শিকার, শিকারী ও জীবজন্তু সম্বন্ধে বিবিধ জ্ঞাতব্য তথ্য

বিশ্বদেব গঙ্গোপাধ্যায়

শিকার, শিকারী ও জীবজন্তু সম্বন্ধে বিবিধ জ্ঞাতব্য তথ্য

অরণ্য-বিদ্যায় দক্ষ অভিজ্ঞ লোকের সাহায্য ও শিক্ষা ব্যতীত হাতে-কলমে বনের জন্তুকে সন্ধান করে আবিষ্কার করবার বিদ্যা কোন রকমে লাভ হতেই পারে না। ...প্রথমত যে-জন্তু শিকার করতে যাবেন তার অভ্যাস, স্বভাব ও গতিবিধির সম্বন্ধে আপনার বিশেষ অভিজ্ঞতা থাকা আবশ্যক।

*

বনের ভিতর যে সব সুঁড়ি-পথ দিয়ে জানোয়াররা আনাগোনা করে, তা খুঁজে পাওয়া শক্ত নয়। তাড়া খেয়ে কোথায় গিয়ে তারা আশ্রয় নেবে, সেটাও অনুমান করা সহজ। ...আমরা যে শুনতে পাই, শিকার করতে গিয়ে অমুক লোক হঠাৎ মারা গিয়েছে কিংবা ঘায়েল হয়েছে, এ সব অনর্থ কিন্তু অকারণে ঘটে না, দৈবাৎ তো নয়ই। এর মূলে থাকে অজ্ঞতা, অনভিজ্ঞতা কিংবা দুঃসাহসিকতা; চলতি কথায় যাকে বলে, বোকামি ও গোঁয়ারতুমি!

*

মৃগয়া শুধু খেলা নয়, এর মধ্যে বিপদও অনেক। তাই সাহস আর বুদ্ধি দুয়েরই বিশেষ প্রয়োজন। তা না হলে এ খেলায় কোন আমোদই থাকত না!

*

শিকারের রাজ্যে ব্যাঘ্রবীরকেই সম্মানের প্রথম পদ দেওয়া উচিত। তিনিই এ রাজ্যের অধিনায়ক। যদিও এই রাজকীয় সংখ্যা অধিক নয়, তবুও আমাদের বিশাল অরণ্য-প্রদেশে তাদের নির্বংশ হবার সম্ভাবনা খুবই কম।

*

যে ব্যক্তি মৃগয়ার নিয়ম মেনে চলে, যার যথার্থ এ-সম্বন্ধে যার অনুরাগ আছে, সে কখনও নির্বিকার জীবহত্যা করে না। যাদের সঙ্গে শত্রুতাচারণ করে, তারা প্রায়ই প্রবল জোয়ান। আর যাতে অধিক সংখ্যা মৃত্যুমুখে পতিত না হয় সে বিষয়েও দৃষ্টি রাখে। কিন্তু শিকার যাদের ব্যবসা ও জীবিকাঅর্জনের উপায়, তারাই কোন নিয়ম গ্রাহ্য করে না; জীবহত্যাকাণ্ডে সংখ্যা নিয়মিত করার চেষ্টা তাদের আদৌ নেই! এই অত্যাচার রহিত করার জন্যে অনেক বিধি-বিধান প্রচলিত হয়েছে। কিন্তু এ বিষয়ে আরও সতর্ক ও সাবধান হওয়া আবশ্যক।

*

নরমাংস ও মৃগমাংস লোভী ব্যাঘ্রদের কথা বলতে গেলে বলা উচিত তারা ভিন্ন গোত্রীয় হলেও এক জাতীয়। তাদের বিপুল শরীর, দৈর্ঘ্যে দশ ফুটের কিছু উপর (রোলাণ্ড সাহেবের পরিমাণরীতি অনুসারে)। শস্য-শ্যামলা বঙ্গমাতা তাদের নামকরণ করেছেন, 'বাঙ্গলার ব্যাঘ্ররাজ'। বঙ্গভূমির জল-বাতাসের গুণে তাদের বরবপু শুধু দৈর্ঘ্যে নয়, আয়তনেও বৃদ্ধি পায়। তাই তারা দেখতে শহরের কাঙাল কেরানীদের মত নয়। মফঃস্বলের মহিমান্বিত জমিদার ও রাজা-রাজড়ার মত মেদমাংসবহুল। চাল-চলনও বিশেষ গম্ভীর রকমের। ...তারা চতুর, সতর্ক, দ্রুতগতি, সহসা তাদের শিকার করা কঠিন।

*

ব্যাঘ্রের স্ত্রী-পুরুষের প্রভেদ আয়তনে ও চতুরতায়। মেয়েরা চালাক বেশী। এইভাবেই বোধ হয় তারা গায়ের জোরের অভাবটা পূরিয়ে নেয়। ...সন্তান-পালন ও রক্ষণের জন্যও বাঘিনীকে অনেক সময় বেশী সতর্ক হতে হয়। কেন না, বাপেদের গ্রাস হতে তার পেটের ছেলেদের রক্ষা করার জন্য অনেক বুদ্ধি খরচ, অনেক ফন্দী আঁটা দরকার। শুধু তাই নয়, এই সময়ে তার ছেলেদের আর আপনার ভরণপোষণের ভার নিজেকে না নিলে চলে না। যিনি জন্মদাতা তিনি কিছুই করেন না; উল্টে ছেলেগুলিকে কেমন করে মারবেন সেই মতলবে ফেরেন। ছেলেগুলি যখন কিছু বড়সড় হয়ে আত্মরক্ষায় সক্ষম হয়, তখনই তাদের মায়ের ভাবনা যায়।

*

বাঘ কিংবা চিতা জলের ঘেঁষ নিতে চায় না মনে করা ভুল। সচরাচর তারা জলে পা দিতে চায় না সত্যি, তবে দরকার হলে স্রোতে গা-ভাসাতে আপত্তি কিংবা অনিচ্ছা দেখায় না। ...এরা সাঁতার দিয়ে বড় বড় খাল বিল বেশ পার হয়ে যায়।

*

পায়ের চিহ্ন দেখে বাঘ কি বাঘিনী বুঝে নেওয়া যায়। চিতাদের সম্বন্ধেও এ কথাটা খাটে। বাঘের পায়ের দাগ অনেকটা চৌকো গড়নের; বাঘিনীর তা নয়। গোল বাধে বাচ্চাদের বেলায়। তাদের পায়ের দাগ দেখে বাঘ কি বাঘিনী বুঝে ওঠা দায়। কিন্তু একটি সহজ উপায়ে এ সমস্যারও মীমাংসা করা যেতে পারে। পায়ের একটা দাগ হতে অন্য দাগের ব্যবধান কতখানি দেখলেই সেটা সহজে বোঝা যায়। পায়ের দাগের আকার দুইয়েরই সমান; তবে খোকা বাঘের পায়ের ফাঁদ খাটো, আর খুকীর লম্বা।

*

বাঘ ও চিতার শিকারপদ্ধতি ভিন্ন। বাঘ কোন জন্তুর পিঠে বা ঘাড়ে পড়েই সামনের পায়ের থাবা দিয়ে তার ঘাড় মটকে ভেঙে দেয় এবং মারবার পরই তাকে মুখে করে কিছু দূর টেনে নিয়ে কোন ঝোপের আড়ালে কিংবা তলায় লুকিয়ে রাখে। চিতা তার শিকারের ঘাড়ে গিয়ে পড়ে বা গলায় কামড় দিয়ে ধরে থাকে। জন্তুটি মরে পড়ে গেলে তবে তাকে ছাড়ে। লোকে বলে রক্ত শুষে নেবার জন্যে সে এমন করে; কিন্তু এ সম্বন্ধে কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি বলে এটাকে সাক্ষ্যরূপ মেনে নেওয়া যায় না।

*

একই দৈর্ঘ্য ও আয়তনের বাঘ বা চিতা কিন্তু ওজনে সমান। একটা বড় বাঘের ভারে একখানি বড় শক্ত চারপাই মড় মড় করে ভেঙে পড়তে পারে। চিতা ওজনে ১ মণ ৩৫ সেরের বেশী হতে প্রায় দেখা যায় না। কিন্তু সে ক্ষেত্রে একটি বড় বাঘ ওজনে সাড়ে ৭ মণ পর্যন্ত হতে পারে।

*

এদেশীয় ভল্লুক আলাস্কাবাসী ভ্রাতার মত বৃহদাকার হয় না, তবুও তার দৈর্ঘ্য ও আয়তন কিছু মন্দ নয়। কখন কখন তাদের প্রায় ৭ ফুট কিংবা তার কাছাকাছি হতে দেখা যায়। ...মানুষের মত সমস্ত পায়ের পাতা দিয়ে সে হাঁটে। পথে যে পায়ের চিহ্ন রেখে যায়, তাও মানুষের মত। ... ভালুক আক বড় ভালবাসে; যে সব চাষীর আকের ক্ষেত একটু নির্জন জায়গায়, সেখানে এদের ক্ষেত-ছাড়া করা বড়ো শক্ত কাজ। ...আহার সন্ধানে এরা বড় শুদ্ধাচারী। বেশীরভাগ ফলমূল খেয়েই জীবনধারণ করে। তা'বলে সম্পূর্ণ অহিংস বলা চলে না। নিতান্ত দায়ে পড়ে মাংস ভক্ষণও করে থাকে। ভালুক তার ছানাদের পিঠে করে ব'য়ে নিয়ে বেড়ায়। তার নখ এবং দাঁত দুই অত্যন্ত তীক্ষ্ন ও ভয়ানক। এর দ্বারাই শত্রুকে আক্রমণ করে এবং অল্পক্ষণের মধ্যেই ক্ষতবিক্ষত করে দেয়।

*

শিকার করতে গিয়ে প্রত্যেক শিকারীর প্রধান কর্তব্য একে অপরকে প্রীত মনে সাহায্য করা। যদিই বা শিকার নিয়ে দুর্ভাগ্যবশতঃ কোন বিবাদ-বিসংবাদ উপস্থিত হয়, তা'হলে শিকারকর্তা এ সম্বন্ধে যে বিচার করেন সেইটিই সন্তুষ্ট চিত্তে মেনে নেওয়া উচিত। নিজের ন্যায্য দাবী বরং ছেড়ে দেওয়া ভাল, তবু কলহ করে মৃগয়া-শিবিরের শান্তি ও সন্তোষ হানি করা কখনও উচিত নয়।

'ঝিলে-জঙ্গলে শিকার'— কুমুদনাথ চৌধুরী। প্রিয়ম্বদা দেবী কর্ত,ক গ্রন্থকারের 'Sports in Jheel & Jungle' নামক গ্রন্থের বঙ্গানুবাদ থেকে অংশত গৃহীত। প্রকাশকাল, ১৩৩১।

*

ব্যাধের শিকার উপজীবিকা মাত্র, কিন্তু ভদ্রের শিকার খেলার (sports-এর) পর্যায়ভুক্ত। সুতরাং ব্যাধের হত্যা ব্যাপক হতে পারে, কিন্তু ভদ্রের শিকার বিচারসহ মাত্রার মধ্যে হতেই হবে। খেলার জন্যে হলেও ভদ্র-সন্তানের মনে রাখতে হবে যে শিকার অতি নিষ্ঠুর খেলা— এ যাতে মানুষকে হিংস্র বা ঘৃণ্য করে না তোলে তার জন্যে অনেক সময়ই সজ্ঞান সাবধানতা দরকার।

*

সংযত ভাবে শিকার করলে মানুষের মন সবল থাকে, উৎসাহ যোগ্য হয়, শরীরে চর্বি বাড়তে পারে না, লোকে আত্মবিশ্বাসী হয়, কষ্টসহিষ্ণুহয়, মানুষের মন অযথা দুর্বল হয় না ইত্যাদি। আবার অতিরিক্ত শিকার-প্রিয় হলে মানুষের মন চঞ্চল হয়, শরীর ব্যাধিগ্রস্ত হয়, স্বাস্থ্য ক্ষয় পায়, মানুষ নিষ্ঠুর হয়ে ওঠে এবং তার আচরণ কর্কশ হয়— ফলে এ হেন লোকের সমাজের পক্ষে অনিষ্টকর হয়ে ওঠার আশঙ্কা থাকে। সুতরাং ভদ্র-শিকারী হতে হলে সর্বদা মাত্রাজ্ঞান সম্বন্ধে সচেতন থাকতেই হবে।

*

জায়গার তারতম্য অনুসারে শিকারের লক্ষ্যবস্তু এবং শিকারের প্রণালীরও পার্থক্য ঘটে।

...পলি মাটির জঙ্গলে শিকার দুই রকমের করা চলে— (১) সুন্দরবন অঞ্চলে নৌকা, মোটর বোট অথবা ষ্টীমলঞ্চ নিয়ে, (২) অপেক্ষাকৃত শক্ত মাটির জঙ্গলে, যেমন শ্রীহট্ট এবং আসামের সমতটের জঙ্গলে হাতী নিয়ে শিকারই সহজসাধ্য। পাহাড় অঞ্চলে শিকার— (১) পায়ে হেঁটে, (২) মোটর গাড়ি চলার রাস্তা থাকলে, মোটর গাড়ি চড়ে রাত্রিতে আলো নিয়ে, (৩) মাচান থেকে, (৪) অথবা হাঁকাও করে করা চলে।

সম্ভবপর জায়গায় বন হাঁকাও করে শিকারই সুবিধা। সব দেশে আবার হাঁকাও করার লোক পাওয়া সহজ নয়। কাজেই দেশ, কাল এবং আপন সামর্থ্য অনুসারে শিকারীকে শিকারের লক্ষ্য, স্থান এবং উপায় ঠিক করে নিতে হবে।

*

যেখানেই শিকার করতে যাওয়া যাক না কেন, প্রথম প্রথম অভিজ্ঞ সুশিক্ষিত শিকারীর সঙ্গে গিয়ে বন-জঙ্গল ও শিকারের অভিজ্ঞতা অর্জন করা প্রয়োজন। শিকারের জায়গা ও জন্তু-বিশেষের দিকে লক্ষ্য রেখে কোন শ্রেণীর বন্দুক ও গুলি ব্যবহার করা উচিত তা ভাল করে জেনে নেওয়া দরকার। গুলি ও বন্দুক নির্বাচনের উপর শিকারের সাফল্য অনেক পরিমাণে নির্ভর করে।

...সম্ভবপর হলে বন্দুক চালনা সম্বন্ধে আবশ্যক শিক্ষা কোনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে নিয়ে নেওয়া ভালো। শিকারে বেরুবার পূর্বে নিজের নিশানার অব্যর্থতার উপর আস্থা জন্মানো চাই— সেটা কিছু ব্যয় এবং আয়াস সাধ্য কিন্তু অপরিহার্য।

*

আপনি কি শিকার করতে চান সেটা মোটামুটি ঠিক করে নিয়ে শিকারের জায়গা নির্বাচন করা উচিত এবং সেই অনুসারে জেনে নেওয়া প্রয়োজন, সেই শিকার কোন সময়ে গেলে সুবিধামত পাওয়ার সম্ভাবনা অধিক। সাধারণতঃ প্রায় সব জায়গায় মোটামুটি সব রকম শিকার করতে হলে জানুয়ারী মাসের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে মার্চ মাসের শেষ পর্যন্ত সময় সুবিধাজনক। গবয় ও বন্য মোষ শিকারের পক্ষে বৈশাখের প্রথম বৃষ্টি হবার পর যাওয়াই সুবিধা।

'শিকারের কথা' নামক ভূপেন্দ্রচন্দ্র সিংহ-র গ্রন্থ হইতে অংশবিশেষ উদ্ধৃত। সংস্কৃতি বৈঠক, ১৭ পণ্ডিতিয়া প্লেস, কলিকাতা হইতে প্রকাশিত। প্রকাশকাল, ১৩৫৫।

*

অনেকের ভুল ধারণা আছে যে, মানুষের সাড়া পেলেই বনের ভিতর থেকে বাঘ-ভালুক গর্জন শুরু করে। আসলে কিন্তু তা নয়— দেখা গেছে, দিনের পর দিন ক্যাম্প করে বনে বাস করলেও বাঘ-ভালুকের ডাক খুব অল্পই শুনিতে পাওয়া যায়, অথচ জঙ্গলে তাদের চলাফেরা টের পাওয়া যে যায় না তা নয়।

*

পশুদের মধ্যে হিংস্র জীব বলতে বাঘের কথাই আমাদের প্রথমে মনে পড়ে। সাধারণভাবে দেখতে গেলে বাঘ সেরকম হিংস্র নয়। নিজের খাবারের তাগিদেই সে শিকার করে এবং যাকে আক্রমণ করে, মুহূর্তের মধ্যেই তার যন্ত্রণা শেষ করে দেয়। ...কিন্তু খাবারের জন্যে শিকারের তাগিদ না থাকলে মানুষ বা অন্য কোন জানোয়ার দেখলে পাশ কাটিয়ে যায়। তবে প্রায়ই দেখা যায় যে, বাঘিনী অনবরত শিকার করে বাচ্চাদের শেখাবার জন্যে; কিন্তু ভালুকের বেলায় তা নয়— অনেক সময়েই দেখা যায় যে তারা পথ আটকে দাঁড়ায় এবং বিনা কারণে চার্জ করে। সাধারণতঃ বাঘ বুড়ো হলে যখন বুনো জন্তু শিকার করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে, তখনই গোরু, ভেড়া প্রভৃতি জানোয়ারের দিকে ধাওয়া না করে মানুষের দিকে লক্ষ্য যায়— তখনই আশপাশের গ্রামের লোকদের পক্ষে মারাত্মক হয়ে ওঠে।

*

বাঘের চার্জ সম্বন্ধে বলা যেতে পারে যে, তার গায়ে গুলি লাগলে শতকরা আশী ভাগ ক্ষেত্রেই সে মুখোমুখি চার্জ করে। শতকরা ১৫ ভাগ ক্ষেত্রে— যে-দিক থেকে গুলি করা হয়, সে-দিক লক্ষ্য করেই চার্জ করে। আর বাকী শতকরা পাঁচভাগ ছোবা থেকে দেখে দেখে চার্জ করে।

*

বাঘ একবার মানুষের মাংসের স্বাদ পেলে তা ভুলতে পারে না। অনবরত মানুষ মেরে চলে। এ সম্বন্ধে অনেক রকম মত আছে। কেউ কেউ বলেন, মানুষের মাংস বেশ সুস্বাদু— সেই জন্যই বাঘ মানুষ মারে। আবার অনেকের বিশ্বাস, বুড়ো হলে যখন শক্তি কমে আসে, তখন মানুষ শিকার সহজ বলে সে মানুষ শিকার করে।

*

বাঘ এক বছরের হলেই তার সঙ্গী খুঁজে নেয়। অনেক দিন পর্যন্ত তারা এক সঙ্গেই থাকে। ক্রমশঃ বাচ্চাদের কলরবে তাদের সংসার ভরে ওঠে। বাঘ কিন্তু তার পুরুষ-সন্তানকে মোটেই সহ্য করতে পারে না, কারণ বড় হবার সঙ্গে সঙ্গেই সে তার বাপের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে।

*

শীতের সময় বাঘ রোদে গা মেলে দিয়ে আরাম করে, গরমের দিন আবার গাছের ছায়ায় কিংবা পাহাড়ের গুহায় গা-ঢাকা দিয়ে বসে থাকে। বাঘের দৃষ্টিশক্তি খুব প্রখর। চলন্ত জিনিসই বাঘের চোখে পড়ে সহজে এবং স্থির জিনিস অনেক সময় দৃষ্টি এড়িয়ে যায়। পঞ্চাশ-ষাট হাত দূরে বসে থাকলেও বাঘ হয়ত অনেক সময় লক্ষ্যই করে না, কিন্তু কোন লোক হঠাৎ গাছে উঠছে দেখতে পেলেই সেদিকে তার চোখ যায়। ভারী শিকার সঙ্গে নিয়েও বাঘ অনায়াসে প্রায় পনর ফিট লম্বা খাল লাফিয়ে পার হয়ে যেতে পারে।

*

শিকারীদের মতে বাঘকে তিন শ্রেণীতে ভাগ করা যেতে পারে।— (১) Man-eater-মানুষখেকো, (২) Cattle-lifter—সাধারণতঃ এরা বেশ মোটা ও ভারী। সেইজন্য অনায়াসে মোষ, গোরু ইত্যাদি মুখে করে নিয়ে যায়, (৩) Game-killer— এরা হরিণ, শূকর প্রভৃতি বুনো জানোয়ার মেরে খায়। এদের শরীর অন্যান্য বাঘের তুলনায় হালকা ধরনের।

*

চিতা বাঘকে অনেক সময়েই হিংস্র হতে দেখা যায়। ...যে জঙ্গলে বাঘ খুব বেশী আছে, সেখানে চিতা খুব কমই দেখা যায়; আবার বাঘ কমলে চিতার সংখ্যা বাড়ে। চিতারা গাছে উঠতে পারে। অনেক সময় মুখে শিকার নিয়ে ১৪-১৫ ফিট লম্বা গাছ বেয়ে উঠে যায়। চিতারা বাঘের চেয়ে নিঃশব্দে বনের মধ্যে চলাফেরা করে। শিকারে গেলে বাঘের আসা-যাওয়া হয়ত টের পাওয়া যাবে, কিন্তু চিতা হঠাৎ বিদ্যুৎগতিতে চোখের সামনে এসে পড়ে— কি করে, কোথা দিয়ে এলো কিছুই টের পাওয়া যায় না। অন্ধকারে বাঘের চোখ আগুনের গোলার মত জ্বলতে দেখা যায়। রাত্রে বাতির আলোতে সব মাংসাশী জীবের চোখ লাল এবং অন্য সব জীবের চোখ সবুজ দেখা যায়।

*

শিকারীর কোন সময়েই বন্দুক ছাড়া জঙ্গলে প্রবেশ করা উচিত নয়। ... কোন সময়েই cross-fire করা বা বন্দুকে গুলি থাকুক বা না থাকুক, ঠাট্টা করে কোন মানুষের দিকে টিপ করা উচিত নয়। অহিংস মাদী জানোয়ার শিকার করাও নিষেধ।

*

হাতী কতটা উঁচু তার সামনের পায়ের পরিধি থেকেই বোঝা যায়। দড়ি দিয়ে পরিধি মেপে দেখলেই দেখা যাবে যে, হাতী ঠিক তার পায়ের দ্বিগুণ উঁচু।

*

Beat প্রথায় শিকার হলো বাঘকে জাগিয়ে ক্রমশঃ মাচানের অথবা stop-এর কাছে টেনে আনা। ...পিছন থেকে তাড়া দিয়ে সামনে শিকারীর দিকে নিয়ে যেতে হয়। যাতে সে পালাতে না পারে সেদিকে অবশ্যই লক্ষ্য রাখা দরকার। খুব বড় জঙ্গলে হয়ত বাঘের খবর পাওয়া গেছে, তখন বাঘ ঠিক কোথায় আছে জানতে হলে, তিন-চার জায়গায় ছাগল বেঁধে চেষ্টা করে দেখতে হয়। যেখানে নালা বা ছোট নদী আছে, সেখানেই ছাগল বেঁধে রাখা দরকার। কারণ, খাবারের কাছে বাঘের জল থাকা চাই এবং ছাগলটা যাতে সব সময় ডাকে এরকম ব্যবস্থা করা চাই— তা না হলে বাঘ টের পাবে কী করে! ...বীটের ব্যবস্থা করতে হলে অনেকটা জায়গা বেছে নিতে হবে। বীট যেখানে করা হবে, সেটা অন্তত ৭৫০-৮০০ গজ লম্বা হওয়া চাই, যাতে বাঘের সামনে বেশ খানিকটা জায়গা থাকে। ...তারপর মাচান থেকে জঙ্গলের দু-পাশে পরপর বাঘ যেখানে থাকা সম্ভব সে পর্যন্ত লোক সাজান থাকে— যারা জঙ্গলে বীট করবে। প্রথম বাঘের ঘুম ভাঙানোর জন্য বীটাররা চেঁচাতে থাকে। ক্রমে বাঘ জেগে চোখ মেলে চায় এবং শব্দ যেদিক থেকে আসছে সেখান থেকে দূরে যেতে চায়। জঙ্গলের দু-দিক থেকেই শব্দ হলে, সে জঙ্গলের মাঝখানে এসে পড়ে— বীটাররা পিছনে শব্দ করে আসতে থাকে। বাঘ ক্রমশঃ এগিয়ে যেতে যেতে মাচানের মুখেই পড়ে যায়; তখন শিকারী তাড়িয়ে আনা বাঘটাকে খুশিমত শিকার করে।

*

বাঘ গুলির আঘাতে জখম হলে কখনও পায়ে হেঁটে তার কাছে যাওয়া উচিত নয়— অন্তত দু-ঘণ্টা সময় দিয়ে নিজেকে ঠিকমত প্রস্তুত করে তবে এগিয়ে যেতে হয়।

*

উঁচু শক্ত গাছের উপর বসে যে শিকার করা হয়, তাকেই মাচান-শিকার বলা হয়ে থাকে। মাচানের জায়গাটা বেশ মজবুত ও প্রশস্ত হওয়া চাই। মাচানে চুপ করে বাঘের অপেক্ষায় বসে থাকতে হয়। অনেক সময় ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকাই সার হয়, বাঘ আর মেলে না। কিন্তু শিকারী অধীর হলে শিকার হারাতে হয়— অসীম ধৈর্য আর কষ্টসহিষ্ণুতা না থাকলে চলে না। অনেক শিকারী Spot-light ফেলে জানোয়ারকে বিব্রত করে শিকার করতে ভালবাসে। এতে জানোয়ারের চোখ ঝলসে যায়, সে কিছুই বুঝতে পারে না, আচমকা গুলি এসে তাকে শেষ করে দেয়— জানোয়ারকে আত্মরক্ষার সুযোগ দেওয়া হয় না— এতে কোন আনন্দ নেই।

*

কয়েকটি জানোয়ার থেকে আত্মরক্ষার উপায়। যথা— সাপ তাড়া করলে এঁকে-বেঁকে ছুটতে হয়, কখনো সোজা যেতে নেই। বন্য শূকর আক্রমণ করলে ডাইনে অথবা বাঁয়ে হঠাৎ সরে যেতে হয়। শূকর সোজা বেরিয়ে যায়, চট করে ঘুরতে পারে না। বন্য মহিষের কবলে পড়লে, কোন নালা বা গর্তের ভিতরে শুয়ে পড়লে নিষ্কৃতি পাওয়া যেতে পারে। মোষ নালা টপকে বেরিয়ে চলে যায়। হাতী পিছু নিলে নড়বড়ে পুলের তলায় আশ্রয় নিতে হয়। হাতী শুঁড় দিয়ে বুঝতে পারে, পুল তার দেহের ভার সইতে পারবে কিনা। যে জিনিস তার ভার সইতে পারবে না, তার উপর তারা কখনও যায় না।

*

কোনো জানোয়ারের ছাল মাটিতে পাপোশ বা কারপেট হিসাবে ব্যবহারের জন্য রাখতে হলে ঠিক পেটের মাঝামাঝি কাটতে হয়। মুখ থেকে ন্যাজ পর্যন্ত mount করে দেওয়ালে রাখতে হলে মাথার দিক থেকে ছাড়াতে হয়। এক কথায় বলতে গেলে ছালটা এমন ভাবে ছাড়াতে হয় যাতে সেলাইটা কোন রকমে চোখে না পড়ে। এরকম ভাবে ছাড়িয়ে নিতে হয় যাতে একটুও মাংস বা চর্বি লেগে না থাকে। নাকের ও চোখের নীচের মাংস খুব সাবধানে ছাড়িয়ে নিতে হয়। বাঘ, চিতা ও সিংহের বেলায় মাথার খুলির খুব কাছ থেকেই কানের চামড়া ছাড়াতে হয়। কানের ফুটো দুটো যাতে ঠিক থাকে সেদিকে লক্ষ্য রাখা দরকার। ছালে কোন মাংস বা চর্বি লেগে থাকলে শুকোবার সঙ্গে সঙ্গে লোমগুলো নষ্ট হয়ে খসে পড়ে। ছাল থেকে সম্পূর্ণভাবে মাংস ছাড়িয়ে নেবার পর নুন এবং ফিটকিরি গুঁড়ো করে সমান অংশে মিশিয়ে চামড়ায় লাগিয়ে দিতে হয়। চোখের পাশে, নাকের ফুটোর মধ্যে, নীচের ঠোঁটে, কানের ভিতরে এবং বাইরে খুব ভালোভাবে লাগানো চাই। তারপর ছায়ায় শুকোতে দেওয়া দরকার। মুখটা হাঁ করিয়ে রাখতে হয় যাতে বাতাস চলাফেরা করতে পারে। রাতে চামড়াটা বিছিয়ে পাথর চাপা দিয়ে রাখা চলে। শুকোবার সময় সমান ভাবে টান দিয়ে রাখা উচিত; এবং তুলে রাখার আগে ভালো করে পরীক্ষা করা দরকার যে কোন রকম নষ্ট করছে কি না। ছাল প্যাক করে পাঠাবার সময় লোমের অংশ ভিতর দিয়ে রেখে টারপিন তেল ছিটিয়ে কিম্বা ন্যাপথলিন দিয়ে গুটিয়ে প্যাক করা উচিত। কখনও রোদে শুকোতে দিতে নেই।

*

নতুন শিকারীর কোন সময়ই বন্দুক ছাড়া জঙ্গলে ঢোকা উচিত নয়। শিকারের যিনি নায়ক তাঁর কথা মেনে চলা একান্ত আবশ্যক। কোন সময়েই বা বন্দুকে গুলি থাকুক বা না থাকুক ঠাট্টা করেও কোনও মানুষের দিকে টিপ করা উচিত নয়। অহিংস মাদী জানোয়ার শিকার করা নিষেধ।

'আসামের জঙ্গলে' নামক সুধাংশুকান্ত আচার্যের গ্রন্থ হইতে অংশবিশেষ গৃহীত। ময়মনসিংহ প্রিন্টার্স লিঃ, ময়মনসিংহ হইতে প্রকাশিত। প্রকাশকাল, ১৩৫২।

*

বন্দুক স্কন্ধদেশের মূলভাগে স্থাপন করতে হয়। তাছাড়া বাঁ হাতে শক্ত করে বন্দুক না ধরে, হালকা হাতে, হাতের পাঞ্জা ঠিক ব্র্যাকেটের মত সঙ্কোচ করে তার উপর বন্দুক স্থাপন করা বিধি। শিকারের সময় অনেকে বাঁ চোখ মুদ্রিত করেন, কিন্তু বাঁ চোখ না বুজে ডান চোখ বুজে 'নিশানা' করলেই সহজে লক্ষ্য স্থির হয়। হালকা নরম হাতে বন্দুকের কুঁদো ধরা ঠিক নয়। তার পরিবর্তে বন্দুক শক্ত হাতে বুকের দিকে চেপে রেখেই গুলি ছোঁড়া উচিত। তাতে তীব্রভাবে পিছু ধাক্কা মারার ভয় থাকে না।

'শিকার-কাহিনী' নামক সূর্যকান্ত আচার্যের গ্রন্থ হইতে সংগৃহীত। সান্যাল এণ্ড কোং, কলিকাতা। প্রকাশকাল, ১৩১৩।

*

শিকারী হওয়া একটা শিক্ষা। এ-শিক্ষা বিনা সাধনায় হয় না। এই সখের জন্যে যথেষ্ট অর্থব্যয়ও করিতে হয়। শুধু তাস-পাশা খেলে অবসর সময়ে দুই-চারিটি চাঁদমারী করিলেই শিকারী হওয়া যায় না। এর জন্য অধ্যবসায়ের সঙ্গে বিশেষ পরিশ্রম ও সাধনার প্রয়োজন।

'শিকার ও শিকারী' নামক ব্রজেন্দ্রনারায়ণ আচার্য চৌধুরীর গ্রন্থ হইতে গৃহীত। প্রকাশকাল, ১৩৩৬।

*

এদেশে বন্দুক-রাইফেলের যখন বিশেষ প্রচলন হয়নি, তখন বাঘ ও বন্যবরাহ— জাল পেতে বড় বড় বর্শার দ্বারা শিকার করা হ'ত।

*

শিকারের আরও একটি কৌশল ছিল : বাঘের অত্যাচার হলে বাণ বা 'বিশাল' পাতা। যে-পথে বাঘ চলাচল করে, রাত্রে সেখানে ফাঁদ পাতা হত, দড়িতে পা দেওয়া মাত্রই, ভীষণ তীর— নাম 'বিশাল' তাকে বিদ্ধ করত। কখনও কখনও সেটা বিষ-মাখানোও থাকত। বিশাল পাতবার পূর্বে পথিক ও দেশস্থ লোকজনকে সাবধান করে দেওয়া হ'ত— যেন সে অঞ্চলে তারা রাত্রে না যায়। এ ছাড়াও বাঘ মারবার জন্যে বহু প্রকার খাঁচা তৈরী হ'ত— তার মধ্যে ছাগল, ভেড়া ইত্যাদি বাঘের লোভনীয় খাদ্য এমনভাবে রেখে দেওয়া হ'ত যে, বাঘ ভিতরে এসে প্রবেশ করলেই ফাঁদে আটকা পড়ে যেত। ফাঁদ পাতারও বৈজ্ঞানিক মাপজোক ছিল— এবং এতেও শিকারীর সাহস ও নিপুণতা প্রকাশ পায়।

*

কোনও কোনও জাতির মধ্যে বন্যজন্তু শিকারে, গর্ত করে শিকার ধরার প্রথা এখনও বর্তমান আছে। সাধারণতঃ পাহাড়ী অঞ্চলে বন্যশূকর শিকারের জন্যই শিকার-যাতায়াতের পথে এই উপায় অবলম্বন করা হয়। জন্তু-জানোয়ার সাধারণতঃ যে-পথে চলাফেরা করে, যাকে game-track বলা হয়, সেখানে নীচু জায়গা থেকে ওপরে উঠবার পথের কোনও বাঁকে এইরকম ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে। পাঁচ-ছ-ফুট লম্বা— ওপরে দু-আড়াই ফুট প্রশস্ত, নীচে চার-পাঁচ ফুট গভীর গর্ত করা হয়। তলদেশ সংকীর্ণ, উপরের পরিসর চার-পাঁচ ফুট হলে, নীচে থাকবে দেড়ফুট দু'ফুট। গর্তের মুখে বাঁশ অথবা নল-খাগড়ার সরু সরু কাঠি দিয়ে ঢাকা থাকে— তার উপর ঘাস ইত্যাদি দিয়ে চারপাশের জঙ্গলের সঙ্গে মিশ খাইয়ে দেওয়া হয়— যাতে, সেখানে যে একটা নূতন কিছু হয়েছে, তা যেন জানোয়ারে টের না পায়। সাধারণতঃ শূয়োর ধরার জন্যই এই ব্যবস্থা।

*

আমাদের দেশে, আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার হওয়ার প্রথম দিকে, যে-সব ইংরেজ ও অন্যান্য ইউরোপীয় নাবিক, সৈনিক ও কর্মচারী এদেশে আসতে থাকেন, তাঁরা আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার এদেশের লোককেও শিক্ষা দেন। মুঙ্গেরে দেশী বন্দুকের কারখানা স্থাপিত হয়। স্থানীয় কারিগরগণ বন্দুক তৈরী করতে আরম্ভ করেন। ...কিন্তু যদিও উন্নত ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র ছিল না, তবুও দেশে এত বেশী সংখ্যায় শিকার ছিল যে, শিকারী যথেষ্ট শিকার পেত। সপ্তদশ ও অষ্টদশ শতাব্দীতে, কোম্পানির রাজত্বকালে, পুনার কাছে একজন ব্রিটিশ অফিসার দু-মাসের মধ্যে চল্লিশটি সিংহ শিকার করেছিলেন। সে সময় কোনও ভাল শিকারীর পক্ষে একশো দেড়শো বাঘ মারাটা একেবারেই অস্বাভাবিক ছিল না।

*

বন্যজাতির মধ্যে (শিকারের জন্য) অবশ্য তীর-ধনুকই বেশী প্রচলন ছিল। গারো অঞ্চলে ভল্ল ও দা'(স্লাম) শিকারের অস্ত্র। তারা তীর-ধনুক ব্যবহার করে না। আসাম ও চট্টগ্রামের পার্বত্যপ্রদেশে হাতী মারবার জন্যে স্থানীয় শিকারীরা গাদা-বন্দুকই বেশীর ভাগ ব্যবহার করত। হাতীর মত বিশালকায় জন্তুর কড়া চামড়া ও হাড় ভেদ করার জন্যে তারা সীসের সঙ্গে টিন মিশিয়ে শক্ত করে নিত। সীসে ও টিন একসঙ্গে গালিয়ে বালি অথবা মাটির মধ্যে গর্ত করে ঢালাই করা হ'ত। হাতী-শিকারের সময় সাধারণ পরিমাণ অপেক্ষা অনেকটা বেশি বারুদ ভর্তি করা হ'ত। যাতে অতিরিক্ত চাপে নল ফেটে না যায়, সেজন্য নলের গোড়ার দিকটা লোহার তার বা বেত দিয়ে খুব মজবুত করে বেঁধে নেওয়া হত।

*

আমাদের দেশের বিভিন্ন দেশীয় রাজন্যবর্গের শিকার-খ্যাতি সাগর পারেও প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। নেপালের মহারাজা ও কুচবিহারের মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণের নাম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। তাঁদেরও পূর্বে পাঞ্জাবকেশরী মহারাজা রঞ্জিৎসিংহের পুত্র দলিপসিংকে ইংরেজ যখন শিক্ষার্থে ইংলণ্ড নিয়ে যায়, সেখানে তিনি বন্দুক চালনায় এতটা দক্ষতা অর্জন করেন যে, ওখানকার শ্রেষ্ঠ লোকদের সমকক্ষ বলে তাঁকে সম্মান দেওয়া হ'ত। বিকানীর ও ঢোলপুরের মহারাজার উড়ন্ত পাখী শিকারের নৈপুণ্য পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শিকারীর সমতুল্য। ময়মনসিংহের মহারাজা সূর্যকান্ত আচার্য, গোবরডাঙ্গার জ্ঞানদাপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায় এবং ব্যারিস্টার কুমুদনাথ চৌধুরীর শিকার-নৈপুণ্য সম্বন্ধে বাংলা দেশের সকলেই অবহিত আছেন। বর্তমান শিকারীদের মধ্যে সুরগুজার মহারাজাও একজন বিখ্যাত শিকারী। তিনি আফ্রিকায় সিংহ, হস্তী, গণ্ডার, জলহস্তী প্রভৃতি হিংস্রজন্তু শিকার করেছেন। কয়েক বছর আগেই তাঁর Royal Tiger শিকার ছিল ১,১১২ এবং ২,০০০ চিতা বাঘ।

সে যুগে ঘোড়া ছুটিয়ে বর্শা দিয়ে বন্যবরাহ বিদ্ধ করা (Pig-sticking) শিকারে একটা বিশেষ কৃতিত্বের পরিচায়ক ছিল। এর জন্য অশ্বকে উপযুক্ত শিক্ষাও দেওয়া হত। এই শিকারের নিয়ম এই যে, ঘোড়া ছুটিয়ে বর্শা দিয়ে শূকর বিদ্ধ করে বর্শা তুলে নিতে হয়। স্ত্রী-শূকরকে শিকার করা হয় না।

*

হাতি খুব উঁচু জায়গায় উঠতে পারে, আবার ঢালুতেও নামতে পারে। অতি সংকীর্ণ খাড়াই পাহাড়ের পথে কিভাবে যে তারা ওই বিপুল দেহ নিয়ে ওঠা-নামা করে, তা স্বচক্ষে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। উঠবার সময়, তারা পা গুটিয়ে নেয় আর পেছনের দুই পায়ের ধাক্কায় দেহটাকে উপরে তুলে দেয়। আবার নামবার সময়, পেছনের দু'পা গুটিয়ে নিয়ে, সামনের দু'পা লম্বা করে দিয়ে হড়হড়িয়ে নেমে যায়।

*

হাতীর দোষেরও সীমা নেই। অকারণে মনুষ্যহত্যায় হাতী পশ্চাৎপদ নয়। প্রতিশোধস্পৃহা ভয়ংকর, শস্য নষ্ট করতে অতিশয় তৎপর— বৃক্ষাদিও নষ্ট করে। এই দেশেরই বানর, হরিণ, বিশেষতঃ হাতির অত্যাচারে বৎসরে প্রায় নব্বুই কোটি টাকার শস্যহানির সংবাদ পাওয়া যায়।

*

এদেশে হস্তী শিকার অপেক্ষা হাতী ধরা ও বশ করে শিক্ষা দেওয়ার প্রথাই বহুকাল ধরে প্রচলিত আছে। ...শিক্ষিত হস্তী যেমন শিকারের অঙ্গ, তেমনি জাঁকজমকের খাতিরে এবং কাষ্ঠ ব্যবসায়ীদের কাজে হাতীর বিশেষ প্রয়োজন হয়। সমস্ত প্রাচ্য দেশেই হাতী একটি মূল্যবান সম্পত্তি। যার জন্য আজও একটা প্রবাদ চালু আছে— 'মরা হাতি লাখ টাকা!'

'শিকারী জীবন' নামক ধীরেন্দ্রনারায়ণ রায়ের গ্রন্থ হইতে অংশবিশেষ উদ্ধৃত। ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েটেড পাবলিশিং কোং প্রাইভেট লিঃ, ৯৩ মহাত্মা গান্ধী রোড, কলিকাতা ৭। প্রকাশকাল, ১৩৩২।

(বানান অপরিবর্তিত)

*

লক্ষ্যভেদ

বাঘকে মারতে যাওয়া তারই সাজে, (ক) নিজের হাতিয়ারে যার ভরসা আছে এবং (খ) চলন্ত জিনিসে অভ্রান্তভাবে লক্ষ্যভেদ করার কায়দাকানুন যার আয়ত্তে। এ দুটো গুণ যার নেই, বাঘ শিকার করতে গিয়ে সে যে সম্ভবত নিজেরই বিপদ ডেকে আনবে তাই নয়, সঙ্গীসাথীদেরও সে বিপদে ফেলবে; আর তার জন্যে মুশকিলে পড়বে নিরীহ গ্রামবাসীরা— কারণ, জঙ্গলে সে ফেলে রেখে আসবে চোট-খাওয়া বাঘ, যে বাঘ পরে হয়ত নিদারুণ নরখাদকে পরিণত হবে।

কখনই তাড়াহুড়ো করে গুলি করা উচিত নয়। কেউ যদি তা করে, তাহলে আজ হোক কাল হোক শিকারের আয়ু তার হঠাৎ অকালেই ফুরিয়ে যাবে। এটা সব সময় মনে রাখা ভালো যে, বাঘের সঙ্গে লাগতে যাওয়া মানে দুনিয়ার সবচেয়ে ধূর্ত, সবচেয়ে হিংস্র জানোয়ারের সঙ্গে পাঞ্জা লড়া— যে লড়াইতে আবেষ্টনী এবং আক্রমণের আর আত্মরক্ষার ক্ষমতার দিক দিয়ে বাঘেরই ষোল আনা সুবিধে।

বাঘকে মারতে এবং ঘায়েল করতে গেলে নিচেকার মোক্ষম জায়গাগুলোতে গুলি করা দরকার।

(ক) গলা, (খ) কণ্ঠা, (গ) কাঁধের ভেতর দিয়ে কলজে, (ঘ) বুকের ভেতর দিয়ে কলজে, (ঙ) দুই চোখের মাঝখান দিয়ে মগজ।

বাঘ যদি শিকারীর দিকে তিন-চতুর্থাংশ ফিরে থাকে, তাহলে গুলি করার সবচেয়ে ভালো জায়গা হল কণ্ঠা। বাঘ তাহলে সোজা ধরাশায়ী হবে— কেননা তাতে গলা থেকে নামা শরীরের শিরাগুলো যেমন ছিঁড়ে খুঁড়ে যাবে, তেমনই বুলেটটি স্নায়ুকেন্দ্র ভেঙে কলজে আর ফুসফুস ফুঁড়ে চলে যাবে।

বাঘ যদি পাশ ফিরে থাকে, তাহলে কলজেই হবে নিশানা। কিন্তু বাঘকে তৎক্ষণাৎ অসাড় অচল করে দেবার জন্যে গুলিটা চালাতে হবে কাঁধের কেন্দ্রস্থল ভেদ করে। অনেক সময় কলজে ফুঁড়ে গুলি করলেও বাঘকে ধরাশায়ী করা যায় না এবং মৃত্যুর আগের কয়েক সেকেণ্ডে সে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে।

বাঘ যদি শিকারীর দিকে মুখ করে একই জমিতে সামনাসামনি দাঁড়িয়ে থাকে, তাহলে গলার ঠিক নিচে বুকের ঠিক মাঝখানটায় গুলি করাই প্রশস্ত। গলা আর ঘাড়ের সন্ধিস্থলে গুলি করলেও সমান ভালো ফল পাওয়া যাবে। মাথার সামান্য ডাইনে বা বাঁয়ে কাঁধের ভেতর গুলি চালাতে পারলে বাঘকে চূড়ান্ত রকমের ঘা দেওয়া যায়। এতে হয়তো কলজে ফুটো হয়ে যাবে। অথবা সম্ভবত শিরদাঁড়া ভেঙে যাবে। বুলেটটা লম্বালম্বিভাবে ঢুকে পড়ে শরীরটাকে অবশ করে দিতে পারে, অথবা— যেটা সবচেয়ে জরুরি— কাঁধের হাড় ভেঙে দেওয়ার ফলে বাঘ মারাত্মকভাবে আর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারবে না।

যে বাঘ সিধে চলে আসছে, বন্দুকের ঘোড়া টানার আগে তাকে হয় একটু পাশ ফেরার, নয় সামনে একটু সরে যাবার সুযোগ দেওয়া উচিত— কারণ, বাঘদের স্বভাব হল যেদিকে ফিরে আছে— চোট খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে— সেইদিকে তেড়ে যাবার। এমনও অনেক অবস্থা আছে, যেক্ষেত্রে বাঘের গায়ে গুলি লাগলেও তার দিক থেকে তেড়ে আসবার কোনো ভয় থাকে না। কিন্তু যে বাঘ আপনাকে দেখে ফেলেছে এবং দেখা সত্ত্বেও যার নড়বার কোনো লক্ষণ দেখা যায় নি, তার সম্বন্ধে খুব হুঁশিয়ার হবেন।

মগজে গুলি চালাতে পারলে তৎক্ষণাৎ দফা রফা হয়— কিন্তু কাজটা যেমন শক্ত, তেমনি যেটা ভাবা যায় সেটাও নিচের দুটো কারণে প্রায়ই শেষ পর্যন্ত ঠিক ঘটে ওঠে না। প্রথমত, বাঘের মগজ নিশানা হিসাবে নেহাৎ ছোট্ট— আকারে একটা আপেলের মত; আরো বেশি ছোট দেখায় তার হাড়সর্বস্ব বিরাট মুণ্ডুটার তুলনায়; চোখের প্রায় তিন-চার ইঞ্চি পেছনে তার মগজের আধার। দ্বিতীয়ত বাঘের কপাল দেখে যে-রকমটি মনে হয় আসলে সে-রকমটি নয়। চোখের ঠিক ওপরে চামড়ার ভাঁজ এবং জায়গাটার রং এমন যে, দেখে মনে হবে আমাদেরই মতো নাকের ঠিক ওপরে চামড়ার নিচে বুঝি উঁচানো হাড়ের কাঠামো আছে। বাঘের মাথার খুলি খুঁটিয়ে দেখলে আশ্চর্য হবেন— যাকে আমরা কপাল বলি, বাঘের সে জিনিস আদৌ নেই; সে জায়গায় তার একটা হাড় বিষম ঢালু হয়ে পেছনের দিকে নেমে গেছে— শুধু মানুষ কেন, অন্য জানোয়ারদের মতনও তার মাথার খুলিতে সামনের দিকে খাড়া হয়ে কপালের মতো কিছু নেই।

সুতরাং চোখের ওপর গুলি লাগলে ভেদ করে তো যাবেই না, বরং হাড় ঘেঁষে পিছলে চলে যাবে। একমাত্র চোখের ভেতর দিয়ে কিংবা নাকের ঠিক গোড়ায় তাক করতে পারলে তবেই সেই গুলি বাঘের মগজে পৌঁছুবে।

সেইজন্যেই, আমার মতে, বাঘের মগজ লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়াটা ভুল। তার চেয়ে গলায় গুলি করাটা সহজ এবং তাতে মগজ ফুটো করারই সমান ফল মেলে।

বাঘ যখন পেছন ফিরে চলে যাচ্ছে, শিকারী যখন তার চেয়ে উঁচুতে রয়েছে— তখন ঘাড় আর শিরদাঁড়ার সন্ধিস্থলে গুলি লাগাতে পারলে বাঘ আর নড়তে পারবে না। শিকারী যদি একই জমিতে থাকে, তাহলে নিশানা করতে হবে ল্যাজের ঠিক গোড়ায়। গুলিটা পেছন থেকে বাঘের বুকে গিয়ে ঘা দেবে। তবে এটা একটা কদাকার ব্যাপার, পারতপক্ষে এভাবে গুলি না করাই ভালো।

কোনো মোক্ষম জায়গায় গুলি যদি না লাগে, তাহলে দেখে অবাক হবেন— গুলির পর গুলি খেয়েও বাঘ কি রকম দিব্যি হেঁটে চলে ফিরে বেড়াবে। বার ছয়েক মারাত্মক গুলি খাওয়ার পরেও তার দৌড় বড় কম হয় না এবং অতগুলো চোট নিয়েও সে জান দিয়ে লড়ে যাবে।

শের জঙ্গ-এর 'ডোরাকাটার অভিসারে' (অনুবাদ সুভাষ মুখোপাধ্যায়) গ্রন্থ হইতে এই বিশেষ অংশটি গৃহীত। প্রকাশকাল, ১৯৬৯।

শিকারের নিয়মের লঙ্ঘনে শিকারীর কীরূপ বিপদ ঘটতে পারে

বেড় শিকারে যদিও শিকারী মাচানে বসেই শিকার করে তবুও সময়ে সময়ে তার অত্যন্ত বিপদ ঘটে যায়। আমি জঙ্গলের জানোয়ারের আক্রমণে শিকারীর যে বিপদ উপস্থিত হয় তার কথা বলছি না, কারণ সে রকম বিপদ বেড় শিকারে খুবই কম ঘটে এবং ঐরূপ বিপদ অন্যরকম শিকারে বেশী ঘটবার সম্ভাবনা থাকে। বেড় শিকারে কোনও শিকারীর যে বিপদ অন্য শিকারীর কাছ থেকে আসতে পারে তার কথাই এখানে বলছি। এই বিপদ অধিকাংশ সময়ে শিকারীর নিজের অবিবেচনার অথবা অন্য শিকারীর শিকারের নিয়মের অজ্ঞতা বা অতিলোভের ফলে ঘটে থাকে। শিকারের একটি প্রধান নিয়ম হচ্ছে যে শিকারী কখনও অন্য শিকারীর মাচানের নিকটবর্ত্তী স্থানে গুলী করবে না। তার কারণ, গুলী কঠিন মাটিতে বা গাছে লেগে প্রতিহত হয়ে, ঊর্দ্ধ দিকে এবং অন্য পথে চালিত হয়ে অপর শিকারীর মাচানের দিকে ছুটতে পারে, বা পাথরে লেগে খণ্ড খণ্ড হয়ে খণ্ডগুলি চার দিকে ছিটকে গিয়ে অপর শিকারীকে আঘাত করতে পারে। এই জন্য বেড় শিকারের নিয়ম এই যে প্রত্যেক শিকারী তার নিজের মাচানে বসবার আগে তার দু'দিকেই ভাল ক'রে দেখে নেবে অপর শিকারীর মাচান কোন লাইনে এবং কতদূরে অবস্থিত, এবং ঐ দু'দিকে কখনও গুলী চালাবে না।

'শিকারের কথা' নামক অক্ষয়কুমার চট্টোপাধ্যায়ের গ্রন্থ হইতে এই বিশেষ অংশটি গৃহীত। প্রকাশকাল, ১৯৪১।

(বানান অপরিবর্তিত)

*

শিকারী কী কী উপায়ে শিকারের জন্তু হতে আত্মগোপন করে

মাচানে বসে বাঘকে লক্ষ্য করার সময় গাছের পাতায় বন্দুকের নলা লেগে শব্দ হওয়ায় বাঘ সতর্ক হয়ে মাচানের দিকে চেয়ে দেখল। ঐটা বলবার সময় মনে হ'ল যে মাচানের সম্বন্ধে এবং অন্য যে উপায়ে শিকারী লুকিয়ে শিকারের প্রতীক্ষায় বসে থাকে তার সম্বন্ধে দু-চারটা বিশেষ কথা এর আগেই আমার তোমাদের বলা উচিত ছিল। আরও বাঘের গল্প বলার আগে এইখানে সেকথা কয়টা বলে নিই।

উঁচু জায়গায় গোপন ভাবে স্বচ্ছন্দে বসে থাকার জন্য মাচান তৈরী করা হয় তা আর বলে দিতে হবে না। যেমন তেমন ক'রে খানিকক্ষণ বসে থাকতে হ'লে বোধ হয় অনেকের পক্ষে গাছের ডালই যথেষ্ট হত। কিন্তু তা করলে ত হবে না। শিকারীর যে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়, ইচ্ছামত ঘোরার দরকার হয়, বন্দুকে লক্ষ্য করার সময় দুই হাতই ব্যবহার করতে হয়, এবং এই সব কারণেই তার নিশ্চিন্ত হয়ে বসবার স্থানের এত প্রয়োজন।

দুইটা যথাসম্ভব সমান্তরাল মোটা ডালের উপর একটা দড়ি দিয়ে ছাওয়া হালকা খাটিয়া বেঁধে বা কতকগুলো গাছের ডাল কেটে এনে সেগুলোকে ঘেঁষাঘেঁষি ক'রে ঐ সমান্তরাল ডাল দুইটার উপর সাজিয়ে বেঁধে দিয়ে একটা বসবার আসন তৈরী ক'রে নেওয়া হয়, আর একেই মাচান বলে। যেখানে এমন গাছ পাওয়া যাচ্ছে না যার দুইটা ডালের উপর ঐ রকম মাচান তৈরী করা যায় সেখানে মাটিতে খুঁটি পুঁতে তার উপর মাচান তৈরী করতে হয়। কিন্তু যেখানে আগে মাচানের মতো কোন জিনিষ ছিল না সেখানে খুঁটির উপর ঐ রকম একটা জিনিষ দাঁড় করালে তা শিকারের জন্তুর দৃষ্টি আকর্ষণ করবে, সেইজন্য খুঁটির উপর মাচান তৈরী করতে হ'লে তাকে কোন গাছের সঙ্গে লাগিয়ে তৈরী করা দরকার, যাতে সেটাকে হঠাৎ গাছেরই একটা অংশ বলে মনে হবে। খুঁটিগুলোতেও এমনভাবে পাতা সাজিয়ে দিতে হয় যেন সেগুলোকে গাছ বলে ভ্রম হয়।

মাচান কখনও আয়তনে বেশী বড় হওয়া উচিত নয়। দু'জনের বসবার জায়গার চেয়ে বেশী জায়গা কখনই দরকার হয় না। মাচান আয়তনে যত বড় হবে তত বেশী জঙ্গলের জানোয়ারের দৃষ্টি আকর্ষণ করার সম্ভব। যাঁরা শিকারে অভ্যস্ত নন এমন সহুরে ভদ্রলোকদের কখন কখন শিকারের জন্য মাচানে বসতে দেখেছি। তাঁদের সঙ্গের সাজ-সরঞ্জাম, দেখলেই বুঝতে পারা যায় যে মড়ির উপর মাচানে বসে শিকার করা তাঁদের পক্ষে সম্ভব নয়। তাঁদের চা খাওয়ার সরঞ্জাম, টিফিন কেরিয়র, সিগারেট কেস, অনেকগুলো রাগ ইত্যাদি যা নিয়ে মাচানে ওঠেন, তা দেখলে মনে হয় যে তাঁরা জঙ্গলে শিকার করতে গিয়েও এতটুকু সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য থেকে বঞ্চিত হতে রাজী নন। মড়ির সন্নিকটে মাচানের উপর বসে যদি কেউ 'ফিষ্টি' করতে, বা ডিশ পেয়ালার ঠুনঠান শব্দ ক'রে চা খেতে বা দেশালাই জ্বালিয়ে সিগারেট ধোঁয়া ছাড়তে লেগে যান, তা হ'লে শিকারের জন্তুটি যে ঐ 'ফিষ্টি' ইত্যাদিতে যোগ দিয়ে কৃতার্থ করতে আসবে না এ তোমরা সহজেই বুঝতে পার। বেড় শিকারে মাচানে ব'সে এসব বরং চলতে পারে, মড়ির উপর ব'সে কখনও না। অল্পপরিসর মাচানের উপর দীর্ঘকাল নিস্তব্ধ আর নিশ্চল হয়ে বসে শিকারের প্রতীক্ষা করা অনভ্যস্ত শিকারীর কাজ নয়।

মাচানের চার পাশে পাতার পর্দ্দা ক'রে ঢেকে দিতে হয় যাতে শিকারীকে সহজে দেখা না যায় এবং মাচানকেও যতটা সম্ভব গাছেরই একটা অংশ বলে মনে হয়। চার পাশে দড়ি খাটিয়ে, বা লম্বা-লম্বি ডাল বেঁধে দিয়ে তার উপর কতকগুলো পাতা ঝুলিয়ে দিয়ে পর্দ্দা তৈরী করা হয়। পর্দ্দার প্রত্যেক দিকে অন্ততঃ দুইটা করে ছিদ্র থাকা দরকার, যার ভিতর দিয়ে শিকারী এবং তার সঙ্গী মাচানের বাহিরে দেখতে পারবে। যেখানে গাছেরই ঘন পাতার ভিতরে মাচান তৈরী হয় সেখানে সব সময়ে এই পাতার পর্দ্দার দরকার হয় না তা বলাই বাহুল্য।

মাচানে উঠবার জন্য বা মাচান থেকে নামবার জন্য একটা সিঁড়ির দরকার। দুইটা লম্বা সরু গাছ কেটে তাতে আড়া-আড়ি ভাবে গোটাকয়েক ছোট ডাল বনের লতা দিয়ে বেঁধে দিয়ে তখনি তখনি এই সিঁড়ি তৈরী ক'রে নেওয়া যায়, যেমন বাঁশের মই আর কি। এই রকম সিঁড়ি কিন্তু মাচানের সঙ্গে লাগান থাকলে সতর্ক জন্তুর দৃষ্টি আকর্ষণ করার সম্ভব, সেইজন্য শিকারী মাচানে বসার পর সিঁড়িটা সরিয়ে ফেলে কাছেই জঙ্গলে লুকিয়ে রাখা উচিত যাতে শিকারী নামবার সময় পুনরায় সহজে ব্যবহার করতে পারে। এ করাও কিন্তু অনেক হাঙ্গাম। সেই জন্য মড়ির উপর বসে শিকারে আমি দড়ির সিঁড়ি ব্যবহার করতে অভ্যস্ত হয়েছিলাম। ঐ সিঁড়ি দিয়ে মাচানের উপর উঠে সিঁড়িটা টেনে উপরে উঠিয়ে নিতাম, আর নামবার সময় আবার ঝুলিয়ে দিতাম। শিকারে যাবার সময় প্রায়ই ঐ রকম একটা সিঁড়ি সঙ্গে রাখতাম।

ইতিপূর্ব্বে বলেছি যে বেড় শিকারে মাচানে বসে শিকার করা তত কিছু কঠিন নয়, কেবল দ্রুত লক্ষ্য করার ক্ষমতা থাকলেই যথেষ্ট; কারণ ঐ শিকারে শিকারের জন্তুকে শিকারীর কাছে তাড়িয়ে এনে হাজির ক'রে দেওয়া হয়। মড়ির উপর বা যেখানে জানোয়ার সচরাচর আসাযাওয়া করে এমন জায়গায় রাত্রিতে মাচানে বসে শিকারের প্রতীক্ষা করা খুব সহজ কাজ নয়, তা আমি আগে যা বলেছি তা থেকে কতক বুঝতে পেরে থাকবে। এতে বড়ই ধৈর্য্যের দরকার। ঐ অবস্থায় মাচানে বসা কতকটা যোগাসনে বসার মতো। নড়বে চড়বে তাতে এতটুকু শব্দ হ'লে চলবে না, কারণ তুমি জান না যে জানোয়ার মাচানের কাছে এসে গেছে কিনা। ঐ অবস্থায় এক ভাবে বসে থাকতে থাকতে যখন পা বা শরীরের কোন অংশ অবশ হয়ে যায় তখন তাকে একটু সরিয়ে সহজ অবস্থায় আনতে গেলে অত্যন্ত ধীরে ধীরে অনেকটা সময় নিয়ে তা করতে হয়। অন্ততঃ আমি তাই করতাম। আমার বিশ্বাস, অনেক নতুন শিকারী যে ঐরকম শিকারে ব'সে বার বার নিষ্ফল হয়ে ফিরে আসেন তার প্রধান কারণ তাঁরা কখনও মাচানে বসতে শেখেন নি। তাঁদের মাচানে বসে উসখুসুনির শব্দগুলো প্রায়ই তাঁদের উপস্থিতির সংবাদটা শিকারের জন্তুদের কাছে পৌঁছে দিয়ে তাদের সতর্ক ক'রে দেয়।

আমার যা অভিজ্ঞতা তাতে শিকারী যদি মাচানে অন্য লোক নিয়ে বসেন তা হ'লে যেন একজনের বেশী না নেন, আর যাকে নেবেন সেও যেন মাচানে নিঃশব্দে দীর্ঘকাল বসতে অভ্যস্ত হয় এবং ভীরু স্বভাবের না হয়। এ না হ'লে প্রায়ই মাচানে বসা নিষ্ফল হয়, এবং সময়ে সময়ে এমন অবস্থার উদ্ভব হয় যে তখন নিজেকে ধিক্কার দিতে ইচ্ছা হয়— 'কেন এই লোককে নিয়ে মাচানে বসেছিলাম' বলে। আমার দু-একজন সাহসী পিয়নকে আমি ঐ ভাবে বসতে শিখিয়েছিলাম। তবুও জ্যোৎস্না রাত্রি হ'লে আমি পিয়নকে সঙ্গে নিতাম না। কেবল অন্ধকার রাত্রিতে তাদের কাউকে নিয়ে মাচানে বসতাম, কারণ ফায়ার করার সময় শিকারের জন্তুর উপর ইলেকট্রিক টর্চের আলো ফেলবার জন্য ঐ কাজে শিক্ষিত একজন সঙ্গীর দরকার হত আমার।

'শিকারের কথা' নামক অক্ষয়কুমার চট্টোপাধ্যায়ের গ্রন্থ হইতে এই বিশেষ অংশটি গৃহীত। প্রকাশকাল, ১৯৪১।

(বানান অপরিবর্তিত)

জঙ্গলে বিট করে শিকার প্রণালী

বন্য জন্তু শিকার করতে হলে বনেই যেতে হয় একথা বলাই বাহুল্য। কিন্তু বনে গেলেই কি এদের দেখতে পাওয়া যায়? বন ত ছোট জায়গা নয় যে সেখানে গিয়ে কোন একটা স্থানে দাঁড়িয়ে চারদিক তাকালেই তার সবটা দেখে নেবে, আর সেই সঙ্গে সেই বনের জন্তুগুলোকেও দেখে ফেলবে। ছোট ছোট বনে বন্য জন্তু, বিশেষতঃ বড় বন্য জন্তু, প্রায়ই থাকে না। বড় জন্তু শিকার করতে হলে বিস্তীর্ণ জঙ্গল, যেখানে লোক সমাগম কম হয়, সেইরকম বনই প্রশস্ত। সহজেই বুঝতে পার যে সেরূপ বনে শিকারের জন্তু খুঁজে বা'র করা বড় সোজা ব্যাপার নয়। তোমরা শুনে থাক যে অমুক বনে (যেমন সুন্দর বনে) অনেক বাঘ আর হরিণ আছে, কিন্তু ঐরকম বন একটা গ্রাম বা একটা সহরের মতো ছোট জায়গা নয়, তার চেয়ে অনেক বড় জায়গা সে সব। আর জন্তুরা ত মানুষের মতো এক জায়গায় ঘর বসতি ক'রে বাস করে না যে একটা কারও সন্ধান পেলে এবং সে কোথায় থাকে কোনমতে জেনে নিতে পারলে ঐ সঙ্গে আরো অনেকগুলির সন্ধান পাবে। ওরকম জঙ্গলে বন্দুক ঘাড়ে করে দিনের পর দিন ঘুরে বেড়ালেও অনেক সময় শিকারের সন্ধান পাবে না।

তা হ'লেই বুঝতে পারছ যে তোমাকে এমন উপায় অবলম্বন করতে হবে যাতে তুমি সহজে শিকারের জন্তুর কাছে পৌঁছুতে পার বা তুমি জঙ্গলে একটা জায়গায় স্থির হয়ে থাকলেও সে তোমার কাছে আসতে বাধ্য হয়। 'বাধ্য হয়' বলছি এইজন্য যে কতকটা জোর ক'রে ভয় দেখিয়েই তাকে আনা হয়।

তোমরা অনেকে কোন বড় পুষ্করিণীতে বেড়াজাল দিয়ে মাছ ধরা দেখেছ,— এই 'বাধ্য করার' ব্যাপারটা সেই রকমের। পুষ্করিণীর একটা দিকে বেড়া জালকে অর্দ্ধচন্দ্রাকারে ছড়িয়ে দিয়ে জালটাকে সেইভাবে টানতে টানতে পুষ্করিণীর অপর দিকে নিয়ে যাওয়া হয়, আর তার ফলে পুষ্করিণীর বড় মাছগুলি জলের আগে আগে চলতে থাকে। জালটী এগিয়ে আসতে আসতে যখন তার সম্মুখের জলভাগ সঙ্কীর্ণ হয়ে আসে তখন মাছগুলো ভয় পেয়ে কি রকম লাফাতে থাকে তা দেখেছ। সম্মুখে আর পালাবার পথ না পেয়ে মাছগুলো তখন জালভেদ ক'রে পালাতে চেষ্টা করে এবং জালে আবদ্ধ হয়। জঙ্গলের জন্তুদেরও কতকটা ঐ রকম উপায়ে শিকারীর কাছে তাড়িয়ে আনা হয়। একে চলতি কথায় জঙ্গল 'পিটা' বা জঙ্গল 'ঝাড়া' বলে। এর ইংরাজী কথা 'বিট' (Beat) করা। এই শিকারের আর এক নাম হচ্ছে 'বেড় শিকার'। জঙ্গল ঝাড়া জিনিষটা এইরূপ :—

জঙ্গলের কোন একটা স্থান শিকারীর জন্য নির্দ্দিষ্ট হয়। সেখানে শিকারী মাটিতে দাঁড়াবে বা গাছের উপর মাচান ক'রে বসবে। এই স্থান থেকে অনেকটা দূরে একদল লোক ঐ জঙ্গলের এক অংশে লাইন দিয়ে দাঁড়াবে। লাইনটা হবে বেশ বড় আর কতকটা অর্দ্ধচন্দ্রাকৃতি, জেলেরা যেমন বেড়াজাল ছড়িয়ে দেয়। ঐ লাইনের বাঁকানো মুখ দুটো থাকবে শিকারের দিকে আর যারা লাইন ধরে দাঁড়াবে তারা সকলেই শিকারীর দিকে মুখ করে দাঁড়াবে। আমি যেখানে বেশীর ভাগ শিকার করেছি বা দেখেছি সেখানে এই লাইনকে 'পন্তা' (পাঁতি?) বলে এবং লাইন ধরে দাঁড়ানকে 'পন্তা ধরা' বলে। আমিও তাই বলব এবং লাইনের লোকদের পন্তার লোক বা বিটার (Beater) বলব। বিটারদের সঙ্গে তীর ধনুক টাঙ্গি কুড়ুল লাঠি প্রভৃতি অস্ত্র, আর নাগরা কাঁসর করতাল ইত্যাদি বাজনা থাকে। শিকারী তার নিজের নির্দ্দিষ্ট স্থানে বসবার পর একটা সঙ্কেত করা হয়; তখন বিটাররা বাজনা বাজাতে বাজাতে আর চীৎকার এবং গাছে লাঠি মেরে খটখট শব্দ করতে করতে ধীরে ধীরে চলতে আরম্ভ করে, যার ফলে ঐ জালের মত পন্তার লাইনটি শিকারীর দিকে এগুতে থাকে। এতে বনের ঐ অংশের জন্তুগুলি তাড়া পেয়ে প্রথমে ধীরে ধীরে শিকারী যেদিকে আছে সেই দিকে চলতে আরম্ভ করে এবং ক্রমশঃ বেশী ভয় পেয়ে ঐদিকে দৌড়ুতে থাকে। ফলে ঐ জন্তুর কতকগুলি শিকারীর দৃষ্টিপথে এসে পড়ে এবং শিকারী তার উপর গুলী চালাবার সুবিধা পায়।

তোমরা ভেব না যে, যে কোন বড় জঙ্গলে এই রকম বেড় শিকার করলেই শিকার পাওয়া যায়। কোন জঙ্গল বা জঙ্গলের কোন অংশ ঝাড়তে হবে তা বেছে নিতে হয় এবং বেছে নিতে হ'লে অধিকাংশ স্থলে স্থানীয় লোক, যারা জঙ্গলে কাঠ আনতে বা অন্য প্রয়োজনে যাতায়াত করে, তাদের সাহায্য নিতে হয়। এই সকল লোকের জানা থাকে যে কোন জঙ্গলে জন্তু বেশী দেখা যায়। জঙ্গলের কোন দিকে ঝাড়তে হবে এবং শিকারী কোথায় বসবে এ সবও প্রায়ই তারাই স্থির ক'রে দেয়। আমরা ভদ্র লোকেরা এই সব লোকদের 'ছোট লোক' ব'লে অবজ্ঞা ক'রে থাকি, কিন্তু তাদের পর্য্যবেক্ষণের ক্ষমতা, তাদের অভিজ্ঞতা, জঙ্গলের ভিতর নানা রকম চিহ্ন দেখে জানোয়ারের অবস্থান বা গতিবিধি স্থির করবার ক্ষমতা দেখলে আশ্চর্য্য হয়ে যেতে হয়। আমার শিকার জীবনের প্রথম অবস্থায় আমি কখন কখন তাদের কথার উপর বেশী আস্থা না রেখে নিজের ইচ্ছানুযায়ী জঙ্গল বিট করাতাম, আর নিজের বসবার স্থান ঠিক ক'রে নিতাম, এবং এই সব শিকারে প্রায়ই কিছু পেতাম না। কিছু অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করার পর আমি আর এই সব লোকদের পরামর্শ অগ্রাহ্য করতাম না এবং তাতে খুব ভালো ফল পেতাম।

'শিকারের কথা' নামক অক্ষয়কুমার চট্টোপাধ্যায়ের গ্রন্থ হইতে এই বিশেষ অংশটি গৃহীত। প্রকাশকাল, ১৯৪১।

(বানান অপরিবর্তিত)

অল্প কথায় বাঘ ও হাতি শিকার

শিকারের মধ্যে বাঘ-শিকার সত্যিই খুব বিপদসংকুল। অতীতে তরোয়াল, বর্শা, তির দিয়ে বাঘ শিকার করা হত। মুঘল যুগের তৈলচিত্রে দেখা যায় ঘোড়সওয়ার শিকারি বর্শা দিয়ে ছুটন্ত বাঘকে ঘায়েল করছে। বাঘকে গ্রামবাসীরা গর্ত খুঁড়ে ফাঁদে ফেলে মারত অথবা খাঁচায় আটকে খুঁচিয়ে মারা হত। এসব নিষ্ঠুর হত্যার মধ্যে মানুষ বীরত্ব খুঁজে পেত। কখনো বিষ মাখানো তির বা বিষ মেশানো টোপ দিয়ে বাঘ মারা হত। আরণ্যক প্রাণীকে মানুষ নিজের শত্রু বলে ভাবত, আজও সেই মনোভাবের পরিবর্তন হয়নি। রাইফেল বা আগ্নেয়াস্ত্রের উদ্ভাবন হবার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের বন্যপ্রাণী হত্যা সহজ হয়ে যায়, শিকারের রীতিও পালটে যায়। জ্যান্ত মোষ বা ছাগলকে টোপ হিসাবে ব্যবহার করে শিকারীরা গাছের উপর মাচায় বা নিকটবর্তী কোনো গোপন স্থানে থেকে বাঘ আসার প্রতীক্ষা করেন। তারপর যথাসময়ে বাঘ শিকার। এ ছাড়া হাঁকোয়া দিয়ে অর্থাৎ ঢাক-ঢোল-টিন পিটিয়ে ঝোপ ঘিরে ফেলা হয়, ভয় পেয়ে বাঘ ঝোপঝাড় থেকে বেরিয়ে এলে শিকারিরা গুলি ছোড়েন। এ ছাড়া বহু প্রাচীনকাল থেকেই হাতির পিঠে চড়ে বাঘ শিকারের প্রথা আছে, আধুনিককালেও শিকারীরাও হাতি ব্যবহার করেছেন। নেপালের তরাইতে শিকারের সময় চার পাঁচশো হাতি দিয়ে বাঘকে গোল করে ঘিরে ফেলা হত, একে 'রিংওয়ে হান্টিং' বলা হত। গুলিতে আহত বাঘ আরো বিপজ্জনক, আহত অবস্থায় আরো হিংস্র হয়ে ওঠে, এছাড়া আহতাবস্থায় শিকার ধরতে পারে না বলে মানুষখেকো হয়ে উঠতে পারে। শিকার ধরার প্রাণীর অভাবে ও বৃদ্ধ হলেও বাঘ গৃহপালিত পশু ও মানুষের উপর আক্রমণ করতে পারে। গুলি করে মৃত ভেবে বাঘের কাছে এগিয়ে যাওয়া শিকারির পক্ষে বিপজ্জনক, আহত বাঘ হঠাৎ তাদের আক্রমণ করতে পারে। সাধারণত বিকট আওয়াজ বা ফাঁকা বন্দুকের শব্দেই বাঘ পালিয়ে যায়। বাঘের পায়ের ছাপ পর্যবেক্ষণ ও অনুসরণ শিকারীর আবশ্যক কাজ, তবে মাটিতে হেঁটে বাঘের মুখোমুখি হওয়া দুঃসাহসিক সন্দেহ নেই, পাথরের মূর্তির মতো স্থির হয়ে থাকলে বাঘ মানুষকে আক্রমণ করে না ও নিশ্বাস বন্ধ করে থাকলে মানুষকে খুঁজে বার করতে পারে না।

চিতাবাঘ বাঘের চেয়েও হিংস্র ও নিঃশব্দ, চুপিসারে শিকারির টোপ নিয়েও পালিয়ে যায়। বাঘের মতোই আহত চিতাও সেই অর্থে বিপজ্জনক। বাঘের মতো চিতাও ভালো সাঁতারু, উপরন্তু এরা গাছে উঠতে পারে। সবচেয়ে দ্রুত ছোটে বিশেষত শিকারি চিতা। বাঘের চেয়ে বেপরোয়া প্রাণী। প্রায় বাঘের মতোই এদের শিকার করতে হয় কিন্তু আরও সাবধানে। রাত্রে বাঘ ও চিতা উভয়ের চোখ জ্বলে, এরা নিশাচর ও অন্ধকারে ভালোই দেখতে পায়।

বাঘের দৃষ্টিশক্তি খুব প্রখর, কিন্তু আশ্চর্য হল স্থির বস্তু বাঘের চোখ এড়িয়ে যায়, বরঞ্চ চলমান বা ধাবমান বস্তু সহজেই চোখে পড়ে। বলা বাহুল্য বাঘের চোখ ফাঁকি দিতে এই কৌশল কাজে লাগে।

সুন্দরবনের মানুষখেকো বাঘের উপর একটি সমীক্ষা : পরিসংখ্যানভিত্তিক সমীক্ষার ভিত্তিতে সুন্দরবনের বাঘকে নিম্নলিখিত তিনটি ভাগে বিভক্ত করা যেতে পারে।

(১) সম্পূর্ণ মতলববাজ মানুষখেকো— সুন্দরবনের বাঘের পঁচিশ শতাংশ এ পর্যায় ভুক্ত। এই বিশেষ শ্রেণীর বাঘ মানুষ দেখামাত্রই ছুটে গিয়ে আক্রমণ করে। জঙ্গলে বাঘের দ্বারা মৃত মানুষের সত্তর শতাংশ এদের দ্বারা আক্রান্ত হয়।

(২) মতলবহীন মানুষখেকো— সুন্দরবনের বাঘের পনেরো শতাংশ এ পর্যায় ভুক্ত। যখন মানুষ বাঘের বসবাসস্থলে এসে উপদ্রব করে কেবলমাত্র তখনই এই শ্রেণীভুক্ত বাঘ আক্রমণ করে। বাঘের দ্বারা মৃত মানুষের কুড়ি শতাংশ এদের দ্বারা আক্রান্ত হয়।

(৩) পরিস্থিতিভেদে মানুষখেকো— সুন্দরবনের বাঘের ষাট শতাংশ এ পর্যায় ভুক্ত। এই শ্রেণীর বাঘের মানুষ আক্রমণের প্রবৃত্তি বসবাসস্থলের পরিস্থিতির উপর নির্ভরশীল। মূলত স্বাভাবিক শিকারের অভাব কিংবা শিকার প্রাণী গ্রহণের অক্ষমতার জন্য এরা মানুষকে আক্রমণ করে থাকে। এই শ্রেণীর বাঘেরাই নিজেদের বসবাসস্থল ছেড়ে লোকবসতিতে প্রবেশ করে গৃহপালিত পশু ও গ্রামের মানুষ আক্রমণ করে। বাঘের দ্বারা মৃত মানুষের দশ শতাংশ এদের দ্বারা আক্রান্ত হয়।

সমীক্ষাতে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে বাঘের নরখাদক হওয়ার সম্ভাব্য কারণগুলি হল:

(১) শারীরিক দুর্বলতা, বৃদ্ধ বয়স ইত্যাদির কারণে জঙ্গলের স্বাভাবিক শিকার ও খাদ্য গ্রহণে অক্ষম হওয়া।

(২) অন্যান্য শিকার তথা খাদ্যের অপ্রতুলতা।

(৩) পূর্ব প্রজন্মের কাছ থেকে মানুষ খাওয়ার অভ্যাস বংশানুক্রমে পাওয়া।

(৪) অনিচ্ছা বা অন্য কোনোভাবে মানুষকে মারার পর তার রক্ত-মাংসের স্বাদ ভালো লাগা।

(৫) নদীচরে ভেসে আসা মানুষের মৃতদেহ খেয়ে ফেলার পর সেই জীবন্ত প্রাণীর উপরে নজর পড়া।

(৬) সুন্দরবনের নদীনালার জলে প্রচুর পরিমাণে লবণ আছে। সেই লবণাক্ত জল বাঘ পান করলে তার কিডনি এবং মূত্রাশয়ের পরিবর্তনের মাধ্যমে তাদের শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। সুন্দরবনের বাঘের মানুষখেকো অভ্যাস ও স্বভাবগত হিংস্রতার সঙ্গে জলের লবণাক্ত ভাগ এবং জোয়ারের জলের ওঠানামার একটি স্পষ্ট সম্পর্ক রয়েছে। সুন্দরবনে 'অলবণাক্ত' জলের ভীষণ অভাব। বছরের বিশেষ কিছু সময়ে প্রাপ্ত বৃষ্টির জল সেই অলবণাক্ত জলের উৎস। সেই কারণে অরণ্য বিভাগ থেকে সুন্দরবনের বিভিন্ন ব্লক ও কমপার্টমেন্টে মিষ্টি জলের পুকুর কাটা হয়ে থাকে। ফলস্বরূপ ওইসব অঞ্চলে মানুষ মৃত্যুর হার কমার সম্ভাবনা থাকে।

 

এদেশে প্রাচীনকাল থেকে বন্য হাতি শিকার ছিল রাজা মহারাজাদের বিলাস। বন্য হাতিকে বন্দি করে পোষ মানিয়ে যুদ্ধে ব্যবহার, পরে বনে কাঠ পরিবহণ ও অন্যান্য কাজে এদের ব্যবহার করা হয়েছে। এছাড়া হাতি পোষা ও চড়া ছিল রাজা-বাদশা ও ধনীলোকদের ঐশ্বর্য ও অহংকারের প্রতীক। পোষাহাতিকে হাতি খেদানো, বন্দি করা এমনকী বন্য হাতি শিকারের কাজে ব্যবহার করা হত। প্রাচীন কালে হাতি শিকারের জন্য আদিবাসীরা বল্লম, তির ধনুক, ভল্ল, দা ইত্যাদি ব্যবহার করত, বিষতিরের প্রয়োগও ছিল। লোকালয়ে হানা দিয়ে অনেক সময় হাতি ফসল, গাছপালা, ঘরবাড়ি ইত্যাদি ধ্বংস করে, সেসময় বাগে পেলে মনুষ্য হত্যায় পিছপা হয় না। মূলত বনে খাদ্যের অভাব হাতিকে লোকালয়ে আসতে বাধ্য করে। সেসময় শব্দ করে বাজি ফাটিয়ে ও আগুন দেখিয়ে বনকর্মীরা তাদের বনে ফিরিয়ে দেন। রাজ্যে এ ধরনের ঘটনার কথা প্রায়ই খবরের কাগজ মারফত জানা যায়। হাতি শিকার এখন নিষিদ্ধ তবে পাগলা হাতি বা খেপা হাতির আবির্ভাব হলে অবশ্য সরকারি আদেশ বলে শিকারিরা তাকে মেরে ফেলতে পারেন, এ প্রসঙ্গে দুর্ধর্ষ বাঙ্গালী হাতিশিকারি চঞ্চল সরকারের নাম উল্লেখযোগ্য। বাঘের চামড়ার মতো হাতির দাঁতের উচ্চমূল্য, চোরাশিকারিদের হাতি শিকার করার কারণ। কানের পাশে বা কপালের মধ্যস্থলে গুলি করে হাতি মেরে থাকেন শিকারিরা। বাঘের চেয়েও হাতি শিকার কঠিনতর, কারণ সোজা মাটিতে দাঁড়িয়ে সে-কাজটি করতে হয়। লক্ষ্যভ্রষ্ট হলে বা আঘাত চরম না হলে আহত হাতি মৃত্যুর মতোই বিভীষিকাময়। কারণ হাতি তার শিকারকে মারার জন্য দীর্ঘক্ষণ গোঁ ধরে থাকে। হাতির বুদ্ধি, প্রতিহিংসাপরায়ণতা, দুষ্টুমি নিয়ে সত্য মিথ্যা মিশিয়ে অনেক ঘটনা আছে তার উল্লেখ এখানে নিষ্প্রয়োজন।

বিশ্বদেব গঙ্গোপাধ্যায

*

বাঘ, চিতা ও হাতির টুকিটাকি

বাঘ—কত রকমেরই না বাঘ। এদের হাবভাব ও রকমসকম বুঝতে হলে আগে কোন কোন দেশে বাঘ পাওয়া যায় তা জানতে হবে। পূর্ব এশিয়াতেই শুধু বাঘ পাওয়া যায়। উত্তর বা দক্ষিণ আমেরিকা কিংবা অস্ট্রেলিয়ায় নয়। এমনকী আফ্রিকা, যেখানে সিংহ, চিতা ও আরও নানান ধরনের হিংস্র জংলি পশুদের দেখতে পাওয়া যায়, সেখানেও বাঘ মেলে না। বাঘের আসল ঘরবাড়ি উত্তর রাশিয়ায় অনুমান করা হয়। এখান থেকেই এরা পূর্বে মাঞ্চুরিয়া, কোরিয়া, চিন, বর্মা, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, জাভা, সুমাত্রা ও বালী দ্বীপে ছড়িয়ে পড়েছে। সিংহলে কিন্তু বাঘ পাওয়া যায় না। এতেই বোঝা যায় এরা সিংহলে পৌঁছোবার আগেই ভারত ও সিংহলের মধ্যে ডাঙা দিয়ে যাওয়ার যে পথটা ছিল, সেটা জলে ডুবে যায়। বর্মা দিয়েই এরা ভারতে ঢোকে। আস্তে আস্তে আসামে, বাংলাদেশে, হিমালয়ের পাদদেশে, মধ্য ও দক্ষিণ ভারতে এরা আস্তানা গাড়ে। গভীর বনে, উপত্যকায়, গুহায়, পাহাড়ি জঙ্গলে আর নদনদীর পাড়ে সাধারণত এরা ডেরা বাঁধে। হিমালয় পাহাড়ের ২৪০০ থেকে ২৭০০ মিটার উঁচু জায়গাতেও বাঘ দেখতে পাওয়া যায়।

ভিন্ন ভিন্ন জায়গার জল-আবহাওয়াও ভিন্ন। তাই এদের চেহারা, হাবভাব ও চালচলনে এত তফাত। বাঘ নানান জাতের, নামকরা যায় চার রকমের।

(১) মাঞ্চুরিয়া-কোরিয়া জাতের বাঘ— আকারে সবচেয়ে বড়ো, গায়ের জোরও বেশি। সারা গায়ে বড়ো বড়ো লোম। বরফ ও ঠান্ডা থেকে এদের বাঁচায়। গায়ের ধারীগুলোর রংও বেশ হালকা।

(২) ক্যাস্পিয়ান সাগরের বাঘ— ক্যাস্পিয়ান সাগরের আশেপাশে, ককেশাস পাহাড়ে ও ইরাণের উত্তরে পাওয়া যায়। দেখতে অনেকটা আমাদের দেশের বাঘের মতো। লোম শক্ত ও ছোটো।

(৩) জাভা ও সুমাত্রা দ্বীপের বাঘ— ইন্দোনেশিয়ার জাভা, সুমাত্রা, বালী ইত্যাদি দ্বীপে এদের পাওয়া যায়। এরা দেখতে ছোটো। এদের গায়ের রং আমাদের দেশের বাঘের চেয়ে গাঢ়। এদের মুখ অন্য সব জাতের বাঘের চেয়ে অনেক সাদা।

(৪) ভারতের বাঘ— এরা রয়েল বেঙ্গল টাইগার নামেই পরিচিত। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সায়েব-শিকারিরা এদের বাংলাদেশে প্রথম খুঁজে পেয়েছিল।

মাঞ্চুরিয়া জাতের বাঘই যা একটু আলাদা। বাকি সব প্রায় একই রকমের। মাঞ্চুরিয়ার হাড়-কাঁপানো শীতে, মধ্য ভারতের প্রচণ্ড গরমে, হিমালয়ের পাদদেশের আর্দ্র জল-আবহাওয়ায় আর আসাম ও কেরলের দুর্দান্ত বর্ষায় বাঘেরা বেঁচে থাকে। উত্তরাঞ্চলের বরফে, তেরাইয়ের জলাভূমিতে, সুন্দরবনের লোনা জলে ও আসামের প্রচণ্ড বর্ষায় এরা অনায়াসে বাস করে।

বাঘের গায়ের রং সোনালি, তার ওপর গাঢ় কালো ডোরাকাটা— পিঠের শিরদাঁড়া থেকে শুরু হয়ে দু-ধার দিয়ে পেটের দিকে নেমে গেছে। ডোরাগুলোর রং কালো কিংবা গাঢ় ধূসর বর্ণের, পেটের তলার দিকে ক্রমশ হালকা হয়ে গেছে। বুক আর তলপেটের রং সাদা। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে ডোরাগুলোর রঙের জলুস কমতে থাকে, ফাঁকও বাড়ে। কিছু কিছু বাঘের গায়ের সামনের দিকে খুব অল্প ডোরা দাগ।

বাচ্চা বাঘেদের লোম তুলোর মতো নরম হলদেটে বালি রঙের। যেমন যেমন বয়স বাড়ে গায়ের রঙের জলুসও তেমনি বাড়তে থাকে, ডোরাকাটা দাগগুলো আরও গাঢ় ও পরিষ্কার হয়ে ফুটে ওঠে। বাঘিনীর গায়ের রং বাঘের গায়ের রঙের চেয়ে অনেক বেশি চটকদার।

শীতকালে এদের গায়ে খুব ঘন লোম গজায়, লোমের রংও বেশ চকচকে হয়। গরমের সময় কিছু লোম ঝরে যায়। গায়ের ডোরাকাট রংও ম্যাড়মেড়ে হয়ে পড়ে। এদের গোঁফগুলো সাদা ও শক্ত। কানের পেছন কালো, মধ্যিখানে খালি একটা করে সাদা ছোপ।

বাঘের গায়ের এই রং ও ডোরাকাটা দাগগুলো আত্মরক্ষায় এদের সাহায্য করে। গরমের সময় গাছের শুকনো পাতার সোনালি রঙের সঙ্গে আর শুকনো ঝোপঝাড়ের মাঝে এদের গায়ের রং এমনভাবে মিশে যায় যে দেখতে পাওয়াই ভার। একবার পিলিভিতের জঙ্গলে একটা আহত বাঘের সন্ধানে ফিরছিলাম। আমরা চার বন্ধুতে মিলে হাতির পিঠে চেপে খুব সাবধানে চারিদিক খোঁজাখুঁজি করছি। কিছুতেই বাঘের হদিশ মেলে না। হঠাৎ একটা ঝোপের আড়াল থেকে বাঘটা যখন আমাদের হাতির মাথার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল তখনই তাকে দেখতে পেলাম।

বাঘের মধ্যে সবচেয়ে নামকরা সাদা বাঘ। নৃপতি শাসিত রাজ্য রেওয়াতে পাওয়া যায়। বন্দি অবস্থায় সাদা বাঘ বাচ্চা দেয়। বাচ্চাও বন্দি অবস্থায় বড়ো হয়ে ওঠে। এদের গায়ের রং ধুলোটে, তার ওপর চকলেট ও বাদামি রঙের ডোরাকাটা।

বেড়াল কিংবা চিতার মতো এরা জল দেখে ভড়কায় না। জলকে এড়িয়েও চলে না। গরমকালে বাঘেদের প্রায়ই খানাডোবায় গা ডুবিযে বসে থাকতে দেখা যায়। সাঁতার দিতেও ওস্তাদ। নেপাল থেকে সাঁতার দিয়ে সারদা খাল পেরিয়ে এরা ভারতে এসেছে, একথা আমাদের অজানা নয়।

বেড়াল জাতের জন্তুরা খুবই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। বাঘ নিজেকে খুব পরিষ্কার রাখে। তবু বাঘের গায়ে একটা বিশ্রী ঝাঁঝালো বোটকা গন্ধ। এই গন্ধই তার শিকারদের সতর্ক করে দেয়। বাঘের নখও বেড়ালের মতো এদের নরম মাংসল থাবার মধ্যে লুকানো থাকে। মাঝে মাঝে গাছের ছালে নখগুলো ঘষে একটু শানিয়ে নেয়।

বাঘের কান বড়ো সতর্ক, ফিসফিস শব্দও কানে পৌঁছোয়, বিপদ বুঝলেই লুকিয়ে পড়ে।

খাওয়ার সময় শুকনো সরু ডাল ভাঙার সামান্য একটু শব্দেও এরা শিকার ছেড়ে লুকিয়ে পড়ে। বিপদ ঘাড়ে নেওয়ার চেয়ে খিদের জ্বালা সহ্য করা এদের কাছে অনেক সহজ। একবার কী হয়েছিল জান। এক শিকারি একটা বাঘকে ধরার জন্যে অপেক্ষা করছিল। সময় কাটাতে শিকারি বই পড়ছিল। বইয়ের পাতা উলটোনোর খসখস শব্দ শুনে বাঘ তার মুখের গ্রাস ফেলে দু-রাত্তির লুকিয়ে কাটাল।

রোদ্দুর বাঘের মোটেই পছন্দ নয়। সারাটা দিন তাই ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেয়। অন্ধকার হলেই পুরোপুরি চোখ মেলতে পারে। আঁধারেই ভালো দেখতে পায়। টর্চের আলোয় চোখদুটো আগুনের মতো জ্বলতে থাকে।

কুকুর, শেয়াল বা চিতার মতো বাঘের ঘ্রাণশক্তি অতটা তীব্র নয়। রাতের অন্ধকারে কিন্তু শুঁকে শুঁকেই এরা শিকার ধরে।

বাঘ নিঃশব্দে চুপিসাড়ে শিকার করে। সঙ্গীকে ডাকতেই যা হাঁক ছাড়ে। আর বাঘিনী শিকার করতে যাবার সময় ডাক দিয়ে বাচ্চাদের জড়ো করে।

বাঘের উঁচু জায়গা খুব পছন্দ। বসার সময় তাই আশপাশের সবচেয়ে উঁচু জায়গা বেছে নেয়। শীতের সময় পাথরের ওপর হাত-পা ছড়িয়ে রোদ পোয়ায়।

এদের বিরক্ত না করলে অযথা কাউকে আক্রমণ করে না। আলো, গোলমাল আর ভিড়ভাড়াক্কা এড়িয়ে চলে। আহত বাঘ কিংবা বাচ্চাদের পাহারা দেয় যে বাঘিনী— এদেরই শুধু হিংস্র হতে দেখা যায়। শিকারিদের কারুর কারুর মতে বাঘ শেয়ালের চেয়ে ভীরু। জখম না হলে বাঘের সাহস ও বীরত্ব জাগে না। রাখাল বালকেরাও গোরু চরাতে চরাতে বাঘকে শুধু চেঁচিয়েই তাড়ায়। বনেজঙ্গলে অন্য জন্তু জানোয়ারেরা বাঘ দেখলে কিংবা বাঘের গায়ের গন্ধ পেলে ডাক দিয়ে সবাইকে সাবধান করে দেয়! খেপা হনুমান ও বাঁদরের কিচকিচ আওয়াজ, হরিণ জাতের পশু কিংবা ছোপকাটা চিতলের একটানা ডাক, মায়াহরিণ বা কাকারের অদ্ভুত অস্বাভাবিক চিৎকার, বুনো মোরগ আর ময়ূরের ডাক— সবকটা আওয়াজের প্রতিধ্বনি শোনা গেলে বাঘ পালিয়ে বাঁচে।

বুনো শুয়োর বাঘের মুখোমুখি হতেও ভয় পায় না। বুনো মোষও বাঘের কবল থেকে অনায়াসেই নিজেকে বাঁচাতে পারে। সাধারণত বাঘ আলো ও আগুনে ভয় পায়। মানুষখেকো বাঘ শিকার পাবার লোভে কিন্তু আলোর দিকে এগিয়ে যায়।

বাঘ খুব সাবধানে, আস্তে আস্তে ও চুপিসারে আঙুলে ভর দিয়ে চলে। পা ফেলে এক মিটার তফাতে। এদের সামনে দুটো পা, প্রত্যেকটায় পাঁচটা করে নখ। পেছনের দু-পায়ে কিন্তু চারটে করে। সামনের পা দুটো পেছনের পায়ের চেয়ে লম্বায় খাটো কিন্তু খুব ভারী। পেছনের পা সুমুখের পায়ের চেয়ে সরু, থাবাগুলো ছোটো। কখনো কখনো সামনের পায়ের ছাপের ওপর পেছনের পায়ের ছাপ এমনভাবে পড়ে যেন মনে হয় কোনো দু-পাওয়ালা জন্তু হেঁটে গেছে। পায়ের ছাপ ধরে বাঘকে খোঁজা যায়। শুধু পায়ের ছাপ দেখেই বাঘের সাইজ, বাঘ না বাঘিনী বলে দেওয়া যায়। সাধারণত এরা ল্যাজ দোলাতে থাকে। রেগে গেলে বা খুব খুশি হলে ল্যাজ নাড়া বন্ধ করে দেয়।

বাঘ মাংসখেকো জন্তু। শুধু মাংস হলেই হল, কার মাংস, তাজা না বাসি, কিছুরই ধার ধারে না। মাংস ছাড়া আর কিছুই খায় না। মাঝে-সাঝে একটু-আধটু সবুজ ঘাস খায়, তাও ওষুধ হিসেবে। বাঘ নিজের শিকার করা মাংস ছাড়া খায় না, অনেকেরই তাই ধারণা। এটা কিন্তু ভুল। যে কোনো জন্তুর শিকার-করা মাংস এরা বিনা দ্বিধায়, বিনা কৈফিয়তেই খেয়ে নেয়। পোকা থিকথিকে পচা মাংস খুব ভালোবাসে।

খিদে পেলে বনের যেকোনো জন্তুজানোয়ার শিকার করে খায়, কোনো বাছবিচার করে না। বাঘ শুধু বুনো কুকুরের দলকে ভীষণ ভয় করে। শেয়ালও মাঝে মাঝে এদের হয়রান করে। খাবার পাবার লোভে বাঘের পিছু নেয়। বন্যার সময় বাঘেরা ব্যাং, কচ্ছপ আর মাছ খেয়ে খিদে মেটায়। বাঘ বাঘেরও মাংস খায়। বাঘিনীরা তাই নিজেদের বাচ্চাদের বাঘের ধারেকাছেও ঘেঁষতে দেয় না।

অন্য জন্তুরা বাঘের শিকার খায় না, একথা কিন্তু সত্যি নয়। সুযোগ পেলে বাঘের শিকার-করা মাংস বনের আর সব জন্তুরাই খায়। তাই শিকার-করা মাংস রাখার জায়গা বাঘেরা রোজ পালটায়। পেট ঠেসে খেয়ে বাকি মাংস লুকিয়ে রাখে। একসঙ্গে পঁচিশ থেকে তিরিশ কিলোগ্রাম মাংস খেতে পারে।

বাঘ শিকারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে না। আস্তে আস্তে চুপিসারে শিকারের কাছাকাছি গিয়ে হঠাৎ দৌড়ে লাফ মারে। প্রথমে শিকারের ঘাড় মটকায় কিংবা টুঁটি চেপে ধরে। এদের খাওয়া খুব পরিষ্কার। অন্য কোনো জন্তুর এত পরিষ্কার নয়। পায়ের দিক থেকে খেতে শুরু করে। প্রথমে ঊরুর মাংস, তারপর আস্তে আস্তে সারা শরীরের মাংস, চামড়া, হাড় ও মাথার চুল চিবিয়ে খায়। নাড়িভুঁড়ি শুধু খায় না, সন্তর্পণে আলাদা করে সরিয়ে রাখে।

এরা একলা শিকার করে। প্রত্যেকের আলাদা আলাদা শিকার করার এলাকা আছে। খিদে পেলেই তবে শিকার করে। সাধারণত মাসে তিন-চার বারের বেশি এদের শিকার মেলে না।

বাঘ মানুষকে ভয় করে। মানুষের উচ্চতা, পোশাক-আশাক আর দুটো পা দেখে। তবুও এরা মানুষ মেরে খায়। বুড়ো, অসুস্থ, দুর্বল বা আহত বাঘের শিকার করতে খুবই কষ্ট হয়। খিদের সময় সামনে মানুষ পড়লে এরা মানুষখেকো হয়ে পড়ে। মানুষখেকো বাঘ গোরু-বাছুর ছেড়ে দিয়ে রাখালেরই পিছু নেয়। মানুষখেকো বাঘিনীর বাচ্চারাও মানুষের মাংসের স্বাদ পেয়ে যায়। এরা কিন্তু মানুষের মাথা খায় না। কুকুরের মতোই বাঘ পাগল হয়ে যায়। পাগল হবার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই অনেককে আক্রমণ করে।

মানুষখেকো বাঘ মানুষ চেনে, মানুষের চালচলনও বুঝতে পারে। অসাবধানী পথিককে হঠাৎ কি করে আক্রমণ করতে হয়, চুপি চুপি বাড়িতে ঢুকে কী করে ঘরের লোককে টেনে তুলে নিয়ে যেতে হয় কিংবা বিশ পঁচিশ জন যেখানে একসঙ্গে শুয়ে আছে সেখান থেকে একজনকে কী করে টেনে তুলে নিতে হয় তা এরা নিখুঁতভাবেই জানে। মানুষখেকো বাঘেরা কোনো কিছু বুঝতে না দিয়ে হঠাৎ পেছন দিক থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। বাঘ দেখতে কত বড়ো— এ নিয়ে নানা রকমের অদ্ভুত অদ্ভুত সব গল্প আছে। শিকারিরা যেসব বাঘ মারেন, বলার সময় বাঘের আসল সাইজের ওপর রং চড়িয়ে দু-এক ফুট বাড়িয়ে বলেন। আগেকার দিনে রাজামহারাজেরা বাঘ মারতেন। এঁদের খুশি করতে এঁদের সাঙ্গোপাঙ্গরা বাঘের সাইজ বাড়িয়ে বলত। মাপবার ফিতে একটু বেশি টেনে ধরে দেখার কিংবা ভুল মাপ পড়ার অভ্যাস শিকারিদের মধ্যে আকছার দেখা যেত। ছ-মিটার লম্বা বাঘও মারা হয়েছে, এমন কথাও শোনা গেছে। অথচ বাঘেরা সাধারণত সওয়া তিন মিটারের বেশি লম্বা হয় না। মাপার সময় বাঘের মাথা থেকে ল্যাজের শেষ প্রান্ত অবধি ধরা হয়। বাঘিনীরা তেত্রিশ-চৌত্রিশ সেন্টিমিটার ছোটো। উচ্চতা এদের এক মিটারের কিছু বেশি। ওজন দু-শো নব্বই কিলোগ্রাম।

বাঘিনীরা তিন মাস দশ দিন পেটে বাচ্চা ধরে। অধিকাংশ সময়ই একসঙ্গে তিনটে বাচ্চা দেয়। জন্মাবার পরই বাচ্চার ওজন দেড় কিলোগ্রামের মতো। বাঘিনী বাচ্চাদের পাহাড়ের গুহায়, নয় বড়ো বড়ো পাথরের পেছনে কিংবা গাছের ফোকরে লুকিয়ে রাখে। বাচ্চাদের ঘাড়ের চামড়া আলতো করে মুখে ধরে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যায়। বাচ্চাদের ধারে কাছে কাউকে ঘেঁষতে দেয় না। ন-দিনের দিন বাচ্চাদের চোখ ফোটে, পরিষ্কার চোখ মেলে দেখতে আরও দিন পনেরো লেগে যায়। মায়ের কোল ধরে বেশ কিছুদিন থাকে। বাঘিনীর আবার বাচ্চা হবার সময় হলে এইসব বাচ্চাদের ছেড়ে দেয়। শিকারিদের মতে বাঘিনীরা জঙ্গলে তিন বছর অন্তর বাচ্চা দেয়। এরাই বাচ্চাদের শিকার খুঁজতে আর শিকার করতে শেখায়। পুরোপুরি বড়ো হতে বাচ্চাদের পাঁচ বছর লাগে।

শিকারের মধ্যে বাঘ-শিকার সত্যিই খুব বিপজ্জনক। আগেকার দিনে তরোয়াল, বর্শা আর তির দিয়ে বাঘ শিকার করা হত। বাঘকে ফাঁদে ফেলার জন্যে গ্রামবাসীরা যারা জঙ্গলে বাস করত তারা প্রায়ই গর্ত খুঁড়ে গর্তের মুখ ঘাস পাতা দিয়ে ঢেকে রেখে দিত। বাঘ ধরার অনেক রকম ফাঁদ ছিল। কখনো কখনো ভুলিয়ে-ভালিয়ে বাঘকে খাঁচায় পুরে বর্শা দিয়ে মারা হত। কোনো কোনো জায়গায় আবার বাঘেদের প্রিয় খাবারের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে টোপ ফেলা হত। সুন্দরবনে মাচা বাঁধার মতো বড়ো গাছ নেই। শিকারিরা তাই নিজেদের বাঁচাতে লোহার শক্ত গরাদ দেওয়া খাঁচার মধ্যে বসে গুলি ছোড়ে।

রাইফেল ও বন্দুকের পসারের সঙ্গে সঙ্গে বাঘ শিকারের রীতিও পালটে গেছে। বাঘের পায়ের ছাপ দেখতে পেলে শিকারিরা সাধারণত একটা বছর খানেকের মোষের বাচ্চাকে সন্ধেবেলা একটা গাছ কিংবা একটা খুঁটির সঙ্গে বেঁধে দিয়ে আসেন। মোষের গলায় দড়ি না বেঁধে তার পা দুটো শক্ত করে বেঁধে দেন। সন্ধেবেলা বাঘ এদিকে এসে পড়লে মোষটাকে মেরে টানতে টানতে আশেপাশের ঝোপঝাড়ে নিয়ে যায়। বেশ ঘন ঝোপঝাড় হলে বাঘও শিকারের সঙ্গে সেখানেই লুকিয়ে থাকে। পরের দিন হাঁকোয়া দিয়ে অর্থাৎ ঢাক ঢোল পিটিয়ে তাড়া দিয়ে বাঘকে সেখান থেকে বাইরে আনা হয়। মাচায় শিকারিরা তো বন্দুক হাতে তৈরি। যেই বাঘ বন্দুকের রেঞ্জ বা পাল্লার মধ্যে এসে পড়ে, অমনি শিকারিরা গুলি ছোড়েন।

হাতির পিঠে চড়ে বাঘ খোঁজাই সুবিধে। এর জন্যে বিশেষভাবে শেখানো-পড়ানো হাতির দরকার। মাচায় বসে শিকার করার চেয়ে চারিদিক ঢাকা গভীর গর্তের ভেতর বসে শিকার করা অনেক শিকারি পছন্দ করেন। লুকিয়ে-থাকা বাঘকে তার জায়গা থেকে তাড়িয়ে মাচার দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। এই তাড়ানোর কাজে অনেক সময় হাতিকেও লাগানো হয়।

সাদা জিনিসে বাঘ ভয় পায়। তাই বাঘের চলার পথ রোধ করতে বা তাকে ভিন্ন পথে নিয়ে যাবার জন্যে তার যাতায়াতের পথে সাদা চাদর টাঙিয়ে কিংবা সাদা কাগজ বিছিয়ে দেওয়া হয়। বাঘ আর এদিকে মাড়ায় না। যেসব বাঘ এই ব্যাপারে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে তারা বিপদ বুঝে জঙ্গলে ফিরে যায়। শিকারিদের কেউ কেউ মাচার চেয়ে হাতির পিঠে চড়ে শিকার করতে ভালোবাসেন। হাতি দিয়ে বাঘকে তাড়িয়ে আনা হয়। হাতির পিঠই হয় মাচা। এর একটা সুবিধে। মাচা সরানো যায় না, কিন্তু হাতির পিঠে চড়ে খুশিমতো এগোনো-পেছোনো যায়।

নেপালের তরাইতে শিকারর সময় চার পাঁচশো হাতি দিয়ে বাঘকে গোল করে ঘিরে ফেলা হয়। এটাই বাঘ শিকারের 'রিং ওয়ে' পদ্ধতি বা গোলাকারে বাঘ ধরার প্রণালী।

বাঘ শিকারের সময় খুব সতর্ক থাকতে হয়। বাঘ তাড়ানো শুরু হলেই বনের আর সব জন্তুরা ডেরা ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে। বাঘও এদের পিছু নেয়। বাঘ যখন ছুটে বেড়ায় তখন গুলি করা খুবই বিপজ্জনক। আহত বাঘ শিকারির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে মেরে ফেলতে পারে। গুলি বিঁধলেই বাঘ গর্জে ওঠে। হাঁকোয়ায় সাধারণত একটা বাঘই বেরোয় কখনো-বা একটার বেশি।

বেশির ভাগ মাচাই চার মিটার বা আরও একটু উঁচুতে বাধা হয়। মাচার চারদিক ভালোভাবে ঢেকে দেওযা হয়।

পায়ে হেঁটে বাঘ শিকার করা আরও শক্ত ও মারাত্মক।

স্বভাবতই বাঘেরা শান্তিপ্রিয়। মানুষ বা অন্যান্য জন্তুজানোয়ারের সঙ্গে খামোখা ঝগড়া বা ঝামেলা বাধাতে চায় না। একবার আহত হলে আর দেখতে হবে না। ঝোপেঝাড়ে তখন ঘাপটি মেরে বসে থাকে। আচমকা শিকারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। আহত বাঘ হাতির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে বা মাচা বেয়ে ওপরে উঠতে এতটুকুও দ্বিধা করে না।

হাতির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছে কিংবা কোনো মানুষকে ধরে ফেলেছে এমন আহত বাঘকে লক্ষ করে কখনো গুলি ছুড়তে নেই। বাঘ এত তাড়াতাড়ি নড়াচড়া করে যে গুলি ফসকে গিয়ে হয় হাতিকে নয় মানুষকে জখম করতে পারে। এইরকম বিপদের সময় গুলির ফাঁকা আওয়াজে বাঘকে ভয় দেখাতে হয়। গুলির শব্দে বাঘ ভীষণ ভয় পায়।

কথায় বলে বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা। বাঘের হাতে জখম হলে বাঁচা খুবই শক্ত। আঁচড়গুলো ঘা হয়ে পচতে আরম্ভ করে। গুলি খেয়ে বাঘ সব সময় কিন্তু মরে না, কখনও কখনও শুধু অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকে। গুলি করে বাঘের কাছে এগিয়ে গিয়ে তাই অনেক শিকারীই প্রাণ হারিয়েছে।

পাথরের মূর্তির মতো মানুষ স্থির হয়ে থাকলে বাঘ আক্রমণ করে না। নিশ্বাস বন্ধ করে থাকলেও মানুষকে খুঁজে বার করতে পারে না।

বাঘের চামড়া, গোঁফ, দাঁত, নখ, মাংস এমনকী চর্বিও কাজে লাগে। অনেকেরই বিশ্বাস বাঘের মাংস খেলে বাঘের মতোই শক্তিশালী আর সাহসী হওয়া যায়। বাঘের চর্বি বাতের খুব ভালো ওষুধ। বাঘের নখ সোনায় কিংবা রুপোয় বাঁধিয়ে তাবিজের মতো ব্যবহার হয়। বাঘের হাড় ইংরেজরা যাকে 'লাকি বোন' বলে, সেটাও সোনা দিয়ে বাঁধিয়ে অনেকে পরে। বাঘের ছাল খুব টেকসই, কার্পেটের মতো ব্যবহার করা হয়। শোনা যায় বাঘিনীর দুধে চোখের অনেক রকম রোগও সারে।

 

চিতাবাঘ বা গুলবাঘ— চিতাবাঘের আর এক নাম গুলবাঘ। বেড়াল পরিবারেরই এরা। খুব চালাক, ধূর্ত আর বিশ্বাসঘাতক। বুন্দেলখণ্ডের লোকেরা বলে 'তেন্দুয়া'। গায়ের ছোপগুলো ফুলের মতো দেখায় বলে এদের 'গুলদার' বা 'গুলবাঘ' বলা হয়।

চিতা প্রায় সব দেশেই পাওয়া যায়। আফ্রিকার বাঘ মেলে না, কিন্তু চিতার ছড়াছড়ি। 'জাগুয়ার' বলে এক জাতের বাঘ আমেরিকার প্রায় সব জায়গাতেই পাওয়া যায়, দেখতে ঠিক চিতার মতো। সাইবেরিয়ার উত্তরাঞ্চল ছাড়া এশিয়ার সব জায়গায় এদের দেখা যায়। আন্দামানের দ্বীপগুলোয়, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, মাদাগাস্কার ও সাহারার মরুভূমিতে কিন্তু চিতা মেলে না। আমাদের দেশে প্রায় সব জায়গাতেই পাওয়া যায়। হিমালয়ের দু-হাজার থেকে দু-হাজার আটশো মিটার উঁচু জায়গাতেও এদের দেখা মেলে। যেখানেই থাকুক, বসবার সময় এরাও সবসময় বাঘের মতো ঠিক উঁচু জায়গাটি বেছে নেয়।

চিতার গায়ের রং সোনালি। তলপেট সাদা, বাকি শরীর কালো ছোপে ভরতি। থাবা, ঘাড়, মাথা, পেট আর ল্যাজের ছোপগুলো ঘন কালো। আসাম ও কেরালায় গড়পড়তা বছরে দু-শো আশি সেন্টিমিটার বৃষ্টি হয়। এখানকার চিতা কালো কুচকুচে। যতই কালো হোক, কালো রঙের তলায় ঠিক ফুলের মতো ছোপ। কাছ থেকে দেখলেই বুঝতে পারবে। আত্মরক্ষার জন্যেই এই রঙের বাহার— সোনালি রং আর কালো ছোপ। জঙ্গলের ধূপছায়ায় এদের সোনালি রং ও কালো ছোপের ওপর যখন গাছের পাতার ছায়া পড়ে তখন কে বলবে এরা ঘাপটি মেরে বসে আছে। এত সুন্দর দেখতে যে গায়ে হাত বুলোতে ইচ্ছে করে।

অনেকটা পোষা বিড়ালের মতো। ছিপছিপে গড়ন, নিঃসাড়ে চলাফেরা করে। তীক্ষ্ন কান, খরখরে জিভ। ছোটায় জাতভাইদের হার মানায়। আশি সেন্টিমিটার উঁচু, ল্যাজের গোড়া থেকে নাকের ডগা অবধি লম্বায় আড়াই মিটার। শুধু ল্যাজটাই পঁচাত্তর সেন্টিমিটার। খুব বেশি করে হলে ওজন একানব্বই কিলোগ্রাম।

চিতা বাঘিনীরা আকারে ছোটো, ওজনও কম। একসঙ্গে এরা তিনটে থেকে চারটে বাচ্চা দেয়। চিড়িয়াখানায় দেখা গেছে এরা তিন মাস পেটে বাচ্চা ধরে। জন্ম থেকে কুড়ি দিন বাচ্চাদের চোখ খোলে না। চিতা বাঘও কখনো কখনো বাচ্চাদের পালতে সাহায্য করে। বাচ্চাদের নির্জন জায়গায় রেখে দেয়। কাউকে কাছে ঘেঁষতে দেয় না। বাচ্চাদের ঘাড়ের চামড়া মুখে ধরে বাঘিনীরা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যায়।

এদের থাবা খুব মাংসল। সামনের পায়ে পাঁচটা করে নখ, পেছনের পায়ে চারটে। হাঁটার সময় নখগুলো থাবার মধ্যে লুকোনো থাকে। সবসুদ্ধ আঠারোটা নখ ঠিক যেন আঠারোটা শানালো ছুরি। এদের খপ্পরে কোনো জন্তুজানোয়ার পড়লে তার রক্ষে নেই। গাছের ছালে ঘষে বলে নখ খুব ধারালো। বেড়ালের মতো তেরচা চোখ নয়, গোল কটা চোখ। টর্চের আলোয় চোখ যেন আগুনের মতো জ্বলে। জোরালো আলোয় ভয় পায়। সূর্যাস্তের পর শিকারে বেরোয়, বাঘের চেয়ে ঘণ্টাখানেক আগে। বাঘ বা সিংহের মতো গর্জন করে না। শুয়োরের মতো ঘোঁৎঘোঁৎ করে। করাত দিয়ে কাঠ কাটার মতো 'ঘোঁৎঘোঁৎ' আওয়াজ। চিতা বাঘকে ডাকবার সময়ও বাঘিনীরা এইরকম আওয়াজ করে। হাঁচি দিয়ে এরা রাগ দেখায়। বাচ্চাদের ধমকানোর সময় সাপের মতো ফোঁস করে ওঠে।

বেড়ালের মতো অনায়াসেই এরা গাছে কিংবা বাড়ির ছাদে চড়তে পারে। বেশির ভাগ সময়ই শিকার মেরে গাছের ডালে লুকিয়ে রাখে। জলে ভীষণ ভয় পায় বলে গায়ে এক ফোঁটা জলও লাগতে দেয় না। বাঘের মতোই এদের শোনার ক্ষমতা তীক্ষ্ন, তারপর দেখার আর সব শেষ শোঁকার। প্রয়োজনে শরীরটা খুব ছোটো করে গুটিয়ে নিয়ে অল্প জায়গাতেই থাকতে পারে।

এরা সব সময় জন্তুজানোয়ারই ধরে খায়। পছন্দ করে কুকুরের মাংস। ঘুমন্ত লোকের খাটিয়ার তলা থেকে নিঃশব্দে কুকুর তুলে নিয়ে যায়। বাঘের শিকার করা লুকানো মাংস এরা অনেক সময় খেয়ে নেয়। তবে বাঘের মতো পরিষ্কার করে খেতে পারে না। খাওয়া দেখেই বোঝা যায়— বাঘ খেয়েছে না চিতা। বাঘের মতো এদের জিভের ওপর দিকটা শিরিষ কাগজের মতো বেশ খরখরে আর নীচের দিকটা মাখনের মতো মোলায়েম।

শিকারের ওপর এরা লাফিয়ে পড়ে না। বিদ্যুৎ গতিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মানুষখেকো চিতা ধরা খুব শক্ত। গাড়োয়ালের রুদ্রপ্রয়াগে এক মানুষখেকো চিতা এক-শো পঁচিশটা মানুষ মারে। আট বছর ধরে চেষ্টা করেও শিকারিরা একে ধরতে পারেনি। বেশ কয়েক মাস ধরে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে বিখ্যাত শিকারি জিম করবেট তাকে খতম করেন।

মাচায় বসে বাঘের হাত এড়ানো যায়, চিতার নয়। হাতিকেও ভয় করে না। লম্বা লম্বা ঘাসের মধ্যে ঘাপটি মেরে বসে থাকে, সুযোগ বুঝলেই দে ঝাঁপ। আহত চিতা যেন সাক্ষাৎ যম। আহত চিতার খোঁজ করতে গিয়ে অনেক শিকারিই প্রাণ হারিয়েছেন। আহত বাঘের চেয়ে আহত চিতা খোঁজা শক্ত। তবে বাঘে ছুঁলে যেমন আঠারো ঘা, চিতায় তেমন নয়। চিতার হাত থেকে রেহাই পেয়ে অনেকেই বেঁচে আছে, কিন্তু বাঘের হাত থেকে নয়।

ধূর্ত বলেই বোধ হয় শিকারি আসার আঁচ পেলেই উধাও হয়ে যায়। বাঘের চেয়ে চিতাই আমাদের দেশে বেশি। চিতাবাঘেরা যত সহজে শিকারির হাত থেকে পালাতে পারে অত সহজে বাঘেরা নয়। যেখানে তিনটে বাঘ মারা হয় সেখানে চিতা মাত্তর একটা। চিতার ধূর্তমির অনেক গল্প আছে। চুপিসারে শিকারির সামনে দিয়ে টোপ নিয়ে এরা পালায়। শিকারি বেচারি বন্দুক হাতে অপেক্ষায় চুপচাপ বসে থাকে।

সাধারণত এরা মানুষের সামনে আসে না। কিন্তু জঙ্গলের মধ্যে কখনো কখনো রাস্তার চৌমাথায় এদের বসে থাকতে দেখা যায়।

আমাদের দেশে আরও দু-রকমের চিতাবাঘ আছে। 'হিম তেন্দুয়া' বা বরফের চিতা। কাশ্মীর কিংবা হিমালয়ের পশ্চিমে তিন হাজার তিনশো মিটার উঁচুতে এদের সাধারণত দেখতে পাওয়া যায়। এরা সমতলভূমির চিতাবাঘের চেয়ে আকারে ছোটো। লম্বায় সওয়া দু-মিটার থেকে পৌনে তিন মিটার, ওজনে তেত্রিশ কিলোগ্রাম থেকে একচল্লিশ কিলোগ্রাম। ল্যাজ এক মিটারেরও বেশি লম্বা। উচ্চতায় পঁচাত্তর সেন্টিমিটার। মেটে রঙের গায়ের ওপর হালকা কালো ছোপ। পাহাড় কিংবা বরফে ঢাকা পাহাড়ে এদের গায়ের রং আত্মরক্ষা করতে সাহায্য করে। লোহার তারের খাঁচায় ধরা হয়। গায়ের ছাল খুব দামি। লোমগুলো লম্বা লম্বা, নরম ও রেশমের মতো।

দ্বিতীয় জাতের চিতার নাম 'ক্লাউডেড চিতা'। আমরা 'বাদুলে চিতা' বলতে পারি। পূর্ব হিমালয়ে, আসাম, সিকিম আর নেপালের ঘন জঙ্গলে এদের বাস। সাধারণত এরা গাছের ওপরেই থাকে। মেটে খাকি গায়ের রং, মাথায় আর ল্যাজে বড়ো বড়ো কালো ছোপ। গায়ের ছোপ খুব বড়ো ও চৌকো। ডোরাকাটা বলে অনেক সময় ভুল হয়।

বাদুলে চিতারা উচ্চতায় প্রায় আশি সেন্টিমিটার, লম্বায় ল্যাজ সমেত দেড় থেকে সওয়া দু-মিটার। ল্যাজটা একষট্টি থেকে নব্বই সেন্টিমিটার। ষোলো থেকে তেইশ কিলোগ্রাম এদের ওজন। পা এদের অন্য সব চিতার চেয়ে ভারী। থাবাগুলো চেপটা ও পুরু। কষের দাঁত খুব লম্বা। মজবুতও খুব। বেশ চড়া দামে এই দাঁত বিক্রি হয়। বোর্নিয়োর অধিবাসীরা কানের গয়না করে পরে। এরা পোষ মানেও সহজে। খাবার সময় বিরক্ত না করলে মানুষ আক্রমণ করে না। বাদুলে চিতা সম্প্রতি দিল্লির চিড়িয়াখানায় আনা হয়েছে।

আমাদের দেশের চিতাবাঘের নিকট আত্মীয় আমেরিকার 'জাগুয়ার'। আমেরিকা ছাড়া আর কোথাও নেই। আমাদের চিতাবাঘের চেয়ে আকারে বড়ো, ওজনে ভারী। রংচঙে ও ছোপকাটা। খাড়া কান, কানের পেছনটা একেবারে কালো। নীচের ঠোঁটে একটা ঘন কালো ছোপ। জল দেখে ভয় পায় না। খুব ভালো সাঁতারু। বন্দি অবস্থায় মহানন্দে থাকে। চিতার মতো অত বাধ্য নয় বলে এদের পোষ মানানো শক্ত।

শিকারি চিতা— শিকারি চিতাও বেড়ালের পরিবারের। কুকুরের সঙ্গে কিন্তু এর বেশ সাদৃশ্য। পা কুকুরের মতো লম্বা। গড়নটুকু ছাড়া বাকি সব বেড়াল পরিবারের অন্য সব জানোয়ারের চেয়ে ভিন্ন। শিকারি চিতা দু-রকমের। আফ্রিকার খোলামেলা জঙ্গলে যে ধরনের শিকারি চিতা পাওয়া যায় আমাদের শিকারি চিতাও তাই। এদের উচ্চতা চিতা বা গুলবাঘের চেয়ে বেশি। তাই ল্যাজ পর্যন্ত ধরলে লম্বায় দুই থেকে আড়াই মিটার। শুধু ল্যাজটাই ষাট থেকে পঁচাত্তর সেন্টিমিটার। উচ্চতায় এক মিটার, ওজন পঞ্চাশ থেকে পঁয়ষট্টি কিলোগ্রাম। বাচ্চারা মায়ের পেটে নব্বই দিন থাকে। একসঙ্গে দুটো থেকে চারটে বাচ্চা জন্মায়।

এদের গায়ের রং ও ছোপ চিতা বা গুলবাঘের মতো। ছোপগুলো গাঢ় কালো রঙের— এই যা তফাত। বাচ্চাদের গায়ের চামড়া হালকা নীলচে পীত রঙের রেশমের মতো। যত বড়ো হয়, ছোপগুলো তত স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মাথাটা শরীরের অনুপাতে ছোটো, মুখ চিতার চেয়ে চেপটা। চোখের জলের মতো চোখের কোল বেয়ে দুটো কালো দাগ নাকের পাশ দিয়ে মুখের দু-দিকে মিলেছে। ছোট্ট কান, চোখের তারা গোল। শক্ত লোম, ঘাড়ে ঝাঁকড়া চুল। নখগুলো পুরোপুরি থাবা দিয়ে ঢাকা নয়। বেড়ালের মতো নখগুলোও পুরো গোটাতে পারে না। আর সবার মতো এরাও গাছের ছালে নখ শানিয়ে ধারালো করে। তফাত শুধু একই গাছের ছালে বার বার নখ শানায়। এদের ধরতে শিকারিরা গাছের চারদিকেই ফাঁদ পাতে। শিকারি চিতার দাঁত চিতার দাঁতের চেয়ে ছোটো।

এদের চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ন। চোখ দিয়েই এরা শিকার করে। শোঁকার ও শোনার ক্ষমতা কম। তাই হাবভাব ও চালচলন চিতার ঠিক বিপরীত। এরা দিনে শিকার করে, চিতা রাতে।

জন্তুদের মধ্যে এরাই সবচেয়ে জোরে দৌড়োয়। হরিণ, চিতলদের পিছু পিছু ছ-সাত কিলোমিটার ছুটে ধরে খায়। চুপিচুপি নিঃসাড়ে শিকার খোঁজে। শিকার নজরে পড়লেই লাফিয়ে ধাওয়া করে। চোখের পলকে একশো কিলোমিটার বেগে দৌড় মারে। শিকার ধরেই মেরে খায়। শিকার মেরে ঝোপেঝাড়ে টেনে নিয়ে যায় না, লুকিয়ে রাখারও চেষ্টা নেই। এধার-ওধার ছড়িয়ে খায়। খাওয়া বড়ো নোংরা।

আমাদের দেশের পশ্চিমের সমতলভূমি, মধ্যভাগের উচ্চভূমি দাক্ষিণাত্য অবধি পুরো এলাকায় এককালে শিকারি চিতা পাওয়া যেত। শিকারি চিতা এখন আর নেই বললেই হয়। ১৯৫১ সালে অন্ধ্রপ্রদেশে একজোড়া শিকারি চিতা শেষবারের মতো দেখা গিয়েছিল।

আগেকার দিনে শিকারের জন্য রাজামহারাজারা কুকুর-হাতির সঙ্গে শিকারি চিতাও পুষতেন। শিকারি চিতা নিয়ে শিকার করায় বেশ একটু দক্ষতার প্রয়োজন। শিকারি চিতার চোখ বেঁধে গোরুর গাড়িতে করে জঙ্গলে নিয়ে যাওয়া হত। শিকার দেখতে পেলে চোখের বাঁধনটা খুলে নেওয়া হত। শিকার দেখেই এরা পাঁই পাঁই করে ছুট দিত। শিকার ধরেই ঘাড় মটকাত পারিশ্রমিক হিসেবে এদের খানিকটা মাংস দেওয়া হত। তাই পেয়েই এরা মহা খুশি। এইরকমই এদের শিক্ষা দেওয়া হত।

ছুটলে শিকারি চিতাকে খুব সুন্দর দেখায়। চলন কিন্তু বড়ো বিশ্রী। সাদাসিধে ও বাধ্য বলে সহজেই পোষ মানে। মালিকের দেওয়া নাম আর সেইসঙ্গে মালিকের নাম তাড়াতাড়ি মনে রাখতে শেখে। শিকারীচিতা বন্দি অবস্থায় থাকতে পারে। বন্দি অবস্থায় খুব কম বাচ্চা দেয়।

বাঘের গায়ের গন্ধ— 'বোঁটকা' গন্ধের কথা, আর চিড়িয়াখানার বাঘের খাঁচায়, বা আশেপাশে যে দুর্গন্ধ পাওয়া যায়, সে-বিষয়ে আগেই বলেছি। কিন্তু মুক্ত প্রকৃতিতেও অনেক শিকারি বাঘের 'বোঁটকা' গন্ধের উল্লেখ করেছেন। 'বোকা পাঁঠার' অর্থাৎ বয়স্ক পুরুষ পাঁঠার গায়ের তীব্র দুর্গন্ধকে অনেকে বোটকা বলেন। দুজন জাপানি বিজ্ঞানী এ গন্ধের জন্য দায়ী রাসায়নিক পদার্থগুলি সনাক্ত করতে পেরেছেন। প্রধানত মিথাইল অক্টানয়িক অ্যাসিড আর এরই কাছাকাছি দু-একটি রাসায়নিক এ গন্ধের জন্য দায়ী।

বাঘের গায়ে কোনো তীব্র গন্ধ আদৌ আছে কি? খৈরির বা ডোরা-র গায়ে কোনো উল্লেখযোগ্য গন্ধই আমরা পাইনি। চিড়িয়াখানার পোষা বাঘে শাংখালাও কোনো গন্ধ অনুভব করেননি। কিন্তু কয়েকটি ক্ষেত্রে একটু দূর থেকে বন্য বাঘের গায়ের গন্ধ অনুভব করেচেন। তাঁর ধারণা বিশেষ বিশেষ সময়, শারীরবৃত্তীয় কারণে হয়তো তুলনামূলকভাবে বেশি তীব্র গন্ধ বের হয় বাঘ-বাঘিনীর গা থেকে। এলজা আর চিতা পিপার গায়ে উল্লেখযোগ্য গন্ধ পেয়েছেন জয় অ্যাডামসন, ঠিক ঋতুকালে যখন তারা সঙ্গমের জন্য প্রস্তুত।

শিকারী শের জঙ্গ একাধিক বার বনের বাঘের গন্ধ পেয়েছেন একটু দূর থেকে। ডানবার ব্রান্ডার বলেছেন শিকার করা বাঘের চামড়া ছাড়ানোর সময় তিনি বাঘের গায়ের 'দুর্গন্ধ' অনুভব করেছেন। সুন্দরবনের গ্রামে মানুষের বাড়িতে বাঘ ঢুকেছে অনেকবার ইদানীং কালে। তখন কেউ কেউ বাঘ দেখার আগেই গন্ধ পেয়েছেন, আবার কেউ কেউ একেবারেই পাননি। সুন্দরবনে টাইগার প্রোজেক্টের দু-তিন জন কর্মচারীর কাছে শুনেছি ঘুমপাড়ানি বন্দুক দিয়ে অজ্ঞান করা বাঘের গায়ে উল্লেখযোগ্য গন্ধ রয়েছে।

তবে মানুষের নাকে না ধরা পড়লেও, অনুকূল বাতাস বইতে থাকলে হরিণ ইত্যাদি বাঘের উপস্থিতি বুঝতে পারে। যে হরিণ বাঘের মার্কিং ফ্লুইড শুঁকে দেখে কৌতূহলের বশে কিন্তু ভয়ের কোনো চিহ্নই প্রকাশ করে না, বাঘের গায়ের গন্ধ বাতাসে ভেসে এলে সে নিমেষেই সচকিত হয়ে ওঠে। প্রথম ক্ষেত্রে, তার অভিজ্ঞতায় সে জানে এই মুহূর্তে বাঘ এখানে নেই। গায়ের গন্ধ মনে এখানেই আছে এখন বাঘটি। অতএব সাবধান। ভারতের বিখ্যাত প্রকৃতিবিদ কৃষ্ণান বছর তিরিশ আগেই বলেছেন বাঘের গায়ের গন্ধটি যদি বিজ্ঞানীরা রাসায়নিক পরীক্ষায় বিশ্লেষণ করতে পারেন, তার সাহায্যে হয়তো শস্যের খেত থেকে হরিণ বা হাতি তাড়িয়ে দেওয়া যাবে। তবে হাতির মতো বুদ্ধিমান প্রাণী হয়তো কিছুদিনের মধ্যেই বুঝে ফেলবে আমাদের এই ধোঁকা দেওয়ার চেষ্টা। এ ছাড়াও গন্ধগুলি সাধারণত অনেক রাসায়নিক পদার্থের মিশ্রণ। সেগুলি ঠিক ঠিক অনুপাতে মেশানোও কঠিন কাজ। একবার একটি ভারতীয় বাঘের মার্কিং ফ্লুইডে পাওয়া গোটা দশেক ফ্যাটি অ্যাসিডের মিশ্রণ (ঠিক পরিমাণ মতো) আফ্রিকার একটি মুক্ত, বনচারী লেপার্ডকে শুঁকতে দিয়েছিলাম। তার খাদ্যর কাছেই একটি পাথরে মাখিয়ে। খাওয়া হয়ে যাওয়ার পরে সে মাথা নীচু করে আশেপাশে খুঁজছিল কোনো ছিটেফোঁটা পড়ে থাকা মাংস। সে সময় ওই গন্ধটি সে নিশ্চয় পেয়েছে, কিন্তু ফ্লেমেনও করেনি, অন্য কোনোরকম আগ্রহ বা ভয় কোনো কিছুই প্রকাশ করেনি। ওই গন্ধ তাকে কোনো বার্তাই দেয়নি। মার্কিং ফ্লুইডের ফ্যাটি অ্যাসিড, এলডিহাইড ইত্যাদি ৩০/৪০ টি পদার্থের মিশ্রণ দিলে হয়তো কাজ হত। অথবা তাতেও নয়, বুর্গারের শতাধিক পদার্থ হয়তো প্রয়োজন।

সে যাই হোক, বাঘের গায়ের গন্ধ বিশ্লেষণ আমাদের কাছে গুরত্বপূর্ণ। হরিণ তাড়ানোর চেয়েও আমার বেশি আগ্রহ বাঘের গায়ের গন্ধবার্তা ফেরোমোন হিসেবে কাজ করে কি না, তা জানতে। জানা গেছে বাঘিনী তার মিলন বেলায় শুধু 'পিচকারি মারে' না, তার শরীরও ঘষে, গাছে বা মাটিতে। তাই হয়তো দু-ভাবে দুটি বার্তা, দুটি আমন্ত্রণ পত্র পাঠিয়ে দেওয়া, দুটি কাছাকাছি ঠিকানায়।

সুন্দরবনে আজকাল অনেক বাঘ ধরা পড়ছে, তাদের ঘুমপাড়ানি বন্দুক দিয়ে অজ্ঞান করা হচ্ছে। এ অবস্থায় তাদের গা থেকে তুলো ঘষে রাসায়নিক দ্রবণের গন্ধের নমুনা সংগ্রহ করা সম্ভব। কিন্তু এদেশে লালফিতার ফাঁসে এ কাজ করা দুঃসাধ্য। তবুও একটি বাঘ আর একটি বাঘিনীর থেকে নমুনা সংগ্রহ করা গেছে। দুটি নমুনাতেই ধরা পড়েছে কতগুলি বড়ো ফ্যাটি অ্যাসিড অণুর অস্তিত্ব। (এগুলি methyl ester অবস্থায় আছে) শুধু এই অণুগুলির জন্য একটা মৃদু গন্ধ থাকার কথা, সেটা সুগন্ধও নয়, কিন্তু উৎকট দুর্গন্ধও নয়। (তবে আরও অনেক অণু আমরা সম্ভবত ধরতে পারিনি।)

 

মস্ত হাতির টুকিটাকি— কমবয়সি মদ্দা হাতিরা মাঝে মাঝে কামোন্মত্ত হয়ে পড়ে। কিছু বিশেষজ্ঞ আছেন যাঁরা মনে করেন, অন্যান্য ঋতুর তুলনায় শীতকালেই এই ঘটনা ঘটে বেশি। উত্তরপ্রদেশের তরাইয়ের বনাঞ্চলে আমি কিন্তু মে মাসে হাতিদের মস্ত অবস্থায় দেখেছি।

একটি হাতি যখন মস্ত অবস্থায় পৌঁছোয় তখন তার রগের দু-পাশে অবস্থিত দুটি ক্ষুদ্র রন্ধ্র থেকে বার হতে থাকে এক ধরনের রস, এরই নাম হল মদ বা মস্তস্রাব। প্রায় এক সেন্টিমিটার লম্বা এই রন্ধ্রগুলি হয় একটু ট্যারচা। সাধারণত রন্ধ্রগুলি বোজা থাকে, তাই দেখতে পাওয়া যায় না। মস্ত অবস্থায় রগ ফুলে উঠলে রন্ধ্রগুলি দেখা যায় এবং সেখান থেকে বার হতে থাকে মস্ত স্রাব।

এই রন্ধ্র স্ত্রী-পুরুষ উভয়েরই থাকে। কিন্তু মস্ত স্রাব কেবল পুরুষদেরই বার হয়। প্রাচীন কিছু লেখায় বলা হয়েছে যে সদ্য বন্দি মাদি হাতির রগ থেকে মস্ত স্রাব গড়িয়ে পড়তে দেখা গেছে। পোষা মাদির ক্ষেত্রে এইরকম ঘটনা কখনো লক্ষ করা যায়নি। প্রাচীন কিছু হাতিপালক এই রসকে মদ না বলে মল (শরীরের বর্জ্য) বলে চিহ্নিত করেন। শরীরের বর্জ্য দুর্গন্ধ যুক্ত হয় কিন্তু মস্ত স্রাবের গন্ধ বেশ ভালো। কামোত্তেজনার সময়ে মাদি হাতিদের কখনোই খেপার মতো ব্যবহার করতে দেখা যায় না। কিন্তু মদ্দাদের কাণ্ডজ্ঞান তো থাকেই না, তার উপর এই সময় তারা হয়ে ওঠে ভয়ংকর। এইরকম সময় সামাল দেওয়ার জন্যই সার্কাস কিংবা চিড়িয়াখানার মদ্দাদের সঙ্গে মাদিদেরও রাখা হয়।

মস্ত স্রাব বেশ ঘন, তেলতেল, গাঢ় বাদামি রঙের আর তীব্র গন্ধযুক্ত। মধ্যবয়স্ক কিংবা বয়স্ক হাতিদের ক্ষেত্রে এর রং হয় প্রায় কালো আর অল্পবয়সিদের ক্ষেত্রে সাধারণত বাদামি। রস বার হওয়ার পরিমাণ অল্প হবে কিম্বা বেশি তা নির্ভর করে হাতির স্বাস্থ্য এবং বয়সের উপর।

প্রথম ক্ষরণ শুরু হয় পনেরো বছর বয়সের কাছাকাছি সময়ে। কিন্তু সেই সময় এর পরিমাণ হয় এতই অল্প যে গড়িয়ে বড়োজোর ২৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত নামতে পারে। পঁয়ত্রিশ বছর পর্যন্ত খুব বেশি ক্ষরণ হয় না আর আচরণেও প্রভাব পড়ে অল্পই। পঁয়ত্রিশ থেকে পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সের মধ্যে খুব বেশি স্রাব বার হওয়া শুরু হয়। এই সময় ক্ষরণ এতটাই বেশি হয় যে হাতির মুখের দু-দিকই যায় ভিজে, কখনো কখনো আবার মুখ থেকে ফোঁটা ফোঁটা গড়িয়ে মাটিতেও ঝরে পড়তে থাকে। এই সময় হাতি পূর্ণ মস্ত হয়। এরা রেগে উঠলে ক্ষরণের পরিমাণ যায় বেড়ে। বাল্মীকি ভালো জাতের হাতির বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেছেন, পর্বতের মতো বিশাল আর শক্তিশালী, মদমত্ত, রগের দু-পাশ থেকে ঝরে পড়ে মস্ত স্রাব। যে হাতির মস্ত স্রাব বার হয় না তাকে মনে করা হয় অশুভ। এই স্রাবের গন্ধ খুবই তীব্র। অভিজ্ঞ লোক এই গন্ধ শুঁকেই বলে দিতে পারেন কাছাকাছি কোন মস্ত হাতি আছে। হাতি যাঁরা পোষেন তাঁদের অনেকেরই এই গন্ধ খুব বেশি তীব্র বলে মনে হয়। সংস্কৃত গ্রন্থে এই স্রাবকে দুর্গন্ধ যুক্ত বলা হয়নি। কিরাতার্জুনীয়ম-এ বলা হয়েছে এর গন্ধ সপ্তপর্ণ কিংবা এলাচ ফুলের মতো।

জীববিজ্ঞানীরা মনে করেন রগের দু-পাশে অবস্থিত গ্রন্থি থেকেই মস্ত স্রাবের ক্ষরণ হয়। হাতি যখন মস্ত হয়ে পড়ে তখন এই গ্রন্থিগুলি বড়ো হয়ে ওঠে আর সেইসঙ্গে তাদের রগ ফুলে উঠে দপ দপ করতে থাকে।

প্রায় চল্লিশ দিন ধরে চলে এই ক্ষরণ। প্রথম কয়েকদিন বার হওয়ার পরিমাণ থাকে অল্প, তারপর ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে, মাঝামাঝি সময়ে পৌঁছে সব থেকে বেশি হয় আর একেবারে শেষ পর্যায়ে গিয়ে কমতে কমতে শুকিয়ে আসে। ঘন ঘন প্রস্রাব পাওয়া এই সময়ের একটি লক্ষণ। দেখলে মনে হয় হাতি যেন সবসময়ই প্রস্রাব করছে। এই সময়ে প্রস্রাবে থাকে তীব্র গন্ধ আর রং হয় গাঢ় হলুদ। প্রস্রাবের এই গন্ধের সঙ্গে মস্ত স্রাবের গন্ধের কিছুটা সাযুজ্য পাওয়া যায়।

বাহ্যিক এই পরিবর্তনগুলি ছাড়াও প্রাণীটির মেজাজ আর আচার-আচরণেও পরিবর্তন ঘটে। দ্বিতীয় পরিবর্তনগুলি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। মস্ত স্রাব বার হওয়ার প্রায় চল্লিশ দিন আগে থেকেই হাতির ব্যবহারে পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। ক্ষরণ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরেও আরও চল্লিশ দিন এর প্রভাব থাকে। মস্ত অবস্থা চলে প্রায় ১২০ দিন। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ বলেন এই অবস্থা চলতে পারে কয়েক দিন, কয়েক সপ্তাহ থেকে পাঁচ মাস পর্যন্ত, হাতির বয়স এবং শারীরিক অবস্থার উপর নির্ভর করে সময়টা।

হাতির মস্ত স্রাব ক্ষরণ শুরুর আগের অবস্থাকে কালিদাস বলেছেন 'অন্তরমদাবস্থা' কিংবা প্রাক মস্ত অবস্থা। রাজা দিলীপ সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, 'রাজকীয় আভরণ ত্যাগ করলেও তাঁর সুগঠিত দেহ ও মুখের ভাবই রাজোচিত মর্যাদার পরিচায়ক। হাতির কপালে মস্তস্রাব না গড়ালেও তার মস্ত অবস্থা বুঝতে যেমন অসুবিধা হয় না, এ ক্ষেত্রেও তেমনি।'

অভিজ্ঞ প্রতিপালকেরা হাতির ক্ষরণ শুরু হওয়ার আগেই তাদের মস্ত অবস্থার পূর্বাভাস দিতে পারেন। তাদের চোখের চাহুনিতেই তখন বদল ঘটে যায়। দেখা দেয় আদেশ অগ্রাহ্য করার একটা প্রবণতা। হাবভাব হয়ে পড়ে খেপার মতো। এই সময় তার কাজকর্ম আর প্রতিক্রিয়া হয়ে ওঠে স্বাভাবিক অবস্থার থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন।

এইরকম সময়ে হাতিও আদেশ হয়তো শোনে তবে খুশিমনে নয় আর সবসময় তো নয়ই। সব কিছু নির্ভর করে তার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার উপর। সব থেকে বাধ্য এবং শান্ত হাতি অনেক সময় দেখা যায় মাহুতের কথা অগ্রাহ্য করছে। এমনিতে মস্ত হাতিমাত্রই ভয়ংকর কিংবা তারা আক্রমণ করে বসবে এ-রকম নয় তবে কোনো কারণে চটে গেলে সে তখন সব কিছুই করে বসতে পারে।

মস্ত অবস্থায় যখন কোনো মদ্দা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় কিংবা খেপে ওঠে তখন সে মানুষকে প্রাণে মারতে পারে, সম্পত্তি ধ্বংস করতে পারে। এইসব সময় তাকে গুলি করে মারা ছাড়া অন্য কোনো পথ খোলা থাকে না। মানুষের স্বভাব হল কামোন্মাদ হাতিমাত্রই তাকে খ্যাপা বলে চিহ্নিত করা। হাতির উন্মত্ত অবস্থা সম্পূর্ণ পৃথক। পোষা হাতির ক্ষেত্রে কামোত্তেজনা পাগলামির জন্ম দিতে পারে। তাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করলেও তারা খেপে ওঠে।

মস্ত ক্ষরণ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হাতি অবাধ্য আর জেদি হয়ে পড়ে। সবাইকেই সে অপছন্দ করতে থাকে। এমনকি যারা তার খুব কাছের এবং যাদের উপর সে নির্ভর করে তাদের দেখলেও তার হতে থাকে রাগ। প্রথম চোটটা পড়ে যারা তার গা ধুইয়ে তার লোম আঁচড়ে দেয় তাদের উপর। খুবই আশ্চর্যের বিষয় হল এই সময় হাতি কোনো একজন মাহুতের কথা শোনে। এমনকী সে তার অপরিচিত হলেও। অন্য কোনো ভাবে যখন আর নিয়ন্ত্রণ করা যায় না তখন অনেক সময় কামোন্মত্ত হাতিদের বাইরে থেকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য মাহুতদের সাহায্য চাওয়া হয়। হাতি যদি ছাড়া থাকে তাহলে তাকে ভুলিয়েভালিয়ে কিম্বা তর্জনগর্জন করে শিকল পরতে বাধ্য করা হয়। ন-মিটার লম্বা দুটি শিকল তার সামনের আর পিছনের পায়ে আটকে দেওয়া হয়।

অভিজ্ঞ মাহুতেরা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আগেই হাতিদের বেঁধে ফেলেন। সেই সময় তাদের রাখা হয় খোঁয়াড়ে। কমিয়ে দেওয়া হয় খাবারের পরিমাণ। খাবারের সঙ্গে অনেক সময় মেশানো হয় কোনো ঘুমপাড়ানি কিছু। আগেকার দিনের মাহুতেরা একতাল ময়দার মধ্যে আফিম মিশিয়ে হাতিদের খাওয়াতেন। আজকের দিনে তাঁরা বেশি নির্ভর করেন ব্রোমাইডের উপর, যথেষ্ট বেশি পরিমাণে যা হাতিদের খাওয়ানো হয়। তামাকও এই ব্যাপারে কিছুটা সাহায্য করতে পারে। ৪৫০ গ্রাম নস্যি হাতিকে প্রত্যেকদিন খাওয়ালে আশা করা হয় সে আর বাড়াবাড়ি করবে না। বাল্টিমোর পার্কে হাতিদের নিয়ম করে প্রত্যেকদিন নস্যি খাওয়ানো হয়।

মস্ত স্রাবের কারণে যতদিন না হাতিদের মেজাজ ঠান্ডা হচ্ছে ততদিন তাদের খাবার দূর থেকে দেওয়া হয় ছুড়ে। তিন-চার মাস তাদের দিয়ে কোনো কাজ করানো হয় না। ক্ষরণ শুরু হওয়ার প্রথম দিকে অবশ্য তাদের দিয়ে কিছু কাজ করানো চলতে পারে।

জঙ্গলে মস্ত হাতিরা সাধারণত একা একা ঘুরে বেড়ায় না। বেশির ভাগ সময়েই তাদের পালের সঙ্গে দেখা যায়। কখনো কখনো নিজেকে পালের থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিলেও খুব একটা দূরে সে চলে যায় না। মস্ত অবস্থায় হাতি অসম্ভব শক্তিশালী হয়ে ওঠে, এমনকী অন্য মদ্দরাও সেই সময় তার কাছে ঘেঁষতে ভয় পায়।

পুরোনো দিনের মাহুতেরা মস্ত হাসি সম্পর্কে বহু কিছু বলেছেন। এঁদের বক্তব্য হল মস্ত স্রাব হচ্ছে মস্তিষ্কের ক্ষরণ। এই ক্ষরণ যখন আরম্ভ হয় সেই সময় হাতির মস্তিষ্কে বিকৃতি ঘটে। তাঁরা মনে করেন, এই অবস্থার সঙ্গে যৌন উত্তেজনার একটি ঘনিষ্ঠ যোগ আছে। মস্ত মদ্দা যদি তার যৌন মিলনেচ্ছাকে চল্লিশ দিন দমন করতে পারে তাহলে সে তার নিয়ন্ত্রণ হারাবে না। যাই হোক না কেন এই অবস্থার সঠিক কার্যকারণ কিংবা বয়ঃপ্রাপ্ত জীবটির জননেন্দ্রিয়ের সঙ্গে এর যোগ অথবা সাধারণভাবে যৌন উত্তেজনার সঙ্গে এর সম্পর্ক এসবের কিছুই এখনও পর্যন্ত পুরোপুরি বিশ্লেষণ করা যায়নি।

সম্প্রতিকালের মধ্যে কামোন্মত্ত অবস্থায় হাতি পালিয়ে যাওয়ার এইরকম একটি দৃষ্টান্ত হল উদয়গিরি নামে হাতিটির কাহিনি। এই মদ্দা হাতিটি ছিল রাষ্ট্রপতির আস্তাবলের সদস্য। উৎসবের সময় তাকে অংশগ্রহণ করতে নিয়ে যাওয়া হত। অসমের জঙ্গলে মাত্র আট বছর বয়সে সে প্রথম ধরা পড়ে। তারপর কাজিরাঙার বিখ্যাত হাতি আকবরকে যেভাবে তালিম দেওয়া হয়েছিল একেও সেইভাবে যত্ন নিয়ে শেখানো হয়। ১৯৫৪ তে তাকে রাষ্ট্রপতির বাসভবনে পাঠানো হয়। ১৯৫৬ সালে একটি শোভাযাত্রায় নেতৃত্ব দেওয়ার সময় সে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে। তার নিউমোনিয়া হয়েছিল। পরের বছর একজন পরিচারক উদয়গিরিকে শিকল পরাতে গেলে সে তাকে পিষে ফেলে। এই ঘটনার পরেই উদয়গিরিকে খাবার দেওয়া হলে সে সঙ্গেসঙ্গে খেতে শুরু করে ও শান্ত হয়ে যায়।

উদয়গিরির দেহে মস্ত রস ক্ষরণের লক্ষণ দেখা দেওয়ায় তাকে বেঁধে রাখা হয়। তারপর যখন মনে হয় যে সে ওই অবস্থা কাটিয়ে উঠেছে তখন খুলে দেওয়া হয় হাতিটিকে। এই সময় একদিন তাকে হাঁটাতে নিয়ে গেলে সে হঠাৎই খেপে ওঠে ও রাস্তা দিয়ে যাওয়া সেনাবাহিনীর একটি গাড়িকে ধাওয়া করে। তারপরেই সে ধেয়ে যায় এক পথচারীর দিকে। লোকটি কোনো মতে একটি বাড়িতে ঢুকে অল্পের জন্য রক্ষা পায়। অসীম সাহসের সঙ্গে তিন ঘণ্টা ধরে মাহুত সমানে চেষ্টা করে হাতিটিকে বাগ মানানোর। সব চেষ্টাই ব্যর্থ হলে সে হাতিটির পিঠ থেকে লাফিয়ে একটি বাড়ির ছাদের উপর চড়ে যায়। শেষ পর্যন্ত হাতিটিকে গুলি করে মারা ছাড়া আর কোনো রাস্তা খোলা ছিল না।

উদয়গিরি এসেছিল অসমের জঙ্গল থেকে। দিল্লির সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিবেশে সে মানিয়ে নিতে পারেনি। এর আগে তার দিল্লির তীব্র ঠান্ডা, প্রচণ্ড গরম আর দীর্ঘ খরা মরসুমের কোনো অভিজ্ঞতাই ছিল না। ১৯৫৬-র গরমের সময় তাকে দেরাদুনে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। পরের বছরও দেরাদুনে যাওয়ার আগেই তার জীবন শেষ হয়ে যায়।

মত্ত অবস্থায় একটি হাতির অভাবনীয় শক্তির প্রকাশ ঘটে। ১৯৬৩-র ২৫ ডিসেম্বর কাগজে একটি খবর প্রকাশিত হয়। আরার কাছে জগদীশপুরে একটি হাতি, বাচ্চারা যেমন খেলনা নিয়ে খেলে, সেইরকম অনায়াসে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা একটি গাড়ি শুঁড়ে জড়িয়ে শূন্যে ছুড়ে দেয়। গাড়িটি গিয়ে পড়ে একটি বাড়ির চালে। ভাগ্য ভালো বলতে হবে যে চালক সেই সময় গাড়ির মধ্যে ছিল না। হাতিটিকে আসতে দেখেই সে গাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যায়। বহু চেষ্টার পর শেষপর্যন্ত মাহুত হাতিটিকে কবজা করতে পারে।

 

ভারতের হস্তী ধরা

খেদা— শিকারিদের কতক অশ্বপৃষ্ঠে এবং কতক পদব্রজে বনের মধ্যে প্রবেশ করে। গ্রীষ্মকালই হস্তী ধরিবার উপযুক্ত সময়। যে স্থানে হস্তী বিচরণ করে, সেই স্থানে শিকারিরা উপস্থিত হইয়া ঢোল এবং ভেঁপু বাজাইতে থাকে। ঢোল ও ভেঁপুর শব্দে, হস্তীযূথ ভীত ও বিচলিত হইয়া পড়ে। তখন তাহারা ইতস্তত দৌড়াদৌড়ি করিয়া বেড়ায়। এইরূপ দৌড়াদৌড়ি করিয়া, শরীরের ভারে ক্রমে তাহারা ক্লান্ত হইয়া পড়ে; তৎপরে নিকটস্থ বৃক্ষের ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণ করে। তখন পাকা শিকারিরা বৃক্ষছাল বা পাটের তৈয়ারি দড়ি হস্তীর গলায় বা পায়ে বাঁধিয়া দেয়। পরে পালিত ও শিক্ষিত হস্তী দ্বারা সেই সমস্ত বন্যহস্তী প্রলোভিত হইয়া ক্রমে মনুষ্যের বশীভূত হয়। একটা হাতির যত দাম, শিকারিরা তাহার সিকি পারিশ্রমিক প্রাপ্ত হয়।

চোরখেদা— যেখানে বন্য হস্তীযূথ বিচরণ করে, শিকারিরা সেখানে একটি পোষা হস্তিনী লইয়া যায়। মাহুত সেই হস্তিনীর পৃষ্ঠে নীরবে মৃতবৎ শয়ন করিয়া থাকে। হস্তিনীর পৃষ্ঠে যে কোনো মানুষ আছে, তাহা জানিবার জো নাই। হস্তীরা হস্তিনীকে দেখিয়া, আপনাআপনি লড়াই করিতে থাকে। ইত্যবসরে মাহুত, হস্তীর পায়ে দড়ি বাঁধিয়া দেয়। শ্যামদেশে এই প্রথায় হস্তী ধৃত হইয়া থাকে।

গাদ— যেখানে হস্তীযূথ সচরাচর বিচরণ করে, সেই স্থানে একটি গর্ত খুঁড়িয়া রাখা হয়। এই গর্ত ঘাসে পরিপূর্ণ থাকে। শিকারিরা অদূরে ঝোপের মধ্যে লুকাইয়া রহে। হস্তীর দল সেই গর্তের নিকট উপস্থিত হইলে, শিকারিরা ঝোপের মধ্য হইতে শব্দ করিতে আরম্ভ করে। হস্তীগণ তখন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হইয়া, অসাবধানে দৌড়াদৌড়ি করিয়া বেড়ায়, ক্রমে একটা-না-একটা সেই গর্তের ভিতর পড়িয়া যায় এবং উচ্চৈঃস্বরে চিৎকার করিতে থাকে। গর্তের ভিতর যিনি পড়িলেন, তিনিই গেলেন। তাহাকে জল বা কোনোরকম খাদ্য দেওয়া হয় না, কাজেই ক্রমে সে বশে আসে।

বার— যে স্থানে হস্তীর দল বিশ্রাম করে, সেইখানে শিকারিরা একটা প্রকাণ্ড গর্ত খনন করে। সেই গর্তের একদিকে একটা পথ থাকে, পথের মুখেই একটি দরজা বসাইতে হয়। দরজা দড়ি দিয়া বাঁধা থাকে। দড়িটি কাটিয়া দিলেই দরজা বন্ধ হইয়া যায়। দরজার নিকট হস্তীর খাদ্যও নানাবিধ থাকে। হস্তীযূথ সেই সকল খাদ্য খাইতে আরম্ভ করে। ক্রমে খাদ্যের লোভে বে-সামাল হইয়া দরজার ভিতর প্রবেশ করে। শিকারিরা তখনই দড়ি কাটিয়া দেয়। অমনই দরজা বন্ধ হইয়া যায়। হস্তীযূথ তখন বিকট চিৎকারে দরজা ভাঙিবার চেষ্টায় থাকে। শিকারিরাও তখন আগুন জ্বালিয়া বাদ্য-বাজনা করে। হস্তীরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হইয়া পড়ে। ক্রমে তাহারা দৌড়াদৌড়ি করিয়া ক্লান্ত হইয়া পড়ে। সেই সময় হস্তিনী আনিয়া ছাড়িয়া দেওয়া হয়। শিক্ষিত হস্তিনীর মোহন ফাঁদে পড়িয়া, হস্তীযূথ আপন অবস্থা ভুলিয়া যায়। সেই সুযোগে শিকারিরা, তাহাদিগকে ধরিয়া পেলে। ক্রমেই সেই মত্ত মাতঙ্গ, মানুষের করায়ত্ত ও বশীভূত হয়।

মোগল সম্রাট আকবরের পূর্বে এই চারি প্রথার যেকোনো প্রথায় হস্তী ধৃত হইত। আকবর একটি কৌশল উদ্ভাবিত করেন। সেই কৌশল এই; বন্য হস্তীযূথের তিনদিকে হস্তীচালকগণ ঘেরিয়া রহিত; একদিক খোলা থাকিত। এই দিকে বহু সংখ্যক হস্তিনী রাখিয়া দেওয়া হইত। চারিদিক হইতে, বন্য হস্তী সকল আসিয়া হস্তিনীদিগকে ঘেরিয়া দাঁড়াইত। হস্তিনীরা তখন একটি রক্ষিত স্থানে যাইত; হস্তীরাও তাহাদের পশ্চাদবর্তী হইত। তাহার পর তাহারা উপরোক্ত উপায় ধৃত হইত। এখন হস্তী ধরিবার নানা কৌশল প্রচলিত আছে।

ভারতের নানা স্থানে হস্তী ধৃত হইয়া থাকে। এখন কিন্তু আর পূর্বের মতন হস্তী পাওয়া যায় না। ১৮৬৮ সালে মাদ্রাজ গবর্নমেন্ট হস্তিনী সংগ্রহ করিতে আরম্ভ করেন। এ কার্যে নেপাল গবর্নমেন্টের অনেক আয় হয়। সিংহলে এখনও অনেক হস্তী ধৃত হইয়া থাকে। আসামেও হস্তী ধৃত হয়। সিংহলের হস্তীরা বড়ো দুর্ধর্ষ। তাহারা সময়ে সময়ে কর্ষিত ক্ষেত্রে উপস্থিত হইয়া, ক্ষেত্রের সমগ্র ফসলাদি নষ্ট করিয়া ফেলে। এইজন্য সিংহল গবর্নমেন্ট হাতি মারিবার জন্য পুরস্কারের ব্যবস্থা করেন। কর্ত,পক্ষের নিকট একটি লাঙ্গুল আনিলেই চারি টাকা পুরস্কার। একবার ছয়শত হস্তী মারিবার জন্য গবর্নমেন্টকে হাজার টাকা পুরস্কার দিতে হইয়াছিল। শিকারিরা হস্তীর সম্মুখবর্তী হইয়া গুলি করে। গুলি কপাল ভেদ করিয়া মস্তিষ্কে প্রবেশ করিলে মৃত্যু নিশ্চিত। এতদব্যতীত কর্ণের পশ্চাদ্ভাগে গুলি করিতে হয়।

সকল অধ্যায়

১. সুন্দরবনের শেষপ্রান্তে
২. শিকারের সন্ধানে
৩. নির্ভীক
৪. শিকারীর ক্ষোভ
৫. শিকারীর ভয়াবহ অভিজ্ঞতা
৬. বিপর্যয়
৭. হাওদা শিকার
৮. হাওদায় বসিয়া শিকার
৯. শিকারের কথা
১০. একদন্তের শেষ
১১. প্যান্থার
১২. মাচা থেকে চিতা ও অন্যান্য
১৩. জঙ্গলের ভ্রূকুটি
১৪. মহিষ
১৫. বীভৎস
১৬. কুমীর শিকার
১৭. হিমালয়ে ভল্লুক শিকার
১৮. কোয়াড়ে ভালুক শিকার
১৯. ভালুকের কবলে
২০. বাজ-বহেরী
২১. পদ্মায় পক্ষী শিকার
২২. পরিশিষ্ট
২৩. শিকারের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম
২৪. শিকার, শিকারী ও জীবজন্তু সম্বন্ধে বিবিধ জ্ঞাতব্য তথ্য
২৫. বন্দুক, বন্দুকের প্রকার ও ব্যবহার সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞাতব্য তথ্য
২৬. বাঙালির শিকারের আগ্নেয়াস্ত্র
২৭. ভারতের ব্যাঘ্র প্রকল্প
২৮. সহায়ক বাংলা পুস্তক তালিকা

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন