বিশ্বদেব গঙ্গোপাধ্যায়

সুধাংশুকান্ত আচার্য
১৯৩৪ সালের ২৫ নভেম্বর আমার শিকার-জীবনের শ্রেষ্ঠ ও স্মরণীয় দিন। ওইদিন সকালে ম্যানেজারবাবু এসে জানালেন যে, আমাদের এক গাড়ি কয়লা এসেছে এবং আজই গাড়ি খালাস করে না দিলে ডেমারেজ দিতে হবে। বাগানে যে কয়েকজন মোটর ড্রাইভার আছে তাদের সবারই জ্বর। একমাত্র ন্যাপা ভালো আছে, তাকে ছেড়ে দিলে সুবিধা হয়। অগত্যা ন্যাপাকে ডেকে কয়লা আনার কথা বলে দিলাম— আরও বললাম যে, সন্ধের দিকে তাকে ছুটি দিয়ে আমি নিজে বরং কয়েকবার গিয়ে অবশিষ্ট কয়লাগুলো নিয়ে আসতে পারব। ন্যাপা এ প্রস্তাবে রাজি হল না— সে বললে, তার বিশ্রামের দরকার নেই, সে একাই সমস্ত কয়লা নিয়ে আসতে পারবে। তবে শেষের দিকে শিকারের জন্য আমি তার সঙ্গে যেতে পারি। সে ট্রাক নিয়ে বেরিয়ে গেল, আমিও মাঠের কাজ দেখতে লাগলাম।

বেলা প্রায় বারোটা। ন্যাপা এর মধ্যে দু-তিন বার কয়লা এনে কলঘরের কাছে নামিয়ে এসেছে। এবার দেখি কয়লাসুদ্ধ ট্রাক নিয়ে মাঠে এসে হাজির। আমি একটু বিস্মৃত হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম— ব্যাপার কি? সে বলল— আসবার সময় পথে দুটো বনগোরু— বাইসন দেখে এসেছে— এখন গেলে খুব সম্ভব পাওয়া যাবে। সমস্ত কয়লা যা বাকি ছিল তা নামানো হয়েছে, আজ না আনতে পারলেও কোনো ক্ষতি নেই। তখনই ইলিমকে হাতি আনতে খবর পাঠালাম, ম্যানেজারবাবুকেও জানিয়ে দিলাম যে ন্যাপা আজ আর কাজে যেতে পারবে না— আমার সঙ্গে শিকারে যাচ্ছে।
মাঠ থেকে বাংলোয় ফিরে শিকারের জন্য তৈরি হয়ে নীচে আসামাত্রই দুজন লোক কাঁদতে কাঁদতে এসে আমার পা জড়িয়ে ধরল। কী হয়েছে জিজ্ঞেস করতে তারা ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললে যে, একদন্ত তাদের বস্তিতে এসে মহা উৎপাত আরম্ভ করে দিয়েছে— শুধু তাই নয়, তাদের একজনের স্ত্রী ও আর একজনের এক আত্মীয়কে মেরে ফেলেছে। এখুনি যদি আমি গিয়ে সকলকে রক্ষা না করি, তবে একদন্ত আজ কতজনকে মারবে তা বলা যায় না! শুনে বড়ো কষ্ট বোধ হল, তবুও রাগের ভান করে বললাম— বেশ আমি যাব কিন্তু খবর যদি মিথ্যে হয় তবে তার জরিমানা দুটো ঘাটী দিতে হবে। দ্বিরুক্তি না করে লোক দুটো স্বীকার করল। এর মধ্যে ইলিম হাতি নিয়ে এসেছে। তাকে বললাম— এই লোক দুজনকে নিয়ে ওদের বস্তিতে গিয়ে খোঁজ নাও সেখানে একদন্ত আছে কিনা। থাকলে তার ওপরে সতর্ক দৃষ্টি রাখো— আমরা একটু পরেই আসছি।
ওদের বস্তি আমাদের বাগান থেকে চার-পাঁচ মাইল দূরে। বেলা দুটোর সময় ট্রাক ভরতি হয়ে আমরা সেই বস্তিতে পৌঁছুলাম। ইলিম এসে জানাল যে এবারকার খবর সত্যি— সে নিজে একদন্তকে দেখেছে, এখন একটা বড়ো বেতঝাড়ের মধ্যে আছে।
আমাদের দুটো হাতির মধ্যে একটির নাম 'বিজয়সিংহ', অন্যটির নাম 'বালা'। আমি বিজয়সিংহের ওপর না উঠে বালার উপর উঠলাম— কারণ, নর হাতি দেখলে পাগলা গুন্ডা হাতি ভয়ানক ভাবে charge করে। ইলিমকে আস্তে আস্তে বেতঝাড়ের মধ্যে ঢুকে যেতে বললাম। বেতঝাড়ের ভিতর ঢোকা যে কত কঠিন ব্যাপার তা লিখে বোঝানো শক্ত। বেতের শিষ ও কাঁটা লেগে সবারই হাত-পা ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেল। সঙ্গে ছিল খোকা ও গিরন— তারাও কাঁটার খোঁচায় ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠল। কিন্তু এত কষ্ট করেও কিছু লাভ হল না। একদন্ত আগেই সেখান থেকে সরে গিয়েছে। হতাশ হয়ে জঙ্গল থেকে বের হব, এমন সময় গ্রামের লোকের চিৎকার শুনে তাড়াতাড়ি সেদিকে গিয়ে দেখি, একটা প্রকাণ্ড হাতি ধানখেতের মধ্যে দাঁড়িয়ে নিশ্চিন্ত মনে ধান খাচ্ছে। এত লোকের হইচই সে যেন ভ্রূক্ষেপই করছে না। এতদিন যাকে দেখার জন্য এত জায়গায় ছুটোছুটি করে বেড়িয়েছি, আজ তাকে এমনি কাছে ভালো করে দেখতে পেয়ে, উত্তেজনায় আমার হাত-পা ঠকঠক করে কাঁপতে লাগল। যদিও অভ্যাসমতো গুলি করার জন্য রাইফেল তখনই তুলে ধরেছিলাম, কিন্তু গুলি করা এ অবস্থায় সম্ভব নয়। তাই হাতি থেকে লাফিয়ে নেমে সবাইকে চুপচাপ থাকতে বলে রাইফেল নিয়ে ধানখেতের মধ্যে দিয়ে একদন্তের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলাম। একটু পরেই বোধ হল হাতিটা আমাকে দেখতে পেয়েছে— কারণ, সে কান ফেঁদে শুঁড় তুলে ল্যাজ সোজা করে স্থির হয়ে একটু দাঁড়িয়েই আস্তে আস্তে দু-এক পা করে আমার দিকে এগুতে লাগল, মনে হল এবারে ঠিক চার্জ করবে। আমি তাকে সে-অবসর না দিয়ে, ধানখেতের মধ্যে একটা জংলি গাছে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে, তার বিরাট মাথা লক্ষ করে গুলি ছুড়লাম। স্পষ্ট দেখতে পেলাম হাতিটা একটু চমকে মাথাটা সরিয়ে নিল এবং আমাকে আক্রমণ না করে একটু ঘুরে দাঁড়াল। তাড়াতাড়ি রাইফেলে আর একটা গুলি ভরে তার বিরাট পাঁজরা লক্ষ করে গুলি করলাম এই মনে করে যে, সে যদি এখন আমাকে আক্রমণ করে তবে তাকে ফেরাবার জন্য তখনও আর একটি গুলি আমার রাইফেলে রইল। কিন্তু আক্রমণ দূরে থাকুক, আমার দ্বিতীয় গুলি খেয়ে অতবড়ো হাতিটা একেবারে উলটে পড়ে গেল— ঠিক যেন একটা বড়ো কালো পাথর কেউ পাহাড়ের গা দিয়ে গড়িয়ে ফেলে দিলে। আমি আনন্দে তখনই আর একটা গুলি ছুড়লাম, কিন্তু এবারের গুলি হাতির গায়ে না লেগে আমার চার-পাঁচ হাত সামনের কতকগুলো ধানগাছ মাটিসুদ্ধ উড়িয়ে নিয়ে গেল। রাইফেলের নল যে এতখানি ঝুলে পড়েছে আমি তা মোটেই বুঝতে পারিনি। যা হোক, এইভাবে আর গুলি করা ঠিক হবে না মনে করে, ইলিমকে ডেকে বালার উপরে উঠে একদন্তের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলাম। এরই মধ্যে সে উঠে সামনের বাঁশঝাড়ে মাথা ঢুকিয়ে এমনভাবে আমাদের দিকে পিছন ফিরে দাঁড়াল যে, তার মাথাটা আর মোটেই দেখতে পাচ্ছিলাম না। আমরা যখন প্রায় পঞ্চাশ গজ দূরে তখন ইলিমকে ওর সামনে যেতে হুকুম দিতে সে বললে— দাদা, সেটা ঠিক হবে না— অতবড়ো হাতি মরতে মরতেও যদি একবার চার্জ করে, তবে আপনাকে তো বাঁচাতে পারবই না, আমরাও কেউ বাঁচব না। তার চেয়ে বরং এখান থেকেই গুলি করে ওর মেরুদণ্ড ভেঙে দিন। কথাটা ঠিক বলেই মনে হল। মেরুদণ্ড লক্ষ করে একটি গুলি করতেই হাতিটা আস্তে আস্তে বসে পড়ল এবং শুঁড় আকাশের দিকে তুলে শব্দ করে ভগবানের কাছে যেন তার অন্তিম প্রার্থনা জানাচ্ছে মনে হল— সেই সময় পিছন থেকে তার মাথাটা দেখতে পেয়ে আর একটা গুলি করলাম। সঙ্গেসঙ্গেই সে মাথা নামিয়ে দাঁতটা জোরে মাটিতে বসিয়ে দিলে। প্রসিদ্ধ লেখক Rudyard Kipling লিখেছেন, হাতি মরার আগে ভগবানকে ডাকে। আমার এই ব্যাপার দেখে তাঁর সেই কথাটা সত্য বলে মনে হল। কাছে গিয়ে দেখলাম তখনও শুঁড়ের ডগাটা অল্প অল্প নড়ছে, আর একটা গুলি করে সব শেষ করে দিলাম। আমার হাতি 'বালা'র উপর থেকে তার উপরে লাফিয়ে উঠতে একটু অসুবিধে হল না। বালা সাড়ে আট ফিট উঁচু, কিন্তু একদন্ত যে 'বৈঠ' দেবার ভঙ্গিতে বসেছিল, তাতেও সে বালা থেকে বেশ উঁচুই ছিল। এতবড়ো হাতি নিরাপদে শিকার করবার আনন্দের আতিশয্যে আমি উচ্ছ্বসিতভাবে বললাম— ইলিম, এইরকম হাতিতে হাওদা চাপিয়ে শিকার করতে কী আনন্দ, —কিন্তু ইলিমের কাছ থেকে কোনো জবাব না পেয়ে ফিরে চেয়ে দেখি, সে আর গিরন দুজনেই কাঁদছে।

তাদের দুঃখের কারণ বুঝতে পারলাম— পুরুষানুক্রমে তারা হাতি চালিয়ে আসছে— হাতিকে তারা নিজের জন বলেই জানে— তাই বন্য হাতি হলেও হাতির ওপর তাদের টান এত বেশি। যা হোক, ইলিম আমার কথার জবাবে বলল— ওর ওপরে হাওদা কষে শিকারে গেলে কিংবা চারজামা চড়িয়ে রাস্তায় বের করলে অতি চমৎকার দেখায় সত্যি, কিন্তু ওকে চালাত কে? ওর ঘাড়টা দেখছেন না? হাতিটার ঘাড়ের দিকে তখন লক্ষ্য গেল— দেখলাম, তার ঘাড় এত চওড়া যে আমি কোনোরকমেই দু-দিকে পা ঝুলিয়ে মাহুতের মতন করে তার ওপরে বসতে পারলাম না। এই অবসরে আমার হাতি দুটো খেতের ধান খাচ্ছে আর নষ্ট করছে দেখে, মাহুতকে হাতি সরিয়ে নিতে বললাম। কিন্তু সবাই আপত্তি জানিয়ে বলল, একদন্তর উৎপাতে তারা ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছিল, আজ থেকে যখন আর তার উপদ্রবের আশঙ্কা রইল না, তখন যে হাতির সাহায্যে আমি একদন্তকে মেরেছি, খেতের সমস্ত ধান সেই হাতিরই প্রাপ্য— আমি যেন তাতে বাধা না দিই। হঠাৎ ন্যাপা এসে আমার হাত ধরে টেনে বলল, দাদা, নেমে আসুন শিগগির। আমি নেমে পড়তেই সে বলল, হাতিটার ওপর নিশ্চয়ই দেবতার দৃষ্টি আছে, দেখুন না ওর পিতামটার— কপালটার দিকে চেয়ে? বিস্মিত হয়ে দেখলাম, সত্যি যেন কেউ এইমাত্র তার কপালের উঁচু জায়গার চারধারে ঘুরিয়ে এক নীল বৃত্ত রচনা করেছে। আমাকে বিস্ময়ে অভিভূত দেখে কৌতূহলী জনতার মধ্যে অনেকে ব্যাপার কী জানতে চাইল। ততক্ষণে অনেকটা সামলে নিয়েছি। দেবতার দৃষ্টির কথা তাদের কাছে কোনোরকমেই বলা চলে না। তাহলে একদন্তের দাঁত কাটা নিয়ে এক মহা গোলযোগের সৃষ্টি হবে। তাই— কিছু নয়— বলে সবাইকে নিয়ে সেখান থেকে সরে এলাম। এখন আমাদের অনেক কাজ বাকি; forest office-এ খবর দেওয়া, একদন্তর দাঁত কাটা, কবর দেওয়া। তাই কয়েকজনকে মৃত হাতির পাহারায় রেখে আমরা সবাই বাগানে ফিরে এলাম।
সেখান থেকে ranger-কে খবর পাঠিয়ে নিজেরা খাওয়া শেষ করে দাঁত কাটার যন্ত্রপাতি ও লোকজন নিয়ে যখন ফিরলাম, তখন বেলা আর বেশি নেই। এর মধ্যেই forest office-এর লোক এসে দাঁত কেটে নেবার অনুমতি দিয়ে গেল। এখানে একটা কথা বলা দরকার— সাধারণত proclaimed হাতি মারলে forest office-এর লোকে এসে নিজেরাই দাঁত কেটে নিয়ে যায় এবং ছ-মাস তারা খোঁজখবর নেয় যে ওটা সত্যিই proclaimed কিনা। ছ-মাসের মধ্যে আর যদি ওই অঞ্চলের পাগলা হাতির অত্যাচারের কোনো খবর না পাওয়া যায়, তখন সেই দাঁত এবং বিজ্ঞাপিত পুরস্কারের টাকা শিকারিকে দেওয়া হয়। কিন্তু এই একদন্ত এতই সুপরিচিত ছিল যে, তার আর শনাক্ত করতে দেরি হল না। Ranger তখনই আমায় দাঁত কেটে নিয়ে যাবার অনুমতি দিয়ে গেলেন। দাঁত কাটার কষ্টসাধ্য কাজটা আমি তাদের দিয়েই করিয়ে নিতে পারতাম, কিন্তু সবসময় তারা পরিশ্রম করে দাঁতের গোড়া অবধি না কেটে বাইরে যতটুকু থাকে সেইটুকু মাত্র কাটে বলে এই ভারটা নিজের ওপরই রাখলাম।

তবে মুশকিল হল এই যে, আমরা কেউ জানতাম না দাঁত কাটা প্রথমে কোথা থেকে আরম্ভ করতে হবে। তাই যতটুকু বাইরে আছে তার গোড়া থেকে শুরু করলাম। হাতির দাঁতের গোড়া যে তার চোখ অবধি তা আগে জানা ছিল না। এদের দাঁত বাইরে যতখানি থাকে, ভিতরেও প্রায় ততখানি থাকে। দশ-বারোজন পালা করে সন্ধ্যা থেকে কাটতে আরম্ভ করে যখন দাঁত কাটা শেষ হল তখন ভোর। আমরা তিন-চারজন একসঙ্গে কাজ করতাম আর বাকি সাত-আটজন হাতির মৃতদেহের ওপর হাত পা ছড়িয়ে বিশ্রাম করত, এমনকী ঘুমোতেও অসুবিধা বোধ করেনি। এমনি প্রশস্ত এবং মাংসল তার দেহ। হবে না কেন! সে ছিল— স্বাধীন— পোষা জানোয়ারের বাঁধা বরাদ্দের ওপর তাকে নির্ভর করতে হয়নি— তাই তার দেহ সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবেই বেড়ে উঠেছিল।
মরবার সময় একদন্ত'র কপালে যে নীল বৃত্ত দেখা গিয়েছিল এই বিষয়ে বাবাকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছিলাম। তিনি তার উত্তরে লিখেছিলেন যে, খুব সম্ভব এই হাতির মাথায় গজমুক্তা আছে। আমি যেন মাথাটা কেটে ভালো করে খোঁজ করি। কিন্তু তখন সে-উপায় ছিল না। কারণ, তাকে মাটি চাপা দেওয়া হয়ে গিয়েছিল।
এর চার-পাঁচ বছর পরে বাবা ও মা বাগানে বেড়াতে আসেন, তখন বাবার সঙ্গে সেই একদন্ত'র কবর খুঁড়ে দেখা গেল— তার দেহ থেকে ধোঁয়া উঠছে ও প্রায় অবিকৃত অবস্থায় আছে। আমি আজও জানি না, এর কারণ কী। আবার তাকে মাটি চাপা দিয়ে রেখে এলাম। গজমুক্তার খোঁজ করা আর হয়নি। হাতিটা উঁচুতে বারো ফিটের ওপর ছিল আর দাঁতটা লম্বায় পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চি এবং বেড়ের দিকে এক ফুট পাঁচ ইঞ্চি এবং ওর ওজন ছিল এক মণ পাঁচ সের।

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন