হাওদায় বসিয়া শিকার

বিশ্বদেব গঙ্গোপাধ্যায়

হাওদায় বসিয়া শিকার

কুমুদনাথ চৌধুরী

 

'হাতী পর হাওদা', আবার তার উপর নিজে রাজার মত ব'সে শিকার করা তো খুব আরাম! হিমালয়ের তরাইয়ে, আসাম আর শ্রীহট্টের জঙ্গলে বাঘ, গণ্ডার, মহিষ, সাম্বর হরিণ প্রভৃতি বড় বড় শিকার, এমন কি তিতির প্রভৃতি ছোট শিকার করবারও এই একমাত্র উপায়। এই সব জায়গায় ঘন জঙ্গল— যেন লম্বা ঘাস আর শরের গভীর সমুদ্র! এ ঘাস এতই লম্বা যে মাঝে মাঝে হাওদা ছাড়িয়ে ওঠে, আর এম্নি ঘন যে সম্মুখে যে সব প্রকাণ্ড হাতী শিকার-সন্ধানে আরোহীকে নিয়ে অগ্রসর হয়, তাদের একেবারে চোখের আড়াল ক'রে ফেলে। প্রতিপদেই গতিরোধ হয়। হাতীর পায়ের চাপে যে-সব ঘাস ভেঙে পড়ে, সেগুলো এম্নি মজবুত যে ভাঙবার আওয়াজটা পিস্তলের শব্দের মত শোনায়। এই উপায়ে যেদিন আমি প্রথম শিকার-সন্ধানে গিয়েছিলাম, সে কথা আমার এখনও বেশ মনে আছে। এ যেন বিচালীর গাদায় হারানো সূচ খুঁজতে যাওয়া! তবে মস্ত এই প্রভেদ যে, এ ক্ষেত্রে যে খুঁজতে যায়, তাকে নিরাশ হ'তে হয় না। যার আশায় 'ঢুঁরত ফিরি' তাকে ঠিক পাওয়া যায়। চলন্ত হাতীর উপর দোল খেতে খেতে তাক ঠিক রাখা অভ্যাস হতে একটু সময় লাগে আর তা ছাড়া ঢেউ এর মতো দোলায়মান ঘন ঘাসের মধ্যে কোন জানোয়ার চলে বেড়াচ্ছে, ভালো ক'রে বুঝতেও বিশেষ অভ্যাস আবশ্যক। হাওদা-শিকার ব্যয়সাধ্য। খুব কম লোকেরই এ রকম হাতী রাখবার সামর্থ্য হয়; আর যে দুচার জন রাখেন, তাঁরাও এ সব হাতীকে রীতিমতো শিক্ষা দিবার কষ্ট স্বীকার করেন না। এ ব্যাপারে গুটিকত রীতিমতো শিক্ষিত হাতী নিতান্তই দরকার। কিন্তু এ-রকম হাতী পাওয়া সহজ নয়। আর যদি পাওয়াই যায়, তা হলে তার দাম দিতে সোনার খনি নিঃশেষ করে ফেলতে হয়! তাই বা ক-জন পারে? হাওদা শিকারে কৃতকার্য হতে হলে এই রকম হাতী অন্তত ২৪।২৫ টি নইলে চলে না। কাজেই বুঝছ, আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ যার নাই, তার ভাগ্যে এ শিকার ঘটা দুঃসাধ্য।

এক সময়ে আমাদের এই বাঙ্গলা দেশ ভারতের অন্য সব প্রদেশের চেয়ে শিকার ব্যাপারে বেশি উন্নতি করেছিল। দেশের জমিদারদের মধ্যে এ সম্বন্ধে স্বাস্থ্যকর প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল। শিকার করা তাঁরা গৌরবের কথা মনে করতেন, আর এই সূত্রে পরস্পরে প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন। এখন আর সেদিন নেই বললেই হয়। বর্ত্তমান জমিদারবর্গ অনেকেই পাশ্চাত্য আহারে বিহারে, বিলাস ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়েছেন। কলপ দেওয়া কড়া কামিজ 'কলার' তাঁরা মুনি-ঋষির কৃচ্ছ্রসাধনের মতোই অপরিহার্য্য মনে করেন। ব্যামিশ্র নিষিদ্ধ আহার্য্য সনাতন স্বাস্থ্যকর খাদ্য অপেক্ষা লোভনীয় হয়ে পড়েছে। যে সকল উগ্র পানীয় এক সময় কেবলমাত্র ঔষধার্থে ব্যবহার করবার বিধি ছিল, এখন সে সকল তাঁরা নিত্য-নৈমিত্তিক করে নিয়েছেন, আর তার অপরিমিত ব্যবহারই পৌরুষ বলে জ্ঞান করেন! নিঃশব্দ-সঞ্চার মখমল-মোড়া 'মোটর'যান ব্যতীত চলাফেরা করতে তাঁদের মন ওঠে না! এইগুলি হচ্ছে আধুনিক জমিদারবর্গের আধ্যাত্মিক পরিমাপ। দৈহিক মাপটি তাঁদের ইংরাজ-দর্জির কাছে পাওয়া সহজ। এদের তরঙ্গায়িত বরবপুগুলি কোট-প্যান্টে ঢাকিয়া সুষ্ট করে রাখাই তাদের কর্ত্তব্য। কোথায় কখন কী-ভাবে ঐ সৌন্দর্য্য ফেটে বেরিয়ে পড়বে তার জন্যে বিশেষ সাবধান হওয়া আবশ্যক। একবার একজন রাজকর্ম্মচারী কোনও জমিদার রাজাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন— 'রাজা, একটি সিগারেট খাবে কি?' আধুনিক আলোকপ্রাপ্ত এই হঠাৎ-নবাবটি বলে উঠলেন— 'আমি শুধু হাভানা ব্যবহার করে থাকি'! হাভানা সর্ব্বোৎকৃষ্ট, সর্বাপেক্ষা অধিক দামী চুরুট। আজকালকার দিনে ম্যানিলা (manilla) আর মিউরিয়ার (muria) প্রভেদ বুঝতে পারাই হচ্ছে সভ্যতার সদগুণের বিশিষ্ট পরিচয়! আর বিবিধ মদ্যের জাতি, গোত্র, গাঁই, কুলচি জ্ঞান যদি থাকে, তা হলে সে তো ইংরাজী কিংবা সংস্কৃত সাহিত্যের অভিজ্ঞতার চেয়ে সমধিক গৌরবের বিষয়! বাক্যালাপ অধিকাংশ সময়ই অকথ্য বিষয় সম্বন্ধেই হয়ে থাকে। যদিও এরা ছুরি কাঁটায় খাবার কায়দাটা খুব ভালোই শিখে নিয়েছেন, তবু পাশ্চাত্য সভ্যতার যথার্থ প্রভাবের বাহিরে পড়ে থাকায়, তার শিল্প, সাহিত্য সম্বন্ধে অজ্ঞতা-বশত সর্ব্বদা কেবলমাত্র বাহ্যাড়ম্বর ও অস্বাস্থ্যকর অবস্থার মধ্যে বাস করে এঁরা দিন দিন অকর্ম্মণ্য ও হীনস্বভাব হয়ে পড়েছেন। মাঝ হতে রাজোচিত মৃগয়া কৌশলের ও চর্চার সমাদর চলে যাচ্ছে।

হাওদার উপরে শিকার করা কোন কোন শিকারীর অভ্যাস আছে তাঁরা অনেকগুলি করে গুলিভরা বন্দুক সঙ্গে নিয়ে যান। তাতে নানান দুর্ঘটনা ঘটবার বিশেষ সম্ভাবনা। আমার মনে আছে একজন অল্পবয়স্ক জমিদার এই অভ্যাসবশত মারা যান। হাতী যখন উপরের দিকে উঠছিল বন্দুক গড়িয়ে পড়ায় গুলি বাহির হয়ে যায়। তাতেই তাঁর মৃত্যু হয়। অভ্যাস করিলে, একটি বন্দুকের সঙ্গে আর একটি তুলে নিতে যে পরিমাণ সময় লাগে, তাতেই অনায়াসে সেটিতে গুলি ভরে নিতে পারা যায়। আর যে বন্দুকটি সর্বদা ব্যবহার করে করে একেবারে আপনার হয়ে গিয়েছে তার কাছে যেমন কাজ পাওয়া যায় নতুন অজানা বন্দুকের কাছে তা হবার জো নেই। আর একটি কাজ কখনো করো না! সম্মুখে ঘাস শুধু নড়ে উঠেছে বলে, জন্তুটিকে যতক্ষণ স্বচক্ষে না দেখতে পাও ততক্ষণ বন্দুক ছুঁড়ো না। সম্মুখের ঘাস নড়ে উঠলেও জন্তুটি হয় তো তা হতে অনেক দূর কিংবা পিছনে পড়ে থাকে।

হাওদা শিকারের লাইন বাঁধবার দুটি নিয়ম আছে। —তার মধ্যে একটি হচ্ছে সূর্ত্তি খেলে যার যেমন নাম উঠবে সেই ভাবে সাজান, কিংবা শিকারের দলপতি (আর সকলে যাঁরা নিমন্ত্রিত অতিথি)— তিনি যে ভাবে দল ভাগ করে দেবেন সেই মতো সাজান। এই সারি বাঁধাটা ধনুকের আকারে করা ভালো। পাশের জায়গা হচ্ছে শিকারের পক্ষে সব চেয়ে সুবিধাজনক। পতাকার সঙ্কেতে এগোতে পিছতে, সারিটা প্রশস্ত কিংবা সঙ্কীর্ণ করে নিতে হয়। এর চেয়ে কিন্তু হাওদায় করে দু-একজন শিকারীকে সম্মুখে পাঠিয়ে তাদের দিয়ে শিকার জড়ো করিয়ে নিলে বেশি সুবিধা হয়। কোথায় কী ভাবে এসব হাতী সারি বেঁধে দাঁড়াবে সে বিষয় স্থির করতে বিশেষ অভিজ্ঞতার আবশ্যক। তার পরে যাতে বাঘ এসে পাশ কাটিয়ে না পালিয়ে যায় কিংবা এই সব হাতীর উপর এসে না পড়ে, সে সম্বন্ধে সতর্ক হবার জন্যে সাহস এবং চাতুরী দুইই কাজে লাগা দরকার। অনেক সময় এমনও হয় যে বাঘ গুড়ি মেরে ব'সে থাকার দরুন অন্ততঃ সেই সময়ের জন্যে, চোখে পড়ে না। সব সময়েই যে নির্ব্বিঘ্নে কার্য্য উদ্ধার হয় তা নয়; কেননা বাঘ যেম্নি এই হাওদাধারী হাতীটিকে দেখে আর অম্নি চার পা তুলে লাফিয়ে ছুটে আসে।

ঘাসের মধ্যে দিয়ে বাঘ যখন আক্রমণ করবার জন্যে ছুটে আসে সে বড় চমৎকার দৃশ্য! দেবতার দেখলেও খুসী হ'য়ে যান। এ স্থলে শুধু হাতীটি নির্ব্বিকার হলে চলে না— শিকারীর গুলিটিও অবিকল সোজা চলা চাই। তবেই বিপদ এড়ান যায়। গুলি না ছাড়লে তো শিকার মরে না। আর সেই সঙ্কট মুহূর্ত্তে সে সম্বন্ধে কোন দ্বিধা করা চলে না। গুলি ছুঁড়তেই হয়; তা তোমার লক্ষ্য যেমনই হ'ক না কেন! গুলি ফসকে গেলেও এ সময় কাজ হয়! কেননা শব্দ শুনে অনেক সময় বাঘ পালিয়ে যায়। কারো ক্ষতি করার সুবিধা পায় না।

এ সব জায়গায় বাঘ কোথাও একটা খুন খারাবী করেছে এ সংবাদ না পাওয়া গেলে তাকে খুঁজে পাওয়া কঠিন। হত্যাকাণ্ড হয়ে গেলেও এই ঘন ঘাস জঙ্গলে সে খবর জানতে দু একদিন চ'লে যায়। যখন দেখা যায় মস্ত মস্ত শকুন চক্র ক'রে ঘুরে ঘুরে উড়ছে অথচ ঘাসের মধ্যে নামছে না, কিংবা ভুঁয়ে নেমে লাফিয়ে পালাচ্ছে না, তখনই বোঝা যায় খুনী ব্যাঘ্রটি কাছাকাছি কোথাও আস্তানা নিয়েছে। এই দস্যুটিকে ফাঁদে ফেলবার জন্যে মাঠে গরু মোষ বেঁধে দিলে অনেক সময় উদ্দেশ্য সাধন হতে দেখেছি। এই উপায়ে একবার চমৎকার একটি বাঘিনীকে হস্তগত করা গিয়েছিল।

এই হাওদা-শিকারের প্রধান বিপদ জলাভূমিতে গিয়ে পড়া। হাতীর মত সাহসী সতর্ক জন্তুও কাদায় পা ব'সে যাচ্ছে দেখলে ভয়ে কাণ্ডজ্ঞান রহিত হ'য়ে যায়। একটা দৃশ্য ঠিক যেন কালকের ঘটনার মত আমার স্পষ্ট মনে আসছে। আমাদের হাতীর সমস্ত সারি, সংখ্যায় প্রায় পঁচিশটি হবে, গারো পাহাড়ের চোরা বালির মধ্যে প'ড়ে হাবুডুবু খেতে লাগল। আমরা বন্য মহিষ আর জলাভূমির হরিণ শিকারে বেরিয়েছিলাম। পথটা মাহুতদের পরিচিত। সেটা ভূমিকম্পের পরের বৎসর। খুব সম্ভব পাহাড়ের উপরকার আলগা মাটি বৃষ্টির জলে ধুয়ে নীচে এসে পড়েছিল। যে জায়গা সবুজ ঘাসে ঢাকা সযত্ন-রক্ষিত শাদ্বলের মত মনে হয়েছিল, সেটি কয়েক হাত গভীর চোরা বালি ছাড়া আর কিছুই ছিল না। আমরা তখনই শরবনে ঢাকা একটা জলাভূমি হতে সবে মাত্র বেরিয়ে এই সঙ্কটস্থানে এসে পড়লাম। অনতিদূরে হাত চল্লিশ তফাতে শুকনো ডাঙা ছিল। প্রত্যেকটি হাতী প্রাণপণ চেষ্টায় অগ্রসর হ'তে লাগল। সবাই ভয়ে চীৎকার ক'রতে ক'রতে চলেছিল। যাদের পিঠে হাওদা ছিল সব চেয়ে দুরবস্থা হয়েছিল তাদেরই। এই দলের মধ্যে শ্রীহট্ট অরণ্যবাসিনী একটি হস্তিনী সর্ব প্রথম নিরাপদ স্থানে গিয়ে পৌঁছিল। এই বুদ্ধিমতী বড় বড় ঘাসের বোঝা শুঁড়ে উপড়ে নিয়ে পায়ের তলায় বিছিয়ে পা রাখবার ঠাঁই ক'রে নিতে লাগল। সকলেই নির্ব্বিঘ্নে অপর পাড়ে উত্তীর্ণ হ'ল, কিন্তু এই জীবন-মৃত্যু সংগ্রামে জয়ী হবার জন্যে তাদের এতই কষ্ট আর পরিশ্রম ক'রতে হয়েছিল যে, তার পর দুদিন আর তাদের চলৎশক্তি ছিল না। একটা খাল পার হতে গিয়ে রাজা একটি হাতী হারালেন। সে পারঘাটার একটু দূরে পার হবার চেষ্টা করেছিল,— কিন্তু বৃথা! আস্তে আস্তে সে কোথায় অদৃশ্য হ'য়ে গেল! মাহুত শুধু প্রাণ হাতে ক'রে সাঁতার দিয়ে অপর পারে গিয়ে উঠল।

শিকার ক'রতে গিয়ে প্রত্যেক শিকারীর প্রধান কর্ত্তব্য একে অপরকে প্রীত মনে সাহায্য করা। যদিই বা শিকার নিয়ে দুর্ভাগ্যবশতঃ কোন বিবাদ বিসংবাদ উপস্থিত হয়, তা হ'লে শিকারকর্ত্তা এ সম্বন্ধে যে বিচার করেন, সেইটিই সন্তুষ্টচিত্তে মেনে নেওয়া উচিত। নিজের ন্যায্য দাবী বরং ছেড়ে দেওয়া ভাল তবু কলহ ক'রে মৃগয়া-শিবিরের শান্তি ও সন্তোষহানি করা কখনও উচিত নয়। একটুও মন ভারী না ক'রে নিজের নির্দ্দিষ্ট জায়গাটি গ্রহণ ক'রো আর মনে ক'রো, সেইটিই তোমার পক্ষে সব চেয়ে সুবিধাজনক। স্বার্থপর, অসন্তুষ্টচিত্ত লোকেরই 'পরিণামে পরিতাপ অবশ্যই ঘটে'। নির্বোধ কিংবা মন্দমতির প্রতি ভাগ্য সুপ্রসন্ন হন না। গেল বৎসর আমারই চাক্ষুষ এই রকম একটি ব্যাপার ঘটেছিল। খবর এল, একটি প্রকাণ্ড বাঘ বাথানের সব চেয়ে ভাল গোরুটিকে মেরেছে। তার পর সেটিকে টেনে নদীর তীরে নিয়ে গিয়েছে, হেঁটে নদী পার হ'য়ে শিকার-শুদ্ধ এক শিমুলতলায় উঠেছে। আমরা সেদিন একটি আহত বাঘের সন্ধানে ফিরছিলাম। আগের দিন আমাদের শিকারকর্ত্তা সেটিকে গুলি করেছিলেন, মারা পড়েনি। সেই জন্যে সেদিন আমরা নূতন আগন্তুকের খোঁজে আর গেলাম না। যদিও সহজেই এ কাজটা সেই দিনই উদ্ধার হ'তে পারত। আমাদের শিকারকর্ত্তা কিন্তু মৃগয়া-ব্যবসায়ীর সহজ-সংস্কার বশতঃই হাতের কাজ শেষ ক'রে, পরের দিনের জন্যে অন্যটি স্থগিত রাখলেন। আহত বাঘটি তো পাওয়া গেলই, উপরন্তু সেই জঙ্গলেই আর একটিও আমরা মারলাম। ডাক্তার— শেষের বাঘটির জন্যে প্রথম গুলির ব্যবস্থা করেন, কিন্তু চরম ঔষধ, নিদান কালের বিষবড়ি, প্রয়োগ করবার ভার অন্যের হাতেই ছেড়ে দিয়েছিলেন। আমরা আশাতীত ফল লাভ ক'রে আনন্দে তাঁবুতে ফিরে পরের দিনের অভীষ্ট লাভের প্রত্যাশায় উৎসুক হ'য়ে প্রতীক্ষা ক'রে রহিলাম।

গরুর হাড়ের খবর বাড়ীতে লিখবার মত প্রসঙ্গ নয়। বিশেষতঃ তাহাতে কাক কি কোকিলের এক দানা মাংসেরও প্রত্যাশা ছিল না। আমরা এই গোহত্যাকারীকে পাহাড়ে, মাঠে, খানাখন্দে, সম্ভব অসম্ভব সব জায়গায় খুঁজে যখন বেলা দুটো পর্য্যন্ত কোন কিনারা ক'রতে পারলাম না, তখন অতিথিদের মধ্যে কেউ কেউ মধ্যাহ্ন ভোজনের চেষ্টায় তাঁবুতে ফিরে গেলেন। এই কারণে আমাদের লাইন হ'তে তিনটি হাতী কম প'ড়ে গেল। তাঁদের ফিরে আসতেও অনেক সময় কেটে গেল। আমাদের শিকার-নেতা এই সময়টি বৃথা অপব্যয় না করে শিকারের সন্ধানেই ফিরছিলেন, বেলাও প'ড়ে আসছিল। তাই আর একটিবার মাত্র খোঁজে বেরুবার মত সময় তখন হাতে ছিল। নদীটি যেখানে অর্দ্ধচন্দ্রাকারে ঘুরে এসেছে, তারই তীরে ঘাস আর শর দিয়ে ঢাকা একখণ্ড জমি ছিল। লম্বায় প্রায় তিন কি চার শ' আর প্রস্থে ১০০ কি ১৩০ গজ। দু'কোণায় জঙ্গলটি ক্রমে ফাঁক হ'য়ে এসেছে; গাছপালা বড় একটা ছিল না। বাঘ যে পথে আসছিল সেটা ছেড়ে অন্য দিকে ফিরে ছিল। তাই আমাদেরও এগোবার লাইন নূতন ক'রে বেঁধে হাতীর মুখ ঘুরিয়ে বিপরীত পথে যাত্রা করতে হল। আমি একেবারে লাইনের শেষে ছিলাম। ঠিক ডাইনের দিকে খানিকটা খোলা ময়দান আর গোচারণের মাঠ ছিল। আমার বাঁয়ে তিন হাওদায় তিন শিকারী ছিলেন। উভয় দিক হ'তেই তাঁদের অধিকৃত স্থানগুলিকে উত্তম উত্তমতর আর অত্যুত্তম বলা যেতে পারে। পঞ্চম হাওদা যাঁর অধিকারে ছিল, তিনি নদীর পারে বিরাজ করছিলেন। আমি যে জায়গাটি পেয়েছিলাম তাতে দৈব সুপ্রসন্ন না হ'লে কিছুই ঘটবার আশা ছিল না। সম্মুখে প্রায় ৮০ গজ পর্য্যন্ত ফাঁকা জমির মাঝে দু-একটি গাছের গুচ্ছ দেখা যচ্ছিল। সে যেন ঠিক ন্যাড়ার মাথায় অর্কফলার মত, —এদিকে ওদিকে খোঁচা খোঁচা শূয়োর কুঁচির মত খাড়া খাড়া! দুএকটি গাছ সমস্ত মাঠটির অনুর্ব্বরতা আরও যেন চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছিল। নদীর বাঁক ধ'রে হাতীর সারি ক্রমে অগ্রসর হচ্ছিল। অল্পক্ষণের মধ্যে বাঘের সান্নিধ্য যতই নিকটতর হতে লাগল, চারিদিকে উত্তেজনার আভাস ততই দৃষ্টি ও শ্রুতিগোচর হল। হাতীর হুঙ্কার, শুণ্ড আস্ফালন ও প্রহরী জমিদারের ভঙ্গী হ'তেই বুঝা গেল, বাঘ নির্দিষ্ট পথে আসছে না, কিন্তু হাতীর সারির মধ্যে যে স্থানটি সব চেয়ে নিরাপদ, সেইখান দিয়ে পলায়নের সুযোগ খুঁজছে। হাতীগুলি যেমন দৃঢ়ভাবে শ্রেণীবদ্ধ হ'য়ে দাঁড়িয়েছিল, সহজে সেখান হ'তে পলায়নের সুযোগ পাওয়া কঠিন। আমার সম্মুখের ঘাসবন ঈষৎ ন'ড়ে উঠতেই আমার সমস্ত শরীর যেন সজীব হ'য়ে উঠল। আমি রুদ্ধনিশ্বাসে একাগ্র দৃষ্টিতে প্রতীক্ষা করে রইলাম। দু'এক মুহূর্ত্তের মধ্যেই একটি প্রকাণ্ড আশ্চর্য্য সুন্দর শার্দ্দূলরাজের উত্তমাঙ্গ আমার দৃষ্টিগোচর হ'ল। তখন সে দূরে,— অনেক দূরে। সম্মুখের খোলা মাঠ দিয়ে সে যে আরও কাছে এগিয়ে আসবে তার কোন সম্ভাবনা ছিল না। কিন্তু আমার দৃষ্টি, মুষ্টি এবং মস্তিষ্ক সবই ঠিক ছিল—.৪৬৫ নং গুলি ছুটে গেল! ব্যাঘ্ররাজ কোথায়? কোথায় অদৃশ্য হলেন? না অদৃশ্য হন নি! বিরল তৃণরাজির মধ্য হ'তে দেখতে পেলাম তিনি ধরা শয্যা গ্রহণ করেছেন! বিশাল শরীর নিস্পন্দ; জীবনের চিহ্নমাত্র নাই! মাহুতকে হুকুম দিলাম, 'বাড়াও'। ডানচোখের উপর একটি সামান্য ক্ষতচিহ্ন, নাক দিয়ে মস্তিষ্ক-মিশ্রিত রক্তধারা ব'য়ে আসছে, শরীর পাথরের মত নিশ্চল, অসাড়!

 

(বানান অপরিবর্তিত)

সকল অধ্যায়

১. সুন্দরবনের শেষপ্রান্তে
২. শিকারের সন্ধানে
৩. নির্ভীক
৪. শিকারীর ক্ষোভ
৫. শিকারীর ভয়াবহ অভিজ্ঞতা
৬. বিপর্যয়
৭. হাওদা শিকার
৮. হাওদায় বসিয়া শিকার
৯. শিকারের কথা
১০. একদন্তের শেষ
১১. প্যান্থার
১২. মাচা থেকে চিতা ও অন্যান্য
১৩. জঙ্গলের ভ্রূকুটি
১৪. মহিষ
১৫. বীভৎস
১৬. কুমীর শিকার
১৭. হিমালয়ে ভল্লুক শিকার
১৮. কোয়াড়ে ভালুক শিকার
১৯. ভালুকের কবলে
২০. বাজ-বহেরী
২১. পদ্মায় পক্ষী শিকার
২২. পরিশিষ্ট
২৩. শিকারের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম
২৪. শিকার, শিকারী ও জীবজন্তু সম্বন্ধে বিবিধ জ্ঞাতব্য তথ্য
২৫. বন্দুক, বন্দুকের প্রকার ও ব্যবহার সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞাতব্য তথ্য
২৬. বাঙালির শিকারের আগ্নেয়াস্ত্র
২৭. ভারতের ব্যাঘ্র প্রকল্প
২৮. সহায়ক বাংলা পুস্তক তালিকা

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন