শিকারের কথা

বিশ্বদেব গঙ্গোপাধ্যায়

ভূপেন্দ্রচন্দ্র সিংহ

 

বনে-জঙ্গলে ঘুরিয়া বেড়াইবার সুযোগ যাঁহারা পান, নিতান্ত নিরুৎসুক দৃষ্টি লইয়া চলিলেও বন্যজীবনে অতি বিস্ময়কর ঘটনা কখনও কখনও ঘটিতে দেখা তাঁহাদের পক্ষে অসম্ভব নহে। যাঁহারা কল্পনার আশ্রয় না লইয়া অতি যথাযথভাবে এইসব ঘটনা সাধারণ সহজ জীবন-যাপন-পন্থী অথবা কেবল কল্পনা-বিলাসী ব্যক্তিগণের নিকট উপস্থিত করেন, তাঁহারাও এই শ্রেণীর লোকের স্বভাব-সুলভ হালকা সমালোচনায় উদব্যস্ত বোধ করেন। মনুষ্য-জীবনের বাস্তব বৈচিত্র্যও যেমন সময় সময় কল্পনার সীমা অতিক্রম করিয়া যায়, তেমনই বন্য-জগতে এরূপ ঘটা বিস্ময়কর নহে। ইহা মনে রাখিলে আপাততঃ অবিশ্বাস্য ঘটনাও অন্য দৃষ্টিতে দেখা চলে। কর্মবিমুখ পাণ্ডিত্যাভিমানী বুদ্ধিজীবীর সাহায্যে অদৃষ্ট-জগতের রমণীয় ও মোহকারী চিত্র আমাদের দেশে নানা কারণেই সহজলভ্য হইলেও, পাশ্চাত্যদেশীয় জ্ঞানমিশ্রিত কর্মসাধন-পুষ্ট লোকের রচিত সত্য ও রসপুষ্ট রচনার পাশে সেইগুলির মেকি রূপ জ্ঞানী সমালোচকের দৃষ্টি এড়ায় না। লৌকিক জ্ঞানকে অনভিজ্ঞ লেখক যখন সাহিত্য পদবাচ্য করিবার অপচেষ্টা করিতে যান, তখন রচনাকে সাহিত্যরসিক ও বৈজ্ঞানিক দুয়েরই নিকট সমভাবে অস্পৃশ্য করিয়া তোলেন। সুতরাং পাঠকবর্গকে প্রথমেই সতর্ক করিব— এই প্রবন্ধে লিখিত ঘটনা সত্যই ঘটিয়াছে, তবে এই সংকলনে প্রকাশের জন্য অসাহিত্যিক ও অবৈজ্ঞানিকের লেখা হওয়ায় তাহা যেন অসত্য বলিয়া উপেক্ষিত না হয়। এই প্রবন্ধে সন্নিবেশিত ঘটনা কাল্পনিক মোহগ্রস্ত দৃষ্টি লইয়া দেখা নহে, ভরা বর্ষায় আসামের বনের ভিতর হাতী শিকারের চেষ্টায় ভ্রাম্যমাণ ব্যক্তির কষ্টার্জিত দৃষ্টিতে দেখা সত্য ঘটনার বর্ণনা।

বহু কারণে লেখকের হাতী সম্বন্ধে উৎসাহী হইবার যথেষ্ট সুযোগ ঘটিয়াছে। এতদিন পর্যন্ত হাতীর প্রতি একটা মোহকারী ভালবাসার ভাব লইয়া চলিয়াছিলাম— যথেষ্ট উত্তেজক কারণ থাকা সত্ত্বেও জগতের লুপ্তপ্রায় বিরাট প্রাণীসমূহের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন এই অতিকায় জন্তুগুলিকে সংহার করিবার ইচ্ছা আদৌ হয় নাই। এই প্রৌঢ় বয়সে হঠাৎ স্বাভাবিক বৃত্তির পরিবর্তন ঘটিয়া কেন যে ইহাদের বিনাশে উদ্যত হইলাম, তাহার উল্লেখ এইক্ষেত্রে অপ্রাসঙ্গিক হইবে। এইটুকু বলা চলে যে, এই পরিবর্তন ঘটায়, হাতীর দলের ভিতর সাহস করিয়া গিয়া তাহাদের বিচিত্র জীবনযাত্রার সহিত বিশেষ পরিচিত হইবার আরও অধিকতর সুযোগ পাইয়াছি। হাতী শিকার করিতে গিয়া হাতীর ভিতর সহানুভূতির প্রাবল্য কিরূপে প্রাণের মায়ার কথা পর্যন্ত বিস্মরণ করাইয়া দেয়, তাহার যে এক সুন্দর চিত্র দেখিয়াছি তাহারই বিবরণ দিবার চেষ্টা করিব।

 

গত বৎসর ভাদ্র মাসে গারো পাহাড়ের ডেপুটি কমিশনার মি. মিত্র জানাইলেন যে রাংথিয়াস্রিয়া গিরিতে দুইটি 'গুণ্ডা' হাতি লোকজনের কৃষি ও গৃহাদি নষ্ট করিতেছে। এই সংবাদ পাওয়ায় তিনি উহাদিগকে বিনাশ করিবার হুকুম দিয়াছেন— হাতী মারিবার হুকুম থাকায় আমি উহাদিগকে বধ করিয়া দন্ত চতুষ্টয় লইতে পারি।

আজকাল 'রোগ' হাতীর সম্বন্ধে বিস্ময়কর ঘটনার নানাপ্রকার উল্লেখ সংবাদপত্র ও মাসিকপত্রে প্রায়ই দেখা যায়। ইহাতে বাঙালী পাঠকের নিকট 'গুণ্ডা' হাতী সম্বন্ধে বিভিন্ন প্রকারের বাস্তব ও অবাস্তব ধারণা জন্মায়। 'খুনে' হাতী সম্বন্ধে বিশেষ কোনও নূতন তথ্যের উল্লেখ করিয়া সেই ধারণার কোনও পরিবর্তন ঘটাইবার চেষ্টা করিব না। হাতী শিকারের অভিজ্ঞতা আমার অত্যন্ত সীমাবদ্ধ। ইহার পূর্বে মারিবার উদ্দেশ্যে দুইটি হাতীকে গুলি করিয়াছি এবং দুই ক্ষেত্রেই সাফল্যলাভ করিয়াছি। নূতন শিকারী না হইলেও হাতী শিকার আমার নিকট নূতন, সুতরাং নূতন শিকারীর সৌভাগ্যই বোধ হয় আমার সাফল্যের পক্ষে এযাবৎ সহায়ক হইয়াছে। যাহাই হউক, সাফল্যের আনন্দে সহজেই ধরিয়া লইয়াছিলাম, যদি হাতীর দেখা পাই, তাহা হইলে এ যাত্রাও সাফল্য সুনিশ্চিত।

'খুঁজি' পাঠাইয়া দিয়াছি, হাতীর নিশ্চিত অনুসন্ধান জানিতে। যথাসময়ে সংবাদ আসিল যে হাতীসিয়া গিরিতে হস্তী দেখা গিয়াছে। হাতীসিয়া গিরি সুসঙ্গ হইতে বাইশ-তেইশ মাইল উত্তর-পূর্বে অবস্থিত— গারো পাহাড়ের ভিতর। স্থানটি আমার পরিচিত। কিন্তু যে কারণেই হউক এখানে যে কয়বার যখনই উপস্থিত হইয়াছি এবং যতদিন অবস্থান করিতে বাধ্য হইয়াছি, ততদিন এবং ততবারই বৃষ্টি পাইয়াছি। এই হাতীর সংবাদ আমি পূর্বেই জানিতাম। কিন্তু আমার জানা ছিল যে এই হাতীর সঙ্গে একটা হস্তিনীও থাকে। সুতরাং কেবলমাত্র দুইটি দন্তী 'রোগ-এর' কথা শোনায় কিছু সন্দেহের উদ্রেক হইতেছিল। প্রথমে গারো পাহাড়ের পাদদেশে বনবেড়া নামক স্থানে মূল ছাউনী করিয়া, হাতি যে সকল লোকের বাড়ী ভাঙিয়াছে ও কৃষি নষ্ট করিয়াছে, তাহাদের ভিতর যাহারা খুনী হাতী দুইটিকে নিশ্চিতরূপে চেনে, এইরূপ কয়েকজন লোক সঙ্গে লইবার ব্যবস্থা করিলাম।

বনবেড়ার তাঁবুর স্থান হইতে হাতীসিয়া— যেখানে থাকিয়া হাতী শিকার করিবার কল্পনা করিয়াছিলাম, তাহার দূরত্ব প্রায় দুই মাইল। সেখানে নেপালীদের একটা গরু ও মহিষের বাথান আছে। পাহাড়ের উপর হইতে যে পথে তাহারা প্রত্যহ দুধ নামাইয়া আনে, সেই পথেই আমাদের যাইতে হইবে। শুনিলাম, দুইদিন হাতীর উৎপাতে দুধ নামান সম্ভব হয় নাই। আমরা নেপালীদের বাথানের নিকটেই কোন স্থানে থাকিব— নতুবা পানীয় জল পাওয়া কঠিন হইবে। আমাদের সঙ্গে কেবলমাত্র নিতান্ত প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ভিন্ন অন্যান্য সমস্তই বনবেড়ার মূল ছাউনিতে রাখিয়া গেলাম।

নেপালীদের বাথানের কিছু উচ্চে আমাদের তাঁবু খাটাইয়া আস্তানা করিবার পর হইতে অবিশ্রান্ত বৃষ্টি হইতে থাকায় এখানে হাতী শিকার করা অসম্ভব হইয়া উঠিল। ততক্ষণে হাতিও এই স্থান ত্যাগ করিয়া অন্যস্থানে চলিয়া গিয়াছে। পঞ্চম দিনে বারিপাত কিছু প্রশমিত হইলে আমরা খারনৈ নদীর অপর পারস্থিত খুসিগিরি নামক বস্তিতে 'আলডা' করিয়া শিকার চেষ্টা করিব স্থির করিয়া এই স্থান ত্যাগ করিয়া যাত্রা করিলাম। বর্ষায় পাহাড়-পথ জঙ্গলাকীর্ণ হইয়া গিয়াছে, তাহার উপর পিছল ও জোঁকের উৎপাতে পথ চলা অতি কষ্টকর হইয়া উঠিয়াছিল। অবশ্য গত চারদিন পাহাড়-বাসে কষ্টের যে অভিজ্ঞতা হইয়াছে, তাহাতে নিজের সহিষ্ণুতা সম্বন্ধে আস্থা জন্মিয়াছিল বলিলে সত্যের অপলাপ হইবে না। মধ্যে মধ্যে ঘন বনের আড়াল হইতে রৌদ্রকিরণোজ্জ্বল, নব-জল-সিঞ্চনপুষ্ট গর্জনশীল ঝরনাগুলি তাহাদের জীবন্ত উল্লাসে প্রাণে পুলকের সাড়া জাগাইতেছিল। পথে এক জায়গায় সংবাদ পাইলাম যে, রাংথিয়াস্রিয়া গিরির জঙ্গলে কয়েকটা হাতী বাঁশ ভাঙিয়া খাইতেছে। হাতী কয়টি গত রাত্রিতে খুসিগিরির দিক হইতে পার হইয়া আসিয়াছে। আমরা আসিবার সময় পাঞ্জালী দিগকে (অর্থাৎ ট্র্যাকার দিগকে) রাংথিয়াস্রিয়া প্রভৃতি জায়গায় খোঁজ করিয়া খুসিগিরিতে যাইবার নির্দেশ দিয়াছিলাম; সুতরাং আমাদের আশা ছিল পাঞ্জালীগণ এখানকার সংবাদ অবশ্যই লইয়া যাইবে। আমাদের বেলা প্রায় দুইটার সময় খুসিগিরি বস্তিতে পৌঁছিলাম। গ্রামে কোনও লোক নাই, সব হাদাং-এ (অর্থাৎ ক্ষেতে) চলিয়া গিয়াছে। প্রকৃতপক্ষে বর্ষার কয়মাস গারোগণ ক্ষেত পাহারা দিবার জন্য ক্ষেতের ভিতর মাচান (বোরং) বাঁধিয়া তাহাতেই বাস করে। ক্বচিৎ কখনও কখনও গ্রামে আসিয়া আবশ্যকীয় কার্য করিয়া যায়। একটি লোক তখন হঠাৎ আসিয়া উপস্থিত হওয়ায় তাহার নিকট খোঁজ পাইলাম, গত রাত্রিতে হাতি নদী পার হইয়া রাংথিয়াস্রিয়ার দিকে চলিয়া গিয়াছে। সুতরাং পূর্বে প্রাপ্ত খবরের সহিত ইহার মিল ছিল।

 

আজ বেশ রোদ উঠিয়াছে— খুসিগিরির এক ধার দিয়া খারনৈ নদী ফেনিল উচ্ছ্বাসে উদ্দামগতিতে পাথরের উপর দিয়া আছড়াইয়া গর্জন করিতে করিতে চলিয়াছে; আর অপর দিক হইতে একটি স্রোতস্বিনী ভীষণ বেগে পাথর ঠেলিয়া আসিয়া মিশিয়াছে খারনৈ নদীতে। সুন্দর জল, নয়নাভিরাম দৃশ্য, পাথরের উপর বসিয়া ধ্যান করা চলে। যাহাই হউক আমরা তপস্বী নহি, সুতরাং এখানে শুধু ভালো করিয়া স্নান করিবার ইচ্ছা হইল। স্নান সারিয়া আমাদের জিনিসপত্র সব রৌদ্রে বিছাইয়া দিবার ব্যবস্থা করিতেছি, এমন সময় এক পাঞ্জালী আসিয়া সংবাদ দিল যে, প্রায় দুই-তিন মাইল দূরে হাতীর খোঁজ হইয়াছে, আমরা যেন অবিলম্বে চলিয়া আসি।

উল্লেখ করা ভাল যে, ইতিপূর্বেই আমরা গ্রামস্থ পান্থশালার (নকপান্থির) সম্মুখে পরিষ্কার প্রাঙ্গণে আমাদের জিনিসপত্র সব রাখিয়াছিলাম। গারো পাহাড়ে প্রায় গ্রামেই একটা উঁচু মাচান থাকে। সেটা গ্রামের অবিবাহিত পুরুষগণ এবং যে কোনও অতিথি ব্যবহার করিয়া থাকে। ইহাকে গারোরা 'নকপান্থি' বলে। নকপান্থিটি পরিষ্কার এবং অন্য কোনও লোক না থাকায় আমরা তাহাতেই রাত্রিযাপন কল্পনা করিয়াছিলাম। নকপান্থির সম্মুখে একটা কাটা গাছের উপর বসিয়া রোদ পোহাইতেছি, এমন সময় দেখি, প্রায় হাতখানেক লম্বা সবুজ রঙ-এর চেপটা মাথা এবং অপেক্ষাকৃত মোটা রকমের একটা সাপ হাঁ করিয়া আমাদিগকে লক্ষ্য করিয়া কামড়াইতে আসিতেছে। লাঠির ঘায়ে সাপ মারা হইল। কিন্তু সাপটাকে সম্পূর্ণভাবে নিহত করিতে শ্রীমান বিমলকে পাঁচ-ছয় বার আঘাত করিতে হইয়াছে, এবং অবশেষে দুই-চার ফোঁটা কার্বলিক এ্যাসিডও ব্যয় করিতে হইয়াছে। সাপ মারিলে শিকার পাওয়া যায় এ সংস্কার থাকায় আমরা বিশেষ উৎফুল্ল হইলাম।

কালবিলম্ব না করিয়া আমরা হাতির উদ্দেশে রওনা হইলাম। তখন বেলা প্রায় তিনটা বাজিয়াছে। খারনৈ নদী প্রায় সাঁতার দিয়া পার হইয়া অপর পারে পৌঁছিয়া অন্য খুঁজিদ্বয় যেখানে অপেক্ষা করিতেছিল, সেখানে পৌঁছিতে প্রায় সাড়ে চারটা বাজিয়া গিয়াছিল। তাহারা একটা উঁচু গাছে বসিয়া হাতির গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করিতেছিল। আমরা নিকটে আসিতেই আমাদিগকে চুপ করিতে ইশারা করিয়া তাহারা গাছ হইতে তাড়াতাড়ি নামিয়া আসিল। ইশারায় জানাইল হাতী অদূরেই আছে। আমরা বন্দুকে গুলি ভরিয়া প্রস্তুত হইয়াই ছিলাম, এখন উৎকণ্ঠায় অস্থির হইয়া উঠিলাম। হাতী গা-ঢাকা দিয়া এত চুপ করিয়া থাকিতে পারে যে পাঁচ-ছয় গজ দূরে বনের মধ্যে দাঁড়াইয়া থাকিলেও তাহার অস্তিত্ব বুঝিবার উপায় নাই।

অতি সন্তর্পণে জিরীং পাঞ্জালী অগ্রসর হইতেছে আর তাহার পিছনেই চলিয়াছি আমরা। হঠাৎ একটা ছোট ডাল ভাঙার শব্দ হইল, আবার সব চুপ। পাঞ্জালী স্থির হইয়া দাঁড়াইয়া শব্দের হেতু নির্ণয়ের চেষ্টা করিল। সেই মুহূর্তে শিকারীর মনের কী ভাব তাহা লিখিয়া বর্ণনা করা কঠিন। তখন নিজের হৃদস্পন্দনের দ্রুত শব্দ নিজেরই কানে ভয়ানক অস্বাভাবিক বলিয়া বোধ হয়। আমরা চারিদিক লক্ষ্য করিয়া সুবিন্যস্ত ঘন বাঁশ বনের ভিতর দিয়া কিছুই দেখিতে পাইলাম না। এদিকে-ওদিকে চাহিয়া ধীরে ধীরে দুই-এক পা করিয়া অগ্রসর হইতেছি, হঠাৎ জিরীং চুপ করিয়া বসিয়া পড়িয়া সম্মুখে অঙ্গুলি নির্দেশ করিল। বুঝিলাম, সে হাতী দেখিয়াছে। হাতীটা একটা বাঁশ গাছের ধারে দাঁড়াইয়া আছে, কিন্তু এমন কাদামাটি মাখিয়া রহিয়াছে যে, তাহার রং পাহাড়ের রং-এর সঙ্গে মিশিয়া গিয়াছে, তারপর হাতীটা একেবারে পাথরের মতো নিশ্চল— সুতরাং হঠাৎ দেখিয়া বুঝিবার কোনও উপায় নাই। একটু নড়িলে বুঝিলাম, এটা পাহাড় কিংবা পাথর নয়, হাতীই ঠিক। কিন্তু অনেক চেষ্টা করিয়াও হাতীর দাঁত কিছুতেই দেখিতে পাইতেছি না। ঠিক আমাদের বাঁ-ধারেই একটা শুকনো পাথর-ঢাকা নালা গিয়াছে। বিমল তাহাতে নামিয়া হাতীটাকে খুব স্পষ্টভাবে দেখিয়া আমাকে সেই দিকে যাইতে ইশারা করিল। আমি নালায় নামিয়াই হাতীটাকে স্পষ্টরূপে দেখিতে পাইলাম। তখন আজাম ও গাগাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, এই হাতীই তাদের ক্ষেত নষ্ট করিয়াছে কিনা এবং ডেপুটি কমিশনার যে হাতী বধের হুকুম দিয়াছেন এই হাতীই সেই হাতী কিনা? তাহারা মাটি ছুঁইয়া শপথ করিল যে, এই হাতীই সেই বড়ো গুণ্ডা হাতী। তখন মুহূর্তকালমাত্র বিবেচনা করিলাম কোথায় গুলি করিব। হাতীটা তখন আমাদিগকে দেখিয়া সন্দিগ্ধ অথচ বিরক্তিপূর্ণ ভাবে ধীরে ধীরে আমাদের দিকে অগ্রসর হইয়া আসিতেছে। অনুমান করিয়া ডান চোখের কিছু উপরে একটু বাঁ-দিকে কপাল ঘেঁষিয়া গুলি করিলাম। সঙ্গে সঙ্গে হাতীটা এক ধাক্কা খাইয়া ঠিক উল্টা দিকে ঘুরিয়া যাইবার সময় পুনরায় এক গুলি করিলাম মাথায়। তখন হাতীটা, আমরা প্রথম যেখানে বসিয়া হাতী দেখার চেষ্টা করিয়াছিলাম, সেইদিকে ঘুরিয়া ঠিক হরিণের মতো বেগে পলায়নপর হইল। আমি আবার একটা গুলি করিলাম। এই গুলি লাগার সঙ্গে সঙ্গে হাতীটা ঠিক যেন কাত হইয়া উল্টাইয়া পড়িল। আমরা অত্যন্ত উৎসাহিত হইয়া পতিত হস্তী লক্ষ্য করিয়া অগ্রসর হইয়া দেখি, হাতী সেখানে নাই— পতনের চিহ্ন রহিয়াছে বটে এবং বেশ খানিকটা রক্তও পড়িয়া আছে, কিন্তু হাতী নাই! প্রথম দুইটি গুলি তিরিশ গজ ব্যবধানে করা হইয়াছে, শেষের গুলি হইয়াছে প্রায় চল্লিশ গজ দূর হইতে। ইহার পূর্বে একটি হাতীকে ষাট গজ দূর হইতে মারা হইয়াছে এবং অপরটি প্রায় পনের গজ দূর হইতে। কিন্তু সেই দুইটি হাতীই প্রকৃতপক্ষে এক-একটি গুলিতেই নিহত হইয়াছিল! সুতরাং তিনটি গুলি খাইবার পরও হাতী মরিল না দেখিয়া বিস্মিত হইলাম। কিন্তু স্থির বিশ্বাস হইল আর একটু ঘুরিয়া দেখিলে হাতী এখনই নিকটে পাইব।

 

সঙ্গে দুই বন্দুকধারী ও দুই পাঞ্জালীকে লইলাম, অপর সকলকে বলিয়া দিলাম, তাহারা হাতির 'মলমে' (পথে) উত্তর দিকে গাছে বসিয়া যেন শব্দ করিতে থাকে। আমাদের ফিরিতে বিলম্ব হইলে যেন তাঁবুতে ফিরিয়া যায়। আহত হস্তীর অনুসরণ করা কখনও নিরাপদ নহে। বাঘের হাতে রক্ষা পাইলেও, অতি শক্তিশালী রাইফল হইতে সময় মত গুলি করিতে না পারিলে আক্রমণশীল হাতীর হস্ত হইতে আমাদের ন্যায় মন্থরগামীদের পক্ষে আত্মরক্ষা করা অসম্ভব। পায়ে হাঁটিয়া হাতি শিকারের সর্বাপেক্ষা বড় উন্মাদনাই এই যে, আপন জীবন পণ করিয়া এই শিকারে প্রবৃত্ত হইতে হইবে। আমার অপর সঙ্গীদ্বয়ও যথেষ্ট সাহসী ছিলেন। তাঁহারা এই অবস্থাতেও কেহই পশ্চাৎপদ হইলেন না। আমার রাইফল কোনটাই হাতী শিকারের পক্ষে খুব উপযোগী ছিল না— সুতরাং ইহাতে বিপদের মাত্রা অত্যধিক।

সময় বেশী ছিল না। পাহাড়ে সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গেই অন্ধকার ঘনাইয়া আসে। বর্ষার নিবিড় বনরাজী পূর্ণ, পথ-হীন, পিচ্ছিল পাহাড়ে চলার অভিজ্ঞতা যিনি অর্জন করিয়াছেন, একমাত্র তিনিই আমাদের অবস্থা উপলব্ধি করিবেন।

অতি নিকটেই অন্য হাতীর বিরক্তিব্যঞ্জক শব্দ শুনিয়া মনে হইল আহত হস্তী অপর হস্তীর দিকে গিয়াছে, ফলে দুইটিই রক্তের গন্ধে ও বারুদের গন্ধে ভীত হইয়া পলায়নপর হইয়াছে। হাতীর পথ অনুসরণ করিয়া চলিয়াছি— ক্রমশঃ-নিবিড় বনানীর মধ্যে। সেখানে বোধ হয় মধ্যাহ্নেও রৌদ্র কখনও প্রবেশ করে না। মশা এবং নানাবিধ পচা গাছের দূষিত বায়ুতে অবস্থা আরও কষ্টকর করিয়া তুলিয়াছিল। এ কয়দিন পাহাড়ে চলিয়া জোঁকের অবিশ্রান্ত উৎপাত গা-সহা হইয়া গিয়াছিল। আমরা হাতীর পথে চলিতে চলিতে দেখিলাম, হাতীগুলি এক জায়গায় আমাদের মাত্র পাঁচ-ছয় হাত দূর দিয়া চলিয়া গিয়াছে। মধ্যে ঘন বন থাকায় কিছু দেখিতে পাওয়া যায় নাই— অথচ হাতী চলার কোন শব্দও পাই নাই। প্রতি পদক্ষেপেই আশা করিতেছি এই বুঝি হাতীর দেখা পাই। এক এক জায়গায় আহত হাতীর পদস্খলনের চিহ্ন দেখিয়া মনে হয়, হাতী খুবই দুর্বল হইয়া পড়িয়াছে, বুঝিবা সম্মুখেই শায়িত অবস্থায় পাইব। কিন্তু একটু চলার পরই ভুল ভাঙিয়া যায় যখন দেখি, আমরা যেখানে কষ্টে উঠিতে পারি এমন পাহাড়ও হাতী সহজেই পার হইয়া গিয়াছে। কোথাও গাছের পাতায় রক্তের দাগ, আবার কোথাও পাহাড়ের গায়ে বিদ্ধ দাঁতের দাগ দেখিয়া মনে হয় পতনোন্মুখ হস্তী কোনও রকমে দাঁতের সাহায্যে টাল সামলাইয়া লইয়াছে। এমন বহু চিহ্ন দেখিয়া উৎফুল্ল হইয়াছি, পরমুহূর্তেই আবার তাহার সামর্থের পরিচয় পাইয়া বিস্মিত হইয়াছি। এইভাবে কিছুক্ষণ অনুসরণ করার পর সূর্যদেব পাহাড়ের আড়ালে গা-ঢাকা দিলেন। সুতরাং অন্ধকারাচ্ছন্ন বনে আর থাকাও সম্পূর্ণ নিরর্থক, বিপজ্জনক ও মূর্খতা বোধে কাঁটাবনে জামা, প্যান্ট ও হাত-পায়ের চামড়া ছিঁড়িতে ছিঁড়িতে কোনমতে খারনৈ নদীর ধারে আসিয়া বসিলাম। তখন সন্ধ্যার অন্ধকারে পর্বত ও অরণ্য এক ভয়াবহ মূর্তি ধারণ করিয়াছে। সবচেয়ে কষ্টদায়ক মশা, 'উনি' পোকা ও অন্যান্য নানাপ্রকার পোকার কামড়। পূর্বেই বলিয়াছি, জোঁকের কামড় গা-সহা হইয়া গিয়াছে। বর্ষায় সাপের উপদ্রব অত্যন্ত হয়। কিন্তু এখন যে অবস্থায় আসিয়া উপস্থিত হইয়াছিলাম, তাহাতে কোনও ভীতিই আর মনে ছিল না! সঙ্গে একটা টর্চ পর্যন্ত ছিল না। এ অবস্থায় একমাত্র মনে হইতেছিল, যে উপায়েই হউক, যত শীঘ্র হয় তাঁবুতে পৌঁছিতে হইবে। সাঁতার দিয়া নদী পার হইয়া খাড়া পাহাড়ের গা বাহিয়া লতা-গাছ ধরিয়া কোনও মতে প্রায় এক ঘণ্টার পথ চলিয়া একটা পুরাতন পায়ে চলার পথ পাইয়া বাঁচিলাম। আর পথে বহুবার হোঁচট খাইয়া অল্প সময় পূর্বেই খুসিগিরি পৌঁছিলাম। আজিকার এই পরিশ্রম যে-কোনও অতি কঠোর পরিশ্রমীর পক্ষে আত্মপ্রসাদের ভাব আনিয়া দিবে তাহাতে সন্দেহ মাত্র নাই।

রাত্রিতে আজ চা-পান ও দধি-চিঁড়া ভক্ষণ হইল। রন্ধন করিয়া খাওয়ার ইচ্ছা আর ছিল না। কিন্তু পাঁচ দিন পরে জলে না ভিজিয়া, পোকা জোঁকের উৎপাতে অতিষ্ঠ না হইয়া, সুখে সমস্ত রাত্রি গাঢ় নিদ্রা উপভোগ করিলাম নকপান্থিতে শুইয়া। ইহার পূর্বে আমি কখনও নকপান্থিতে বাস করি নাই। গারোদের মধ্যে ভয়ংকর চর্মরোগ হয়। সুতরাং তাহাদের ব্যবহৃত এই সকল স্থানে থাকার কথা মনে হইলেই ভীতি ও ঘৃণার উদ্রেক হইত। কিন্তু আজ আর এসব কথা মনেও হয় নাই। আমরা যে সকল লোককে গাছে উঠিয়া থাকিতে বলিয়াছিলাম, তাহারা অনেক রাত্রিতেও না আসায় মনে করিলাম তাহারা রংথিয়াস্রিয়ার হাদাং-এ নিশ্চয় রাত্রি কাটাইয়াছে।

পরদিন খুব প্রত্যুষে উঠিয়া কি ভাবে কার্য করা হইবে তাহার একটা খসড়া স্থির করা হইল। শিকারী দল হতীর যাওয়ার পথে অনুসরণ করিয়া সন্ধ্যার পূর্বে রংথিয়াস্রিয়া গিরির হাদাং-এ ফিরিবে। পাঞ্জালীর দল অন্যান্য সম্ভবপর স্থান খুঁজিয়া সেইদিন অথবা তার পরদিন সন্ধ্যায় রাংথিয়াস্রিয়ার হাদাং-এ আসিয়া মিলিবে। চারিজন লোক দিয়া ছয় বেলার খিচুড়ীর মাল-মসলা, চায়ের সরঞ্জাম, কয়েকটা টর্চ, ঔষধের বাক্স, মশারী, দুইটা ত্রিপল এইরূপ সামান্য কিছু উপকরণসহ রাংথিয়াস্রিয়ার হাদাং-এ পাঠাইয়া দিলাম। তাহাদিগকে উপদেশ দিয়া দিলাম, গারোদের পরিত্যক্ত কোনও পুরাতন 'বোরং'-এ যেন তাহারা মালপত্র রাখিয়া, শুকনো কাঠ যোগাড় করিয়া জায়গা পরিষ্কার করিয়া রাখে।

অপর লোকগুলি ইত্যবসরে আসিয়া বলিল যে, রাত্রি হইয়া যাওয়ায় তাহারা রাংথিয়াস্রিয়ার হাদাং-এ ছিল। দুইটি হাতী প্রথমেই তাহাদের গাছের নীচ দিয়া পলাইয়া গিয়াছিল। আহত হস্তী ধীরে ধীরে কষ্টে অনেকক্ষণ পরে তাহাদের পথেই ঠিক গাছের নীচে দিয়াই গিয়াছে— হাতির কপাল এবং শিরদাঁড়ার নীচে, পিছনে ডান দিক হইতে প্রচুর রক্তপাত হইতেছে। হাতি খুবই আহত হইয়াছে। তাহাদের মতে হাতী আর বাঁচিবে না।

আমরা শীঘ্র আহারাদি সারিয়া ব্যবস্থামত রওনা হইলাম। বাকী সকলকে মালপত্রসহ খুসিগিরিতে রাখিয়া বলিয়া গেলাম, আমরা যদি কোনও চিঠি পাঠাই তাহা হইলে পত্রের মর্মানুযায়ী ব্যবস্থা তাহারা যেন করে।

হাতীর পদচিহ্ন অনুসরণ করিয়া বুঝিলাম, আহত হস্তী অপর দুইটির সহিত মিলিত হইয়াছে। পথে চলার ভঙ্গী দেখিয়া মনে হইল যে, প্রথমত এইটি অপর দুইটির সহিত মিলিত হইতে চাহিলেও কেন যেন অপর দুইটি ইহার সান্নিধ্য এড়াইয়া চলিয়াছে। কিন্তু একটা নরম এঁটেল মাটির মত কর্দমাক্ত স্থানের নিকট আসিয়া মনে হইল, হস্তিনী অপর হস্তীর নিকট হইতে ফিরিয়া আসিয়া আহত হস্তীর সহিত মিলিত হইয়াছে। প্রথমে সুস্থ দুইটি একটা নূতন পথ দিয়া অনেকদূর পর্যন্ত চলিয়া গিয়াছিল। উহাদের মধ্যে গুণ্ডাটি আর ফিরে নাই, কিন্তু 'কুনকী' (অর্থাৎ হস্তিনী) আসিয়া আহত হস্তীর সহিত মিলিত হইয়াছে। এই স্থান দেখিয়া ইহাও মনে হইল যে, রক্ত বন্ধ করিবার উদ্দেশে মাটি লইয়া আহত স্থানে দিবার চেষ্টা করিয়াছে। মাটিতে শুঁড়ের চিহ্ন দেখিয়া স্পষ্ট মনে হইল উভয় হস্তীই শুঁড় দিয়া মাটি তুলিয়াছে। ইহার পর বৃক্ষপত্রাদিতে রক্তের চিহ্ন প্রায় দেখি নাই। এখন হইতে এই দুই হাতীর পথ আর বিভিন্ন হয় নাই। অপর গুণ্ডাটি মধ্যে মধ্যে এই পথে চলিলেও প্রায় সময়েই অদূরেই এক স্বতন্ত্র পথে গিয়াছে। কখনও এই দুইটির আগে গিয়াছে— কখনও পশ্চাতে। দেখিয়া অনুমান করিলাম, অপর গুণ্ডাটি অতি অল্প সময় ইহাদের নিকট আসিলেও প্রায় সময়ই ভিন্ন পথে গিয়াছে। প্রায় চারি ঘণ্টাকাল হস্তীর পথ অনুসরণ করিয়াও যখন হস্তীর দেখা পাইলাম না, তখন অসময় হইয়া যাইবে এই ভয়ে পূর্বনির্দিষ্ট 'হাদাং'-এ ফিরিবার কল্পনা করিলাম। পথে কোনও হাতীর শোয়া অথবা খাওয়ার চিহ্ন পাইলাম না। তাহাতে অনুমান হইল, হাতি সমস্ত রাত্রিই চলিয়াছে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে।

এখন পর্যন্ত আমরা হাতির পথেই চলিয়াছিলাম সুতরাং লতা বল্লরীর বেড়াজালের উৎপাত এতটা হয় নাই। পথ-চলা কতক পরিমাণে সহজই মনে হইয়াছে। তারপর হাতীর পথ ছাড়িয়া সোজা জঙ্গলের ভিতর দিয়া চলিতে হইতেছে। কত রকমের লতার বন্ধন, একটু অসতর্ক হইলে কোনটা গলায় জড়াইয়া যায়, কোনটা পায়ে লাগিয়া যায়, কোনটায় বন্দুক আটকাইয়া যায়। মধ্যে মধ্যে নানা অদ্ভুত কাঁটার আঁচড়ে কাপড় জামা ও শরীর কাটিয়া গিয়াছে। এইরূপ নানা প্রকার দুর্ভোগ ভোগ করিতে করিতে পর্বতশিখরে মানুষের চলার পুরাতন পথ পাইলাম। এই পথ ধরিয়া হাতী 'হাদাং'-এ ধান খাইতে যায়। সুতরাং পথটা কিছুটা সুগম হইয়াছে। পাহাড়ে তিন-চার ঘণ্টা চলিবার পর, বিশেষতঃ শিকারের অন্বেষণে বাহির হইলে কেমন যেন একটা 'খুন চাপা' ভাব আসিয়া উপস্থিত হয়— তখন শারীরিক কষ্ট ও শ্রম বড় একটা উপলব্ধিই হয় না। যখন 'হাদাং'-এ উপস্থিত হইলাম, তখন বেলা সাড়ে তিনটা বাজিয়াছে। পাহাড়ের জঙ্গল কাটিয়া প্রায় খারনৈ নদী পর্যন্ত 'হাদাং' করিয়াছে। উপরের অংশে প্রায় সব জায়গায় হাতী ধান খাইয়া নষ্ট করিয়াছে। নীচের দিকের ধান বেশ আছে। দুই-একটা 'বোরং'ও হাতী ভাঙিয়া শেষ করিয়াছে। প্রায় সব গাছেই মাচান ও মই বাঁধা আছে, হাতীর আক্রমণ হইতে রক্ষা পাওয়ার জন্য।

ধান পাকিয়া যাওয়ায় ধান সংগ্রহের জন্য গারো রমণীরা মাথায় ঝুড়ি ('খক' বা 'জোঙ্গা') বাঁধিয়া ঘুরিতেছে, কেহ 'বোরং'-এ বসিয়া ধান ভানিতেছে। বিস্তীর্ণ হাদাং-এ মোট সাত-আটটি বোরং। ক্ষেতে ধান, চিংড়া (খরমুজ), কাঠ, আলু, রাঙ্গী আলু, কার্পাস তূলা, চুকাই, কচু, মরীচ, ভুট্টা, কাংনী দানা প্রভৃতি লাগান হইয়াছে— মধ্যে মধ্যে মিষ্টি কুমড়া, লাউ, চাল কুমড়া প্রভৃতির গাছও আছে। গারো রমণীরা ধান কাটে না, পাকা শিষ বাছিয়া ছিঁড়িয়া লয়।

সংবাদ পাইলাম কোনও 'বোরং' খালি না থাকায় মুক্ত আকাশের তলে রাত্রিবাস করা ভিন্ন গতি নাই। জলও অনেক নীচে; জলের জন্যে প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট পথ নামিতে হইবে। আমরা যেখানে দাঁড়াইয়া ছিলাম, সেখানে এক বালতি জল আনিতে দেড় ঘণ্টা সময় লাগিবে। সুতরাং সর্বপ্রথম স্থির হইল, আজ রাত্রিতেও চিঁড়া ভক্ষণ করা, কারণ জল আনিয়া রান্না করা অসম্ভব! জায়গাটাও অতি খারাপ, সেখানে বসিয়া রান্না করাও চলে না। সুতরাং তাড়াতাড়ি এক বালতি জল আনার ব্যবস্থা করিয়া চা-পানের উদ্যোগ হইল। কতকটা বন পরিষ্কার করিয়া সেখানে রাত্রিবাসের ব্যবস্থা করা হইল। ত্রিপল দিয়া সঙ্গের জিনিসপত্র ঢাকিয়া রাখা হইল। লেখা অনাবশ্যক, সন্ধ্যাসমাগমের সঙ্গে সঙ্গে মশা প্রভৃতির ভীষণ আক্রমণ শুরু হইল। আমি প্রতিষেধক হিসাবে প্রত্যহ কুইনাইন খাইতাম, কিন্তু সঙ্গীগণ পুনঃপুনঃ সাবধান করা সত্ত্বেও এ সম্বন্ধে অসতর্ক ছিলেন। ফলে বাড়ি ফিরিয়া কেবলমাত্র আমিই 'ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়া'র আক্রমণ হইতে রক্ষা পাইয়াছি, অন্য সকলেই অল্প বিস্তর ভুগিয়াছে। এমন কি গারোগণও বাদ যায় নাই।

ইতিমধ্যে সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গেই পাঞ্জালীগণ আসিয়া বলিল, যে তাহারা প্রায় তিন-চার মাইল দূরেই হাতী দেখিয়া আসিয়াছে। হাতী অত্যন্ত 'কাবু' (অর্থাৎ গুরুতররূপে ক্লিষ্ট) হইয়াছে। খুব ধীরে ধীরে চলে, কান অথবা ঘাড় নাড়াইতে পারে না, শুঁড় ও লেজ নাড়ায় না। হস্তিনী আহত হস্তীর গা ঘেঁষিয়া দাঁড়াইয়া থাকে, আর মধ্যে মধ্যে শুঁড় দিয়া আহত স্থানে মাটির প্রলেপ দেয় অথবা মাটি গুঁজিয়া দেয়। মানুষের শব্দ পাইলেই হস্তিনী মরিয়া হইয়া আক্রমণ করে। তাহাদের মতে, কাল সূর্যোদয়ের পর ছড়ার ধারেই হাতী নিশ্চিত পাওয়া যাইবে। এই সংবাদে শিকারের সাফল্যের আশায় যেমন উৎফুল্ল হইলাম, তেমনই আবার হাতীর জীবনের নূতন একটি পরিচয় পাইয়া কেমন একটি বিচিত্র অনুভূতিতে আবেশ-বিহ্বল হইয়া রহিলাম। বিচিত্র এই জগৎ! বিচিত্র প্রকৃতির লীলা!

এই গ্রামের গারোকে পূর্ব হইতেই নিযুক্ত করিয়াছি। সে পাঞ্জালীদের সঙ্গে ফিরিলে তাহার চেষ্টায় ও তাহার স্ত্রীর সৌজন্যে রাত্রির জন্য আমাদের মাথা গুঁজিবার স্থান জুটিল। উৎসাহে পাঞ্জালীদিগকে সমস্ত রাত্রি প্রচুর মদ্যপানে আপ্যায়িত করাইল। আমি সারা রাত্রি ভাবিতে লাগিলাম— ইহা কি সত্য যে হাতীর এক বুদ্ধি-মিশ্রিত মায়া আছে।

শিকারে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যসম্ভারে নয়ন-মন যেমন সার্থকতার পরিপূর্ণতা লাভ করে, তেমনই বনবাসী মনুষ্য-সমাজের বিশিষ্ট জীবনযাত্রার সহিত সাক্ষাৎ পরিচয়লাভেরও যথেষ্ট সুযোগ পাওয়া যায়।

 

খুব সকাল সকাল আহারাদি সারিয়া লইলাম। পাঁচজন পাঞ্জালী ভিন্ন দুইজন কুলিকে সঙ্গে লইলাম। কুলির সঙ্গে এক টিফিন-ক্যারিয়ারে দধি, চিঁড়া, গুড় ও ফ্লাস্কে জল এবং দুইটি টর্চ দিয়া দিলাম। যদি হাতীর পিছনে ঘুরিতে ঘুরিতে জঙ্গলে রাত্রি হয়, তাহা হইলে এই সব কাজে লাগিতে পারে।

যেদিকে হাতীর পলায়নের স্বাভাবিক গতি হইবে অনুমান করা গেল, সেই ঘাঁটিতে একজন বন্দুকধারীকে রাখিলাম এবং অপর দুই তিন ঘাঁটিতেও গাছে গাছে দুই তিনজন লোক রাখিয়া দিলাম। হাতী পলায়নপর হইলে তাহারা যেন সেই পথ হইতে ভয় দেখাইয়া হাতি ফিরাইয়া দেয়। বন্দুকধারী ভদ্রলোক গাছে উঠিতে পারেন না, বহু কষ্টে তাঁহাকে গাছে তুলিয়া গাছের সঙ্গে দড়ি দিয়া বাঁধিয়া দেওয়া হইল, যাহাতে ভয়ে গাছ হইতে পড়িয়া না যান।

এইসব কার্য সমাধা করিয়া আমরা তিনজন পাঞ্জালী লইয়া হাতির উদ্দেশে হেমদাঙ্গি ছড়ার দিকে নামিতে লাগিলাম। সোজা পাহাড়ের গা ঘেঁষিয়া নামিয়া চলিয়াছি। চারিদিকে সাজান বাঁশবন। নীচে ছড়ার শব্দ যাইতেছে। হঠাৎ একটা বাঁশ ভাঙার অস্পষ্ট শব্দ কানে আসায় একজন পাঞ্জালীকে গাছের উপরে উঠিয়া হাতীর সাড়া পাওয়া যায় কিনা দেখিতে বলা হইল। লোকটা ঠিক বাঁদরের মত সহজে গাছের উচ্চতম চূড়ায় উঠিয়া দেখিতে লাগিল। খানিক পরে নামিয়া আসিয়া বলিল, কিছু নীচেই বড় দাঁতাল, 'গোগাবা', (অর্থাৎ গুলি খাওয়া) হাতীটা হস্তিনীর সঙ্গে ধীরে ধীরে আসিতেছে। দেখিয়া মনে হইল বড় হাতীটা দুই-একটা নলাগ্র ধীরে ধীরে শুঁড় দিয়া মুখে দিবার চেষ্টা করিতেছে। হস্তিনী কিন্তু তাহার গাত্র সংলগ্ন হইয়া আছে এবং এক-একবার হাতীর মাথায় শুঁড় বুলাইয়া মাটি দিতেছে। পাঞ্জালীকে পুনরায় গাছে চড়িয়া চারিদিকে লক্ষ্য রাখিতে বলিয়া আমরা আরও নামিয়া গেলাম। পঁচিশ-তিরিশ গজ নীচে ছড়া দিয়া ধীরে ধীরে হস্তী অগ্রসর হইতেছে— হস্তী ও হস্তিনী উভয়কেই দেখিলাম। অপর পাশ দিয়া হস্তিনী উহার গা ঘেঁষিয়া আসিতেছে। হস্তীর অন্য কোনও নড়াচড়া টের পাইলাম না, কিন্তু ক্লিষ্ট গতিতে অগ্রসর হইতেছে। ধীরে ধীরে কান পর্যন্ত সমস্ত মাথাটা বাহির হইয়া আসিল।

শিকারে প্রায়ই প্রথম সুযোগ পাওয়ামাত্র গুলি না করিলে আর হয়ত গুলি করার অবসর পাওয়া যায় না। হাতির মর্মস্থলে গুলি করার সুযোগ ইহার চেয়ে আর হইতে পারে না— সুতরাং লক্ষ্য করিলাম। আমরা সোজা উপরে ছিলাম, সুতরাং গুলি করিতে হইলে মদস্রাবের ছিদ্রের উপর যে হাড় আছে তাহার কিছু উপরে করিতে হয়, কিন্তু আমার বন্দুকের গুলিটা 'সফট নোজ' ছিল। অবশ্য 'ম্যাগাজিনে' 'হার্ড নোজ' ছিল— বদলাইতে গেলে শব্দে কুফল হইবার আশঙ্কা। অপর রাইফেলেও দুইটিই 'সফট নোজ', সুতরাং মদস্রাবের ছিদ্র লক্ষ্য করিয়া গুলি করিতে বাধ্য হইলাম। মনে করিয়াছিলাম, হাতীকে উল্টাইয়া ফেলিতে এই গুলিই যথেষ্ট হইবে, তাহার পর দ্বিতীয় গুলি প্রয়োজন হইলে 'হার্ড নোজ' ব্যবহার করা যাইবে। কিন্তু গুলি লাগার সঙ্গে সঙ্গে হাতি মাথা ঘুরাইয়া পলায়নপর হইল। সঙ্গে সঙ্গে আরও একটি গুলি করা হইল। পাঞ্জালী গাছের উপর হইতে ডাকিয়া বলিল, হাতী উত্তর দিকে লোকেন্দ্রবাবুর পথে চলিয়াছে— সঙ্গে হস্তিনী আছে। খুব বিশ্বাস ছিল গুলির ধাক্কায় হাতি পড়িয়া যাইবে, তাহা না হওয়ায় অত্যন্ত বিস্মিত হইলাম।

হাতীর পিছনে পিছনে যথাসম্ভব দ্রুত চলিলাম। চলা কি যায়? উঁচুনীচু পাহাড়ের পথ। এই সুবৃহৎ জন্তুগুলি যে দ্রুতগতিতে স্বচ্ছন্দে এই পথ দিয়া যায় তাহার আংশিক বেগে চলিতে পারিলেও হয়তো হাতীর নিকটে যাওয়া সম্ভবপর হইত। কারণ হাতী মধ্যে মধ্যেই দম লইয়া চলিতেছিল। কিছুদূর চলিতেই উত্তরের পথ হইতে চিৎকার শোনা গেল যে, হাতী সেইদিকে দ্রুত অগ্রসর হইতেছে। হাতী ফিরাইয়া দিবার জন্য লোকেন্দ্রবাবু একটা আওয়াজ করিলেন। ইহা শুনিয়া হাতী ফিরিল বটে, কিন্তু আমাদের পথে নহে। হাতীর পথ অনুসরণ করিতে করিতে লোকেন্দ্রবাবুর গাছের দৃষ্টিপথবর্তী হওয়া মাত্র তিনি বলিলেন, আমরা যেখানে দাঁড়াইয়া, আহত গুণ্ডা ও হস্তিনী সেই পর্যন্ত আসিয়া খানিকক্ষণ দাঁড়াইয়াছিল— বন্দুকের শব্দ শুনিয়া পুনরায় ফিরিয়া গিয়াছে! হাতির কপালে দুই জায়গায় মদস্রাবের ছিদ্রের নিকট, কানের পাশে এবং শিরদাঁড়ার নীচে, এই কয়েক স্থান হইতেই রক্তপাত হইতেছে। পূর্বের ক্ষতস্থান মাটির প্রলেপে ঢাকা।

ইহার পর হাতীর পায়ের চিহ্ন অনুসরণ করিয়া সমস্ত দিন পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরিতে লাগিলাম। যেখানেই কাদা মাটি পাইয়াছে ক্ষতস্থানে তাহা প্রলেপ করিয়াছে— এখানেও মনে হইল হস্তিনী ক্রমাগত হস্তীর পরিচর্যা করিয়াছে। কত দুর্লঙ্ঘ পাহাড় হস্তী এইভাবে পার হইয়া চলিয়াছে তাহার অবধি নাই। কি শক্তিমান এই জন্তু! আমরা ক্ষুধার্ত, তৃষ্ণার্ত ও অসম্ভব ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছি, কিন্তু আশা সম্পূর্ণ ছাড়ি নাই।

বেলা সাড়ে চারটা পর্যন্ত চলিয়া প্রায় সন্ধ্যার প্রাককালে এক স্থানে আসিয়া হাতীর সদ্য চিহ্ন পুনরায় পাইলাম— একটা জায়গায় কিছু পূর্বেই শুইয়াছে এবং হাতী এতই দুর্বল হইয়া পড়িয়াছে যে উঠিবার সময় দাঁতের উপর ভর করিয়া তাহাকে দাঁড়াইতে হইয়াছে। এইস্থান হইতে অল্প দূর মাত্র গিয়াই হাতীর বাঁশ ভাঙার শব্দ পাইলাম। বৃক্ষবহুল স্থানের শেষে একটি তিন-চার হাত পরিমাণ নালা পার হইয়া হাতী একটা 'চাতালে' (অর্থাৎ দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তী অপরিসর সমতল ক্ষেত্রে) ঘন সন্নিবিষ্ট নলবনে প্রবেশ করিয়াছে। আমরা হাতীর পথে, নালার ধারে, দাঁড়াইয়া থাকিতেই সুস্পষ্ট নিঃশ্বাসের শব্দ পাইলাম। পাশেই একটা ছোট গাছ ছিল। একজন পাঞ্জালীকে তাহার উপর হইতে পর্যবেক্ষণ করিবার জন্য নির্দেশ করিলাম। লোকটা গাছে উঠিয়া একটু পরেই সহসা নামিয়া আসিল। বলিল, হাতী দশ-বারো হাত দূরে দাঁড়াইয়া আছে। হস্তিনী আহত হস্তীকে আড়াল করিয়া আছে, আক্রমণোদ্যত হইয়া আমাদের দিকে তাকাইয়া আছে। লোকটা গাছে উঠিয়াই দেখে হস্তিনী আহতের ক্ষতস্থানে শুঁড় বুলাইয়া মাটির প্রলেপ দিতেছে। কিন্তু আমাদের শব্দ পাইয়াই হউক অথবা গন্ধ পাইয়াই হউক, সহসা উত্তেজিত হইয়া ফিরিয়া চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া আছে। তখনও হাতীর নূতন ক্ষতস্থান হইতে প্রচুর রক্তপাত হইতেছিল; কিন্তু পুরাতন ক্ষতস্থান হইতে তখনও কিছু রক্তই হউক বা জলীয় কোনও পদার্থই হউক মিলিত হইয়া প্রলেপের মাটি ভিজাইয়া দিয়াছিল।

এমন সমতল জায়গায় এত ঘন-সন্নিবিষ্ট বনে সন্ধ্যার প্রাককালে শিকার করিতে যাওয়া বিপজ্জনক হইবে। আমরা পাঞ্জালী ভাল নহে— সুতরাং একজন গারো পাঞ্জালীকে সম্মুখে রাখিয়াই হাতির অনুসরণ করিতে হইবে। কিন্তু এই ধরনের বনে হাতীর অনুসরণ করিতে যাইয়া হঠাৎ এমন ভাবে তাহার সম্মুখীন হইতে হইবে যে, শিকারী হাতী দেখিতে পাইবার পূর্বেই পাঞ্জালী হস্তী কর্তৃক আক্রান্ত হইবার সম্পূর্ণ সম্ভাবনা। সুতরাং শিকারী সম্মুখে না থাকিয়া পাঞ্জালীর অনুসরণ করা এক্ষেত্রে অত্যন্ত অন্যায় এবং বিপজ্জনক। নিরস্ত্র পাঞ্জালীকে এইভাবে বিপদের মুখে ফেলিয়া নিজে নিশ্চিন্ত থাকা কোনও শিকারীর পক্ষে বর্বরোচিত কাপুরুষতা। অথচ নিজের জ্ঞানের অল্পতা সম্বন্ধে সম্পূর্ণ সচেতন থাকায় মূঢ়ের মত বৃথা স্পর্ধা করিতে পারি না। ভুল পদ-চিহ্ন অনুসরণ করিলে শিকার নষ্ট ও অপমৃত্যু উভয়ই হইতে পারে। সুতরাং স্থির করিলাম, পাঞ্জালীকে গাছের উপর উঠাইয়া হাতীর দিকে ঢিল ছুঁড়িতে বলিব। তাহাতে উত্তেজিত হইয়া আক্রমণ করিতে আসাই হাতীর পক্ষে স্বাভাবিক, তখন গুলি করিব। কিন্তু হস্তিনীও আসিতে পারে, সেইজন্য 'শট গানে' 'এস. জি' মার্কা ছররা ভরিয়া রাখিয়া অপর এক শিকারীর হাতে দিয়া বলিলাম, 'কুনকী' আক্রমণ করিতে আসিলে তাহার পায়ে গুলি করিতে হইবে। পুনরায় পাঞ্জালী গাছে চড়িয়া নামিয়া আসিয়া বলিল, হাতী দুইটাই একটু দূরে জঙ্গলের আড়ালে সরিয়া গিয়াছে— এখন আর তাহাদের শরীর দেখা যায় না। তখন দুইজন পাঞ্জালীকে উল্টা পথে যাইয়া ফাঁকা আওয়াজ করিয়া হাতীকে আমাদের পথে তাড়াইয়া দিতে বলিলাম, তাহা হইলে হাতী আমাদের দিকে অগ্রসর হইলে গুলি করার খুবই সুযোগ হইবে। পাঞ্জালীগণ চলিয়া গেলে একটা গাছের আড়ালে আমরা অপেক্ষা করিতে লাগিলাম। হঠাৎ একটা গাছ ভাঙার শব্দ হওয়ার পরই হস্তিনীর ভীষণ ক্রোধান্ধ একটা শঙ্খনাদ শুনিলাম। তাহার পর আর কিছুই শোনা যায় না। সব স্তব্ধ। স্থির হইয়া চাহিয়া আছি, হাতী আমাদের পথে আসে কিনা দেখিবার জন্য। সন্ধ্যার অন্ধকার ধীরে ধীরে নামিয়া আসিতেছে— বনানী বিহগ-কূজনে মুখরিত হইয়া উঠিয়াছে, গাছের নীচে ছায়া দ্রুত ঘনতর হইয়া উঠিতেছে। এমন সময় মনে হইল, বিরাট ভূতের মত কী যেন একটা ছায়ামূর্তি নিঃশব্দে গাছের নীচে প্রায় চল্লিশ গজ দূরে আসিয়া দাঁড়াইল। একবার মনে হইল যেন হাতী। ঠিক সামনা-সামনি চাহিয়া দাঁড়াইয়া আছে— নিশ্চল। দুইটা দাঁতও যেন স্পষ্টই মনে হইল, কিন্তু আবার মনে হইল, বুঝি চোখের ধাঁধা, গাছের ডালে আলো পড়ায় অমন দেখা যাইতেছে। চোখকে বিশ্বাস করিতে পারিলাম না। দশ গজ অগ্রসর হইয়া একটা উঁচু জায়গায় যেই দাঁড়াইয়া দেখিতে যাইব, অমনি অতর্কিতে একটা শুকনো ডালের শব্দ হইল, সঙ্গে সঙ্গে মড় মড় শব্দ ও সব অদৃশ্য। পঁচিশ-তিরিশ গজ দূরে দাঁড়াইয়াছিল হাতীটা অথচ আমি এবং সঙ্গীদ্বয় কেহই টের পাইলাম না।

সন্ধ্যার সঙ্গে সঙ্গে পাঞ্জালীদ্বয় ফিরিয়া আসিল। তাহারা বলিল, তাহারা যেদিকে গিয়াছিল হাতিও সেইদিকেই অগ্রসর হইতে থাকে। হঠাৎ তাহারা সম্মুখে উপস্থিত হওয়া মাত্র হস্তিনী তাহাদিগকে আক্রমণ করে। সম্মুখে একটা গাছ থাকায় তাহারা রক্ষা পাইয়াছে। হস্তিনী আসিয়াই গাছটা ভাঙিয়া ফেলে। ইত্যবসরে তাহারা পলায়ন করিয়া আত্মরক্ষা করে। হস্তিনী রাগে চিৎকার করিয়া কিছুদূর দৌড়াইয়া আসে। এই অবস্থায় বন্দুকধারী পাঞ্জালী গুলি ছুঁড়িবার অবসরও পায় নাই।

ইহার পর সেই রাত্রিতে গারো পাহাড়ের নিবিড় বনে কি কষ্ট পাইয়াছি তাহা লিখিয়া পাঠকবর্গের ধৈর্যচ্যুতি ঘটাইব না।

পাঞ্জালী এই হাতীকে আরও অনেকদিন অনুসরণ করিয়াছে— শেষ সংবাদ যাহা দিয়াছে, তাহাতে ইহাই বুঝিয়াছি যে, হস্তিনী আহত সঙ্গীর সান্নিধ্য কখনও পরিত্যাগ করে নাই, মানুষের শব্দ শোনা মাত্র পাগল হইয়া আক্রমণ করিয়াছে।

এই শিকার-স্মৃতি বহুদিন মনে জাগিবে— আর স্পষ্ট হইয়া থাকিবে হাতীর এই মায়ার বন্ধনের দৃষ্টান্ত।

(বানান অপরিবর্তিত)

সকল অধ্যায়

১. সুন্দরবনের শেষপ্রান্তে
২. শিকারের সন্ধানে
৩. নির্ভীক
৪. শিকারীর ক্ষোভ
৫. শিকারীর ভয়াবহ অভিজ্ঞতা
৬. বিপর্যয়
৭. হাওদা শিকার
৮. হাওদায় বসিয়া শিকার
৯. শিকারের কথা
১০. একদন্তের শেষ
১১. প্যান্থার
১২. মাচা থেকে চিতা ও অন্যান্য
১৩. জঙ্গলের ভ্রূকুটি
১৪. মহিষ
১৫. বীভৎস
১৬. কুমীর শিকার
১৭. হিমালয়ে ভল্লুক শিকার
১৮. কোয়াড়ে ভালুক শিকার
১৯. ভালুকের কবলে
২০. বাজ-বহেরী
২১. পদ্মায় পক্ষী শিকার
২২. পরিশিষ্ট
২৩. শিকারের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম
২৪. শিকার, শিকারী ও জীবজন্তু সম্বন্ধে বিবিধ জ্ঞাতব্য তথ্য
২৫. বন্দুক, বন্দুকের প্রকার ও ব্যবহার সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞাতব্য তথ্য
২৬. বাঙালির শিকারের আগ্নেয়াস্ত্র
২৭. ভারতের ব্যাঘ্র প্রকল্প
২৮. সহায়ক বাংলা পুস্তক তালিকা

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন