বিশ্বদেব গঙ্গোপাধ্যায়

হিতেন্দ্রমোহন বসু
পাখি দিয়ে শিকার করা এক অতি প্রাচীন শিকার পদ্ধতি; প্রাচ্যেই এই পদ্ধতির উদ্ভব হয়েছিল। তিন হাজার বছর আগেকার একটা পাথরে খোদাই করা লিপি থেকে জানা যায় যে, প্রাচীন ব্যাবিলোনিয়ায় তখন এইরকম শিকার করা হত।
প্রাচীন ভারতে এবং চীন দেশেও শ্যেনের সাহায্যে শিকারের প্রচলন ছিল। 'শ্যৈনিক-শাস্ত্র' পাঠ করলে নানা জাতের বাজবহেরীর বিষয়ে জানা যায় এবং প্রাচীন ভারতবর্ষে, মৃগয়ায় শিকারী শ্যেনের ব্যবহার সম্বন্ধে অনেক খবরও পাওয়া যায়। পরে মধ্য-যুগে, এদেশে মুসলমানদের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে ইরান, আফগানিস্থান ও মধ্য এশিয়ার বাজবহেরী খেলোয়াড়দের কায়দা এবং অভিজ্ঞতার সাক্ষাৎ-পরিচয় ভারতবাসীরা পেতে লাগল। মনে হয়, মুসলমানদের এদেশে আসার পরে বাজবহেরী খেলার শখটা বেশি ছড়িয়ে পড়ে।
বন্দুকের ক্রমোন্নতি এবং সহজলভ্যতার ফলে এই শখ কমতে থাকে। কিছুদিন আগেও বড়ো বড়ো করদ রাজা-মহারাজাদের শিকারি বাজবহেরী পোষার একটা রেওয়াজ ছিল। এখন তাদের রাজত্বলোপের সঙ্গে সঙ্গে এই শখটাও লোপ পেয়েছে এবং অধুনা শিক্ষিত লোকেদের মধ্যে এই শখ আর নেই বললেই চলে। তবে খুঁজলে, দু-একজনের সাক্ষাৎ মিলতে পারে। একজনের কথা বলতে পারি, তিনি হচ্ছেন মদীয় অনুজ শ্রীমান কার্তিক বসু। বাংলাদেশের নিপুণ ও সুখ্যাত ক্রিকেট খেলোয়াড়।
যাঁরা গিরেবাজ পায়রা পোষেন, তাঁদের কাছে মাঝে মাঝে শুনতে পাওয়া যায়, 'শিকরেতে পায়রা নিয়েছে।' এসব ক্ষেত্রে বুঝতে হবে, শিকরে বলতে তাঁরা যে পাখিটাকে বুঝছেন, সেটা বহেরী জাতের পাখি (Peregrine)। শিকরে বলে যে পাখি আছে তার কর্ম নয় পায়রা ধরা। বিশেষ করে উড়ন্ত পায়রা ধরা।
জংলি অবস্থায় শিকরে পাখি বড়ো একটা পাখি ধরে খায় না— এক চোট-খাওয়া পাখি বা পাখির বাচ্চা ছাড়া। ইঁদুর, গিরগিটি, ব্যাং এই সবই এর শিকার ও খাদ্য। তবে, মানুষের হাতে পড়ে সে পাখি শিকারের কায়দা শেখে, আর সঙ্গে সঙ্গে তার আত্মবিশ্বাস আর সাহসও বেড়ে যায়। একটা শেখানো শিকরে একবার শিকারের সময়ে জঙ্গলে হারিয়ে যায়। অনেক চেষ্টা করেও তার কোনো পাত্তা পাওয়া যায়নি। শিকরের মালিক ছুটিতে বিদেশে এসেছিলেন, শিকরে নিয়ে শিকারের অভিপ্রায়ে। ছুটি ফুরিয়ে এসেছে তখন, তিনি শিকরে ত্যাগ করেই ফিরলেন তাঁর কর্মক্ষেত্রে। চার-পাঁচদিন পরে, সেই শিকরেকে দেখা গেল সেই বাড়ির বাগানে, যে বাড়িতে শিকরের মালিক মাসখানেক কাটিয়েছিলেন তাঁর শিকরে নিয়ে। তার একটা পায়ে তখনও ফিতের 'বেড়ি' বাঁধা রয়েছে, অপরটা সে দাঁতে কেটে ফেলে দিয়েছে।
বাড়ির গায়ে-লাগা একটা আম গাছে বসে সেটা টিঁউ-টিঁউ করে ডাকতে লাগল। শিকরের মালিকের পরিবারের কেউ কেউ তখনও ওই বাড়িতে বাস করছিলেন। তাঁদের সবাই চিনতে পারলেন শিকরেটাকে। বাগানে যে-কটা পাখি দেখতে পেলে, সবকটার পেছনে ধাওয়া করতে লাগল সেই শিকরেটা। কিছুক্ষণ পরে, বাড়ির পোষা মুরগিগুলো ভয়ানক চেঁচামেচি শুরু করেছে শুনে বাড়ির লোকেরা বাগানের দিকে নজর দিলেন, দেখতে পেলেন, একটা মুরগিকে শিকরেটা আঁকড়ে ধরে আছে, মুরগিটা ছোটাছুটি করছে আর চেঁচাচ্ছে। সবাই মিলে তাড়া দিতে শিকরেটা ছেড়ে দিলে মুরগিটাকে, কিন্তু মুরগিটা তার কিছু পরেই মারা যায়। শিকরের বড়ো বড়ো নখওলা আঙুলের পেষণে ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিল মুরগির পিঠের দিকটা।
যত্ন করে শেখানো শিকরে, তাই মুরগির মতো বড়ো বড়ো পাখিকেও ধরতে ইতস্তত করেনি, কিন্তু একটা জংলি শিকরে ওরকম হামলা করবে না।
শিকরে : ছোটো জাতের পাখি; লম্বায়-চওড়ায় একটা পাপিয়ার মতো। ভালো করে শেখালে এরা অপেক্ষাকৃত বড়ো পাখি ধরে ফেলে। তবে দ্রুতবেগে উড়তে পারে না। শিকারের (যে পাখিকে শিকার করা হবে) কাছে গিয়ে, হাতে মুঠো করে ধরে (যেমন করে পায়রা ধরা হয়) শিকারের দিকে শিকরে পাখিকে ছুড়ে দেওয়া হয়। এই ছোড়ার কায়দাটা আয়ত্ত করতে পারলে, শিকার আত্মরক্ষার জন্য প্রস্তুত হবার বা উড়ে পালিয়ে যাবার আগেই শিকরে উড়ে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে তার শিকারের উপরে, আর তার বড়ো বড়ো নখওলা অত্যন্ত শক্তিশালী পাঞ্জার চাপে শিকারকে কাবু করে ফেলে অল্পক্ষণের মধ্যেই।
বাশা : শিকরেরই কাছাকাছি একটা জাত, শিকরের চেয়ে অনেক দ্রুতগামী এবং কিছু বড়ো পাখি। শিকরের মতন ঝাঁপিয়ে পড়ে শিকার করে না, আর তাকে মুঠো করে ধরে ছুড়ে দিতেও হয় না। এরা শিকার করে মালিকের হাত থেকে উড়ে শিকারকে সোজাসুজি শূন্যে তাড়া করে। বটের ও ঘুঘু এরা ধরে ফেলতে পারে, যদি শিকারের কাছে গিয়ে এদের ছাড়া যায়। কদাচিৎ তিতিরও শিকার করে। তবে, এদের দম খুব বেশি নয়। আন্দাজ এক-শো গজের মধ্যে শিকার ধরতে পারলে তো ধরলে, নতুবা পিছু ধাওয়া ছেড়ে দিয়ে নিকটের কোনো একটা গাছে আশ্রয় নেয়, বিশ্রামের জন্য।
কথায় বলে 'শ্যেনদৃষ্টি'। বাস্তবিক শ্যেনজাতি অন্তর্ভুক্ত পাখিদের দৃষ্টি খুবই প্রখর— বিশেষ করে বহেরী গোষ্ঠীর পাখিদের। এরা আকাশে অনেক উঁচুতে উড়ে উড়েও খেতের পাখির চলাফেরা লক্ষ করে। সাধারণত এবং মোটামুটিভাবে, বাজ-খেলোয়াড়েরা শ্যেনজাতীয় পাখিদের দু-ভাগে বা জাতে বিভক্ত করেন। বহেরী জাতের পাখিদের বলেন 'লম্বা ডানার পাখি' (falcons), আর বাজ জাতের পাখিদের বলেন, 'ছোটো ডানার পাখি' (hawks)। লম্বা ডানার পাখিরা উড়তে পারে অনেক জোরে আর অনেকক্ষণ ধরে; আর এরা শিকার করে শূন্যে ছোঁ মেরে, পেছনের আঙুলের বৃহৎ নখ দিয়ে উড়ন্ত শিকারের পিঠ ফেড়ে দিয়ে। তবে, ছোটোপাখি হলে, দু-পায়ের নখ বসিয়ে উড়ন্ত শিকারও ধরে। ছোটো ডানার পাখিরা (বাজ, বাশা ইত্যাদি) কেবল বৃহৎ নখওলা পাঞ্জার পেষণের জোরেই শিকারকে কাবু করে। এদের পাঞ্জায় অসাধারণ শক্তি।
লম্বা ডানার পাখিদের মধ্যে সেরা পাখি হল 'বহেরী' আর ছোটো ডানার পাখিদের মধ্যে সেরা হল, 'বাজ'। বাজের পাঞ্জায় বাস্তবিকই অসাধারণ শক্তি। যদিও 'পাঞ্জা' কথাটা ব্যবহার করছি, তবুও একথাটা বোধ হয় সকলেই জানেন যে, পাখিদের পায়ে পাঁচটা আঙুল থাকে না। বড়োজোর একটা কাঁটার মতন থাকে ঠ্যাঙের পেছন দিকে।
'ছোটো ডানা'র বাজ আর 'লম্বা-ডানা'র বহেরী, এরা নিজের নিজের জাতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ শিকারি। তাই লোকে বলে, 'বাজ-বহেরী' বা চলতি কথায়, বাজ-বউরী।
বহেরী : বহেরী দিয়ে শিকারের কায়দাটা অনেকটা এইরকম : শিক্ষিত বহেরীকে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আকাশে বহেরী উড়ছে, ক্রমশ উপরে উঠছে। উঠতে উঠতে এত উঁচুতে উঠেছে যে, প্রায় বুঁদ হয়ে গিয়েছে। লম্বা লম্বা চক্কর দিচ্ছে; নীচে বিস্তৃত প্রান্তর; মাঝে মাঝে দু-চারটে ঝোপ আর ঘাসের জঙ্গল। উপরে শিকারি শ্যেনকে দেখে মাঠের সমস্ত পাখি ঝোপেঝাড়ে ঘাসের জঙ্গলে লুকিয়েছে— আর বহেরীর মালিক চলেছে ওই ঝোপঝাড় জঙ্গল পিটতে পিটতে। ফলে, হয়তো একটা পাখি তাড়া খেয়ে উড়ল আকাশে— সঙ্গেসঙ্গে বহেরী উপর থেকে বিদ্যুদগতিতে মারলে ছোঁ, আর তার পিছনের আঙুলের লম্বা নখ দিয়ে তাড়া খাওয়া পাখিটার পিঠ ফেড়ে দিলে।
সাধারণত তিতির শিকার এই পদ্ধতিতে করা হয়ে থাকে। তবে, তিতিরের কৌশলের কাছে মাঝে মাঝে বহেরীকে হার মানতে হয়। দেখা গেছে, আকাশে বহেরী দেখামাত্র তিতির ঝোপঝাড়ে ঢুকে পড়ে, কিংবা একেবারে নিঃসাড় হয়ে পাথর বনে যায়; সাধ্য কী তখন তাকে খুঁজে কেউ বার করে। অদ্ভুত ক্ষমতা, বলতেই হবে। যা হোক, তিতিরকে ওড়াতে পারলে, তবেই তাকে বহেরী দিয়ে শিকার করানো সম্ভব। তাই লাঠি দিয়ে পিটে পিটে বা শিকারি কুকুর দিয়ে জঙ্গল ভাঙিয়ে ঝোপঝাড় থেকে তাকে ওড়ানো হয়; আর তখনই সেই তিতিরের উপর বহেরী ছোঁ মারে এবং তার দু-পায়ের পেছনের আঙুলের বৃহদাকার নখ দিয়ে তিতিরের পিঠটা একেবারে ফেড়ে ফেলে। কখনো-বা তিতিরকে শূন্যেই ধরে ফেলে বহেরী তার পাঞ্জা দুটো দিয়ে, আর ঘুরতে ঘুরতে প্যারাসুটের মতন মাটিতে নেবে আসে।
আবার মালিকের হাত থেকে উড়ে ধাওয়া করে শিকার ধরার কায়দাও শেখানো হয় বহেরীকে, কিন্তু সেক্ষেত্রেও বহেরী চক্রাকারে উড়ে শিকারের ঊর্ধ্বে ওঠে, তারপর সুবিধা বুঝে উপর থেকে ছোঁ মারে।
কালিজ : (Black Pheasant) বা ওই গণের পাখি এই পদ্ধতিতে শিকার করানো হয়। বহেরীকে (বা বহেরী গণের অন্যান্য পাখিকে) পোষ মানানোর সময় চোখ-ঢাকা টুপি পরানো হয়, নতুবা সে ভয় পেয়ে ঝটপট করতে থাকে আর নানা রকমের চোট খায়। পোষ মানার সঙ্গেসঙ্গে টুপিটা মাঝে মাঝে খুলে দেওয়া হয়। যখন তাকে শিকারে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন তাকে টুপি পরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। ঠিক শিকারের জন্য তাকে ছাড়ার পূর্বে তার টুপি খুলে দেওয়া হয়।
বহেরী যে গণের পাখি, সেই গণ-অন্তর্ভুক্ত একটা অপেক্ষাকৃত ছোটো পাখি (একটা পায়রার মতন)। শিকারে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এদের নাম 'তুরমতী'। এরা অত্যন্ত দ্রুতগতিতে ওড়ে এবং সহজেই পোষ মানে। এদের দিয়ে বটের ও গুঁড়ুর জাতীয় ছোটো ছোটো পাখি শিকার করানো হয়।
শ্যেন জাতীয় সমস্ত পাখির শিকার পদ্ধতি লেখা এখানে সম্ভব নয়। সামান্য বারো-তেরো ইঞ্চি শিকরে থেকে আরম্ভ করে প্রায় তিন ফুট ইগল, নানা জাতের শ্যেন দিয়ে পৃথিবীর নানা জায়গায় নানা রকমের শিকার করানো হয়— সামান্য আঘিন বা বাগেরী থেকে অতি দ্রুতগামী 'চিংকারা-হরিণ' পর্যন্ত। শ্যেন দিয়ে চিংকারা শিকার এখন আর হয় না বোধ হয়, তবে সুবর্ণ ইগল দিয়ে নেকড়ে শিকার করানো এখনও হয়ে থাকে— মধ্য এশিয়ায়।
শ্যেন দিয়ে চিংকারা শিকার আগে ভারতে অনেক জায়গাতেই দেখা যেত। এই শিকারে শ্যেনের সঙ্গে তাজী কুকুর ব্যবহার করা হত। যাঁরা এইরকম শিকারে যেতেন, তাঁরা ঘোড়ার উপর সওয়ার হয়ে যেতেন, নইলে শিকারের আসল ও পরিপূর্ণ রূপটি পাওয়া অসম্ভব হত। তাজী-কুকুরের (Greyhound) সাহচর্যে শ্যেন দিয়ে চিংকারা শিকার দেখার সৌভাগ্য যাঁদের হয়েছে, তাঁদের মধ্যে অনেকেই (তাঁদের অধিকাংশই ইংরেজ) এই শিকার সম্বন্ধে কিছু-না-কিছু লিখে গিয়েছেন এবং একবাক্যে বলে গিয়েছেন যে, এ শিকারের তুলনা হয় না। বাজবহেরী খেলায় অভিজ্ঞ একজন ইংরেজ চিংকারা-শিকার দেখে যা লিখেছিলেন, তার কিছু অংশ নীচে অনুবাদ করে দেওয়া হল :
'...আমরা তখন প্রান্তরটার কাছাকাছি এসে গিয়েছি। নবাব সাহেবের প্রধান শিকারী, সঙ্গে যে-সব তাজী-কুকুর (Greyhound) আনা হয়েছিল, তার মধ্যে থেকে দুটো কুকুর বেছে নিলে আর যে-লোকটার হেফাজতে বাজ-বহেরীগুলো ছিল, তার কাছে গিয়ে পাখীগুলোকে একনজর দেখে একটা ''চরখ'' (বহেরী গণের পাখী) তার নিজের হাতের উপর বসিয়ে নিলে। পাখীটা তখন টুপি-পরা অবস্থাতেই ছিল, যেমন ছিল আর সব ক'টা পাখীই। অদূরে চিংকারা হরিণটা একটা ছোট গাছের পাতা খেতে ব্যস্ত। অমনোনীত কুকুর ও পাখীগুলোকে দুজন লোকের জিম্মায় একটা গাছের ছাওয়ায় রেখে, এ-ঝোপ ও-ঝোপের আড়ালে আড়ালে তখন অগ্রসর হওয়া শুরু হলো আমাদের— যতটা সম্ভব, ওই চিংকারার কাছে যাওয়াই হলো আমাদের উদ্দেশ্য। কারণ, চিংকারার সঙ্গে দৌড়ে পাল্লা দেওয়া কোনও তাজী-কুকুরের সাধ্য নয়। মতলবটা হচ্ছে, আকস্মিক একটা আক্রমণে শিকারকে হতভম্ব করে দেওয়া, তাকে হতবুদ্ধি ক'রে দিয়ে তার পলায়ন চেষ্টাকে কিছুটা প্রতিহত করা।
বার বার করে হাওয়ার গতির দিক নির্ণয় করা হচ্ছে... যখন চিংকারাটার কাছে, প্রায় ষাট গজের মধ্যে এসে গিয়েছি, তখন দেখতে পেলাম, বাছাই করা কুকুর দুটো চিংকারার পেছনে ধাওয়া করবার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়েছে, তারা থেকে থেকে সামনের দিকে সজোরে হ্যাঁচকা টান দিয়ে ঝুঁকছে। যে লোকটা শেকল ধরে আছে, সেও কুকুরগুলোর হ্যাঁচকা টানের চোটে ঝুঁকে পড়ছে... আবার সামলে নিচ্ছে। শিক্ষিত কুকুর, মুখে টুঁ শব্দটি নেই।
প্রধান শিকারী একটা বড় গাছের ঝোপের পেছনে গিয়ে থামল, পেছনের দিকে তাকিয়ে ''ডোরিয়া''কে (কুকুরের রক্ষী) ইশারা করলে এগিয়ে আসতে... তারপর ঝোপটা পার হয়ে খোলা প্রান্তরের এক প্রান্তে গিয়ে পৌঁছল তারা। দেখলাম, প্রধান শিকারী ''চরখ'' পাখীটার চোখ-ঢাকা টুপি খুলে সেটাকে উড়িয়ে দিলে, আর সঙ্গে সঙ্গে সংকেত করে দিলে ডোরিয়াকে তার কুকুর ছাড়তে।

লক্ষ্য করলাম চরখ পাখীটাকে। সেটা সোজা চিংকারার দিকে না গিয়ে, ডান দিকে বাঁক নিয়ে আকাশে উঠতে লাগল। তলার দিকে তাকিয়ে দেখি, কুকুর দুটো সোজা ছুটেছে হরিণটার দিকে। আমরা সকলেই যথাসম্ভব ক্ষিপ্রতার সঙ্গে ঘোড়া ছুটিয়ে দিলাম।
চরখ পাখীটা তখন বেশ উঁচুতে উঠেছে... বৃত্তাকারে উড়ছে। চিংকারা ছুটছে, পেছন পেছন কুকুর দুটো প্রাণপণ ছুটছে— তাদের বুক মাটি ছোঁয় ছোঁয়। নিমেষের মধ্যে দেখি, চিংকারাটা কুকুর দুটোকে অনেকখানি পেছনে ফেলে দিয়েছে— আর দু'শো গজ আন্দাজ যেতে পারলেই বড় বড় ঝোপ-ওলা জঙ্গলে সে ঢুকে পড়বে, আর তা-হলেই সে একরকম নিরাপদ। কারণ, ওই জঙ্গলে চরখের খেলা অসম্ভব— আর কুকুরও বেকার। ঠিক তখনই কালো তীরের মতন কি একটা আকাশ থেকে বিদ্যুদবেগে পড়ল এসে চিংকারাটার মাথার ওপর— একেবারে আকস্মিকভাবে! মনে হলো, চিংকারাটা আছাড় খেলে... তারপরই দেখি সেটা আবার ছুটছে। কিন্তু এবার সে দিক পরিবর্তন করেছে... মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে ওই চরখ পাখীটা... চিংকারা তার গন্তব্যস্থান ওই জঙ্গলে আর যেতে পারলে না— যেতে দিলে না ওই চরখ। পটের এই হঠাৎ পরিবর্তনে কুকুর দুটো দ্বিগুণ উৎসাহে ছুটছে— ব্যবধান কিছু কমেছে চরখের কারসাজিতে। ওদিকে, ছোঁ মেরেই চরখ আবার উড়ছে আকাশে... বেশ খানিকটা উঁচুতে উঠেছে সে।
...কুকুর দুটো আবার পেছিয়ে পড়ছে— আমরা তারও পেছনে। ... কুকুর দুটো ক্রমান্বয়ে পেছিয়ে পড়ছে... আমরা কোণাকুণি চলেছি। চিংকারাটা ডান দিকে মোড় নিয়েছিল বলে এ-সুবিধা আমরা পেয়েছি। ঘোড়াগুলো নতুন উৎসাহ নিয়ে ছুটছে... শিকারের নেশা যেন এদেরও চেপেছে!
কিন্তু সবই যেন বৃথা... ওই তো, অদূরে আর একটা জঙ্গল দেখা যাচ্ছে, চিংকারাটা আর আন্দাজ তিন-শো গজ গেলেই ঢুকে পড়বে ওই জঙ্গলে! কুকুর দুটো হরিণটার অন্ততঃ পঞ্চাশ গজ পেছনে...যখন ওই জঙ্গলটায় গিয়ে ঢুকবে ওই চিংকারা তখন অন্ততঃ একশো গজ পেছনে থাকবে কুকুর দুটো। চরখটা গেল কোথায়! এদিক-ওদিক মাথা ঘুরিয়ে আকাশটাকে দেখে নেবার চেষ্টা করলাম— কিছুই দেখতে পেলাম না। এখনও যদি একটা ঝাপট মারতো ওটা, তা'হলেও উপায় ছিল!
নাঃ, চিংকারা শিকার দেখার সৌভাগ্য নেই আমাদের; ও জিতে গেল আজকের লড়াইয়ে। তা জিতুক, কোনও ক্ষোভ নেই—অন্ততঃ আমার মনে। চিংকারা অত্যন্ত দ্রুতগামী, বরাবরই শুনে এসেছি। তাই ব'লে এত? আর এতক্ষণ ধরে এত দ্রুত সে ছুটতে পারে! স্বচক্ষে না দেখলে বিশ্বাস করা আমার পক্ষে অসম্ভব হতো। ওই তো, জঙ্গল সে ঢুকলো বলে... নাঃ, বাহাদুর চিংকারা!
ওকি! ওকি!! চিংকারাটা আছাড় খেয়ে পড়ল যেন! ওই তো চরখটা তার পাশ থেকেই আবার উড়ল! চিংকারাটাও উঠেছে... বাঁ দিকে মোড় নিয়েছে— চরখটা এবার বেশী উঁচুতে উঠল না। হাত-চল্লিশ উপরে উঠেই আবার ঝাঁপিয়ে পড়ল চিংকারাটার উপর। কিন্তু এবারে ঠিক ছোঁ মারা নয়, মনে হ'ল যেন, তার পাঞ্জা দিয়ে আঁকড়ে ধরেছে হরিণটার মাথা। হরিণটা হোঁচট খেয়ে আবার সামলে নিলে, মাথা ঝেড়ে চরখের হাত থেকে নিজেকে ছাড়ালে! কিন্তু চরখ হরিণটার হাত চার-পাঁচ উপরে উঠে গোটা দুই পাক দিয়ে আবার পড়ল ঝাঁপিয়ে, তার মাথার উপর! এবারে হরিণটা পড়ে গেল, সঙ্গে সঙ্গে চরখও ছেড়ে দিলে তাকে। হরিণটা আবার উঠেছে, কিন্তু তার আগেকার ক্ষিপ্রতা আর দেখা যাচ্ছে না, উঠতে-না-উঠতেই, চরখটা আবার ঝাঁপিয়ে পড়েছে... চিংকারা মাটিতে পড়ে গিয়ে পা ছুঁড়ছে— তাজী কুকুর দুটো গিয়ে ধরেছে ওই ধরাশায়ী হরিণকে— এ যেন ভেলকি দেখছি!
আমরাও গিয়ে পৌঁছলাম সেখানে। গিয়ে দেখি, একটা কুকুর ধরেছে হরিণটার গলা কামড়ে, অপরটা ধরেছে তার কোমরে... চরখটা হাত দুই তফাতে তার ডানা উঁচু করে ছড়িয়ে দিয়ে ক্যাঁ ক্যাঁ ক্যাঁ করে চ্যাঁচাচ্ছে আর মাটির উপর লাফিয়ে-লাফিয়ে নেচে বেড়াচ্ছে। প্রধান শিকারী ঘোড়া থেকে নেমেই হরিণটাকে দিলে একটা ছুরি দিয়ে জবাই করে। উদ্দেশ্য, হরিণ-মাংসকে মুসলমানের খাদ্য হিসাবে উপযোগী করা।
...কুকুর দুটো একটু তফাতে শুয়ে পড়ে হাঁপাচ্ছে। হরিণটার কাছে গিয়ে দেখি, তার মুখটা একেবারে ক্ষত-বিক্ষত ক'রে দিয়েছে ওই চরখটা। একটা চোখ কোটর থেকে বা'র করে নিয়েছে, অপরটাও অক্ষত অবস্থাতে নেই। কুকুর দুটোর কাছে গিয়ে দেখলাম... একেবারে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে তারা। আমাদের ইংলণ্ডের জাত-গ্রেহাউণ্ডের সঙ্গে তুলনা করলাম— অনেক প্রভেদ। এই কুকুরগুলো আরও শক্তিশালী, চোয়াল আরও মজবুত পায়ের তলাকার (তেলোর) চামড়া অনেক বেশী কড়া, যার দরুন অসমান কাঁকর-ওলা জমিনের উপর দিয়ে এরা স্বচ্ছন্দে দৌড়তে পারে। দমও এদের বেশী। তবে নিছক গতিবেগের হিসাবে ইংলণ্ডের গ্রেহাউণ্ডই শ্রেষ্ঠ...'

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন