বিশ্বদেব গঙ্গোপাধ্যায়

কুমুদনাথ চৌধুরী
মধ্যপ্রদেশের সীমান্তে আমারই পরিচিত কোনো স্থানে পার্শ্ববর্তী প্রদেশ হতে একটি ব্যাঘ্র উপস্থিত হয়ে, সপ্তাহ-তিনেকের মধ্যে অনেকগুলি নরনারী হত্যা করেছে, এই সংবাদ পেলাম। লোকজনে বড়ো ভয় পেয়ে গিয়েছিল। পাহাড়ে জঙ্গলে তাদের কাঠ-ভাঙা, ফুল কুড়িয়ে আনা, একরকম বন্ধ হয়ে গিয়েছিল বললেই হয়। নিজে অলক্ষ্যে থেকে শিকার ধরার পক্ষে সেই ব্যাঘ্রটির বিশেষ সুবিধাজনক জায়গা জুটেছিল। যে পথ বেয়ে গোরুর গাড়ি সারি সারি আসে, সেইখানে লুকিয়ে বসে তিনি অনেক বলি সংগ্রহ করেছেন শুনলাম। তিনি বাঘিনী হলেও শিকারি কম ছিলেন না— গাই, বলদ, ছাগল, ভেড়া সবই উজাড় করেছিলেন। স্থানীয় শিকারি তাকে মারবার বেশ একটি সুযোগ পেয়েছিল। সন্ধ্যাবেলায় সে তখন মৃত গোরুটি ভক্ষণের চেষ্টায় ফিরছিল। কিন্তু বেচারা শিকারির কাছে যে কার্তুজ (cartridge) ছিল তা ফেটে গুলি বাহির হয়নি। বাঘিনী সেই যে চমকে পলায়ন দিলে তারপর আমরণ সে আর প্রলোভনে ভোলেনি বা ফাঁদে পা বাড়ায়নি।
শিকারের লোভে K. G. B. পথের ধারে একটা স্টেশনে এসে আমার সঙ্গ ধরলেন। রাতদুপুরে আমরা গিয়ে পৌঁছোলাম। যাঁদের উপরে তত্ত্বাবধানের ভার ছিল, তাঁরা পোঁটলাপুঁটলি সমেত আমাদের থানায় নিয়ে তুললেন। এমন নিরাপদ স্থানে আমাদের প্রথম আর সবেমাত্র রাত্রিবাস।
ভোর হতে-না-হতে আমরা মহাসমারোহে যাত্রা শুরু করলাম। প্রশস্ত রাজপথ— সুন্দর আধুনিক পথ। কিছুক্ষণ পরে ব্রিটিশ রাজ্যের একজন প্রহরী আমাদের তত্ত্বাবধানের ভার গ্রহণ করলে। অতঃপর হস্তীপৃষ্ঠে কয়েক মাইল যাবার পরই আমরা শিবিরে গিয়ে পৌঁছোলাম। এর আগেই শিকার-সন্ধানে লোক জড়ো করে চারিদিকে পাঠানো হয়েছিল। শৈলমালাবেষ্টিত যে স্থানটিতে আমাদের শিবির সংস্থাপন হয়েছিল, সে যেন এক স্বপ্নরাজ্য। গোধূলির শ্যামচ্ছায়, পাদপরাজি আচ্ছাদিত বনভূমি যখন স্নিগ্ধ অন্ধকারে আবৃত হয়ে এল, তখন চারিদিক হতে সম্বর মৃগের ঘণ্টাধ্বনির মতো আহ্বান-রব বারংবার আমরা শুনতে পেলাম। সে যেন বনের অধিষ্ঠাত্রী দেবীর আরতির মঙ্গলবাদ্য!
বাঘিনী সম্বন্ধে যে সংবাদ আমরা জানলাম, সে হচ্ছে পাঁচ-ছয় দিনের বাসি খবর। যাই হোক প্রভাতেই ভাগ্যলক্ষ্মী সুপ্রসন্ন হলেন। সংবাদ এল, সূর্যোদয়ের শুভলগ্নে খানিক দূরে বাঘিনী একটি স্ত্রীলোককে ভোগে লাগাবার উদ্যোগ করেছিল, পারেনি। সে কোনোরকমে একটা পাথরের স্তূপের আড়ালে গা-ঢাকা দিয়ে বেঁচে গেছে। নিরাশ হয়ে ব্যাঘ্রী একটি নালার মধ্য দিয়ে অন্য পথে যাত্রা করেছে। নালার পাশের ভিজে বালিতে তার পায়ের টাটকা চিহ্ন খুব স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। আর বনের মধ্যে দিনের বেলা লুকিয়ে থাকবার জন্যে যে পথে চলে গিয়েছে, সেখানেও তার পা থেকে ঝরে পড়া বালি আর কাদার দাগ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। নালার পাড়ে লাফিয়ে উঠে যেখানে সে পাহাড়ে চড়েছে, সেইখান হতেই তাকে অনুসরণ করে যাওয়া কঠিন হয়েছিল।— কোথাও গড়িয়ে পড়া এক খণ্ড পাথর, কোথাও-বা পায়ের চাপে মুচড়ে-পড়া সুকুমার লতাগুল্ম, কোথাও-বা বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্ত তৃণগুচ্ছ। এই দেখেই পথ আবিষ্কার করে অগ্রসর হচ্ছিলাম। সত্বর অগ্রসর হওয়া ঘটে ওঠেনি, কেননা স্থিরনিশ্চয় না হয়ে পা বাড়ানো আমরা যুক্তিসিদ্ধ মনে করিনি। দিনের আলোতে পাহাড়ের নিরাপদ আশ্রয়টি ছেড়ে সে অধিক দূরে অগ্রসর হবে না জেনে, নিঃশব্দ ধীর পদক্ষেপে আমরা নালার কাছে ফিরে এলাম। নালার কাছে পলায়নের তিনটি ঘাট; তার দুটি ভিন্ন ভিন্ন পথ ছিল। শেষের পথ দুটি নালা হতে পাহাড়ের দিকে গিয়েছিল। ঘাট তিনটি একজন লোকেই পাহারা দিতে পারে।
আধ মাইল দূর হতে বাঘকে তাড়া দিয়ে আনবার বন্দোবস্ত করা হল। আমি আট ফুট উঁচু একটা পাথরের উপর উঠে আমার বসবার মোড়াটি এমন জায়গায় রাখলাম যেখান হতে তিনটি ঘাটই আমি স্পষ্ট দেখতে পাই। আমার ডাইনে ও সম্মুখে আরও দুটি পাথরের ঢিবি, আর গুটিকতক গাছও ছিল। ঘাটের পথ থেকে দু-চারটি সরু গলি এরই মাঝখান দিয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। আমি পাথরের উপর মোড়া পেতে বসেছিলাম। তার উপরে গুটিকতক গাছ ছিল। গাছের ডালগুলি এমনিভাবে নামিয়ে দিয়েছিলাম, যাতে করে আমি আড়ালে থাকতে পারি অথচ চারিদিক দেখবার কি বন্দুক চালাবার কোনো অসুবিধা না ঘটে। কত সামান্য আড়াল হলেই যে লুকোবার সুবিধা হয়, শিকার পাশ দিয়ে অসন্দিগ্ধ চিত্তে যায়, দেখতে পায় না, সেকথা সহজে বিশ্বাস হয় না। মানুষের গন্ধ হয়তো-বা পায়, কিন্তু বেলা বাড়তে আরম্ভ করলে সে-গন্ধও কম হয়ে আসে। আর যদি চুপচাপ বসে থাকা যায়, তাহলে সেদিকে মনোযোগ আকৃষ্ট হবার, ধরা পড়বার সম্ভাবনা বড়ো একটা থাকে না। প্রকাণ্ড একটা হিংস্র জন্তু পাশ দিয়ে যখন চলে যায় তখন স্থির হয়ে থাকা কঠিন কাজ, কিন্তু অভ্যাস ও সাধনার বলে শিকারির মজ্জা-পেশি ক্রমে ইস্পাতের মতো দৃঢ় হয়ে ওঠে। তখন কোথাও আর এতটুকু কাঁপে না, কি নড়ে না। আমি যে জায়গাটি পছন্দ করে নিয়েছিলাম, সেখান হতে চারিদিকে গাছপালা আর গলিঘুঁজির জন্যে হাত বিশেক তফাতে গুলি করাটা তেমন নিরাপদ ছিল না। সেখানে আমার ডান পাশে পাহাড়টা গড়িয়ে নালার দিকে নেমে গিয়েছিল। K. G. Bকে একখানি ছোটো খাটিয়া মাচান করে বেঁধে দেওয়া হয়েছিল আর সেইখানকার একজন গৌঁটিয়া তার সঙ্গে ছিল। চট করে গাছে চড়ে পড়বার ক্ষমতা তার অদ্ভুত। আর তা ছাড়া স্থান যতই সংকীর্ণ হোক না কেন, সে তারই মধ্যে অবলীলাক্রমে নিজের ঘুরবার ফিরবার সুবিধা করে নিত; কোনোরকমে আড়ষ্ট হত না। এই চতুর লোকটির তা ছাড়া বন্দুকের তাকও ছিল।

প্রায় ঘণ্টাখানেক প্রতীক্ষার পর বনের মধ্যে হতে যেসব শিকারিরা বাঘ তাড়া করে আনছিল তাদের শোরগোল শোনা গেল। আরও কিছুক্ষণ যাবার পর আমাদের মধ্যে জনকয়েককে পাহাড়ের মাথার উপর দেখতে পেলাম। মুহূর্তের মধ্যে দেখলাম স্থূলাঙ্গী একটি ব্যাঘ্রী ত্বরিত গমনে নালার মধ্য-ঘাট পার হয়ে আসছে। নিমেষের জন্য সে প্রস্তরস্তূপের ব্যবধানে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। পরমুহূর্তেই তার মস্তক আর গ্রীবাদেশ দৃষ্টিগোচর হবা-মাত্রই আমি তার স্কন্ধদেশ লক্ষ করে বন্দুক ছুড়লাম। সে আমার বাঁয়ে দশ গজ দূরে ছিল। আমার বন্দুক তুলতে সামান্য কী একটু শব্দ হয়েছিল তাতেই সে ঘাড় ফিরালে। গুলি তার কানের মধ্যে দিয়ে ঘাড়ে গিয়ে লাগল। তৎক্ষণাৎ সে ধূলিলুণ্ঠিত হয়ে পড়ল। দ্বিতীয় গুলি মারবার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছিলাম, কিন্তু যখন দেখলাম সে আর নড়াচড়া করলে না, তখন বন্দুকের যে নলটি খালি হয়ে গিয়েছিল সেইটি আবার পুরে কী ঘটে দেখবার জন্যে অপেক্ষা করে রইলাম। শিকারিরা কয়েকজন পাহাড়ের মাথা হতে একটু নেমে আমার ডাইনের দিকে, আর বাকি কয়েকজন সম্মুখে কিছু দূরে সতর্ক হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। যতক্ষণ মৃগয়াভিনয়ের যবনিকাপতন না হয় ততক্ষণ এ সাবধানতা বিশেষ আবশ্যক। জয়গর্বে উৎফুল্ল আমি আর স্থির হয়ে থাকতে পারলাম না। সংকেতসুচক বাঁশিটি বাজিয়ে দিলাম। তখনই চারিদিক হতে জয় জয় শব্দে মহাকোলাহলে সকলে সে সংকেতে মহানন্দ প্রকাশ করলে ও নিকটে এল। K. G. B. আর গৌঁটিয়া দুজনেই আমার কাছাকাছি ছিলেন। সবাই এসে ঘিরে দাঁড়িয়ে ব্যাঘ্ররাজ-পত্নীর রাজযোগ্য অঙ্গাবরণ আর বর্ণের প্রশংসা করতে লাগলেন।

অবিলম্বে বাঘিনীকে এক পর্যঙ্কে শয্যা রচনা করে দিয়ে, বাহকেরা সমারোহে শোভাযাত্রা করলে। আমি আর K. G. B. গজারোহণে আর সেই গৌঁটিয়া গজরাজের পুচ্ছদেশে লম্বমান হয়ে তাদের অনুসরণ করলাম। পথে গ্রামবাসীরা আমাদের সঙ্গ নিলে। কাছে গিয়ে দেখলাম বাঘিনীটি কৃশোদরী। তার চামড়াখানি বড়োই সুন্দর।
শিকার করে এমন সুন্দর বাঘছাল যদি লাভ হয়, তবে তাকে রক্ষা করবার জন্য বিশেষ যত্ন করতে হয়। আমরা প্রসিদ্ধ চর্মশোধনকারী Messrs. Rowland Ward-এর নিকট ওই চামড়া লন্ডন শহরে পাঠিয়ে দিলাম। তখন জার্মানদের অনুগ্রহে জাহাজডুবির অসম্ভাবনা ছিল না। এর আগে আর পরে যেসব পার্সেল পাঠিয়েছিলাম, সবগুলিরই পৌঁছানো সংবাদ যথাসময়ে আমার হস্তগত হল, কিন্তু এ চামড়ার অনেকদিন কোনো সংবাদ না পাবার পর একদিন হৃদয়বিদারক সংবাদ এল যে, শত্রুপক্ষের বিরুদ্ধাচরণে পার্সেলটি হারিয়ে গিয়েছে! হায়, এমন বিজয়-আনন্দের পরিণাম যে এমন শোকাবহ হবে তা কে জানত! কিন্তু এ ক্ষতি পূরণ হবার উপায় ছিল না!

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন