বিশ্বদেব গঙ্গোপাধ্যায়

সূর্যকান্ত আচার্য
গল্প করিতে করিতে আমরা বৈতরণী নদী উপম ছিটগড়ের সম্মুখীন হইলাম। মাহুতগণ 'আল্লা আল্লা' ধ্বনি করিয়া কণ্টকাকীর্ণ সূচীদুর্ভেদ্য ছিটগড়ের মধ্যে হাতী প্রবেশ করাইল। গাঢ় ঘন অটবী; চতুর্দিকে স্তূপে স্তূপে অন্ধকার; কাঁটা, ডালপালার ও লতার ভয়ে আমরা শঙ্কিত চিত্তে হস্তীপৃষ্ঠে বসিয়া আছি। হাতী কোথায় যাইতেছে, কোন দিকে টানিয়া নিতেছে, কিছুই দৃষ্টিপথে পতিত হইতেছে না— অন্ধকার, ঘোর অন্ধকার! কেবল মাঝে মাঝে মাহুতগণের মার-মার, ধর-ধর, শব্দের সঙ্গে সঙ্গে হাতীর জঙ্গল ভাঙার মড়-মড়, কড়-কড় বিকট শব্দ শোনা যাইতেছে। আর ক্বচিৎ কোথাও দুই-একটি ঘুঘু পাখী শব্দাতঙ্কে শঙ্কিত হইয়া, সভয়ে সরসর করিয়া কুলায় হইতে উড়িয়া পলাইতেছে, এই অনুভব হইতে লাগিল। এই অটবীকেই বৈতরণী বলিয়াছি। এই বৈতরণী পার হইতে না পারিলে আর সেই স্বর্গস্থান— শিকারভূমিতে উপস্থিত হইবার দ্বিতীয় পথ নাই। অনেক হুড়াহুহুড়ি, অনেক ধস্তাধস্তির পর বিক্ষত না হইলেও, ক্ষত দেহে ছিটগড়ের বাহির হইলাম। 'দুর্গা' বলিয়া হাপ ছাড়িয়া বাঁচিলাম। হাতীগুলি গুরুতর শ্রমের পর ফসফস করিয়া দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করিল। মাহুতগণ 'আল্লা-রসুল' বলিয়া বিরাম লাভ করিল। ক্রমে ক্রমে সমুদায় হাতী, জঙ্গল হইতে বাহির হইয়া আসিল। গায়ের কোট, হাতীর গদী ভালরূপে ঝাড়িয়া-পুছিয়া আমরা দৃঢ়রূপে প্রস্তুত হইয়া বসিলাম। ফরাজী মিঞার হাতী, আমার হাতীর নিকটে আসিল, এবং আমাকে আরও একটু অগ্রসর হইতে বলিল। কিছু সম্মুখে যাইয়াই দেখিতে পাইলাম, এক পল্লবিত শাল গাছের একটি ঝোপের মধ্যে শৃঙ্গধারী তরুণ বয়স্ক একটি সুন্দর গাউজ দাঁড়াইয়া আছে। আমি স্পষ্ট উহার সর্বশরীর দেখিতে পাইলাম, বাবুর হাতীও পাশে ছিল। জানি না, আমি কেন নিজে গুলি না করিয়া বাবুকে হরিণটি অঙ্গুলি নির্দেশপূর্বক দেখাইয়া দিলাম। বাবু অমনি বন্দুক উঠাইয়া 'ধা' করিয়া উহার উপর গুলি নিক্ষেপ করিলেন। কিন্তু ধীরতাসহ লক্ষ্য না করায় (excited হওয়ায়) উপযুক্ত স্থানে গুলি বিদ্ধ না হইয়া, উহার পিছনের এক পায়ে গুলি লাগিয়া গাউজটি খোঁড়া হইয়া দৌড়াইতে লাগিল। বাবু উহার পশ্চাৎ অনুসরণ করিলেন। আমরা আর অগ্রসর হইলাম না, অল্পক্ষণ পরেই কিছু দূরে বন্দুকের আওয়াজ শুনা গেল এবং অগ্রসর হইয়া দেখিতে পাইলাম, গাউজ পড়িয়াছে, হরিণ-সম্মুখে করিয়া বন্ধুবর দণ্ডায়মান। গাউজটি হাতীতে উঠাইয়া বাবুকে ধন্যবাদ এবং উৎসাহ দিতে দিতে আমরা পুনরায় শিকারের উদ্দেশে বাহির হইলাম।

কিছুদূর অগ্রসর হইয়াছি, অনতিদূরে একটি বিলের মত স্থান দৃষ্টিপথে পতিত হইল। খুজী মিঞাকে জিজ্ঞাসা করায় সেও উহাকে একটি বিল বলিয়াই নির্ণয় করিল, অধিকন্তু বলিল, ঐ স্থানে প্রচুর পরিমাণে বন্য মহিষ থাকে, ওখানে গেলে পাওয়ার বিশেষ সম্ভাবনা। মহিষের কথা শুনিয়া অন্যান্য হাতী পশ্চাতে রাখিয়া ধীরে ধীরে আমরা বিলের দিকে অগ্রসর হইতে লাগিলাম। এবং কতকটা নিকটবর্তী হওয়া মাত্র দেখিতে পাইলাম, অন্যূন পঞ্চাশ কি ষাটটি মহিষ জল হইতে উঠিয়া আমাদের দিকে একবার চাহিয়া, এক লাইনে (একটির পাছে, অন্যটি) জঙ্গলাভিমুখে চলিল। কর্দমাক্ত মহিষপাল দেখিয়া বোধ হইল, যেন একখানা চলন্ত মাটির দেয়াল আস্তে আস্তে চলিয়া যাইতেছে। এই তামাসা দেখিতেছি, ইতিমধ্যে মহিষপাল বন্দুকের 'পাল্লা' ছাড়াইয়া অনেকটা দূরে যাইয়া পড়িল, সুতরাং আর উহাদের উপর আওয়াজ করা হইল না। এ যাত্রা মহিষের তামাসা দেখিয়া তৃপ্ত হইলাম, আবার লাইন করিয়া হরিণের উদ্দেশে চলিলাম। পথে শিকারীগণ দুইটি হরিণ শিকার করিল, বাবুও আর একটি জাত-হরিণ মারিলেন। আজ তাঁহার বিলক্ষণ সুযাত্রা। দুই-দুটা শিকার, বড়ই স্পর্ধার বিষয় সন্দেহ নাই। আমরা যাইতেছি, পথিমধ্যে একটি ঝোপের আড়ালে ছোট খাটুয়া হরিণ আমার 'শিকারী ছোকরার' নজরে পড়িল, সে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া আমাকে ঐ হরিণটি দেখাইল। আমি ছররা (buck-shot) নিক্ষেপ করিলাম, হরিণটি তাহাতে না পড়িয়া, খোঁড়া হইয়া ছুটিতে লাগিল। তখন বেলা অধিক হইয়াছে, প্রখর সূর্যের তাপ! টিফিনের নিমিত্ত আমরা ছায়ার অনুসন্ধান করিতেছি, দূরে এক প্রকাণ্ড বটগাছ দৃষ্টিপথে পতিত হইল। এই স্থানেই বিশ্রাম করা হইবে, বটগাছের নিকটে একটি পুরাতন পুষ্করিণী আছে একথা খুজী সাহেব বলিলেন। আমরা ঐ বটগাছ লক্ষ্য করিয়াই হাতী প্রধাবিত করিলাম। আমরা যখন উক্ত বটগাছের সম্মুখীন হইয়াছি, তখন দেখিতে পাইলাম, আমার আহত হরিণের ন্যায় একটা ছোট হরিণ ঘাসবনের মধ্য হইতে বাহির হইয়া দৌড়াইয়া পলাইতেছে। আমাদিগকে ঐখানেই নামিতে হইবে, সুতরাং আমি তাড়াতাড়ি হাতী হইতে নামিয়া 'জলদ কদমে' হরিণের পাছে ছুটিলাম। ভরসা, উহাকে সহজেই শিকার করিয়া আনিতে পারিব। কিন্তু যখন উহার অনুসরণ করিলাম, তখন আর হরিণ দেখিতে পাই না। সম্মুখে কাঁটা শালগাছের একটা প্রকাণ্ড 'টাল' দেখিতে পাইয়া ভাবিলাম, উহার উপরে উঠিয়া দাঁড়াইলে কোথায় হরিণটি আছে, তাহা সহজেই লক্ষ্য করিতে পারিব। উহার উপরে উঠিলাম—
''সুখ দুঃখ, সম্পদ বিপদ,
কালচক্রে ঘোরে পদে পদে,
তাহার মাঝেতে নর,****করে বাস নিরন্তর,
শৃঙ্খলেতে যথা চতুষ্পদ।''
বিপদ মানুষের পদে পদে! বিপদ-আপদের সমষ্টি লইয়াই মানব জীবন! কখন কি হইবে, কেহই বলিতে পারে না, কি বুঝিতেও পারে না, কারণ তখন বুদ্ধিবিপর্যয় ঘটে!
আমি যেমন ঐ শালগাছের টালের উপর উঠিলাম, ও সম্মুখে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিলাম, অমনি আমার মাথা ঘুরিয়া গেল, আত্মা কাঁপিয়া উঠিল, দেখিলাম কিনা, এক প্রকাণ্ড ভালুক ঐ স্তূপের আড়ালে ছায়াতে শায়িত, আমাতে উহাতে ব্যবধান অনুমান আট কি দশ হাতের অধিক হইবে না। যেমনি আমি টালের উপরে উঠিয়াছি, অমনি বিকট গর্জন করিয়া ঐ জঙ্গলভূমিকে কম্পিত করিল এবং লম্ফ দিয়া দণ্ডায়মান হইল। নিরুপায়! তখন যদি পলাইতে চেষ্টা করি, নিশ্চয় আক্রমণ করিবে, সে আক্রমণ নিবারণের উপায় আমার দ্বারা সম্ভব হইবে না! স্তূপ হইতে নামিলে ভালুকের হাতে মৃত্যু নিশ্চয়! ভালুক দুই পায়ে ভর করিয়া, ঠিক মানুষ যেমন দাঁড়ায়, তদ্রূপ অবস্থায় দাঁড়াইয়া বাহুদ্বয় প্রসারণপূর্বক চীৎকার করিয়া অগ্রসর হইতে লাগিল। আমি অনুপায় হইয়া খুব জোরে 'চুপরাও' বলিয়া তাহার চীৎকারের প্রতিজবাব দিলাম। টিফিনের স্থান এখান হইতে বড় বেশী দূরে নহে, উদ্দেশ্য, ভালুকের গর্জন এবং আমার চীৎকার শুনিয়া বন্ধুবর অন্যান্য লোকসহ নিশ্চয়ই সাহায্য করিতে আসিবেন। কিন্তু হায়! এই দুঃসময়ে কেহই আসিল না, কেহই আমার এই বিপদের সাথী হইতে অগ্রসর হইল না!
ভালুক ক্রমে আরও অগ্রসর হইতে লাগিল, পুনঃপুনঃ কর্কশ গর্জনে বনস্থলী প্রকম্পিত করিল। আমি পুনরায় 'চুপরাও' বলিয়া ধমক দিলাম। তাহাতে মাত্র দুই-তিন পা পশ্চাতে হটিল। স্থির করিলাম, ভালুক আমার সহিত খেলা করিতে আসে নাই, আমি তাহার খেলার দোসর নহি; সে দুর্দান্ত, আমি শান্ত, সে আমাকে কিছুতেই ছাড়িয়া যাইবে না।
বন্দুক লইয়া ঠিক হইয়া দাঁড়াইলাম। পকেট হইতে দুইটি গুলির কার্তুজ বাহির করিয়া বন্দুকে পুরিলাম এবং সতর্কতার সহিত ভালুকের গতিবিধির উপর লক্ষ্য করিতে লাগিলাম। এখানে বলা প্রয়োজন, বাঘ-ভালুক কর্তৃক কেহ আক্রান্ত হইলে, চক্ষের উপর তাহার স্থির লক্ষ্য রাখা একান্ত কর্তব্য; প্রবাদ আছে, 'বাঘ-ভালুকের চারি চক্ষে লজ্জা'—এ কথাটা একেবারে মিথ্যা নয়, ঠিক।
ভালুক এইবার সতেজে আমাকে যেমনি আক্রমণ করিতে অগ্রসর হইল, তাহার বুকের সাদা স্থান লক্ষ্য করিয়া, অমনি আমি গুলি করিলাম— এক গুলিতেই ভালুক ওলট পালট খাইয়া ধরাশায়ী হইল। আমি ভগবানের মহিমাকে ধন্যবাদ দিয়া লম্বা কদমে টিফিনের স্থানে উপস্থিত হইলাম। আর আনুপূর্বিক ঘটনা বাবুর নিকট বিবৃত করিয়া তাঁহাদের ভীরুতায় ধিক্কার দিতেও ত্রুটি করিলাম না। কিন্তু সকলেই আমার সংকটাপন্ন অবস্থা এবং ভালুকের চীৎকার শুনার বিষয় একস্বরে অস্বীকার করিলেন। আমিও তাঁহাদের কথা স্বীকার করিয়া লইলাম। ভালুক আনিতে হাতী পাঠাইয়া টিফিনে বসিলাম। বেলা প্রায় অবসান, শিকারও যথেষ্ট হইয়াছে, অতএব তাঁবুতে ফেরাই সেইদিন স্থির করা হইল।
(বানান অপরিবর্তিত)

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন