বিশ্বদেব গঙ্গোপাধ্যায়

ধীরেন্দ্রনারায়ণ রায়
একবার শিকারে গিয়ে বন্দুকের ছিটে একটি মেয়ের পায়ে লাগায় শপথ করেছিলাম— এক বছর বন্দুক ধরব না। প্রতিজ্ঞা পালন করেছি— এক বছর বন্দুক ছুঁইনি। বলেও দিয়েছিলাম— শিকারের খবর কেউ যেন না দেয়। তাই, ভগবান আমাকে বাজিয়ে পরীক্ষা করে নিতে চান বলেই বুঝি অনেকরকমের বাঘ-শুয়োরের খবর আসতে থাকে। বুকে ঝড় বয়ে যায়— তবুও যাই না। সদীর্ঘ নিশ্বাস ফেরত দিই। এমনকী, যেসব বালিহাঁসের জন্যে পদ্মার চরে কত কষ্ট স্বীকার করেছি— তারাই এখন আমার বাড়ির উপর খুব নীচু করে রোজ সকালে উড়ে যায়— আমি চোখ ফিরিয়ে নিই।
এই অজ্ঞাতবাসের পর, শুভ পয়লা বৈশাখে ঘুমন্তপুরী সচেতন হয়ে উঠল। একটা দাঁতাল বন্যবরাহ শিকার করে আমিও হালখাতায় নাম লেখালাম। দেখলাম— দীর্ঘ একবছর আমি বন্দুককে ভুলে থাকলেও সে আমায় ভোলেনি।
এর পরই ছোটো-বড়ো শিকারে দস্তুরমতো মেতে উঠলাম।
বাঘ-শুয়োরের চাইতে পাখি শিকার যে খুব সহজ, তা নয়; বিশেষ করে পদ্মার ফাঁকা বালুচরে।
মাঘ মাস। দুর্দান্ত শীত তার দাঁতের কামড়ে যেন ঘুমন্ত পৃথিবীকে আঁকড়ে ধরে আছে! অতি প্রত্যুষে, অরুণোদয়ের আধ-ফোটা কচি আলো কুয়াশাচ্ছন্ন পদ্মার প্রশান্ত বক্ষে নামতে এসেও প্রতিহত হয়ে ফিরে যায়। এইরকম একটা শীতের প্রভাত।
পদ্মার বুকে নোঙর-করা আমার বজরাখানা সমস্ত রাত ধরে ঢেউয়ের সঙ্গে হেলে-দুলে নেচে উঠছিল। আমি তার মধ্যে লেপ মুড়ি দিয়ে কখনো-বা ঘুমিয়ে নিয়েছি, আবার কখনো-বা ঘুম ভেঙে দেখেছি— পদ্মার তরঙ্গের সঙ্গে যুদ্ধ করেও আমার বজরাখানা সেইখানেই বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
ঠিক ভোর হবার মুখেই শিকারে বের হব। বজরার সঙ্গে একটা ছোট্ট জেলে-পানসি বাঁধা ছিল। আমি খাকি হাফ-শার্ট-প্যান্ট পরে নিলাম, কারণ কটকটে সাদা বা উজ্জ্বল রঙের কোনো পোশাক পরা থাকলে, পাখিরা শিকারিকে শিগগির কাছে ভিড়তে দেয় না। কারণ, তাদের ভগবানের দেওয়া সহজাত একটা তীব্র বোধশক্তি আছে, আর সেটা এত প্রবল যে, তারা ঠিকই বুঝতে পারে, কে বন্ধু আর কে তাদের শত্রু। আমি বহুবার দেখেছি, চাষিরা পদ্মার চরে চাষ করে— পাখিরা তাদের গ্রাহ্যই করে না; কিন্তু শিকারিদের তারা দূরে দেখতে পেলেই হুশ করে উড়ে যায়। আমি বন্দুক টোটা সব নিয়ে পানসিতে চেপে বসে মাঝিদের ছেড়ে দিতে বললাম। কথার সঙ্গে সঙ্গে নৌকা পদ্মার বুক চিরে হেলেদুলে চলতে লাগল— ছপ ছপাৎ ছপ—ছপ ছপাৎ ছপ!
এই পদ্মা! এরই নাম কীতিনাশা! যুগযুগান্তের কত না ধ্বংসলীলা তার বুকে উধাও হয়ে ছুটে চলেছে। ছোটো ছোটো ঢেউগুলি তীরে আছড়ে পড়ে বলতে চায় কত না অকথিত বাণী! আমার কৈশোর ও যৌবনের নিত্য-সহচর এই পদ্মার জীবন যেন আমার জীবনের সঙ্গে একসঙ্গে মিশে আছে।
দূর থেকে অস্পষ্ট আলোকে দেখলাম, নানান জাতীয় হাঁস, বন্য রাজহাঁস, চকাচকি পদ্মার চরে মেলা বসিয়েছে— তাদের অফুরন্ত কাকলি দিয়ে যেন নিস্তব্ধ প্রভাতকে সচকিত করে তুলতে চায়। যেন তাদের পাখার ঝাপটে জাগিয়ে তুলতে চায় ঘুমন্ত ধরণীকে।
কিন্তু থাক, কবিত্ব করলে তো আর শিকার করা যায় না!
এদিকে ধীরে ধীরে প্রকৃতি দেবী তাঁর কুয়াশার অবগুণ্ঠন সরিয়ে নিয়েছেন। এখন বেশ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, পাখিগুলো দূরে— অপর পারের বালুচরে, এক এক স্থানে তাদের স্বজাতিবর্গ নিয়ে আহারের অন্বেষণে খুব ব্যস্ত। একটা দলপতি বন্য রাজহাঁস গ্রীবা উচ্চ করে সতর্ক প্রহরীর কার্যে নিযুক্ত আছে— কোথাও কোনোদিক থেকে শত্রুর আগমন হচ্ছে কি না তাই নিরূপণ করবার জন্যে। সেই দলপতি 'প্যাঁক প্যাঁকোর প্যাঁক' শব্দ করলেই সকলে আহার ছেড়ে চারিদিকে সন্ত্রস্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে, আর যেই দলপতি উড়লেন, সকলেই অনুরূপ শব্দে আকাশ-পথযাত্রী হলেন। কিন্তু অন্য কোনো জীব যতই সুচতুর হোক না কেন, ভগবানের সৃষ্টিতে মানুষই হচ্ছে সব চাইতে চালাক।
একটু এগিয়ে যেতেই পাখিগুলো পিছনে ফিরতে লাগল। তখনও তারা বন্দুকের পাল্লায় আসেনি। আমি মাঝিকে বললাম— 'না, আর কাজ নেই— নৌকা ফিরিয়ে ওই যেখানে নদীর ধারে একটা চাষি জমি চাষ করছে, ওইখানে আমাকে নামিয়ে দাও।' তারাও আমায় সেই নির্দিষ্ট স্থানেই নামিয়ে দিলে। তারপর সন্তর্পণে নেমে দেখলাম, অনতিদূরে একটি কৃষক জোড়া বলদের পুচ্ছ মর্দন করে লাঙল চালিয়ে যাচ্ছে, আর সঙ্গে সঙ্গে নিরীহ গো-জাতির চৌদ্দপুরুষ উদ্ধার করে চলেছে— তার মুখে অকথ্য ভাষা যেন খই ফুটছে। বলদ দুটো অনাহারে দুর্বল—কৃশ; তাই তাদের দুর্বহ জীবনভার যেন আর বইতে পারে না— তার উপর অজস্র লাঠি প্রহারে জর্জরিত। সেই কৃষকের কাছে গিয়ে বিনা ভূমিকায় বললাম— 'ভাই, একটু সাহায্য করতে হবে যে। বলদ দুটো খুলে নিয়ে ওই পাখিদের বাঁয়ে রেখে আমার সঙ্গে এগিয়ে চল না— না, আমিই তোমার সঙ্গে এগিয়ে যাব? আর তোমার একটু সময় নষ্ট হবে বলে এই নাও দু-টাকা।' সে তৎক্ষণাৎ টাকা দুটো ট্যাঁকস্থ করে নিয়ে, বলদ দুটো খুলে চলতে লাগল। আমি তার মাথার মাথল অর্থাৎ আমাদের দেশি হ্যাট খুলে নিয়ে নিজের মাথায় পরে নিলাম। সে তো হেসেই অস্থির! সেও তার কোমরে বাঁধা গামছাখানি খুলে মাথায় জড়িয়ে নিলে। আমি আমার Long range Duck gun-এ 3A shot ভরে বন্দুকটি পিছনে লুকিয়ে তার স্কন্ধে হাত দিয়ে চললাম, যেন আমরা কতকালের চেনা বন্ধু। সেই চাষি বন্ধু এগিয়ে যাবার সময় কত গল্প বলতে লাগল— কত হাকিম-হুকুম সব আসে এখানে শিকার করতে— আমি কেমন ভালো করে শিকার করিয়ে দেই।' এই বলে সগর্ব দৃষ্টিতে সে আমার দিকে চাইল— যার অর্থ, শিকারের বাহাদুরির সবটাই যেন তারই প্রাপ্য। তারপর কথার মাঝেই ফস করে বলে বসল— দ্যান না ম'শয়, আপনাদের একটা ভালো বিড়ি-টিড়ি। আমি বললাম— আমার কাছে তো বিড়ি নেই, তবে সিগারেট আছে। —হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমিও ওই কথাই বুলছি। —আপনাদের ওই সাদা বিড়ি। বাস্তবিকই, তাদের সরলতায় মুগ্ধ না হয়ে থাকা যায় না। আমি পিঠ চাপড়ে বললাম— 'দেখ, এখন ওসব খায় না— শিকারটা হয়ে যাক, তারপর একটা কেন— দশটা দিয়ে যাব— আর এসময় বেশি কথা বলতে নেই— শিকার পালিয়ে যাবে।' কে কার কথা শোনে! সে অনর্গল বকেই চলেছে— পূর্বে যারা সব শিকার করতে এসেছিল তাদের ইতিহাস। আমি তার হাত ধরে বললাম— দয়া করে একটু চুপ কর ভাই। কী বুঝে সে তার বিরামবিহীন বক্তৃতায় ছেদ টানল। কিছুক্ষণ পরেই শিকারটা প্রায় আশি-নব্বই গজের মধ্যে এসে পড়তেই আমি আর কাল বিলম্ব না করে বন্দুকটি উঠিয়ে ধাঁ করে পর পর দুটো আওয়াজ করলাম। দেখলাম, দুটি সুবৃহৎ বন্য রাজহাঁস তৎক্ষণাৎ পঞ্চত্বপ্রাপ্ত হল। আর একটি ডানা ভেঙে গিয়ে আবার উঠে দাঁড়াল। তার প্রাণপণ চেষ্টা যে, একবার কোনোরকমে পদ্মার জলে গিয়ে পড়তে পারলে স্রোতে ডুব দিয়ে ভেসে যাবে— তাকে আর ধরা যাবে না। আমিও বন্দুক ফেলে দিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটলাম, সেও প্রাণপণে ছুটে চলেছে। এ যেন রাজপুতের প্রতিজ্ঞা— জীবন্তে ধরা নাহি দিব।

সে তখন প্রায় জলের কাছাকাছি পৌঁছে যায় আর কি— এমন সময় ছুটতে ছুটতে 'মহাপঙ্কে নিপতিতং'— গভীর পাঁকের মধ্যে পড়ে গেলাম। প্রায় আমার কোমর পর্যন্ত ডুবে গেল। আমি কাত হয়ে শুয়ে পড়লাম, কোনোমতে প্রাণটাকে বাঁচাবার জন্যে। তা নইলে হয়তো আমার জীবন্ত সমাধি হয়ে যেত। এ-রকম চোরাবালি পদ্মার চরে প্রায় থাকে—দেখে ঠিক ধরা যায় না। আমার তখন 'ন যযৌ ন তস্থৌ' ভাব। এইরূপ দুর্দশা দেখে, আমার সেই কৃষক বন্ধুটি ছুটে কাদায় লম্বা হয়ে শুয়ে যেন সাঁতার কেটে আমার দিকে এগিয়ে এল। তার একটি হাত ধরে, আমরা দুটি বন্ধু মুখোমুখি শুয়ে আছি সেই পাঁকের উপর। আমার দেহ অবশপ্রায়— কম্পিত কণ্ঠে তাকে বললাম— আর বুঝি আমার ওই হাঁসটা পাওয়া গেল না। সে প্রায় ধমকের সুরেই আমায় বললে— ওসব কথা ছাড়ান দ্যান— আল্লার নাম করেন— কোনো ভয় নাই। ক্ষীণকণ্ঠে উত্তর দিলাম— সে তো বুঝলাম, —কিন্তু খোদার পবিত্র নাম যে এখন আমার মুখে আর আসছে না বন্ধু। সে কিন্তু ক্ষান্ত হবার পাত্র নয়। সে তার মৌলবির কাছে শেখা দু-এক লাইন কোরানশরিফের বয়েত আমার কানের কাছে আওড়াতে লাগল। দেখলাম, সে চাষি হলেও নিরক্ষর নয়, এ বিষয়ে একটু জানাশোনাও আছে। সে আমায় সান্ত্বনার সুরে বললে— আমাকে ধরে কোনোরকমে উঠে আবার লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ুন কত্তা। আমি তাকে ধরে উঠবার চেষ্টা করতেই, বিপরীত ফল হল। আগে কোমর পর্যন্ত ছিল, এখন আবক্ষ পাঁকে ডুবে গেলাম। অসহায় কাতর দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে, তার হাত দুটো চেপে ধরে বললাম— আর বুঝি এযাত্রা উঠতে পারলাম না ভাই! আমার তখন অর্ধচেতনাহীন অবস্থা। যাই হোক, আমার জীবননাট্যের যখন এইরকম পরিস্থিতি, ঠিক সেই সময় আমার মাথার উপর খুব নীচু দিকে এক ঝাঁক হাঁস যেন ব্যঙ্গ করেই উড়ে গেল— প্যাঁক, প্যাঁকোর, প্যাঁক। আমার মনে হল— 'দল দলায় পড়লে হাতী, চামচিকেয় মারে লাথি।' ওদিকে দূর হতে আমার মাঝিরা আমার প্রায় অন্তিম অবস্থা দেখতে পেয়ে, একগাছা মোটা দড়ি নিয়ে ছুটে এল। নৌকা বাঁধবার জন্যে এধরনের দড়ি, সাধারণত নৌকোতেই থাকে।
একে দুর্দান্ত শীত, তারপর পাঁকের মধ্যে ডুবে আছি— যেন মৃত্যুর অন্ধকার আমার চোখে নেমে আসছে। যেখান থেকে পাঁক শুরু হয়েছে, সেখানে মাঝিরা দাঁড়িয়ে পড়ল, আর ঠিক যেমন করে জেলেরা নদীর জলে ঘুরিয়ে জাল ফেলে, ঠিক তেমনি কসরত করে তার দড়িটা আমার দিকে ছুড়ে দিলে। আমার কৃষক বন্ধুটি তাড়াতাড়ি করে একটু সরে গিয়ে দড়িটা টেনে এনে আমার হাতে দিয়ে বেশ জোর গলায় বললে— খুব চেপে ধরেন কত্তা! আমি এক হাতে দড়ি আর এক হাতে আমার নবলদ্ধ বন্ধুটিকে খুব জোরে ধরে উঠবার চেষ্টা করলাম, আর মাঝিরাও দড়ির উপর দিকটা ধরে প্রাণপণে আমায় টেনে তুলবার চেষ্টা করলে— যা হোক, জীবন-মৃত্যুর এই tug of war-এ জীবনই জয়যুক্ত হল। কোনোপ্রকারে উঠে আবার পাঁকের উপর সোজা লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লাম। নবপরিচিত বন্ধুটিকে বললাম— 'তুমি হে ভরসা মম অকূল পাথারে।' কিছুক্ষণ বিশ্রামের পর, পাঁকে সাঁতার কেটে আমরা দুজনে যেখান থেকে মাঝিরা দড়ি ছুড়েছিল, সেইখানে উঠে এলাম। সর্বশরীরে এত কাদা লেগে গিয়েছে যে, আমার ওজন দুই মণের জায়গায় বোধ হয় আড়াই মণটাক হয়ে গিয়েছে। ক্লান্ত অবসন্ন দেহে কোনোমতে নৌকোয় চেপে বসলাম।
নৌকোয় আসবার পথে, কৃষক বন্ধু পিছন থেকে অনর্গল বক্তৃতা আর উপদেশ-বাণী বর্ষণ করে চলেছে। কিন্তু আসবার সময় শিকার-করা সেই দুটো রাজহাঁস, আমার বন্দুক আর তার মাথলটি কুড়িয়ে আনতে ভোলেনি। কারণ আমি যখন পিছন ফিরে বললাম— আমার হাঁস দুটো? সে উত্তর না দিয়ে শুধু হাত দুটো উঁচু করে দেখাল। আমি তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললাম— তোমার জন্যই আমি আজ বেঁচে গেলাম। আমার বন্ধুটি বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে বললে— 'রাখে আল্লা, মারে কেডা?' কিন্তু আমার নৌকোয় ওঠবার সময়েই মাঝিদের কাছে আমার পরিচয়টা জেনে নিতেই সে একেবারে চুপ হয়ে গেল। নৌকোয় উঠে আমি বললাম— কী হে, হঠাৎ চুপ মেরে গেল কেন? সে বললে— আপনি যে আমাদের গরিবের মা-বাপ, আপনার নাম খুব শুনেছি, চোখে দেখিনি হুজুর। আমার গোস্তাকি মাফ করতে আজ্ঞা হয়। আমি বললাম— তুমি আমার প্রাণ বাঁচিয়েছ, তাই আমাকেই তোমার গোস্তাকি মাফ করতে হবে বই কী! আচ্ছা বেশ, মাফ করব— কিন্তু একটা শর্তে— এই সাদা বিড়িটা আমার সামনে ধরিয়ে যদি তুমি আগের মতো আমার সঙ্গে কথা বলে যাও! সে বহু সংকোচ, আপত্তি জানিয়ে শেষটা রাজি হল— আমিও তার হাতে একটা সিগারেট দিয়ে দেশলাই জ্বালিয়ে সেটা ধরিয়ে দিলাম— আর সিগারেটের টিনটাও তাকেই দিয়ে দিলাম।
এমন সময় অদূরে একটা বন্দুকের আওয়াজ শুনতে পেলাম। দূরবিনটা নিয়ে দেখি, আমার অতিথি স্যার নাজিমুদ্দিন, পাকিস্তানের ভূতপূর্ব গভর্নর জেনারেল, আমার কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতপূর্ব ভাইস চ্যান্সেলর, পরলোকগত স্যার আজিজুল হক, তাঁদের মধ্যে কে একজন কী-একটা শিকার করে সেটাকে তাড়াতাড়ি উঠিয়ে নেবার জন্যে জোরে নৌকো চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁরা দু-দিন আগে শিকারের জন্যে লালগোলার 'গেস্ট হাউসে এসে' আমার অতিথি হয়েছিলেন। গতকাল আমরা শিকার করেছি। আজও তাঁরা সারাদিন শিকার করে আবার কলকাতায় ফিরে যাবেন। বাড়িতে তাঁদের জন্যে যথোচিত বন্দোবস্ত করে আমি রাত্রেই বজরাতে এসে ঘুমিয়ে ছিলাম। প্রত্যুষে চা পান করে পদ্মাবক্ষে তাঁরা আমার সঙ্গে মিলিত হবেন— এটা পূর্বেই তাঁদের সঙ্গে কথা ছিল। যা হোক, আমি আমার এই নূতন বন্ধুটিকে আলিঙ্গন করে বিদায় নিলাম। পরস্পরের কর্দমাক্ত দেহ— কারো কোনো অসুবিধার কারণ নেই। বিদায়ের সময় আমার ত্রাণকর্তা আমাকে গা-হাত-পা ধুয়ে নেবার জন্যে উপদেশ দিতেও কসুর করেনি। তাকে বুঝিয়ে বললাম— শিকারিরা বন্দুকের আওয়াজ শুনে কি আর চুপ করে থাকতে পারে, বন্ধু! যাক, আর আমার সময় নেই— চললাম; তুমি ভাই, দু-দিন পরে একবার রাজবাড়িতে আমার সঙ্গে দেখা করো। মাঝিদের বললাম— শিগগির ওই নৌকোটার কাছে আমায় নিয়ে চলো। তারাও ক্ষিপ্রতার সঙ্গে তিনটি দাঁড় একসঙ্গে ফেলে পঙ্খিরাজের মতো আমার পানসিখানাকে উড়িয়ে নিয়ে চলল। কিছু দূর যাওয়ার পর পিছন ফিরে দেখি, আমার সেই উপদেষ্টা বন্ধুটি তখনও তীরে দাঁড়িয়ে আমার দিকেই চেয়ে আছে। কী সহজ, সরল, গ্রাম্য মানুষটি— আর সেইসঙ্গেই মনে পড়ল, শহরে গড়ে ওঠা নকল সভ্যতার কথা!
আমায় আসতে দেখে, খাজা নাজিমুদ্দিন তাঁদের নৌকো থামালেন। কাছে আসতেই জিজ্ঞাসা করলাম— আপনাদের কী শিকার হল? আমার সেই কিম্ভূতকিমাকার রূপ দেখে তাঁরা অবাক হয়ে চেয়ে রইলেন। উত্তর দিলেন স্যার আজিজুল হক— কথায় নয়— নৌকোর তলা থেকে একটা রাজহাঁস দু-হাতে তুলে ধরে। তারপর বললেন— মাঝ-পদ্মায় একটাই ভেসে যাচ্ছিল— আর এটা আমিই মেরেছি। তারপর আমার দিকে চেয়ে, হেসে, ঠাট্টা করে বললেন— কোথাও বেড়া টপকাতে গিয়ে খানায় পড়েছিলেন নাকি? আমিও তেমনি সুরেই উত্তর দিলাম— বেড়া টপকাতে নয়, আপনার হাতের ওই হাঁসটাই আমায় খানায় ফেলেছিল! স্যার নাজিমুদ্দিন বললেন— ওঃ, তাই বুঝি উড়তে পারছিল না! গুলি না করলেও লাঠি দিয়েই সাবড়ে দেওয়া যেত! আমি তখন তাঁদের কাছে আমার সেই মহাপঙ্কে উত্থান-পতনের ইতিহাসটা আনুপূর্বিক খুলে বললাম। আমার এই কথা শুনে স্বভাব-গম্ভীর স্যার নাজিমুদ্দিন খুব জোরে হেসে উঠলেন। আর স্যার আজিজুলের হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে গেল। স্যার আজিজুল বললেন— কালও আমাদের সঙ্গে আপনার হয়রানি হয়েছে, আজও আপনি ক্লান্ত, আপনি বাড়ি গিয়ে একটু বিশ্রাম করুন। তা ছাড়া, আপনি তো আমাদের জন্যে সবরকম বন্দোবস্তই করে দিয়েছেন। আমি দ্বিরুক্তি না করে ফিরে এলাম।
ফিরবার পথে দেখি, একজোড়া চকাচকি বেশ মনের সুখে বসে আছে, ভাবলাম, দেখি, এটাকেও যদি মারা যায়। 'অধিকন্তু না দোষায়।' জেলে-পানসি তাদের পাশ দিয়েই চলেছে— কিন্তু এরকমের নৌকো দেখাতে অভ্যস্ত বলেই সচরাচর তারা উড়ে যায় না। প্রায় পাল্লার মধ্যে এসে পড়েছে, তখনই তারা 'ককর কোঁ, ককর কোঁ' শব্দ করে উঠল— এটা উড়বার পূর্বাভাস। আমার মাঝিরা আমাকে নিয়ে বহু শিকার করিয়েছে— তাদের কিছু বলতে হল না। আমি বন্দুক তুলতেই তারাও দাঁড় থামিয়ে দিলে। আমিও তৎক্ষণাৎ আওয়াজ করলাম— তখনই একটা পাখি তার অন্তিম নিশ্বাস ত্যাগ করলে। অন্য চকাটি কেঁদে কেঁদে তাকে ঘিরে চারিদিকে উড়তে লাগল। তার বিরহের আর্তনাদ যেন আমার বুকে তীরের মতো এসে বিঁধল। আমি তার এই দুঃখের অবসান করতে আর একটি shot করলাম— লাগল না। সে ঊর্ধ্বে, আরও ঊর্ধ্বে— সূর্যোজ্জ্বল নীলিমায় তার অভিযোগ জানাতে জানাতে আমায় যেন অভিশাপ দিয়ে চলেছে। মাঝিরা পাখিটাকে কুড়িয়ে নিয়ে এল— তারপর পদ্মার এপারে না আসা পর্যন্ত সেই অপরটিও সঙ্গে সঙ্গে উড়ে আসতে লাগল— তার কণ্ঠে যেন অনাদিকালের বিরহের আর্তধ্বনি। মানুষ যখন নীড় রচনা করতে শুরু করেনি— তখন হয়তো এদের মর্মকথা বুঝত। তারপর মানুষ যখন ভাষা পেল, তখনই বুঝি এদের ভাষা বুঝবার শক্তি সে হারিয়ে ফেললে!
এপারে এসে দেখি, আমার জনৈক আত্মীয় এসেছে আমাদের শিকার দেখার জন্যে। আমার এই কর্দমাক্ত অবস্থা দেখে হাসতে হাসতে সে ছুটে এল— হাতে তার ভরা বন্দুক। আসবার সময় হঠাৎ তার বন্দুকটির আওয়াজ হয়ে গেল; আমার পাশ দিয়েই গুলিটা গেল বেরিয়ে। সে অপ্রতিভের মতো একটু চুপ করে থেকে তারপর বললে— আজ কী হত তোমার? আমি নির্বিকারভাবে উত্তর দিলাম— হত আর কী, মরে যেতাম। চেয়ে দেখ দূরে, ওই পাখিটার কান্না আর সইতে পারি না।
এখানে আমার সেই আত্মীয়টির প্রথম জীবনের শিকার-নৈপুণ্যের ইতিহাস না বললে কিছুটা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। প্রথম বন্দুক কেনবার শখ ভূতের মতো তার ঘাড়ে চাপতেই, সে হঠাৎ একদিন একটা বন্দুক কিনে বসল, কিন্তু তাতে টোটা ভরে ট্রিগার টানাতে তার আর ভরসা হয় না— শখ আছে, সাহস নেই; তবু সে করলে কী, একটা লম্বা বিশ-ত্রিশ গজ দড়ি এনে ট্রিগার বেঁধে দূর থেকে টান দিয়ে গুলি ছোড়ার অভ্যাস করে নিলে; আর এমনি করেই সে সাহসও সঞ্চয় করলে। তারপর, যেদিন থেকে তার তাক করে পাখি শিকার করবার পুলক জাগল, বিল খালের আশপাশের ছাগল, ভেড়া, কুকুরগুলো কত যে অক্কা পেতে লাগল, তার আর সীমা সংখ্যা নেই— তার প্রাণে শিকারি হবার ইচ্ছেটা ষোলো আনার জায়গায় আঠারো আনা ছিল কিনা!
লালগোলা ঘাটে আমার মোটর প্রস্তুত ছিল। সোজা বাড়ি ফিরলাম। তখন বেলা প্রায় তিনটে। সদর দরজায় গাড়ি থামতেই, সম্মুখে দেখলাম, ভটচায মশায়ের সুদীর্ঘ একটা নাসিকা। পাঁজি-পুথি বগলে নিয়ে তিনি বেরিয়ে আসছেন। তিনি প্রশ্ন করলেন— এটি চক্রবাক, না চক্রবাকী? উত্তর দিলাম— ঠিক জানা নেই। আপনি স্বয়ং পরীক্ষা করে দেখুন। অর্ধহস্ত পরিমিত জিহ্বা কর্তন করে গম্ভীর হয়ে তিনি বললেন— আহা, শ্রীকৃষ্ণের জীব। বাঘ-শুয়োর ছেড়ে শেষকালে কিনা নিরীহ পক্ষী শিকার? আমি বললাম— আর কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দেবেন না পণ্ডিতমশাই।
এইজন্যেই মনটা ভালো নেই। আমি যখন উপরে উঠে আসি, তখনই শুনলাম— কয়েকজন ভদ্রলোক কলিকাতা থেকে শিকার করতে এসেছেন। উপরে আমার বৈঠকখানায় গিয়ে দেখি, 'অমৃতবাজার পত্রিকা'র সম্পাদক শ্রীতুষারকান্তি ঘোষ এবং তাঁর সঙ্গে দু-তিনজন ভদ্রলোক। প্রাণচঞ্চল তুষারকান্তি আমাকে দেখেই চেঁচিয়ে উঠল— এই যে ধীরেন-দা, অ্যাঁ— তোমার এসব কী ব্যাপার? বলে দু-পা এগিয়ে এসেই আবার পিছিয়ে গেল। আমিও ছুটে গিয়ে এই অবস্থায় তাকে আলিঙ্গন করবার লোভটুকু সামলাতে পারলাম না। তার ধপধপে সাদা পাঞ্জাবিটা কর্দমাক্ত হয়ে গেল। তাকে জড়িয়ে ধরে বললাম— তুমি এমনি মাহেন্দ্রক্ষণে এসে পড়েছ, এ অবস্থায় হয়তো আর জীবনে এমনি করে তোমায় কখনো কাছে পাব না। সকলেই বিকট হাস্যে ঘরটাকে যেন ফাটিয়ে দিলে। আমি ওই ঘরে একটা প্রকাণ্ড আরশির সামনে দাঁড়িয়ে নিজের অপরূপ মূর্তিটা ভালো করে দেখে নিলাম। অজ্ঞাতে মুখ থেকে বেরিয়ে এল— কী সুন্দর, কী বীভৎস!

তুষার বললে, এক্ষুনি শিকারে যাব। আমি বললাম— সে কী হে? এই এলে— একটু জিরোও— দম নাও— তারপর কাল ভোররাত্রে আবার বেরুনো যাবে। সেকথা কে শোনে? তাই আশেপাশে শিকারের জন্যে সব ঠিক করে তাদের মোটরে উঠিয়ে আমি একটি লোককে তাদের সঙ্গে দিলাম। গায়ে আমার এঁটেল মাটি— একবার লাগলে আর সহজে ছাড়তে চায় না, তারপর শুকিয়ে উঠেছে— তাই স্নানের ঘরে ঢুকে পড়লাম ঘণ্টা দুই কাদার সঙ্গে যুদ্ধ করতে। সন্ধ্যা হয়ে এল; স্নানান্তে নবজীবন লাভ করে বৈঠকখানায় গিয়ে, তুষারদের অপেক্ষায় আছি, এমন সময় সে কতকগুলো ঘুঘু ফতাকা, হরিতাল মেরে হইহই করে সদলবলে ফিরে এল। আমার তখন শরীর ভীষণ ক্লান্ত। পরদিন ভোররাত্রে শিকারে বের হবার সব ব্যবস্থা করে, নৈশভোজনান্তে আমরা তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লাম। অবশ্য মাথার কাছে অ্যালার্ম দেওয়া ছোটো ঘড়িটা রাখতে ভুল করিনি।
পরদিন অতি প্রত্যুষে উঠে দেখি, গায়ে অসহ্য ব্যথা— তাহলেও তুষার আর তার সঙ্গীদের ডেকে তুললাম— সবাই প্রাতঃকৃত্যাদি সেরে নিল। তারপর সাজ সাজ রব।
আমরা দু-খানা মোটরে, কয়েকটি বন্দুক আর টোটা নিয়ে পদ্মার দিকে রওনা হলাম। তুষারকে বললাম— বাইরে তোমার বন্ধু তুষারের বড়ো অত্যাচার—হাত-পাগুলো যেন হিম হয়ে আসছে! সে হেসে বলল— কুছ পরোয়া নেই— শিকার পেলেই আবার গরম হয়ে উঠবে। চা পান ও খাবারের আয়োজন নৌকোতেই ছিল— আমরা সূর্যোদয়ের পূর্বেই সেগুলির সদব্যবহার করলাম। দুজন শিকারি দুই নৌকোয় চেপে বসে বিভিন্ন দিকে যাত্রা করল। আমি আর তুষার এক নৌকোয় গেলাম— আমাদের সঙ্গে আর একটি ভদ্রলোকও উঠলেন— তাঁর নাম সূর্যবাবু। সূর্যোদয়ের ঠিক পূর্বেই নৌকো ভাসিয়ে দিলাম। খাবারের নৌকোকেও আমাদের পিছনে আসতে বলা হল। কিছুদূর অগ্রসর হতেই সূর্যদেব দুলতে দুলতে উঠতে শুরু করলেন। আমি সূর্যবাবুকে বললাম— ওই দেখুন, আপনার মিতে আপনাকেই বুঝি উঁকি মেরে দেখছেন। তারপর তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম— আপনি আর কোথাও শিকার-টিকার করেছেন? তদুত্তরে কিঞ্চিৎ কেশে গলাটা পরিষ্কার করে নিয়ে তিনি উত্তর দিলেন— না মশায়, ওসব বিদ্যে-টিদ্যেও আমার নেই, তবে শিকার দেখতে আমার খুব ভালো লাগে। আর তার চাইতেও ভালো লাগে সেটা খেতে। আর সেই উদ্দেশ্যেই আমার এখানে আগমন। বলে তিনি কোঁত করে একটা ঢোঁক গিলে ফেললেন। যাই হোক, আবার সেই বিভিন্ন পাখির কলরবের মধ্যে এসে পড়লাম— আমার মনে হল, কালকের সেই বিরহী চকার ক্রন্দন এখনও যেন আকাশে-বাতাসে ছড়িয়ে আছে! আমি আনমনা হতেই আমাকে ঠেলা দিয়ে তুষার বললে— দেখুন, দেখুন দাদা, ওই চরে কত হাঁস, কত চকা, কত নাড়োল!— কতকগুলি অস্ফুট অব্যয় শব্দ ব্যবহার করে নৌকোর এধার থেকে ওধার পর্যন্ত লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে সে অস্থির হয়ে উঠল। তুষারের দৃষ্টি সম্মুখে আবার সূর্যবাবুর দৃষ্টির পশ্চাতে। কারণ তিনি মাঝে মাঝে বলে উঠছেন— খাবারের নৌকোটা ঠিক আসছে তো? তুষারের দিকে ফিরে বললাম— ধীরে, বন্ধু ধীরে, এত ব্যস্ত হলে পদ্মায় শিকার করা অসম্ভব! আমি সেকথায় উত্তর না দিয়ে তুষারকে বললাম— দেখ ভাই, আমায় প্রথম shot করতে দাও। সে রাজি হয়ে বলল— তাই হোক ধীরেনদা, তাই করো— তোমার শিকারের অনেক গল্পই শুনেছি। এবার চাক্ষুষ দেখা যাক!
আবার সেই কালকের চর। দেখেই মাথায় একটা দুষ্টবুদ্ধি খেলে গেল— তুষারকে একবার সেই পাঁকের মধ্যে ডুবিয়ে দি! কিন্তু ভাবলাম, টেনে তুলবে কে? বেচারা বড়ো ভালোমানুষ— সহজ, সরল, ঘোরপ্যাঁচের মধ্যে নেই— তাকে আমার বড়ো ভালো লাগে— তারপরেও সে আমার অতিথি। তুষার আমার ভাবান্তর লক্ষ করে বলল— তুমি হেসে উঠলে যে? আমি বললাম— ও কিছু না। বালিহাঁসগুলো কালকের মতো চরের মাঝে না বসে ঠিক জলের ধারেই বসেছে— এই যা সুবিধে। পাল্লার মধ্যে আসতেই আমার বন্দুক গর্জে উঠল— গুড়ুম, গুড়ুম! —কিন্তু একটাও হাঁস পড়ল না। প্রতিধ্বনি ব্যঙ্গ করে ফিরে এল— গুড়ুম, গুড়ুম! তুষার আমার দিকে চাইল— তার দৃষ্টি তীক্ষ্ন— সে-চাউনির অর্থ— বাঃ, চমৎকার শিকারি বটে! সূর্যবাবু আমায় বললেন— ছাড়ান দিন— গুলি লাগুক-না-লাগুক, ক্ষতিবৃদ্ধি নেই। এই বলেই তিনি পিছনের নৌকোকে আমাদের নৌকোর কাছে আসতে বললেন। অন্য একদল পাখি এসে আবার সেই চরেই বসল। তুষার মারবার আগেই আমি আবার shot করলাম— এবারও চিচিং ফাঁক। কিছুই পড়ল না! তুষারের দৃষ্টি এবার তীক্ষ্নতম। এ চাউনির অর্থ, আরে ছ্যাঃ— তুমি কোনো কম্মের নও। আমি ঘোর অপ্রস্তুত— এ-রকম তো আমার কখনো হয় না— এ কি কালকের সেই চকারই অভিশাপ!
তুষার আমায় ঠেলা দিয়ে বললে—
—তোমার মনে আছে ধীরেনদা, একদিন তোমাকেই সম্বোধন করে বলেছিলাম— আজ একজন মানুষের মতো মানুষ দেখলাম? আজ আবার সেই আমি তোমাকেই বলছি, হ্যাঁ, একটা শিকারির মতো শিকারি দেখলাম।
—দু-দু-বার যখন miss করেছি, তা বলতে পার বটে— তবে এটা আমার আসল রূপ নয়, কিন্তু আমাকে মানুষের মতো মানুষ আবার দেখলে কোথায়?
তুষার একেবারে হেসে গড়িয়ে পড়ল— তারপর বলতে শুরু করে দিলে—
সেই যে মেদিনীপুরে মস্ত বড়ো একটা বিয়ের প্রীতি-সম্মেলন থেকে স্পেশ্যাল ট্রেনে আমরা ফিরছিলাম— বাংলার বড়ো বড়ো রাজন্যবর্গ, দু-একজন হোমরাচোমরা দেশনেতা, আরও বহু অ্যারিস্টোক্র্যাট ছিলেন— ফারপো-র অনুগ্রহে ট্রেনেই যাদের ঢেউ বয়ে যাচ্ছিল— সবারই আঁখিয়া লালে লাল— স্খলিত চরণের কত না বিচিত্র ভঙ্গি— মুখে খিস্তির ফোয়ারা বস্তিকেও হার মানিয়ে দেয়। সপ্তরথী মিলে তোমাকে অভিমন্যু বধের চেষ্টায় ছিল— তুমি কিন্তু একবিন্দুও ছুঁলে না!
—শুধু আমি নয়, তুমিও; আমি তবু সিগারেট খাই— তুমি আমার চেয়েও এক কাঠি সরেস— তাও খাও না— আবার সবারই মুখের ওপর কীরকম কড়া কড়া কথা শুনিয়ে দিয়েছিলে— খুব মনে আছে— সে কি ভোলা যায়!
—হ্যাঁ, ধীরেনদা, সেদিন তোমার আসল রূপ দেখেছিলাম— এক ধাক্কায় সবাইকে দূরে ঠেলে দিয়ে বললে— No earthly power can make me drink. সেদিন তোমার গলায় যে সুর উঠেছিল, তা এখনও আমার কানে লেগে আছে।
—হ্যাঁ, হ্যাঁ, হাওড়া স্টেশনে নেমে আমায় বুকে জাপটে ধরে তুমি ওই ধরনের কী-একটা কথা বলেছিলে বটে!
এমন সময় খাবারের নৌকোটিও আমাদের কাছে ভিড়িয়েছে। সূর্যবাবুও তখুনি তড়াক করে ওই নৌকোয় লাফিয়ে গিয়ে চপ, কাটলেট প্রভৃতির সদব্যবহারে মনোযোগ দিলেন। আমি মাঝিকে বললাম— ওই আলাতুলির চরে শিগগির নৌকো চালিয়ে নিয়ে যাও। সূর্যবাবু খাবারের ডিশ হতে মুখ না তুলেই বললেন— হ্যাঁ, তাই যাক— কোনো আপত্তি নেই, তবে আমার ভোজনটা শেষ হবার পর! তাই করা হল— তারপর আমাদের নির্দিষ্ট পথে নৌকো ছেড়ে দিলে।
নৌকো চলেছে— হঠাৎ এক ঝাঁক স্নিপেট আমাদের সম্মুখে একটা ক্ষুদ্র বালুচরে এসে বসল। তুষার লাফিয়ে উঠে 'এবার আমি মারব' বলেই বন্দুকটা বেশ বাগিয়ে ধরে জুতসই হয়ে বসল— তারপর বন্দুকটা একবার উঁচু, একবার নীচু, এপাশ-ওপাশ দেখে ভালো করে তুলে ধরল— নিশানা করা চাই তো! তারপরই গুড়ুম, গুড়ুম, গুড়ুম! একেবারে double shot, অনেকগুলো স্নিপেট তুড়ুক তুড়ুক করে লাফিয়ে উঠে শেষ হয়ে গেল। তুষারের কী চেঁচামেচি— আর কী আনন্দ! ভোজনবিলাসী সূর্যবাবু নৌকোর মধ্যে হতে কচ্ছপের মতো গলা বের করে বললেন— ওগুলো বেশ একটা আলুর মতো হবে— এখুনি ছাড়িয়ে শিককাবাব বানিয়ে খাব। তুষার কিন্তু ঘোরতর আপত্তি জানিয়ে বললে— না, আজকের সব শিকার কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হবে। অগত্যা ভদ্রলোকটি আবার একটি ছোটো ঢোঁক গিলে চুপ করে রইলেন।
মাঝি স্নিপেটগুলো কুড়িয়ে আনবার পর, আমাদের নৌকো আবার চলতে লাগল। পথে আমার আর তুষারের মধ্যে সবরকমের আলোচনার দানা বেশ জমাট বেঁধে উঠল— কাব্য, গল্প, উপন্যাস, নাটক, দর্শন, রাজনীতি— কিছুই বাদ পড়ল না। সব কিছুরই চচ্চড়ি বানিয়ে আমরা পূর্ণচ্ছেদ টানলাম। সূর্যবাবু পেটে হাত বুলিয়ে বললেন— আমার এ নৌকোয় থাকা আর পোষাবে না। ওই খাবারের নৌকোয় আমায় চাপিয়ে দিন। আমিও একটি ছোট্ট কেয়াবাত বলে তাঁকে পিছনের নৌকোয় উঠিয়ে দিলাম। একটু পরেই আলাতুলির চরে পদ্মার জলেই আমাদের নৌকোও এসে খস করে থেমে গেল!
দূরে ওই ধূসর বালুস্তূপ যেন মূর্ছিত হয়ে পড়ে আছে। তারই আশেপাশে অজস্র বালিহাঁস, চকাচকি আর নানান জাতীয় পাখি দেখে তুষারের আনন্দে হার্টফেল হয়ে যাবার জোগাড়। তার ভাবটা যেন, এক আওয়াজেই সে সব পাখিগুলোকে মেরে কুড়িয়ে আনবে। আমারও হাত নিশপিশ করছে। আমার ভাবগতিক দেখে সে আগেই বলে উঠল— 'না, ধীরেনদা, এবারটি তা আর হতে দিচ্ছি না।' 'তবে তাই হোক— নেমে যাও। আর দেখ, ওই যে রাখাল ছোড়াটা গোরু চরাচ্ছে, ওই ওকে আর গোরুটাকেও সঙ্গে নিয়ো— আর ওর মাথলটা তোমার মাথায় দিয়ে খুব সাবধানে এগিয়ে যেয়ো, বুঝলে!' 'সে আর বলতে হবে কেন? দেখ না, কী করি'— বলেই সে লাফিয়ে পদ্মায় নামল। সেখানে একটু বেশি জল— তার বুক পর্যন্ত ভিজে গেল। কিন্তু ঊর্ধ্ববাহু হয়ে সে বন্দুকটি উঁচু করেই ধরে রেখেছে। আমি সহাস্যে বললাম— হ্যাঁ, দেখলাম বটে প্রথম নমুনা— তুমি কী কর! এখন লক্ষ্মী ছেলেটির মতো উঠে এসে দিকি! সেকথায় কর্ণপাত না করে তাড়াতাড়ি সে তীরে উঠল— আর ভিজে বিড়ালটির মতো পাখিগুলির দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইল। হ্যাঁ, একাগ্রতা বটে! অস্ত্রশিক্ষার সময় দ্রোণাচার্য যেমন তাঁর শিষ্য অর্জুনকে জিজ্ঞাসা করলেন— তুমি কী দেখছ? অর্জুন উত্তর দিয়েছিলেন, শুধু ওই পাখির চোখ ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাচ্ছি না, গুরুদেব। গুরু তখন অনুমতি দিলেন, লক্ষ্য বিদ্ধ করো। আজ্ঞার সঙ্গেসঙ্গেই অর্জুন পাখিটার চক্ষু বিদ্ধ করে ভূতলশায়ী করলেন! দুর্ভাগ্যবশত যদিও আজ আমি নিজেই দু-বার ব্যর্থ হয়েছি, তবুও গুরুর মতোই তাকে আদেশ দিলাম— এগিয়ে যাও— ঠিক পারবে। মাঝিও টোটার ব্যাগ ঘাড়ে করে তার সঙ্গে যেতে লাগল।
এদিকে পিছনে তাকিয়ে দেখি, আমাদের সূর্যবাবু তখনও খুব নিবিষ্টচিত্তে ভোজন করে চলেছেন— তাতে কমা নেই, কোলন নেই, ফুলস্টপ নেই— তুষারের জলে পড়াটাও তিনি দেখতে পাননি! যদি পৃথিবীতে প্রলয় হয়ে যায়, তাহলেও হয়তো তিনি টের পাবেন না! এও আর এক রকমের একাগ্রতা! আবার ওদিকে তুষারও চলেছে রাখাল আর গোরুটিকে সঙ্গে নিয়ে। একবার উঠছে আবার হামাগুড়ি দিচ্ছে। হঠাৎ সে বসে পড়ল। আমি দেখলাম, একটা দলছাড়া চকা একা একদিকে বসে আছে; কালকের সেই বিরহী চকা কিনা কে জানে! তুষার যে পাখির ঝাঁকের দিকে অগ্রসর না হয়ে বুদ্ধিমানের মতো সেই একটা চকার দিকেই এগিয়ে গেল, এতে তার শিকার চাতুর্যেরই পরিচয় পেলাম। কারণ, পাখির দঙ্গলের মধ্যে চেষ্টা করতে গেলে, যদি একটা পাখি ওড়ে, তবে আর তাদের কাউকেই পাওয়া যাবে না। তুষার বেশ তাক করে আওয়াজ করার সঙ্গেসঙ্গেই সেই চকার নিঃসঙ্গ জীবনটাও শেষ হয়ে গেল। চিরকল্লোলময় তুষার বন্দুক উঁচু করে নৃত্য জুড়ে দিয়েছে; তার আনন্দ দেখে মনে হল, এ-রকম শিকার তার ভাগ্যে বুঝি এই প্রথম। তার উচ্ছল প্রাণশক্তি দেখে আমার সত্যিই খুব ভালো লাগল। তারপর ওই পাখিটাকে কুড়িয়ে আনার জন্য তুষার একটা লম্বা দৌড় দিতেই একবার ডিগবাজি খেল, কিন্তু উঠেই আবার ছুটল। চকাটি নিয়ে ফিরে আসবার সময় তার ভাবটা এই, যেন যুদ্ধে জয়লাভ করে ফিরে আসছে। তার প্রতি পদক্ষেপে ফুটে উঠছে একটা দৃপ্ত ভঙ্গিমা। নৌকোয় উঠে তার মুখে যেন তুবড়ি ছুটতে লাগল, আর তার সঙ্গে কী প্রাণখোলা হাসি! এমন সময় এক ঝাঁক 'টিল' সামনে উড়ে আসতেই তুষারের উপর্যুপরি দুই নলের আওয়াজে চার পাঁচটা পাখি পদ্মার বুকে ঝুপঝাপ করে পড়ে গেল— তার সেদিনকার অব্যর্থ সন্ধান দেখে চমৎকৃত হলাম।
আমার তখন পেটে আগুন জ্বলছে, বেলা প্রায় দুটো। আমি বললাম— এসো, খেয়ে নেওয়া যাক। বলেই পেছনের নৌকোর দিকে ফিরে গেলাম। তখনও তুষারের প্রচণ্ড বক্তৃতা অনর্গল বয়ে চলেছে। ওই নৌকোয় গিয়ে দেখি সূর্যবাবু কুম্ভকর্ণের মতো নাসিকা গর্জন করে নিদ্রা যাচ্ছেন। তাড়াতাড়ি বড়ো টিফিন-ক্যারিয়ারটি এনে খুলে দেখলাম, সেটা একেবারে শূন্য। তুষারের বক্তৃতাও হঠাৎ থেমে গেল। তারপর—
তারপর আর কী? আমরা নীরবে পরস্পরের দিকে বুদ্ধিমানের মতো চেয়ে রইলাম!
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর তুষার বললে— এতগুলো খাবার হল কী? শুষ্ককণ্ঠে উত্তর দিলাম— সূর্যবাবুর পেট চিরে দেখো না কী হল।
আমরা ক্ষুধাতুর দুটি প্রাণী, পিছনে সেই মোটা বেঁটে ভদ্রলোকটি ভুঁড়ি খুলে নিদ্রা যাচ্ছেন।
আমাদের নৌকো আবার চলতে থাকে। তুষারের এত স্ফূর্তি যে কোথায় নিবে গেল, তার পাত্তাই নেই। অবশ্য তার সঙ্গে আমারও। তবে এইটুকুই পার্থক্য যে আজ আমি কিছুই শিকার পাইনি।
আমাদের অবস্থা দেখে বোধহয় মাঝিদের দয়া হল। তারা বললে— আমাদের চিঁড়ে-মুড়ি আছে হুজুর, দেব কি? আর কয়েকটা ডিমও আছে, হুকুম দেন তো সিদ্ধ করে দেই।
আমি বললাম— আজ আমার যে কপাল— দেখো আবার যেন সব ঘোড়ার ডিম না হয়ে যায়! আমার কথা লুফে নিয়ে তুষার বলে উঠল— দাও, দাও, তাই দাও! চিঁড়ে-মুড়ি নিয়ে নুন-তেল মেখে সবেমাত্র মুখে দিয়েছি, সূর্যবাবু জেগে উঠে তাঁর তেল-চুকচুকে প্রকাণ্ড টাকখানা বের করে বললেন— আপনাদের নৌকোয় যাব কি?
তুষার সেকথায় উত্তর না দিয়ে একবার শুধু ভ্রূভঙ্গি করে তার দিকে চাইল। তারপরেই মাঝিকে জোরে নৌকো চালিয়ে নিয়ে যেতে বললে।
ইতিমধ্যে অপর দুটি নৌকোও ফিরে এল। মাঝ-পদ্মায় আমরা সবাই মিলিত হতেই তুষার দূর হতে জিজ্ঞেসা করলে— তোমাদের শিকার-টিকার কিছু হল? তাদের মুখ বিবর্ণ— উত্তর এল কিস্সু হয়নি— পদ্মায় আবার কোনো ভদ্রলোক শিকার করতে আসে? আরে ছ্যাঃ!
তুষার সেকথা শুনতে পেয়েছিল কি না বোঝা গেল না, তবে খুব আগ্রহের সঙ্গে বললে— তোমাদের নৌকোয় কিছু খাবার-টাবার আছে?
তারা উত্তর দিলে— আমাদের খেয়েদেয়েও যথেষ্ট বেঁচে গেছে— মানুষ কি এত খেতে পারে?
—'পারে বই কী' বলে একবার পশ্চাতে চাইলাম— দেখি সূর্যবাবুর নৌকো অনেকটা পিছনে পড়ে আছে— তাই তাঁর অজ্ঞাতে আমরা দুজনে তাড়াতাড়ি আহার শেষ করে নিলাম। তুষার মৌনব্রত ভঙ্গ করে আবার মুখর হয়ে উঠল। আমাকে দেখিয়ে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ প্রদর্শন করে সে তার বন্ধুদের বললে— আজ ধীরেনদাও কিস্সু মারতে পারেনি। বলার সময় তার সুন্দর করে ছাঁটা গোঁফের আড়ালে যে একটা চাপাহাসি লুকিয়ে ছিল, সেটাও বেশ লক্ষ করলাম। আমি নীরব— দৃষ্টি ব্যথাতুর। ভগবান বুঝি আমার অন্তরের ব্যথা টের পেয়ে এক ঝাঁক হাঁস আমার মাথার উপর পাঠিয়ে দিলেন।
তুষার বা অন্য কেউ তা লক্ষ করেনি। হাঁসগুলো যদিও দূরে— তবু পাল্লার মধ্যে আসতেই, আমি এঁটো হাতেই ভরা বন্দুকটা তুলে fly shot করলাম। একটা সুবৃহৎ বন্য রাজহাঁস উলটেপালটে ঝপাৎ করে পদ্মার বুকে পড়ল। তুষারকে বললাম— আর একবার আমার দিকে আগের মতো একটা কটাক্ষ দৃষ্টিনিক্ষেপ করো তো বন্ধু! তুষার তখন লাফিয়ে উঠে আবার কী চিৎকারই শুরু করে দিয়েছে— তার কী আনন্দ!
হাঁসটা পড়েছিল সূর্যবাবুর নৌকোর ঠিক সামনেই। তিনি জল থেকে পাখিটা তাড়াতাড়ি তুলে হাতে করে ওজন নিচ্ছিলেন। তাঁর কাছে আসতেই তিনি সাড়ে বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে বললেন— সের আড়াইটাক ওজন হবে নিশ্চয়, কি বলেন? বলে কোঁত করে একটা ঢোঁক গিললেন।
তুষার তাড়াতাড়ি হাত বাড়িয়ে বললে— সেটা বাড়ি গিয়ে ওজন করব— এখন দাও তো পাখিটা।
সূর্যবাবু দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করে হাঁসটা তাঁর হাতে তুলে দিলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে তিনিও আমাদের নৌকোয় চেপে বসেই বললেন— নৌকোভ্রমণ স্বাস্থ্যের পক্ষে খুবই ভালো, ঘন ঘন খিদে পায়— হেঁঃ, হেঁঃ, হেঁঃ। খাবারটাবার কিছু আছে নাকি?
তুষার ওইসব খালি বাসনপত্রের দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বললে— ওই দেখতেই পাচ্ছ তো— কিছুই নেই। বলেই মাথাটা এগিয়ে দিলে— তবে আমার এই মস্তকটাই আছে— চর্বণ করো।
আমাদের সকলের দম-ফাটা হাসি পদ্মার বুকে উথলে উঠে আবার পদ্মার বুকেই মিলিয়ে গেল।
সূর্যবাবু কিন্তু সপ্রতিভ; স্নিপেটগুলো ভালো করে গুনে দেখলেন— মোট উনপঞ্চাশটি।
আমাদের মধ্যে কে যেন টিপ্পনী কাটলেন— এবার সূর্যবাবুকে ফট্টিনাইনে পেয়েছে। তাতেও তাঁর মুখে কোনো ছাপ পড়তে দেখা গেল না!
হয়তো তিনি তখন শিককাবাবের চিন্তায় মশগুল।
তারপর—
এর পরেও আবার তারপর কী? আমরা হইহই করে বাড়ি ফিরে, স্নান সেরে কাপড়-জামা বদলে নিলাম।
তুষারের প্রাণে আজ স্ফূর্তির জোয়ার। তার নিজের হাসির তুফানে সে নিজেই হাবুডুবু খাচ্ছে। হারমোনিয়াম খুলে আলিবাবার সব গানগুলো এক এক করে সে গেয়ে যেতে লাগল, আর আমিও তবলায় চাঁটি দিয়ে বোল উড়িয়ে চললাম।
আসর ভরপুর। এদিকে কিন্তু সূর্যবাবুর পেটে আবার দ্বাদশ সূর্যের উদয়। তিনি গানের মজলিশ ত্যাগ করে সটান উঠে গিয়ে বেয়ারাকে বললেন,— 'শিগগির আমার খাবার আনো।'
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন