শিকারের সন্ধানে

বিশ্বদেব গঙ্গোপাধ্যায়

প্রবোধকুমার সান্যাল

 

কাহুভাগ জঙ্গলের খ্যাতি বিহারে কম নয়। গয়া জেলার মধ্যে যে জঙ্গলগুলি বিশেষ খ্যাতিসম্পন্ন— যথা, রজৌলি, একতারা, জনকপুর— কাহুভাগ এদেরই একটি। বিশাল পর্বত, গহন আরণ্য, দুর্গম গুহা, লোকালয়হীন পার্বত্য উপত্যকা, বালুবহুল উপলখণ্ডময় জলধারা, এদেরই ভিতরে ভিতরে ব্যাঘ্র, ভাল্লুক, প্যান্থার, লেপার্ড, হরিণ, শম্বর প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। এই অরণ্যের ব্যাস ও দৈর্ঘ্য নির্ভুল হিসাব করা কঠিন— শোনা যায়, দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে শত শত মাইল। যাঁরা এ সম্বন্ধে আলোচনা করেন তাঁদের মধ্যে অনেকেরই ধারণা, সমগ্র ভারতবর্ষের প্রত্যেকটি অরণ্য প্রত্যেকটির সঙ্গে সংযোগ-সূত্রে গ্রথিত। অর্থাৎ দণ্ডকারণ্যের সঙ্গে শ্রীহট্টের যোগাযোগ, সুন্দরবনের সঙ্গে নৈমিষারণ্যের। আমারও মনে হয় কথাটার সঙ্গে সত্যের ছোঁয়াচ আছে। ভারতবর্ষ অরণ্যময় দেশ এতে আর সন্দেহ নেই, মাঝে মাঝে প্রান্তর আর জনপদ, মাঝে মাঝে নদী ও পর্বতের ব্যবধান। এর জন্যে অরণ্যগুলির ভিতরেই কেবল আত্মীয়বিচ্ছেদ ঘটেনি, মানুষের সঙ্গে মানুষের ভাগও হয়েছে— অর্থাৎ কেউ দক্ষিণী, কেউ গুজরাটি, কেউ বর্মি, কেউ-বা বাঙালি। বিহারে দেখেছি অরণ্যে অরণ্যে আত্মীয়তা। পালামৌ, হাজারিবাগ, কোডার্মা, গোমো, নিমিয়াঘাট, পরেশনাথ, রাজগৃহ, গয়া— রাষ্ট্রিক ব্যবধান ছাড়া এদের মধ্যে আর কোনো কথা নেই। দেওয়ানি মামলায় হাকিমের নির্দেশ মেনে নিয়ে ভাই ভাই যেন ঠাঁই ঠাঁই হয়ে গেছে; বিহারের অরণ্যগুলির ভিতরে আবহাওয়ার ঐক্য সহজেই বোঝা যায়— জল, বাতাস সাধারণ স্বাস্থ্য, মৃত্তিকার শুষ্কতা, মশা ও ম্যালেরিয়ার স্বল্পতা, পরিপাকশক্তি বৃদ্ধি, —অনেকের বিশ্বাস বর্মা ও সুন্দরবনের তুলনায় বিহার অনেকাংশে নিরাপদ— স্বাস্থ্যের দিক থেকে।

বিস্তৃত নদীবহুল অরণ্যে শিকারিদের অসুবিধা আছে। জানোয়ার সেখানে নির্লিপ্তভাবে বাস করে, পলি পড়া মৃত্তিকায় সাপের উৎপাত হয় প্রচুর, বিপদের সম্ভাবনা বেশি। সেইজন্য সুন্দরবনে আত্মরক্ষার সমস্যাটা বড়ো। শুষ্কমৃত্তিকায় দুর্ভোগ কম। বালুময় নদী, জল আছে কিন্তু কাদা কম। বিহারের জঙ্গলগুলি সেইজন্য যশোহর, খুলনা ও বরিশালের দক্ষিণভাগ অপেক্ষা কিছু 'ভদ্র'।

আমি শিকারি নই, যাঁরা আমার সঙ্গী, তাঁরাও নামকরা শিকারি কেউ নন। তাঁদের সব আছে, কিন্তু সাধ্য কতখানি তা আজও জানা যায়নি। বাঘ তাঁরা আজও মারেননি, সুতরাং এখনও তাঁরা 'আইবুড়ো'। শখ, একাগ্রতা, দুঃসাহস, কর্মশক্তি ও উৎসাহ আমাদের এই মহাদুর্গমে টেনে এনেছে।

কাহুভাগের অন্ধকার জঙ্গলে কণ্টাকাকীর্ণ ক্ষতবিক্ষত পথে যখন নামলাম রাত তখন অনেক। শীতে আড়ষ্ট, ভয়ে ভারাক্রান্ত, কৌতূহলে উৎকর্ণ— প্রথমেই লাঠিটা শক্ত করে ধরলাম। আমরা মাত্র পাঁচটি প্রাণী। হীরালালদার হাতে বন্দুক, নগেনবাবুর কাঁধে রাইফেল, ইমাম আলির কাছে স্পটলাইট, জংলির মাথায় ইলেকট্রিক মিটার। সকলের পিছনে আমি, আমার বাঁ-হাতে টর্চ। আমাদের মোটর অন্ধকারে এক জায়গায় ভূতের মতো দাঁড়িয়ে রইল। তেওয়ারি রইল গাড়ির জিম্মায়।

আমাদের প্রথম বিস্ময় জাগল মানুষের গন্ধ পেয়ে। এই গহন অরণ্যে মানুষ! কিন্তু বিস্ময় কেন? এস্কিমোরা মানুষ, পশ্চিম আফ্রিকার নরখাদকরা মানুষ, নরমুণ্ডলোভী ফ্যাসিস্টরাও মানুষ— তবে এই শ্বাপদ-সংকুল অরণ্যে মানুষ থাকবে না কেন? কিছুদূর অন্ধকারে অগ্রসর হয়ে দেখা গেল, কয়েক ঘর দেহাতির বাস। তারা দিনের বেলা চাষ করে, গৃহপালিত পশু বিক্রি করে, কিন্তু সূর্যাস্তের পর আর তাদের সাড়াশব্দ থাকে না। অনেকেই মাঝে মাঝে জানোয়ারের হাতে প্রাণ দেয়, অনেকে আবার বর্শা, বল্লম, টাঙ্গি প্রভৃতি অস্ত্রের দ্বারা জানোয়ারও বধ করে। রাত্রে যদিই-বা তারা ঘরের বার হয়, দল বেঁধে যায় হল্লা করতে করতে। শিকারি কোথাও এসেছে সন্ধান পেলে তারা সাগ্রহে সাহায্য করতে ছুটে আসে বকশিশের লোভে। একজনের ঘরের দরজায় এক প্রকাণ্ড শম্বর বাঁধা রয়েছে দেখা গেল। শম্বর হরিণেরই মাসতুতো ভাই— নিরীহ জীব, মারতে জানে না, মরতে পারে সহজে। ভারতবাসীর সঙ্গে ওদের প্রকৃতিগত ঐক্য। আমাদের দেখে কয়েকজন এসে দাঁড়াল, তারা আমাদের সঙ্গী হবে। আমরা কেউ কারো মুখ দেখতে পাচ্ছিনে, যেন পরস্পর সকলেই বিচ্ছিন্ন, কেউ কারুকে চিনিনে। উপরে, নীচে, বামে, দক্ষিণে অন্ধকারের পর অন্ধকারের দুর্ভেদ্য প্রাচীর, সেই প্রাচীর ভিতরে ও বাহিরে একাকার, নিরাকার। আমরা সবাই এক শ্রেণিভুক্ত— কৃষ্ণকায় প্রেতের দল। হীরালালদা মিলিয়ে গেলেন জংলিদের মধ্যে, নগেনবাবু আর ইমাম আলির পার্থক্য গেল ঘুচে, আমার সঙ্গে বৃক্ষজটার প্রভেদ রইল না। যে আত্মীয়তা ছিল লোকালয়ে দিবালোকে, এই দুর্ভেদ্য ষড়যন্ত্র, শঙ্কা ও সন্দেহে অবসন্ন প্রতি পদলেহন— কিন্তু উৎসাহে উল্লসিত প্রাণ, দুঃসাহসে দুর্জয় মন। আপন প্রাণচেতনা তখন স্পর্শ করতে পারি, নিবিড় করে অনুভব করতে পারি আপন অস্তিত্বকে— প্রতি রোমে রোমে প্রথম পুলক রোমাঞ্চ হয়ে উঠেছে।

অরণ্যের আকাশ সংকীর্ণ, তবু মাঝে মাঝে চোখে পড়ছে উজ্জ্বল নক্ষত্রদল। শাখায়-প্রশাখায়, লতায়-পাতায় শীতের তীব্র শীর্ণ বায়ু মর্মর শব্দে বয়ে চলেছে। চারিদিক অদ্ভুতভাবে নিস্তব্ধ। সেই স্তব্ধতা গভীরতর হয়, যখন শোনা যায় পক্ষীশাবকের মৃদু আর্তনাদ, কীটপতঙ্গের কাতরানি, কোনো জানোয়ারের বিচিত্র অস্পষ্ট কণ্ঠ। আকাশের তারার আলোয় হাতড়ে হাতড়ে চলেছি, কোনোদিকে কিছুই দেখছিনে— কিন্তু জানি, আমাদের পথের দুইপাশে অরণ্যে ঐশ্বর্যের সমারোহ।

শুক্লপক্ষের রাত্রে শিকারিদের গতিবিধির অসুবিধা। অরণ্যের মর্মে মর্মে যখন জ্যোৎস্না প্রবেশ করে, শিকারিকে তখন নিষ্ক্রিয়ভাবে মাচার উপর বসে থাকতে হবে। জানোয়ারের কান ভয়ানক উৎকর্ণ, চক্ষু তাদের সন্দেহে সজাগ। মানুষ নামক নূতন কোনো জানোয়ারের আবির্ভাব যদি অনুভব করে, তবে হামাগুড়ি দিয়ে তারা গা-ঢাকা দেয়। জ্যোৎস্নালোকে তাই মানুষকে তারা অতি সহজেই আবিষ্কার করে ফেলে। কলিকাতা শহরের রাজপথে একটিমাত্র বাঘ দেখা গেলে যেমন সমগ্র শহরে চাঞ্চল্য জাগে, তেমনি অরণ্যে কোথাও মানুষের আবির্ভাব ঘটলে জানোয়ারগণের মধ্যে তেমনি চলে আন্দোলন। কেউ ঘোষণা করে দেয় গর্জনে, কেউ শব্দে, ছুটোছুটিতে। ঘ্রাণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি, অনুভবশক্তি মানুষের অপেক্ষা তাদের অনেক বেশি। আত্মীয়তার আয়োজন তাদের অসামান্য। ব্যাঘ্রের চাতুর্য ও কুশাগ্রবুদ্ধি সর্বজনবিদিত। তবু তারা যখন প্রাণ দেয়, তখন বুঝতে হবে মানুষ তার অসতর্ক মুহূর্তের সুবিধা নিয়েছে। রাজরাজড়া, লাটবেলাট যখন বাঘ মারে, তখন তাদের প্রশংসা ও ছবি ছাপা হয় কাগজে কাগজে : কিন্তু শিকারিমাত্রই জানে এই হত্যাকাণ্ডে পৌরুষ নেই। প্রথমত, এইসব শিকারে শত শত লোক লাগিয়ে জঙ্গলকে চারিদিক থেকে ঘেরাও করে 'বিট' করা হয়; একদিকের পথ খোলা থাকে, সেই পথের উঁচু মাচার উপর বসে থাকেন নাড়ুগোপাল রাজকুমার; বাঘ যখন সেই পথ দিয়ে পালায় তখন ভালো একজন শিকারি তাকে প্রথম গুলি করে। বহু নামজাদা শিকারি আমার চেয়েও ভীতু— আমার চেয়েও দুর্বলদেহ। তারা শখের তৃপ্তির জন্য অরণ্যে যায়, সাহসের পরিচয় দিতে যায় না। একশত শিকারির ভিতরে একজনকে হয়তো পাওয়া যায়, যে প্রতিভাবান— জানোয়ারের গতিবিধি, রীতিনীতি ও মনস্তত্ত্বের সঙ্গে যার পরিচয় আছে, যার আছে দুর্লভ সাহস, অজেয় প্রাণ, অসীম শক্তি ও বলিষ্ঠ স্নায়ুমণ্ডলী। সমগ্র ভারতবর্ষের শিকারিদের ইতিহাসে এইরূপ একজনমাত্র শিকারিকে দেখা গেছে, আমরা বাঙালিরা তাঁর জন্য গর্বিত, তিনি স্বর্গীয় কে. এন. চৌধুরী। অনেকেই জানে, চৌধুরী মহাশয় কখনো অসতর্ক জানোয়ার বধ করেননি। বৃহৎ লেপার্ড, ভীষণ রয়াল বেঙ্গল— এদের তিনি পাঞ্জা পাঠাতেন, আহ্বান করতেন সম্মুখ সমরে, সেই ভয়াল ক্রুদ্ধ ব্যাঘ্র যখন চৌধুরী মহাশয়কে আক্রমণ করত, তখন তিনি তাকে বধ করতেন। এই বধ করার কাজ বড়ো কঠিন, কারণ প্রায়ই এক গুলিতে তারা মরে না। উদরে, পায়ে, পাছায়, এই সমস্ত স্থানগুলি বাদ দিতে হবে, কারণ এইসব স্থানে গুলি লাগলে বাঘ মরে না; মারতে হবে বুকে, শিরদাঁড়ায়, হাতের উপরিভাগে, কপালে কিংবা রগে। আক্রমণশীল ক্রুদ্ধ ব্যাঘ্রের সন্ধিস্থানে অকম্পিত হাতে লক্ষ্য স্থির করা, নিজের লক্ষ্যের প্রতি বিশ্বাস, সাহসের প্রতি দৃঢ়তা, নার্ভকে অবিচল রাখা, অপরাজয়ের প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব— এই গুণগুলির জন্য কে. এন. চৌধুরী অমর হয়ে থাকবেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অরণ্যই তাঁর উপর প্রতিশোধ নিলে। তাঁর বিচারবুদ্ধিতে ঘটল মুহূর্তের ভুল। আহত মুমূর্ষু ব্যাঘ্রের চাতুরীর ফাঁদে তিনি ধরা দিলেন, কালাহান্ডির অজানা অরণ্যের গভীর গর্ভে তাঁর সেই ভুল চিরস্থায়ী হয়ে রইল। শিকারিদের জন্য একটি পরম শিক্ষা রক্তের অক্ষরে লেখা হয়ে গেল।

পথের দিশা নেই, অন্ধকার থেকে চলেছি অন্ধকারে। সকলেই আমরা অন্ধ, কিন্তু ইমাম আলির চোখ দুটো জ্বলছে দপ দপ করে। সে একজন গুণী, কারণ অন্ধকারে সে দেখতে পায়। দিনের বেলায় সে ঘুমোয়, রাত্রে জাগে। জানোয়ারেরাও তাই। রাত্রেই তারা বেশিরভাগ আহারের সন্ধানে ঘুরে বেড়ায়। ইমাম আলি শিকারের নেশায় আবাল্য উন্মত্ত। জন্তু আবিষ্কার করায় তার আনন্দ, হত্যা করায় নয়। স্পটলাইটের আলোয় জন্তুর চক্ষুকে দিশাহারা করে দিতে সমগ্র গয়া জেলায় তার জুড়ি নেই। সে বকশিশও চায় না, অনুগ্রহও চায় না, তোষামোদও করে না, বিরক্তও হয় না। ইমাম আলি অদ্ভুত মানুষ।

মাঝপাথে হীরালালদা একবার থমকে দাঁড়ালেন। কাছাকাছি পৌঁছেই কানে কানে চুপি চুপি বললেন, শুনতে পাচ্ছ?

তাঁর গলার আওয়াজে যেন অজগর সর্পের নিশ্বাস শুনলাম। মুখ তুললাম, আমার চোখের তারার ভাষায় তাঁকে প্রশ্ন করলাম। তিনি ইঙ্গিতে বললেন, দূরে অস্পষ্ট গর্জন! কাছাকাছি এসেছি। ভয় পেয়ো না, কঠিন করে হাঁটো।

তাঁর কথায় সেদিনকার ঘটনাটা মনে পড়ে গেল। এম. এ. পাশ করা একটি বাঙালির ছেলে রজৌলির জঙ্গলে এসেছিল শিকার করতে। সাহসী, বলশালী, পরিশ্রমী এক তরুণ। সঙ্গে ছিল লোকজন। তিন দিক থেকে জঙ্গল 'বিট' করা হল। ছেলেটি উঁচু মাচায় বসেছিল। এমন সময়ে সেই পথে এল বাঘ। ছেলেটির হাতে রাইফেল ছিল, বাঘ হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে গর্জন করে উঠল। কয়েকটি মুহূর্ত, তার পরেই গুড়ুম। সঙ্গেসঙ্গে জঙ্গলের ভিতরে ঝটাপট শব্দ, সম্ভবত আহত ব্যাঘ্র পালিয়ে গেছে। কিছুক্ষণ পরে সাড়াশব্দ না পেয়ে লোকজন এসে দাঁড়াল। দেখা গেল, রাইফেলটা মাচার নীচে জঙ্গলের উপর পড়ে রয়েছে, ছেলেটির আধখানা দেহ মাচার ধারে ঝুলছে! সবাই গিয়ে তাকে ধরে নামাল, সে তখন বিড় বিড় করে কী যেন বকছে! শহরে এনে হাসপাতালে পরীক্ষা করা হল— ছোকরার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। চোখের সুমুখে বন্য ব্যাঘ্রের হুংকার তার স্নায়ুতন্ত্রকে আতঙ্কে বিধ্বস্ত করে দিয়েছিল; সেই অবস্থায় তার হাত থেকে রাইফেলটা খসে গিয়ে কেমন করে না জানি আপনাআপনি আওয়াজ হয়ে যায়। বাস্তবিক ভয়ার্ত ব্যাঘ্রের অরণ্যবিদারী গর্জন কাছে থেকে বরদাস্ত করা অসামান্য শক্তিমত্তার প্রয়োজন। ভগবতীপ্রসাদের কাছে শুনেছি, হ্যালেট সাহেবেরও এই অবস্থা ঘটে; তিনি পাগল হননি বটে, তবে পঁচিশ গজ দূরে বাঘ দেখেই তাঁর পরনের হাফ প্যান্ট নষ্ট হয়ে গিয়েছিল; সেই বাঘকে হত্যা করেন পার্শ্বোপবিষ্ট ভগবতীপ্রসাদ; কিন্তু গোপন বন্দোবস্ত অনুযায়ী মিস্টার হ্যালেটের নামেই সেটা চলে গেছে!

খানিকটা অবকাশ পাওয়া গেল, অরণ্যের ঘনিষ্ঠতা এদিকে কিছু কম। কোথায় যেন মহিষ আছে, তার গলার টুং টাং শব্দ কানে আসছে। আমরা ধারালো দৃষ্টিতে অনুসন্ধান করতে করতে এগিয়ে চলেছি। কাছেই ছোটোখাটো আর একটা অড়হরের খেত পাওয়া গেল; অর্থাৎ লোকালয় আছে কাছাকাছি। চারিদিক বেষ্টন করে পার্বত্য অরণ্য, মধ্যস্থলে এই খেতখণ্ড। ছায়ার মতো আমাদের নিঃশব্দ গতি, খেতের ছায়ার জটলার ভিতরে আত্মগোপন করে চলেছি। দূরের গর্জন আর শোনা যাচ্ছে না। কালো রাত্রি দিগন্তে খাঁ খাঁ করছে।

ইমাম আলি হঠাৎ একটা ইঙ্গিত জানাল। মার্চ করা সৈন্যদের মতো আমরা সবাই মুহূর্তে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। পলকের ভিতরে রাইফেল ও বন্দুক উদগ্র! ইমাম আলি জানোয়ারের গন্ধে সজাগ হয়েছে। কোথায় জানোয়ার? কোনদিকে? কোন পথে? ইমাম আলি কি জাদুবিদ্যা জানে? অন্ধকারে কী উপায়ে সে জন্তু আবিষ্কার করে?

স্পটলাইটের মতো নির্ভুল রশ্মি গিয়ে পড়ল অড়হর খেতের মর্মস্থলে। আমার সমস্ত প্রাণ, সমস্ত রক্ত উঠে এল চোখের তারায়! দেখলাম, মাত্র কুড়ি গজ দূরে তিনটি হরিণ। অড়হরের পাতা চিবোচ্ছে। আঃ, এমন দুর্লভ দৃশ্য জীবনে দেখিনি। আলিপুরের অথবা লাহোরের চিড়িয়াখানার আধমরা হরিণ নয়, দিল্লি থেকে রাজপুতানার পথে মাঠে-চরা হরিণ নয়— অরণ্যের হরিণ, পীতাভ নীল, সর্বাঙ্গে শ্বেতচক্র, কালো চোখে কাজলের রেখা টানা, কপালের শৃঙ্গশাখা— প্রাণময়, চঞ্চল, সুন্দর! ওরা যেন অরণ্যের প্রাণমূর্তি, যেন সফল স্বপ্ন, রহস্য ও বৈচিত্র্যের ওরা জীবন্ত প্রতীক।

গুড়ুম!!

মৃত্যুর ঝলকে আন্দোলিত হয়ে উঠল আকাশের তারকার দল, অরণ্যের নিবিড় নিস্তব্ধতা, বনদেবীর সন্তানবৎসল হৃদয়! যেন বন্দুকের টোটা আর অব্যর্থ সন্ধান ভুলে উলটো পথে আমারই বুকে এসে বিঁধল। মৃত্যুর আগে নিরপরাধ হরিণ যেন আমারই কাছে করুণ কণ্ঠে তার শেষ আবেদন জানিয়ে গেল। নিশ্বাস রুদ্ধ করে সেই মুহূর্তে নিজের মনে প্রতিজ্ঞা করলাম— শিকারের জন্য আর আসব না অরণ্যে।

না, হরিণ মরেনি, কাঁচা-শিকারির লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছে! স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। টর্চের আলোয় কিছুক্ষণ রক্তের চিহ্ন খোঁজাখুঁজি করা হল, কিন্তু বৃথা, হরিণগুলো অক্ষত অবস্থাতেই পালিয়ে গেছে।

জনকপুরের জঙ্গলে প্রবেশ করেছি। পথ অতি সংকীর্ণ; অনেক দিন বোধ করি এদিকে মানুষের সমাগম হয়নি, লতাপাতা আর আগাছায় পথ বুজে গেছে। আমাদের গাড়িখানা যেন এক অদৃশ্য সুড়ঙ্গের মধ্যে নেমে এসেছে। সম্মুখে, পিছনে সমস্তই একাকার; কেবল গাড়ির হেডলাইটের আলোর আভায় পথের দুই পাশে অরণ্যের দুর্ভেদ্য প্রাচীর চলেছে। এটা বাঘের জঙ্গল— ইমাম আলি জানিয়েছে। কথাটা মিথ্যা বলে মনে হল না। আগের জঙ্গলে স্পটলাইটের আলোয় সহস্র সহস্র উজ্জ্বলন্ত মণিমাণিক্যের মতো জন্তুগণের উদ্ভ্রান্ত চক্ষু দেখেছিলাম, কিন্তু এখানে তাদের চিহ্নও নেই। এখন একটা প্রাণীহীন বিচিত্র জগৎ। কীট, পতঙ্গ, পক্ষী, সর্প, খরগোশ, শিয়াল, হরিণ— কিছুরই চিহ্ন নেই। কিছু নেই, তার কারণ এখানে বাঘের আবাস। হরিণের দল দেখলে জানা যায়, বাঘ সেদিকে থাকে না; তেমনি বাঘ থাকে যে জঙ্গলে আর কোনো জন্তু প্রবেশ করে না। বাঘ বড়ো সাম্প্রদায়িক, হিংস্র। সে মনে করে, অরণ্যটা তারই জন্য সৃষ্টি, তারই রাজ্যপাট, তারই শাসনে চলবে সব। শান্তিবাদী ভদ্র জানোয়ারের স্থান তার এলাকায় নেই। একমাত্র বানর ছাড়া আর কোনো জন্তু বাঘের জঙ্গলে পাওয়া যায়নি।

বানরের কথায় সেই গল্পটা মনে পড়ে গেল। এইদিকেই এক জঙ্গলে 'আদমখোর' (man-eater) এক বাঘের ভয়ানক উৎপাত শুরু হয়। অনেকগুলি চাষি আর জংলিকে সে হত্যা করেছে। মানুষের রক্ত ও মাংস খাবার পর আর কোনো জন্তুর প্রতি বাঘের আসক্তি থাকে না; কারণ মানুষের রক্ত ও মাংসে লবণ আছে, সেইজন্য অতি সুস্বাদু —delicious! অতীব 'আদমখোর' বড়ো ভয়ংকর। তাকে ধ্বংস করতেই হবে। যাই হোক, সেই বাঘটাকে শিকার করবার জন্য সরকার পক্ষ থেকে পাঁচশত টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হল। বড়ো বড়ো শিকারি এসে হাজির। ইব্রাহিম নামক এক বৃদ্ধ মুসলমান পথপ্রদর্শন করে একে একে প্রত্যেকটি শিকারিকে সেই জঙ্গলের ভিতরে রেখে এল। প্রত্যেকবার একজন মাত্র। কিন্তু এই পর্যন্তই, পরের দিন দেখা যায়, শিকারির ছিন্নভিন্ন দেহ রক্তাক্ত অবস্থায় ভূলুণ্ঠিত! এইভাবে পাঁচ-ছয়জন নামজাদা শিকারি প্রাণ দেয় ও বাঘের উৎপাত বাড়তে থাকে।

সরকার ঘোষণা করলেন, হাজার টাকা পুরস্কার!

তখন একজন সাহেব এলেন। ইব্রাহিমকে খবর দেওয়া হল। ইব্রাহিম এসে বললে, তোমার মতো চারজন সাহেব প্রাণ দিয়ে গেছে, হাজার টাকার লোভে কেন প্রাণ দিয়ে যাবে? ওহে ইংরেজ, বাড়ি ফিরে যাও।

সাহেব নাছোড়বান্দা। সুতরাং ইব্রাহিম তাকে পথ দেখিয়ে সেই বিশেষ জঙ্গলটার দিকে ছেড়ে দিয়ে এল। সাহেব একাই জঙ্গলে প্রবেশ করলেন। বেলা অপরাহ্ন। আকাশের পশ্চিমে সূর্য, কিন্তু নীচে অরণ্যে তখনই অন্ধকার দল পাকাচ্ছে। সাহেব ভীত-দৃষ্টিতে চারিদিক লক্ষ করলেন। প্রাণী কোথাও নেই। কীট, পতঙ্গ, শৃগাল, বন্যকুকুর, হরিণ— কোথাও কিছু নেই। তিনি দেখলেন, ইতস্তত বিক্ষিপ্ত এক-একটা নরকপাল, কোথাও চর্বিত মনুষ্য-কঙ্কাল, কোথাও শুকনো রক্তের দাগ। চলতে চলতে দেখা গেল, এক জায়গায় একটা প্রকাণ্ড গর্ত। বোঝা গেল, শিকারিরা এই গর্তের ভিতর নেমে লুকিয়ে বাঘের দিকে লক্ষ রাখত। কেউ মাচায় উঠে, কেউ গর্তে নেমে। সাহেব তাঁর রাইফেলটা বাগিয়ে ধরে অসীম সাহসে সেই গর্তের ভিতরে নামলেন। তাঁর বুঝতে আর বাকি রইল না যে, এইখানে বাঘ আসে। নিকটেই ছোটো একটি জলাশয়। অরণ্যের জলাশয় বিপজ্জনক।

এমন সময় হঠাৎ বানর লাফাতে লাফাতে এল, একবার সাহেবকে লক্ষ করল, তার পরেই তীব্র কণ্ঠে সে চিৎকার করে উঠল। লক্ষণটা ভালো নয়। সন্দেহক্রমে সাহেব গর্তের ভিতর থেকে উঠে নিকটবর্তী এক গাছের ডালে আরোহণ করলেন। তারপর কয়েকটি মুহূর্ত। দেখতে দেখতে এক বিশালকায় ব্যাঘ্র ছুটে এসে সেই গর্তের ভিতরে লাফ দিল। একটি নিমেষ! পরমুহূর্তেই গুড়ুম! গুড়ুম!! গুড়ুম!!!

তিন গুলিতে ব্যাঘ্রের মৃত্যু!

বানরটার হঠাৎ প্রতিহিংসা প্রবৃত্তি জেগে উঠল! সাহেবকে সে আক্রমণ করবার জন্য দৌড়ে এল। বটে, বানরের এত বড়ো স্পর্ধা!

গুড়ুম! — এক গুলিতেই বানরও ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল।

জঙ্গল থেকে বেরিয়ে ইব্রাহিমের সঙ্গে দেখা। তখন লোকলশকর নিয়ে সেই বাঘ ও বানরের মৃতদেহ তুলে আনা হল। পরদিন ডাক্তারি পরীক্ষায় জানা গেল, বাঘটা ছিল অন্ধ! প্রকৃতির অদ্ভুত রহস্যযোগে বানরটার সঙ্গে ছিল ব্যাঘ্রের বন্ধুত্ব। দুইজনের ষড়যন্ত্রে অতগুলি শিকারির প্রাণ গেছে! সাহেবের ডায়েরিতে এই বিচিত্র বন্ধুত্বের পুঙ্খানুপুঙ্খ ইতিহাস লেখা আছে। প্রকৃতির ভাষা মানুষের নিকট চিরদিনই অপরিজ্ঞাত।

অসাড় অবশ অবস্থায় বসে আছি। শীতের ঠান্ডায় গরম কাপড়চোপড়ের ভিতর থেকেও হাত-পাগুলো জমে গেছে। চক্ষু আমাদের সজাগ। শোনা গেল, তিরিশ মাইলের ভিতরেও এখানে লোকালয় নেই। ভয়ে, সাহসে, আনন্দে, কৌতূহলে মনের অবস্থা জটিল। দুই পাশে অরণ্য এত উঁচু যে, হঠাৎ কোনো জানোয়ার অতর্কিতে আমাদের আক্রমণ করলে প্রাণ বাঁচানো কঠিন। এমন ঘটনা অনেকবার ঘটেছে— গাড়ির ভিতর থেকে মানুষ তুলে নিয়ে বাঘ পালিয়েছে। গাড়ির হেডলাইটের রশ্মি দশ-পনেরো গজের বেশি দূরে যায় না— তার বাইরে সমস্তই আমাদের কাছে অজানা। পথের নানা বাঁক, নানা বাধা, নানা সমস্যা। মাঝে মাঝে ঝিল্লিরব, কোথাও কোনো কীট কোন অলক্ষ্য বৃক্ষের মর্মস্থলে দাঁত বসিয়ে কুরে কুরে খাচ্ছে— তারই একঘেয়ে শব্দ। কোনো পাখির ডানার একটা ঝাপটা, কোথাও শুকনো পাতার ভিতর দিয়ে গিরগিটির সরসরানি। মাত্র এইটুকুই— বাকি আর সমস্তই নিঃশব্দতার সমুদ্রের মধ্যে আকণ্ঠ নিমজ্জিত; বন্দুকের গুলিও বোধ হয় সেই নীরবতাকে ভেদ করতে অক্ষম।

তবু একসময় ফুলের গন্ধে ফিরে পেলাম আমার পরিচিত পৃথিবীকে। আমিও অরণ্যেও, বোধ করি মর জগতেই প্রতিষ্ঠিত আছি। একদা ভীষণ ভয়াল সমুদ্রতরঙ্গের মধ্যে যে এক ঝটিকাবিক্ষুব্ধ রাত্রির ইতিহাস; তারপরে এক নূতন গন্ধ পেয়েছিলাম চিররহস্যময় অরণ্যের— শিকড়ের সঙ্গে মৃত্তিকার, বৃক্ষকোটরের সঙ্গে সর্পদেহের, লতাপাতার সঙ্গে পাখির ডানার, শাখাপ্রশাখার সঙ্গে জড়ানো জন্তুর নিশ্বাসের। যেন এই অরণ্যের জটায় জটায় বিস্মৃতপ্রায় প্রাচীনের গন্ধ, যেন পৌরাণিক যুগের তপস্বীগণের গঙ্গাযাত্রার গন্ধ, মৃত্যুর পরপারে যেন কোন অজানা জীবনের গন্ধ। ফুলের গন্ধেও সেই কথা। একে আস্বাদ করিনি লোকালয়ের লোকযাত্রায়, এ ফুল ফোটে না কোনো উদ্যানে, এ ফুল নয় পৃথিবীর।

এর পরে কী পাব সেই সামগান-মুখরিত প্রাচীন তপোবন, বল্কলধারী সন্ন্যাসীর কাছে? যাদের আশ্রমপ্রান্তে পাব ব্যাঘ্র আর হরিণের অদ্ভুত সমন্বয়, হিংসা ও অহিংসার নিবিড় যোগসূত্র, সংহার ও শান্তির পরম সংগম?

এই গন্ধ কি আমাদের সেই পথে নিয়ে যাবে?

সকল অধ্যায়

১. সুন্দরবনের শেষপ্রান্তে
২. শিকারের সন্ধানে
৩. নির্ভীক
৪. শিকারীর ক্ষোভ
৫. শিকারীর ভয়াবহ অভিজ্ঞতা
৬. বিপর্যয়
৭. হাওদা শিকার
৮. হাওদায় বসিয়া শিকার
৯. শিকারের কথা
১০. একদন্তের শেষ
১১. প্যান্থার
১২. মাচা থেকে চিতা ও অন্যান্য
১৩. জঙ্গলের ভ্রূকুটি
১৪. মহিষ
১৫. বীভৎস
১৬. কুমীর শিকার
১৭. হিমালয়ে ভল্লুক শিকার
১৮. কোয়াড়ে ভালুক শিকার
১৯. ভালুকের কবলে
২০. বাজ-বহেরী
২১. পদ্মায় পক্ষী শিকার
২২. পরিশিষ্ট
২৩. শিকারের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম
২৪. শিকার, শিকারী ও জীবজন্তু সম্বন্ধে বিবিধ জ্ঞাতব্য তথ্য
২৫. বন্দুক, বন্দুকের প্রকার ও ব্যবহার সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞাতব্য তথ্য
২৬. বাঙালির শিকারের আগ্নেয়াস্ত্র
২৭. ভারতের ব্যাঘ্র প্রকল্প
২৮. সহায়ক বাংলা পুস্তক তালিকা

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন