড়ি গোয়ালিনী ছেড়ে কপোতাক্ষ ও আরও দু-একটি অখ্যাতনামা নদী বা নালা পার হয়ে পাঙ্গাশিরা নদীতে ঢুকে পড়ি। এখানে coupe আছে। Fuel coupe—অর্থাৎ জ্বালানি কাঠের জঙ্গল। জঙ্গল ডাক হয়— যেসব গাছ বাতিল হয়ে যায়— তাতে চিহ্ন করা থাকে, সেগুলি ঠিকাদার ডেকে নেয়।

সেটা পার হয়ে মঙ্গলবার ভোরে আমরা ধোন্দল খালে পৌঁছে গেলাম। এখানে যথেষ্ট হরিণ— সবই চিত্রল। হরিণ শিকারে প্রবৃত্তি ছিল না— কিন্তু আহার্য হিসেবে একটা শিকার করা হল। একটিমাত্র L.G. shot-এই কাজ হয়ে গেল। বহু হরিণ চরে বেড়াচ্ছে— চোখ জুড়িয়ে যায়— এক একটা দলে ত্রিশ-চল্লিশটা করে থাকে।

সেদিন অপরাহ্ন ৩-৩০ মিনিটে আমরা কয়টি ধুরন্ধর ধোন্দল ত্যাগ করলাম। মারিয়া ও আর একটা নদী অতিক্রম করেই জপনা গাং। এখানেও নদীপারের জঙ্গলে প্রচুর হরিণ। এরই পর বড়শিয়া নদী। ১৩ই চৈত্র আমরা পৌঁছোলাম ভাগড়া নদী; সেখান দিয়ে খেজুরিয়া খাল। এর আশেপাশে হেঁতাল ও বেতের জঙ্গল। সেখান থেকে ১৪ তারিখে পাঁঠাকাটা পৌঁছোলাম। এখানেও বেলা বারোটা পর্যন্ত বাঘের সন্ধান করা গেল।

আমরা লঞ্চে ক্রমেই সুন্দরবনের পূর্বাঞ্চলে প্রবেশ করছি। চব্বিশ পরগনার অংশ অনেক আগেই পার হয়ে এখন খুলনা জেলার অংশে ঢুকে পড়েছি। এ সমস্তই এখন পাকিস্তানে। পাঁঠাকাটা থেকে আমরা যাব খুলনা জেলার শেষ প্রান্তে সুন্দরবনের সুপতি ফরেস্ট স্টেশনে।

১৫ তারিখে বেলা ন-টায় আমরা শরণখোলা ফরেস্ট স্টেশনে পৌঁছোলাম। এখানে কিছু পাখি শিকার করা গেল। এখানেই রাত্রিযাপন।

১৬ তারিখে আমরা পদব্রজে জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরতে থাকি। শরণখোলা থেকে তিন চার মাইল দূরে 'রগি ফরেস্ট'-এ পৌঁছোলাম। এইটুকু পথ যেতেই অনেকগুলো সাঁকো পার হতে হয়। প্রত্যেকটি সাঁকো পার হওয়াই বিপজ্জনক। 'রগি' ফরেস্ট স্টেশন বলেশ্বর নদীর ওপর। ওপারে পিরোজপুর— বাখরগঞ্জ জেলায়। এই ফরেস্ট স্টেশনের আশেপাশে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সব চিহ্নই রয়েছে। প্রকাণ্ড অবজারভেশন পোস্ট— জাপানি বিমান আক্রমণের মহড়া নেবার জন্য বিমান-বিধ্বংসী কামান পাতার কাঠের মঞ্চ— সবই তখন বহাল তবিয়তে বর্তমান।

আলতাফ হোসেন করিতকর্মা লোক। তিনি লঞ্চে তাঁর সরকারি পরিদর্শনের কাজে বেরিয়েছেন— সেসব কাজও করে যাচ্ছেন আবার আমাদের সঙ্গে শিকারের আলোচনা এবং যেখানে যেটুকু সুযোগ-সন্ধান পাওয়া যায়, সেই খবরও জোগাড় করে চলেছেন। অনিমেষের আর কোনো কাজ নেই— রান্নাবান্নার তদবির করা, যেখানেই খাবার জলের খোঁজ পাওয়া যায়, খালাসিদের দিয়ে জল আনিয়ে টাটকা জলে ড্রামগুলো ভরতি করে নেয়, কারণ জল সাত আট দিন বাসি হলেই তাতে পোকা হবার সম্ভাবনা। হরিণ বা পাখি শিকার হলে সেসবের সদগতি— এই নিয়েই তার সময় কাটে— আর কারণে অকারণে কেটলিভরা চায়ে চুমুক দিতে গিয়ে মাঝে মাঝে বিষম খেয়ে বিষম অনর্থ বাধায়। কুদরত গালে হাত দিয়ে বিমর্ষ হয়ে বসে থাকে।

আমিও একমনে শুধু এই চিন্তাই করে যাই সুন্দরবনে এসে নিজের হাতে একটা বাঘ মারতে না পারলে লোকসমাজে মুখ দেখাব কী করে!

১৭ চৈত্র। আলতাফ হোসেনের ইনস্পেকশন প্রায় শেষ। ডিঙিতে করে আমরা আবার শরণখোলায় উপস্থিত হলাম। আসার পথে আরও কিছু পাখি শিকার করা গেল।

সেদিনই দুপুরে আমরা রওনা হলাম সুপতি ফরেস্ট স্টেশনের দিকে। এটাই আমাদের শেষ গন্তব্যস্থল। এখান থেকেই আমরা আবার ফিরে আসব।

সুপতি ফরেস্ট স্টেশনেও 'মিলিটারি বেস' হয়েছিল— এদিক-ওদিক তার চিহ্ন দেখা গেল।

হ্যাঁ, জঙ্গল বটে। এমন ঘন আর জমাট জঙ্গল খুবই কম দেখা যায়। তেমনি শিকারও অঢেল। বাঘের ভয়ও খুবই বেশি। সেটা অমূলক নয়। কয়েকটি নিদারুণ অত্যাচারের অতি করুণ কাহিনি শোনা গেল। বাঘের কথা শুনে আমি প্রস্তাব করি, এখানেই একটা চেষ্টা নেওয়া যাক। আলতাফ হোসেন তার কাজকর্ম শেষ করে নিতে চায়, বলে— ব্যস্ত কী? তোমায় এমন জায়গায় নিয়ে যাব যে বাঘ তোমার মুঠোর মধ্যে এসে যাবে।

১৮ চৈত্র। আমরা সুপতি থেকে সমুদ্রের কাছাকাছি কটকা খালে পৌঁছোলাম। এখানে লোকজন আসে না— আসাও খুব কঠিন। প্রচুর হরিণ দেখতে পাওয়া গেল। দুটো হরিণ শিকার করলাম। এখানে বনমুরগিও প্রচুর— কিন্তু সুন্দরবনে বনমুরগি শিকার করা হয় না। কুদরত খাঁ সবিস্তারে বুঝিয়ে বলে— ওখানকার স্থানীয় লোকজন ও শিকারিরা বনবিবির নামে মুরগি পুজো দেয়। বনবিবি হল বনের অধিষ্ঠাত্রী দেবী।

আমাদের লঞ্চ নোঙর করা ছিল। রেলিং-এ ভর দিয়ে রাইফেল হাতে জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে ছিলাম— হঠাৎ একটা বাঘকে নদী সাঁতরে পার হতে দেখা গেল। আমার লং রেঞ্জের রাইফেলের পাল্লার মধ্যেই— উপযুক্ত সময় বুঝে ট্রিগার টিপলাম। মুহূর্তে বাঘটা জঙ্গল পার হয়েই অদৃশ্য।

তবে কি ব্যর্থ হলাম? জঙ্গলে নামার অভিপ্রায় ব্যক্ত করতেই আলতাফ হোসেনের ঘোরতর আপত্তি।

—এ জঙ্গলে কেউ পায়ে হেঁটে শিকার করেনি— আপনি এ-রকম দুঃসাহস করবেন না।

আমার শিকারিজীবনের অভ্যাসটাই হচ্ছে বিপদের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়া। তাই তার কথাটা আমার মনঃপূত হল না। দেখাই যাক না— কী হয়।

কুদরত আর দুই তিন জন সঙ্গী নিয়ে জঙ্গলে প্রবেশ করলাম। বনে প্রচুর হরিণ। একটা সদ্যনিহত হরিণও দেখতে পেলাম। বাঘের পায়ের চিহ্নও আছে। এখানে ঘাস বেশ পরিষ্কার— শূলো কম। কিন্তু ইতস্তত পায়চারি করে অথবা দূরে পায়ে হেঁটে বাঘ পাওয়া খুবই কঠিন— হয়তো সেই জানোয়ার আমাদের দেখতে পায়— কিন্তু আমাদের নজরের সামনে আসতে চায় না। অনেক ঘোরাঘুরি করেও বাঘের দর্শন পেলাম না। কুদরতও অনেক চেষ্টা করে দেখল। আমার সঙ্গীদের মধ্যে একজন দুটো হরিণ শিকার করলেন।

ব্যর্থতার অবসাদ নিয়ে লঞ্চে ফিরে আসতেই অনিমেষ আমাকে অভ্যর্থনা জানায়।

—কী হল? এমন জঙ্গলেও বাঘ পেলে না? তোমাকে দেখেই ভেগে পড়ল নাকি?

মেজাজটা ভালো ছিল না— তাই বিরক্ত হয়েই জবাব দিলাম— তুমি তো গায়েগতরে বেশ বাগিয়ে নিয়েছ, তোমাকে সঙ্গে নেওয়াই উচিত ছিল— তাহলে হয়তো বাঘের নোলায় জল পড়ত।

আতলাফ হোসেনের প্রস্তাব :

—চলো, আর দেরি না করে, আমরা সোজা পাঁঠাকাটা ক্যুপে ফিরে যাই। ওখানে জোর কাঠের কারবার, অনেক মহাজনি নৌকো আসে, কোনোটা হাজার মণি, কোনোটা পাঁচশো মণি। ব্যবসায়ী, কাঠুরে ইত্যাদি বহু লোকজনের সমাগম। মানুষের গন্ধ পেয়ে বাঘেরও ওখানেই আনাগোনা।

পাঁঠাকাটার নাম শুনেই অনিমেষের প্রাণে উৎসাহের জোয়ার— সে হাততালি দিয়ে ওঠে— বাঃ খাসা জায়গা। পাঁঠাকাটা হয় যখন, তখন খেতেও পাব। অনেকদিন খাইনি— হরিণের মাংস বড্ড চিমড়ে।

ডি. এফ. ও. তার উৎসাহের আগুনে এক বালতি ঠান্ডা জল ঢেলে দিলে।

—নামটাই পাঁঠাকাটা, ওখানে আপনার ছাগবৎসের কোনো সন্ধান মিলবে না।

২০ চৈত্র— আমরা পাঁঠাকাটায় ফিরে এলাম।

জঙ্গলে ঢোকাই খুব বিপজ্জনক। বাঘের উপদ্রব অত্যন্ত বেশি। সুদক্ষ গ্রাম্য শিকারিও অনেক ক-জনই সেখানে আছে। শিকার করাই তাদের পেশা। সবই মুসলমান। অভিজ্ঞতাও প্রচুর। পায়ে হেঁটে বা বন্দুকের ফাঁদ পেতে শিকার করে। কিন্তু কেউ জঙ্গলে যেতে চায় না। কে আর বেনাহক বাঘের হাতে প্রাণ দিতে চায়!

গোলপাতার চালান হয় এই ক্যুপ থেকে। ব্যাপারীরা সব হাত গুটিয়ে বসে আছে। সুন্দরবনের শিকারিদের মুরুব্বি ফকির এসে মাথায় লাল শালুর কাপড় বেঁধে মন্ত্র পড়ে— মুরগি ছেড়ে দেয়— বনবিবির কাছে মানত করে— কিন্তু তার সমস্ত কেরামতিই নিষ্ফল। বাঘের অত্যাচার ক্রমেই বাড়তে থাকে— প্রায়ই খবর আসে— কেউ-না-কেউ ঘায়েল হয়েছে।

এদিকে মহাজনি নৌকো সব সারি সারি বাঁধা। সরকারি ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের কাজকর্ম বন্ধ— প্রচুর ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। দু-শো টাকা থেকে পাঁচশো টাকা উঠল একটা বাঘের মৃত্যুপণ। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয় না। সুন্দরবনের এ অঞ্চলের বাঘগুলো কি তিরস্করণী বিদ্যায় সিদ্ধ? ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেল? কীভাবে কখন যে তারা মানুষ উঠিয়ে নিয়ে গা ঢাকা দেয়— কিছুতেই তার হদিশ মেলে না। মিস্টার আপরাইট নামে এক সাহেব প্রবেশনারি অফিসার সেসময় ওই অঞ্চলেই ছিলেন। তিনিও তাঁর সমস্ত সাহস ও অভিজ্ঞতা প্রয়োগ করে ব্যর্থ হলেন। এমনকী কী গান-ট্র্যাপ করেও কিছুই ফল হল না।

আমিও দু-তিন জন শিকারিকে সঙ্গে নিয়ে, সাহসে বুক বেঁধে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াই, আবার খালে খালেও বোটে ঘোরাঘুরি করি— সন্ধ্যার পূর্বেই লঞ্চে ফিরে আসি। কপালে নেইকো ঘি, ঠকঠকালে হবে কী?

কত আর বসে থাকা যায়? পাখি আর হরিণ শিকার করে মন ভরে না। যার জন্য এত কষ্ট স্বীকার, সেই মহাপ্রভুর দর্শন সুযোগসুবিধামতো না পেলে, ভাগ্যের দোষ দেওয়া ছাড়া উপায় কী।

আলতাফ হোসেনের কাছে একটা প্রস্তাব করে বসি,

—কুদরতের কাছে শুনলাম, এখান থেকে মাইল দুই দূরে অনেক নৌকো একসঙ্গে রয়েছে, ব্যবসায়ীর দল, পেশাদার শিকারি আর লোকলশকরও অনেক ক-জন আছে, চলো না, ওখানেই আমরাও ভিড়ে পড়ি। বিড়ালের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়লেও ছিঁড়তে পারে। মি. আপরাইট আগ্রহের সঙ্গেই আমাদের দলে ভিড়ে গিয়েছিলেন, তিনিও আমাদের প্রস্তাবে সানন্দে সম্মতি দিলেন।

কাজেই আলতাফ হোসেন একরকম আমাদের চাপে পড়েই মত দিতে বাধ্য হলেন। ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে একটা পাঁচশো মণি মহাজনি নৌকো জোগাড় করা গেল। অনিমেষকে সঙ্গে যাওয়ার কথা বলতেই সে নির্নিমেষে আমার দিকে চেয়ে থাকে। তারপর বিমর্ষ উক্তি,

—কাজ কী বাপু— এত ঝামেলায় না গেলেই কি নয়? বাঘের রাজ্যে বাঘ আছে— ওদের পেছনে খামোখা লেগে কেন নিজের বিপদ ডেকে আনা— তার চাইতে লঞ্চে গিয়ে দিব্বি কয়েকদিন ভ্রমণ করা গেল। এখন ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাওয়াই উচিত।

অনিমেষকে রেহাই দিলাম। আলতাফ হোসেন ডেপুটি রেঞ্জারকে যথাযোগ্য নির্দেশ দিয়ে আমার সঙ্গে চলল। প্রবেশনারি অফিসার মি. আপরাইট, মানুষ হিসাবেও আপরাইট— বুক ফুলিয়ে আমার আগেই সেই মহাজনি নৌকোয় চেপে বসে।

পেশাদার শিকারি কুদরত খাঁ আমাদের সঙ্গেই বরাবর 'লাক ট্রাই' করে চলেছে যদি বাঘ শিকার করে পুরস্কারটা বগলদাবা করা যায়।

খালের জলে খানিকটা ছাড়াছাড়ি কয়েকখানা মহাজনি নৌকা ভিড় করে আছে। আমাদের নৌকাও সেখানে একধারে ভিড়ল। প্রত্যেক নৌকার সঙ্গেই একটি করে জালিবোট বাঁধা আছে।

সন্ধের আগেই সবাই নৌকোর পাটাতনের ওপরে ছোট্ট ঘরে কাঠের জানালা দরজা সব বন্ধ করে শুয়ে পড়ে। দেখাদেখি আমরাও সেইমতো সতর্ক হয়ে থাকি। রাত অনেক হয়েছে— আর সবাই ঘুমিয়ে। আমার চোখে ঘুম নেই। শুয়ে শুয়ে আকাশপাতাল চিন্তা করি। হাতের কাছে পাঁচ ব্যাটারির টর্চলাইট আর ৪৫০/৪০০ বন্দুকটায় গুলি ভরে তৈরি হয়ে থাকি।

হঠাৎ একটা হইচই আওয়াজে চমকে উঠি। ঠেলা দিয়ে আলতাফ হোসেন আর আপরাইট সাহেবকেও ডেকে তুলি। কুদরত খাঁ নৌকার এক কোণে জড়োসড়ো হয়ে ঘুমিয়েছিল। সেও তড়াক করে লাফিয়ে উঠেই বাইরে মাথা গলিয়ে দেখতে চায়।

নিমেষের মধ্যে আমিও জানলা খুলে টর্চের আলো সামনে ফোকাস করি। আশপাশের নৌকা থেকে, হা হুতাশ আর হইচই আওয়াজ শুনে আন্দাজমতো টর্চের আলো ফেলতেই দেখতে পেলাম, বেশ খানিকটা দূরে একটা কেঁদো ডোরাকাটা বাঘ পাড়ের কাছে জলের ওপর দাঁড়িয়ে যেন হাঁপাচ্ছে— তার মুখে একটা জোয়ান মরদ।

এ অবস্থায় কী কর্তব্য, আলতাফ হোসেনকে জিজ্ঞেস করতেই সে মাথা ঝাঁকিয়ে উত্তর দেয়— না না, বাঘটা অনেক দূরে— এখান থেকে গুলি করে কোনো লাভ নেই— শুধু ওর মতলবটা লক্ষ করে যাও।

কুদরত খাঁ বলতে চাইল— বাঘটা ওপরে উঠে যদি পালিয়ে যায়— কী করবেন? এখুনি গুলি করুন।

আলতাফ হোসেনের এক ধমকে সে চুপ করে গেল।

ইতিমধ্যে টর্চের আলোয় পরিষ্কার দেখা গেল বাঘটা তার শিকারকে মুখে করে টেনেহিঁচড়ে পাড়ের ওপর উঠে পড়ল। এদিকে বিভিন্ন নৌকার ওপর যত লোকজন ছিল— তারা সবাই সমস্বরে এমনি একটা হইচই লাগিয়ে দিলে যে বাঘেরও বুঝি মাথার গোলমাল দেখা দিল। সে তার মুখের গ্রাস— সেই লোকটিকে পাড়ের ওপর কিছুটা দূর টেনে নিয়ে মাটিতে রেখেই পাশের জঙ্গলে পালিয়ে গেল।

এদিকে রাতও শেষ হয়ে এসেছে। যে নৌকায় বাঘের হামলা হয়েছিল— সেখানে আমরাও নৌকা বেয়ে গেলাম, শুনলাম, বাঘটা জঙ্গল থেকে বেরিয়ে জলে সাঁতার কেটে ছোটো জালিবোটে উঠেছিল— তারপর একসঙ্গে বাঁধা মহাজনি নৌকায় উঠে পড়ে। সেই নৌকার কাঠের জানালার ভিতরের হুড়কোটা বন্ধ না থাকলেও আলগা ছিল— পা চালিয়ে সেটাই ভেঙে ঢুকে পড়েছে।

কী আশ্চর্য, সাত সাতটা লোক ঘুমিয়ে ছিল, তার মধ্যে বেছে বেছে সব চাইতে তাগড়া জোয়ান লোকটিকেই বাঘ তুলে নিয়েছে। তারপর যে পথে আগমন, সেই পথেই নিষ্ক্রমণ— অতবড়ো একটা পাটজোয়ান মরদকে মুখে নিয়ে সাঁতরে পার হতে গিয়ে খুবই শ্রান্ত হয়ে পড়েছিল নিশ্চয়, তাই টর্চের আলোয় তাকে হাঁপাতে দেখেছিলাম।

তখন বেশ ভোর হয়ে গিয়েছে। আমরা সবাই ও অন্যান্য নৌকারও অনেকে পারে উঠলাম। লোকটা খতম। বাঘের কামড় অনেকখানি বসে গিয়েছিল— জানোয়ারের চোয়াল দুটো বুঝি লোহার— তার নিষ্পেষণে লোকটার ঘাড় ভেঙে ঝুলে পড়েছে।

মিস্টার আপরাইট বললেন— গান-ট্রিক করেই এটাকে খতম করব।

কুদরত খাঁ-ও কুদরত দেখায়— মারির কাছে বাঘ না এসে যায় না—

আমার কিন্তু প্রস্তাবটা মোটেই মনঃপূত হল না— আলতাফ হোসেনকে বলি— না ভাই, এ-রকম ফন্দি করে বাঘ শিকারে প্রবৃত্তি আমার হয় না। তুমি তো জানো, আমি ঘুমন্ত বাঘকে জাগিয়ে তারপর শিকার করেছি। তুমি বরং এর কাছাকাছি একটা গাছে মাচান বাঁধার ব্যবস্থা করো। কিংবা কিছু দূরেই একটা গর্ত করে দাও, তার মধ্যে বসে থাকব— নিজের হাতে বাঘ শিকার না করলে আর মজাটা কী? আর না হয়, তান্ত্রিকের মতো মরা মানুষটার ওপরেই বসে আমি ব্যাঘ্র-সাধনা করব। শুধু তাঁর আগমনটাই চাই— হয় তিনি না হয় আমি— দুটোর মধ্যে একটা শেষ হয়ে যাক!

আলতাফের বিদ্রোহ ঘোষণা— না, কখনোই তা হতে দেব না— এর জন্য তোমার সঙ্গে যদি ফাটাফাটি হয়ে যায়— সেও ভি আচ্ছা।

তারপরই আলতাফ হোসেন আমার কাঁধে হাত রেখে বলল— যা বললে— সেটা খুবই ঠিক, কিন্তু ওদিককার সুন্দরবনে মাচান বেঁধে শিকারের রেওয়াজ নেই। যাই হোক— তুমি আমার সম্মানিত অতিথি— তারপর তোমার বন্দুকও বহুদিন উপবাসী— যদি নিজের হাতে তার পিপাসা মেটাতে চাও— চেষ্টা করে দেখতে দোষ কী? অদূরে গর্ত করেই একটা টুল নিয়ে ওর মধ্যে বসে থাকবে, ওপরে ডালপালার আচ্ছাদন দিয়ে এমন করে ঢেকে দেব, বাছাধন বুঝতে না পারে— কি বল?

কুদরত খাঁ নিমরাজি ভাব দেখালে বটে, কিন্তু ডি. এফ. ও. সাহেবের আদেশ। কাজেই লোকজন জোগাড় করে বেশ একটা গর্ত করে ডালপালা দিয়ে ঢেকে দিলে।

বেলা পাঁচটায় আমি টর্চ ফিট করা হেভি রাইফেল নিয়ে গর্তে ঢুকে পড়লাম। ওপরটা প্ল্যানমতো ঢেকে দিলে। আর সবাই নৌকায় ফিরে গেল। তারা আমাকে প্রতিশ্রুতি দিয়ে গেল— সারা রাত নৌকোয় জেগে থাকবে।

বসে আছি তো আছিই— প্রভুর দর্শন নেই। সুন্দরবনের বাঘ কি জাদু জানে?— সে কি ভেলকি দেখিয়ে আমাকে ঠকিয়ে যাবে?

বন্দুকটা ওপরে মাটিতে রেখে নীচে বসে আছি।

মনে মনে আরও চিন্তা করি, বাঘ যদি মাথার ওপর দিয়ে আসে, তাহলে? যা হবার হবে— সামনে, পেছনে, পাশে কড়া নজর রাখছি।

রাত প্রায় দুটো। ক্ষীণ চাঁদের অস্পষ্ট আলোয় দেখা গেল, কী যেন একটা এগিয়ে আসে। বিরাট একটা হাঁড়ির মতো মাথা— সামনের দুটো পা সাঁতার কাটার মতো করে ধীরে ধীরে এপাশ-ওপাশ ফেলে মাতালের মতো টলতে টলতে সেই মারির কাছে এসে থামল।

আমি টর্চ ফিট করা বন্দুক কাঁধে চেপে ধরলাম। তারপর ট্রিগারে আঙুল লাগিয়ে টর্চের বোতাম যেই টিপেছি— একরাশ আলোয় বাঘের সেই বিরাট মাথাটা অত্যন্ত পরিষ্কার আমার বন্দুকের নলের ঠিক সোজা পথে।

আলোর উৎসের দিকে তাকাতেই বাঘের গণ্ডদেশ স্পষ্ট চোখে পড়া আর গুলি ছোড়া একই মুহূর্তে।

জানোয়ারটা বিকট একটা গর্জন করলে বটে, কিন্তু সে ছুটেও গেল না, বা কোনো লাফও দিল না— শুধু ছিটকে একপাশে গড়িয়ে পড়ল।

বিচিত্র কী বেঁচে থাকার— তাই চুপ করে আছি।

বন্দুকের আওয়াজ শুনেই সামনের নৌকাগুলোর যত লোকজন হট্টগোল লাগিয়ে দিলে।

কিন্তু রাত্রে কারো বাইরে আসার উপায় নেই— আমার অবস্থাটাও সেই অন্ধকূপ-হত্যার শামিল।

ভোর হতেই বন্দি জীবনের অবসান। সর্বাগ্রে ছুটে আসে কুদরত খাঁ— তারপর মিস্টার আপরাইট— সর্বশেষে আলতাফ হোসেন। সে চিৎকার করে বললে— সুন্দরবনের মাটিতে নেমে গর্তে ঢুকে এ ধরনের শিকার আজ পর্যন্ত ক-টা হয়েছে, জানি না শুনিওনি।

আমার সঙ্গে শেকহ্যান্ড করে সে বললে— শাবাশ ভাই শাবাশ! পুরস্কারের পাঁচশো টাকা তোমারই।

—না বন্ধু, তোমার টাকার পরিবর্তে আমরা বরং পরস্পর পাঁচশো আলিঙ্গন করি, এসে। তোমার মতো এমন একটা মুরুব্বি না থাকলে আমার দ্বারা কখনোই এ ধরনের শিকার সম্ভব হত না। তোমার খাঁটি বন্ধুত্বই আমার চরম পুরস্কার।

অধ্যায় ১ / ২৮

সকল অধ্যায়

১. সুন্দরবনের শেষপ্রান্তে
২. শিকারের সন্ধানে
৩. নির্ভীক
৪. শিকারীর ক্ষোভ
৫. শিকারীর ভয়াবহ অভিজ্ঞতা
৬. বিপর্যয়
৭. হাওদা শিকার
৮. হাওদায় বসিয়া শিকার
৯. শিকারের কথা
১০. একদন্তের শেষ
১১. প্যান্থার
১২. মাচা থেকে চিতা ও অন্যান্য
১৩. জঙ্গলের ভ্রূকুটি
১৪. মহিষ
১৫. বীভৎস
১৬. কুমীর শিকার
১৭. হিমালয়ে ভল্লুক শিকার
১৮. কোয়াড়ে ভালুক শিকার
১৯. ভালুকের কবলে
২০. বাজ-বহেরী
২১. পদ্মায় পক্ষী শিকার
২২. পরিশিষ্ট
২৩. শিকারের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম
২৪. শিকার, শিকারী ও জীবজন্তু সম্বন্ধে বিবিধ জ্ঞাতব্য তথ্য
২৫. বন্দুক, বন্দুকের প্রকার ও ব্যবহার সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞাতব্য তথ্য
২৬. বাঙালির শিকারের আগ্নেয়াস্ত্র
২৭. ভারতের ব্যাঘ্র প্রকল্প
২৮. সহায়ক বাংলা পুস্তক তালিকা

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন