শিকারীর ভয়াবহ অভিজ্ঞতা

বিশ্বদেব গঙ্গোপাধ্যায়

দুর্গাপ্রসাদ রায়

 

জলপাইগুড়ির চা-বাগান অঞ্চলে ডুয়ার্সে প্রচুর শিকার পাওয়া যায়। বাঘ, ভালুক, গণ্ডার, বাইসন, হাতী, মহিষ ইত্যাদি হিংস্র জন্তু— আবার হরিণ, সম্বর প্রভৃতি নিরীহ জন্তুতেও ইহার জঙ্গলগুলি পরিপূর্ণ। গণ্ডার, বাইসন, মহিষ, হাতী— ইহারা রক্ষিত জন্তু পর্যায়ে পড়ে। কারণ, অনাবশ্যক হত্যার ফলে ইহাদের সংখ্যা প্রায় লোপ পাইতে বসিয়াছিল। সুখের বিষয় এই যে, এখন ইহারা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাইতেছে। আমাদের এই অঞ্চলে শিকারীর অভাব নাই, ভাল শিকারীও অনেক আছেন। চা-বাগানের জনৈক সাহেব এবং স্থানীয় শিকারীগণ মিলিত হইয়া প্রায় রবিবারেই শিকারে বাহির হন এবং অনেক শূকর, চিতাবাঘ এবং কখনো কখনো দু-একটি বাঘও মারা পড়িয়া থাকে।

একবার ২৫ শে এপ্রিল রবিবার এমনি একটি শিকারের দিন ঠিক হইয়াছিল। আমাদেরই বন্ধুমহলের চা-বাগানের কয়েকজন অ্যাসিসটেন্ট ম্যানেজার সাহেব এবং আমরা কয়েকজন বাঙ্গালী শিকারে যাইব স্থির হয়। ধূপগুড়ির নিকটবর্তী জঙ্গল সংলগ্ন একটি গ্রামের পাশে ইহার পূর্বের রবিবারে বিট করায় কয়েকটি শূকর মারা পড়ে, সুতরাং এই রবিবারেও এ জায়গায় যাওয়া সাব্যস্ত হয় এবং তদনুসারে প্রায় একশত কুলী গাড়ি করিয়া পাঠান হয়। কুলীদের এই শিকারে সর্বাপেক্ষা বেশী উৎসাহ। প্রথমতঃ, ইহারা স্বভাব সাহসী ও শিকার প্রিয় এবং দ্বিতীয়তঃ, শূকর মাংস ইহাদের অতীব প্রিয় খাদ্য সুতরাং খবর পাইলেই ইহারা প্রস্তুত হইয়া পড়ে এবং প্রাতঃকাল হইতে সন্ধ্যা পর্যন্ত জঙ্গল তাড়াইয়া বেড়াইতে বিন্দুমাত্রও ক্লান্তি বা নিরুৎসাহ বোধ করে না। সেবার আমাদের দলে প্রায় আটজন শিকারী ছিল, সুতরাং একটা বড় রকম জঙ্গলের অংশ বাছিয়া লইয়া প্রায় একশ' হাত পর পর আটজন শিকারী বন্দুক লইয়া দাঁড়াইবার পর বিট শুরু হইল। বহুদূর হইতে চীৎকার করিয়া ও টিন পিটাইয়া কুলীর দল শিকারীদের সম্মুখ দিকে আগাইয়া আসিতেছে, কোন জানোয়ার থাকিলে সাধারণতঃ ভয়ে শিকারীদের সম্মুখ দিয়া পালাইতে যাইয়া মারা পড়িবে তাই এইরূপ ব্যবস্থা। যাহা হউক, এমন সময় দূর হইতে ইশারায় কুলীরা জানাইয়া দিল যে, সম্ভবতঃ বাঘ বিটে আছে এবং আমাদের বন্ধু 'হ' যেখানে দাঁড়াইয়া আছে, খুব সম্ভব সেই দিকেই বাঘ যাইবে। তদনুসারে 'হ' প্রস্তুত হইয়া রহিল। বাঘ ঐ পথেই আসিতেছিল এবং অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই খুব সুবিধাজনক স্থানে আসিয়া পড়িত, কিন্তু হঠাৎ লাইনের অপর প্রান্তে বন্দুকের শব্দ হওয়ায় বাঘ সামান্য ঘুরিয়া 'হ'-এর প্রায় কাছাকাছি আসিয়া পড়িল এবং বন্দুকের শব্দ শুনামাত্রই চঞ্চল এবং কথঞ্চিৎ ক্রোধান্বিত হইল তাহা বলাই বাহুল্য। যখন প্রায় ৬।৭ গজ দূরে বাঘ দেখা গেল, 'হ' তখন গুলি ছুঁড়িলেন। গুলিটি যদিও বাঘের গলার নীচের দিকে লাগিয়াছিল, কিন্তু বিশেষ আহত করিতে পারে নাই। কারণ 'হ'-এর রাইফেলটি ছিল .৩৭৫ বোর ম্যানলিকার। এই জাতীয় রাইফেল দূরপাল্লায় সূক্ষ্ম নিশানা মারিবার পক্ষে খুবই উপযোগী, কিন্তু ব্যাঘ্র প্রভৃতি হিংস্র জন্তুকে আঘাত করিয়া সঙ্গে সঙ্গে ধরাশায়ী করিবার ক্ষমতা ইহার নাই, অবশ্য অদৃষ্টক্রমে যদি বাঘের মস্তিষ্ক বা চক্ষু ভেদ করে তবে স্বতন্ত্র কথা। .৩৭৫ কেন ২২ বোরের বন্দুকের গুলি যদি কোনপ্রকারে যে-কোন হিংস্র বলশালী জন্তুর মস্তিষ্কে প্রবেশ করে, তাহা হইলে তাহার তৎক্ষণাৎ মৃত্যু হইবে, এক পা-ও অগ্রসর হইবার ক্ষমতা থাকিবে না, কিন্তু এরূপ অস্বাভাবিক সৌভাগ্য শিকারীর ভাগ্যে কদাচিৎ ঘটিয়া থাকে। গুলি লইয়াই বাঘটি ডিগবাজী খাইয়া পড়ে, কিন্তু পরমুহূর্তেই সামলাইয়া উঠিয়া চক্ষের নিমেষে 'হ'-এর উপর ঝাঁপাইয়া পড়ে। বাঘটা খুব বড় নয়, সবেমাত্র যৌবনের সীমায় পৌঁছিয়াছে, আট ফুটের কিঞ্চিৎ উপর। একে বাঘের ৩০০।৩৫০ পাউণ্ড ওজন তার উপর প্রচণ্ড ধাক্কার সহিত উপরে পড়ায় 'হ' চিৎ হইয়া মাটিতে পড়ে। হাতের বন্দুক ছিটকাইয়া পড়িয়া যায়। 'হ'-এর পরবর্তী শিকারী 'বি. জি' বেশী দূরে ছিলেন না এবং এই ব্যাপার দেখিয়াই তিনি দৌড়াইয়া আসেন এবং তাঁহার দোনলা 'শট-গান'-এর দুইটি গুলিই প্রায় এক সঙ্গে বাঘের পাঁজরে নিশানা করিয়া মারেন। কিন্তু হিংস্র জন্তুদের ক্রোধ ও জিঘাংসা অনেক সময় দৈহিক যন্ত্রণার ঊর্ধ্বে উঠিয়া যায় এবং এ ক্ষেত্রেও তাহাই ঘটিল। বাঘ 'হ'-কে ছাড়িয়া এক লাফে 'বি.জি'র উপর পড়িল। 'হ' তখন উত্থানশক্তি রহিত, কারণ ইতিমধ্যেই বাঘ তাহার ডান হাতের উপরের দিক, ঘাড়ের দুই-তিন জায়গায় এবং এক পায়ের কিয়দংশ কামড়াইয়া, মাংস জায়গায় জায়গায় ছিঁড়িয়া ফেলিয়াছে। 'বি. জি' ধাক্কা সামলাইতে না পারিয়া 'হ'-এর পার্শ্বে চিৎ হইয়া পড়িলেন, কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্য এই যে, বাঘ তাহার আসল আততায়ীকে মোটেই ভুলে নাই। সে এবার 'বি. জি'র বুকের উপর বসিয়া 'হ'-এর একখানি পা আবার চিবাইতে শুরু করিল। পরে 'হ'-এর মুখে শুনিলাম যে, বাঘ এক একবার 'হ'-এর পা চিবায় আর প্রচণ্ড গর্জন করে, আর তাহার মুখনিঃসৃত লালায় 'বি. জি'র চোখ মুখ ভরিয়া যায়। ৩৫০ পাউণ্ড বাঘ বুকের উপর বসিয়া গর্জন করিতে থাকিলে কাহারো ভাল লাগার কথা নয়, সুতরাং 'বি. জি'র তখনকার মনের অবস্থা সহজেই অনুমেয়। অতীব সৌভাগ্যের বিষয় এই যে, এ পর্যন্ত বাঘ যদিও প্রায় 'হ'কে পঞ্চাশ জায়গায় কামড়াইয়াছে, কিন্তু তখন পর্যন্ত শুধু মাংস ছিঁড়িয়া ফেলা ছাড়া কোন জায়গায় হাড়ে কামড় দেয় নাই এবং 'বি. জি'কে চড় মারিয়া ফেলিয়া দিয়া তাহার বুকের উপর বসা সত্ত্বেও তার শরীরে কোথাও চোট লাগে নাই, কেবলমাত্র চোখের নীচে একটা সামান্য আঁচড় লাগিয়াছে। দ্বিতীয়বার যখন বাঘ 'হ'-কে কামড়ান আরম্ভ করিল তখন তাহার গর্জন পূর্বাপেক্ষা বাড়িয়াছে এবং 'হ'-এর নিকট পরে শুনিলাম যে, সে তখন প্রাণের আশা ত্যাগ করিয়া ভগবানকে স্মরণ করিয়াছিল।

ঠিক এই সময়ে একটা অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটিল যাহার ফলে— আজ 'হ' জীবিত এবং 'বি.জি' সুস্থ শরীরে পুনরায় শিকার করিয়া বেড়াইতেছে।

বাঘের দ্বিতীয় আক্রমণে যখন 'হ'-এর প্রাণরক্ষার আর কোন আশাই ছিল না, সেই মুহূর্তে কোথা হইতে একটি পোষা মহিষ বিদ্যুৎবেগে ছুটিয়া আসিয়া বাঘটিকে চার্জ করিল এবং অমিতবিক্রমে শিং-এ উঠাইয়া লইয়া প্রায় পঁচিশ গজ দূরে নিক্ষেপ করিল। আশ্চর্য এই যে, পোষা মহিষ বাঘের গন্ধে দড়ি ছিঁড়িয়া পালায়, অবশ্য আক্রান্ত হইয়া নিরুপায় অবস্থায় দুই মিলিয়া বাঘ মারিয়া ফেলিয়াছে, এরূপ গল্প শুনা গিয়াছে, কিন্তু পোষা মহিষ ছুটিয়া আসিয়া মানুষকে বাঁচাবার জন্য বাঘকে আক্রমণ করে, ইহা কখনও শুনি নাই। 'হ'-এর তখন জ্ঞান আছে এবং সে সমস্তই দেখিতে পাইতেছে, কিন্তু চলনশক্তিহীন। 'হ'-এর মুখে শুনিলাম যে, মহিষটি এমনভাবে তাহাকে বাঁচাইয়া বাঘকে স্থানচ্যুত করিল যে, একটু অসাবধান হইলেই মহিষের পদদলিত হইবার সম্ভাবনা ছিল। সর্বাপেক্ষা অদ্ভুত ব্যাপার এই যে, বাঘকে ২৫ গজ দূরে ফেলিয়া আসিয়া, মহিষটি 'হ'-র পার্শ্বে ফিরিয়া আসিল এবং মাথা নীচু করিয়া গর্জন করিতে লাগিল। বাঘ আবার একটু সামলাইয়া লইয়াই, ছুটিয়া আসিয়া মহিষের মাথার উপর পড়িল। মহিষও কিছুক্ষণ ধ্বস্তাধ্বস্তি করিয়া পুনরায় শিং-এ ঠেকাইয়া বাঘকে বহুদূরে ঠেলিয়া লইয়া গেল। এ যাত্রায় মহিষটিও বিশেষরূপে আহত হইল এবং বাঘ মশায়ের শক্তিও প্রায় স্তিমিত হইয়া আসিল। সে তখন নিকটবর্তী জঙ্গলে প্রবেশ করিয়া মাঝে মাঝে গর্জন করিতে লাগিল। এই সমস্ত ঘটনা ঘটিতে চার মিনিটের অধিক সময় লাগে নাই, কারণ বাঘের মুহুর্মুহু গর্জন শুনিয়াই সমস্ত শিকারী সেইদিকে দৌড়াইয়া আসিতে থাকে এবং সকলে পৌঁছাইলে দেখা যায় যে, 'হ' প্রায় অজ্ঞান অবস্থায় পড়িয়া আছে, ক্ষতস্থানগুলি হইতে প্রচুর রক্তপাত হইতেছে। 'বি.জি' কিছু দূরে যাইয়া বসিয়া আছে, তাহার কোন আঘাত লাগে নাই, তবে বাঘের ধাক্কা এবং তৎপরে বুকের উপর বসায় সে কিছুটা আচ্ছন্ন মত হইয়া আছে।

তখন সকলে মিলিয়া সারি ধরিয়া নিকটস্থ ঝোপের দিকে যাইতেই বাঘের প্রচণ্ড গর্জন আরম্ভ হইল এবং অল্পক্ষণ মধ্যেই ঝাঁপাইয়া বাহিরে আসিল। কিন্তু এবার 'এম. সি'র এক গুলিতেই সে ধরাশায়ী হইল। চামড়া ছাড়াইবার পর দেখা গিয়াছিল যে, প্রায় দশ-বারোটি গুলিই তাহার গায়ে লাগিয়াছিল।

তাহার পর তাড়াতাড়ি করিয়া উভয় শিকারীকেই হাসপাতালে পাঠানো হইল। বলা বাহুল্য 'হ' এবং 'বি. জি'র শারীরিক ও মানসিক শক্তি এবং সাহস যে অতুলনীয় ছিল তাতে সন্দেহ নাই।

পোষা মহিষ মানুষকে বাঘের হাত হইতে এইভাবে বাঁচায় এবং ফিরিয়া আসিয়া তাহার কাছে দাঁড়াইয়া পাহারা দেয়, ইহা বুদ্ধির দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায় না।

কুলীরা বলাবলি করিয়াছিল, 'সাহেব, মহিষ তোমার পূর্বজন্মের পিতৃপুরুষ ছিল, তাই তোমাকে ঐভাবে বিপদে রক্ষা করিল।'

(বানান অপরিবর্তিত)

সকল অধ্যায়

১. সুন্দরবনের শেষপ্রান্তে
২. শিকারের সন্ধানে
৩. নির্ভীক
৪. শিকারীর ক্ষোভ
৫. শিকারীর ভয়াবহ অভিজ্ঞতা
৬. বিপর্যয়
৭. হাওদা শিকার
৮. হাওদায় বসিয়া শিকার
৯. শিকারের কথা
১০. একদন্তের শেষ
১১. প্যান্থার
১২. মাচা থেকে চিতা ও অন্যান্য
১৩. জঙ্গলের ভ্রূকুটি
১৪. মহিষ
১৫. বীভৎস
১৬. কুমীর শিকার
১৭. হিমালয়ে ভল্লুক শিকার
১৮. কোয়াড়ে ভালুক শিকার
১৯. ভালুকের কবলে
২০. বাজ-বহেরী
২১. পদ্মায় পক্ষী শিকার
২২. পরিশিষ্ট
২৩. শিকারের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম
২৪. শিকার, শিকারী ও জীবজন্তু সম্বন্ধে বিবিধ জ্ঞাতব্য তথ্য
২৫. বন্দুক, বন্দুকের প্রকার ও ব্যবহার সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞাতব্য তথ্য
২৬. বাঙালির শিকারের আগ্নেয়াস্ত্র
২৭. ভারতের ব্যাঘ্র প্রকল্প
২৮. সহায়ক বাংলা পুস্তক তালিকা

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন