বিশ্বদেব গঙ্গোপাধ্যায়

সুধাংশুকান্ত আচার্য
এবার মাচা থেকে যে একটিমাত্র চিতা শিকার করেছি সেই কথাই বলব। আমাদের বাগানে অ্যাসিসস্ট্যান্ট ম্যানেজার মি. সহেরিয়ার বাড়ির ভিতরের উঠোনে বসে তাস খেলছি। বেলা প্রায় শেষ হয়ে গেছে এমন সময় তার গোয়াল ঘরে— আমরা যেখানে বসে খেলছিলাম তার ঠিক পিছনেই একটা হুটোপুটির শব্দে ফিরে দেখি একটা চিতাবাঘ বেড়া ভেঙে গোয়াল ঘরে ঢুকে একটা ছাগল ধরে নিয়ে যাচ্ছে। সবাই মিলে চেঁচামেচি করায় ছাগল ফেলে দিয়ে চিতাবাঘ পালিয়ে গেল। তার পরের দিনও ঠিক ওই সময়ে আবার একটা হাঁস ধরে নিয়ে গেল। এর পরের দিনও আমাদের বাগানের একটা কুলি তার চৌকির নীচে বাঁধা পাঁঠার ডাক শুনে দেখে একটা চিতা সেটাকে ধরে টানছে, তখন সেও পাঁঠার দড়ি টানতে এবং চিৎকার করতে থাকে। চিতা পালিয়ে গেল কিন্তু টানাহেঁচড়ায় পাঁঠাটা মারা গেল। চিতার দৌরাত্ম্য প্রাত্যহিক ঘটনায় দাঁড়াল দেখে আমাদের বাগানের জমাদারের ছেলে পদকে তখনই একটা মাচা বাঁধতে বললাম। আমার মাচার বিশেষত্ব— বেশ বড়ো এবং মজবুত হওয়া চাই— মশারি খাটিয়ে শোবার মতো। তার উপর বিছানা পেতে মশারি খাটিয়ে রাইফেল নিয়ে বেশ আমি ঘুম দি। টর্চধারী প্রহরী যে থাকে তার কাজ জেগে থাকা এবং জানোয়ার এলে আমায় জাগিয়ে দেওয়া। উঠে চোখমুখ ভালো করে রগড়ে রাইফেল নিয়ে টিপ করা পর্যন্ত জানোয়ার যদি থাকে তবে মারা পড়ে নইলে সে যায় পালিয়ে, আর আমি পড়ি ঘুমিয়ে। একথা হয়তো কেউ বিশ্বাস করবেন, হয়তো কেউ করবেন না, কিন্তু কথাটা সত্যি।

মি. সহেরিয়ার গোয়ালের পিছনেই মাচা বেঁধে পদ পাহারায় রইল। যদি জানোয়ার আসে খবর দেবে। রাত প্রায় বারোটা বাজে— কোনো খবর না পেয়ে শুয়ে পড়ব ভাবছি এমন সময় পর পর বন্দুকের দুটো আওয়াজ হল। পদ নিশ্চয়ই বাঘ মেরেছে মনে করে আমি, পরেশবাবু আর সন্তোষ খোঁজ নিতে মাচার কাছে গেলাম। পদকে জিজ্ঞেস করায় সে বললে— চিতার ওপর দুটো গুলি করেছে, তবে একটাও লাগেনি। আমরা মাচায় উঠে বসলাম। দুটো আওয়াজ করা হয়েছে— এরপর আর চিতাটার ফিরে আসবার সম্ভাবনা নেই মনে করে আমরা বেশ আড্ডা জমিয়ে বসলাম। গল্পগুজব, হাসি তামাশা এমনকী গানও চলছে— হঠাৎ পদ আমাকে বললে— 'বাঘ এসেছে।' দেখি আমাদের এতগুলো লোকের উপস্থিতি ও কোলাহল অগ্রাহ্য করে চিতাটা মাচার নীচে বসে ওপরের দিকে চেয়ে রয়েছে। পদ টর্চ ধরতেই গুলি করলাম। চিতাটা একটা লাফ মেরে উলটে পড়ে গড়াগড়ি দিতে লাগল। আমি তাড়াতাড়ি রাইফেল-এ আর একটা গুলি তখনই ভরে নিলাম কিন্তু বিপদ হল সন্তোষ আর পদকে নিয়ে। সন্তোষ বলে সে টর্চ ধরবে— পদ বলে, না— সে বার বার টর্চ ধরে আসছে, তার অধিকার সে ছাড়বে না। দুজনে দুজনের টর্চ নিয়ে কাড়াকাড়ি, শেষটায় বাঘের গায়ে না ধরে আমার মুখের ওপর ধরে বসে রইল। আমি রাগ করে উঠতেই দুজনেই চিতা যেদিকে পড়ে গড়াগড়ি করছিল সেইদিকে টর্চ ফেলল। কিন্তু এর মধ্যেই চিতা জঙ্গলে ঢুকে পড়েছে। তার আর কোনো খোঁজ পাওয়া গেল না।
রাত তখন প্রায় দুটো; এখন মাচা থেকে নেমে খোঁজ করা সম্ভব নয়, উচিতও নয়। কাজেই তাদের খানিকটা গালাগালি করে শুয়ে পড়লাম। খুব ভোরে সন্তোষ উঠে আমাদের ঘুম থেকে ডেকে তুলল। তাকে বাগানে পাঠালাম— কয়েকজন কুলি ডেকে আনবে, আর আমার ঘোড়াটা পাঠাবে।
অনেকক্ষণ কেটে গেছে। কুলিরা এসে পড়ল কিন্তু সন্তোষের দেখা নেই, ঘোড়াও পাঠায়নি। যা হোক, আমরা সবাই মিলে বাঘের খোঁজে জঙ্গলের দিকে এগিয়ে গেলাম। খানিকটা যেতেই বাঘটা আমাদের সাড়া পেয়ে গোঙাতে লাগল। জঙ্গলের মধ্যে কিছুই দেখা যায় না— শুধু ডাক শুনে গুলি করা চলে না। কাছে এমন একটা বড়ো গাছ নেই যে উঠে দেখব বাঘটা কোন জায়গায় আছে। পরেশবাবুকে বললাম, 'আপনি আমার কাঁধে উঠুন, আমি এগিয়ে যাই। বাঘ কোথায় আছে হয়তো আমার কাঁধের উপর থেকে দেখতে পাবেন।' পরেশবাবুকে কাঁধে নিয়ে খানিকটা যেতেই চিতাটা আমাদের দেখতে পেয়ে গোঙানো শুরু করতেই পিছনে হটে এলাম। চিতাটা কিন্তু তার জায়গা ছেড়ে বেশিদূর আসছে না। এখন কী করা যায়? পরেশবাবুর কথামতো দু-খানা বড়ো বাঁশ এনে দুজন কুলি দিয়ে সামনের খেত দু-ভাগ করে দিয়ে আমরা ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে লাগলাম, এমনি করে খানিকটা যেতেই এবার চিতাটাকে পরিষ্কার দেখা যাওয়ায় আমি গুলি করলাম। চিতাটা উলটে পড়ে গেল। তখন ঘোড়া এসে পড়ায় আমি ঘোড়ায় চড়ে মরা চিতাটার কাছে যেতেই দুটো চিতার বাচ্চা দেখতে পেলাম। সবাই মিলে সে-জায়গাটা ঘিরে অনেক চেষ্টা করেও বাচ্চা দুটোকে ধরতে পারলাম না— ঘন জঙ্গলের মধ্যে পালিয়ে গেল। চিতাটা জঙ্গল থেকে বের করে মাপ নিলাম প্রায় ৬′—৪″হবে। রাত্রে যে গুলি করেছিলাম সেটা পিঠে লেগে মেরুদণ্ড ভেঙে যাওয়ায় চার্জ করে বেশি দূর আসতে পারছিল না। লোকের কাছে শুনেছি বাঘের দুধ আগুনে পোড়ে না—হাওয়া লাগলেই জমে যায়। পরীক্ষা করে দেখলাম একথা সত্যি।

মঙ্গলদই থেকে ফেরার পথে চিতা
এর কয়েকদিন পর Mr. J. Fetters, Mr. Macleod এবং Mr. L. R. Patel স্বর্গীয় V. J. Patel-এর ভ্রাতুষ্পুত্র এরা সবাই র লোক, আমাদের বাগানে এলেন। আমরা কীভাবে ট্রাকটর দিয়ে চাষ আবাদ করছি দেখবার জন্যে আর ট্রাকটর চলছে কি না এবং কোনো দোষ ত্রুটি থেকে থাকলে সেগুলো ঠিক করে দেবেন বলে।
শিকার ছাড়া অন্য কোনো sports না থাকায় বাগানের কর্মচারী এবং আমরা মিলে ফুটবল খেলা আরম্ভ করেছিলাম। তারই ফলে কাছাকাছি অন্য বাগানে আমরা খেলতে যেতাম এবং তাঁদেরও আমন্ত্রণ করতাম।
আমাদের বাংলো থেকে প্রায় ১০।১১ মাইল দূর মঙ্গলদইতে সেদিন আমাদের খেলতে যাবার কথা। Mr. Macleod-ও আমাদের হয়ে খেলতে চলেছেন।
কোথাও গেলেই সঙ্গে একটা রাইফেল বা বন্দুক রাখতাম। খেলে ফেরবার পথে দেখি পথের ধারে কতগুলো বস্তির লোক মিলে বাদ্যযন্ত্র নিয়ে গান-বাজনা করছে, সঙ্গেসঙ্গে পানপাত্রও হাতফিরি হচ্ছে। একটু দূরে এদের দিকে পিছন ফিরে একটা বড়ো চিতা সামনের মাঠে চরে বেড়ানো একটা গোরু লক্ষ করছে। সে তার শিকার নিয়ে এতই ব্যস্ত যে এতগুলো লোকের গান-বাজনা ও মত্ততার কোলাহল এবং আমাদের মোটরের ঘড়ঘড়ানির শব্দেও তার ভ্রূক্ষেপ নেই, শিকারের উপর লাফিয়ে পড়বার ভঙ্গিতে বসে রয়েছে, শুধু ন্যাজের ডগাটা একটু নড়ছে। গাড়ি থেকে আমি আর Macleod নেমে চিতার পিছন দিকে প্রায় ২৫।৩০ হাত দূরে দাঁড়িয়ে বলাবলি করছি যে কোনখানে গুলি করা যায়, কারণ চিতাটা মাথা নীচু করে সামনের দুটো পায়ের ওপর ভর দিয়ে পিছনদিকটা উঁচু করে এমনভাবে আছে যে তার ঘাড় ভালো করে দেখা যায় না। পাশের দিকে যেতেও ভরসা হয় না, সামনে যাওয়াও অসম্ভব। পিছনের দিকটা ক্রমশ উঁচু হচ্ছে, লাফ দেবার পূর্ব লক্ষণ দেখে আর দেরি না করে গুলি করলাম। কোনো শব্দ না করে চিতাটা শুয়ে পড়ল। আমি আবার গুলি করব, কিন্তু Macleod বললে, 'একটু অপেক্ষা করুন, আমি এর নাড়িটা পরীক্ষা করে দেখি মরে গেছে কি না।' সে এক হাসির ব্যাপার। সাহেব খানিকটা এগিয়ে গিয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে বাঘের পিছনের পায়ে হাত দিয়েই চট করে সরিয়ে নিল। তারপর আবার হাত দিয়ে বললে যে না একদম শেষ হয়ে গেছে, নাড়ির স্পন্দন নেই। আমার গুলিটা সোজা হার্ট দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ায় প্রায় গুলির সঙ্গেসঙ্গেই চিতাটা মারা গেছে, নইলে নাড়ি দেখার ফলে হয়তো সাহেবকেই হাসপাতালে পাঠাতে হত। বন্দুকের শব্দ পেয়েই গানবাজনারত লোকগুলো ছুটে এল, তাদের এত কাছেই এত বড়ো একটা চিতা ছিল তারা জানতেই পারেনি। আমাদের অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে তারা চিতাটা গাড়িতে উঠিয়ে দিল। মাপ নিয়ে দেখলাম ৮′-৬″। এখন অবধি এইটিই আমার সবচেয়ে বড়ো চিতা।
ট্রাকটর থেকে চিতা
সাধারণ লাঙল আর কলের লাঙল দিয়ে চাষের মধ্যে অনেকটা পার্থক্য আছে। সাধারণ লাঙল দিয়ে চাষ করতে হলে জমি পরিষ্কার করে নিতে হয়, কিন্তু কলের লাঙল দিয়ে চাষ করতে হলে ছন, ইকরা বা তারাবন জাতীয় জঙ্গল পরিষ্কার করার প্রয়োজন হয় না বরং কল চালানোর ফলে এগুলো এমন অদ্ভুতভাবে উলটে মাটি চাপা পড়ে যে সারের কাজ করে— কেবল বড়ো গাছ যদি জমিতে থাকে তবে সেগুলো কাটতে হয়। কলের লাঙল দিয়ে অল্প সময়ে এত বেশি পরিমাণ জমি ভালোভাবে চাষ করা চলে যে সাধারণ লাঙলের সঙ্গে তুলনাই হয় না। কিন্তু একটা অসুবিধা এই যে অল্প জমি কলের লাঙল দিয়ে চাষ করা চলে না। খুব বড়ো প্লট হলে, কলের লাঙল দিয়ে প্রথমে বাইরে থেকে বৃত্তাকারে চাষ আরম্ভ করে পরে চৌকোভাবে ভিতরের দিকে চাষ করা হয় এবং সবশেষে কোনাকুনি চাষ দিয়ে শেষ করা হয়। জমি চাষ করা আরম্ভ হলেই এইসব ছন, ইকরা ও তারাবন থেকে মুরগি, তিতির প্রভৃতি পাখি বের হতে থাকে, পরে হরিণ, শুয়োর জাতীয় জানোয়ার এবং সব শেষে চিতা কিম্বা বাঘ বের হয়। এজন্য আমি যেদিন ট্রাকটর চালাতাম, সঙ্গে একটা রাইফেল এবং বন্দুক রাখতাম।
আমি কেমন ট্রাকটর চালাতে পারি, দেখতে চাওয়ায় Mr. Fetters-কে আমার পাশে বসিয়ে একদিন সকালে ট্রাকটর দিয়ে চাষ আরম্ভ করলাম। অভ্যাস মতো আমার .২৫০/৩০০০ রাইফেল সঙ্গেই ছিল। আমার সৌভাগ্যবশত সেদিন একটা চিতা বের হওয়ায় সেটাকে গুলি করে মারি। Mr. Fetters ট্রাকটরের bonnet-এর উপর চিতাটা রেখে আমাকে পাশে দাঁড় করিয়ে তাঁর camera দিয়ে একটা snap নিলেন। তাঁদের বিজ্ঞাপনের বই 'The dotted line'-এ ছবি দিয়ে চিতা শিকারের বেশ দু-লাইন লিখে তাঁর ট্রাকটরের বিজ্ঞাপন প্রকাশ করলেন। এর একখানি কপি আমাকে পাঠিয়েছিলেন।
পরপর কয়েকটা চিতা শিকারের যে কথাগুলো লিখলাম হয়তো অনেকে এগুলো শুধু গল্প বলেই মনে করবেন আবার অনেকে মনে করবেন শিকার করা খুব সহজ ব্যাপার কিন্তু সত্যি বলতে দুটোর একটাও নয়। শিকারজীবনে কোনো কোনো সময়ে এ-রকম দু-চারটে শিকার খুব সহজলভ্য হলেও বাস্তবিকপক্ষে তা নয়। পাকা শিকারি যাঁরা, তাঁরা আমার একথা নিশ্চয়ই বুঝতে পারবেন।

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন