বীভৎস

বিশ্বদেব গঙ্গোপাধ্যায়

আর্য মুখোপাধ্যায়

 

কালী পাহাড়ের পশ্চিম দিকেই একটা কুলি বস্তি। পাহাড় কাটার কাজ নিয়ে এসেছে ওরা দূর দূর গাঁ থেকে। এপ্রিল মাস। দুপুরে প্রচণ্ড গরম তার ওপর ওই পাথুরে জায়গার ওপর দিয়ে বয় 'লু'। এর ভিতর আবার সেই বিভীষিকা! কর্মক্লান্ত শরীরটাকে দিনের শেষে বিশ্রামের জন্য এলিয়ে দিয়েও নেই স্বস্তি! আবার কোন ঘরের অস্ফুট কুসুম ঝরে যাবার পালা কে জানে! ত্রস্ত ভীত চোখে বুকের মধ্যে নিজেদের বাচ্চা চেপে ধরে করুণ প্রার্থনা জানায় কামিনগুলো ভগবানের উদ্দেশে।

সকাল বেলায় দেখতে গিয়েছি জানোয়ারদের ওঠা-নামার ট্র্যাক পাহাড়টার অপর পাড়ে, ঘুরতে ঘুরতে রোদ বেড়েছে, রওনা হয়েছি বাড়িমুখো। সঙ্গী আমার তিন বন্ধু। গল্প করতে করতে বস্তিটার প্রায় কাছেই এসে পড়েছি, ছুটতে ছুটতে এসে হাজির এক কুলি; সারা দেহে তার পাথরের গুঁড়ো আর ধুলো। কিছু বলার আগেই তার চোখ ছাপিয়ে জল এসে গেল। জোয়ান লোকের এ-রকম হঠাৎ কান্নার কী কারণ না জানতে পেরে যখন অস্বস্তি বোধ করছি মনে মনে, মুখ খুলল কুলিটা। জানলুম, এক জানোয়ার তার দুধের বাচ্চাটাকে নিয়ে গেছে গতকাল রাত্তিরে, একটা রক্তমাখা কাঁথা ছাড়া আর কিছুই পায়নি বাচ্চাটার। এ-রকম আরও অনেকের গেছে নাকি এই ক-মাসের মধ্যে। অনেক চেষ্টাতেও করতে পারেনি কিছুই। আবছা চাঁদের আলোয় যা দেখেছে, তাতে কেউ বলছে চিতওয়া (লেপার্ড বা প্যান্থার), কেউ বলছে লাকার (হায়না), আবার কেউ-বা বলছে লাকড়া বাঘ (নেকড়ে)।

বস্তিতে আসতেই ভিড় জমে চারিদিকে। নানা ধরনের কথা শুনি নানা লোকের মুখ থেকে এ সম্বন্ধে। সন্তানহারা মা কান্নায় ভেঙে পড়ে আমাদের দেখে। প্রতিশোধের আগুন মনের মধ্যে চেপে বিস্তারিত বিবরণ শুনি এই নিদারুণ অপহরণের, যার একমাত্র উদ্দেশ্য হত্যা। বন্ধুদের ওখানে রেখে কুলিটার সঙ্গে দেখতে থাকি সেই কাঁথা পাওয়ার জায়গাটা, দু-একটা পাথরের ওপর কয়েক ফোঁটা জমা রক্তের দাগ। ওই রুক্ষ পাথুরে জায়গায় কোনো চিহ্নই নেই পায়ের ছাপের, অনেক দেখেও বুঝতে পারলুম না জানোয়ারটার স্বরূপ। ঘণ্টা দুয়েক কাটিয়ে আবার ফিরলুম বস্তিতে। মোটামুটি সাবধান হবার কথা বলে জানালুম যে, এর প্রতিকার করার জন্য চেষ্টা করব আপ্রাণ। সারা রাস্তাটা ভাবতে ভাবতে এলুম, কানে তখনও কান্নাটার রেশ রয়েছে লেগে।

একটা হিংস্র শ্বাপদের মুখ ভেসে এল, ছিন্নভিন্ন করে মাংস খাচ্ছে শিশুদেহ থেকে। ট্রিগারে চাপ দিয়েছি আঙুলের, আওয়াজ হল খট। মিসফায়ার! চোখ খুলে দেখি বিছানাটা ঘামে ভিজে গিয়েছে একেবারে, সেইসঙ্গে গায়ের জামাকাপড়। বালিশের নীচ থেকে ঘড়িটা বার করে দেখি বেলা পাঁচটা প্রায়। তাড়াতাড়ি উঠে বন্ধুদের ডেকে তুলি এবার। বিকেলের চায়ের সঙ্গে রাত্তিরের খাওয়ার পালাটাও চুকিয়ে নিয়ে বেরোলুম সবান্ধবে, বিকেল ছ-টা তখন। আবার সেই বস্তি। বস্তিটার সামনের আমগাছে দুজনকে একটা চারপাইয়ের ওপর বসিয়ে, আমি আর একজন গিয়ে বসলুম পাহাড়টার কিছু ওপরে— দুটো পায়ে-চলা পাহাড়ি রাস্তার মাঝামাঝি। সূর্য গেছে অস্তাচলে, শেষ আলোর রেশ রয়েছে লেগে পশ্চিম দিগন্তে। আমাদের পিঠের কাছে একটা বড়ো কাঁটাঝোপ, সামনে একটা মাঝারি পাথরের আড়াল। বস্তির শেষ ঘরটা পঞ্চাশ গজের মধ্যেই। রাইফেলের ওপরের আলোটা ঠিক করে দেখে নিলুম আবার। সব চুপচাপ। একটা একটা করে নাইটজারের ডাক শুরু হল এবার কাছের আর দূরের জঙ্গলগুলো থেকে; রাত্তিরের পর্দা ঢাকতে লাগল চারিদিক। এর কিছু পরেই পাহাড়ের মধ্যে থেকে ডাক ভেসে এল হুতুম পেঁচার চাপা গম্ভীর গলায়— হুড় গুম ম ম।

বসে আছি তো বসেই আছি। রেডিয়াম ডায়াল ঘড়ির সময় ঘোষণা করছে রাত্রি সাড়ে দশটা, এগারোটা, সাড়ে এগারোটা। হঠাৎ মাথার ওপরের পাহাড় থেকে পাথর গড়িয়ে পড়ার আওয়াজ! আবার! এবার আমাদের বাঁ-দিকে পাহাড়ি রাস্তায়! আবছা তারার আলোয় দুটো ছায়ামূর্তি ভেসে উঠল। একটা ছোটো, আরেকটা বড়ো। রাইফেলের ওপর মুঠোটা দৃঢ় হয়ে ওঠে, নিশ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করি সুযোগের। আরও কাছে আসায় দেখলুম একটা মাদি সম্বর আর তার বাচ্চা। রাইফেলের ওপর মুঠোটা আলগা করি এবার। আস্তে আস্তে নেমে চলে গেল বেশ দূরের ছোটো জলাটার দিকে। আড়ষ্ট পা দুটোকে একটু আরাম দিয়ে আবার বসলুম গুছিয়ে। কোনো শব্দ নেই আর, প্রহরের পর প্রহরই কেটে গেল শুধু। শেষ রাত্রিতে একটু ঝিমুনি এসে গিয়েছিল বোধ হয়, চমক ভাঙল বুনো মুরগির ডাকে। তখনও আলো ফোটেনি, শুকতারাটা জ্বলজ্বল করছে পাহাড়টার মাথা ঘেঁষে। ব্যর্থ প্রতীক্ষা। বন্ধুদের সব ডেকে নিয়ে যখন বাড়িমুখো রওনা হলুম, পুব আকাশে তখন সবে আলো দেখা দিয়েছে।

আজ রবিবার। কুলিদের ছুটি আজ; সজাগ থাকবে সবাই। তাই আর বসলুম না আজ। সন্ধেটা বেড়িয়ে কাটল এধার-ওধার। শহরের প্রায় সবটাই দেখা হল।

সোমবার সকালেই আবার গিয়ে হাজির হলুম বস্তিটায়। জানলুম, অঘটন কিছু ঘটেনি। নিশ্চিন্ত হওয়া গেল অনেকটা। আমগাছটার গোড়ার আড়ালে একটা গর্ত করতে বলে দিলুম, যাতে বসতে পারি দুজন। আবার গেলুম পাহাড়ের ওপর, ট্রাকগুলো ভালো করে দেখতে। কাঁকর আর পাথরে চিহ্ন নেই পায়ের ছাপের। নীচে নেমে দেখি গর্ত তৈরি হয়েছে, যাতে স্বচ্ছন্দে বসা চলে দুজনের। বিকেলে আসব জানিয়ে চলে এলুম ওদের সকৃতজ্ঞ দৃষ্টির সামনে থেকে।

যখন গিয়ে হাজির হলুম আবার, সূর্য তখন সিঁদুর-রং ছড়িয়ে দিয়েছে। পাহাড়ের মাথা আর গাছপালাগুলোতেও সেই রঙেরই ছোঁয়া রয়েছে লেগে। এক এক করে হাজির হতে লাগল কুলিগুলো তাদের কাজ সেরে। আমাদের জায়গাটা থেকে দক্ষিণ দিকের একটা পাতায় ছাওয়া ঘর ঠিক করেছি, যাতে কেউ থাকবে না। শুধু জ্বলবে একটা কেরোসিনের ছোট্ট আলো। আর যে চারপাইটা ঘরে থাকবে, তার ওপর থাকবে কাঁথা আর ছেঁড়া কাপড় জড়ানো একটা ছোট ছেলের মতো মূর্তি (খড়ের) যেটা আমি তৈরি করেছি। দরজাটা থাকবে আধ-খোলা— যাতে বাইরে থেকে আবছা আলোয় দেখা যাবে চারপাশটা। মনোমতো সব গুছিয়ে নিয়ে জানিয়ে দিলুম ওদের যে, কেউ যেন না বেরোয়, আমি না ডাকলে যেন বন্দুকের আওয়াজ শুনেও না আসে আমার কাছে। প্রত্যেক দিনের মতো আজও যখন ওদের বাড়িগুলো নিস্তব্ধ হল তখন রাত প্রায় আটটা। সব কুঁড়েঘরগুলোই বন্ধ ভেতর থেকে; খালি একটা বাদ— সেটা আমারটা। দেখলে মনে হয় কেউ যেন এখুনি বেরিয়েছে বাচ্চাটাকে শুইয়ে। সজাগ উৎকর্ণ হয়ে বসে আছি আমরা দুজন। হাতে আজ আর রাইফেল নেই, আছে বন্দুক। কাছাকাছি মারতে গেলে বন্দুকেই সুবিধে বেশি। বন্ধুর হাতে পাঁচ সেলের টর্চ। ঝিঁঝি ডেকে চলেছে একটানা, মাঝে মাঝে ভেসে আসছে নিশাচর পাখির ডাক। দূর জঙ্গল থেকে কানে ভেসে এল সম্বরের ডাক— খ্যাঁক। একটা বাচ্চা কেঁদে উঠল কোন ঘরে, ঘুম-জড়ানো গলায় তার মা কী বলাতে একটু ফুঁপিয়েই চুপ করল আবার। কী দেখব, আর কী দেখতে বসে আছি নিজেই জানি না, কিন্তু আগ্রহ অসীম। রাত্তির বাড়ছেই ক্রমশ, আর আমরা ভাবছি আজও বুঝি ব্যর্থ হল এ প্রতীক্ষা। রাত এগারোটা বাজে প্রায়। কখন আসবে সেই শিশুহন্তারক!

রাত সাড়ে এগারোটা! পিঠে আঙুলের চাপ পড়ায় ফিরে দেখি, বন্ধু ইশারা করছে একটা বড়ো পাথরের ঢিবির দিকে। একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলুম সেই দিকে, একটা অস্পষ্ট ছায়া পড়ল যেন ঢিবিটার পাশ ঘেঁষে। একটু এগিয়েই আবার একটা ছোটো ঝোপের আড়াল নিল জানোয়ারের ছায়াটা। বস্তিগুলোর কাছে আসতে হলে একটু ফাঁকায় তাকে আসতেই হবে। সময় যেন হু হু করে কেটে যাচ্ছে, কিন্তু আর বেরোচ্ছে না কেন জানোয়ারটা। আমার ফাঁকিটা বোধ হয় ধরে ফেলেছে। নাঃ, ওই তো এবার বেরোচ্ছে ঝোপের পাশ থেকে এদিক-ওদিক চাইতে চাইতে। কী নিঃশব্দ আর সন্তর্পণ পদক্ষেপ! আরও একটু এগোলেই আসবে আমার সুযোগ। মনে সন্দেহ হচ্ছে এটাই তো সেই, না খাদ্যলোভাতুর অন্য আরেকটা! দেখা যাক, যদি ওই ঘরটার সামনে যায় ওর ভাবভঙ্গিতেই বোঝা যাবে অনেকটা। এইবার সেই আধ-ভেজানো দরজাটার দিকে এগোচ্ছে আস্তে আস্তে। ছায়াটার আকৃতি দেখে এবার বোঝা যাচ্ছে যে এটা একটা বেশ বড়ো সাইজের হায়না। এই সেই হন্তারক!

ইশারায় মুহূর্তে বন্ধুর হাতের টর্চের উজ্জ্বল আলো গিয়ে পড়তেই, খানিকটা থমকে ছুটের চেষ্টা করার মুখে পাক খেয়ে পড়ে ঘাড়ে একটা 'এল. জি' লাগায়। বন্ধু উত্তেজনার চিৎকার করে ওঠে, 'আবার মারো ওকে, নয়তো পালাবে।' নিষ্ফলভাবে পা ছুড়ে আস্তে আস্তে নিশ্চল হয়ে গেল দেহটা। বন্ধ হল ওর শিশুমেধ চিরদিনের মতো। বন্দুকের আওয়াজের পর বন্ধুর ডাকে একে একে লোক ছুটতে লাগল বস্তিটা থেকে। কাছে গিয়ে দেখি, প্রকাণ্ড একটা বুড়ে হায়না রয়েছে পড়ে।

আজ আর শিশু-রক্ত নয়, ওরই রক্ত রয়েছে চারিদিকে ছড়িয়ে, ধুলো আর কাঁকর-বিছানো জমির ওপর।

সকল অধ্যায়

১. সুন্দরবনের শেষপ্রান্তে
২. শিকারের সন্ধানে
৩. নির্ভীক
৪. শিকারীর ক্ষোভ
৫. শিকারীর ভয়াবহ অভিজ্ঞতা
৬. বিপর্যয়
৭. হাওদা শিকার
৮. হাওদায় বসিয়া শিকার
৯. শিকারের কথা
১০. একদন্তের শেষ
১১. প্যান্থার
১২. মাচা থেকে চিতা ও অন্যান্য
১৩. জঙ্গলের ভ্রূকুটি
১৪. মহিষ
১৫. বীভৎস
১৬. কুমীর শিকার
১৭. হিমালয়ে ভল্লুক শিকার
১৮. কোয়াড়ে ভালুক শিকার
১৯. ভালুকের কবলে
২০. বাজ-বহেরী
২১. পদ্মায় পক্ষী শিকার
২২. পরিশিষ্ট
২৩. শিকারের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম
২৪. শিকার, শিকারী ও জীবজন্তু সম্বন্ধে বিবিধ জ্ঞাতব্য তথ্য
২৫. বন্দুক, বন্দুকের প্রকার ও ব্যবহার সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞাতব্য তথ্য
২৬. বাঙালির শিকারের আগ্নেয়াস্ত্র
২৭. ভারতের ব্যাঘ্র প্রকল্প
২৮. সহায়ক বাংলা পুস্তক তালিকা

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন