হিমালয়ে ভল্লুক শিকার

বিশ্বদেব গঙ্গোপাধ্যায়

হিমালয়ে ভল্লুক শিকার

ধরণীধর সেন

 

বাঙালির পক্ষে হিমালয়ের পাহাড়ি জঙ্গলে ভাল্লুক শিকার আশ্চর্য বটে। কিন্তু এই আশ্চর্য অভিজ্ঞতা আমার ঘটেছিল। একবার ১৯৩৫ সালে এক বিদেশি বৈজ্ঞানিক অভিযানের সঙ্গে আমি কাশ্মীর ও পুঞ্চরাজ্যগুলি ঘুরে বেড়াবার সুযোগ পেয়েছিলাম ও সেইসঙ্গে কিছু শিকারেরও সুযোগ জুটেছিল। এই বিদেশি বৈজ্ঞানিক দলটির নাম ছিল 'ইয়েলকেমব্রিজ ইন্ডিয়া এক্সপিডিশন'— বৈজ্ঞানিক জগতে এদের আবিষ্কারের কথা অনেকেই শুনেছেন। কিন্তু শিকার করা এই অভিযানের আসল উদ্দেশ্য ছিল না, এদের আসল উদ্দেশ্য ছিল, ভারতের আদিম মানুষের প্রস্তরীভূত কঙ্কাল, তাদের পাথুরে অস্ত্রশস্ত্র ও তাদের আস্তানা আবিষ্কার করা। সেকথা আজ বলছি না। কাজের মাঝে মাঝে কীরকম আমাদের বন্য শিকার জুটত তার গল্পই এখানে বলব। আপনাদের অনেকেই বিশেষ করে যাঁরা কাশ্মীরের প্রান্তে হিমালয়ের পার্বত্য অঞ্চলগুলি দেখেছেন, হয়তো তাঁরা শুনেছেন সেখানকার পথে-বিপথে ভাল্লুকের দেখা মাঝে মাঝে মিলে থাকে। কাশ্মীর ও পুঞ্চ এ দুটি রাজ্যই ভাল্লুক-প্রসিদ্ধ। কিন্তু এগুলি সাধারণ কালো ভাল্লুক পরিবারভুক্ত নয়, এদের কাশ্মীরে বাদামি ভাল্লুক বা 'ব্রাউন বেয়ার' বলে। কারণ এদের বুকের এক জায়গায় অতি সুন্দর বাদামি রং দেখতে পাওয়া যায়। এদের গায়ের লোমসুদ্ধ চামড়া খুব দামি। তার কারণ, মৃগনাভির মতো বাদামি ভাল্লুকও ক্রমশ বিরল হয়ে আসছে। কাশ্মীর-রাজ থেকে স্পেশাল লাইসেন্স না নিয়ে এদের মারার নিয়ম নেই।

এই ভাল্লুকগুলি সাধারণত ভালোমানুষ বলেই মনে হয়। কিন্তু আক্রমণ করলে এরা বাঘের চেয়েও হিংস্র হয়ে ওঠে। দু-পায়ে দাঁড়িয়ে পড়লে এরা সহজে একটা লম্বা মানুষকে ছাড়িয়ে যায়। অনেক পাকা শিকারির হাত থেকে লড়াই করে এদের বন্দুক কেড়ে নিতে শোনা গিয়েছে, তারপর নৃশংসভাবে তাকে নখ দিয়ে ছিঁড়ে হত্যা করেছে! অনেক শিকারি বলেন— এদের চেয়ে বাঘের হাতে মৃত্যু অনেক ভালো। কাশ্মীরি ভাল্লুকেরা গুহাপ্রিয়। আর এই গুহাগুলিই প্রাগ-ঐতিহাসিক মানুষের কঙ্কালের জন্য খনন করা আমাদের একটা কাজ ছিল। ভাল্লুকগুলোকে হয় গুলি করতে হত, নয়তো সশস্ত্র হয়ে তাড়াতে হত। সব গুহাতেই যে ভাল্লুক থাকে তা নয়। একবার কী হল শুনুন— যে গুহাটির কথা বলছি, সে-গুহাটি ছিল কাশ্মীরের লোলাব উপত্যকার অন্তর্গত। একদিনেই আমরা জেনে নিলাম, সন্ধ্যার ঝোঁকে ভাল্লুক খাবার অন্বেষণে বেরিয়ে পড়ে, তারপর ভোর রাত্রে ফিরে আসে। দিনের বেলা তারা বড়ো একটা বেরোয় না। প্রথম দু-দিন তো আমরা চেঁচামেচি বাজনা-বাদ্যি করে ভাল্লুকভায়াকে কিছুতেই গুহার বাইরে আনতে পারলাম না। আমাদের অভিযানে টম প্যাটারস বলে একটি স্কচ ছেলে ছিলেন— পাকা শিকারি। ভাল্লুকভায়াকে ছাড়বার পাত্র তিনি নন। কাজেই আমাদের এক নিশীথ অভিযান ঠিক হল— বন্দুকের নলেতে একটি শক্তিশালী টর্চ লাগিয়ে টম প্যাটারসন গুহাটির ছাদে ঘুপটি মেরে ভোররাত্রের দিকে বন্দুক বাগিয়ে বসলেন। আমি তাঁকে উৎসাহ ও সাহায্য দেবার জন্য একটা লম্বা বর্শা হাতে নিয়ে তাঁর পেছনে গিয়ে বসলাম, যদি কিছু বিপদ ঘটে, তাহলে তাকে সাহায্য করতে পারব এই আশায়। আমার নিজের বন্দুক বা লাইসেন্স তখন ছিল না, তাই কাশ্মীরে থাকতে একটা বর্শা করিয়েছিলাম। যাই হোক, বেশ ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করবার পর টমের মুখ থেকে একটা অস্ফুট আওয়াজ বেরিয়ে এল। সঙ্গেসঙ্গে আমিও দেখলাম— সেই আবছা আলোছায়া পাহাড়ি পথে, একটি ভাল্লুক মন্থর গতিতে এগিয়ে আসছে। আমরা নিশ্বাস বন্ধ করে রইলাম। আরও কাছে— আরও কাছে, তারপরই হঠাৎ টর্চের তীব্র আলো ভাল্লুকের গায়ে পড়াতে সে থমকে দাঁড়াতেই সঙ্গেসঙ্গে গুড়ুম গুড়ুম। ভাল্লুকটাও সঙ্গে সঙ্গে মাটি থেকে শূন্যে লাফিয়ে উঠল, আবার গুড়ুম। ভাল্লুক পড়ল মাটিতে, আবার গুড়ুম। তারপর সব শেষ। সবসুদ্ধ বোধ হয় তিন সেকেন্ডের বেশি সময় লাগল না।

ভাল্লুকের বাদামি চামড়া বিলাতে টমের বন্ধুর কাছে। কিন্তু টম এতে খুশি হল না। বললে, আর একটা ওর পেছনে নিশ্চয় ছিল, তাকে বার করতে হবে। কিন্তু দু-দিন বসেও তার সাড়াশব্দ মিলল না। তখন টম একটা অসমসাহসিক কাজ করলে। বললে, সেন, তুমি থাকো, আমি আজ গুহার ভেতর গিয়ে শেষ পর্যন্ত দেখব। আমি তাকে বাধা দিতেও সে শুনলে না। বুঝলাম তার মাথায় শিকারির খুন চেপেছে। সেরাতেই টম গেল সেই গুহার ভেতর। তার পরদিন টম তাঁবুতে চায়ের টেবিলে যে গল্প বললে, তার মুখ থেকেই তা শোনা—

আমি বন্দুকটা বাগিয়ে ধরে টর্চ জ্বেলে গুহার অন্ধকারে তো ঢুকে পড়লাম। ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে গুহার দেয়ালে দেয়ালে আলো ফেলতে লাগলাম ও ক্রমশ নিঃশব্দে খুব আস্তে আস্তে এগুতে লাগলাম। মাঝে মাঝে ছাতের সঙ্গে মাথা ঠুকে যেতে লাগল। তারপর গুহাটা ক্রমশ ছোটো হয়ে এল, তখনও আমি হামাগুড়ি দিয়ে এগুতে লাগলাম। সামনে বোধ হয় নিজেরই প্রকাণ্ড অদ্ভুত অদ্ভুত ছায়া দেখতে লাগলাম। একটু ভয় যে করছিল না তা নয়। হঠাৎ কাদাজলে পড়ে গেলাম, কিন্তু জল ছিল না বেশি তাই রক্ষে! মনে হতে লাগল এই বুঝি ভাল্লুকের সামনাসামনি পড়ি। ট্রিগারে আঙুল লাগিয়ে আসন্ন বিপদের জন্য একেবারে তৈরি হয়েই এগুতে লাগলাম। কিন্তু কই? কিছুই দেখতে পেলাম না। গুহার শেষ অবধি পৌঁছে সামানে ভিজে ভিজে দেয়াল পেলাম। একটু দাঁড়ালাম, কিন্তু নিশ্বাস যেন বন্ধ হয়ে আসছিল। মন বড়ো খারাপ হল। তারপর আস্তে আস্তে পিছু হেঁটে গুহা থেকে বেরিয়ে এলাম। ভাল্লুকটা তাহলে জন্মের মতো তার এ আস্তানা ছেড়ে চলে গিয়েছে!

ভাল্লুক মিলল না বটে, কিন্তু টমের বাহাদুরিতে আমরা বাহবা দিলাম। আমাদের দলপতির ছিলেন একজন জার্মান, তাঁর নাম ডি টেরা— তিনি ছিলেন ভূতত্ত্ববিদ; শিকারের ঝোঁক তার বড়ো একটা ছিল না। কিন্তু তিনিও বললেন, তাই তো! টম, ভাল্লুকটা মারলে তুমি নিশ্চয় চামড়াটা আমার স্ত্রীকে উপহার দিতে!

 

এরপর আমাদের কাজের ভাগ হয়ে গেল। আর আমার ভাগ্যেই পড়ল পার্বত্য নদী লীডার উপত্যকার অন্তর্গত গুহাগুলি খনন কাজের জন্য পরীক্ষা করা। শ্রীনগর থেকে টম গেল সিন্দ উপত্যকায় আর ডি টেরা গুলমার্গে। আমার পথের শেষ লক্ষ্য হল বিখ্যাত অমরনাথ গুহা— (যার কথা আপনারা অনেকেই শুনেছেন)। আর এরই রাস্তায় কাজের উপযোগী গুহাগুলি দেখা। যা হোক, শ্রীনগর থেকে মোটরে আমি পাহালগাম পৌঁছোলাম। পাহালগাম থেকেই অমরনাথের পার্বত্য পথ শুরু, আর লোকালয়ের শেষ। পাহালগামে পৌঁছে আমি একজন শিখ সর্দারকে শিকারি নিযুক্ত করলাম। এর নাম ছিল গুরুদিৎ সিং। তার নিজের বন্দুক ও লাইসেন্স ছিল। এ ছাড়া ডি টেরা আমাকে একজন 'পাঠান' বেয়ারা দিয়েছিলেন— রান্না ও তাঁবুর কাজের জন্য। এই পাঠানটি গত মহাযুদ্ধের ফেরত; ফ্রান্সে লড়াইয়ের সময় তার ঊরুতে লাগা গুলির দাগ এখনও আছে। এর নাম ছিল মিশ্রিখান। দুজনেই বলবান ও সাহসী লোক। আমি খুব খুশি ও উৎসাহিত হয়ে তাদের তখনই সঙ্গে নিলাম এবং শীঘ্রই তারা আমার আপনার লোকের মতো হয়ে গেল। কিন্তু আমার ভাগ্যে মাত্র যে দু-বার ভাল্লুক শিকার জুটেছিল, সে-শিকার দু-বারই হাতছাড়া হয়েছিল আর দু-বারই টমের মতো বন্ধু ও শিকারির অভাব অনুভব করেছিলাম। যাহোক, ঘটনা দুটোর একটা আগে শোনাই।

ছোটো বড়ো গুহা দেখলাম অনেক, কিন্তু অমরনাথের তুষারপথে এসেই ঘটনাটি ঘটল। এ জায়গা থেকে অমরনাথ-গুহা মাত্র সামান্য পথ। জায়গাটা প্রায় এগারো হাজার ফিট উঁচু। কাছে দশবারো মাইলের মধ্যে কোথাও লোকালয় নেই, কেবল বরফ আর বরফ। আর কেবল যারা ভেড়া চরায় সেই ভবঘুরে কাশ্মীরি চোপানের দল। দু-একটি দলের কখনো কখনো তাঁবু দেখা যায়, আর দেখা যায় তাদের বিরাট ভেড়ার দল। একদিন নিজের কাজকর্ম সেরে ক্লান্ত হয়ে তাঁবুতে ফিরেছি, হঠাৎ দেখি, একটা চোপান এসে হাজির, সে ভাঙা উর্দুতে ও কাশ্মীরিতে যা বললে, তাতে বুঝলাম, কাল রাত্রে তার একটা বড়ো ভেড়া তার তাঁবুর কাছেই ভাল্লুকে মেরে গিয়েছে; সাব যদি মেহেরবানি করেন তো গরিবের অন্য ভেড়াগুলো রক্ষা পায়— ইত্যাদি। দেখলাম, এ সুযোগ আমার ছাড়া উচিত নয়। গুরুদিৎ ও মিশ্রিখান তো উৎসাহ দেখিয়ে হইহই করে উঠল। জিজ্ঞেস করলাম, তাঁবু তোর কত দূর? উত্তরে বুঝলাম, মাইলখানেক দূর হবে আমার তাঁবু থেকে। তখনই হুকুম দিলাম, তৈরি হও, তাঁবু নিয়ে চলো ওই জায়গায়। তখন বেলা প্রায় পাঁচটা, পাহাড় থেকে অন্ধকার আস্তে আস্তে নেমে আসছে। খাওয়াদাওয়া সেদিন আর আমার হল না, সাজপোশাক রইল গায়ে— পড়লাম বেরিয়ে। এক মাইল রাস্তাই বটে! প্রায় এক ঘণ্টার পর চোপানের শতছিদ্র তাঁবুর কাছে এসে পড়লাম। দেখলাম, কম করেও প্রায় দু-তিনশো ভেড়া তাঁবুর সামনে জমা হয়ে রয়েছে আর তাঁবুরই একধারে একটা প্রকাণ্ড ভেড়া মরে পড়ে রয়েছে— তার পেটটা একেবারে ফাঁক হয়ে নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে আছে। সে এক বীভৎস দৃশ্য! ভাল্লুকটার সাহসের কথা মনে হতে লাগল। তা ছাড়া একথাও মনে হল যে, এরা কি তাহলে মাংসপ্রিয়! না, কিছু জোটে না বলেই তারা ভেড়া ধরতে আরম্ভ করে। চোপানের কাছে শুনলাম, ব্যাপারটা তাই বটে। চোপান দূরে একটা তুষারাবৃত পাহাড়খণ্ড দেখিয়ে বললে, ওইদিক দিয়ে সে নেমে আসে— আজও সে তার হাতে-মারা এই ভেড়াটি নিতে আসবেই। যাক— তাঁবু তো লাগাতে বললাম।

মিনিট দশেক-এর মধ্যেই তাঁবু তৈরি হয়ে গেল। আমার তাঁবুর ঠিক পেছনে চোপানের তাঁবুতে গিয়ে দেখলাম, তার স্ত্রী ও দুটি সুন্দর ছেলে-মেয়ে চুপ করে বসে আছে। ছেঁড়া জামার ভেতর থেকে তাদের গায়ের রং আর স্বাস্থ্য যেন ফেটে পড়ছে। ছেলে-মেয়ে দুটিকে কোলে নিলাম, কথা বললাম, কিন্তু তারা কিছুই বোঝে না, বড়ো বড়ো চোখে বিস্ময়ে আমার দিকে চেয়ে রইল।

দেখতে দেখতে নেমে এল সন্ধ্যা, ঘনিয়ে এল আঁধার, আমি নিজের তাঁবুতে গিয়ে ঢুকলাম। চোপান বললে, আমি রইলাম বসে, খবর দেব— চোখ আমার পাহারায় রইল— বলে, নিজের তাঁবুতে সে ফিরল। আমার তাঁবুর সামনে বিরাট ভেড়ার দল গিজগিজ করছে, অন্ধকারে তাদের কারুর কারুর নীল চোখগুলি জ্বলে জ্বলে উঠছে। বিশ্রী গন্ধ আর প্রায় পাশেই পড়ে আছে সেই নাড়িভুঁড়ি বের করা হতভাগ্য মরা ভেড়াটা। মাঝে মাঝে এক একটা ভেড়ার ছানা করুণভাবে ম্যাঁ ম্যাঁ করে ডেকে উঠছে। আমাদের চোখ থেকে ঘুম যেন জন্মের মতো ছুটে গেছে। পাশেই বসে আছে নিঃশব্দে গুরুদিৎ মিশ্রিখান, টোটা-ভরা বন্দুক আর তীক্ষ্ন বর্শা নিয়ে আসন্ন যুদ্ধের জন্য তৈরি হয়ে আছে। অনেকক্ষণ বসে বসে অবসন্ন হয়ে আমরা উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লাম। আমার গোদা বুট জুতোজোড়া খুলে একটু আরামের নিশ্বাস ফেললাম। হাতের কাছে ধুচুনিতে (ওদের দেশে 'কাংড়ী' বলে) আগুন জ্বলছে, তাতেও শীত আমাদের কিছুমাত্র কমছে না। গায়ে পুলওভার ওভারকোট তো আছেই। নিঃশব্দে সময় কাটতে লাগল। হঠাৎ শুনতে পেলাম, ভেড়াগুলোর মধ্যে থেকে একটা অস্ফুট হিস হিস হিস আওয়াজ— আর মনে হল, তারা যেন একটু চঞ্চল হয়ে উঠেছে। কিন্তু গিজগিজ করছে সেই ভেড়ার দল, কোথায় যে কী হচ্ছে অন্ধকারে ঠাওর করার জো নেই। কিন্তু সঙ্গেসঙ্গে চোপানটার মূর্তি দেখা গেল, সে চাপা গলায় বললে— সাব, আ গিয়া! আমি তো জুতো পরবার সময় পেলাম না, 'মস্যি' (বুটের ভেতরে পরবার একরকম পাতলা চামড়ার জুতো) পরেই বেরোলাম, একেবারে নিঃশব্দে হাতে টর্চ নিয়ে। চোপান টর্চ জ্বালাতে মানা করলে। সবচেয়ে আগে পথপ্রদর্শক চোপান, তার পায়ে পায়ে গুরুদিৎ বন্দুক বাগিয়ে, আর সেইসঙ্গে আমি ও মিশ্রিখান। মিশ্রির হাতে বর্শা। পায়ের নীচে ঠান্ডা মাটি, কখনো নীচে নামি কখনো উঁচুতে উঠি, কখনো হোঁচট খেতে খেতে সামলে নিই আর কখনো ডান দিকে কখনো বাঁয়ে এগুতে থাকি। বোধ হয় বিশ-পঁচিশ পা গিয়েছি কি যাইনি, হঠাৎ চোপান একদিকে আঙুল দেখিয়ে বলে উঠল, ওই ওই— সঙ্গেসঙ্গে টর্চের আলো ফেললাম, কই কিছু তো দেখতে পেলুম না। টর্চ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ফেলতে লাগলাম। একেবারে নিশ্বাস চেপে, হঠাৎ সামনে না গিয়ে পড়ি তাই ভাবতে লাগলাম। উঃ, বাপস, সে কী সময়! ভাল্লুকটা কোথায় ঘাপটি মেরে বসে রইল নাকি? দেখার চেয়ে না দেখা যেন অন্ধকারে আরও ভয়ংকর হয়ে উঠল। আমাদের চারটি প্রাণীর জীবন অত্যন্ত অসহায় মনে হতে লাগল। প্রায় মিনিট কুড়ি খোঁজা গেল কিন্তু কোথাও কিছু পাওয়া গেল না। অবসন্ন হয়ে তাঁবুতে সব ফিরলাম। চোপান বললে, সাব, এখানেই কোথাও ওটা আছে। আপনারা শুয়ে পড়ুন, আমার দায়, আমি জেগে পাহারায় রইলাম। কিন্তু ঘুম কি আসে? তাই সে-অবস্থায় সমস্ত রাত সেই পাহাড়ের মধ্যেই আমাদের অনিদ্রায় কাটল। ভোরের আবছা আলো ফুটলে দেখলাম, চোপান সপরিবারে এসেছে, সেলাম করে করুণভাবেই বললে, সাব, আপশোস, একটা ভেড়া আমার নিয়ে গেছে বেটা, আমি জানতে পারিনি, তোমার কসুর নেইকো। বসে পড়ে বলে চলল, সাব, এরা আসে নিঃশব্দে, এমনভাবে অন্ধকারে বোকা ভেড়াকে ধরে যে, সে টুঁ-শব্দটি পর্যন্ত করতে পারে না— তারপর তার জানটি মেরে যেমন নিঃশব্দে আসে, তেমনি নিঃশব্দে সরে পড়ে। বুঝলাম, তাহলে এবার একটা পুরো ভেড়া নিয়েই সে উধাও হয়েছে। সেরাত্রে আবার একেবারে অমাবস্যার অন্ধকার ছিল। অত্যন্ত মন খারাপ নিয়ে, অনিদ্রায় অবসন্ন হয়ে ফিরে এলাম নিজের ঘাঁটিতে। তারপর দিন দুয়েক পরে কাজ শেষ করে অমরনাথ থেকে বিদায় নিলাম। কেবল আসবার দিন একবার খোঁজ করেছিলাম নীচেকার জঙ্গলে। আর কতকগুলি গিধ্বড় বলে বুনো খরগোশ জাতীয় একরকম ছোটো লোমওয়ালা জন্তু মেরে মনের ও হাতের আশ তখনকার মতো মেটালাম। ছোটো হলেও এদের লোম ও চামড়া ভারি সুন্দর।

শিকারের মোহ যখন মানুষকে পেয়ে বসে, তখন আর তার রক্ষে নেই। আগেই বলেছি আমি মোটেই শিকারি নই, কিন্তু শিকারের মোহ যেন আমাকে পেয়ে বসল। কী ব্যাপার এখন সেই কথাই বলছি—

অমরনাথ থেকে নেমে পাহালগামে আবার ফিরে এলাম। অমরনাথ যেতে হলে এই পাহালগাম জায়গাটি দিয়ে পশ্চিম দিকে যেতে হয়। আর শ্রীনগর বা অন্যত্র যেতে হলে পাহালগামেই অমরনাথ থেকে আবার নেমে আসতে হয়। যাহোক, এবার ঠিক করলাম যাব পূর্ব দিকে অর্থাৎ কোলাহাই তুষার নদীর উদ্দেশে। কোলাহাই পাহালগাম থেকে প্রায় মাইল কুড়ি রাস্তা হবে। চেষ্টা করলে ঘোড়ার পিঠে একদিনেই পৌঁছানো যায়, কিন্তু আমি মাঝে লিডারওয়াট বলে একটি সুন্দর জায়গায় রাত্রে বিশ্রাম নিয়ে পরের দিন বেলা থাকতে থাকতেই কোলাহাই পৌঁছোলাম এবং কোলাহাই তুষার-নদীর পাশেই অপরিসর উপত্যকার মাঝে একখণ্ড তৃণভূমিতে তাঁবু লাগালাম। গাছপালার কথাই নেই, ঘাস্যও এসব জায়গায় দুর্লভ। অনেক খুঁজে-পেতে ও তুষার-নদীর প্রায় একেবারে সামনে গিয়ে পড়ে এই সামান্য ঘাসে-মোড়া সোনার জায়গাটুকু আবিষ্কার করেছিলাম। দু-ধারে আকাশছোঁয়া পাহাড়ে চারদিক নিস্তব্ধ নিঝুম হয়ে আছে। কেবল একপাশ দিয়ে লিডার নদী তুষার পাহাড়ের নীচেকার একটা গর্ত থেকে বেরিয়ে একটানা একঘেয়ে একটা শব্দ করে চলেছে। কোথাও গ্রাম, লোকালয়, এমনকী একটা মানুষের মাথাও দেখা যাচ্ছে না। এদিকের রাস্তা এই কোলাহাই তুষার নদী ও পাহাড় অবধি এসে একেবারে শেষ হয়ে গিয়েছে। সূয্যি বোধ করি এখানে দেখা দেয় না— আকাশের দিকে চাইলে মনে হয়, সূয্যি কোনকালে এদেশে ওঠে না। চারিদিকে ঠান্ডার একটা প্রলেপ ও কেমন একটা থমথমে ভাব। ভাল্লুকের চলাফেরা করবার উপযুক্ত জায়গা বটে!

এক ঘণ্টার মধ্যে যেন হঠাৎ সন্ধে হয়ে গেল। কেবল পাহাড়ের চুড়োর দিকে চেয়ে মনে হতে লাগল, অন্য দেশে দিন যেন এখন অনেক বাকি। এইরকম স্যাঁৎসেঁতে আবহাওয়ার মধ্যে আমার ছোট্ট ছোউলদারি তাঁবুটিতে আমি ও আর একটিতে গুরুদিৎ সিং, মিশ্রিখান ও আরও দুজন কুলি— এই পাঁচটি প্রাণী মাত্র জেগে আছি। আর চারিদিকে সব যেন আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়ছে। এ জায়গাটাতে যে ভাল্লুকভায়াদের বেশ গতাগম্য আছে আমার শিকারি ও কুলিরা ভালোরকম জানে— তারা এর আগেও এদেশে এসেছে।

সেদিন খুব ভোরে আমরা লীডার নদীর ধারে এমন একটা জায়গা ঠিক করলাম যে, ভাল্লুকের ওপরে পাহাড়ে ওঠবার পথে বা নেমে সেখানে জল খেতে আসবার সম্ভাবনা খুব বেশি— শোনা গিয়েছে তারা প্রায় আসেও।

তখনও বেশি রাত্রি; আমরা তিনটি প্রাণী— আমি, গুরুদিৎ ও মিশ্রিখান একটা প্রকাণ্ড পাথরের পেছনে গা ঢাকা দিলাম। একরকম অগুনতি গোলাকার পাথরখণ্ড সেখানে পড়ে আছে। আমাদের পেছনে একটা খাড়াই পাহাড়ের গা। আমাদের পাশেই ঠিক আর একটা প্রকাণ্ড পাথরের খণ্ড তার পাশ দিয়ে জানলার মতো করে নদীর ধারটা ও ভাল্লুকের চলার রাস্তা বেশ চোখে পড়ে। গুরুদিৎ গুছিয়ে বন্দুকের নালাটা ওই দিকে ফিরিয়ে তাক করে রাখল। বসে বসে দেখলাম, পুব আকাশের অতি সামান্য একটু আলোর ভাবে নদীর ধারটা আবছা থেকে যেন একটু সামান্য স্পষ্ট হল। আমরা অধীরভাবে অপেক্ষা করছি— কথাবার্তা নেই। যা কথা কওয়ার ছিল, তাঁবুতে সব সেরে এসেছি। আমার হাতঘড়িটা টিক টিক করে আওয়াজ করছে— দেখতে পাচ্ছি না ঠিক ক-টা বেজেছে। তাঁবু থেকে বেরুবার সময় হয়েছিল জানি সাড়ে তিনটে। চুপচাপ। এমন সময়— প্রায় তিনশো গজ দূরে, দুটো ছায়া আস্তে আস্তে যেন একদিকে সরে যাচ্ছে— হঠাৎ আমার চোখে পড়ল। সেদিকে আঙুল দিয়ে নিশ্বাস বন্ধ করে গুরুদিৎকে দেখালাম। গুরুদিৎ মাথা নাড়লে— অর্থাৎ বন্দুক চলবে না। এখন দেখা গেল, আমাদের রাস্তার দিকে না এসে ভাল্লুক-জোড় যেন ভিন্ন পথ নিচ্ছে। তাহলে শিকার তো হাতছাড়া হবার জোগাড়। আমি অস্থির হয়ে পড়লাম, গুরুদিৎ অস্ফুট স্বরে আমাকে বললে, আব বৈঠিয়ে, ম্যায় উসকো পিছু যাউঙ্গা। বলে চতুর শিকারির মতো নিঃশব্দে সে উঠে ওদিকে চলে গেল— কিছুক্ষণের মধ্যেই বিরাট প্রস্তরখণ্ডগুলি তার গন্তব্য পথ আড়াল করল এবং ভাল্লুকগুলোকেও আর দেখা গেল না।

আবার কিছুক্ষণ কাটল চুপচাপ। এবার একটু একটু যেন আলো পাহাড় থেকে নীচে নামছে। হঠাৎ দেখি, একটা প্রকাণ্ড ভাল্লুক একেবারে জলের ধারে মুখ নীচু করে আছে। কী ভয়ংকর! —গুরুদিৎ নেই কাছে; বড়ো আপশোস হতে লাগল। কিন্তু কোথায় সে? সে কি অন্য কোথাও থেকে ভাল্লুকটাকে তাক করছে? ...কিন্তু বেশ কয়েক সেকেন্ড কেটে গেল। ভাল্লুক সেই মুখ নীচু করে আছে তো আছেই— কিন্তু ওটা করছে কী— জল খাচ্ছে নাকি? ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। অথচ পঞ্চাশ-ষাট গজের মধ্যেই। আমার রক্ত ইতিমধ্যে গরম হয়ে উঠল— কীসের একটা টানে উশখুশ করে উঠলাম। ভাবলাম, আমার হাতের বর্শাটা ছুড়ে তার পিঠে গেঁথে দিই। তাক করে গায়ের সমস্ত জোরে বর্শাটা টিপ করে ছুড়লাম। কিন্তু আমি আফ্রিকার হটেনটট নই— ও চলবে কেন! ভাল্লুকটার প্রায় ফুট খানেক পাশে একটা পাথরে ঠোক্কর খেয়ে বর্শাটা অন্য একটা দিকে ভীষণ জোরে ছিটকে পড়ল। মুহূর্তে কী হয়ে গেল— সঙ্গেসঙ্গে গুড়ুম গুড়ুম করে দুটো আওয়াজ! ভাল্লুকটা তীক্ষ্ন বেগে একদিকে বেরিয়ে গেল এবং সঙ্গেসঙ্গেই আবার নিকটেই গুড়ুম গুড়ুম করে দ্বিতীয় বার আওয়াজ! প্রায় ছয়-সাত মিনিট আমরা অস্থিরভাবে চুপচাপ— বাইরে বেরিয়ে আসতেও পারছি না। নিজের উপর ভয়ানক রাগও হচ্ছে। মিশ্রিখান একবার বিড় বিড় করে কী যেন বললে। কিন্তু হতভাগা গুরুদিৎ কোন দিকে গেল? বেশ ফর্সা হয়ে এসেছে— রাত্রি আর নেই। এবার দূরে, মনে হচ্ছে যেন একটা সমস্ত রাত্রি পরে গুরুদিৎকে দেখতে পেলাম। আর দেখতে পেলাম, একটা ভাল্লুকের বাচ্চাকে ঝোলাতে ঝোলাতে সে নিয়ে আসছে। অবশ্য সেটা মরে গেছে। শেষে, ভাল্লুকের বাচ্চা!—ওটার অতটুকু চামড়া কী হবে? গুরুদিৎ এসেই বললে, জি, আব লোক কই আওয়াজ কিয়া? আমি তখন আমার বর্শা ছোড়ার অতিলোভের ইতিহাসটা লজ্জিতভাবে বললাম। তখন গুরুদিৎ বললে যে, একটা বড়ো ভাল্লুক নির্ঘাত নিত— কিন্তু ওই আওয়াজে সে চমকে সরে যাওয়াতে তার লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। ভাল্লুকটার পেছনে এই ছোটো বাচ্চাটা ছিল— ওরা দুটোই ছুটছিল— সেও পিছু নিলে এবং বাচ্চাটা একটু পিছিয়ে পড়াতে ওইটাকেই সে গুলি লাগিয়েছে। আমি ক্লান্ত হয়ে বললাম— যাক, আজকে অনেক হয়েছে আর কাজ নেই, —ওটা আমি তোমাকে উপহার দিলুম। গুরুদিৎ খুশিই হল। আমরা সেদিনকার অভিযানের কিছু কাজ শেষ করে তাঁবুতে ফিরলাম।

তার পরের রাত্রের আগেই কোলাহাই থেকে বিদায় নিলাম। হয়তো বড়ো ভাল্লুকটা বাচ্চা হারিয়ে হিংস্র হয়ে আমাদের তাঁবু আক্রমণ করে বসত। ভাল্লুক হিংস্র হয়ে উঠলে তারা সমস্ত বন্য পশুদের চেয়ে ভয়ংকর হয়ে ওঠে।

কয়েক দিন পরে পাহালগাম ও শ্রীনগর হয়ে গুলমার্গে আমরা চলে এলাম। এবং সেখানে টম ও ডি. টেরার সঙ্গে দেখা হল। শুনলাম, আমি ও টম পুঞ্চরাজ্যে যাব ঠিক হয়েছে। অনেকদিন বাদে টমকে আবার পেয়ে আমার ভারী মনটা খুব হালকা ও খুশি হয়ে উঠল।

 

গুলমার্গ থেকে শুরু করে উঠতে উঠতে পীরপঞ্জল পাহাড় টপকে পুঞ্চরাজ্যে নামবার অ্যাডভেঞ্চারের মস্ত প্ল্যান তৈরি হল। যে পার্বত্য-গলি (pass) দিয়ে আমরা যাব সেটার নাম চোরপঞ্জল পাস। সাধারণত নেহাত অ্যাডভেঞ্চার-দুরস্ত বা জেল-পালানো খুনি আসামি ছাড়া অন্য কোনো লোক বোধ হয় এ রাস্তা নেয় না। রাস্তা মানে, দু-ফুট পায়ে চলার অপ্রশস্ত বিপদসংকুল পিচ্ছিল পথ। যা হোক, শুরু হল আমাদের যাত্রা। আমরা সমস্ত দিন হাঁটতাম ও যেখানেই সন্ধে হয়ে যেত সেখানেই তাঁবু ফেলতাম— আর বাইরে আকাশের তলায় সর্বপ্রথমে আমাদের ডিনার তৈরি হত। সমস্ত দিন চলে ক্লান্ত হবার দরুন সাতটার সময়ই ভবঘুরে বেদুইনদের মতো খাওয়াদাওয়া করে আমরা যে যার তাঁবুতে ঢুকতাম। বাইরে আমাদের লোকজনের কেউ কেউ পালা করে পাহারায় থাকত। বন্য পশু ও ছিঁচকে ডাকাতের জন্যে এই সাবধানতা। টমের দুটি বন্দুকের একটি আমার কাছে থাকত এবং দুটোই টোটা-ভরা অবস্থায় আমাদের বিছানার একপাশে পড়ে থাকত। পীরপঞ্জল পাহাড় পার হবার আগে এক জায়গায় (পাঞ্জান পাথরি) আমাদের তাঁবুর পেছনের জঙ্গলে ভাল্লুক এসেছিল শুনেছিলাম।

পীরপঞ্জল পাহাড়টা উচ্চতায় চোদ্দো হাজার ফুটের বেশি। যেদিন পীরপঞ্জল পাহাড়চূড়ায় সেই চোরপঞ্জল গলিতে চোদ্দো হাজার ফিটের ওপরে দাঁড়িয়েছিলাম, সেদিন এক অপূর্ব অনুভূতি হয়েছিল আমাদের। চারদিক শূন্য, কুয়াশাচ্ছন্ন, পায়ের তলায় কালো বরফ! কতবার আমরা যে পিছলে পড়ছিলাম তার ঠিক ছিল না। সেদিন মনে হয়েছিল যেন হিমালয় জয় করেছি। কাছাকাছি এক জায়গা থেকে আমরা সুউচ্চ নঙ্গ পর্বতের অপরূপ ধবল-চূড়া দেখলাম— সে এক স্বর্গীয় দৃশ্য! পীরপঞ্জল পার হয়ে আমরা পুঞ্চরাজ্যে নামলাম।

পুঞ্চরাজ্যে সাপুর বলে একটা পাহাড়ি গ্রামে আমাদের ভাল্লুক শিকারের একটা প্রকাণ্ড ঘটনা ঘটল। শুনেছি এই সাপুর গ্রামে এমন একটি গুহাও নেই, যেখানে ভাল্লুকের বসতি নেই। এজন্য আমরা মনস্থ করেছিলাম, আমাদের অভিযানের প্রত্যেক সভ্যের জন্য একটি করে ভাল্লুক মারা হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমাদের অত বড়ো উচ্চাকাঙ্ক্ষা চতুর ভাল্লুকের দল ব্যর্থ করেছিল। তবে আমাদের চেষ্টা একেবারে নিষ্ফল হয়নি।

সাপুরে সমতল ভূমি বলে কিছু ছিল না। যা হোক, গিয়েই আমরা শুনলাম, ভুট্টাচোর ভাল্লুকের জ্বালায় গ্রামবাসীরা অতিষ্ঠ হয়ে আছে। সন্ধে হলেই ভুট্টার খেতে তারা দল বেঁধে ভুট্টা খেতে আসে। আমাদের শিকারের দল ভেবে তারা উৎসাহিত হয়ে অভ্যর্থনা করলে। বিনামূল্যে মুরগি, ডিম, দুধ, কাঠ— সব পেয়ে গেলাম। তারা বললে, তাদের গ্রামের দু-চারজন শিকারিও যোগ দেবে— কিন্তু তাদের লাইসেন্স নেই, তাই তারা মারতে পারবে না। তারপর একদল বাজনা, বিগল, ঢোল এসব বাজিয়ে তারা তুমুল কোলাহল করে ভাল্লুকগুলোকে কোণঠাসা করবে বা তাদের তাড়িয়ে একদিকে বার করবে অর্থাৎ রীতিমতো রাজ-শিকারের বন্দোবস্ত হল! রাজারা যেমন লোকজন বাজনা-বাদ্যি নিয়ে শিকার করেন, আমাদেরও সেই ব্যবস্থা হল।

ভোর প্রায় চারটে নাগাদ আমাদের দল শিকারে বেরোল। মাঝে মাঝে এখান থেকে সেখান দু-একজন করে আমাদের দলে যোগ দিতে লাগল। তামাশা দেখবার জন্য ছেলে-ছোকরার দল অনেক পেছনে চলল। শেষ রাত্রের সেই প্রচণ্ড ভয়াবহ খাড়াই পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে যেতে বেশ রোমাঞ্চ হচ্ছিল।

 

দু-চারটে ভাল্লুকের গুহা এড়িয়ে (কারণ, সোজা খাড়াইর দরুন সেখানে পৌঁছোনো শিবের অসাধ্য) আমরা শেষে একটা অপেক্ষাকৃত কম খাড়াইয়ে একটা বিরাট গুহার আস্তানা দেখলাম। মুহূর্তে পাকা শিকারির মতো আমরা চুপ করে দু-তিনটে ছোটো ছোটো দলে ভাগ হয়ে গেলাম। আমাদের ছোটো দলটি ক্রমশ এগিয়ে একেবারে প্রায় গুহার সামনে এসে পড়ল। ভাল্লুকের যে এটা একটা আস্তানা তাতে সন্দেহ নেই। ওখানকার স্থানীয় এক শিকারি বললে, ভাল্লুক গুহার ভেতরেই আছে— আপনারা গুলির আওয়াজ করুন, বেরুবে। এটা ভুল হল। গুহার ভেতরের অন্ধকার লক্ষ করে টম গুলি চালালে— সমস্ত নিস্তব্ধ পাহাড় কাঁপিয়ে তার ভয়াবহ গুরুগম্ভীর প্রতিধ্বনি হল— আমরা সম্মুখ-সমরের প্রতীক্ষা করতে লাগলাম। কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ নেই। গুহাটার দু-তিনটে ফাটল দিয়ে আমরা সতর্কে উঁকিঝুঁকি মেরেও কোনো ছায়া বা কোনো কায়া আবিষ্কার করতে পারলাম না। সেই ফাটলগুলো দিয়ে দু-চারটে গুলি ছোড়াও হল— গুলির ভীষণ শব্দে মনে হল— ভাল্লুকের বাবাও বেরিয়ে এল বুঝি! বেশ খানিকক্ষণ প্রতীক্ষা করার পর— আর সময় নষ্ট করার আমার ও টমের ইচ্ছা হল না— কাছেই অন্য গুহা ও জঙ্গলের খোঁজে আমরা এগুতে লাগলাম। বলা বাহুল্য, এখানকার শিকারিরাই আমাদের পথপ্রদর্শক ছিল। প্রায় আধঘণ্টা পরে এবার আমরা একটা খড়-এর ধারে এসে পড়লাম— জঙ্গলে ভরতি পাহাড়ের গায়ে গায়ে দু-চারটে গুহাও চোখে পড়ল। এবার আমরা কাজটা রীতিমতো গুছিয়ে করলাম। ঢোল বাজনার দলকে নীচে পাঠানো হল— লোক প্রায় পঞ্চাশ জন হবে— তাদের পাঁচ ছ-টা ভাগ করে নীচেকার জঙ্গলটা গোল করে ঘিরে ফেলতে বলা হল। গোলমাল চেঁচামেচি হইচই করে ক্রমশ এই দলটি ভাল্লুকগুলোকে তাড়িয়ে একটা বিশেষ দিকে নিয়ে আসবে ও সেই বিশেষ দিকে, যেখানে ভাল্লুক ভাববে তার একমাত্র পালাবার পথ; সেখানে আমরা বন্দুক বাগিয়ে লুকিয়ে বসলুম। আমাদের একটু দূরে গুরুদিৎ সিং তৈরি হয়ে রইল। কয়েক মিনিটের মধ্যেই সব ঠিকঠাক হল, আক্রমণ করবার জন্যে সকলেই প্রস্তুত হয়ে নিল। তারপর দলের মধ্যে থেকে কে একজন বাঁশি বাজিয়ে দিলে— যেন ফুটবল ম্যাচ আরম্ভ হচ্ছে! সঙ্গেসঙ্গে ঢোল কাঁসার বিগল ও গগনফাটা কান ঝালাপালা তুমুল চিৎকার— সে এক বিরাট কাণ্ড! কখনো যা আগে নিজের চোখে দেখিনি, বা নিজের কানে শুনিনি— সেসব দেখে শুনে আমার সমস্ত শরীর একটা ভয়ানক উত্তেজনায় ও রোমাঞ্চে কীরকম হতে লাগল। এ-রকম অদ্ভুত অভিজ্ঞতা পূর্বে আমার জীবনে ঘটেনি। মনে হতে লাগল, ভাল্লুকের দল খেপে গিয়ে একেবারে হত্যাকাণ্ড না শুরু করে। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে নিজেকে সামলে নিলাম ও বাইরে আমার অভূতপূর্ব উত্তেজনার কিছুমাত্র প্রকাশ করলাম না।

টম পাশেই বন্দুক বাগিয়ে নিশ্চল স্থির দৃষ্টিতে একটা বিশেষ দিক লক্ষ করে বসে আছে, কিন্তু মাঝে মাঝে সেও যেন উত্তেজিত হয়ে কী-একটা অস্ফুট শব্দ করছে। মিনিট কয়েক সে বিকট বাজনা কোলাহল চলল, ও তারপরই সেই হইচই-এর মধ্যে একটা প্রকাণ্ড ভাল্লুক প্রায় ৫০ গজ দূরে আমাদের সামনে দৃষ্টিগোচর হল। আমার সমস্ত শরীর যেন হিপনোটাইজড হয়ে গেল এবং মুহূর্তেই টমের বন্দুক ভীষণ শব্দে গর্জে উঠল— গুড়ুম, গুড়ুম! দু-বার, তিনবার— গুড়ুম! মনে হল দেখলাম যেন, ভাল্লুকটা আছড়ে মাটিতে সটাং হয়ে পড়ে গেল, পড়বার পর সামনের জঙ্গলের জন্য তাকে আর দেখা গেল না। এদিকে আমরা উঠতেও পারছি না। হয়তো ঝাঁপিয়ে আসবে ভাল্লুকটার সঙ্গী বা প্রতিবেশী দু-চারটে। গুলির আওয়াজের সঙ্গে বাজনা কোলাহল হঠাৎ থেমে গেল। একটা সর্দারকে ইঙ্গিতে আবার বাজনা বাজাতে শুরু করতে বলা হল। আবার সেই তুমুল গগনভেদি চিৎকার উঠল এবং মিনিট পাঁচেক পরেই দেখা গেল— এক দিকের লোকের দল ঊর্ধ্বশ্বাসে পালাচ্ছে আর চেঁচাচ্ছে— যাক, বোধ হয় দু-একটা ভাল্লুক দু-এক জনকে জখম করে নিজের রাস্তা করে নিচ্ছে। শীঘ্রই আমাদের কাছে সে-দলের একটা লোক এসে পড়ল, দেখলাম গা দিয়ে রক্ত পড়ছে, তবে এমন কিছু নয়। বুঝলাম, পালাবার সময় কোন পাথরখণ্ডে তার পা ঠুকে গিয়েছে। লোকটাকে কিছু বলবার তখন সময় নেই, আমরা সামনের দিকে দৃষ্টি স্থির করে বসে রইলাম। আবার হঠাৎ বাজনা থেমে গেল— আর দুটো-তিনটে লোক নীচে থেকে চেঁচিয়ে উঠল, 'ভাগা—ভাগা—!' 'আরে কিধার ভাগা—কৌনসে গিয়া'—তার জবাব নেই, হঠাৎ সব একেবারে চুপচাপ। কিন্তু পরমুহূর্তেই কতকগুলো লোক হুড়মুড় করে এদিক-ওদিক ছিটকে পড়ল! টম বসেই তাক করেছিল; ওদের কাণ্ড দেখে— উত্তেজনায় সে উঠে দাঁড়াল। তার মুখ লাল হয়ে উঠেছে, আমিও লোকগুলোর বোকামি বুঝলাম। চেঁচামেচি বন্ধ করাটা তাদের অত্যন্ত অন্যায় হয়ে গিয়েছে— চেঁচামেচি করতে থাকলে ভাল্লুক কিছুতেই তাদের ব্যূহ ভেদ করে যেতে পারত না। আমাদের সামনের পালাবার একমাত্র রাস্তাতেই ভাল্লুককে আসতে হত। কিন্তু এর পরে অনেক কাণ্ড ঘটল, কোনো দল এদিকে নামে— কোনো দল ওদিকে ওঠে, তারপর আমরা ভাল্লুকের পেছনে, কি ভাল্লুক আমাদের পেছনে— তুমুল ছত্রভঙ্গের মধ্যে সব গোলমাল একাকার হয়ে গেল! হাঁপাতে হাঁপাতে আবার আমরা পূর্বেকার জায়গায় এসে দাঁড়ালাম। টম বললে, সেন, দেখলে এদের বোকামি! আমি হেসে বললাম, এদের ব্যাপারই ওইরকম টম, গরিলা যুদ্ধ, এরা নিয়মিত শৃঙ্খলাবদ্ধ হয়ে কাজে নামতে জানে না। মাঝখান থেকে আমাদের নাকাল করে মারলে। আর আমরাও যে পাকা শিকারি নয় তাও বোধ হয় ওরা ধরতে পেরেছে! যাক, যেটাকে গুলি করা হয়েছে কিছুক্ষণ আগে, সেটাকে দেখা যাক। এগিয়ে ঢালুতে একটু নেমে দেখা গেল, সেটা সত্যিই মরেছে। প্রকাণ্ড জানোয়ারটা— তার চারটে মোটা পুরু থাবার তীক্ষ্ন নখগুলো তখন বেরিয়ে বেঁকে শক্ত হয়ে আছে! গায়ের লোম বোধ হয় ৬ ইঞ্চি ঘন হবে— সুন্দর কালো নরম লোম। একটা গুলি বুকের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেছে আর একটা কাঁধ দিয়ে। সেখানটা রক্তাক্ত হয়ে আছে। টম বললে, সেন, আমাদের অনেক তপস্যার ফল এবং আমরা নিশ্চয় খুশি হয়েছি। কিন্তু বেটাদের বোকামি না থাকলে অন্তত আরও একটা আমাদের হাতে মরত। নেহাত ভাল্লুকগুলোর আয়ুর জোর ছিল।

তারপর প্রায় সমস্ত দিন আমাদের কাজে ঘুরেছিলাম, কিন্তু শিকার আর মেলেনি। এটা একটু আশ্চর্য লাগল— কারণ, শোনা গিয়েছিল সাপুর ভাল্লুকে ভরতি। তবে কি তারা আমাদের আসার গন্ধ পেয়ে রাত্রি থাকতেই সব দূরে দূরে সরে পড়েছে! যাহোক সন্ধ্যার সময় ক্লান্তিতে মরিয়া হয়ে আমরা তাঁবুতে পৌঁছোলাম। দুজনেই খিদেতে একেবারে অস্থির হয়ে পড়েছিলাম। মিশ্রিখান জানত— সে আমাদের জন্যে খাসা ডিনার তৈরি রেখেছিল।

পরের দিন ভোরবেলা পুঞ্চের উদ্দেশে পাহাড়ি ঘোড়ার পিঠে লটবহর নিয়ে আবার আমরা যাত্রা করলাম। সেদিন ছিল ২০ অগাস্ট। তারপর কাজের মধ্যে দিয়ে, পাহাড়-পর্বত, নদী, জঙ্গল অতিক্রম করতে করতে পুঞ্চ হয়ে নিত্যনতুন জায়গায় তাঁবু ফেলতে ফেলতে আমরা ১৫ সেপ্টেম্বর রাওয়ালপিণ্ডি পৌঁছোলাম। রাওয়ালপিণ্ডি এসে (যখন আমরা বৈদ্যুতিক আলো দেওয়া পিচ ঢালা রাস্তা দিয়ে চলেছিলাম) মনে হতে লাগল— যেন একযুগ পরে সুদূর আফ্রিকা বা অস্ট্রেলিয়ার কোনো জঙ্গল থেকে আমরা এইমাত্র এক সভ্যজগতে এসে পৌঁছোলাম। সব কিছু— বাড়ি-ঘর, লোকজন আমাদের চোখে আশ্চর্য অস্বাভাবিক গোছের লাগতে লাগল। টম বললে, সেন, দেশে গিয়ে স্কটল্যান্ডের কোনো মাসিক কাগজে আমাদের পুঞ্চ-ভ্রমণ-কাহিনি আমি নিশ্চয় লিখব। আমি বললাম, আমিও টম, বাংলা দেশে কোনো মাসিক পত্রিকাতে একদিন সব লিখব।

সকল অধ্যায়

১. সুন্দরবনের শেষপ্রান্তে
২. শিকারের সন্ধানে
৩. নির্ভীক
৪. শিকারীর ক্ষোভ
৫. শিকারীর ভয়াবহ অভিজ্ঞতা
৬. বিপর্যয়
৭. হাওদা শিকার
৮. হাওদায় বসিয়া শিকার
৯. শিকারের কথা
১০. একদন্তের শেষ
১১. প্যান্থার
১২. মাচা থেকে চিতা ও অন্যান্য
১৩. জঙ্গলের ভ্রূকুটি
১৪. মহিষ
১৫. বীভৎস
১৬. কুমীর শিকার
১৭. হিমালয়ে ভল্লুক শিকার
১৮. কোয়াড়ে ভালুক শিকার
১৯. ভালুকের কবলে
২০. বাজ-বহেরী
২১. পদ্মায় পক্ষী শিকার
২২. পরিশিষ্ট
২৩. শিকারের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম
২৪. শিকার, শিকারী ও জীবজন্তু সম্বন্ধে বিবিধ জ্ঞাতব্য তথ্য
২৫. বন্দুক, বন্দুকের প্রকার ও ব্যবহার সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞাতব্য তথ্য
২৬. বাঙালির শিকারের আগ্নেয়াস্ত্র
২৭. ভারতের ব্যাঘ্র প্রকল্প
২৮. সহায়ক বাংলা পুস্তক তালিকা

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন