বিশ্বদেব গঙ্গোপাধ্যায়

আরণ্যক
ইংরাজ লেখক H. M. Tomlinson-এর একটি সুন্দর অরণ্য-বর্ণনা পড়েছিলাম। গভীর বনের ভিতর শিকারির অগ্নিকুণ্ড যখন শেষরাত্রে নিব নিব হয়ে এসেছে, অদূরে বাঘের গুরুগর্জন শোনা গেল; শিকারি ত্বরিতে শয়ন ছেড়ে কাঠের গুঁড়ি ঠেলে আগুনটাকে ভালো করে উসকিয়ে তুললেন ও রাইফেল হাতে নিয়ে স্তব্ধ অন্ধকারে বন-কাঁপানো গম্ভীর গর্জন বসে বসে শুনতে লাগলেন। লেখক বলছেন, ঘন জঙ্গলে মাটিতে বসে কাছ থেকে ওই চাঞ্চল্যকর গর্জন শোনা এক অপরূপ অভিজ্ঞতা। এমন লোক নেই যে, ক্ষণিকের জন্যও মনে ভয়ের শীতল স্পর্শ ওই সময় অনুভব না করে।
আর একজন বিখ্যাত শিকারি বলেছিলেন, সঙ্গিন-মুহূর্তে ভয়ের আবির্ভাব অসমসাহসী শিকারিও অবশ্যই অনুভব করে, কিন্তু অন্যের সঙ্গে তার তফাত এই যে, সে ভয়কে আমল দেয় না। ওটা তার কাছে অবান্তর মনোবিকার মাত্র, যা অগ্রাহ্য না করলে তার প্রাণের আশঙ্কা ষোলো আনা।
বনেজঙ্গলে যারা শিকারের পিছনে ঘুরেছে, তাদের অনেকেই কোনো-না-কোনো সময়ে হঠাৎ বিপদের সামনাসামনি হয়েছে। কেউ প্রাণ বাঁচাতে পারেনি, কেউ জখম হয়ে ছাড়া পেয়েছে, আবার কেউ-বা বিনা আঁচড়ে ফিরে এসেছে। যারা বেঁচেছে তারা কোনোদিন নিজেদের ভয়ংকর অভিজ্ঞতার কথা ভুলতে পারে না। বহুদিন পরেও অতীত ঘটনা তাদের চোখে স্পষ্ট হয়ে ভাসে। তাদের মধ্যে যারা শান্ত সুবোধ নয়, তারা ভয়ের নিষ্ঠুর কামড় খেয়েও জীবন-মরণের জুয়া খেলতে আবার জঙ্গলের ছক পেতে বসে। বিপদের নেশাই বোধ হয় সব নেশার সেরা, হিমালয়ের চূড়ায় চূড়ায় তাই এত ভিড়।
বাঘের গর্জনের কথা বলছিলাম এইজন্য যে ওটাকে উপলক্ষ করে মর্মান্তিক ভয়ের শাসনে আমিও আসামি হয়েছি। ছেলেবেলায় চিড়িয়াখানায় বাঘের ডাক শুনে দিশেহারা হয়ে পড়তাম। বয়সের সঙ্গে ভয়টা না বেড়ে কমেই গেছে; কিন্তু এখনও বাঘের গর্জনকে সমীহ করি, যদি চোখের আড়ালে বাঘ থাকে আর আমরা দুজনেই এক মাটির উপর অবস্থান করি।

প্রথমে চিতাবাঘ সম্পর্কে একটা ঘটনা বলি। অনেকদিন আগে আমাদের গ্রামে বেশ বড়ো একটা চিতাবাঘ এসে উৎপাত আরম্ভ করে।
তার অভ্যাস ছিল— সন্ধ্যার পর থেকে কিছুক্ষণ ডেকে বেড়াত। বোধ হয় সঙ্গিনীর অনুসন্ধানে এ-রকম করত। আমাদের বাড়ির পিছনে কাঁটাঝোপে ভরতি একটা জঙ্গলে তার আড্ডা ছিল। সেখান থেকে বেরিয়ে গ্রামের রাস্তা ধরে ডাকতে ডাকতে সে আমাদের বাড়ির পশ্চিম দিকে একটা বটগাছের তলায় ঘন ঝোপের মধ্যে আসত, তারপর অল্পক্ষণ হাঁকডাক শুনিয়ে আবার পথ ধরে জেলাবোর্ডের রাস্তায় উঠে শিকারের জোগাড়ে বেরোত। বাঘটা অসাধারণ ধূর্ত ছিল বলে তাকে মারবার চেষ্টা সফল হয়নি। আমরা তার দরাজ গলা শুনেই খুশি থাকতাম। একদিন রাত্রে আমাদের পাশের গ্রামের কয়েকজন বন্ধুবান্ধব বেড়াতে এসেছেন, আমরা সকলে দোতলার বারান্দায় গল্পগুজব করছি, এমন সময় বাঘটা পশ্চিম দিকে ডেকে উঠল। আমার ছোটো দাদা খুব সাহসী এবং ভালো শিকারি, তিনি রহস্যচ্ছলে উক্ত বন্ধুদের দলের একটি ভীতু ছেলেকে বললেন, সে ওই বাঘের চলাফেরার রাস্তায় ঘুরে আসতে সাহস করে কি না? ছেলেটির মুখে কথা নেই। তার দাদা আরও ভীতু ও কুটিল প্রকৃতির লোক। তিনি ভাবলেন, তাঁদের অপদস্থ করার উদ্দেশ্যেই বুঝি ছোটোদাদা এ-রকম প্রস্তাব করলেন। প্রতিশোধ নেবার জন্য একটু গরম ভাবেই তিনি আমাকে বললেন, 'তুমি ওখানে ঘুরে আসতে পার?' আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, 'হ্যাঁ, পারি।' তিনি বললেন, 'যাও দেখি, তোমার কত সাহস এবার বুঝব।' ছোটোদাদা বললেন, 'ও যেতে চেয়েছে তাই যথেষ্ট, যাওয়া না যাওয়া আসল কথা নয়।' কিন্তু ওই ভদ্রলোক শাইলকের মতো নাছোড়বান্দা, পালটা নেবেনই। ছোটোদাদা উভয়সংকটে পড়েছেন তখন, তিনি জানেন শিকারে আমার অভিজ্ঞতা খুবই কম, আমি গাছেও চড়তে পারি না, ওদিকে অপরকে যখন তিনি যাবার কথা বলেছেন আমাকেই-বা কী করে বাধা দেন? আমি যখন বেরোচ্ছি, শাইলক বললেন, সঙ্গে বন্দুক বা টর্চ নেওয়া চলবে না। এতে তাঁর স্বগ্রামবাসীরা পর্যন্ত চটে ওঠায় ও শর্ত আর টিকল না। পশ্চিমে আমবাগানের ভিতর দিয়ে আমি গ্রামের দিকে রওনা হলাম, তখনও বাঘটা ডেকে চলেছে। এগিয়ে আমাদের বাড়ির রাস্তা আর গ্রামের রাস্তার মোড়ে বাঁ-দিক ঘুরে বটগাছের কাছে যখন যাচ্ছি তখন ডাক থেমে গেল। অমনি আমার ভয়ও বাড়তে লাগল। বাঘটা বটগাছের নীচ থেকে শেষবার ডেকেছিল, কিন্তু তারপর যে কোথায় আছে তার নির্দেশ নেই। রাস্তার দু-পাশে ঘন ঝোপঝাড়, আমার বুক ঢিপ ঢিপ করছে, মনে হচ্ছে বাঘটা ঝোপের আড়ালে আমার পাশে পাশে চলেছে। চারদিকের অন্ধকার যেন টর্চের একমুখী আলোকে গিলে খেতে আসছে। আমি কলের মতো পা চালিয়ে বটগাছের তলায় পৌঁছোলাম, মনে হল টর্চটা চারিদিকে ঘুরিয়ে একবার দেখে নিই, কিন্তু তা পারলাম না। ঠিক দম দেওয়া পুতুলের মতো আমার অবস্থা, একভাবে পা ফেলছি; দাঁড়াতে পারি না, তাড়াতাড়ি হাঁটতেও পারি না। বটগাছ পার হয়ে আমাদের বাড়ি ফিরবার কথা। জেলাবোর্ডের রাস্তায় না ফিরে পাটখেতের ভিতর দিয়ে শর্টকাট ঠিক করলাম, কারণ উৎকণ্ঠা আর সহ্য হচ্ছিল না। পাটখেতের মধ্যে নেমে অবস্থা আরও খারাপ হল; মাথা-সমান উঁচু পাটগাছ ঠেলে ঠেলে যাচ্ছি আর বরফের মতো ঠান্ডা ধারালো ছুরির ডগা যেন আমার শিরদাঁড়ার উপর থেকে নীচে দাগা বুলিয়ে যাচ্ছে। সেটা চিতাবাঘের নখের তুলনায় বোধ হয় কম পীড়াদায়ক নয়। ভাবছি মরবার জন্যই বেকুবের মতো এই পাটখেতের মধ্যে পা বাড়ালাম। ভগবানের করুণা ছাড়া সব জিনিসেরই সীমা আছে। তেপান্তরজোড়া পাটখেতেরও। বাড়ির সামনে বাগানে যখন পৌঁছোলাম, বটতলা থেকে আবার পরিচিত ডাক শুরু হল। বাঘটা গুঁড়ি মেরে ওখানেই ছিল। আমি তার পাশ দিয়ে আসবার সময় সে যে আমার উপর কড়া নজর রেখেছিল সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই। এই অভিজ্ঞতা কখনো ভুলব না। কিন্তু সত্যিই আমার ভয়ের কোনো কারণ ছিল না, যেহেতু চিতাটা মানুষখেকো নয়। তবে সে-বয়সে বন্য জানোয়ারের মনস্তত্ত্বে আমার পণ্ডিত হবার কথা নয় এবং আক্রান্ত হলে আমার বন্দুক টর্চ খুব কাজে আসত না।
আর একবার ডোরাদার বাঘের গর্জনের সূত্র অনুসরণ করতে গিয়ে উৎকট আতঙ্ক ভোগ করেছিলাম। সেবার শীতকালে আমি ভুটানের সীমানায় পাহাড়ের নীচে ক্যাম্প করেছিলাম। একটা পাহাড়ি নদী যেখানে সমতলভূমিতে পড়ে চওড়া হয়েছে, তারই ধারে আমার ঘাঁটি ছিল। চারপাশে বিশাল জঙ্গল-এলাকা, জানোয়ারও বেশ আছে, কিন্তু আমার অদৃষ্টে কোনো বড়ো শিকার জুটছিল না। অথচ প্রায়ই বনের মধ্যে বাঘের চলাফেরার চিহ্ন পেতাম, সম্বরের ঘোড়ার মতো বড়ো পাঞ্জা দেখে তার শিং-এর মাপ অনুমান করতে চেষ্টা করতাম, আর মাঝে মাঝে জংলি মুরগি, বার্কিং ডিয়ার মেরে আশ মিটাতাম। কয়েকটা মড়ি পেয়েছিলাম, কিন্তু বাঘ আসেনি। বাঘের টোপ হিসাবে যে মোষ বাঁধা হত, পাশ দিয়ে গেলেও বাঘ সেদিকে ভ্রূক্ষেপ করত না। আমার রুটিন ছিল রোজ ভোরবেলা ও বিকালের পর জঙ্গলের এক-একটা অংশ ভালো করে খুঁজে দেখা। সরকারি বাংলোর চৌকিদার, অধীর নামে এক ছোকরা, অনেক সময় শিকার-অনুসন্ধানে আমার সঙ্গ নিত। সে খুব উৎসাহী, সাহসী আর চটপটে ছিল এবং ওখানকার জঙ্গল ও জানোয়ার সম্বন্ধে তার মোটামুটি মন্দ জ্ঞান ছিল না। উত্তর দিকের দুর্গম পাহাড়ি জঙ্গল বাদে আর সব জায়গাই আমার দেখা হয়েছিল। প্রায় ছয় সপ্তাহ আমার এইভাবে কাটল। ফিরবার সময় যত এগিয়ে আসছে, আমিও তত নিরাশ হয়ে পড়ছি। একদিন অধীর বলল, ভালো শিকার তো মিলছে না, মহাকালের পুজো দিয়ে দেখলে হয়; এটা মহাকালের রাজ্য, তাঁর কৃপা ছাড়া কিছু হওয়ার নয়। আমার আস্থা না হলেও অধীরের কথায় পূজার জন্য কয়টা টাকা দিলাম, যথাসময়ে গেরুয়াধারী পূজারি প্রসাদ দিয়ে গেল। তার পরেই অধীর খবর আনল, নদীর ডান দিকে আর উপরে পাহাড়ের মাথায় একটা হ্রদ আছে, তার চারদিকে গভীর জঙ্গল; সেইখানে বিরাট সম্বর আছে, সে নিজে পায়ের দাগ দেখে এসেছে। ওখানে বাঘের উৎপাত নেই বলে নাকি সম্বরগুলো ওইদিকে বেশি বিচরণ করে। সেই সময় আমার কাছে মি. হফ নামে এক বন্ধু এসেছিলেন। আমরা এই খবরে আশান্বিত হয়ে পরদিন বেলা দুটো-আড়াইটের সময় জায়গাটা দেখবার জন্য বার হলাম। হফ-এর সঙ্গে তার পাহাড়ি বেয়ারাও চলল। অনেক নালা, জঙ্গল ভেঙে আমরা একটা খাড়া পাহাড়ের তলায় পৌঁছোলাম। অধীর বলল, হ্রদটা ওরই উপরে। ঘন ঘাস ও ছোটো ছোটো আলগা পাথরের উপর দিয়ে হাঁচড়-পাঁচড় করে আমরা উপরে উঠে দেখলাম পাহাড়ের ওপিঠে অল্প নীচেই ছোটো একটা হ্রদ, পরিষ্কার টলটল করছে জল। তিনভাগ ঘিরে পাহাড়ের সংকীর্ণ শিরার খাড়া পাড়, আর আমাদের সামনে ওপারে একভাগ হচ্ছে সমান জমি, ওদের সঙ্গে মিশেছে। বড়ো বড়ো গাছের নীচে ঘাসে ঢাকা সব জায়গাটা। গভীর ঘন জঙ্গলের মধ্যে দৃশ্যটা অতি মনোরম। বিলাতের পার্ক বলতে যা বোঝায় তার সঙ্গে তুলনার যোগ্য। সামান্য বিশ্রাম করে আমরা জানোয়ারের হদিশ খুঁজতে লাগলাম, কিন্তু পাথুরে জমিতে চলাফেরার পথের রেখা ছাড়া বিশেষ কিছু পেলাম না; হ্রদের একেবারে ধারে অল্প জলের নীচে সম্বরের মস্ত পাঞ্জা দেখলাম। তখন সূর্য অস্তায়মান, হ্রদ ঘুরে সমান জমিটায় আর গেলাম না। অন্ধকার হওয়ার আগে পাহাড় থেকে নামবার আমার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু হফ পরদিন চলে যাবে, তার খুব আগ্রহ সন্ধ্যা অবধি সুযোগের অপেক্ষা করে। অগত্যা রাজি হয়ে আমি জলের ধরে ঘাসের মধ্যে একটা পাথরে বসলাম, অধীর আমার পিছনে বসল। হফ ও তার লোক আমাদের বাঁ-দিকে হ্রদটি ঘুরে, মাঝামাঝি পাড়ের খাড়াই ধরে উপরে উঠে কতগুলো বড়ো গাছের নীচে অদৃশ্য হল। কোথায় জায়গা নিল ঠিক দেখতে পেলাম না। শিস দিয়ে আমরা পরস্পরের অবস্থান আন্দাজ করে নিলাম। অন্ধকার হতে আরম্ভ করেছে এমন সময় জোরে ঝটাপট শব্দ শুনে চমকে দেখি, মাথার উপর ধনেশ পাখির দল গাছে গাছে বসছে। তাদের ডানার ঝাপট যখন থামল তখন বেশ অন্ধকার হয়ে গেছে। আমি ফিরবার সমস্যায় একটু অসহিষ্ণুহয়ে হফকে ইশারা করব ভাবছি, অকস্মাৎ পাহাড়ের স্তব্ধতা চুরমার করে উদাত্ত গর্জন জলের উপর দিয়ে এসে যেন ধাক্কা মারল। অধীরের খবর যে এক্ষেত্রে নির্ভুল হয়নি তার জীবন্ত প্রমাণ। আমি অনুমান করতে চেষ্টা করলাম রাজকীয় নির্ঘোষের কর্তা ঠিক কোনখানটিতে রয়েছে। কিন্তু ওপারে সেই সমান জমিটাতে যে রয়েছে তার বেশি বুঝতে পারলাম না। একটু পরে আরও জোরে হাঁক এল। এবার আওয়াজটা বাঁ-দিকে, অর্থাৎ ওপার থেকে এদিকে আসার সরু পথের মুখে। আমার মনে হল প্রচণ্ড গর্জনে মাটি যেন কেঁপে উঠল।

আমি বন্দুকটার সেফটি ক্যাচ তুলে উৎকর্ণ হয়ে বসে আছি; হফ ওদিকেই আছে, একটা সুযোগ নেবেই। একটু পরে আবার সাড়া পেলাম, এবার আরও কাছে এবং স্বর বেশ মৃদু। আওয়াজ করে শেষে হাঁফ ছাড়বার সময় মুখ দিয়ে জোরে নিশ্বাস ফেললে যেরকম শব্দ হয়, সে-রকম শব্দ। কেন বলতে পারি না বিকট হুংকারের চেয়ে মোলায়েম স্বগতোক্তি আমার কানে বেশি বিশ্রী লাগল। অধীর তখন একেবারে আমার পিঠে ঠেসে বসেছে। আমি মনে মনে নানা হিসাব কষছি; প্রথম আমার সঙ্গে টর্চ নেই এবং সাধারণ শটগান, অধীরের সঙ্গে একটা কমজোর টর্চ আছে, তার ব্যাটারি ক্ষীণ। দ্বিতীয়ত, হফ-এর কাছে একটা .৪০৫ উইনচেস্টার ম্যাগাজিন রাইফেল; হফ ওটাকে যতই শক্তিশালী অস্ত্র মনে করুক, আমি মনে করি না। ভুটানের জঙ্গলে রাত্রে বড়ো বাঘের সঙ্গে মাটিতে দাঁড়িয়ে লড়বার উপযুক্ত অস্ত্র ওটা নয়। .৪০৫-এর সঙ্গে আমি পরিচিত। এক গুলিতে না পড়লে, হফ-এর গুলি খেয়ে বাঘ যদি আমাদের দিকে ছুটে আসে, তাহলে নিশ্চিত মরণ। ওই সঙ্গে হফ-এর রাইফেলের গুলি কোনাকুনি এসে অথবা জলে ঠিকরে আমাদের গায়ে লাগতে পারে কি না তাও একটু মনে হয়েছিল। তৃতীয়ত, হফ যদি মারবার সুবিধে না পায় তবে বাঘটা পথ ধরে সোজা আমাদের দিকে চলে আসবে এবং আচমকা আমাদের দেখতে পেয়ে যদি ভড়কে একটা ঠোনা মারে তাহলেও ভবিষ্যৎ অন্ধকার। আর শেষ এবং সবচেয়ে বড়ো প্রশ্ন হচ্ছে আমাদের সঙ্গে যেই দুই বেচারা এসেছে তাদের নিরাপত্তা। আমি আর হফ না হয় শখ করে প্রাণসংশয় করতে পারি, কিন্তু ওরা আমাদের উপর নির্ভর করে এসেছে, সঙ্গে কুকরি ছাড়া আত্মরক্ষার কিছু নেই। কোনোরকম সংকটে ওদের রক্ষা করার দায় সম্পূর্ণ আমাদেরই। অবশ্য এসব কথা খুব তাড়াতাড়ি আমার মনে খেলে গেল। হফকে যথেষ্ট সুযোগ দেওয়া হয়েছে, আর নয়। আমি নিঃশব্দে বন্দুকে একটা চার নম্বর টোটা পুরে আকাশে ফাঁকা আওয়াজ করলাম। সঙ্গেসঙ্গে নুড়ির ওপর ভারী লাফ-এর শব্দ শুনলাম। বাঘটা উলটো দিকে সমান জমির ওপিঠে পালাল। তারপর হফ-এর মহা ক্ষোভ আর অনুযোগের পালা। আর কয়েক সেকেন্ড পরেই সে নাকি পরম সুযোগ পেত, আমি তার আগেই সব নষ্ট করে দিলাম। ও নিয়ে আর বেশি কথা হল না। অতি কষ্টে পাহাড় থেকে নামলাম, হফ-এর জোরালো টর্চ ছিল তা সত্ত্বেও বাড়ি ফিরবার পথ একেবারে অচেনা লাগছিল। অধীর বলছিল, একজন পাহাড়ি আছে ওদিককার সব অন্ধিসন্ধি সে জানে, চোরাই শিকারের বদনামও তার আছে। আমরা দশটার পর ক্যাম্পে ফিরেই সে-লোকটাকে ডাকতে পাঠালাম। আমাদের খাওয়াদাওয়ার পর সে এসে পৌঁছোল। চেহারা দেখে বুঝলাম জঙ্গলের পাকা লোক; রোগা কিন্তু পাকানো তারের মতো দেহ কঠিন। হ্রদের ওদিকে আমাদের শিকারে নিয়ে যাবার কথা বলতে সে ঝাড়া অস্বীকার করল। যত টাকাই বকশিশ দেওয়া হোক ওখানে সে একদম যাবে না। ওটা মহাকালের স্থান, ওখানে কোনো জানোয়ার মারলে অশুভ হবে। আর ওই বাঘটা সাদা রং-এর, বহুকাল থেকে ওখানে আছে কেউ মারতে পারে না। এক শিকারি ওকে গুলি করার পরে দুর্ঘটনায় পড়েছিল এবং একটি পাহাড়ি হ্রদের ধারে গাছে রাত কাটানোর ফলে ঘোর পাগল হয়ে গেছে। সে লোকটিকে এখনও সকলে দেখে মাঝে মাঝে, পাহাড়ে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায়। তা ছাড়া ওটা কার এলাকা বলা যায় না, ওইসব পাহাড়ে স্বভাবদুর্বৃত্ত ভুটিয়ারা ঘুরে ঘুরে বেড়ায় শিকারের সন্ধানে। তারা দুর্ধর্ষ-প্রকৃতি, ভারত-সরকার, ভুটান-দরবার কাউকেই খাজনা দেয় না। বন্দুক টোটার লোভে আগন্তুককে গোপনে আক্রমণ করবার ঘটনাও ঘটেছে ইত্যাদি। আমাদের ওখানে যেতে বার বার মানা করে পাহাড়ি শিকারি বিদায় নিল। আমরা আলোচনা করলাম, ওর শিকারের ভালো জায়গা নষ্ট হবে বলে এসব গাঁজাখুরি গল্প শুনিয়ে গেল। হফ যাওয়ার পর আমি ওই কৌতূহল-জাগানো জায়গা সম্বন্ধে খবর নিতে, আরও রহস্যময় ব্যাপার শুনলাম। কয় বছর আগে দূর শহরে এক মাড়োয়ারি যুবক স্বপ্ন পেয়ে আসে, হ্রদের ধারে রাত্রে মহাকালের পুজো দিলে সে গুপ্তধন পাবে। যুবকটি তার সঙ্গের লোককে নীচে রেখে দুপুর বেলা পুজোর উপচার নিয়ে একলা পাহাড়ের উপর চলে যায়। পরদিন তাকে ফিরতে না দেখে তার সঙ্গী লোকজন নিয়ে উপরে উঠে দেখে যুবকটির মৃতদেহ হ্রদের জলে ভাসছে। শরীরে কোনো জখমের চিহ্ন নেই। লাশ নামিয়ে থানায় খবর পাঠানো হয়, তারপর ময়নাতদন্তের জন্য সদরে সেটা চালান যায়। এটা আর বানানো কাহিনি নয়, স্থানীয় অনেকে লাশ দেখেছিল। বিবিধ লোমহর্ষক বৃত্তান্ত যতই শুনছি, ওই নিরীহদর্শন হ্রদের গুপ্তরহস্য ততই আমাকে আকর্ষণ করছে। উপরন্তু শিকারের প্রশস্ত ক্ষেত্র, তা নিজেই পরখ করছি; বিশেষত সাদা বাঘের সুযোগ জীবনে কখনো পাব না। আরও অনেক বিচিত্র কাহিনি শুনলাম, কিন্তু সেসব নিছক রূপকথা বলে এখানে উল্লেখ করছি না। ঠিক করলাম, সঙ্গে কেউ না গেলেও একলাই ওখানে রাত্রে থাকব। রেলওয়ের কোনো বন্ধুর সৌজন্যে ওখানে মাচা করার বন্দোবস্ত সহজ হল। খাওয়ার পর দুপুরে আমার চাকর বাহাদুর, অধীর ও কয়েকজন কুলি নিয়ে আমি রওনা হলাম। এবার হ্রদের ধার ঘুরে সমান জমিটায় গেলাম। জমিটা শক্ত পাথুরে, হাঁটু-সমান ঘাসে ঢাকা। ওদিকে একটা ছোটো ঢিপির পিছনে বড়ো বড়ো পাথরে ভরতি শুকনো ঝোরা পাহাড়ের গা বেয়ে নীচে নেমে গেছে, একপাশে আরও উঁচু বড়ো পাহাড়ের ঢালু এসে এই পাহাড়ের গায়ে মিশেছে, দুটোর মাঝখানের খাঁজ বেয়ে জানোয়ার-চলা পথ, আর সমান জমির উপর দিয়ে হ্রদের জল অবধি ক্ষীণ একটা পথের দাগ। এই তিনটে পথের তেমাথা থেকে প্রায় পঞ্চাশ গজ দূরে একটা সুবিধামতো গাছে মাচা বাঁধতে বলে আমি ঘুরে জায়গাটা দেখতে লাগলাম। চোখে পড়ল শিংসমেত একটা ছোটো বাইসনের মাথা, অনেকদিনের পুরোনো বাঘের মড়ি। এক জায়গায় নরম একটু মাটিতে বাঘের পাঞ্জা দেখলাম, বিরাট তার আকার। এ যে সেই ভীম-গর্জনের মালিকের থাবা তাতে সন্দেহ রইল না। যেমন গলা তেমনই আয়তন। এখানে-সেখানে হাড়ের টুকরো ছড়ানো, গাছে নখের আঁচড়। বেলা চারটের আগেই মাচা হয়ে গেল। ফ্লাস্কে গরম কফি, বিস্কুট ও অন্যান্য সরঞ্জাম নিয়ে আমি মাচায় বসলাম, বাহাদুরকে বলে দিলাম, পরদিন সকালে রোদ উঠবার পর দূর থেকে সাড়া দিয়ে যেন আসে।
জায়গাটার প্রাকৃতিক শোভা মুগ্ধ চোখে দেখেছি, নির্জন বনের মধ্যে অজানা পাখির সুমধুর শিস, ঝাঁকে ঝাঁকে নানা রং-এর পাখির আসা যাওয়া। দূরে সম্বরের শিং ঠোকাঠুকির আওয়াজ শুনতে পেলাম— ঠিক যেন বাঁশের গায়ে লাঠির ঘা পড়ছে। কতগুলো জংলি মুরগি ফাঁকা জায়গায় চরতে লাগল। একটা মাঝারি গোছের শুয়োর আমার ডান দিকে মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে কী খুঁজতে লাগল। আমি খুশিমনে অনেক আশা নিয়ে প্রবীণ সাদা বাঘটার রূপ কল্পনা করছি। এই পটভূমিকায় তাকে কী সুন্দর মানাত! আশঙ্কার লেশমাত্র আমার মনে নেই। হঠাৎ নজরে পড়ল, একটা বড়ো চিতাবাঘ দুই পাহাড়ের মাঝের গলিটা দিয়ে আসছে। খানিক দূরে এসে তার কেমন সন্দেহ হল, সন্তর্পণে একটু এগোয় আর দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক দেখে, লেজটা আস্তে আস্তে ডাইনে-বাঁয়ে দোলায়। দেখলাম তার কড়া নজর আমার মাচার কাছেই কোনো জিনিসের উপর। জিনিসটা অন্য কিছু নয়, সদ্য ছাল-ছাড়ানো গাছের ডালের সাদা একটা টুকরো। মাচা বেঁধে ওরা অসাবধানতাবশত ওখানেই ফেলে রেখেছে। চিতার ভাবভঙ্গি উন্মুখ হয়ে দেখছি আর ভাবছি মুভি ক্যামেরায় কী চমৎকার ছবি উঠত। একটু পরে এমনিই তার দিকে নিশানা করতেই সে বিদ্যুদবেগে ত্রিশ গজ পিছনে ছুটে গিয়ে একটা বাঁকের মুখে দাঁড়িয়ে ডালপালা-ঢাকা আমার মাচার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি নিশ্চল হয়ে রয়েছি। এর আগে সে উপরে লক্ষ করেনি, কিন্তু আমার সামান্য নড়া আড়াল থেকেও তার চোখে পড়েছে। ভালো করে ঠাহর করতে পারছে না ওখানে ব্যাপারটা কী। সে স্থির করল আবহাওয়া স্বাস্থ্যকর নয়, ঘুরে পালাল। আমি মাচা থেকে নেমে সাদা ডালের টুকরোটা দৃষ্টির বাইরে সরিয়ে ফেলে আবার স্বস্থানে ফিরে গেলাম। তখনও দিনের আলো শেষ হয়নি। বিচিত্র ঐশ্বর্যের গোপন রহস্য নিয়ে ধাপে ধাপে হিমালয়ের উদ্ধত শির আকাশ ছুঁয়েছে। হ্রদের জল আয়নার মতো স্থির, আকাশের ক্ষীয়মাণ আলোর ছিটেটুকু বুকে ধরে আছে। জংলি মুরগি জমি ছেড়ে রাত্রের জন্য গাছে আশ্রয় নিচ্ছে, তাদের ডাক মাঝে মাঝে শোনা যায়। সমস্ত পরিবেশ একটা অবর্ণনীয় শান্ত গাম্ভীর্যে পূর্ণ। অন্ধকার ঘনিয়ে এল। আমিও উৎসুক হয়ে সেদিনকার বুড়ো বাঘের প্রতীক্ষা করতে লাগলাম। সামান্য শব্দের জন্য কান খাড়া, সেই সময় ধনেশ পাখিদের ডানার ঝাপট বড়ো বিরক্তজনক লাগছিল। অন্ধকারে হরিণের সাড়া পেলাম, আমার মাচার পিছন দিয়ে একটা সম্বরকে স্বাভাবিক গতিতে যেতে দেখে বুঝলাম মহাকালের সাদা জটাধারী বাঘ (বেশি বয়স হলে ঘাড়ের লোম বেশ বড়ো হয় এবং রং-ও ফিকে হয়) সহজে আমাকে কৃতার্থ করতে আসবে না। সেদিনকার ফাঁকা আওয়াজ তাকে খুব হুঁশিয়ার করে দিয়েছে। তারার আলোর তরল অন্ধকারের মধ্যে সাধ্যমতো নজর চালাবার চেষ্টা করছি। চারিদিক ঘিরে সুগভীর স্তব্ধতা, কাছে-পিঠে একটা মানুষও নেই যে আমার কোনো বিপদ হলে সাহায্য না করুক জানবে যে দুর্ঘটনা ঘটল, বা কী ধরনের দুর্ঘটনা। নানারকম আতঙ্কের গল্প শুনে মনে কিছু সন্দেহের ভাবও হয়তো লুকিয়ে ছিল ওই রহস্যময় বনের স্থানমাহাত্ম্য সম্পর্কে। দুশ্চিন্তা একটু একটু করে আমার মাথায় জড়ো হতে লাগল। মজার কথা যে, বন্য জীবজন্তুর কোনো ভয় বোধ করিনি, ভূতপ্রেতেরও বড়ো প্রাধান্য দিইনি। সেই পাগলটার চিন্তাই আমাকে ভাবিয়ে তুলল।
ওই অদ্ভুত পরিবেশে পাগলটার উপস্থিতির চিন্তা অস্বাভাবিক অস্বস্তি আর ভয় জাগিয়ে তুলল। হঠাৎ সে এসে উপদ্রব আরম্ভ করলে মহা মুশকিলে পড়ব; গুলি চালিয়ে ঠেকানো চলবে না, আর অন্ধকারে নীচে নেমে তার সঙ্গে কুস্তি লড়াবার কল্পনাও বিষম। হয়তো রাত্রে কখন ঘুমিয়ে পড়ব, সেই সুযোগে পাগল মাচা আক্রমণ করবে। এইসব উদ্ভট আশঙ্কার সঙ্গে পাহাড়ি দুর্বৃত্তদের সমূলক ভয়ও ঘনীভূত হচ্ছিল। তারা যদি আমাকে সাবাড় করবার সুযোগ খোঁজে, তাহলে সেটা কঠিন হবে না। মনে পড়ল— কবে কোন ফরেস্ট গার্ডের মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল, কোথায় কোন ফরেস্ট অফিসারকে খুন করার চেষ্টা হয়েছিল, এসব পুরোনো কাহিনি। ভাবতে লাগলাম, একলা এখানে আসা গোঁয়ারতুমি হয়েছে। নীচে যেসব বিবরণ শুনে গাঁজাখুরি বলে মনে হয়েছিল, এখন মনে হল সেসব গল্প মহাকালের প্রসাদ সেবনের ফল না-ও হতে পারে। এমন সময় আমার ডান দিকে ঢিপির নীচে আর্তনাদ শুনে আমি কাঠ হয়ে গেলাম। অবিকল কচি শিশুর ককানির শব্দ। আমি টর্চ ঘুরিয়ে ভালো করে দেখলাম— কিছুই নেই, শুধু ঘাস। বিষম ধাঁধায় পড়লাম। পাখি রাত্রে ঘাসের মধ্যে ডাকবে কেন? আর কোন জন্তু এ-রকম আওয়াজ করতে পারে? আবার অন্য পাশ থেকে ওই শব্দ, দেখি কিছু নেই। ভয় তখন পুরোপুরি আমার ঘাড় চেপে ধরেছে, মহাকাল তাঁর গোধূলিতে-দেখা দক্ষিণ মুখ উলটো দিকে ফিরিয়ে নিয়েছেন। কোণঠাসা জন্তুর মতো বসে বসে ভাবতে লাগলাম ভূত, মানুষ যাই আসুক সহজে ছেড়ে দেব না। এবং আমার সুবিধা যে আমি মাটি থেকে উপরে রয়েছি, যা হওয়ার এই মাচাতেই ঘটবে। আরও কয়েকবার ওইরকম স্পষ্ট শিশুর ককানির শব্দ শুনলাম, কিন্তু কিছুই দেখতে পেলাম না। তারপর হঠাৎ ওই শব্দ হল একটা গাছের উপর থেকে। সেই মুহূর্তে বুঝলাম ওটা আমার অচেনা কোনো রাতচরা পাখি। যেমন ভয় পেয়েছিলাম তেমনই আশ্বস্ত হলাম। তারপর সারারাত বিভিন্ন জীবের সাড়াশব্দ শুনে কাটালাম বটে, কিন্তু মহাকালের বাঘ দেখবার সৌভাগ্য হল না। রাত আন্দাজ বারোটায় আমার তন্দ্রা এসেছিল, আমি গাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে বসেছিলাম, শুকনো পাতার ঈষৎ একটা আওয়াজ শুনে বুঝলাম বাঘ বা চিতা এসেছে। অপেক্ষা করলাম, কিন্তু কিছুই এগিয়ে এল না। তখন যতদূর সম্ভব আস্তে ঘুরবার চেষ্টা করবামাত্র ঝপ করে একটা আওয়াজ হল এবং আমিও জানলাম মহাকালের বাঘ আমার গুলিতে মরবে না। তার যেটুকু সন্দেহ ছিল মিটিয়ে নিয়ে কিছুকালের মতো সে চলে গেল। পরদিন সকালে বাহাদুরের সঙ্গে নীচের পাহাড়ি বস্তির অনেক কুতূহলী লোক আমার ঘাড়-মটকানো লাশ দেখতে এসে নিরাশ হল।
প্রথম রাতের বিচিত্র অভিজ্ঞতার পর আমার আর ভয় হয়নি। পর পর কয়েক রাত আমি ওখানে ছিলাম। বাঘের পাত্তা পাইনি, কিন্তু এক রাত্রে সংলগ্ন পাহাড়ের বাঁশবনে গোলমাল শুনে হাতির কথা ভেবে সন্ত্রস্ত হয়েছিলাম। মড় মড় বাঁশ ভাঙার আওয়াজ, পাথর গড়ানোর আওয়াজ, সব মিলে মনে হচ্ছিল বুঝি বা হাতির পাল জঙ্গল ভেঙে শেষ করছে। ভোর হওয়ামাত্র ওদিকে গিয়ে বাইসনের নাদি দেখে বুঝলাম বাইসনের পাল বাঁশবনে চরতে এসেছিল। বাইসন যে এত হুটোপাটি করে আমার জানা ছিল না। শিং ঠোকাঠুকির আওয়াজ অনুসরণ করে দূর থেকে সম্বরের লড়াই-এর দৃশ্যও উপভোগ করেছি। পাহাড় থেকে একেবারে খালি হাতে ফিরিনি। বাঁশবনের ধার ঘেঁষে একটা প্রকাণ্ড দলছুট সম্বর (মদ্দা সম্বর বয়স বেশি হলে দল থেকে সরে যায়) একদিন পেয়েছিলাম। হাওয়া আমার অনুকূল থাকায় নাগাল পাওয়া কঠিন হয়নি। সেটার শিং বত্রিশ ইঞ্চি লম্বা ও গোড়ার বেড় প্রায় দশ ইঞ্চি ছিল। উত্তর-পূর্ব ভারতের পক্ষে দৈর্ঘ্য মন্দ নয়, যদিও মধ্য-ভারতে এর চেয়ে অনেক বড়ো শিং পাওয়া যায়। তবে বেড়টা মধ্য-ভারতের তুলনায়ও খুবই ভালো বলা চলে।
ওই সুদৃশ্য স্থানের কুখ্যাতি সম্বন্ধে আমি চাঞ্চল্যকর কিছু আবিষ্কার করতে পারিনি বটে, কিন্তু মনে হয়েছে, কুসংস্কারাচ্ছন্ন কোনো লোক যদি রাত্রে নিরস্ত্রভাবে ওখানে একলা পড়ে, তাহলে পাখির অদ্ভুত আওয়াজও তার কাছে এমন বিভীষিকা সৃষ্টি করবে যে মাথা খারাপ হওয়া অসম্ভব নয়।
মাড়োয়ারি যুবকের মৃত্যুর কারণ অবশ্য এ-রকম নির্দোষ কিছু নয়। ও সম্পর্কে রহস্যভেদ করবার যথাসাধ্য চেষ্টা করে আমি নিজের সিদ্ধান্তে পৌঁচেছি। সমান জমিটার একদিকে নাবাল জমির একটা চওড়া পটি হ্রদ থেকে বেরিয়ে পাহাড়ের ঢালুতে মিশেছে। হ্রদের জল বাড়লে এ পথেই বাড়তি জল উপচে যায়। কাদা জমি বলে এখানে ঘাস জন্মায় না, হরিণের চলাফেরায় পটিটা ক্ষতবিক্ষত। এর মাথায় হ্রদের জলে কতগুলো বড়ো পাথরের চাতাল জেগে আছে। এটাকেই হ্রদের ঘাট বলা যায়। পুজোর উপকরণ নিয়ে যুবকটি এখানেই বসেছিল, সময়টা ছিল বর্ষার শেষ। হিমালয়ের নীচের দুর্ভেদ্য জঙ্গলে শঙ্খচূড় সাপ (Hamadryad বা Snake-eating Cobra) মোটেই বিরল নয়, এবং এদের মতো ক্রুর হিংস্র প্রকৃতি সর্পকুলে আর কেউ নেই। শোনা যায় এরা জলের কাছে থাকতে ভালোবাসে, কারণ জলখেলা নাকি এদের অভ্যাস। হ্রদে আসতে হলে ওই চওড়া পটিটা সাপের উপযোগী পথ হবে। খুব সম্ভব রাত্রে শঙ্খচূড় সাপ ওইখান দিয়ে এসে যুবকটিকে আক্রমণ করে ও সে বেচারি জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। পরের দিন পুজোর জিনিস পাথরের উপরেই ছিল বলে শোনা যায়। মৃতদেহ দেখেছিল এ-রকম একজন বলল, দেহে আঘাতের কোনো চিহ্ন ছিল না, কিন্তু সর্বাঙ্গ কালচে বিবর্ণ হয়ে গিয়েছিল। ওই মুলুকে শঙ্খচূড় মেরেছেন এ-রকম লোকও আমি জানি। দুর্ঘটনার সব তথ্য আমার জানবার উপায় নেই, কিন্তু আমার কৈফিয়ত ভুল নয় বলেই আমার বিশ্বাস।
গভীর জঙ্গলের মধ্যে পাহাড়ের কোলে শান্তশ্রী হ্রদের আকর্ষণ এখনও আমার কাছে প্রবল, কিন্তু প্রথম রাত্রে রাতচরা পাখির ডাক শুনিয়ে যে ভয়ংকর রসিকতা সে করেছিল তা বিলক্ষণ মনে থাকবে।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন