বন্দুক, বন্দুকের প্রকার ও ব্যবহার সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞাতব্য তথ্য

বিশ্বদেব গঙ্গোপাধ্যায়

বন্দুক, বন্দুকের প্রকার ও ব্যবহার সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞাতব্য তথ্য

বন্দুক মোটামুটি দুই রকমের বলা যেতে পারে। এক হচ্ছে স্মুথ-বোর (smooth-bore) বন্দুক, আর এক রকম হ'ল রাইফল (Rifle)। নলের ভিতরের গঠনকে বোর বলে। স্মুথ-বোর বন্দুকের নলের ভিতরটা একেবারে মসৃণ বা প্লেন, —একটা সাধারণ জলের পাইপের ভিতরটা যেমন হয়। ...রাইফলের নলের ভিতরটা সম্পূর্ণ প্লেন নয়, আগাগোড়া স্ক্রুয়ের মতো করে একটা অগভীর প্যাচালো খাঁজ কাটা থাকে। ছিদ্রের ভিতরে আলো ফেলে দেখলেই ঐ খাঁজটিও স্পষ্ট দেখা যায়। রাইফলের নল সম্পূর্ণ ইউরোপ থেকে আমদানী। ইউরোপীয়েরা আমাদের দেশে আসবার আগে আমাদের দেশের লোকেরা 'সাদানলী' বন্দুকের ব্যবহার জানত।

এই দুই রকম বন্দুকই এক নল বা দুই নলের হতে পারে। দুই নলের বন্দুককে দু'নলী বা জোড় নলী বন্দুক বলে। এক রকম একনলী রাইফল আছে, তার নাম মেগাজিন (Magazine) রাইফল। মেগাজিন মানে একটি আধার যার মধ্যে কতকগুলি কার্তুজ রাখা যায়। এই রকম একটি করে মেগাজিন এই রাইফলগুলিতে সংযুক্ত থাকে এবং মেগাজিনটি রাইফেলের একটি অংশ বলা যেতে পারে। মেগাজিন রাইফেল এমনভাবে তৈরী যাতে একটি কার্তুজ ফায়ার হবার পর, বন্দুক সংলগ্ন কোন বিশেষ অংশ (যার নাম লিভার) হাত দিয়ে ঠেলা বা টানা মাত্রই যে কার্তুজটি ফায়ার হয়ে গেল, সেটি নল থেকে বেরিয়ে পড়ে যায় এবং সঙ্গে সঙ্গে মেগাজিন থেকে আর একটি কার্তুজ গিয়ে নলের মধ্যে ঢোকে। ...সাধারণত পাঁচ বা ছ'টা কার্তুজ এক একটি মেগাজিনে থাকে। আবার এরকম মেগাজিন রাইফলও আছে, যাতে একটা কার্তুজ ফায়ার হওয়ার পর আর হাত দিয়ে কিছুই করতে হয় না, আপনা-আপনি ফায়ার হওয়া কার্তুজ তৎক্ষণাৎ নল থেকে বেরিয়ে যায় এবং তার জায়গায় আর একটা কার্তুজ মেগাজিন থেকে বেরিয়ে নলের ভিতরে যায়। ...আজকাল প্রায় সমস্ত যুদ্ধের রাইফলই এই রকমের। একে অটোমেটিক রাইফল বলে।

...রাইফলে ছটরা ব্যবহার করা যায় না। প্রত্যেক ফায়ারে কেবলমাত্র একটি বুলেট বা গুলি ছোঁড়া যায়। সুতরাং রাইফল দিয়ে পাখী শিকার— বিশেষতঃ উড়ন্ত পাখী শিকার চলে না। ...পাখী শিকারে সাদানলী বন্দুকই ব্যবহার হয়, রাইফল ব্যবহার হয় না... আমরা সাধারণতঃ যে সব সাদানলী ব্যবহার করি তার গুলি সত্তর-আশী গজের বেশী দূর শিকারের জন্তুর পক্ষে বড় একটা মারাত্মক হয় না। কিন্তু রাইফল সাদানলীর চেয়ে অনেক গুণ বেশী শক্তিশালী অস্ত্র। বড় জন্তু শিকারের জন্য তৈরী একটা সাধারণ রাইফল দিয়ে পাঁচ ছয় শত গজ দূর থেকে বাঘ-ভাল্লুক সহজে মারা যায়, যদি ঠিক মত লাগাতে পারা যায়। ...আমার যা অভিজ্ঞতা তাতে শিকারে দুইশত গজের বেশী দূর থেকে ফায়ার করা প্রায়ই আবশ্যক হয় না। অধিকাংশ শিকার একশত গজের ভিতরেই হয়ে থাকে।

*

বন্দুকের নলের ছিদ্রকে ইংরেজীতে বোর বলে। আমরা যে সাদানলী বন্দুক বেশী ব্যবহার করি তার বোরের নম্বর হচ্ছে ১২। ...এই ১২ নম্বরের সাদানলীর বোরের ব্যাসের পরিমাণ বা ফাঁদ হচ্ছে এক ইঞ্চিকে চার ভাগ করে তিন ভাগ নিলে যতটা হয় তার চেয়ে সামান্য একটু কম। কিন্তু রাইফলের বোরের কথা যখন বলা হয়— তখন ঐ রকম মনগড়া নম্বর দিয়ে বলা হয় না। একেবারে বুঝে নেওয়া যায়, তার বোরের ফাঁদ এক ইঞ্চির কত অংশ। যেমন যদি কেউ বলে, 'এটা পাঁচশো বোরের রাইফল,' তখনই বুঝতে হবে তার বোরের ব্যাস এক ইঞ্চিকে এক হাজার ভাগ করে তার পাঁচশত ভাগ নিলে যতটা হয় ঠিক ততটা— অর্থাৎ আধ ইঞ্চি। সেই রকম 'চারশত বোরের রাইফল' মানে তার বোরের ব্যাস ঠিক

বা ২/৫ ইঞ্চি।

*

১২ নম্বর সাদানলীর নলের দৈর্ঘ্য ও বোরের ব্যাস আজকাল শিকারে যে সব রাইফল ব্যবহার হয় তার চেয়ে বড়, কিন্তু ঐরূপ সাদানলীর ওজন ঐসব রাইফলের চেয়ে কম। তার কারণ, কার্তুজ ফায়ার হওয়ার সময় যাতে বারুদের বিস্ফোরণের জোরে নলা ফেটে না যায় এরকম দৃঢ় ক'রে নলা তৈরী করতে যতটা ইস্পাতের দরকার হয়, তা সাদানলীর চেয়ে রাইফলে অনেক বেশি লাগে। ... আজকাল বড়ো জন্তু শিকারের জন্য অত্যন্ত শক্তিশালী (high velocity) রাইফল সাধারণতঃ ৩৫০-৫০০ বোরের মধ্যে হয়ে থাকে। ৪০০ বা ৪০৫ বোরের চেয়ে বেশী খুব কম লোকই ব্যবহার করে। তার চেয়ে বড় বোরের রাইফল বিষম ভারী হয় আর তা ব্যবহার করতে খুব শক্তিমান হওয়া দরকার।

*

রাইফলের নলীর ছিদ্রের গায়ে স্ক্রুর মতো যে খাঁজকাটা থাকে তাতে প্রধানতঃ ফায়ার করার সঙ্গে সঙ্গে বুলেটটি নলার মধ্য দিয়ে চালিত হয়ে ঐ প্যাঁচকাটা খাঁজের সঙ্গে ঘর্ষণ পেয়ে মহাবেগে ঘুরতে ঘুরতে নলার মুখ থেকে বা'র হয়, এবং যতদূর ঐ রকম ঘুরতে ঘুরতে সোজা লাইনে ছোটে। ঐ মহাবেগে ঘোরার ফলেই বুলেট বহুদূর পর্যন্ত আপনার সরল গতিপথ থেকে পাশাপাশিভাবে বিচ্যুত হয় না, কেবল যেতে যেতে পৃথিবীর আকর্ষণে ক্রমশঃ নেমে প'ড়ে মাটিতে আঘাত করে।

*

শিকারে মেগাজিন রাইফলের চেয়ে জোড়নালী রাইফল বেশী উপযোগী, এ অনেক শিকারীর মত। তার কারণ এই যে, শিকারের জন্তুর উপর থেকে লক্ষ্য না সরিয়ে জোড়নলী বন্দুকে একটার পর একটা, এরূপ দুইটা ফায়ার করা যায়, কিন্তু মেগাজিন রাইফলে তা করা যায় না। ... জোড়নলীতে তুমি নিমেষ না ফেলতে বাঘের উপর আরেকটি ফায়ার করতে পার, কিন্তু মেগাজিনে তা পারবে না। তুমি যতক্ষণে হাত দিয়ে লিভারের কাজ শেষ ক'রে আবার বাঘের উপর লক্ষ্য করবে, ততক্ষণে বাঘের তোমার উপর লাফ দেবার খুব সম্ভাবনা থাকে। অবশ্য, অটোমেটিক রাইফলে হাত দিয়ে লিভার টানতে বা ঠেলতে হয় না, সুতরাং জোড়নলীর মতো তাতেও জন্তুর উপর হতে লক্ষ্য না সরিয়ে একটার পর একটা ফায়ার করে যাওয়া চলে। কিন্তু বড় জন্তু শিকারের উপযোগী অত্যন্ত শক্তিশালী বড় বোরের রাইফল আজ পর্যন্ত অটোমেটিক হয়নি।

*

বন্দুকের যে বারুদ এবং বুলেট ব্যবহার হয় সে সম্বন্ধে দু'একটা কথা বলি। কিছুদিন আগে পর্যন্ত সদানলী আর রাইফল দুয়েতেই কেবল কালো বারুদই ব্যবহার হ'ত। আজকালও যে কালো বারুদ ব্যবহার হয় না, তা নয়। তবে ঐ বারুদের ব্যবহার এখন কমে গেছে। কালো বারুদের ধোঁয়া বেশী হয়। আজকাল সাদানলীতে বেশীর ভাগ স্মোকলেস (smokeless) বা নির্ধূম বারুদ ব্যবহার হয়। এই বারুদে যে একেবারে ধোঁয়া হয় না তা নয়, খুব কম ধোঁয়া হয়।

খুব বেশী শক্তিশালী (high velocity) রাইফলে কালো বারুদ ব্যবহার হয় না। তাতে যে বারুদ ব্যবহার হয় তাকে সাধারণতঃ করডাইট (Cordite) অথবা য়্যাকসাইট (Axite) বলে। এই বারুদের বিস্ফোরণ শক্তি অত্যন্ত বেশী ব'লে যে সব রাইফলে এই বারুদ ব্যবহার হয়, তার নলে কালো বারুদ ব্যবহারের উপযোগী রাইফলের নলের চেয়ে অনেক বেশী পুরু ইস্পাতের তৈরী, এবং সেই কারণে ভারীও বেশী। একটা ৪০০ বোরের করডাইট রাইফল একটা ৫০০ বোরের কালো বারুদ রাইফলের চেয়ে অনেক বেশী শক্তিশালী। একটা ৪০০ বোরের ইংরেজী করডাইট রাইফলের ক্ষমতা এতেই বুঝতে পারা যাবে যে, ওই রাইফলের বুলেট (যার ব্যাস আধ ইঞ্চিরও কম) যখন ফায়ার হয়ে নলের মুখ থেকে বের হয়, তখন সেটা ৪০০০ ফুট পাউণ্ডের শক্তি বহন করে; অর্থাৎ একটা ৪০০০ পাউণ্ড বা প্রায় ৫০ মণ লোহার তাল এক ফুট উঁচু থেকে যদি মাটিতে পড়ে, সেই লোহার তাল যতটা জোরে মাটিকে ধাক্কা দেয়, এই ছোট বুলেটটি নলা থেকে বেরিয়েই যে জিনিস বা জন্তুকে আঘাত করবে তাকে তত বড় ধাক্কা দেবে। একটা বড় রয়্যাল টাইগার (Royal tiger) আক্রমণ করবার জন্য লাফ দিয়েছে, আর তখন তার সম্মুখ দিয়ে যদি ঐ গুলি তার শরীরে আঘাত করে তা'হলে তার লাফের অর্ধপথেই বুলেটের বিষম ধাক্কায় লাফ থেমে যাবে এবং সে মাটিতে প'ড়ে যাবে।

*

রাইফলের বুলেট সাধারণতঃ দুই রকমের হয়। একরকম যার অগ্রভাগ নরম সীসার তৈরী, আর একরকম যার সমস্তটাই নিকেল বা ঐরকম কঠিন ধাতুর পাত দিয়ে ঢাকা। যে সব জন্তুর চামড়া বেশ নরম আর যাদের আকার অত্যন্ত বৃহৎ নয়, সেই সব জন্তুর উপর নরম বুলেট ব্যবহার হয়। ঐ বুলেট চামড়া এবং তার নীচের মাংস ভেদ ক'রে জন্তুর মর্মস্থানে পৌঁছুতে পৌঁছুতে বুলেটের নরম অগ্রভাগ ব্যাঙের ছাতার মতো চ্যাপটা ও বড় হয়ে অথবা খণ্ড খণ্ড হয়ে গিয়ে মর্মস্থান একেবারে ছিন্ন-ভিন্ন ক'রে দেয় এবং অতি শীঘ্র মৃত্যু ঘটায়। বাঘের চামড়া নরম, সেইজন্য বাঘের উপর সর্বদা এইরকম বুলেট ব্যবহার হয়। ভালুকের চামড়া বাঘের মতো অত নরম না হলেও খুব বেশী শক্ত নয়, আর আকারেও ভালুক খুব বড় নয়, সুতরাং ভালুক শিকারেও এই বুলেটই ব্যবহৃত হয়। অন্যান্য অপেক্ষাকৃত ছোট জন্তুর পক্ষে এই বুলেট উপযোগী। কিন্তু হাতী বা গণ্ডারের পক্ষে এই বুলেট উপযোগী নয়। এই সব জন্তুর চামড়া অত্যন্ত দৃঢ় এবং তারা আকারেও অত্যন্ত বৃহৎ। তাদের চামড়া এবং মাংসরাশি ভেদ ক'রে যেতে যেতে যে বুলেট চ্যাপটা বা খণ্ড খণ্ড হয়ে যাবে সে বুলেট তাদের মর্মস্থানে পৌঁছুতেই পারবে না এবং শীঘ্র মারাত্মকও হবে না। এই জন্য ঐসব জন্তুর উপর কঠিন নিকেলের আবরণ দেওয়া বুলেট ব্যবহার হয়।

*

রাইফলের বুলেট ঠিক গোল নয়, লম্বাটে, আর অনেক সময় তার অগ্রভাগ কতকটা ছুঁচলো হয়। লেড পেনসিলের কাটা অগ্রভাগ ঢেকে রাখবার জন্য যেরকম একটা ধাতুর আবরণ ব্যবহার করা হয়, প্রায় সেই রকম আকৃতির। সাদানলীর বুলেট সাধারণতঃ গোলাকারই হয়। অন্য রকমেরও আছে। কিন্তু গোল বুলেটই সাদানলীর পক্ষে বেশী উপযোগী।

*

বন্দুকের লক্ষ্য বা নিশানা করবার কয়েকটা কথা। ...বন্দুকের নলের মুখটি সর্বদা লক্ষ্যের উপর রাখতে হবে, অথচ যত বেশী বেশী দূর থেকে নিশানা করা হবে, বন্দুক সেক্ষেত্রে এমনভাবে ধরতে হবে যাতে নলের মুখ লক্ষ্যের উপর হতে না সরিয়ে, নলটিকে লক্ষ্যের দূরত্বানুসারে বেশী বেশী ঊর্ধ্বমুখী ক'রে ধরা হয়, যার ফলে বুলেটটি লক্ষ্যতে পৌঁছুবার আগে নেমে প'ড়ে মাটিতে আঘাত না করে বা লক্ষ্যের নীচে দিয়ে বেরিয়ে না যায়।

*

এখন জিজ্ঞাস্য হতে পারে, —'রাইফলের নলটা লক্ষ্যের দূরত্বানুসারে কতটা ঊর্ধ্বমুখী করতে হয়, তা কি করে জানব?' তার উত্তর এই— নলার মুখ লক্ষ্যের দূরত্বানুসারে কতটা ঊর্ধ্বমুখী ক'রে ধরতে হবে তার নির্দেশের উপায় বা যন্ত্র নলের উপরিভাগে তার গায়েই দেওয়া থাকে। নলের মুখের ঠিক উপরেই একটি ছোট ফোরসাইট (Fore sight) বা মাছি বসান থাকে। এই ফোরসাইট নলের গায়ে দৃঢ়-সংলগ্ন, এর নড়ন-চড়ন নেই। নলের একেবারে পিছন দিকে ব্যাকসাইট (Back sight) বা নিশানা করবার জন্য ইস্পাতের ছোট পাত বসান থাকে এবং ঐ পাতের ঠিক মাঝখানে একটা খাঁজ কাটা থাকে। লক্ষ্যকারীর চোখের সঙ্গে লক্ষ্যের জিনিস ফোরসাইট আর ব্যাকসাইটের খাঁজ এক লাইনে আসলে তবে লক্ষ্য স্থির হয়। রাইফলের ব্যাকসাইট একটা থাকে না, ঐরকম কতকগুলি একটার পর একটা বসান থাকে। ব্যাকসাইটগুলি নলার দেহ হতে সমান উঁচু নয়। ভিন্ন ভিন্ন উচ্চতার ব্যাকসাইট তাদের উচ্চতা অনুসারে পর পর সাজান থাকে, ও ভিন্ন ভিন্ন দূরত্বের জন্য ঐ সব ভিন্ন ভিন্ন উচ্চতার ব্যাকসাইট ব্যবহার করতে হয়। ব্যাকসাইটগুলির গায়েই ঐ সব দূরত্বের নির্দেশক সংখ্যা মুদ্রিত করা থাকে, — যেমন ১০০ গজ দূরের লক্ষ্যের জন্য যে ব্যাকসাইট ব্যবহার করবে তাতে ১ লেখা থাকবে, ২০০ গজ দূরের লক্ষ্যের জন্য ২, ৩০০ গজের জন্য ৩, এই রকম। লক্ষ্য যত বেশী বেশী দূরে থাকবে, তত বেশী বেশী উঁচু ব্যাকসাইট ব্যবহার করতে হয়।

*

অনেক রাইফলে ব্যাকসাইটের জন্য কতকগুলি ভিন্ন পাত না থেকে একটি মাত্র খাঁজকাটা পাত থাকে, এবং এরূপ একটা বন্দোবস্ত থাকে যাতে পাতটিকে অপর একটা অপেক্ষাকৃত লম্বা, ফুটরুলের মতো দাগ কেটে ভাগ করা, অপরিসর ইস্পাতের ফলকের গায়ে লক্ষ্যের দূরত্বানুসারে ইচ্ছামত উঁচুতে তুলে দেওয়া বা নীচেতে নামিয়ে দেওয়া যায়। দাগগুলোর মুখে দূরত্বজ্ঞাপক সংখ্যা লেখা থাকে, যেমন ১০০, ২০০ থেকে আরম্ভ ক'রে ১০০০, ১২০০ পর্যন্ত। ফলকটি নলার গায়ে একটা কব্জা দিয়ে আঁটা থাকে, যাতে রাইফল যখন ব্যবহার করা না হয়, তখন ফলকটাকে নলার গায়ে শুইয়ে রাখতে পারা যায় এবং ব্যবহার করার সময় দাঁড় করিয়ে দেওয়া যায়। সে সব রাইফলে (যেমন যুদ্ধের রাইফল) অনেক দূর পর্যন্ত লক্ষ্য করার বন্দোবস্ত রাখতে হয়, তাতে এই রকম ব্যাকসাইটই ব্যবহার হয়, কারণ তা না হ'লে নলার গায়ে অনেকগুলো ভিন্ন ভিন্ন পাত দিতে হয়। শিকারের জন্য বড় বোর রাইফলে সচরাচর ৫০০ গজের উপরে নিশানা করবার বন্দোবস্ত থাকে না। এমন রাইফলও আছে যার বুলেটের গতিবেগ এত বেশী যে প্রথম ২।৩ শত গজের জন্য ভিন্ন ভিন্ন ব্যাকসাইটের দরকার হয় না, অর্থাৎ ঐ দূরত্ব পর্যন্ত বুলেট মাটির দিকে নামতে সুরু করে না। এই রাইফলগুলি ছোট বোরের বেশী শক্তিশালী রাইফল, এবং তার বুলেটের ওজনও বেশী নয়।

*

ভিন্ন ভিন্ন দূরত্বে লক্ষ্য করবার জন্য ভিন্ন ভিন্ন ব্যাকসাইট দিয়ে রাইফলে লক্ষ্যকারীর কাজ সহজ ক'রে দেওয়া হয় বটে, কিন্তু তা ছাড়াও তার নিজের করণীয় বিশেষ কিছু বাকী থেকে যায়, এবং সেটা হচ্ছে লক্ষ্যের জিনিসের দূরত্ব অনুমান ক'রে নেওয়া।

*

রাইফলে খুব দূরে লক্ষ্য ভেদ করতে হলে লক্ষ্যকারীর শরীর ও মন সবল এবং স্নায়ু দৃঢ় হওয়া চাই। কারণ লক্ষ্য স্থির ক'রে ফায়ার করবার সময় এক চুল এদিক ওদিক হলে দূরের লক্ষ্যে গুলি লাগবে না, লক্ষ্য থেকে অনেকটা ভ্রষ্ট হয়ে পড়বে। এইজন্য যারা রাইফলে লক্ষ্যভেদের প্রতিযোগিতায় জয়ী হতে চায় তাদের অনেক দিন, অনেক মাস ধ'রে শরীর ও মনের সংযম শিক্ষা করতে হয়। মন নিরুদ্বেগ আর স্নায়ু ইস্পাতের মতো দৃঢ় হওয়া চাই। তারা সর্বপ্রকার মাদকদ্রব্য এমন কি তামাক পর্যন্ত একেবারে ত্যাগ ক'রে এই সাধনায় রত হয়।

*

কোন কোন সাদানলী বন্দুকেও ৫০ এবং ৭৫ গজের ব্যাকসাইট দেওয়া থাকে। আমার কিন্তু মনে হয় এই বন্দুকে ওরকম ব্যাকসাইটের বিশেষ দরকার হয় না। ...এই বন্দুকের দৌড় বা পাল্লা বেশী দূর নয়। কোন একটা বন্দুক কিছুদিন ব্যবহার করতে করতেই বুঝা যায় ৬০, ৭০, ৮০ গজ দূর থেকে বুলেট দিয়ে মারতে হ'লে ঠিক লক্ষ্যস্থানের কতটুকু ঊর্ধ্বে লক্ষ্য করলে ভালো হয়। বেশী দামের উৎকৃষ্ট সাদানলী বন্দুকে ব্যাকসাইট একেবারেই দেওয়া হয় না। এই বন্দুক যত বেশী উৎকৃষ্ট হয় তত বেশী হালকা হয়।

'শিকারের কথা' নামক অক্ষয়কুমার চট্টোপাধ্যায়ের গ্রন্থ হইতে এই বিশেষ অংশটি গৃহীত। প্রকাশকাল, ১৯৪১।

(বানান অপরিবর্তিত)

সকল অধ্যায়

১. সুন্দরবনের শেষপ্রান্তে
২. শিকারের সন্ধানে
৩. নির্ভীক
৪. শিকারীর ক্ষোভ
৫. শিকারীর ভয়াবহ অভিজ্ঞতা
৬. বিপর্যয়
৭. হাওদা শিকার
৮. হাওদায় বসিয়া শিকার
৯. শিকারের কথা
১০. একদন্তের শেষ
১১. প্যান্থার
১২. মাচা থেকে চিতা ও অন্যান্য
১৩. জঙ্গলের ভ্রূকুটি
১৪. মহিষ
১৫. বীভৎস
১৬. কুমীর শিকার
১৭. হিমালয়ে ভল্লুক শিকার
১৮. কোয়াড়ে ভালুক শিকার
১৯. ভালুকের কবলে
২০. বাজ-বহেরী
২১. পদ্মায় পক্ষী শিকার
২২. পরিশিষ্ট
২৩. শিকারের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম
২৪. শিকার, শিকারী ও জীবজন্তু সম্বন্ধে বিবিধ জ্ঞাতব্য তথ্য
২৫. বন্দুক, বন্দুকের প্রকার ও ব্যবহার সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞাতব্য তথ্য
২৬. বাঙালির শিকারের আগ্নেয়াস্ত্র
২৭. ভারতের ব্যাঘ্র প্রকল্প
২৮. সহায়ক বাংলা পুস্তক তালিকা

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন