বিশ্বদেব গঙ্গোপাধ্যায়

অক্ষয়কুমার চট্টোপাধ্যায়
একটা বাঘের উপদ্রব যখন অতিশয় বেশি হয়ে উঠেছিল তখন ময়ূরভঞ্জের কর্তৃপক্ষ তাকে মারবার জন্য পাঁচশত টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছিলেন। সেই সময়ে আমার ঊর্ধ্বতন একজন সিভিলিয়ান সাহেব কর্মচারী ওই বাঘকে মারবার জন্য একটি রীতিমতো অভিযানের বন্দোবস্ত করেন এবং তিনিই অভিযানের নেতা হয়েছিলেন। বাঘের উপদ্রবের জঙ্গল এলাকাকে চার ভাগ করে তিনি এক ভাগ নিজের হাতে রাখলেন, অপর তিন ভাগ তিনজন শিকারিকে দেওয়া হল এবং ওই তিনজনের মধ্যে আমি একজন ছিলাম। আমরা প্রত্যেকে নিজ নিজ ভাগে জঙ্গলের মধ্যে আগে থেকে মাচান তৈরি করে সেইসব মাচানের কাছে মহিষ বা অল্প দামের ঘোড়া কিনে বাঁধতে লাগলাম, উদ্দেশ্য যে বাঘে কোনো মহিষ বা ঘোড়া মেরে গেলে মাচানে গিয়ে বসব, আর বাঘ পুনরায় মড়ির কাছে আসলে তাকে মারব। চার-পাঁচ মাইল অন্তরে অন্তরে আমাদের ক্যাম্প পড়ল। জঙ্গল থেকে প্রায় দেড় মাইল দূরে এক গ্রামে আমি তাঁবু ফেলে রইলাম। প্রত্যহ প্রাতে আর সন্ধ্যায় গ্রামের লোকেরা কয়েকজন একত্র হয়ে জঙ্গলে গিয়ে আমার বাঁধা মহিষটাকে ঘাস জল দিয়ে আসত।
এইরকম চার-পাঁচ দিন করার পর, একদিন প্রাতে গ্রামবাসীরা মহিষকে দেখে ফিরে এসে সংবাদ দিল যে, পূর্ব-রাত্রিতে মহিষটাকে বাঘে মেরে রেখে গেছে। ওই সময়ে আমার ক্যাম্পে দুটো হাতি ছিল। আমি জনকয়েক লোক সঙ্গে নিয়ে একটা হাতিতে চড়ে মড়ির কাছে উপস্থিত হলাম। দেখলাম, মড়ির পিছন দিকের খানিকটা নরম মাংস বাঘ খেয়ে গেছে। তখন গ্রীষ্মকাল, বৃষ্টি না হওয়ায় কঙ্করময় মাটি শুকিয়ে শক্ত হয়ে রয়েছে। মহিষকে মারবার সময় বাঘের নখে স্থানে স্থানে মাটি খুঁড়ে গেছে বটে, কিন্তু শক্ত মাটিতে বাঘের থাবার সম্পূর্ণ দাগ মড়ির কাছে দেখতে পেলাম না। তখন আমি নিকটে বনের মধ্যে চারপাশে খুঁজে দেখতে দেখতে দেখলাম যে, একটা সরু নালার ভিতর ভিজে মাটিতে বাঘের পায়ের সদ্য চিহ্ন রয়েছে। নালাতে ঝিরঝির করে জল বয়ে যাচ্ছে, মহিষ মেরে রক্তমাংস খেয়ে বাঘ সেখানে জল খেতে এসেছিল।
ইতিমধ্যে আমার আদেশমতো সঙ্গের লোকেরা, মাচানের চারদিকে যে পাতার বেড়া দিয়ে মাচানকে আড়াল করে দেওয়া হয়, সেটাকে নূতন পাতা দিয়ে মেরামত করে দিল। আমি মাচানে গিয়ে বসলাম। সঙ্গের লোকেরা চলে গেল। মাহুতকে বললাম হাতিকে জঙ্গলের বাহিরে নিয়ে গিয়ে কোনো গাছের তলায় ছায়াতে রাখতে। সমস্ত দিন কিন্তু বাঘের দেখা নেই।
যখন ঠিক সূর্যাস্ত হয়েছে, সন্ধ্যার অন্ধকার ক্রমশ ঘনিয়ে আসছে, তখন দেখতে পেলাম বাঘ আসছে— বেশ বড়ো একটা প্যান্থার। নিঃশব্দে ধীরে ধীরে আসছে, একটুও চলার শব্দ পর্যন্ত নেই। কয়েক পা এসে থামছে আর চারদিকে চাইছে। সোজা না এসে বক্র সর্পিল-গতিতে একবার এদিকে একবার ওদিকে সরে গিয়ে মড়ির দিকে একটু একটু করে এগিয়ে আসছে। ক্রমশ মড়ির খুব কাছে এসে, বিড়াল যেমন করে থাবা গেড়ে বসে, সেইরকম করে মাচানের দিকে মুখ করে বসল। সেই সময় আমি রাইফেল তুলে নিয়ে যেমন লক্ষ করতে যাচ্ছি, আমার অত্যন্ত সাবধানতা সত্ত্বেও রাইফেলের নলা একটা পাতায় লেগে একটু খুস করে শব্দ করল। শব্দ হতেই প্যান্থারটা চকিতে মুখ তুলে গাছের উপরের দিকে, অর্থাৎ মাচানের দিকে তাকিয়ে দেখতে লাগল। তার সঙ্গে আমার চোখাচোখি হল, কিন্তু আমি একটুও না নড়ে নিমেষ না ফেলে, তার দিকে চেয়ে রইলাম। অন্ধকার হয়ে আসছিল আর আমি পাতার বেড়ার পিছনে ছিলাম বলে বাঘ পাতার আড়ালে আমার চোখ দেখতে পেল না। অল্পক্ষণ ওইরকম তাকিয়ে থেকে সে আবার দৃষ্টি নামিয়ে নিয়ে তার আশেপাশে চারদিকে চেয়ে দেখতে লাগল। সেই অবকাশে আমি গুলি করলাম। রাইফেলের আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে বাঘ একটা গর্জন করে এক লাফে জঙ্গলের ভিতর ঢুকে অদৃশ্য হল। আমি বুঝতে পারলাম গুলি বুকে না লেগে পেটে লাগল, কারণ বুকে ওই প্রচণ্ড রাইফেলের গুলি লাগলে বাঘ ওইখানেই উলটে পড়ত।

মাহুত আমার বন্দুকের শব্দ শোনার প্রায় আধঘন্টা পরে হাতি এনে উপস্থিত করল। সে আগে দূর থেকে চেঁচিয়ে বাঘের কথা জিজ্ঞাসা করল। বাঘ যেদিকে চলে গেছে মাহুত আমার কথামতো তার বিপরীত দিক দিয়ে হাতি নিয়ে এল। হাতি মাচানের নীচে এসে দাঁড়ানোর পরে আমি মাচান থেকে নেমে গেলাম। দেখলাম বাঘ যেখানে বসে ছিল সেখানে সদ্য রক্ত পড়েছে মাটির উপর। অন্ধকারে বনের মধ্যে ওই বাঘকে অনুসরণ করা বৃথা আর অত্যন্ত বিপজ্জনক বুঝে আমি ক্যাম্পে ফিরে এলাম।
ক্যাম্পে ফিরে গ্রামের লোকদের বললাম যে পরদিন প্রাতে আমি বাঘ খুঁজতে যাব। তারা সকলেই আগ্রহ প্রকাশ করল আমার সঙ্গে যেতে। রাত্রি শেষ হতে-না-হতেই তারা আমার তাঁবুর কাছে জড়ো হল। সকালে উঠে তাঁবুর বাহিরে এসে দেখি যে গ্রামবাসীরা— প্রায় শ-খানেক লোক— ধনুর্বাণ, টাঙ্গি, কুড়ুল ইত্যাদি নিয়ে বসে রয়েছে। আমি বললাম যে, হাত মুখ ধুয়ে কিছু খেয়ে বেরুতে আমার একটু দেরি হবে। তারা ওই দেরিটুকু পর্যন্ত অপেক্ষা করতে রাজি নয়। তাদের ভিতর একজন প্রৌঢ় ছিল, সে অল্প বয়সে শিকার করত। সে আমার অনুমতি চাইল যে ওই লোকদের নিয়ে আগেই বনে গিয়ে সাবধানে খুঁজে দেখবে যে বাঘটা বেঁচে আছে কি না। কথাটা আমার ভালো লাগল না, কারণ আহত বাঘ যে কী ভয়ানক তা আমার জানা ছিল। কিন্তু লোকটি এবং অন্য গ্রামবাসীরা অতিশয় অনুরোধ করায় আমি তাদের যেতে দিলাম। বলে দিলাম, যে তারা যেন অতি সাবধানে রক্তের দাগ অনুসরণ করে এবং যেমন দেখবে যে রক্তের দাগ শেষ হয়েছে— আর এগোবে না। ওইসব কোল সাঁওতাল ভূমিজ গ্রামবাসীদের মধ্যে এমন অনেক লোক থাকে, যারা জঙ্গলের মধ্যে নানারকম চিহ্ন দেখে জানোয়ারের গতিবিধি লক্ষ করতে খুব দক্ষ, আরও সেইজন্য কতকটা আশ্বস্ত হয়ে তাদের যেতে দিলাম। এই ভুলটা এই ঘটনার আগে কখনো করিনি এবং পরে তো নয়ই, আর ভুল করার ফলটা সেদিন হাতে হাতে পেয়েছিলাম। প্রৌঢ় শিকারির অনুরোধে কার্তুজ-ভরা একটা সাদা জোড়নলী বন্দুক তার হাতে দিলাম। আমার একজন পিয়োনকে একটা হাতি দিয়ে ওই লোকদের সঙ্গে পাঠিয়ে দিলাম এবং বলে দিলাম যেন রক্তের দাগ অনুসরণ করার সময় হাতিটা আগে আগে যায়।

লোকগুলি হাতি নিয়ে বিদায় হয়ে যাওয়ার প্রায় আধঘণ্টা পরে অপর হাতিটা চড়ে আমি শিকারস্থলে রওনা হলাম। অর্ধেক রাস্তা গিয়েছি, এমন সময় দেখলাম যে, একজন লোক জঙ্গলের দিক থেকে দৌড়ে আসছে। কাছে এসেই সে হাঁফাতে হাঁফাতে বললে, 'একজনকে বাঘে ধরে ফেলেছে!' শুনে আমি চমকে উঠলাম। কী করে ধরল জিজ্ঞাসা করায় সে বললে, 'আমরা মাচানের তলা থেকে রক্তর দাগ দেখে যেতে যেতে বনের মধ্যে অনেকটা দূরে একটা ঘন ঝোপের কাছাকাছি যেমন পৌঁচেছি, বাঘটা ভয়ানক গর্জন করে ঝোপ থেকে বেরিয়ে আমাদের দিকে দৌড়ে এল। আমরা যেদিকে পারলাম ছুটে পালালাম, হাতিটাও দৌড় দিল। খানিক দূর দৌড়ে গিয়ে দাঁড়ালাম। তখন আর বাঘটাকে দেখতে পেলাম না। আমরা আবার একত্র হয়ে পরামর্শ করে বাঘকে পুনরায় খুঁজে বার করার জন্য পন্তা ধরে দাঁড়ালাম, তারপর ওই লাইন ধরে ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে লাগলাম। যেতে যেতে একটা উঁচু বড়ো পাথর আমাদের লাইনের সামনে পড়ল। ওই পাথরের আড়ালে যে বাঘ লুকিয়ে থাকবে এ আমাদের মনেই হয়নি। লাইনের একটু আগে আগে বুড়ো শিকারি বন্দুক নিয়ে চলছিল, সে যেমন ওই পাথরের কাছে পৌঁছুল অমনি বাঘ পাথরের ওপাশ থেকে গর্জন করে, এক লাফে তার উপর এসে পড়ল। বুড়ো মাটিতে পড়ে গেছে আর বাঘ তাকে কামড়ে ধরেছে এই দেখেই আমি দৌড়েছি তোমাকে খবর দিতে। অন্য লোকেরাও পালাচ্ছে দেখে এসেছি।

এই কথা শুনে আমি বুঝলাম যে, যে কাজ করতে, অর্থাৎ বাঘকে উত্ত্যক্ত করতে আমি বারণ করে দিয়েছিলাম, এরা ঠিক সেই কাজটি করে বসেছে। আমি মাহুতকে বললাম, হাতিকে দৌড় করিয়ে দিতে। যথাসম্ভব শীঘ্র ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখলাম, যে সেই প্রৌঢ় শিকারি মাটিতে পড়ে আছে। তার ডান হাতের উপরের অংশটা ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে আর ওই অংশের হাড় দুই-তিন টুকরো হয়ে মাংস ভেদ করে বেরিয়ে পড়েছে। রক্তে মাটি ভিজে গেছে আর তখনও ক্ষতস্থানগুলো থেকে রক্তস্রাব হচ্ছে। আমি তখনই একজনের একখানা গামছা নিয়ে ক্ষতগুলো উপরের দিকের অংশে শক্ত করে জড়িয়ে একটা কাঠি দিয়ে, যাকে টুর্নিকেট (tourniquet) বলে, সেইরকম করে ঘুরিয়ে চাপ দিয়ে, রক্ত বন্ধ করে দিলাম। তারপর আহত লোকটিকে জঙ্গলের বাহিরে বইয়ে নিয়ে গিয়ে, গ্রাম থেকে খাটিয়া আনতে লোক পাঠালাম, আর কয়েকজন লোককে মোতায়েন করে রাখলাম, খাটিয়া আনলেই তারা তাতে করে শিকারিকে সেখান থেকে দশ মাইল দূরে হাসপাতালে বয়ে নিয়ে যাবে। এই বন্দোবস্ত করে আমি আবার জঙ্গলে ফিরে গেলাম।

সেখানে আমার পিয়োন বলল যে, শিকারিকে বাঘে ধরবার পর যারা পালাচ্ছিল তাদের কয়েকজন লোক ফিরে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে দূর থেকে বাঘের দিকে পাথর ছুড়েছিল। পাছে শিকারির গায়ে লাগে এই ভয়ে কেউ তির ছুড়তে সাহস করেনি। লোকজনের চিৎকারে এবং পাথর ছোড়ায় বাঘ শিকারিকে ছেড়ে দিয়ে প্রায় সত্তর-আশি গজ দূরে একটা লম্বা খাদের (ravine) মধ্যে ঢুকেছে। তখন আমি যে হাতিতে চড়ে এসেছিলাম তার মাহুতকে জিজ্ঞাসা করে জানলাম যে হাতিটা কখনো শিকারে ব্যবহার হয়নি। এটা হস্তিনী ছিল। পিয়োন যে হাতিতে চড়ে বসে ছিল সেটা ছিল একটা দাঁতাল পুরুষ-হাতি। ভাবলাম, সেইটাতে চড়ে খাদের মধ্যে নামব। সেই হাতিতে চড়তে যাচ্ছি, এমন সময় পিয়োন অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে বলল, 'এ কাজ করবেন না, এর উপর থেকে আপনি ফায়ার করতে পারবেন না। বাঘ যখন চার্জ (charge) করেছিল তখন এ হাতি এমন করে বনের ভিতর দিয়ে ছুটে পালাল যে আমার মনে হল গাছের ডাল মাথায় লেগে আমার মাথা ভেঙে যাবে এবং আমি হাতি থেকে মাটিতে পড়ে যাব।' সেই হাতির মাহুতও বলল যে, ওই হাতিও শিকারে অভ্যস্ত নয়।
তখন আমি পায়ে হেঁটে রাইফেল নিয়ে সেই খাদের কাছে গিয়ে উপস্থিত হলাম। লোকেরা এবং হাতি দুটো আমার পিছনে এল। দেখলাম খাদের ভিতরটা ছোটো ছোটো গুল্মের ঝোপে ভরা, আর সে-ঝোপগুলো খাদের কিনারা পর্যন্ত উঠে এসেছে। খাদের ওই ঝোপের ভিতর নেমে আহত বাঘকে খুঁজতে যাওয়া বড়ো বেশি দুঃসাহসের কাজ। একটু ভেবে নিয়ে আমি জনকয়েক লোককে খাদের ধারের বড়ো বড়ো গোটাকয়েক গাছের উপর উঠিয়ে দিয়ে, তাদের ভালো করে দেখতে বললাম, বাঘ কারো নজরে পড়ে কি না। অল্প সময় পরে তাদের একজন বলল, 'আমি বাঘের পিছনের পা আর লেজ দেখতে পাচ্ছি, লেজটা মাঝে মাঝে নড়ছে।' তখন অন্য লোকদের খাদের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিয়ে, আমি খাদের একেবারে ধারে একটা বড়ো গাছের পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম আর গাছের উপরের লোককে বাঘের লুকোবার স্থানটা যতটা সম্ভব নির্দেশ করে দিতে বললাম। সে হাত দিয়ে দেখিয়ে আর মুখে বলে ওই স্থানটা আমাকে বুঝিয়ে দিল। আমি সেই জায়গাটা লক্ষ করে উপর্যুপরি কয়েকটা ফায়ার করলাম। খাদের ভিতর থেকে বাঘ গর্জন করে উঠল, বুঝতে পারলাম এইবার খাদ থেকে বেরিয়ে পড়বে। আমি গাছটার পিছনে দাঁড়িয়ে রাইফেল ঠিক করে ধরে দু-ধারে দেখতে লাগলাম কোথায় বাঘ খাদ ছেড়ে উঠে আসে। অতি অল্পক্ষণ পরেই গাছের উপরের লোকেরা গোলমাল করে উঠল : 'গেল, গেল, পালাল!' আমি উপরের দিকে চেয়ে দেখলাম লোকেরা হাত দিয়ে খানিক দূরে দেখিয়ে দিচ্ছে। সেইদিকে চেয়ে বুঝলাম যে, বাঘ খাদের কিনারার উপরে না উঠে কিনারার নীচে নীচে অনেকটা পথ দৌড়ে, তারপর উপরে এসে একটা ঝোপ পার হয়ে পাশে আর একটা খাদে গিয়ে ঢুকছে। একটা ফায়ার করলাম, সেটা লাগল বলে মনে হল না।
তখন আমি বড়ো মুশকিলে পড়েছি বলে মনে হল। আহত বাঘটাকে ওই অবস্থায় ছেড়ে আসা অসম্ভব। সেটা অত্যন্ত লজ্জার কথা হবে। ইত্যবসরে গাছের লোকগুলি নেমে আসল এবং হাতি দুটোও আমার কাছে এসে দাঁড়াল। এই সময় একজন সাঁওতাল আমাকে বলল, 'হুজুর, তুই একটা হাতি এগিয়ে দিয়ে তার পাশে পাশে যা না কেন? বাঘ যখন হাতিকে তাড়া করবে তখন তুই গুলি করবি।' আমি তখন বললাম, 'বাঃ, এই ঠিক বলেছে; খুবই ভালো প্রস্তাব।' আমি একজন মাহুতকে আদেশ দিলাম, হাতি নিয়ে যেখানে বাঘ খাদে নেমেছে সেইখানে খাদে ঢুকতে। মাহুত তাই করল, আর আমি হাতির পাশে পাশে গিয়ে খাদের কিনারায় দাঁড়ালাম। হাতি খাদে নামামাত্রই বাঘ মহা গর্জন করে হাতিকে চার্জ করল, আর হাতি শুঁড় তুলে ঊর্ধ্বশ্বাসে খাদ থেকে বেরিয়ে এসে দৌড়ুল। সে এক অদ্ভুত দৃশ্য, অন্য সময়ে দেখলে হাসি পাবার কথা। অত বড়ো জানোয়ারটা— পিছনের পা দিয়ে মাঝে মাঝে লাথি ছুড়তে ছুড়তে ভয়ে দৌড়োচ্ছে, আর তার পিছনে তার চেয়ে ছোটো জানোয়ার তাকে তাড়া করছে। দেখতে দেখতে হাতি এক ধারে বেরিয়ে গেল, আর রঙ্গভূমিতে রয়ে গেলাম বাঘ আর আমি। আমাকে দেখেই বাঘ ফিরে দাঁড়িয়ে, বিড়াল শিকারের উপর লাফ দেওয়ার ঠিক আগে যেমন করে মাটিতে পেট দিয়ে শরীরটাকে গুটিয়ে বসে যায়, ঠিক সেইরকম করে বসল। আমার তখনকার সম্পূর্ণ একাগ্র দৃষ্টির উপর মুহূর্তের মধ্যে বাঘের যে চেহারা ফুটে উঠেছিল, সেটার ছাপ আমার স্মৃতিতে চিরকালের মতো মুদ্রিত রয়ে গেছে। তখন তার ঠোঁট গেছে গুটিয়ে, তীক্ষ্ন বড়ো দাঁতগুলো বেরিয়ে পড়েছে, কান দুটো পিছন দিকে চেপটা হয়ে মাথার সঙ্গে লেপটে গেছে, লেজটা চাবুকের মতো এপাশ ওপাশ করে দুলছে, চোখ দুটো ভীষণ হিংস্রভাবে উঠেছে জ্বলে। আমার কাছ থেকে পঁচিশ ফুট আন্দাজ দূরে তখন সে, একেবারে সামনাসামনি; লাফ দেওয়ার জন্য প্রস্তুত। ওই দেখেই আমি তৎক্ষণাৎ এক হাঁটু মাটিতে রেখে বসে গিয়েই বাঘের দুই চোখের মাঝখানে লক্ষ করে নিমিষের মধ্যে ফায়ার করলাম। বাঘ আর উঠল না, ঠিক সেই অবস্থাতেই রয়ে গেল। কেবল তার সমস্ত শরীরটার ভিতর দিয়ে দিয়ে একটা শিহরন চলে গেল, চোখের আগুন নিবে এল, মুখটা নেমে পড়ে মাটিতে ঠেকল, আর লেজটা একবার আস্ফালন করে উঁচু হয়ে উঠে তারপর মাটিতে স্থির হয়ে পড়ে রইল। এই লক্ষ্যভ্রষ্ট হলে সেদিন আমার জীবন সংশয় হত তার আর সন্দেহ নাই।

তারপর বাঘের কাছে গিয়ে দেখলাম রাইফেলের গুলি তার মাথাটাকে একটা কুড়ুলের ঘা দিয়ে কেটে দিলে যেমন হয়, ঠিক তেমনি করে দু-ফাঁক করে দিয়ে চলে গেছে, আর তার সঙ্গে মস্তিষ্কের খানিকটা ছিটকে বেরিয়ে এসেছে। দেখলাম, পূর্বদিনের গুলিটা বাঘের পেটের একপাশে ঢুকে মেরুদণ্ড স্পর্শ না করে কোমরের নীচে একপাশ ভেদ করে বেরিয়ে গিয়েছিল। ক্যাম্পে এসে মেপে দেখেছিলাম বাঘটা লম্বায় সাড়ে সাত ফুট ছিল। আমি যতগুলি প্যান্থার মেরেছি তার মধ্যে এইটাই সবচেয়ে বড়ো। সেবারকার অভিযানে আমারই অদৃষ্টে কেবল এই বাঘ জুটেছিল, অপর শিকারি কেউ কিছু পাননি।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন