বিশ্বদেব গঙ্গোপাধ্যায়

ব্রজেন্দ্রনারায়ণ আচার্য চৌধুরী
অনেক শিকারি মনে করেন শিকার করবার সময় জানোয়ারের ঘাড়ের উপর গিয়া না পড়িলে বাহাদুরী কিছু কম হয়। কিন্তু বিশেষ কোন কারণ ব্যতীত, কোন সময়েই কোন শিকারের একেবারে ঘাড়ের উপর গিয়া হাতী লইয়া পড়া উচিত নয়। ইহাতে বিপদের সম্ভাবনা তো আছেই, অধিকন্তু হাতীর উপর হইতে খাড়াভাবে ঘাস কি ঝোপ-জঙ্গলে নীচের দিকে দেখা যায় না বলিয়া শিকার করা চলে না। একটু দূর হইতেই বরং তেরছা ভাবে ভাল দেখা যায়; কাজেই শিকারীর একটু দূরে থাকাই ভাল। একবার এইভাবে বাঘের ঘাড়ে গিয়া পড়াতে, আমাদের পার্টির এক শিকারীর যেরূপ বিপদ ঘটিয়াছিল, তাহা বলিতেছি—
বাংলা ১৩০৪ সনের ভীষণ ভূমিকম্পের পর, কিংবা তার পরের বছর আমরা 'দুদুং-এর থলে' (থল একটি উলুখড় সমাকীর্ণ বহুদূর বিস্তীর্ণ জঙ্গল) শিকার করিতে যাই। সেবার আমাদের পার্টিতে মনুবাবু, মহেশবাবু ও আমি ছিলাম। আমাদের ইচ্ছা ছিল, থলে শিকার করিবার পর, সুসঙ্গ-এর মধ্য দিয়া পূর্বাভিমুখে সিলেটের দিকে কতকদূর অগ্রসর হইব। আমাদের বাহাদুরপুর কাছারীর নিকটবর্তী পোড়াপুঁঠিয়া গ্রামে, একটি অতি বিস্তীর্ণ জলাশয়ের ধারে আমরা প্রথমে 'ক্যাম্প' করি। এই জলাশয়টি এককালে বাহিত নদী ছিল, পরে উহার স্রোত বন্ধ হইয়া ডোবায় পরিণত হইয়াছে। যাহারা হাজারিবাগের হ্রদ দেখিয়াছেন, তাঁহারা ইহার বেশ ধারণা করিতে পারিবেন।
আমরা বরাবরই 'থলে' যাইবার পথে এই স্থানে দু-তিন দিন থাকিয়া হল্ট করিয়া যাইতাম। কারণ, ইহার নিকটেই লেপার্ডের খুব ভালো ভালো কয়েকটি জঙ্গল আছে। বহুদূর বিস্তীর্ণ স্বভাবসুন্দর এই জলাশয়ের তীরে সারি সারি তাঁবু পড়িয়া স্থানটিকে আরও সুন্দর করিয়া তুলিত। আমরা এই স্থানে দুই দিন থাকিয়া তিন-চারটি বাঘ মারিয়া 'থলে' চলিয়া গেলাম। আমাদের অঞ্চল 'থল' Hog-deer শিকারের একটি প্রসিদ্ধ স্থান।
'থলে' বাঘের কয়েকটি বড়ো বড়ো প্রিয় ঘন জঙ্গল আছে। ঐসব জঙ্গলে অনেক সময়ই বাঘ পাওয়া যায়। ইহা ছাড়া 'থলের' নিকটবর্তী ভিন্ন ভিন্ন গ্রামে অনেক ছোট ছোট জঙ্গল আছে, তাহাতেও সময় সময় দুই একটি লেপার্ড পাওয়া যাইত। কিন্তু সেবার কি জানি কেন, বহু লেপার্ড আসায় এই সব জঙ্গল ভর্তি হইয়া গিয়াছিল। যে জঙ্গলেই যাইতাম, দু-একটা করিয়া লেপার্ড পাওয়া যাইত। একদিন পাঁচটা পর্যন্ত পাইয়াছিলাম। সেবার বাঘের এত আমদানী দেখিয়া, আমরা বে-খবরেই নিকটবর্তী গ্রামসমূহের জঙ্গল ঠেঙ্গাইয়া বেড়াইতাম এবং প্রতিদিনই দু-তিনটি করিয়া লেপার্ড পাইতাম। এই স্থানে সেবার চার পাঁচ দিনে চোদ্দ পনেরোটি লেপার্ড শিকার করা হয়।
এইরূপে একদিন 'চালিতাখালি' গ্রামের নিকটবর্তী কোন জঙ্গলে গিয়া একটি লেপার্ড পাই। ঐ স্থান আমাদের 'ক্যাম্প' হইতে ৫।৬ মাইল দূরে ছিল। জঙ্গলটি বেশ ঘন এবং একটি শুষ্ক নালার মধ্যে অবস্থিত ছিল। লম্বায় প্রায় দুই ফার্লং এবং চওড়ায় কোন কোন স্থানে এক ফার্লং এবং কোথাও বা কিছু কম হইবে।
সেদিন আমাদের কি অযাত্রা ছিল যে বাঘটিকে কিছুতেই মারিতে পারিতেছিলাম না। আমরা তিনজনে উহার উপর বহু গুলি বর্ষণ করিয়াও কিছুই করিতে পারিলাম না; কারণ একে ঘন নল বন, তাহার মধ্যে আবার খুব ঘন ঘন গুজার ঝোপ বিঘ্ন জন্মাইতেছিল। (গুজা একরূপ বুনো কাঁটা গাছ। ইহারা এক-একটি ঝোপের মত হয় ও ইহাতে সাদা সাদা ফুল হয়। ইহাকে ইংরেজীতে Bush rose বলে)। এক ঝোপ হইতে আর এক ঝোপে লাফাইয়া যাইবার সময়, snap shot ছাড়া নিশানার কোন সুযোগ পাওয়া যাইত না। (যে সব আওয়াজের সময় বন্দুকের নল জানোয়ারের দিকে রুজু করিয়া চোখ না বুজিয়াই আওয়াজ করা হয় তাহাকে snap shot বলে। ইহাতে অনেক সময় বন্দুক বুকে লাগান যায় না। খুব অভ্যাস না থাকিলে এইরূপ shot মারা যায় না)। ক্রমাগত পাছে পাছে দৌড়াদৌড়ি করিতে করিতে জঙ্গল অনেকটা পা'ট হইয়া আসিয়াছিল। যতই জঙ্গল পা'ট হইতে লাগিল, বাঘের বিক্রম যেন ততই বাড়িতে লাগিল। তখন আর সহজে এক ঝোপ হইতে অন্য ঝোপে বাহির হইতেছিল না। ঝোপের নিকট হাতীর মাথায় লাফাইয়া উঠিত। এইভাবে ক্রমাগত 'চার্জ' করিয়া পাঁচ-সাতটা হাতীকে বেশ ঘায়েল করিল। ইহার পর লাইনের অবস্থা অতি শোচনীয় হইয়া দাঁড়াইল; মাহুতদের মনেও প্রবল ত্রাস উপস্থিত হইল। কোন কোন মাহুত 'পীরের বাঘ, মারিয়া কাজ নাই', কেহ বা 'ইহা দেবাংশী, ইহাকে মারা যাইবে না,' ইত্যাদি যাহার মুখে যাহা আসিল তাহাই বলিয়া ফিরিয়া যাইতে উপদেশ দিতে লাগিল। স্থূল কথা, মাহুতেরা অত্যন্ত ভীত হইয়াছিল বলিয়াই এইরূপ নানা উপদেশ দিতেছিল। আমাদের নিশানার উপর উহাদের বিশেষ আস্থা ছিল, কিন্তু এখানে ক্রমাগত বিফলতায় বোধহয় উহাদের মন দমিয়া গিয়াছিল। এরপর আমরা স্থির করিলাম 'বীটার' হাতী ছাড়া আমাদের তিন হাওদা লইয়াই চেষ্টা করিয়া দেখিব। তদনুসারে হাওদা তিনটি পাশাপাশি করিয়া, আমরা এ-ঝোপ সে-ঝোপ, দেখিতে দেখিতে অগ্রসর হইতে লাগিলাম।
মহেশবাবুর হাওদা, রাজা জগৎকিশোরের 'শম্ভুপ্রসাদ' নামক দাঁতালের (tusker) উপর ছিল। বোধহয় 'শম্ভুপ্রসাদ' বাঘের ঘাড়েই পাড়া দিবার উপক্রম করিয়াছিল, অথবা কি কারণে বলিতে পারি না, হঠাৎ বাঘের ডাক শুনিয়া মহেশবাবুর হাওদার দিকে তাকাইয়া দেখি, বাঘ 'শম্ভুপ্রসাদে'র মাথায় উঠিয়া কামড়াইয়া ধরিয়াছে; কিন্তু শরীরটা হাতীর কানের পাশ দিয়া ঝুলিতেছে। হাতী চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া আছে, কিন্তু তাহার প্রকাণ্ড কান দুইটা ফাঁক করিয়া মেলাইয়া দিয়েছে। (এইভাবে হাতীর কান ফাঁক করিয়া দাঁড়ানোকে কান ফাঁদাইয়া দাঁড়ান বলে।) সেই সঙ্গে মহেশবাবু, হাওদার সম্মুখে ঝুঁকিয়া 500 Express rifle দিয়া বাঘকে নিশানা করিতেছিলেন। হাতীর কানে বাঘ ঢাকা পড়িয়া গেলেও তিনি মনে করিতেছিলেন, বাঘকেই নিশানা করিতেছেন। আমরা এই অবস্থা দেখিয়া ক্রমাগত চেঁচাইয়া গুলি মারিতে নিষেধ করিতেছি; কিন্তু তাঁহার সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নাই। মহেশবাবু এত উত্তেজিত হইয়া পড়িয়াছিলেন যে, আমাদের চীৎকার তাঁহার কানে পৌঁছে নাই। তিনি দম করিয়া হাতীর কানেই গুলি করিয়া বসিলেন। বন্দুকের আওয়াজে বাঘ হাতী ছাড়িয়া দিয়া লাফাইয়া আর এক ঝোপের ভিতর ঢুকিল। এদিকে মাহুতও 'আমাকে মারিয়া ফেলিয়াছে' বলিয়া আর্তনাদ করিয়া উঠিল। দেখা গেল, Express-এর shell গুলি, হাতীর কানে লাগিয়া কাটিয়া টুকরা-টুকরা হইয়া গিয়াছে ও তাহারই কয়েক টুকরা মাহুতের পায়ে বিঁধিয়া গিয়াছে।
সৌভাগ্যের বিষয় এই যে, মাহুতের জখম মাত্র চর্মভেদ করিয়াছিল, কিন্তু হাতির কান ছিঁড়িয়া গিয়াছে। এই অবস্থা দৃষ্টে মহেশবাবুর মুখ চুন হইয়া গেল। তাড়াতাড়ি হাতী সরাইয়া নিয়া হাওদা খুলিয়া ফেলা হইল। হাতীর কানের বড়ো বড়ো শিরা হইতে ফিনকি দিয়া রক্ত বাহির হইতেছিল। হাওদা বদলাইতে যে সময় লাগিল, আমার মনে হইল, ইহাতে বুঝি দু-তিন ঘটি রক্ত পড়িল। ইহার পর হাতীকে 'ক্যাম্পে' লইয়া গিয়া নদীতে ফেলিয়া লোহা পোড়ার দাগ দিয়া, তবে রক্তস্রাব বন্ধ করা হয়। অজস্র রক্তস্রাবে হাতীকে সেদিন একটু অবসন্ন বোধ করায়, এক বোতল No. 1 ব্রাণ্ডি একেবারে খাওয়াইয়া দেওয়া হইল। কিন্তু পরদিন হাতীর আর বিশেষ কোন দুর্বলতা অনুভব করি নাই। রক্তস্রাব বন্ধ হওয়া পর্যন্ত খুব কম হইলেও এক কলসী রক্ত পড়িয়াছিল। এত রক্তপাতেও ক্ষণিক দুর্বলতা ছাড়া, তার আর কিছুই অসুবিধা উপলব্ধি করিতে পারি নাই। হাতি ছাড়া অন্য কোন জানোয়ার হইলে এ অবস্থায় মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী ছিল।

মাহুতকে পাঁচ-সাত দিন ক্যাম্প হাসপাতালেই থাকিতে হইয়াছিল। বেচারা আরোগ্যলাভ করিয়া আড্ডাস্থিত অন্যান্য মুসলমানদিগকে খুব বড় একটা 'খোদা'র সিন্নি দিয়া ভোজ দিয়াছিল। তবে এই অর্থ মহেশবাবুর পকেট হইতে বাহির হইয়াছিল কিনা বলিতে পারি না।
বাঘটি এইভাবে আমাদিগকে 'নাকাল' করিয়া, পরে আর কিন্তু মোটেই কষ্ট দেয় নাই। বোধহয় সে তখন মনে করিয়াছিল, 'আর কেন, তোমাদের যত ক্ষমতা দেখা গেল, এখন অস্ত্র ত্যাগ করিলাম।' তবে ভীষ্মদেবের মত সে কাহাকেও 'শিখণ্ডি' বলিয়া ভ্রম করিয়াছিল কিনা, তাহা বলিতে পারি না। লেপার্ড হইলেও, ইহা মাপে প্রায় আট ফিট ছিল। এত বড়ো লেপার্ড সচরাচর খুব কমই দেখা যায়।
(বানান অপরিবর্তিত)
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন