বিশ্বদেব গঙ্গোপাধ্যায়

কেদারনাথ চট্টোপাধ্যায়
প্রাণীবিজ্ঞানে সরীসৃপ বলতে যে জীবগুলি বুঝায়, তার মধ্যে সকলের চাইতে হিংস্র ও ভয়ানক বোধ হয় কুমির। কুমিরের অবশ্য নানা জাত আছে এবং তার মধ্যে সবকয়টিই সমান বড়ো বা হিংস্র নয়, অবশ্য সবকয়টিই মাংসাশী। বৈজ্ঞানিকরা বলেন যে, পৃথিবীতে একুশ রকম কুমির আছে, সেগুলি যথাক্রমে কুমির, এলিগেটর ও কেয়মান এই তিন নামে পরিচিত। আমাদের দেশে কুমিরকে সাধারণত দুই জাতে ভাগ করা হয়— মেছো কুমির, যাকে হিন্দিতে বলে ঘড়িয়াল এবং কুমির যাকে হিন্দিতে বলে মগর। ঘড়িয়ালের লম্বা সরু চোয়াল, পাখির ঠোঁটের মতো এবং তার ডগায়, নাকের ছিদ্রের আশেপাশে, একটা বড়ো মাংসের পিণ্ডের মতো থাকে। বড়ো কুমিরের চোয়াল ভারী এবং খাটো ত্রিভুজের আকৃতির। দেখলেই বুঝা যায় তার চোয়ালে ভয়ানক জোর। বড়ো বড়ো পশুও সে-কামড় সহজে ছাড়াতে পারে না।
মেছো কুমির সাধারণভাবে মাছ ধরেই খায় এবং তার মুখের ও চোয়ালের গড়ন মাছ ধরার পক্ষে খুব সুবিধার। কিন্তু তাই বলে মেছো কুমিরের শাস্ত্রে এমন কিছু নেই যাতে তার অন্য জীব, এমনকী সুবিধা পেলে মানুষ পর্যন্ত— ধরে খাওয়া নিষেধ আছে। তবে আমাদের দেশে বড়ো পশু, যথা গোরু, বাছুর, মানুষ ধরে খায় অন্য কুমিরই বেশি এবং সেই কারণে তাদের কাছেই ভয়ের কারণ বেশি। এই জাতের কুমির আমাদের দেশ থেকে নিয়ে দক্ষিণ চিন পর্যন্ত সব এলাকায় নদী অঞ্চলে পাওয়া যায়।

হিংস্র ও মানুষখেকো কুমিরের মধ্যে গঙ্গার মোহনা অঞ্চলের কুমিরই সবচেয়ে বড়ো ও ভয়ানক হয়ে থাকে। এখানকার কুমির তেত্রিশ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয় বলে জানা গিয়েছে। অবশ্য এখন বন্দুক ও রাইফল বহু লোকের হাতে গিয়েছে এবং সেগুলির পাল্লা ও মারণশক্তি প্রবল হয়েছে। উপরন্তু কুমিরের চামড়ায় তৈরি শৌখিন জিনিসের চাহিদা হওয়ায় কুমির শিকারে লাভের পথও হয়েছে। সেই কারণে যে সকল অঞ্চলে মানুষের বসতি ঘন বা যাওয়া-আসা সহজ সেখানে কুমিরের সংখ্যাও কমেছে এবং কুমির অত বড়ো হওয়ার সুযোগও আর পায় না। তবে সুন্দরবন অঞ্চলে বড়ো কুমির এখনও আছে এবং সেখান থেকে অন্য জায়গায় যাতায়াত করার পথ তাদের বন্ধ হয়নি, যদিও সেই যাতায়াত আগের মতো তাদের পক্ষে নির্বিবাদে হয় না। বড়ো কুমির নদীতে এসে গোরু ছাগল নিয়েছে এই সংবাদ পেলেই শিকারিদের কান খাড়া হয় এবং মানুষ নিলে সে-কুমির মারতে একাধিক শিকারি ঘোরাফেরা আরম্ভ করেন। যদি স্থানীয় লোকেরা কিছু সহায়তা করে, কুমিরের খোঁজখবর দেয়, তবে তাকে ঘায়েল করতে বা মারতে খুব বেশিদিন লাগে না। আগেকার দিনে এত বন্দুক রাইফলের লাইসেন্সও ছিল না এবং গঙ্গা ও তার শাখানদীগুলির তীরে এত ঘনবসতিও ছিল না। সুতরাং এক একটা অঞ্চলে যুগ যুগ ধরে একই কুমির উৎপাত করে যেত। সাহেব শিকারিদের কুমির মারার খুব উৎসাহ ছিল না, কেননা কুমির শিকারে ঝঞ্ঝাট অনেক এবং কুমির গুলি খেলেই সরসর করে জলে নেমে যায় বলে তার চামড়া পাওয়া কঠিন হত।
যেসব জায়গায় গোরু-ছাগল বা লোকজন নদীর জলে নামে জল খেতে বা নিতে, অথবা ধোয়া-মাজা বা স্নানের জন্য, তারই কাছে কুমির ঘোরে-ফেরে। জলের উপর ভাসে তার দুই চোখ ও নাকের ডগা, যা খুব লক্ষ করে না দেখলে নজরে পড়ে না। কোনো পশু বা অসাবধান লোক জলে নামলে কুমির দূর থেকে লক্ষ করে জলের ভিতর দিয়ে তিরবেগে এসে তাকে ধরে, বা ধরতে না পারলে লেজের প্রবল ঝাপটায় জলে ফেলে। তারপর জলের ভিতরে টেনে নিয়ে গিয়ে তাকে বারে বারে শূন্যে ছুড়ে দিয়ে ভালো করে কামড়ে ধরে নিয়ে ডুবিয়ে মেরে, নিজের গর্তের কাছে বা নিরিবিলি জায়গায় নিয়ে যায়। কত নির্বোধ পশু, কত অসাবধানী স্ত্রী-পুরুষ, চঞ্চল ছেলে-মেয়ে যে এইভাবে আগেকার দিনে কুমিরের কবলে যেত তার গোনাগুনতি নেই। বিশেষ করে বড়ো নদনদী অঞ্চলে তো ওইরকম দুর্ঘটনা প্রায় নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপারই ছিল।
গল্পে আছে যে, এক অন্যমনস্ক বউ আর তার অল্পবয়সি ননদ ভোরের দিকে, জনমানুষ চলাফেরার আগে নদীতে যায়। সেখানকার কাজ শেষ করে সে বাড়ি ফিরে চুপচাপ কীসের চিন্তায় ভুলে থাকে। এদিকে বেলা হবার সঙ্গেসঙ্গে বাড়ির লোকে তার সেই ছোটো ননদের খোঁজ করে, কিন্তু সে যে ওই বউয়ের সঙ্গে ভোরে বেরিয়েছিল তা কেউ দেখেনি, কাজেই তাকে কেউ জিজ্ঞেস করেনি।
বেলা হতে বাড়ির বউ-ঝিরা খেয়েদেয়ে যখন মুখ ধুচ্ছে, সেই সময় সেই ভোলা-মন বউ দেখল বাড়ির একটি ছোটো মেয়ে লাফালাফি করে নাচছে। সেই দেখে সে ছড়া কেটে বললে—
'কিবা কথা মনে এল আঁচাতে আঁচাতে
ঠাকুরঝিরে লইয়া গেল নাচাতে নাচাতে।'
গল্পে তারপর কী হল সেকথা বলে না। তবে কুমিরে মানুষ নেওয়া প্রায় এইরকম সাধারণ ব্যাপারই ছিল।
কুমির মারার ব্যবস্থাও নানারকম ছিল। একরকম বঁড়শি-কল ছিল যাতে ছ-টা কি আটটা বড়ো বড়ো ফলা দেওয়া বঁড়শি ইস্পাতের স্প্রিঙের উপর আঁটা থাকত। সেই স্প্রিংগুলো চেপে বঁড়শিগুলো একসঙ্গে করে তাঁত দিয়ে বাঁধলে সেটা পদ্মের কুঁড়ির মতো দেখতে হত। সেই বঁড়শির ভিতরে ও উপরে মাংসের তাল তাঁত দিয়ে বেঁধে, তার গোড়ার দিকের লোহার বোঁটায় ইস্পাতের সরু তার অনেকটা লম্বা করে বেঁধে তারপর দড়ি দিয়ে ডাঙায় মজবুত খোঁটা বা গাছের গুঁড়ির সঙ্গে তা শক্ত করে আটকে কুমিরের বাসার কাছে ফেলা থাকত। কুমির গিলে খায়— টুকরোও করে না, চিবিয়েও খায় না। সুতরাং এই টোপসুদ্ধ বঁড়শি গিলে আটকা পড়ত। এদিকে কুমিরের পেটে গিয়ে সেই বঁড়শির তাঁত গলে ছিঁড়ে যাবামাত্রই স্প্রিং খুলে সেই লোহার পদ্ম খোলা ছাতার মতো ছড়িয়ে কুমিরের পেটের ভিতর গেঁথে যেত। তারপর কুমিরকে টেনে ডাঙায় তুলে শেষ করতে আর কতক্ষণ?
ইছামতি নদীতে পঁচিশ-ত্রিশ বছর পূর্বেও খুব কুমিরের উৎপাত ছিল। আড়ংহাটায় নদীর ঘাটে একটু গভীর জলে অনেক বড়ো বড়ো সুঁদরী, গরান বা শালের সরু-মোটা গুঁড়ি পোঁতা থাকত দেখেছি। ঘাটে নৌকা আসার বাঁকা পথ ছিল, তা ছাড়া প্রায় সমস্ত ঘাটই এইরকম ছয়-সাত সারি খোঁটায় ঘেরা ছিল। এই ঘেরা জায়গায় কুমির ঢুকতে সাহস করত না, কেননা সেখানে লুকিয়ে ঢোকা সহজ নয় এবং শিকার নিয়ে যাওয়াও সহজ নয়। তবে আঘাটা জায়গায় গোরু-ছাগল তো যেতই, আবার অসাবধানে মানুষও যেত এবং মাঝে মাঝে তাদের কুমিরেও ধরত।
আমার এক বন্ধুর জমিদারি ছিল ওই অঞ্চলে। তাঁর কয়েক ভাই কুমির শিকারে খুব দক্ষ ছিলেন, বিশেষে মেজো ও সেজো ভাই। একবার তাঁরা আড়ংহাটার কাছারিবাড়িতে গিয়ে খবর পেলেন যে, একটা বড়ো কুমির খুব উৎপাত করছে। শুনে ওই দুই ভাই ওখানকার জেলেদের ডেকে খোঁজ করতে বললেন যে ওই কুমিরটা নদীর পাড়ে কোথায় রোদ পোয়াতে ওঠে। এখানে বলা দরকার যে, কুমিরমাত্রেই, বিশেষ করে শীতের দিনে নদীর পাড়ে রোদ পোয়াবার একটা জায়গা ঠিক করে। জায়গাটার ডাঙার দিক ঝোপঝাড় বা খানাখন্দে ঘেরা হওয়া চাই, যাতে ডাঙার দিক থেকে কুমিরকে দেখা অসম্ভব এবং তার কাছে পৌঁছানোও শক্ত। জায়গাটা নদীর দিকে খোলা ও উঁচু পাড়ের উপর হওয়া চাই, যাতে কুমির নদীর দিকে দূর পর্যন্ত নজর রাখতে পারে এবং দরকার পড়লে ঢালু পাড় দিয়ে সড়সড় করে জলে নেমে যেতে পারে।
বড়ো কুমিরমাত্রেই খুব হুঁশিয়ার। শীতের দিনে প্রায় নির্জীবের মতো অসাড় হয়ে শুয়ে তারা রোদ পোয়ায়। আমরা জেলে-নৌকায় চড়ে দূর থেকে দেখে আস্তে আস্তে সেদিকে এগিয়েছি। নৌকার খোলের মধ্যে পাটা দিয়ে শুয়ে গিয়েও দেখেছি, নৌকা যেমন এগিয়ে কুমিরকে বন্দুকের পাল্লার মধ্যে এনেছে, সঙ্গে সঙ্গে কুমিরও আস্তে আস্তে পাড় বেয়ে নেমে জলে গিয়েছে। যদিও এ বিষয়ে সন্দেহ নেই যে, সে শিকারিকে দেখতে পায়নি। অথচ যদি সেই নৌকায় শুধু জেলেরা থাকত তবে সে নড়ে দেখত কি না সন্দেহ। এমন কথাও শুনেছি যে, সুন্দরবনের কুমির পাড় থেকে নেমে এসে জেলেডিঙি উলটে দেবার চেষ্টাও করেছে। ফিরিঙ্গি খালের প্রসিদ্ধ মানুষখেকো তো জেলেনৌকা পর্যন্ত আক্রমণ করত। নৌকা ছোটো বা জেলেডিঙি হলে স্রোতের সঙ্গে দাঁড় টেনে দ্রুত এঁকেবেঁকে পালানো ছাড়া উপায় থাকত না। কেননা তার সেই ত্রিশ ফুট লম্বা তালগাছের গুঁড়ির মতো দেহ দিয়ে সে যদি নৌকো বা ডিঙির নীচে ঘষড়া দিতে একবার পারত, তবে হয় নৌকা উলটে লোকজন জলে পড়ত, নয়তো তলার কাঠ খুলে গিয়ে নৌকা ডুবে যেত। আর জলে পড়া মানেই যমের সঙ্গে সাক্ষাৎ!
যাই হোক আমার বন্ধুরা দুই ভাই স্থির করলেন যে, কুমিরটাকে মারতে হবে। তার খোঁজের জন্য কিছু বকশিশের ব্যবস্থা করায় জেলেরা নদীর পাড় ধরে অনেক দূর পর্যন্ত খুঁজে দেখতে লাগল। তারপর একদিন খবর এল যে বেশ কিছু দূরে একটা বড়ো কুমিরকে দেখা গিয়েছে নদীর পাড়ে ওইভাবে শুয়ে রোদ পোয়াচ্ছে। জায়গাটা খারাপ। নদীর পাড় সেখানে অনেকখানি ভাঙাচোরা; —কোথাও জলা, কোথাও খুব ঝোপঝাড়— মানে, সেখানে লোকজন চলাচলের মতো জায়গাই নেই। অনেক খোঁজখবর করার পর ঠিক হল যে সেই জায়গা ছাড়িয়ে, নদীপথে একটু এগিয়ে, একটা বাঁকের আড়ালে নেমে, ডাঙার পথ দিয়ে কুমিরের ওই আড্ডার পিছন দিক দিয়ে ওখানকার কাছবরাবর পৌঁছানো যাবে। তারপর তো শিকারের পালা; তাতে ঝোপজঙ্গলই-বা কী আর নদীনালা, জলা বা ভাঙনের চড়াই-বা কী? সে সবই তো শিকারের অঙ্গ।
জলপথে গিয়ে, পাড় ঘেঁষে নৌকা নিয়ে, কুমিরের কাছে সহজেই পৌঁছানো যেত— অন্তত রাইফেলের পাল্লার মধ্যে। কিন্তু তারপর একটার বেশি দুটো গুলি মারার সুযোগ হত না, কেননা নৌকা দেখবামাত্রই কুমির ঝাঁপিয়ে জলে পড়ত। গুলি খেয়ে সে মরে জলে ডুবে গেলে ওই পর্যন্তই। তারপর তার চিহ্নও দেখা যেত কি না সন্দেহ! বড়োজোর তার পচা দেহটা কোথাও নদীর পাড়ে বা চড়ায় পাওয়া যেত, তাতে শিকারির লাভ কী?
খোঁজখবরমতো সব ঠিক করার পর একদিন ওই শিকারি দুই ভাই, সঙ্গে লোকজন নিয়ে নৌকায় করে যথাস্থানে পৌঁছোলেন। তারপর পোয়া মাইল মাঠ ভেঙে, হেঁটে, কুমিরের আড্ডার কাছে এসে হাজির হলেন। যারা খোঁজ এনেছিল তাদের দুজন খুব সন্তর্পণে সরু পথ দেখিয়ে, ঝোপঝাড় আস্তে ফাঁক করে এঁদের নিয়ে চলল। ওই দুই ভায়ের মধ্যে মেজো যিনি তাঁর দেহ ছিল বিলক্ষণ মোটা এবং শরীরের শক্তিও ছিল অসাধারণ, কিন্তু শিকারের সময় তিনি যখন চলতেন তখন কোনো শব্দ হত না তাঁর চলার, এ আমি নিজে দেখেছি। তিনি আগে এবং তাঁর পায়ের চিহ্নের উপর পা ফেলে সেজোভাই চললেন। হঠাৎ সামনের দুজন একেবারে আড়ষ্ট হয়ে গুঁড়ি মেরে বসে গেল। বুঝা গেল যে শিকারের কাছেই পৌঁছানো গেছে। তখন মেজোভাই সেজোভাইকে ইশারায় খুব সাবধানে ঝোপের আড়াল ধরে, এগিয়ে আসতে বললেন।
সামনের লোক দুটির কাছে পৌঁছোতেই ঝোপের ভিতর দিয়ে দেখা গেল যে, পাঁচ-সাত গজ তফাতে একটা প্রকাণ্ড কুমির শুয়ে রয়েছে। দুই ভায়েরই হাতে দোনলা বারো বোরের বন্দুক 'রেডি' করাই ছিল। সেজোভাই উঠে দাঁড়িয়ে কুমিরের গর্দান লক্ষ করে গুলি চালালেন। গর্দানের কাছে শিরদাঁড়া 'রোটাক্স' বুলেটের মারে ঘায়েল হয়ে যাওয়ায় কুমিরটা দ্রুত এগিয়ে জলে পড়তে পারল না। কিন্তু বন্দুক তুলে মারবার মধ্যে কুমির যেটুকু সময় পেয়েছিল, তার মধ্যেই সে ঘাড় ফিরিয়ে শত্রুর দিকে তাকিয়ে, সেইসঙ্গে পাড়ের নীচের দিকে চলতে আরম্ভ করে। সেইজন্যে গুলির চোট পুরোমাত্রায় শিরদাঁড়ায় লাগেনি। গুলি লেগে কুমির উলটেপালটে নীচের দিকে গড়িয়ে গেল, কিন্তু সে কাত হওয়ার সঙ্গেসঙ্গে অন্য ব্যারেলের গুলি তার সামনের দুই পায়ের মাঝ বরাবর বুকে লাগল। দুই গুলি খেয়ে কুমিরের অবস্থা তখন শেষ হয়ে এসেছে এবং মেজোবাবু বন্দুক নিয়ে এগিয়ে যেতেই সাত-আটজন লোক লগি দিয়ে এবং বোট হুক দিয়ে কুমিরকে চেপে ধরলে।

ইতিমধ্যে ব্যবস্থামতো দুটো নৌকা, গুলির আওয়াজের সঙ্গেসঙ্গে নদীর উপর ওই জায়গার সামনে এসে তীরে ভিড়ল। তারপর কুমিরকে বাঁশের সঙ্গে বেঁধে 'হেঁইয়ো জোয়ান' করে নৌকায় তোলা হল। যখন কাছারির কাছের ঘাটে শিকার নিয়ে নৌকা ফিরল, তখন কুম্ভীর মহাশয় শেষ হয়ে গেছেন!
কুমিরটা বাইশ ফুট লম্বা ছিল এবং তার পেটে বড়ো বড়ো পাথরের নুড়ির সঙ্গে রুপোর বালা, মল, চুড়ি বেশ কয়েকটা পাওয়া যায়। কয়েকটি হতভাগিনী মেয়ে যে ওর পেটে গিয়েছিল তার স্পষ্ট প্রমাণ ওই গহনাগুলি থেকেই পাওয়া গেল।
এসব কথা ত্রিশ-বত্রিশ বৎসর আগেকার। তখন এদেশে জাপানিদের এক খুব বড়ো কোম্পানি, 'মিসুই বুশন কাইশা' অনেক আমদানি-রপ্তানির কারবার করত। তার জাপানি অফিসারেরা খেলাধুলায়, বিশেষ করে টেনিসে, খুব ভালো ছিল। তাদের মধ্যে দুজন, ওকোমাটো এবং সিমিটজু টেনিস খেলায় বিশ্ববিখ্যাত হয়েছিল।
ওইসব জাপানিদের সঙ্গে আমার ওই বন্ধুর চতুর্থ ভাই কাজে-কারবারে খুবই পরিচিত ছিলেন। একবার তাঁদের কলকাতার বাড়িতে ওই জাপানি সায়েবদের নিমন্ত্রণ করায়, তারা এসে ওই বাইশ ফুট কুমির এবং আরও তিন চারটে কুমিরের 'ট্রফি' দেখে মেজোবাবুকে ধরে বসল যে তাদের কুমির শিকারে নিয়ে যেতে হবে। তাদের বলা হল যে কুমির শিকারে কষ্ট আছে, কিন্তু তারা সেকথা হেসেই উড়িয়ে দিলে। বললে যে, 'আমরা মিলিটারি শিক্ষাপ্রাপ্ত জাপানি পল্টনের লোক, আমরা ওসবে থোড়াই ভয় পাই। কুমিরের কাছে নিয়ে গেলে আমরা দেখিয়ে দেব জাপানি রাইফেলে কুমির মরে কি না!'
আমার বন্ধুর দল বনেদি জমিদার গোছের, কাজেই এইরকম অনুরোধ তাঁরা ফেলতে পারেন না। এর কিছুদিন পরেই এক ছুটিতে চারজন জাপানি সাহেবকে নিয়ে তাঁরা তিন ভাই গেলেন ওই ইছামতিতে কুমির শিকারে। এবং আগের থেকে খোঁজ রাখার কথা কাছারিতে জানিয়ে দেওয়ায় তাঁরা যাবামাত্রই শুনলেন যে, একটা মাঝারি গোছের কুমির, ষোলো, সতেরো ফুট আন্দাজের, নদীর পাড়ে এক জায়গায় ডেরা করেছে, যেখানে যাওয়া খুব মুশকিল হবে না। খবর পেয়ে তো জাপানিরা খুব খুশি, তাদের আর তর সয় না, একটা রাত্রি শেষ হয়ে ভোর হতে।
পরের দিন যথাসময়ে নৌকায় করে সেই কুমিরের আড্ডার কাছাকাছি, শিকারির দল তো নেমে পড়লেন। তারপর কিছুটা হেঁটে যাবার পর, মেজোবাবু নীচু গলায় বললেন, 'এবারে নিঃশব্দে এগোতে হবে।' তার পরের কথা সেজোবাবুর জবানিতে এইমতো :
'আমরা তো টিপে টিপে একজনের পায়ের দাগের উপর পেছনের জন, এই করে এগোচ্ছি। যত এগোই তত জাপানিরা দাঁত বার করে হাসে, অবিশ্যি নিঃশব্দে। সেইসঙ্গে মাথা নেড়ে জিজ্ঞেস করে, 'কোথায়?' রাইফেল তো চারজনাই বাগিয়ে ধরেছে। আমার তো ভয়ই হতে লাগল যে, উৎসাহের চোটে শেষ পর্যন্ত আমাদেরই না মেরে বসে।
তারপর কাছাকাছি এসে পড়েছি যখন, তখন মেজদা হাত দিয়ে জোরে ইশারা করে বললেন, গুঁড়ি মেরে নীচে ঝুঁকে এগোতে, যাতে ঝোপের ওপারে কুমির টের না পায়, যে আমরা কাছে এসে পড়েছি। আমরা তো ঝুঁকে পায়ে পায়ে এগোতে যাচ্ছি, এমন সময় দেখলাম যে জাপানিরা একেবারে শুয়ে পড়ে বুকে হেঁটে চলল। বোধ হয় ওটা মিলিটারি চাল এই কথা ভাবতে ভাবতে এগোচ্ছি— কয়েক পা এভাবে গিয়েছি-কি-না-গিয়েছি, এমন সময় ওদের বড়োসাহেব জাপানি ভাষায় গাঁ গাঁ করে চেঁচিয়ে উঠে লাফাতে আরম্ভ করল। আর যত লাফায় তত তার গায়ের কোট, শার্ট, গেঞ্জি সব খুলে ছুড়ে ফেলে, রাইফল তো মাটিতেই পড়ে। বলব কী দাদা, লোকটা নিমেষের মধ্যে উদোম ন্যাংটো হয়ে গেল!
'আমরা সংবিৎ ফিরে পেয়ে, তাকে গিয়ে ধরে দেখি যে, লাল পিঁপড়েয় তাকে সর্বাঙ্গ ছেঁকে কামড়ে ধরেছে। তার গা থেকে পিঁপড়ে ছাড়িয়ে ভেতর বাইরে ব্র্যান্ডি প্রয়োগ করে, তাকে তো ঠান্ডা করা গেল। কিন্তু কুমির ততক্ষণে গঙ্গাসাগরে পাড়ি দিয়েছে!
'যাই হোক ফিরবার মুখে একটা চড়ায় একটা দশ-বারো ফুট কুমির দেখা গেল। সে বেটা উলটো দিকে মুখ করে ছিল, সুতরাং চারজন জাপানি কাছে পৌঁছে চারটে রাইফলের গুলিতে তুবড়ি ছুটিয়ে তাকে শেষ করলে। তাতেই তারা মহা খুশি, আর আমাদেরও আপদের শান্তি!'
এই হল জাপানি মতে কুমির শিকারের পালা।

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন