৪০. মনোরমা কলকাতায়

সমরেশ মজুমদার

দীপাবলী দাঁড়িয়ে পড়েছিল। এমন দৃশ্য যে কখনও দেখবে তা জীবনেও ভাবেনি। একটা টিনের সুটকেস এবং বড় পুঁটলি নিয়ে মনোরমা একতলার সিঁড়িতে বসে ছিলেন। তাঁর ওপাশে দারোয়ানের সঙ্গে কথা বলছে খোকন। গেটে দাঁড়িয়ে দীপাবলী এ-দুটোকেও মেলাতে পারছিল না।

প্রায় দৌড়েই সে মনোরমার সামনে হাজির হল, ‘তুমি?’

মনোরমা মুখ তুললেন। বয়স এবং অভাব একই সঙ্গে আরও ছোবল মেরেছে ওঁর মুখে। একটু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন। তাঁর গানের রং কখনও হয়তো সাদা ছিল। সেমিজের চেহারাও এত নোংরা যে এ-পাড়ার কাজের মেয়েরাও পরতে চাইবে না। দারোয়ানের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে খোকন পাশে চলে এল। মনোরমার ঘোলা চোখে ধীরে জল এল। তাঁর মুখ কাঁপতে লাগল। এবং অকস্মাৎই শরীর নিংড়ে কান্নাটা ছিটকে এল। দীপাবলীর একই সঙ্গে কষ্ট আনন্দ এবং সংকোচ হল। ক্রমশ শেষেরটা অস্বস্তির মাত্রা বাড়াল। দারোয়ান তো বটেই, ফ্ল্যাটে আর যারা যাওয়া-আসা করছে তারাও দাঁড়িয়ে পড়ছে এই দৃশ্য দেখতে। সে দু’হাতে মনোরমাকে টেনে তুলল, ‘ওঠো, ঘরে চলো।’

কথা বলার চেষ্টা করলেন মনোরমা কিন্তু পারলেন না। দীপাবলীর মনে হচ্ছিল সে পাখির মতো হালকা একটা শরীরকে ওপরে তুলছে। খোকন আসছিল জিনিসপত্র নিয়ে ওদের পিছনে। সিঁড়ি ভাঙতেও মনোরমার বেশ কষ্ট হচ্ছে। মাঝে মাঝেই তাঁকে দাঁড় করাচ্ছিল দীপাবলী। সেই বউটি ফ্ল্যাটের দরজায় দাঁড়িয়ে অবাক চোখে দৃশ্যটি দেখল। কোনও দিকে না তাকিয়ে ধীরে ধীরে ওঁদের নিয়ে নিজের ফ্ল্যাটের দরজায় পৌঁছে গেল সে।

ভেতরে ঢুকে একটা চেয়ারে মনোরমাকে বসিয়ে প্রথমে জানলাগুলো খুলে দিয়ে পাখা চালাল দীপাবলী। তারপর খোকনকে বলল, ‘বস খোকন।’

চেয়ারে বসতে বসতে খোকন বলল, ‘বাঃ, সুন্দর বাড়ি তো তোর।’

‘বাড়ি নয়, ফ্ল্যাট। ভাড়া দিয়ে থাকি।’ দরজাটা বন্ধ করল সে। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আগে হাত মুখ ধুয়ে পরিষ্কার হ— তারপর তোদের কথা শুনব। এদিকে একটা বাথরুম আছে, তুই ওখানে চলে যা। আমি ঠাকুমাকে নিয়ে ভেতরে যাচ্ছি।’

মনোরমার গলায় চিনচিনে শব্দ বাজল, ‘আমি এখানে একটু বসি।’

দীপাবলী ওঁর হাত ধরল, ‘ভেতরের ঘরে গিয়ে একেবারে জামাকাপড় ছেড়ে শুয়ে পড়বে চলো। তাতে বেশি আরাম লাগবে। চলো।’ খোকন বাক্স এবং পুঁটলি ভেতরের ঘরে রেখে এল।

এতক্ষণ সম্ভবত সমস্ত ব্যাপারটাই অনিশ্চিতের মধ্যে ছিল। শরীর এবং মনের সমস্ত শক্তি যেন নিঃশেষিত হয়ে গিয়েছিল। দীর্ঘ মরুপথ পেরিয়ে অবশ হয়ে যাওয়া মানুষ যেমন মরূদ্যান দেখতে পেয়ে আচমকা কিছু শক্তি তৈরি করে ফেলে সেইভাবেই মনোরমা ভেতরে এলেন। তাঁর মুখে কোনও কথা ছিল না। নিজের শোওয়ার ঘরের সংলগ্ন বাথরুমের দরজায় পৌঁছে দীপাবলী জিজ্ঞাসা করল, ‘নিজে হাত মুখ ধুতে পারবে তো?’

মনোরমা ঘাড় নেড়ে এগিয়ে গেলেন। দীপাবলী বলল, ‘ভেতরে বালতিতে জল আছে। সেটা নিতে না চাইলে কল খুলে নিয়ো। দরজাটা ভেজিয়ে রাখো, বন্ধ কোরো না।’

মনোরমা ভেতরে চলে গেলে সে ছুটে রান্নাঘরে পৌঁছে গ্যাস জ্বালিয়ে এক কেটলি জল চাপিয়ে দিল। তারপর আবার ফিরে এসে মনোরমার তালাবিহীন টিনের বাক্স খুলল। ওপরেই একটি পরিষ্কার থান এবং সেমিজ রয়েছে। সে-দুটোকেই বের করে ওটাকে সরিয়ে রেখে বাথরুমের দরজায় টোকা দিল, ‘তোমার হয়ে গিয়েছে? বেশি জল ঢেলো না, নতুন জায়গা। জামাকাপড় ওখানেই ছেড়ে রাখো, তোমাকে ধুতে হবে না। আর এগুলো নাও।’

দরজা সামান্য ফাঁক করে সে পরিষ্কার জামাকাপড় এগিয়ে ধরতেই মনোরমা সেগুলো নিলেন। এবং তখনই সারাদিনের ক্লান্তিটাকে টের পেল দীপাবলী। খাটের পাশের চেয়ারটায় বসে পড়ল সে। নিজে যতক্ষণ পরিষ্কার না হচ্ছে ততক্ষণ এই ক্লান্তিটা যাবে না। স্নান করে চা না-খাওয়া পর্যন্ত রোজই এমন হয়। বাইরের বাথরুমে জল পড়ার শব্দ হচ্ছে। হঠাৎই মনে পড়ল, বাড়িতে কাঁচাবাজার তেমন কিছু নেই। আজ সকালে যাব যাব করেও যায়নি সে। অতএব ওঁদের একটু সামলে বাজারে বেরোতে হবে। দীপাবলী উঠল। রান্নাঘরে ঢুকে দেখল জল ফুটে গিয়েছে। চটপট চা বানাতে বসল সে। বাইরের বাথরুমের দরজার শব্দ হল। অর্থাৎ খোকনের হয়ে গিয়েছে। মাথার ভেতরে একসঙ্গে অনেক চিন্তা আসছিল। কিন্তু সেগুলোকে সরিয়ে রাখছিল সন্তর্পণে। না, এ নিয়ে আগেভাগে কিছুই ভাববে না সে। চায়ের কাপ আর বিস্কুট নিয়ে প্রথমে বাইরের ঘরে গেল দীপাবলী। সেই এক শার্ট প্যান্ট পরে খোকন চুল আঁচড়াচ্ছিল। টেবিলে কাপ ডিশ নামিয়ে সে জিজ্ঞাসা করল, ‘জামা ছাড়লি না?’

‘নাঃ। আমি তো আজ চলে যাব।’

‘চলে যাবি মানে?’

ঘড়ি দেখল খোকন, ‘এখনও আধঘণ্টা টাইম আছে। এর মধ্যে স্টেশনে যাওয়া যাবে না?’

মাথা নাড়ল দীপাবলী, ‘না।’

‘তা হলে আটটার রকেট বাস ধরব। কোত্থেকে ছাড়ে জানিস?’

‘তোকে কি আজই যেতে হবে?’

‘না, মানে, থেকে কী করব!’

‘আমার বাড়িতে প্রথম এলি। সেখানে যদি রাজকার্য না থাকে তা হলে যাওয়া চলবে না।’

‘শোন, তুই এখানে একা থাকিস, আমি থাকলে তোর অসুবিধে হবে।’

‘একের বদলে দু’জনে যদি অসুবিধে না হয় তিনজনে হবে তা ভাবছিস কেন? তা ছাড়া আমি যদি রাত দশটায় ফিরতাম তা হলে কী করতিস? বাজে কথা না বলে চা খেয়ে ফ্রেশ হয়ে একটু রেস্ট নে। আমি আসছি।’ দীপাবলী অসন্তুষ্ট মুখে বেরিয়ে এল। দু’কাপ চা আর বিস্কুট ট্রেতে চাপিয়ে শোওয়ার ঘরে ঢুকে দেখল মনোরমা তাঁর পুটলির সামনে বসে আছেন। ফরসা জামাকাপড়ে তাঁর শোভা পালটেছে। দীপাবলী জিজ্ঞাসা করল, ‘ওখানে কী করছ? উঠে এসো। চেয়ারে বসে আরাম করে চা খাও। তারপর শুয়ে পড়বে।’

মেঝেতে বসেই মনোরমা মাথা নাড়লেন, ‘আমি তো চা খাই না।’

‘ও।’ থতমত হয়ে গেল দীপাবলী, ‘আগে খেতে না?’

‘এখন একদম ছেড়ে দিয়েছি।’

‘তা হলে দু’-তিন চুমুক দাও। শরীরটা ভাল লাগবে। শেষবার কখন খেয়েছ।’

‘খেয়েছি।’

‘কখন?’

মনোরমা জবাব দিলেন না। দীপাবলী বলল, ‘তার মানে নিজেই মনে করতে পারছ না। এসো এখানে বসো৷’ প্রায় হাত ধরেই বৃদ্ধাকে তুলে নিয়ে এল সে। নিতান্ত অনিচ্ছায় মনোরমা বিস্কুট খেলেন, চায়ে কয়েকটা চুমুক দিলেন। উলটোদিকে বসে দীপাবলীর মাথায় নানান প্রশ্ন জট পাকাচ্ছিল। শেষবার যখন দেখেছিল তখনও মনোরমাকে এমন উদভ্রান্ত লাগেনি। এবং তখনই তার মনে পড়ল। মনোরমা তাকে শেষবার বাসি কাপড়েই এক বিছানায় শুতে অনুমতি দিয়েছিলেন কিন্তু এই মহিলার বাছবিচারের প্রাবল্য ভয়ানক রকমের ছিল। অতএব এখানে এসে তার ব্যবহৃত বিছানায় উনি শুতে চাইবেন কিনা সন্দেহ। শুলেও স্বচ্ছন্দ বোধ করবেন না। অথচ তার সঞ্চয়ে বাড়তি বিছানা নেই। বাইরের ঘরেরটা খোকন ব্যবহার করবে। চা খাওয়া শেষ করে সে উঠে আলমারি খুলল। পরিষ্কার বিছানার চাদর বের করে খাটে রাখল। তখন মনোরমা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী করছিস?’

‘এটাকে পালটাচ্ছি।’

‘কেন? একটুও ময়লা হয়নি তো।’

‘তুমি এতে শোবে?’

মনোরমা চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে বিছানায় এসে বসলেন। কোনও কথা না বলে পুরনো চাদরের ওপরেই শুয়ে পড়লেন দেওয়ালের পাশ ঘেঁষে। বড় ভাল লাগল দীপাবলীর। সে নামানো চাদর আবার তুলে রেখে ঝুঁকে মনোরমাকে স্পর্শ করল, ‘ঘুমিয়ে নাও, খাবার হলে ডাকব।’

কপালে দ্বিতীয়বার আঙুল ছোঁয়াতেই গম্ভীর হয়ে গেল সে। মনোরমার জ্বর এসেছে। গলায় হাত রাখতেই বোঝা গেল পুড়ে যাচ্ছে। সে খুব অবাক হল। একতলা থেকে যখন বৃদ্ধাকে প্রায় কোলে করেই সে ওপরে তুলেছিল তখন কিন্তু কোনও উত্তাপ ছিল না। হয়তো টের পায়নি, কিন্তু এমন উত্তাপ টের না পেয়ে থাকা যায় না। উত্তেজনায় মন অন্যমনস্ক ছিল বলে খেয়াল করেনি এই যুক্তিও মানতে পারছে না। তা হলে জ্বর কি বাথরুম থেকে বেরিয়ে এল?

কিন্তু কী ওষুধ দেওয়া যায়? ঘরে সামান্য জ্বরজারি মাথা ধরার ওষুধ রয়েছে। কিন্তু মনোরমার শরীরের যা অবস্থা তাতে কোন ওষুধ সহ্য হবে বা হবে না তা সে জানে না। বোঝা যাচ্ছে পেট খালি আছে অনেকক্ষণ। ওঁর ধাতও তার জানা নেই। ঠিক মোড়েই যে ওষুধের দোকানটা সেখানে একজন ডাক্তার বসেন সকাল সন্ধে। যাওয়া আসার পথে দেখেছে তাঁকে। বাজার থেকে ফেরার পথে ওঁকেই ডেকে আনবে সে। আয়নার সামনে গিয়ে চুল আঁচড়ে নিচ্ছিল তাড়াতাড়ি করে এমন সময় চিনচিনে গলায় মনোরমা ডাকলেন। সে কাছে যেতে বললেন, ‘খু-উ-ব জ্বর।’

‘হ্যাঁ। আমি ডাক্তার ডাকতে যাচ্ছি।’

মাথা নেড়ে না বললেন মনোরমা। তারপর উঠে বসে আঙুল দিয়ে পুঁটুলিটা দেখিয়ে দিলেন। দীপাবলী জিজ্ঞাসা করল, ‘কী আছে ওতে?’

‘ওষুধ!’ কাঁপুনি স্পষ্ট বোঝা গেল।

দীপাবলী এগিয়ে গিয়ে পুঁটুলি খোলার চেষ্টা করল। বাথরুম থেকে বেরিয়ে এই কারণেই এখানে বসেছিলেন মনোরমা। গিটগুলো জব্বর। খুলতে সময় লাগল। কী নেই এতে। প্রয়োজনীয় অপ্রয়োজনীয় যা পেরেছেন সংগ্রহ করে এনেছেন বৃদ্ধা। তার মধ্যে থেকে একটা টিনের বাক্স বের করে আনল সে। এই বাক্সটাকে সে চেনে। অনেক অনেক বছর আগে এই বাক্সটা এনেছিলেন অমরনাথ। এতে চকোলেট ভরতি ছিল। মনোরমা বললেন, ‘ওটা। ওটা নিয়ে আয়।’

বাক্সটাকে খুলতেই অনেকগুলো হোমিওপ্যাথি শিশির মুখ দেখতে পেল সে। ছিপির ওপর সাংকেতিক লেখা। সেটা মনোরমার সামনে ধরতেই তিনি হাতড়ে হাতড়ে একটা শিশি তুলে নিলেন। ছিপি খুলে গোটা পাঁচেক দানা জিভে ঢেলে বালিশের পাশে শিশিটাকে রেখে মাথা নাড়লেন। বাক্সটাকে ফিরিয়ে নিয়ে গেল দীপাবলী।

এবার সে দ্বন্দ্বে পড়ল। মনোরমা যদি হোমিওপ্যাথি ওষুধ খেতে অভ্যস্ত হন তা হলে নিশ্চয়ই অ্যালোপ্যাথ ডাক্তারের চিকিৎসা পছন্দ করবেন না। কিন্তু ওই ওষুধে যদি জ্বর না কমে? অপেক্ষা করা ছাড়া কিছু করার নেই। কাল সকালেও যদি জ্বর না কমে তা হলে দেখা যাবে। মনোরমার শরীরে একটা চাদর মেলে দিল সে। পুরনো চাদর।

টাকা আর বাজারের ব্যাগ নিয়ে বাইরের ঘরে এসে দেখল খোকন জামাপ্যান্ট পালটেছে। তাকে দেখে জিজ্ঞাসা করল, ‘কোথায় যাচ্ছিস?’

‘বাজারে। এদিকে ঠাকুমার জ্বর এসেছে।’

‘জ্বর তো ওখানেও ছিল। ওই শরীর নিয়ে এসেছে। দুপুরে বলল জ্বর নেই। কিন্তু তুই বাজারে যাচ্ছিস কেন? উনি কি ভাত খাবেন?’

‘না। খেতে দেওয়া উচিত হবে না। মিষ্টি ফল আনব।’

‘দোকানটা কোথায় বল আমি নিয়ে আসছি। বাড়িতে আলু ডিম আছে?’

‘আছে।’ দীপাবলী মাথা নাড়ল।

‘তা হলে ডিমসেদ্ধ আলুসেদ্ধ আর ভাত কর। তুই খেতে পারলে আমার আপত্তি নেই।’

‘প্রথমদিন এসে ডিমসেদ্ধ খাবি?’

‘দুর শালা! আমি তোর কুটুম নাকি?’

‘অ্যাই, খারাপ কথা বলবি না!’ চোখ পাকাতে গিয়েও হেসে ফেলল দীপাবলী।

‘ওহো, সরি সরি। ড্রাইভার মানুষ তো, জিভের দোষ হয়ে গেছে। বল, দোকানটা কোথায়?’

মন থেকে সায় দিচ্ছিল না। প্রথম দিনেই বাজারে পাঠানো ভদ্রতা নয়। কিন্তু দীপাবলী হার মানল খোকনের আগ্রহের কাছে। ফলের দোকানের অবস্থান ভাল করে বুঝিয়ে দিল সে। মনোরমাকে একা ফেলে দু’জনেরই একসঙ্গে বেরিয়ে যাওয়া উচিত হবে না। মিষ্টির দোকানটা পথেই পড়বে।

খোকন বেরিয়ে গেলে ওর বিছানাটা ঠিক করে দিয়ে বাথরুমে ঢুকল দীপাবলী। গায়ে জল দিতেই আরাম হল। শোওয়ার ঘরে মনোরমা মড়ার মতো পড়ে আছেন চাদর মুড়ি দিয়ে। এমন কী ঘটনা হল যাতে বৃদ্ধা আগাম খবর না দিয়ে চলে এলেন কলকাতায়? দীপাবলী ভেবে পাচ্ছিল না। নিশ্চয়ই কেউ ওঁর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছে। খোকনের সঙ্গে যোগাযোগ হল কী করে তাও বোধগম্য হচ্ছে না। সবশেষে এ-বাড়ির ঠিকানাটা!

পরিষ্কার হয়ে স্বস্তি। দীপাবলী বাইরে এসে মনোরমাকে দেখল। ঘুমন্ত মানুষকে তুলে থার্মোমিটারে জ্বর দেখা ঠিক নয়। কিন্তু জ্বরটা দেখা দরকার। চেয়ারে বসে ওই মুখের দিকে তাকিয়ে সমস্ত ছেলেবেলাটাই উপড়ে এল। বাল্যের দেখা মনোরমা নিজের জগতটা আলাদা করে রাখতেন সবসময়। নিজে রান্না করে খেতেন, বেশিরভাগ ব্যাপারেই মূল পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতেন। শুধু রাত্রে দীপাবলী তাঁর পাশে শুতে পারত। সে-সময় মেয়েদের কীরকম হওয়া উচিত এই ব্যাপারে উপদেশ দিয়ে যেতেন। পরবর্তীকালে এই উপদেশগুলোকে যুক্তিহীন মনে হয়েছে। কিন্তু তখন তাঁর কথা না শুনে উপায় ছিল না। তারপর চা-বাগানের সেই বাড়িতে সন্ন্যাসীর উদয় হল। দৃশ্যগুলো হঠাৎই স্পষ্ট হল। মনোরমা স্বীকার করেননি মানুষটাকে। অমরনাথও কিছুটা উদ্‌ভ্রান্ত হলেও পরে এ নিয়ে কোনও আলোচনা করেননি। সেইসময় মনোরমা কী তেজি ব্যবহার করেছিলেন। এমনকী দীপাবলীর বিয়ের ব্যাপারে ওঁর জেদ বড় ভূমিকা নিয়েছিল। হয়তো উনি জেদি না হলে অমরনাথ তার বিয়ে দিতেন না। বিধবা হয়ে ফিরে আসার পরে এই মহিলা তাকে বাধ্য করেছিলেন সেইসব আদিম নিয়মকানুন মানতে। তার মনের গায়ে বিধবা ছাপটা মেরে দেবার চেষ্টা করেছিলেন প্রবলভাবে।

অথচ কী আশ্চর্য, এসব সত্ত্বেও এই বৃদ্ধাকে সে কখনই ভিলেন মনে করতে পারেনি। শেষবার চা-বাগানে দেখা করতে গিয়ে ওঁর পাশে শুয়ে পরিচিত ঘ্রাণ পেয়ে মনে হয়েছিল নিজের জায়গায় ফিরে এসেছে। সেবারই লক্ষ করেছিল সেই মনোরমা অনেক পালটে গিয়েছেন। নিজের মুখে তিনি ক্ষমা চেয়েছেন বিবাহের ব্যাপারে জেদ ধরার জন্যে। ওটা না চাইলেও দীপাবলী কখনই ওঁকে দূরে সরিয়ে দিতে পারত না। শুধু অনুশাসনের বাড়াবাড়ি নয়, অনেক ভাল মুহূর্তও তো সে পেয়েছিল মনোরমার কাছ থেকে। অথচ ইনি তার কেউ নন। অন্তত রক্তের সম্পর্কে তো নয়। অমরনাথ যে অর্থে তার বাবা ইনি সেই অর্থে তার ঠাকুমা নন। অথচ আজ ইনি নাতনির কাছেই ছুটে এলেন। এসে ভাল করেছেন। দীপাবলীর মন এমনই চাইছিল। কিন্তু তার জীবন, জীবনযাত্রা এই প্রাচীন ভদ্রমহিলা কীভাবে নেবেন? তার চেনা মনোরমার পক্ষে তা সম্ভব নয়। ভয় এখানেই। এইসময় বেল বাজল।

দরজা খুলে দেখল প্যাকেট নিয়ে ফিরে এসেছে খোকন। ঢুকে বলল, ‘বাব্বা, তোদের এখানে জিনিসপত্রের দাম খুব বেশি। একটা বাতাবি লেবু তিন টাকা চাইল। অথচ আমাদের ওখানে কেউ কিনে খায় না।’

‘খামোকা বাতাবি কিনতে যাবি কেন? আর এখন তো বাতাবির সময় নয়।’

‘হ্যাঁ। অসময়ের ফল অনেক দেখলাম।’

‘তা হলে নিউ মার্কেটে গেলে ট্যারা হয়ে যেতিস৷’ প্যাকেটদুটো নিয়ে সে জিজ্ঞাসা করল, ‘কত খরচ হল তোর?’

‘কেন? দাম দিবি নাকি?’

‘দিয়ে দেওয়া উচিত।’

‘খুব বড়লোক হয়েছিস, না?’

‘দেখে মনে হচ্ছে?’

‘এরকম ফ্ল্যাটে থাকার কথা আমরা ভাবতে পারি না।’

‘অভ্যেস। ওখানে থাকলে আমিও ভাবতাম না।’

‘দামের কথা বলিস না।’

‘বেশ। চা খাবি?’

‘না। সকাল থেকে শুধু চা খেয়ে যাচ্ছি।’

‘দুপুরে ভাত খাসনি?’

‘চান্সই পেলাম না। ট্রেন লেট ছিল। বারোটায় শিয়ালদায় পৌঁছেছি। তারপর ঠাকুমাকে নিয়ে কীভাবে যে বাইরে এসেছি বুঝতেই পারছিস।’

‘স্টেশন থেকে এখানে এলি কখন?’

‘তিন ঘণ্টা লেগেছে। তিনটের সময়।’

‘সেকী রে?’

‘আরে কলকাতার রাস্তাঘাট তো চিনি না। তোর ঠিকানা যাকে দেখাই সে-ই উলটোপালটা বলে। এই বাসে যান, ওই বাসে যান। বাস স্টপে এসে চক্ষু চড়কগাছ। আমি একা হলে উঠতে পারতাম। ঠাকুমাকে তুললে বুড়ি মরে যেত।’

‘আশ্চর্য! তুই বাসে উঠতে গেলি মালপত্র নিয়ে?’

‘আমি শুনেছিলাম ট্যাক্সিওয়ালারা নাকি খুব ঘোরায়।’

‘তুই নিজে তাই করিস নাকি?’

‘আমাদের ওখানে কেউ মিটারে যায় না। ফিক্সড ভাড়ায় ঘুরিয়ে লাভ কী? প্রায় এক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে ট্যাক্সির ধান্দায় গেলাম। কেউ শালা যেতে চায় না। এটা কিন্তু আমাদের ওখানে পাবি না। শেষে এক সর্দারজি রাজি হল। ঠিকানা খুঁজে খুঁজে এখানে এসে পৌঁছালাম শেষপর্যন্ত। এসে দেখি তুই নেই। দরজা বন্ধ। দারোয়ানটা ভাল তাই বসতে দিল।’

‘আমি যদি না ফিরতাম?’

‘কোথায় যেতিস?’

‘ধর, কলকাতার বাইরে যদি যেতাম।’

‘হোটেল খুঁজতে হত।’

‘হুম। তা হলে তোর জব্বর খিদে পেয়েছে। বস, আমি রান্না করে ফেলি।’

‘চা খেয়ে খিদেটা মরেছে। ঠাকুমা কেমন আছে?’

‘ঘুমুচ্ছে।’ দীপাবলী প্যাকেট নিয়ে ভেতরে ঢুকল। পেছন পেছন এল খোকন। ‘এত বড় বাড়িতে তুই একা থাকিস?’

‘এত বড় আর কোথায়?’ হাসল দীপাবলী, ‘আর কে থাকবে সঙ্গে?’

‘না। এটা ঠিক না।’ মাথা নাড়ল খোকন, ‘তোর বর দিল্লিতে আর তুই এখানে। লোকটাই বা কী রে? আরে হ্যাঁ, চুপচাপ বিয়ে করলি, নেমন্তন্ন খেলাম না কিন্তু!’

‘আজ রাত্রে খাওয়াব।’

‘ডিমসেদ্ধ ভাত?’ আঁতকে উঠল খোকন, ‘তুই কী রে?’

রান্নাঘরে ঢুকে কাজ শুরু করতে করতে দীপাবলী বলল, ‘তোর বিয়েতে আমাকে বলেছিলি? তুই আমার বিয়ের নেমন্তন্ন একেবারে খাসনি তা তো নয়!’

‘মানে? কখন খেলাম?’

‘কেন? সেই যে ছেলেবেলায়। আমার প্রথম বিয়ের সময়’

‘দুর! সেটা বিয়ে ছিল নাকি?’

‘বিয়ে থাক বা না-থাক, খেয়েছিলি তো।’

‘মনে আছে তোর শ্বশুরবাড়িতে যাওয়ার সময় আমি বিশু খুব কেঁদেছিলাম। আর তুই যখন ফিরে এলি খুব ভাল লেগেছিল। যাক গে! তোর নতুন বরের কথা বল। লোকটা কেমন? খুব শিক্ষিত নিশ্চয়ই?’

‘তা তো বটেই। শিক্ষিত।’

‘তুই মাইরি আমাদের খুব গর্ব।’

‘কেন?’

‘বাঃ, আমরা ছেলেবেলায় একসঙ্গে খেলতাম। আমি ড্রাইভার আর তুই অফিসার।’

‘তুই আমাকে এখনও বন্ধু ভাবিস?’

‘বন্ধু? না হলে এলাম কেন?’

‘তা হলে এসব কথা আর বলবি না।’ দীপাবলী ভাত চড়িয়ে দিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘ঠাকুমা তোকে খবর দিয়েছিল এখানে আসার জন্যে?’

রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে ছিল খোকন। দু’দিনের দাড়িতে ওকে বিষন্ন দেখাচ্ছে। বলল, ‘না রে। আমি স্ট্যান্ডে গাড়িতে বসে ছিলাম। হঠাৎ দেখি বুড়ি ওই বাক্সপেটরা নিয়ে টলতে টলতে আসছে। কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম কোথায় যাবেন? বলল, কলকাতায়। ভাব, তোর কাছে একা চলে আসবে? অথচ ভাল করে হাঁটতে পারছে না। অনেক বোঝালাম, শুনল না। তোর মা মারা গিয়েছে জানিস তো?’

‘জানি।’

‘তারপর কী করব! মনে হল একা ছাড়া উচিত নয়। ওকে বসিয়ে গাড়ি গ্যারেজ করে বাড়িতে গিয়ে জামাকাপড় নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।’ হাসল খোকন।

দীপাবলী কী বলবে ভেবে পাচ্ছিল না। এরকম কাজ আজকাল কেউ করতে পারে এই ধারণাই তার চলে গিয়েছিল। সেই কোন ছেলেবেলা বিশু খোকন সে ফুল পাড়ত, আংরাভাসায় মাছ ধরতে যেত, নারী পুরুষের ভেদাভেদ জ্ঞান ছিল না, সেই স্মৃতির সুবাদে একজন দিন আনি দিন খাই মানুষ কাজকর্ম ছেড়ে এতদুরে চলে এল? অনেক অনেক দিন পরে দীপাবলীর মনে হল সে খুব সহজ গলায় কথা বলতে পারছে। এখন কোনও পুরুষ তো তাকে তুই বলে না। সে জিজ্ঞাসা করল, ‘তোর বউ কেমন আছে?’

‘আছে। মায়ের সঙ্গে খচখচি চলছেই।’

‘মাকে বোঝাতে পারলি না?’

‘বাবা পারেনি।’ খোকন হাসল, ‘শোন, ঠাকুমাকে তোর কাছে রাখবি?’

‘হ্যাঁ, কেন?’

‘অসুবিধে হবে না? একা বাড়িতে রেখে যেতে হবে।’

‘আস্তে আস্তে মেনে নেবে।’

‘গুড। তোর দুই ভাই মাইরি বহুত হারামি! সরি, আবার হারামি বললাম। বড়টা বউ নিয়ে চা-বাগানে থাকে, খোঁজ নেয় না, ছোটটা যা পারছে তাই বিক্রি করছে। মা মরে যাওয়ার পর ঠাকুমাকে দেখত না। বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বলত। বাড়িটা বেচে দেবার ধান্দা। এই অবস্থায় আর ওখানে পাঠাস না।’ খোকন আন্তরিক গলায় বলল।

‘আমিই নিয়ে আসতাম। তুই আমার উপকার করলি খোকন!’

‘দুর! এটা আবার উপকার হল নাকি?’ একটু থেমে অন্যরকম গলায় বলল, ‘তুই যদি খুব রাগ না করিস, মানে, আমার একটা উপকার করবি?’

ভাত দেখছিল দীপাবলী। গলার স্বরে মুখ ফিরিয়ে বলল, ‘ভণিতা করছিস কেন?’

‘বুঝলি তো, ড্রাইভার ক্লাসের মানুষ। অভ্যেস হয়ে গিয়েছে।’

‘কীসের অভ্যেস?’

‘তুই মাইরি রাগ করবি?’

দীপাবলী এক মুহূর্ত ভাবল। তারপর জিজ্ঞাসা করল, ‘তুই মদ খাস?’

‘ওই একটু। সারাদিন খাটুনির পরে না খেলে ঘুম আসে না। আমি বাথরুমে গিয়ে টুক করে খেয়ে আসব। তুই টেরও পাবি না।’

‘তোর সঙ্গে আছে?’

‘হ্যাঁ। ভুটানি জিনিস। এই, তুই রাগ করছিস?’

‘ঘরে গিয়ে বস, আমি আসছি। যা।’ গলা তুলে আধো ধমকের সুরে খোকনকে পাঠিয়ে দিল সে। ভাত হতে দেরি আছে। দীপাবলী মাথা নাড়ল। অলোক বন্ধুদের নিয়ে বাড়িতে বসে মদ্যপান করলে যদি দোষ না হয় তা হলে খোকন খেতে পারবে না কেন? ওর দৃঢ় বিশ্বাস খোকন বেসামাল কিছু করবে না। যে-খোকন চাঁপা ফুল তুলতে ভালবাসত তার এখন মদ না খেলে ঘুম আসে না। এরই নাম জীবন।

শোওয়ার ঘরে গিয়ে মনোরমাকে দেখে এল সে। ঘুমুচ্ছেন। জ্বর সেই একইরকম, অন্তত কপালে হাত দিয়ে মনে হল। ডিমের ওমলেট ভাজল সে। একটা ট্রে-তে জলের বোতল, গ্লাস, ওমলেট আর চানাচুর নিয়ে সতর্ক পায়ে বাইরে ঘরে ঢুকে টেবিলে নামিয়ে রাখল। তাই দেখে লাফিয়ে উঠল খোকন, ‘আই বাপ, এ কী করেছিস ভাই?’

‘আগে ওমলেট খেয়ে নাও। তারপর ওগুলো গিলো। আর হ্যাঁ, গিলতে পারিস, কিন্তু পা যদি টলে তা হলে বাড়ি থেকে বের করে দেব।’ দীপাবলী উলটোদিকের চেয়ারে বসল।

পাঁইট থেকে মদ গ্লাসে ঢেলে খোকন বলল, ‘তোকে বলতে খুব ভয় করছিল। না বললে ঠকতাম। তোর বর মাল খায়?’

‘আবার অভদ্র কথা বলছিস?’

‘সরি? মদ খায়? মদ তো অভদ্র কথা নয়।’

‘খায়। দীপাবলী গম্ভীর গলায় বলল, ‘তোর বাড়িতে অশান্তি হয় না?’

‘হয়। বউটা গন্ধ সহ্য করতে পারে না।’

‘তা হলে খাস কেন?’

খোকন হাসল, ‘আমার বউ আমাকে খুব ভালবাসে।’

‘তা হলে তো আরও কথা শোনা উচিত।’

‘তুই বুঝবি না।’

দীপাবলী উঠল। ভাত নামিয়ে কাজ গুছিয়ে রাখল। তারপর মনোরমাকে দেখতে গেল। মনোরম নড়াচড়া করছেন। সে থার্মোমিটার বের করে বলল, ‘দেখি, হাঁ করো তো, জ্বর দেখব।’

মনোরমা কথা শুনলেন। থার্মোমিটারে জ্বর একশো দুই। খুব ঘাবড়ে যাওয়ার মতো নয়। সে জিজ্ঞাসা করল, ‘এখন কেমন লাগছে?’

মাথা নেড়ে ভাল বললেন মনোরমা। তাঁর চোখের কোণে জল।

‘শোনো, একটু মিষ্টি খাও। রাত্রে আর ফল দেব না। খেয়ে শুয়ে পড়ো।’

‘না। ভাল লাগছে না।’

‘না লাগলেও জোর করে খেতে হবে। ওঠো।’ দীপাবলী প্যাকেট খুলে চারটে সন্দেশ বের করে নিয়ে এল। অনেক সাধ্যসাধনা করে দুটোর বেশি খাওয়ানো গেল না। জল খাইয়ে বাথরুম থেকে ঘুরিয়ে এনে আবার বিছানায় শুইয়ে দিল তাকে। চাদর ঢেকে দিয়ে বলল, ‘এবার তুমি লক্ষ্মী মেয়ের মতো ঘুমোও, কেমন?’

বাইরের ঘরে এল সে। চুপচাপ মদ খাচ্ছে খোকন। ওকে দেখে হাসল।

দীপাবলী জিজ্ঞাসা করল, ‘বিশুর খবর কী রে?’

‘জানি না। ওরা কেউ আমাকে আর বন্ধু মনে করে না।’

‘ঠিক না রে। ছেলেবেলার বন্ধুদের কেউ ভুলতে পারে না।’

হঠাৎ অন্যরকম গলায় খোকন বলল, ‘কী ভাল দিন ছিল না রে? তোর বাবার কথা খুব মনে পড়ে। খুব ভদ্রলোক ছিলেন। সেই বড়বাবুর বুড়ো বাপটাকে মনে আছে? মেয়ে দেখলেই কেমন করত। তখন তো বুঝতাম না ভাল, এখন হাসি পায়।’

দীপাবলী জিজ্ঞাসা করল, ‘কালীপুজোর কথা মনে আছে?’

‘হুঁ। এখন মাইক বাজিয়ে পুজো হয়। আগের মতো নেই। একটা চাঁপা গাছ ছিল মাঠের মধ্যে, সেদিন দেখলাম কেটে ফেলেছে।’

শুনে দীপাবলীর খুব খারাপ লাগল।

খোকন বলে যাচ্ছিল, ‘ললিতাদিকে মনে আছে? সেই যে বাগানের মধ্যে শ্যামলদার সঙ্গে প্রেম করছিল, যার জন্যে শ্যামলদার বাবা আত্মহত্যা করল, মনে আছে?’

‘আছে।’

‘আত্মহত্যা করেছে।’

‘সেকী?’ চমকে উঠল দীপাবলী, ‘আমি তো ওকে জলপাইগুড়ির হাসপাতালে দেখেছিলাম।’

‘শ্যামলদার সঙ্গে ঝগড়া করে গলায় দড়ি দিয়েছে। শ্যামলদাকে পুলিশ ধরেছিল। এখন ছেড়ে দিয়েছে। ললিতাদি চিরকালই ছিটিয়া ছিল, বুঝলি।’ গ্লাস শেষ করল খোকন, ‘তোর বিয়ে হয়েছে ক’দিন?’

‘অনেকদিন।’

‘দুর! আমাদের ওখানে যখন গিয়েছিলি তার পরে তো?’

‘তাই।’

‘তা হলে অ্যাদ্দিনে বাচ্চা হয়নি কেন?’

‘তোর তাতে কী?’

‘না, বাচ্চা হলে দু’জনে আলাদা থাকতে পারতিস না।’

মদ খাওয়া হয়ে গিয়েছিল, ছোট বোতলটা খালি। দীপাবলী ওগুলোকে তুলে নিয়ে গিয়ে ভাত বাড়ল। চুপচাপ খেয়ে গেল খোকন। খাওয়াদাওয়ার পর বিছানা দেখিয়ে দিল দীপাবলী। খাটে বসে সিগারেট ধরিয়ে খোকন হঠাৎ বলল, ‘দীপু, তোর বাড়িতে যদি আমার বউকে নিয়ে আসি থাকতে দিবি?’

‘নিশ্চয়ই।’ দীপাবলী হাসল, কবে আসবি?’

‘জানি না। মা মরে গেলে হয়তো।’ গলাটা কেমন হয়ে গেল খোকনের।

গোছগাছ করতে আরও রাত হল। খোকনের ঘরের আলো নেবানো। ওর নাক মৃদু ডাকছে। শোওয়ার জন্যে তৈরি হতে আর একটু সময় লাগল। সন্তর্পণে মনোরমার পাশে শুয়ে বেডসুইচ টিপে আলো নেবাতেই মনোরমা আঁকড়ে ধরলেন তাকে। হাউহাউ করে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন তিনি।

খানিক স্থির হয়ে দীপাবলী ওঁর মুখে হাত চাপা দিল। মনোরমা একটু শান্ত হতে সে বলল, ‘যা বলার কাল সকালে বোলো। এবার তুমি ঘুমাবে। আমি এখন কোনও কথা শুনব না। ঘুমাতে চেষ্টা করো।’

সকল অধ্যায়

১. ১. কাকভোর বলে কিছু নেই এখানে
২. ২. টেলিগ্রামটা ছিঁড়ল দীপাবলী
৩. ৩. এরকম একটা দিনের কথা
৪. ৪. অর্জুন নায়েক
৫. ৫. ঘুম এসেছিল অনেক রাত্রে
৬. ৬. এস ডি ওর অফিসে
৭. ৭. অবস্থা খুব গোলমেলে
৮. ৮. দীপাবলী বসে পড়ল
৯. ৯. সতীশবাবু
১০. ১০. দাদাবাবু
১১. ১১. বাঙালির চরিত্র
১২. ১২. শুতে বসতে অস্বস্তি
১৩. ১৩. ন্যাড়া গাছটা
১৪. ১৪. হাটতলা পেরিয়ে
১৫. ১৫. সকালে উঠেই তিরি চলে গিয়েছে
১৬. ১৬. দোতলা বাসের জানলা
১৭. ১৭. জীবন দাবা খেলার মত
১৮. ১৮. এ এক অপূর্ব আনন্দ
১৯. ১৯. দিল্লী শহরে
২০. ২০. ইন্টারভিউ কেমন হল
২১. ২১. খাম খুলে চিঠির ওপর নজর
২২. ২২. বুকের ভেতর জমে থাকা ছেলেবেলা
২৩. ২৩. ঘুম ভেঙ্গেছিল সাতসকালে
২৪. ২৪. কিছু জিনিসপত্র কেনার ছিল
২৫. ২৫. যাত্রাপথে
২৬. ২৬. কিছু ভাল ছেলেমেয়ে
২৭. ২৭. কর্মচারীদের আচরণবিধি
২৮. ২৮. শুভ্রাদের বাড়ির সামনে
২৯. ২৯. নতুন ফ্ল্যাটে
৩০. ৩০. দিল্লীতে দূরত্ব কোন সমস্যাই নয়
৩১. ৩১. সরকারি চাকরিতে
৩২. ৩২. চাকরির ক্ষেত্রে
৩৩. ৩৩. ঘরে বাইরে নিরন্তর যুদ্ধ
৩৪. ৩৪. প্রাথমিক পর্বে নির্লিপ্ততা
৩৫. ৩৫. এ এক অদ্ভুত সম্পর্ক
৩৬. ৩৬. দীপাবলী এবং অলোক
৩৭. ৩৭. হাওড়া স্টেশনে
৩৮. ৩৮. কলকাতা অফিসের এক নম্বর বস
৩৯. ৩৯. সুখের চেয়ে স্বস্তি ভাল
৪০. ৪০. মনোরমা কলকাতায়
৪১. ৪১. মনোরমার জ্বর
৪২. ৪২. মনোরমার বিদ্রোহ
৪৩. ৪৩. নিজের মনের অন্ধকার

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন