বিশ্বদেব গঙ্গোপাধ্যায়

হীরালাল দাশগুপ্ত
শিকার শেষে ভোরের দিকে যখন জঙ্গল থেকে ফিরছি, তখন চোখ দুটি শ্রান্ত। মনের শ্রান্তিও কম নয়। একটা বাঘের উপরে দু-তিনটে গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছে। আর দু-তিনটে গুলি অন্তত ওর গায়ে লেগেছে। কিন্তু বাঘ খুঁজে আনা সম্ভব হয়নি। মোটরের মাডগার্ডের উপরে যে প্রকাণ্ড জানোয়ারটা মুখ থুবড়ে পড়ে আছে, ওটা একটা শম্বর। দুটো বন-শুয়োর দিয়ে এসেছি জঙ্গলের সাহায্যকারী লোকজনদের খাওয়ার জন্যে।
আমাদের শিকারের প্রথম পাঠ তখনও শেষ হয়নি। শস্ত্রচর্চার এই অধ্যায়ে থাকে প্রবল উৎসাহ আর প্রবলতর উত্তেজনা। নবী আখতার আমাদের অরণ্যের পথপ্রদর্শক, শিকারের পরিচালক এবং সমস্ত ব্যাপারটার ব্যবস্থাপক। কোথায় জানোয়ার পাওয়া যায় তার ঠাঁইঠিকানা ওর জানা আছে। এ ছাড়া মোদিয়া আর পুনোয়া— এই দুই পদাতিক, কখনো-বা ফাগুয়া, বনের নিত্যকার নূতন খবর জুগিয়ে নবী আখতারকে ওয়াকিবহাল করে রাখে। ওরা নবী আখতারের মতোই এই পার্বত্য অঞ্চলের আরণ্যক।
ওদের হালচালে মনে হয়, ওরা কোনো বিস্মৃত যুগে প্রতিদ্বন্দ্বী বাঘের হাতে প্রাণ হারিয়েছিল। মনের কোথায় যেন লুকিয়ে আছে সেই প্রতিহিংসার জ্বালা। তাই শস্ত্রধারী শিকারিকে সঙ্গে নিয়ে তাদের আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় বাঘের গুহাগহ্বর। শার্দূলের মতো নিঃশব্দে ওরা চলে। চলার কৌশলও ওদের আয়ত্তে আছে সেই জানোয়ার-জীবন থেকে। এজন্মে চারটে পা ওদের নেই। পা খসে গিয়ে সেখানে গজিয়েছে দুটো করে হাত।
সকালে ও অপরাহ্নে ওরা পা টিপে টিপে এগুতে থাকে, জঙ্গলের ঝরনার দিকে। মহুয়ার আশেপাশেও থাকে ওদের তীক্ষ্ন নজর। ঝোপের আড়াল থেকে বাঘ ওদের ভ্যাংচালে, ওরা ওই হাত দুটো দিয়ে টপাটপ গাছের উঁচু সরু ডালে চড়ে যায়। বাঘ রক্তচোখে তাকালে ওরাও জবাব দেয় চোখে চোখে। ওদের চোখ থাকে দিনরাত মহুয়ার নেশায় আরক্ত। বাঘকে ওরা ভয় নিশ্চয়ই করে, কিন্তু বাঘও যে ওদের দেখলে ভয় পায় না, এমন নয়। সুযোগ সুবিধা পেলে কেউ কারোর ঘাড় মটকাতে কসুর করে না। বাঘের ঘাড় মটকাতে মোদিয়াদের প্রয়োজন হাতিয়ার-বন্ধ শিকারির। সে-ব্যাপারে নবী আখতার ওদের উপযুক্ত মাধ্যম। শিকারি এসে জোটে নবী আখতারের কাছেই। সে নিজেও অদ্বিতীয় ধনুর্ধর।
তখন শুক্লপক্ষ। এই পক্ষে বাহিরের শিকারির আনাগোনা খুব কম। দৈবাৎ কোনো ভারী 'আমির আদমি' এসে ছাউনি ফেলে। লোকজন জুটিয়ে বাঘ শিকারের জন্য তৈরি করে কয়েকটা মাচা। প্রত্যেক মাচার কাছে ফাঁকাতে রাস্তার মতো জায়গায় বাঁধা হয় জ্যান্ত মোষ। কোনো ছেঁড়া কাপড়, কাগজের টুকরো, গাছের নূতন কাটা কোনো ডাল দেখতে পেলে মানুষের শয়তানি বুঝে নিতে বাঘের বিলম্ব হয় না। আড়াল থেকে বাঘ গাছের ডালে মাচার দিকে তাকিয়ে সরে যায়। হয়তো দূর থেকে মানুষের এই কাপুরুষোচিত ভণ্ডামির জন্যে 'হুম' করে গর্জন করে। বনের জানোয়ারেরা ভয় পেয়ে দূরে পালিয়ে যায়। কিন্তু সন্দেহের কারণ না ঘটলে বাঘ এসে রজুবদ্ধ মোষকে পাকড়াও করে।
তার পরের ব্যাপার অতি সংক্ষিপ্ত। কখনো বাঘ গুলি খেয়ে গড়াগড়ি যায়। হয়তো গুলিলাগা জায়গাটা প্রচণ্ড তেজে কামড়ে ধরে— কল্পিত অপরাধীকে সাজা দিতে। কখনো-বা বিরাট হুংকারে ছুটে যায় আততায়ীর সন্ধানে। নূতন শিকারি হলে এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়ে পাগলের মতো। বাঘ উল্লম্ফনে দৃষ্টিসীমা অতিক্রম করে। বন্দুকের শব্দে ঘুম-ভাঙা পাখি আর্ত চিৎকারে উড়ে যায় অন্য গাছে।
যখন বিষণপুরের পাহাড়চূড়ায় চাঁদ নিবু নিবু হয়, পাণ্ডুর চন্দ্রকলা আবছা মায়াজাল বিছিয়ে দেয় মহুয়াটাঁরে, যখন মহুয়াবীথি মদালস চোখে ঝিমিয়ে পড়ে, তখন কদাচিৎ একটি শিকারি এগিয়ে আসে গোবিন্দপুরের রাস্তা ধরে।
কমলপুরের পাহাড় থেকে বাঁয়ে। মোটর সন্তর্পণে গড়িয়ে চলে মহুয়া বনে। ওখানে মহুয়ার গন্ধে ভালুক আসে। হরিণ আসে। কখনো-বা হরিণের পিছু নিয়ে আসে বাঘ। নবী আখতার ছাড়া সে-বাঘের সন্ধান বড়ো আর কেউ পায় না। ঝরনার ধারে সন্ধ্যা-সকালে বাঘের পায়ের ছাপ পড়েছে কি না, সে-খবর রাখে নবী আখতার। বাহিরের শিকারিরা সে-খবর রাখে না।
কী বিশাল সুদূরবিস্তৃত এই মহুয়াটাঁর! মানুষ নাই, জল নাই, বন্ধুর প্রান্তর। শুধু খাড়া দুটো কান উঁচু করে লাফিয়ে চলে খরগোশ। কখনো চোখে পড়ে, কখনো অদৃশ্য হয় খাদের ভিতরে। প্রান্তরের কোথাও পিঠটা উঁচু হয়ে উঠেছে উটের মতো, কোথাও-বা নীচু। নালা খাদ গহ্বর। এই খাদ না থাকলে এই মহুয়া-লোভী জানোয়ারেরা শিকারির গুলি থেকে বাঁচবে কী করে! একসঙ্গে যে ধরা পড়বে সব গোষ্ঠী-গোত্র।
অসংখ্য মহুয়া তরু— অগণ্য। শত শত হাজার হাজার। চৈত মাসে উপর থেকে সারাদিন টুপটাপ করে ফুল ঝরে। সুগন্ধে ভরে যায় বন উপবন। কামিনী, জুঁই আর মতিয়ার গন্ধ নয়। বাতাবি ফুলের গন্ধও নয়। মিষ্টি গন্ধ। গন্ধে যেন নেশা ধরে। দিনে শোভা, সুবাস। রাত্রের অরণ্য সেই গন্ধে মশগুল। হঠাৎ পাতায় পাতায় বাতাসের শিহরন জাগে। বাতাস বয়ে নিয়ে যায় এই গন্ধ অরণ্য থেকে অরণ্যান্তরে।
আশ্চর্য প্রকৃতি। কোন শিল্পী গড়েছে একে? কার তপস্যা? কার কমল-কোরক-সদৃশ অঙ্গুলি পত্রপল্লবে বুলিয়েছে এই রং, পুষ্পে এই সুরভি? কার খুশির সাধনায় এরা পরেছে এই বেশ— বর্ণ— গন্ধ? কোমল দেহে এমন উপচে-পড়া তৃপ্তি? সবই আশ্চর্য। মহুয়া বনের ভিতর দিয়ে চলতে মনে হয় স্বপ্নলোকের পথিক আমরা। চলার সঙ্গী এই নিঃশব্দ তরুশ্রেণি। বুঝতে পারছি, ওরা সজীব, ওরা জীবন্ত। ওই রূপ, ওই বর্ণ, ওই গন্ধ, ওই মৌন তৃপ্তি— ওই ওদের ভাষা। ওদের আবেদন আসে অন্তরের অতলে।
সেদিন আমাদের ঘোরাফেরায় মহুয়ার নেশার ঘোর কেটে গেছে। এরা আমাদের পায়ে পায়ে চলেছে পথের সঙ্গী রূপে। এগিয়ে গেলে সঙ্গে যায়। পিছে যায় পিছিয়ে গেলে। তখন শিকার খুঁজব, না পাহাড়ের ভালে দেখব পাণ্ডুর চাঁদের টিপ-পরা চন্দ্রচূড়, না পুলকের আসর জমাব স্বপ্নলোকের এই বিহ্বল সাকিদের সঙ্গে!
হঠাৎ মনের ভিতরের হিংস্র জানোয়ারটা জেগে ওঠে বহেরা নবী আখতারের ইংরেজি বুলিতে : 'ব্যাক— ব্যাক!' নবী আখতার শিকার দেখেছে। একচক্ষু চন্দ্রকলা তখন চোখ বুজেছে। মহুয়াটাঁর পেছনে ফেলে এসেছি— সে বহু দূরে। ডাইনে পাহাড়, বাঁয়ে একটা অড়হরের প্রকাণ্ড খেত। অড়হর গাছগুলির এক প্রান্ত কাঁপছে। ওখানেই শিকার। জানোয়ারটা আলো থেকে নিজেকে বাঁচাতে লুকিয়েছে খেতের প্রান্ত থেকে ভিতরের দিকে। কিন্তু শিকারি তাকে ছাড়ে না। টর্চ নিয়ে সন্ধান করছে অড়হরের ফাঁকে ফাঁকে। হঠাৎ চলন্ত মোটরটা লাফিয়ে উঠেছে। মোটরের ভিতর দাঁড়িয়ে ছিলাম। ধাক্কা সামলাতে না পেরে হুড়মুড় করে পড়ে গেলাম। এমনি প্রায়ই ঘটে। কিন্তু মাথার ভিতর তখন ক্ষিপ্ত অজগরটা ফুঁসছে। সামনে বাঁয়ের দিকে ছুটছে একটা প্রকাণ্ড দেহ। রাইফেলটা তুলে ট্রিগার টেনে দিলাম। জানোয়ারটা লাফিয়ে পড়ল। আর উঠল না। ওটা একটা শম্বর। ও মানুষ মারে না। গৃহস্থের ফসল খায়। একপাল শম্বর সাবাড় করে ফেলে, একটা ফসলের খেত, একরাত্রে। দরিদ্র চাষির প্রাণান্ত পরিশ্রমে উৎপন্ন ফসল। সকলে লক্ষ্যভেদের জন্য সাধুবাদ দিলে। আমি খুশি হই না। আমি ভাবি, গুলিটি লেগেছে দৈবাৎ। তবু এমন নিখুঁত নিশানা! একটা বাঘ— নিদেন একটা ভালুক হলেও তো পারত!
সে যাই হোক। এবার আর মহুয়ার নেশা নেই। নেশা জমেছে রক্তের। সুরার চেয়ে তীব্র সে-নেশা। গাড়ি হাঁকাও— 'গো অন।' নবী আখতারের হুকুম। গাড়ি ছুটল পাহাড়ের কোল ঘেঁষে। পাহাড় আঁকাবাঁকা হয়ে ঘুরছে দক্ষিণে। বাঁয়ে কালী পাহাড়ি। ওদিকে প্রস্তরায়িত তর্জনী তুলে পাহাড়টা চলেছে মহাদেওস্থানের অরণ্য লক্ষ করে। মহাদেওস্থান! বড়ো গভীর ও অরণ্য। ওটা শ্বাপদের আলয়। কিন্তু বছরে একরাত ওখানে মহাদেবের ধ্যান ভাঙে। কত যুগযুগান্ত পূর্বের শিলাময় শিব। বছরে এক রাত! অমানিশার অন্ধকারে মিটমিট করে তাকান পূজারিদের পানে প্রসন্ন চোখে। ওখানে পূজার ডালি বয়ে সানুচর আসেন মকসুদপুরের রাজা। প্রদীপ জ্বলে। ডমরু বাজে। কবে কোন পিতৃপুরুষ সুদূর অতীতে স্বপ্নে পেয়েছিল তাঁর আরাধ্য দেবকে এই কণ্টকাকীর্ণ অরণ্যের আঁধারে। আজও তাঁর ডাক আসে শিবচতুর্দশীর অন্ধরাতে। ভুজঙ্গ তাঁকে পথ ছেড়ে দেয়! শার্দূলের চোখ ঝিমিয়ে আসে। ভক্তদের বিনিদ্র রাত কাটে দেবাদিদেবের ধ্যানে। অদূরে শেয়াল ডাকে প্রসাদের আশায়। হায়েনারা ওত পেতে আড়ালে চোখ মিটমিট করে। বিষণপুরের পাহাড়ের বাঁকে ওই প্রস্তর-তর্জনী উদগ্র হয়ে আছে মহাদেওস্থান নির্দেশ করে।
সামনেই আবার বন্ধুর উপত্যকা। কাঁটা-গুল্ম, ঝোপঝাড়, প্রস্তরখণ্ডে সমাকীর্ণ। গা এলিয়ে শুয়ে আছে রাস্তা জুড়ে একটা খুদে পাহাড়। কবে পাহাড় গর্ভে সঞ্চিত সাগর পাথর ভেঙে বেরিয়েছিল দিগবিজয়ে। আরও কাজ ছিল— ঊষর পাহাড়ের রুক্ষতাকে রসধারায় ভিজিয়ে গলিয়ে সেখানে প্রাণসঞ্চার করতে কোটি কোটি জীবাণুর বীজাণুর— আর প্রাণীর। আজ পানীয় জোগাতে তৃষিত বনানীর, তৃষাতুর ফসলের আর জলস্রোত নেই। আজ ওখানে পড়ে আছে ওই পাথুরে কবন্ধ।
আমাদের গাড়ি ওখানে পৌঁছুতেই পাহাড়-সংলগ্ন গভীর নালার ভিতর থেকে বেরিয়েছে একপাল বন্য বরাহ! কী দুর্ধর্ষ এই বরাহ। গায়ে ওদের অসুরের শক্তি। শৌর্যে ও বলিষ্ঠতায় বেপরোয়া। দ্বন্দ্বযুদ্ধে দুর্জয়। কিন্তু আশ্চর্য এই যে এরা নিঃসঙ্গ নয়, যেমন নিঃসঙ্গ বাঘ। বিশেষ ঋতুতে বাঘ ও বাঘিনী একসঙ্গে বিচরণ করে বটে, কিন্তু অধিকাংশ সময়েই এরা একক। অন্য যেকোনো বাঘ তার প্রতিদ্বন্দ্বী। এমনকী তার নিজের শাবকও। কিন্তু এই মহাবলী বরাহ রাত্রে প্রস্তর-কঙ্করময় উপত্যকায় জ্ঞাতি-গোষ্ঠী নিয়ে চলেছে একসঙ্গে। যেমন চলে কুটুম্ব বাড়িতে নিমন্ত্রণ খেতে সমাজবদ্ধ মানুষ!
সেই অন্ধরাতের বিভীষিকা-ভরা অরণ্যে মানুষ ও জানোয়ারের কোথায় যে ঐক্য, সে-গবেষণার মনোবৃত্তি তখন আমাদের ছিল না। ছিল না সে-দৃষ্টি, যে তাকাবে সৃষ্টির আদিম অরণ্যলোকে। তাকিয়ে দেখবে বিবর্তন-পর্যায়ে প্রাণশক্তির তৃতীয় প্রতীক বরাহকে।
মাথায় রক্তের নেশা। হাতে অধীর উদ্যত রাইফেল। সেটা গর্জন করল একটা দাঁতালো শুয়োরকে লক্ষ করে। বন্ধুর লক্ষ্য অপরদিকে। দুটো শুয়োর ছাড়া আর সবগুলো পালিয়ে গেল। মোদিয়া আর পুনোয়ার খুশির শেষ নেই। ওই শুয়োর দুটো কেটে কাল হবে ওদের মহোৎসব। বাজনা বাজবে। মেলা বসে যাবে পুরুষ ও নারীর। তার সঙ্গে চলবে মহুয়া-চোঁয়ানো মদ আর উৎকৃষ্ট বরাহ মাংস।
গাড়িটা অনেকক্ষণ থেমে গেছে। ওরা শুয়োর দুটো কুড়িয়ে একটা নিরাপদ জায়গায় রেখে দিচ্ছে। পরদিন ভোর হতেই মোদিয়াদের দলবল আসবে দড়ি আর বাঁশ নিয়ে।

বাঁয়ে কালী পাহাড়ির গম্বুজাকৃতি চূড়াগুলো নক্ষত্রের আলোয় অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। বিষণপুরের পাহাড়টা আর একবার ডাইনে মোড় ফিরছে। মনে হয়, আমাদের চলার সঙ্গে সঙ্গে ওই প্রস্তরীভূত বিরাট অজগর পার্শ্ব পরিবর্তন করছে। এখনও ডান দিকটা নজরে আসছে না। এতক্ষণ যে জানোয়ারগুলো টগবগ করে বুকের ভিতর ছুটছিল, তাদের গতি মন্থর হয়েছে। তাই এই স্তব্ধরাতের অরণ্যায়তনে বিষণপুর পাহাড়ের শীর্ষদেশের ওই উদ্যত তর্জনী, কালী পাহাড়ি গম্বুজ একাকার করে নিঃশব্দে ভিড় করেছে অন্তরের গভীরে। সেখানে রক্ত নেই, হিংসা নেই, দ্বন্দ্ব নেই, চাঞ্চল্য নেই। আছে অচপল অনিমেষ দাক্ষিণ্য। আশ্চর্য এই মানুষ আর মানুষের হৃদয়! ওখানে লুকিয়ে আছে একটি সুর, একটি অসুর। একজন উদাসী, একজন ভোগী। কিন্তু সেকথা থাক।
গাড়ি আবার ছুটেছে। একটা আলো জ্বলজ্বল করছে পাহাড়ের বাঁকে। এই আলো ধরা পড়েছে নবী আখতারের হস্তধৃত আলো-শিখায়। নবী আখতার বলছে, 'বাঘ— খুব হুঁশিয়ার!'
নবী আখতারের নির্দেশে ড্রাইভার গাড়িটাকে বাগাচ্ছে। শুয়োরের যাতায়াতের রাস্তার ঝোপের বাইরে মুখ রেখে ওত পেতে আছে বাঘ। হঠাৎ বাঘ চোখ বুজেছে অথবা মাথাটা ঘুরিয়েছে। নূতন শিকারি। উত্তেজনার সীমা নেই। দুই বন্ধু রাইফেল তুলেছি পাহাড়শীর্ষ লক্ষ করে। হুকুমের তর সইছে না। আর একবার চোখ দেখা দিতেই দুটো রাইফেল থেকে গুলি ছুটেছে। বাঘ লাফিয়েছে! আবার দুটো গুলি! দুটো জ্বলন্ত লৌহপিণ্ড। এবারে গর্জন শুনতে পাচ্ছি।
গুলি নির্ঘাত লেগেছে। জঙ্গল লক্ষ করে আবার গুলি ছুড়েছি। রাইফেলের পুনঃপুনঃ গুমগুম আওয়াজ পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে ধাক্কা খেয়ে ছুটেছে দূরদূরান্তে। এবারে আর গর্জন নেই। পাহাড় স্তব্ধ। অন্য যে জানোয়ারগুলো আহারের সন্ধানে আড়াল থেকে বনপথে বেরিয়ে পড়েছিল, তারা নিশ্চয়ই রাইফেলের আওয়াজে গা ঢাকা দিয়েছে। তা দিক। সেসব জানোয়ারে আমাদের প্রয়োজন নেই। আমাদের অপরিসর অবকাশ ফুরিয়ে এসেছে।
বাঘটাকে খুঁজে বার করা অসম্ভব। একটি গভীর অনতিক্রম্য পাবর্ত্য নালা পাহাড়ের পাদমূলে আমাদের যাওয়ার রাস্তা বন্ধ করে আছে। ঘন ঝোপঝাড় আর কাঁটা জঙ্গলে সে-নালা দুরধিগম্য। ওখানে দিনের বেলা আশ্রয় নেয় বাঘ, বরাহ, ভালুক। ওই নালা পূর্বেও দু-বার আমাদের বাঘের সন্ধানে বাধা দিয়েছে।
ভোরের আর বিলম্ব নেই। একটা ঠান্ডা হাওয়া বয়ে নিয়ে আসছে অরণ্যের স্নিগ্ধ বীজনে। দিনের বেলায় বাঘটা খুঁজে বার করে আমাদের পাঠিয়ে দিতে নির্দেশ দিলাম। সম্ভাবিত খরচপত্রও বুঝিয়ে দেওয়া হল। গাড়ি ছুটল আবার বিষণপুরের পাহাড়ের উত্তর দিকের কঙ্করাকীর্ণ রাস্তা ধরে। মহুয়াটাঁর পেছনে ফেলে, কমলপুর ছেড়ে, থালীর রাস্তা ধরে বহুদূর— পঞ্চাশ ক্রোশ দূরে শহরের উদ্দেশে।

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন