বিশ্বদেব গঙ্গোপাধ্যায়

বিজয়কান্ত সেন
অন্তরের চিত্রশালায় কত চিত্রই সঞ্চয় করে গেছি, তার কতক গেছে হারিয়ে, কতক-বা হয়ে এসেছে অস্পষ্ট ম্লান আর কতকগুলি রয়েছে প্রাঞ্জল রেখায় আঁকা। আমার ঘটনাবহুল জীবনের একটি ঘটনার কথা মনে পড়ে। সে আজ প্রায় ৪৩ বছর আগেকার কথা। চাকরিজীবনের আরম্ভে তখন আমার কর্মস্থল গিরিডিতে, সেটা ১৯১২ সাল। চঞ্চলা উশ্রী নদীর তীরের সেতুর কাছে উশ্রীভিলায় আমার বাসা বেঁধেছি। শিকারের শখ আমার কৈশোর থেকে, কিন্তু এখানে ঝোপঝাপ বা টুকরো জঙ্গল ছাড়া বড়ো জঙ্গল বলতে যা বোঝায়, তা কাছেপিঠে এক রকম নেই-ই বলতে গেলে। কার্যোপলক্ষ্যে নানা স্থানে আমায় সফরে যেতে হত। একদিন গাঁওয়া বলে একটি জায়গা থেকে সফর করে ফিরছি, নববর্ষার পুঞ্জ পুঞ্জ ঘন কালো মেঘে আকাশ গেছে ছেয়ে, বনের ভেতরে একটা ফাঁকা জায়গায় দেখি, একটা ময়ূর তার প্রকাণ্ড পেখম মেলে দিয়ে নাচছে, আর তারই কাছে আরও কতগুলো ময়ূর-ময়ূরী কেউ-বা খাবারের খোঁজে মাটি ঠোকরাচ্ছে, কেউ-বা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বিচিত্র সবুজের মাঝে তাদের রামধনু রং রচনা করেছে বর্ণের ইন্দ্রজাল। কিছুক্ষণ থেমে প্রকৃতির নাটমঞ্চের এই দৃশ্য উপভোগ করলাম, তারপর চললাম এগিয়ে। গাঁওয়ার পথে কোয়াড় বলে একটা জায়গা পড়ে, গিরিডি থেকে মাইল এগারো হবে। এখানে রাস্তার উত্তর দিকে ১০০ গজ দূরে বেশ খানিকটা জায়গার উপর জেলা বোর্ডের একটি ছোটো বিশ্রামাগার (Inspection Bungalow)। রাস্তার অপর পারে ঢালু নেমে গেছে, মেঘলা আকাশের পটভূমিকায় ঘন সবুজ বনে ঢাকা একটি পাহাড়, তারই কোলে একটি ঝিল রাস্তা থেকে ২০০ গজ দূরে বর্ষার জলে ভরপুর। চারিদিকে পলাশের ছোটো ছোটো নতুন জল পেয়ে সবুজ সতেজ। জায়গাটি বড়োই মনোরম। স্থির করলাম দু-এক দিন ছুটি নিয়ে এখানে এসে কাটিয়ে যাব বাড়ির সকলকে সঙ্গে নিয়ে। সেদিনটা ছিল বৃহস্পতিবার, সামনের শনিবারই এখানে কাটাব মনে করে বাংলোর চৌকিদারকে সেই মতো বন্দোবস্ত রাখবার কথা বলে গেলাম।
মি. H. W. Williams I. C. S. তখন ওখানকার সাব-ডিভিশনাল অফিসার ছিলেন। তাঁর কাছে একটা দিন ছুটি নিয়ে শুক্রবার দুপুরে আমি সপরিবারে রওনা হলাম কোয়াড়। আমি আমার দ্বিচক্রযান সাইকেলে, অন্য সকলে পুসপুসে। আমার বন্ধু গিরিডির শ্রীবিপিন চৌধুরীকেও আমন্ত্রণ জানিয়ে গেলাম। স্থির হল, পরদিন সে সাইকেলে গিয়ে আমার সঙ্গে মিলিত হবে এবং ওখানেই খাওয়াদাওয়া করবে।
ওখানে পৌঁছে রাস্তার ওপারে হেঁটে বেড়াচ্ছি, দেখি একটি সাঁওতাল বিলের ওপারের বন থেকে বেরিয়ে রাস্তার অপর পারের বনের দিকে যাচ্ছে। আমি তাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলাম, 'তোর নাম কী রে?' সে বললে, 'বড়কু মাঝি।'
'হ্যাঁ রে, এখানে শিকার মিলবে?'
'শিকার করবি? কী শিকার? এখানে আছে বই কী।'
'ভালুক মিলবে এখানে?'
'বনা? হ্যাঁ, মিলবে। তাও আছে।'
তার সঙ্গে কথা বলে ঠিক করলাম, পরদিন বেলা দু-টার সময় তার বাড়ি যাব, তারপর সে আমাদের নিয়ে যাবে শিকারে।
বিপিন এলে খাওয়াদাওয়া সেরে আগের দিনের কথামতো বিপিন ও আমি বেরিয়ে গেলাম সাইকেলে সেই সাঁওতালটির গ্রামের উদ্দেশে। সেখানে গিয়ে শুনি যে বড়কু মাঝি বাড়ি নেই, জঙ্গলে গেছে। কী করি, আমি আর বিপিন একটা গাছতলায় অপেক্ষা করতে লাগলাম। প্রায় আড়াইটার সময় মাথায় এক বোঝা কাঠ নিয়ে ফিরল বড়কু। 'আমরা সেই দুটোর সময় থেকে বসে আছি শিকারে নিয়ে যাবি বলে, আর তুই গ্রাম ছেড়ে কোথায় চলে গেছিস বল তো?' বললাম আমি। সে জবাব দিল, 'আমাদের তো ঘড়ি নেই, কী করব বাবু, তা চল না এখনই নিয়ে যাচ্ছি।' বাড়িতে গায়ে কাঠের বোঝা নামিয়ে লোকটি ফিরল, কাঁধে গামছা, হাতে একটা ছোটো লাঠি, তার সে-চেহারাটা আজও চোখের সামনে ভাসছে। সঙ্গে চলল তার ন-দশ বছরের ছেলেটি, কোনো বাধা শুনল না।
বসতি থেকে উত্তর-পশ্চিম দিকে জায়গাটা ঢালু নেমে গেছে, কিছু দূরে গিয়ে একটি ছোট্ট নদী পর্যন্ত। সেই নদীর ধারে যেতেই বড়কু তার ছেলেকে বলল, 'মা হিজু পে' (আর আসিস না)। সে দু-একবার আপত্তি করে ফিরে গেল। নদীর ওপারে বনের শুরু। আর সেই বন ও উঁচু-নীচু জমি থেকে এক-একটা নালা এসে এই নদীতে মিশেছে, কোনো কোনোটার-বা আছে জলের ধারা, আবার কোনো কোনোটা-বা যখন নামে জোর বৃষ্টির ধারা, তখন সেই জল বয়ে আনে, আবার বৃষ্টি থেমে যাবার খানিক পর তার ধারা যায় শুকিয়ে, রয়ে যায় শুধু সিক্ততা। নদী পার হয়ে এই রকম এক-একটা নালার ভেতর ঢুকে বড়কু পায়ের দাগ খুঁজতে গিয়ে, একের পর এক দু-চারটে দেখার পরই একটাতে গোরুর খুরের দাগের মতো একটা দাগ একটু নিবিষ্ট মনে দেখল। প্রশ্ন করায় উত্তর দিল, 'শুয়োরের পায়ের দাগ, ওটা একোয়া শুয়োর।'
'পাওয়া যাবে ওকে?'
'যাবে, কিন্তু দেরি হবে।— তা তুই তো ভালুক মারবি, চল, তাই খুঁজি।'

সেখানেই আর একটু এগিয়ে মানুষের পদচিহ্নের মতো চিহ্ন; তাই দেখে খুব মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগল। পাঞ্জা চওড়া, লম্বায় খাটো, গোড়ালির কাছটা সরু, সামনের দিকটায় দু-একটা নখের দাগ। দাগটা ডান দিক থেকে এসে নালা পার হয়ে ধ্বসনা (যেখানটায় মাটি ধসে পড়েছে) দিয়ে বাঁ-দিকে উঠে গেছে। নরম মাটিতে তার পায়ের দাগের সঙ্গে নখের দাগ দেবে বসে গেছে। বড়কু সেই দাগ ধরে উপরে গেল, চারিদিক খুব ভালো করে দেখে নিল পদক্ষেপের বৈশিষ্ট্য এবং কত দূরে দূরে পড়েছে। আমরা কাছে যেতে আস্তে আস্তে বললে, 'বাবু, আমার জান তোর হাতে, মনে থাকে যেন।' আমি বললাম, 'আমাদের জান যতক্ষণ আছে, ততক্ষণ তুই নিশ্চিন্ত থাকতে পারিস।' তারপর সে মাটিতে চোখ রেখে অসমতল উঁচু-নীচু জমির উপর দিয়ে চলতে লাগল। কী দেখে চলেছে সে-ই জানে। জিজ্ঞাসা করলে অসহিষ্ণুভাবে জবাব দেয়, 'দেখতে পাচ্ছিস না? এই তো।' একটা ভাঙা ঘাসের ডগা, কোথাও-বা একটু কাঁকর সরে গেছে এইসব দেখায়। আমরা সত্যি কথা বলতে, এসব মোটেই বুঝতে পারি না। ও না দেখিয়ে দিলে আমাদের চোখেও পড়ত না এসব চিহ্ন। তখনও আমি শিকারে অনভিজ্ঞ, শিক্ষানবিশ মাত্র, পদচিহ্ন দেখে জন্তুজানোয়ার চেনা বা তাকে খুঁজে বের করা এর আগে কখনো জানতাম না, দেখিওনি। এ একটা নতুন বিজ্ঞান, আর এ বিজ্ঞানে আমার প্রথম গুরু বড়কু। নরম মাটিতে সচরাচর পায়ের দাগ দেখা যায়, কিন্তু শক্ত মাটিতেও যে পায়ের দাগ পাওয়া যায়, এ আমার জানা ছিল না, এই প্রথম দেখে বিস্মিত হলাম। এক ক্রোশ আন্দাজ গিয়ে আমাদের এক জায়গায় বলল, 'দাঁড়া তোরা, আমি ভালো করে খুঁজে আসি।' আমরা সেখানে দাঁড়ালাম। চারিদিকে ঝোপজঙ্গল, মাঝে মাঝে শাল গাছের সার, এখানে-ওখানে দেখা যায় নালা। একটু পরেই বড়কু ফিরে এসে বলল, 'ভালুক আছে। যেমন অবস্থায় আছে তেমন অবস্থায়ই খুঁজে দেখিয়ে দেব, মারবি, না, তাড়িয়ে বার করে দেব?' বললাম, 'তোর সঙ্গে গিয়ে মারলে তো পেছন থেকে মারব, তা আমি চাই না, তার চেয়ে তাড়িয়ে সামনে বের কর।' বিপিনকে দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করল, 'বাবু কি আলাদা দাঁড়াবেন?' বিপিন সবে শিকার শিখছে, তাকে গাছের উপর উঠিয়ে দিলাম। জঙ্গলে ত্রিশ ফুট চওড়া একটা সোতীর (ছোটো পার্বত্য নদী) কিনারে একটা ছোটো ঝোপের আড়ালে সে আমাকে দাঁড় করাল। গা ঝোপের আড়ালে রেখে দাঁড়ালাম। ঝোপের উপর দিয়ে সারা সোতী ও ওপার দেখা যায়। আমার পেছন থেকে দশ-পনেরো ফুট দূরে একটা নালা এসে সোতীতে মিশেছে। পেছন থেকে বন ও উঁচু জমির জল এই নালা দিয়ে সোতীতে পড়ে। ওপারটা কিছুদূর পরিষ্কার, তার ঝোপজঙ্গল ক্রমে বনে গিয়ে মিশেছে। আমার থেকে প্রায় পঞ্চাশ গজ দূরে ডাইনে গাছে বিপিন।

আমায় বড়কু বলে গেল, ওপার থেকে ভালুক সোজা সোতী পার হয়ে আসবে। আমরা যেদিক থেকে এসেছিলাম বড়কু সেদিকে চলে গেল। বোধ হয় কুড়ি-পঁচিশ মিনিট বাদে শুনলাম, ওপারের জঙ্গলের ভেতর ঠকঠক করে শব্দ হচ্ছে। দূরে গাছের গায়ে লাঠির আঘাত করলে যেরকম শব্দ হয়, সেইরকম শব্দ। কখনো কাছে, কখনো দূরে; একবার ডাইনে, একবার বাঁয়ে; এইভাবে শব্দ চলতে লাগল। হঠাৎ দেখি, একটা প্রকাণ্ড ভাল্লুক ঝোপের ভেতর দিয়ে আসছে নদীর দিকে, ঝোপের উপর তার মাথাটা দেখা যাচ্ছে। আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি তার প্রায় চারশো গজ দূরে হবে। সে আসছে চার হাতে-পায়ে, কিন্তু ঝোপের উপর তার মাথা দেখা যাচ্ছে। মস্ত ভালুক দেখে প্রাণে বড়োই আনন্দ হল। ভালুকটা সোজা এসে সোতীটা একবার এদিক-ওদিক দেখে নিল, তারপর সোতীতে নেমে আমার সোজা পার হতে লাগল। মাঝামাঝি যখন এসেছে তখন বন্দুক তুলে গুলি করলাম। গুলি খেয়েই চিৎকার করে পড়ে গেল— সে কী বিকট চিৎকার, সারা বন কেঁপে উঠল তার চিৎকারে! আহত বাঘের গর্জনও ভয়ংকর, কিন্তু এ যেন তাকেও অতিক্রম করে। ভালুকটা পড়ে যাবার পরই চক্ষের নিমেষে উঠে তেড়ে এল আমার দিকে, যাকে বলে চার্জ করল। আবার একটা গুলি করলাম, সেটা তার পেছনের বাঁ-পায়ে লাগল। প্রায় ঘাড়ের উপর এসে পড়েছে তখন জন্তুটা। আবার গুলি করলাম, কিন্তু এ গুলিটা লাগল না; কিন্তু না লাগলেও এই গুলিটাই আমাকে আসন্ন মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করল। অত কাছ থেকে গুলি করার জন্য ভালুকটা যেন বিস্ফোরণের ধাক্কায় আমাকে এড়িয়ে পাশের নালাটিতে ঢুকে পড়ল। ছুটে তার পিছু নিতে গিয়ে আমার বুকপকেট থেকে কতগুলো টোটা পড়ে গেল। সেগুলো কুড়িয়ে পকেটে পুরেছি, এমন সময় বড়কু মাঝি এসে বলল, 'ভালুক কই?'
আমার কাছে সব শুনে বড়কু বলল, 'এই বন্দুক লিয়ে শিকার করতে এসেছিস? যদি মেরে যেত?' আমি দৃঢ়ভাবে বললাম যে, ভালুক নিশ্চয়ই মরবে। সে তখন প্রথমে যেখানে ভালুকটা পড়েছিল সে-জায়গাটা ও তারপর থেকে যা চিহ্ন ছিল পরীক্ষা করে এল। আমায় সহসা প্রশ্ন করল, 'ফেপসায় (lungs) মারলি কেন? পেছনের বাঁ-পায়েও লেগেছে, পা-টা ভেঙে গেছে।' গুলি যে ফুসফুস ও পায়ে লেগেছে তা ও কী করে জানল? আশ্চর্য হয়ে গেলাম, কিন্তু প্রশ্নের সময় সে নয়, ভালুককে মারা চাই-ই। বললাম, 'ভালুকটাকে শেষ করে আসি চল।' আমার অস্ত্রের উপর তার আর বিশ্বাস নেই। বললে, 'তোমার এই বন্দুক নিয়ে পারবে? যদি ফিরে দাঁড়ায়, বন্দুকসুদ্ধ তোমাকে খতম করে দেবে।' তাকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম, গুলি যে জায়গায় লেগেছে তাতে সে মরবেই; তিলে তিলে মরার চেয়ে নিজেই তাকে শেষ করে দিতে চাই। তবু সে বার বার বলল, 'ও বন্দুক নিয়ে শিকার করা কোনোমতেই উচিত নয়। মনে বড়ো দুঃখ হল, দামি বন্দুক, অনেক শখ করে বিলেত থেকে আনিয়েছি। এই 333 Cordite Magazine rifle, Jeffry কোম্পানি অল্প দিন আগে বার করেছে। এই রাইফেল-এর জন্য যখন বিলেতে অর্ডার পাঠাচ্ছি, তখন প্রসিদ্ধ শিকারি মুক্তাগাছার শ্রীব্রজেন্দ্রকিশোর আচার্য চৌধুরীর সঙ্গে আমার একটু আলোচনা হয়েছিল, এখানে তার পুনরুল্লেখ অপ্রাসঙ্গিক হবে না। ব্রজেন্দ্রকিশোরবাবু তখন হাজারিবাগে আমার প্রতিবেশী ছিলেন। এই রাইফল আনাবার ইচ্ছা তিনি সমর্থন করেননি। বলেছিলেন, 'যদি একটা ছুঁচ বিদ্যুৎ-বেগে আপনার হাতের ভেতর ঢুকে ভেঙে যায় তবে বেশি আঘাত খাবেন, না, একটা বড়ো ঢেলা আপনার হাতের উপর তার চেয়ে কম বেগেও লাগে তবে বেশি আঘাত লাগবে?' দৃষ্টান্ত হিসাবে তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার একটা ঘটনা বলেছিলেন।
তাঁদের ওদিকে গারো পাহাড়ে মাঝে মাঝে ওঁরা হাতি খেদা করতেন। একবার খেদা করবার সময় একটা দাঁতাল হাতি খেপে গিয়ে খেদার বেড়ার উপর বার বার আক্রমণ করতে লাগল। কোনোরকমে তাকে ঠেকানো যায় না। শেষকালে এ-রকম হল যে, বেড়া প্রায় ভেঙে যায়। ব্রজেন্দ্রকিশোরবাবু তখন বেড়ার উপর থেকে 450 Cordite Express দিয়ে তাকে গুলি করলেন। একটু থমকে গেল বটে কিন্তু পড়ল না, মরিয়া হয়ে দ্বিগুণ বেগে আক্রমণ করতে লাগল। আরও একটা গুলি করা হল, তবু কাজ হল না। তখন ব্রজেন্দ্রকিশোরবাবুর পিতার আমলের একজন প্রাচীন শিকারি বলল, 'আজ্ঞে কর্তা, ও বন্দুকে কী হবে? তোমার বাবার আমলের যে বন্দুক আছে, তাই এনে গুলি করো।' তার কথামতো ব্রজেন্দ্রকিশোরবাবু 8 bore black powder rifle দিয়ে গুলি করলেন। বললেন, 'ধপ করে গুলি গিয়ে লাগতেই হাতিটা পড়ে গেল। একবার ওঠবার চেষ্টা করল বটে, কিন্তু পারল না; আবার পড়ে গেল আর উঠল না। আমার মনে হয়, আপনি বড়ো বোরের রাইফল আনলে ভালো করতেন।' পরের জীবনে অবশ্য এর সত্যতা যথেষ্ট উপলব্ধি করেছি।
ব্রজেন্দ্রকিশোরবাবুর কথাটা আমার মনে পড়তে লাগল; কিন্তু শিকারের নেশা তখন আমাকে পেয়ে বসেছে। ভালুকটাকে যে করেই হোক খুঁজে বার করতেই হবে। জিদ করায় বড়কু রাজি হল এবং যে নালার ভেতর দিয়ে ভালুক অদৃশ্য হয়েছিল সেই নালায় ঢুকল এবং সঙ্গে আমরাও চললাম। বড়কু আগে তার ঠিক পেছনেই রাইফল নিয়ে আমি। হঠাৎ নালা ছেড়ে সে বাঁ-দিকের উঁচু জমিতে উঠল, যদিও কোনোরকম চিহ্ন আমাদের চোখে পড়ল না। খুব সন্তর্পণে চলেছে, যেন জানোয়ারটা কাছেই কোথাও আছে। প্রশ্ন করতে গেলে অধীর হয়ে চুপ করতে ইঙ্গিত করে। প্রায় দু-শো গজ এইভাবে যাবার পর রক্তের দাগ পেলাম। কী কৌশলে যে short cut করে সে আমাদের নিয়ে এল সে-ই জানে! এমনি করে আরও দু-একবার short cut করে এক নালার মধ্যে ঢুকলাম। কিছুতেই আর কৌতূহল দমন করতে না পেরে জিজ্ঞাসা করলাম, 'কী করে তুই এদিক দিয়ে এলি?' সে একটু কৃপার দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, 'বাঁ-পায়ে গুলি লেগেছে, কাজেই সে-পায়ে জোর কম এবং চলতে গেলে ডান দিকটাই সহজে বেশি চলবে এবং জানোয়ারটা ক্রমে বাঁ-দিকে ঘুরে যাবে।' সত্যিই তো! কিন্তু ও বলার আগে কথাটা একবারও মনে হয়নি আমার। মনে মনে ভাবলাম, একেই জঙ্গলের তীর্থগুরু করব। পদচিহ্ন দেখে জন্তুজানোয়ার অনুসরণ করা, যাকে বলে ট্র্যাকিং, তার উপর সেই আমার অসীম শ্রদ্ধা এনে দিল। পরে এই বিষয়ে যতটা পারদর্শিতা লাভ করি তার গোড়াপত্তন এইখানে।
নালা ধরে যেতে যেতে হঠাৎ এক বাঁকের মুখে ঢুকেই বড়কু পিছু হটে এসে আমাকে সামনে এগিয়ে দিল। আমি বাঁক পার হয়েই দেখি, আহত ভালুকটি হাঁপাচ্ছে আমাদের দিকে পিছন করে। সঙ্গেসঙ্গে গুলি করলাম, গুলি লাগলও, কিন্তু সে পড়ল না; মৃত্যুর বিরুদ্ধে যেন তীব্র প্রতিবাদ করে ধ্বসনা দিয়ে উপরে উঠে গেল। অদ্ভুত প্রাণ! অশেষ এদের প্রাণশক্তি। কিন্তু ক-বারের ব্যর্থতায় আমার জিদ বাড়িয়ে তুলল, মাথায় যেন খুন চেপে গেল আমার। আমি বললাম, 'ঢিল মেরে বার করে দে, ওকে আজ মারবই।' লোকটি অগত্যা আমাদের নিয়ে উপরে উঠে এল। ভালুককে চোখে দেখতে পাচ্ছি না কিন্তু আট-দশ গজ দূরে তার জোর জোর নিশ্বাসের শব্দ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি। দিনশেষের আলো তখন ম্লান হয়ে এসেছে। বড়কু একটা গাছে উঠে চুপি চুপি জানাল, সেখান থেকে আহত ভালুকটিকে দেখা যাচ্ছে। আমরা সুবিধামতো জায়গা বেছে নিয়ে দাঁড়ালাম, আমি বাঁ-দিকে, বিপিন ডাইনে। বড়কু গাছ থেকে পাথর ছুড়তে লাগল ভালুকটার আশপাশে। বিপিনের ভাগ্য ভালো; ভালুক ওর দিক দিয়েই বেরোল। বিপিন তখনই গুলি করল, তাতে ভালুকটি একটু দূর ছুটে গিয়েই পড়ে গেল। কাছেই একটা শাল গাছ ছিল যার ব্যাস পাঁচ ইঞ্চি আন্দাজ হবে। তার নিষ্ফল প্রতিহিংসার নিদর্শনস্বরূপ রুদ্ধ আক্রোশে সেই গাছটিকে এক কামড়ে দু-খানা করে দিল। আমরা কাছে গিয়ে দেখি, শেষ হয়ে গেছে। পরে বহু শিকারের সুযোগ ও সৌভাগ্য হয়েছে কিন্তু এতবড়ো ভালুক আর কমই দেখেছি।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন