বিশ্বদেব গঙ্গোপাধ্যায়

জিতেন্দ্রকিশোর আচার্য চৌধুরী
প্রভাতে তাম্বুর বাহিরে পদার্পণ করিবামাত্র আমাদের 'খুঁজি' 'সাধুর বাপ' দন্তপংক্তি উৎঘাটিত করিয়া হাস্যমুখে অভিবাদনপূর্বক করজোড়ে আমাদের সম্মুখে দণ্ডায়মান হইল। প্রভাতে এমন একজন ধর্মাত্মার হাস্যকৌমুদীচ্ছটা-সমুজ্জ্বল, বিকশিত-দশন-সুশোভিত মুখমণ্ডল দর্শন করিয়া সেদিন আমার শিকারের পক্ষে শুভদিন হইবে বলিয়া আশা করিলেও আমার আশা কিরূপ ফলবতী হইয়াছিল, তাহা পাঠক শীঘ্রই জানিতে পারিবেন। যাহা হউক, সে অনাবশ্যক বাকচাতুর্যে আমাদিগকে খুশি করিবার চেষ্টা না করিয়া সংক্ষেপে যে সংবাদ আমাদের গোচর করিল, তাহা সুসংবাদ বটে এবং যথেষ্ট উৎসাহজনক। সে বলিল, বাঘে ঘোড়া মারিয়াছে এবং বাঘটা মড়ি লইয়া ঘুমাইতেছে— তাহাও সে দেখিয়া আসিয়াছে। প্রভাতে উঠিয়া শিকারীর পক্ষে ইহা অপেক্ষা আর কি সুসংবাদ থাকিতে পারে? 'শুভস্য শীঘ্রম'— আমরা তাড়াতাড়ি প্রস্তুত হইয়া লইলাম।
যে জঙ্গলে ব্যাঘ্রাচার্যের নিদ্রাসুখ উপভোগের সংবাদ পাওয়া গেল, সেই জঙ্গলটি তাম্বুর প্রান্তবাহিনী বিলের অপর পারে অবস্থিত। এই জঙ্গলের আকার কতকটা ইংরাজী Y অক্ষরের অনুরূপ। প্রথমে কিছুদূর জঙ্গল, তাহার পরেই একটি খাল। খাল পার হইবার অব্যবহিত পরেই জঙ্গলটির দুই শাখা দুই দিকে প্রসারিত। জঙ্গলগুলি বিলের 'কাঁধী'র সন্নিবিষ্ট। আমরা এই জঙ্গলের কিনারায় উপস্থিত হইয়া হাতীর সারি করিলাম। কি প্রণালীতে ব্যূহ রচিত হইল, এখানে তাহার একটু বিবরণ দেওয়া আবশ্যক। দক্ষিণে আমি, আমার পরে কাকা, বাবা, দাদা মহাশয়, মহেশদা, মদনদা, নরেন্দ্র এবং সকলের উত্তরে তাউই মহাশয়। আমাদের হাওদা এইভাবে পরপর এক সারিতে সংস্থাপিত হইল। দুই দুই হাওদার ব্যবধানে তিন চারিটি করিয়া খালি হাতী (যাহাদের উপর কোন শিকারি অধিষ্ঠিত ছিলেন না) সন্নিবিষ্ট হইয়াছিল।
এইভাবে আমরা শ্রেণীবদ্ধ হইয়া ধীরে ধীরে জঙ্গল ভাঙ্গিয়া অগ্রসর হইতে লাগিলাম। চলিতে চলিতে আমরা প্রায় খালের কিনারায় উপস্থিত হইয়াছি, এমন সময় আমি দেখিতে পাইলাম— বাঘ খাল প্রায় পার হইয়া যায় আর কি!— আমি যে একজন শিকারী বাঘ শিকার করিতেই এই অরণ্যে প্রবেশ করিয়াছি, হাতে বন্দুক আছে, তাহা তুলিয়া অনায়াসেই বাঘটাকে মারিতে পারি, এবং তাহাই কর্তব্য, নতুবা শিকার অদৃশ্য হইতেও পারে, এ সকল কথা তখন আমার মনেও আসিল না। আমি সুযোগ ত্যাগ করিতেছি ইহা বিস্মৃত হইয়া, শিকার দর্শনেই আনন্দাভিভূত হইয়া তুড়ি দিয়া কাকাকে ডাকিয়া বলিলাম, 'শিকার যে যায়; শীঘ্র মারুন।' কাকা তৎক্ষণাৎ বন্দুক তুলিয়াই গুলি করিলেন। হঠাৎ ডাক শুনিয়া ফিরিয়া হাতী থামাইয়া গুলি করিতে সম্ভবত গুলিটা একটু নড়িয়া গিয়াছিল। কাকা বাঘের পৃষ্ঠ লক্ষ করিয়াই গুলি করিয়াছিলেন, কিন্তু আমি দেখিলাম গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হইয়া বাঘের পায়ের দাবনা ঘেঁষিয়া জলে পড়িল। কাকা তাহাতে দ্বিতীয়বার গুলি করিবার আর অবসর পাইলেন না! কাকা তখন আমার অমনোযোগের ও সুযোগ থাকিতে যথাসময়ে গুলি না করার ত্রুটির জন্য আমাকে তিরস্কার করিলেন; আমি আমার ত্রুটি অস্বীকার করিতে পারলাম না; অপরাধী ছাত্রের মতো নিঃশব্দে তাঁহার তিরস্কার পরিপাক করিয়া সংকল্প করিলাম খাল পার হইয়া পুনর্বার লাইন করিতে হইবে।
পূর্বেই বলিয়াছি, খালের পরপার হইতেই জঙ্গলের দুই বাহু দুই দিকে প্রসারিত হইয়াছে। বাঘটাকে যেদিক দিয়া যাইতে দেখিয়াছি সেই দিকেই লাইন করিতে বলিলাম। কিন্তু তাউই মহাশয় তাহার বিপরীত দিক দেখাইয়া বলিলেন, 'বাঘ ঐদিকে গিয়াছে।' সেই দিকের জঙ্গল কম বলিয়া সেই জঙ্গলটি প্রথমে ভাঙ্গিয়া দেখাই সকলের যুক্তিসংগত মনে হইল। তখন আমরা লাইন করিয়া জঙ্গল ভাঙ্গিতে প্রবৃত্ত হইলাম। জঙ্গল ভাঙ্গিতে ভাঙ্গিতে আমরা জঙ্গলের প্রায় শেষ সীমায় উপস্থিত হইয়াছি, এমন সময় একটি ছোপা হঠাৎ নড়িয়া উঠিল। তাউই মহাশয় কিঞ্চিৎ অগ্রসর হইয়া সেই কম্পমান জঙ্গলের উপর চারি বন্দুক হইতে আটটি গুলি নিক্ষেপ করিলেন! সুতরাং ব্যাঘ্ররাজ সেই জঙ্গলে লুকাইয়া থাকিলে তাহার পঞ্চত্ব লাভ তো সামান্য কথা— তাহার সর্বাঙ্গ ঝাঁঝরা হইয়া যাইত, ইহা অসংকোচে দৈববাণী করা যাইতে পারে। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে বাঘ তখন সেখানে ছিল না; তবে জঙ্গলে নড়িবার কারণ কি? বোধহয় এই প্রশ্ন মুহূর্তের জন্য সকল শিকারীর মনেই উদিত হইয়াছিল, কিন্তু এই সমস্যার মীমাংসা হইতেও অধিক বিলম্ব হইল না, কারণ সেকেণ্ড দুই পরেই একটি হাঁড়িচাঁচা পাখী সেই ছোপার ঘন পল্লবদলের অন্তরাল হইতে বাহির হইয়া সবেগে পক্ষান্দোলন করিতে করিতে উড়িয়া গেল; আর কিছুই দেখিতে পাওয়া গেল না। আমরা জানিতাম, জানোয়ার দেখিয়াই নিশানা করা উচিত; অন্ততঃ আমরা এইরূপই শিক্ষা পাইয়াছিলাম। কিন্তু তাঁহারা বলেন, জঙ্গল নড়িতে দেখিলে অনুমানের উপর নির্ভর করিয়া গুলি ছুঁড়িতে হইবে। আমার মনে হয় এই কাজটি অধিকতর কঠিন তো বটেই, তাহার উপর শিকার করিয়া যে আনন্দ ও তৃপ্তি হয়, জঙ্গল নড়িতে দেখিয়া কেবল অনুমানের উপর নির্ভর করিয়া অদৃশ্য শিকারের উদ্দেশ্যে গুলি বর্ষণে সেই আনন্দ ও তৃপ্তি আসিতেই পারে না। জঙ্গল নড়িতে দেখিয়া শব্দভেদী নিশানায় বন্দুকের গুলি যদি শিকারের দেহে বিদ্ধ হয়, তাহা হইলে গণিতজ্ঞ পণ্ডিতেরা এই লক্ষ্যভেদ-কাহিনী উজ্জ্বলবর্ণ-রাগে রঞ্জিত করিয়া তৎসম্বন্ধে সুন্দর আলোচনা করিতে পারেন এবং তাহার উপর দীর্ঘকাল ত্রিকোণমিতি পরিমিতির গবেষণাও চলিতে পারে, কিন্তু এইরূপ শিকারে শিকারীর মনে লক্ষ্যভেদ-জনিত আনন্দের সঞ্চার হয় না। অমুক শিকারী ঝোপ নড়িতে দেখিয়া গুলি করিয়া বাঘ মারিয়াছেন শুনিয়া অনেকে বিস্ময়াপ্লুত হৃদয়ে বাহবা দিবেন সন্দেহ নাই, কিন্তু তাহা কি অন্ধকারে লোষ্ট্র নিক্ষেপ দ্বারা অদৃশ্য লক্ষ্যকে আহত করার ন্যায় দৈবায়ত্ত ব্যাপার নহে? লক্ষ্যভেদের এইরূপ সার্থকতায় অন্য কেহ আনন্দ ও তৃপ্তিলাভ করিতে পারেন কিনা জানি না, কিন্তু আমি দুর্ভাগ্যক্রমে সে রসে বঞ্চিত!
যাহা হউক 'পর্বতের মূষিক প্রসবের' অর্থাৎ ব্যাঘ্রের উলম্ফনের পরিবর্তে হাঁড়িচাঁচার পক্ষান্দোলনে আমরা কতকটা নিরুৎসাহ হইয়া সেই দিক হইতে প্রত্যাবর্তন-পূর্বক অন্য দিকে 'লাইন' করিলাম। পূর্ববারের লাইনে যাঁহার যে স্থান নির্দিষ্ট ছিল, এবারও তাহাই থাকিল, কেবল আমার স্থানটি কাকা অধিকার করিলেন। বাঘের পায়ে গুলির আঁচড় লাগিয়াছে, দুই হাওদার ব্যবধানে আমার স্থান-নির্দেশের ইহা একটি কারণ হইলেও, দ্বিতীয় কারণ এই যে, আক্রান্ত ব্যাঘ্র জঙ্গলের কিনারা ঘেঁষিয়া পলায়নের চেষ্টা করিবে ইহা সকলেই বুঝিয়াছিলেন; আমিও দোষের দায় হইতে মুক্তিলাভের এই সুযোগ ত্যাগ না করিয়া স্বেচ্ছায় স্থান পরিবর্তন করিলাম। কারণ, সিদ্ধহস্ত বহুদর্শী শিকারীর নিকট হইতে বাঘ পলায়নে সমর্থ হইলে তাহা বাঘের সৌভাগ্য বা দীর্ঘায়ুর নিদর্শন বলিয়াই সর্বসম্মতিক্রমে গ্রাহ্য হইয়া থাকে, কিন্তু যাঁহারা পাকা শিকারীর শ্রেণীতে প্রমোশন পান নাই, দুর্ভাগ্যক্রমে যদি তাঁহাদের হাত হইতে শিকার পলায়ন করে, তাহা হইলে তাহা তাহার সৌভাগ্য বা দীর্ঘায়ুর নিদর্শন বলিয়া স্বীকার করিতে সাধারণতঃ প্রায় কেহই সম্মত হন না। শিকারের অদৃষ্ট বা পরমায়ুর কথা চাপা পড়িয়া শিকারীর অদৃষ্ট ও হস্তের অপযশের কথাই মুক্তকণ্ঠে ঘোষিত হয়, এবং সর্বসম্মতিক্রমে তাহা প্রতিপন্ন হইয়া যায়। সুতরাং স্থান পরিবর্তনে আমার ক্ষুব্ধ বা নিরুৎসাহ হইবার কোন কারণ ছিল না।
আমরা এই নূতন 'লাইন' করিয়া কিছুদূর অগ্রসর হইতেই আমাদের সম্মুখস্থ জঙ্গল বেশ প্রবলভাবেই আন্দোলিত হইয়া উঠিল। এইভাবে জঙ্গল দেখিয়া আমি স্পষ্ট বুঝিতে পারিলাম, ব্যাঘ্রদেহের সংঘর্ষণে পাদপরাজি আলোড়িত হইতেছে, ব্যাঘ্রপ্রবর আমার সম্মুখ দিয়াই অগ্রসর হইতেছেন। পূর্ববারের ব্যর্থতার কথা আমি এত শীঘ্রই বিস্মৃত হই নাই, এজন্য এবার আর কাহাকেও ডাকাডাকি করিলাম না এবং আমি স্বয়ং যে কার্য করিতে পারি সে ভার অন্যের হস্তে সমর্পণ করিতেও আগ্রহ হইল না। আমার ঠিক সম্মুখেই জঙ্গলের ভিতর দিয়া একটি সংকীর্ণ অরণ্যপথ আড়াআড়িভাবে প্রসারিত ছিল। জঙ্গলের আন্দোলনে বাঘের গতি নির্ধারণ করা কিছুমাত্র কঠিন মনে হইল না। আমি তৎক্ষণাৎ বুঝিতে পারিলাম, বাঘকে সেই সংকীর্ণ পথটি অতিক্রম করিয়া যাইতে হইবে। সে সেই পথে পদার্পণ করিবামাত্র আমি তাহাকে সুস্পষ্টরূপে দেখিতে পাইব এ বিষয়ে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ না থাকায়, আমি বন্দুক হাতে লইয়া ঘোড়া তুলিয়া সম্পূর্ণ প্রস্তুত হইয়া রুদ্ধ-নিশ্বাসে তাহার প্রতীক্ষা করিতে লাগিলাম, —বাঘ পথের উপর যেমন পদার্পণ করিবে সেই মুহূর্তেই গুলি মারিব।
কিন্তু দৈবের বিধান অলঙ্ঘনীয়, কোথা হইতে কোন কল্পনাতীত বিঘ্ন আসিয়া আমাদের সকল সংকল্প ব্যর্থ করিয়া দেয়, এবং অচিন্ত্যপূর্ব দৈবশক্তির প্রচণ্ড প্রতিকূলতায় আমাদের শক্তি-সামর্থ্য মুহূর্তে ব্যাহত ও চূর্ণ হইয়া যায়, ইহা প্রতিপন্ন করিবার জন্যই যেন দৈববিড়ম্বনায় সেই মুহূর্তে আমার হাতী হঠাৎ সম্পূর্ণ অতর্কিতভাবে ভূমিকম্পসঞ্জাত একটি ফাটলের ভিতর পড়িয়া গেল। রণজয়ের পূর্বমুহূর্তে যেন জননী বসুন্ধরা দ্বিধা বিভক্ত হইয়া কুরু-সেনাপতি অঙ্গরাজ কর্ণের রথচক্র গ্রাস করিলেন।
আমি সে সময় আমাদের যে হাতীর উপর ছিলাম, তাহার নাম চমকতারা। চমকতারাকে সেই ফাটলের ভিতর পতনোন্মুখ দেখিবামাত্র আমার ধারণা হইল, সে একেবারেই উল্টাইয়া পড়িবে। আমি এই আকস্মিক বিপৎপাতে কিংকর্তব্যবিমূঢ় না হইয়া চক্ষুর নিমেষে বন্দুকটা নীচে নিক্ষেপ করিয়া হাওদার একপ্রান্ত দৃঢ়মুষ্টিতে ধরিয়া ফেলিলাম। এইভাবে হাওদা ধরিতে যদি এক মুহূর্ত বিলম্ব হইত বা হাত ফসকাইয়া যাইত, তাহা হইলে আমি বোধহয় সম্মুখের দিকে ডিগবাজী খাইয়া হাওদা হইতে জঙ্গলের ভিতর নিক্ষিপ্ত হইতাম, এবং বাঘটা সেই মুহূর্তে সেইস্থানে আসিয়া পড়িলে শিকারীকেই সম্ভবতঃ শিকারের বদন-কবলিত হইতে হইত! অবস্থাটা কিরূপ আরামজনক হইত, পাঠক-পাঠিকাগণ তাহা সহজেই কল্পনা করিতে পারিবেন।
যাহা হউক হাতীর বুদ্ধি-কৌশলে অবস্থানটা তেমন সাংঘাতিক বিপজ্জনক হইবার সুযোগটি নষ্ট হইয়া গেল। কারণ, চমকতারা পতনোন্মুখ হইবামাত্র তাহার সুদীর্ঘ শুণ্ড প্রসারিত করিয়া তদ্দারা ফাটলের অপর পাড় অবলম্বন-পূর্বক সামলাইয়া লইবার চেষ্টা করিল, নতুবা আমার ভাগ্যে যাহা ঘটিবার ঘটিত, তাহার উপর হাওদাখানিও ভাঙ্গিয়া চূর্ণ হইত। কিন্তু এখানেই বিপদের সম্ভাবনা দূর হইল না; আমার সেই হস্তচ্যুত নল উঁচু করিয়া উদ্যতফণা বিষধর অপেক্ষা সহস্রগুণ অধিক সাংঘাতিক বিপদের সূচনা করিয়া সেই ফাটলের ভিতর বসিয়া রহিল! সেই সংকটময় মুহূর্তে আমি সম্মুখে দৃষ্টিপাত করিয়া ব্যাঘ্রের অঙ্গশোভা সুস্পষ্ট দেখিতে পাইলাম, এবং তাহার প্রশস্ত ললাটতলে জ্বলন্ত অঙ্গারের ন্যায় ক্রোধ-প্রদীপ্ত দুইটি উজ্জ্বল অগ্নিগোলক ভাস্বর প্রভা বিকীর্ণ করিয়াও যে তাহার এই সুখসেব্য দ্বিপদ মিত্রটির প্রতি লোলুপদৃষ্টি নিক্ষেপের সুযোগ পাই নাই, এ অপবাদ দিলে তাহার প্রতি অত্যন্ত অবিচার করা হয়। সে যে আমার গজস্কন্ধে তৎক্ষণাৎ লাফ দিয়া পড়িল না, ইহার কারণ আমার শোচনীয় অবস্থা দর্শনে তাহার মনে বোধহয় কিঞ্চিৎ করুণার সঞ্চার হইয়াছিল, এবং অবজ্ঞাভরে হাস্য করা তাহার পক্ষে সম্ভব হইয়া থাকিলে আমার সেই 'সসেমিরা' অবস্থা নিরীক্ষণ করিয়া সে নিশ্চয়ই 'অথান্ধকারং বন-পন্থানম দংষ্ট্রাময়ুখৈ সকলানি কুর্বন' একটু হাসিয়াছিল।

কিন্তু এই অবস্থায় অধিককাল থাকিতে হইল না। বাবা আমার অবস্থা দেখিয়া কি ভাবিলেন বলিতে পারি না, কিন্তু তাঁহার স্বাভাবিক ধীরতার অভাব হয় নাই, ইহা সহজেই বুঝিতে পারা গেল। তিনি তৎক্ষণাৎ আমার পার্শ্বে কিঞ্চিৎ সরিয়া আসিয়া বাঘটিকে গুলি করিলেন। গুলি তাহার কোমরের নিকট লাগিলেও তাহার উত্থানশক্তি রহিত করিতে পারিল না। গুলি খাইয়া সে তাহার সম্মুখস্থিত ভূমিকম্পের আর একটি ফাটলে প্রবেশপূর্বক সেখানে আশ্রয় গ্রহণ করিল। যে হাতীর পিঠে বাবার হাওদা ছিল তাহার নাম ভোলানাথ। বাবা যে সময় বাঘটাকে গুলি করেন, হাতীটা সেই সময় আমার পরিত্যক্ত উদ্যত-নল বন্দুকের উপর দাঁড়াইয়াছিল! হঠাৎ ভোলানাথের চরণস্পর্শে বন্দুকের ঘোড়া নড়িয়া গিয়া একটা শোচনীয় বিভ্রাট ঘটিতে পারে এই আশঙ্কায় সতর্ক করিবার জন্য কত চিৎকার করিলাম, কিন্তু 'কাকস্য পরিবেদনা'— আমার চিৎকার অরণ্যে রোদনবৎ হইল, কেহই আমার কথা কানে তুলিলেন না! যাহা হউক, দৈবানুকম্পায় কোন বিভ্রাট ঘটিল না, বাবার হাতী ভূ-বিবরশায়ী শার্দূলের অনুসরণ করিলে, আমি অনেক সাহস ভরসা দিয়া তিনচারিটা হাতী সেই স্থানে আনাইয়া, তাহাদের দ্বারা স্থানটি পরিবেষ্টিত করিয়া বন্দুকটা তুলিয়া লইলাম, কিন্তু তখন আমার মনের অবস্থা কিরূপ শোচনীয় হইয়াছিল, তাহা প্রকাশ করিবার শক্তি নাই। বাঘটা একবার নহে, দুইবার আমার সম্মুখে আসিয়া দেখা দিল, অথচ দুইবারই তাহাকে মারিবার সুযোগ ব্যর্থ হইল! একবার স্বেচ্ছায় সুযোগ ত্যাগ করায় আর একবার দৈবের প্রতিকূলতায় সুযোগ নষ্ট হওয়ায়, মন এমন দমিয়া গেল যে, মনে হইতে লাগিল আমি হয়ত কোন দিনও বাঘ মারিতে পারিব না! ক্ষোভে, দুঃখে, আত্মগ্লানিতে আমার দেহমন যেন অবসন্ন হইয়া পড়িল। আমি ফাটল হইতে বন্দুকটা তুলিয়া লইতে লইতে বাঘটা ব্যাঘ্রলীলা সংবরণ করিল। আমি বিমর্ষভাবে সেইস্থানে দাঁড়াইয়া আকাশ-পাতাল ভাবিতে লাগিলাম।
বাবা যেস্থানে বাঘটাকে গুলি করিয়াছিলেন, সেই স্থানে তাহার আহত অঙ্গ হইতে শোণিত নিঃসারিত হইয়া মৃত্তিকার কিয়দংশ সিক্ত করিয়াছিল। এতদ্ভিন্ন তাঁহার গুলিতে আহত হইয়া বাঘটা যে পথে ধাবিত হইয়াছিল, সেই পথে তাহার রক্তধারা ছাড়াইতে ছড়াইতে গিয়াছিল। সুতরাং সেই পথের সর্বস্থানেই রক্তচিহ্ন সুস্পষ্ট দেখা যাইতেছিল। বাঘটা পঞ্চত্বলাভ করিলে আমি পথের সেই রক্তচিহ্নগুলি লক্ষ্য করিতেছিলাম, এমন সময় নরেন্দ্র হঠাৎ আমার কাছে আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, 'বল তো, বাঘটা কে মেরেছে?' আমি তাহার এই প্রশ্নে ঈষৎ বিস্মিত হইয়া বলিলাম, 'বাঘটা বাবা মেরেচেন। তাঁরই প্রথম গুলি, আর সে গুলি বাঘের গায়ে লাগতেও দেখেছি।' বাবার গুলি খাইয়া বাঘের দেহনিঃসৃত রক্তে যে স্থানটা ভিজিয়া গিয়াছিল তাহাও তাহাকে দেখাইলাম। আমার উত্তর শুনিয়া সে মুখ খুব গম্ভীর করিয়া চলিয়া গেল; তাহার মুখ কিজন্য যে সহসা নিদাঘাপরাহ্নের মেঘকান্তিবৎ অপ্রসন্ন হইয়া উঠিল সে রহস্য আমি তখন বুঝিতে না পরিয়া একটু বিস্মিত হইলাম। কিন্তু পরে বুঝিতে পারি। ঘটনাটা এই—
বাঘটা ভূমিকম্পের ফাটল হইতে বাহির হইয়া প্রথমেই নরেন্দ্রের হাতীকে আক্রমণপূর্বক পা কামড়াইয়া ধরে; নরেন্দ্র গুলি করায় বাঘটা হাতীটাকে পরিত্যাগ করিয়া ভূমিকম্পের ফাটলের ভিতর দিয়া চলিতে আরম্ভ করে। মদন দাদাও আমার মতন ভূমিকম্পের ভিতর পড়িয়াছিলেন; বাঘটা ফাটলের ভিতর দিয়া যাইতে যাইতে তাঁহার হাতীর শুঁড় কামড়াইয়া ধরিল। সেই অবস্থায় হাতী ফাটলের উপর উঠিয়া দাঁড়াইল, কিন্তু বাঘ তখন শুঁড় পরিত্যাগ না করায় সে শুঁড়েই ঝুলিতে লাগিল। সেই সুযোগে মদন দাদা বাঘকে দুইটি গুলি মারেন; প্রথম গুলি খাইয়াই বাঘ হাতীর শুঁড় পরিত্যাগ করিল, দ্বিতীয় গুলিতেই তাহার ইহলীলার অবসান হইল।
নরেন্দ্রর ধারণা হইয়াছিল, সর্বপ্রথম তাঁহারই গুলি বাঘের গায়ে লাগিয়াছিল, তাহার পূর্বে আর কাহারও গুলি বাঘের অঙ্গ স্পর্শ করে নাই। এই জন্যই সে প্রথমে বাঘের দাবী করিয়াছিল। ঠিক এই ধারণার বশবর্তী হইয়া মদন দাদাও তাঁহার শিকার বলিয়া বাঘের দাবী করিয়া বসিলেন। তাঁহারা উভয়েই বাঘের অধিকার লইয়া বাদানুবাদ করিতেছেন, এমন সময় বাবা সেখানে উপস্থিত হইয়া বলিলেন, 'তোমরা ঝগড়া করিও না, বাঘ আমার।' এই কথায় নরেন্দ্র মনে করিল, বাবা বোধহয় ঝগড়া চাপা দেওয়ার জন্য মদন দাদার পক্ষাবলম্বন করিয়াই এই মন্তব্য প্রকাশ করিলেন। সুতরাং শিকার যে তাহারই, ইহা প্রতিপন্ন করিবার উদ্দেশ্যেই নরেন্দ্র আমার নিকট আসিয়া ঐরূপ প্রশ্ন করিয়াছিল। আমি তাহার ভ্রম বুঝিতে পারিয়া তাম্বুতে ফিরিয়া আদ্যোপান্ত সকল কথা তাহার গোচর করিলাম; অতঃপর সে বোধহয় সে সকল কথা আর মনেও স্থান দেয় নাই।
আমরা তাম্বুতে প্রত্যাগমন করিলে বাঘের চামড়াখানি ছাড়াইয়া লওয়া হইল। চামড়া ছাড়াইয়া লওয়া হইলে মাংসের লোভে একপাল শকুন পড়িল। এই সকল শকুনি স্বাভাবিক সংস্কার-বলে বুঝিতে পারে, আমাদের অনুসরণ করিলে তাহাদের ক্ষুন্নিবারণের ব্যবস্থা হইবে, সুতরাং আমরা তাম্বু উঠাইবামাত্র শকুনির পাল তাম্বুর নিকট আসিয়া সংযোগের প্রতীক্ষায় বসিয়া থাকে। আমরা যখন যেখানে তাম্বু স্থাপন করি, শকুনির পাল আমাদের উদ্দেশ্য বুঝিতে পারিয়া সেই স্থানেই আমাদের অনুসরণ করে এবং তাম্বু উঠিলেই তাহারা নিকটবর্তী কোন বৃক্ষে আশ্রয় গ্রহণ করে। বাঘ মারা হইলে তাহাদের আনন্দ ও উৎসাহর সীমা থাকে না। কারণ বাঘের সমস্ত মাংসই ইহারা খাইতে পায়, যেন ইহাদের জন্যেই আমাদের ব্যাঘ্র শিকার। বাঘের মাংসে উদর পূর্ণ করিয়া পরদিন ইহারা নদীতে দীর্ঘকাল ধরিয়া স্নান করে। যে শকুনি অধিক পরিমাণে বাঘের মাংস উদরস্থ করে, তাহার কেবল স্নান করিলেই চলে না— সে বুক পর্যন্ত বসিয়া থাকিয়া শরীর শীতল করে। দীর্ঘকাল জলে পড়িয়া থাকিলে প্রচুর মাংসাহারজনিত দৈহিক উত্তাপ প্রশমিত হইয়া শরীর স্নিগ্ধ হইবে, এ শিক্ষাও বোধ হয় তাহাদের সহজাত সংস্কারের ফল।
রাত্রিকালে তাউই মহাশয়ের হাতীর একটি শাবক পিলখানা হইতে ছুটিয়া বাহির হইয়া তাম্বুর সীমায় প্রবেশ করিয়া নানা উপদ্রবে সুনিদ্রার ব্যাঘাত ঘটাইয়াছিল। তাম্বুর ভিতরে বাঘের তেলের একটি টিন ছিল, তাহা সে উল্টাইয়া ফেলিয়া দেয়, এবং চাল ডাল প্রভৃতি আহার্য দ্রব্যও কিছু কিছু নষ্ট করে। তাহার এই উপদ্রবে বিস্মিত হইবার কারণ নাই; পোষা হাতীর শাবকগুলি সাধারণতঃ অত্যন্ত দুর্দমনীয় ও দুরন্ত হইয়া থাকে।
অদ্য যে বাঘ শিকার হইল, সে বাঘিনী; দৈর্ঘ্যে আট ফিট নয় ইঞ্চি।
(বানান অপরিবর্তিত)
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন