১৫. সকালে উঠেই তিরি চলে গিয়েছে

সমরেশ মজুমদার

সকালে উঠেই তিরি চলে গিয়েছে হাটতলায়। রান্নাঘরের জিনিসপত্রে টান পড়েছে। আজ রবিবার। চুপচাপ বিছানায় পড়ে থেকেও দীপাবলী বুঝল গনগনিয়ে সূর্যদেব উঠছেন। জানলা বন্ধ তবু তাঁর আঁচে বোঝা যাচ্ছে দিনভর তিনি জ্বলবেন আর জ্বালাবেন। ক’দিন যেসব মেঘেরা আকাশ কাঁপাচ্ছিল তারা চলে গিয়েছে ডুয়ার্স কিংবা আর কোথাও।

ছুটির দিনেও বিছানায় শুয়ে থাকার অভ্যেস তৈরি হয়নি তার। কিন্তু সে আজ ইচ্ছে করেই উঠছিল না। চোখ খুলে এই ঘর, ছায়াছায়া ঘরের কোণ দেখতে দেখতে আচমকাই নিশ্বাস বেরিয়ে এল। হঠাৎ মনে হল সে বড্ড ভাল হয়ে আছে। সততা, রুচি, বিবেক ইত্যাদি ব্যাপারগুলো নিয়ে হয়তো বেশিরকমের বাড়াবাড়ি করছে। একটা রক্তমাংসের মানুষের যা করা উচিত, অথবা মানুষীরা যা করে থাকে তার ধারে কাছে যাচ্ছে না। নিজেকে আজ কীরকম নীরক্ত বলে মনে হতে লাগল। তার জায়গায় একটি পুরুষ থাকলে কী করত? যে-পুরুষ জীবন শুরু করার মুহূর্তেই ধাক্কা খেয়েছে। বল্‌গাহীন জীবনযাপন করত? সেটা কীরকম? সবকিছু ছড়িয়ে এলোমেলো করে রাখা, মদ্যপান কিংবা নারীসঙ্গে নিজেকে বিস্তৃত করা! একা সেই পুরুষ যদি ভিতু না হয়, যদি তার পাপবোধ নিজের মতো করে তৈরি থাকে তা হলে সে এসব কাজ করতেই পারে। কিন্তু নারীর পক্ষে চোরাপথে কানামাছি খেলে স্বাদ মেটানো ছাড়া ওই জীবনের কাছে পৌঁছাতে এই সামাজিক ব্যবস্থা কখনওই দেবে না। আর তার নিজের ক্ষেত্রে তো এ-ব্যাপারের জন্যে কখনওই কোনও আকর্ষণ দানা বাঁধেনি। কার এক গল্পে যেন পড়েছিল কোনও এক মানষ বিবেকানন্দের আন্তরিক ভক্ত ছিলেন। তাঁর কথা তাঁর গল্পে মানুষটির জীবনের শতকরা তিরিশ ভাগ বুঁদ হয়ে থাকত। সেই একই মানুষ মদ্যপান করতে যেতেন প্রকাশ্যে। খারাপ পাড়ায় গিয়ে বারবনিতাদের সঙ্গে সময় কাটাতে ভারী ভালবাসতেন। মানুষটি পছন্দসই বারবনিতার সঙ্গে অবসরে গল্প বলতেন বিবেকানন্দ বিষয়ে। তাঁর জীবনের এমন অনেক চমকপ্রদ ঘটনা যা সেই বারবনিতাকেও আকর্ষণ করত। হয়তো মানুষটির গল্প বলার ক্ষমতা ছিল নিপুণ। শুনতে শুনতে নাকি সেই বারবনিতা একদিন ব্যাবসাই ছেড়ে দিল। মানুষটিকে বলল, ‘আর এসো না বাপু আমার কাছে। ঘেন্না ধরে গেছে এ-জীবনে। আহা, তিনি কী করতে বলেছিলেন আর আমি কী করেছি এত দিন!’ সত্যি সেই স্ত্রীলোকটির জীবন পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিল অথচ ওই মানুষটির হয়নি। কেউ তাঁকে ঘটনাটা বলে প্রশ্ন করতেই তিনি হেসেছিলেন, ‘আমার মনে যদি বিশ্বাস খাঁটি না হত তা হলে ওর মনে বিশ্বাস জন্মাত না। কিন্তু খাঁটি বলেই যদি এখানে আসা বন্ধ করি তা হলে ওর তো কোনওকালেই মুক্তি আসত না। ও গেল, দেখি আর যদি কেউ যায়!’

গল্পটি মনে পড়তেই হেসে ফেলল দীপাবলী। যতই সে নিজে গম্ভীর মুখে চলাফেরা করুক আসলে সে নিশ্চিতভাবে গবেট। রাগ অপমান বেড়ে গেলে সমঝোতা করতে শিখল না। হুট করে এই চাকরিটা ছেড়ে দিল। সবকিছু পাকা হয়ে গিয়েছে। এস ডি ও, ডি এম-রা তো দরখাস্ত গ্রহণ না করানো পর্যন্ত স্বস্তি পায়নি। অথচ সামনে কী পড়ে আছে তা তার জানা নেই। এই কোয়ার্টার্স ছেড়ে যাওয়ার সময় এলে চারদিকে নিচ্ছিদ্র অন্ধকার।

পাশ ফিরে শুয়ে দীপাবলী সেই হস্টেলটার কথা ভাবল। সোজা কলকাতায় চলে গিয়ে দেখা করলে হয়। পুরনো বোর্ডার বলে জায়গা থাকলে জায়গা মিলতে পারে। না হলে অন্য হস্টেলে। একটু পাকা ব্যবস্থা করে রাখা যাতে মেয়াদ ফুরিয়ে এলে জলে পা না বাড়াতে হয়। চাকরি থেকে সব দিয়ে থুয়েও যা হাতে আছে এবং আসবে তাতে কয়েক মাস তো কাটানো যেতে পারে টাকার কথা না ভেবে। চোখ বন্ধ করল দীপাবলী। তিন দিনের ছুটি নিয়ে কলকাতায় যেতে হবে। এইসময় বাইরের দরজায় শব্দ বাজল। বেরুবার সময় তিরি মাটিতে ছিটকিনি ফেলে দরজা টেনে দিয়ে গিয়েছিল। অনিচ্ছা সত্ত্বেও উঠতে হল। বাইরের লোক কেউ হলে বড় অস্বস্তির। বাসিমুখে কারও সঙ্গে কথা বলতেই তার খারাপ লাগে। কিন্তু আজ সেটা উপেক্ষা করে দরজা খুলে তিরিকে দেখে নিশ্চিন্ত হয়ে ফিরল। তিরির মুখে উত্তেজনা, এক হাতে বাজারের থলে অন্য হাতে একটা খাম।

‘জানো, সিনেমার লোকজন সব কাল রাত্রে ফিরে গিয়েছে। সবার মাথায় হাত।’

‘মাথায় হাত কেন?’

‘বাঃ, পকেটে টাকা আসছিল বন্ধ হয়ে গেল। আর এই নাও তোমার চিঠি। কাল নাকি এসেছে, জ্বর হয়েছিল বলে কাল দিতে পারেনি, বাড়ি নিয়ে গিয়েছিল, দেখা হতে দিয়ে দিল। চা করব?’ খাম হাতে নিয়ে মাথা নাড়ল দীপাবলী। তারপর বেতের চেয়ারে গিয়ে বসল। অমলকুমারের চিঠি। যাদের ছিল সরাসরি চলে আসার কথা তাদের খবর নিয়ে চিঠি এল। চোখ সরিয়ে নিল সে। এই চিঠি পড়তে বিন্দুমাত্র আগ্রহ হচ্ছে না। বিষয় কী তা তো জানাই। না আসতে পারার জন্যে নিশ্চয়ই একগাদা যুক্তি থাকবে সেইসঙ্গে বিনীত ক্ষমা প্রার্থনা। চিঠিটাকে খামের ভেতর ঢুকিয়ে রাখল সে। আর তারপরেই মনে এল, ওরা না এসে ভালই করেছে। এখন এই জায়গা ছেড়ে যাওয়ার আগে ওরা এলে সে কী বলত? আমার চাকরি নেই, চলে যাচ্ছি। অমলকুমার কীভাবে নিত জানা নেই তবে মাসিমার নিশ্চয়ই ভাল লাগত না কথাটা শুনতে। যার কাছে বেড়াতে আসা সেই যদি শেকড়ছিন্ন হয় তা হলে কি খুশি থাকা যায়? মানুষ বড় দুঃখের সঙ্গী চায়, কিন্তু অপমান হজম করতে হয় একা, নিজের মতন করে। এখন তার সেই সময়। অমলকুমাররা না এসে একদিক দিয়ে তার বড় উপকার করেছে।

সারাটা দিন কেউ এল না। সতীশবাবু মাঝে মাঝে রবিবারেও এসে দেখা করে যান। আজ তাঁরও দেখা পাওয়া গেল না। বিকেলে চা খেতে খেতে তিরির সঙ্গে কথা বলছিল সে। তিরি জেনেছে সে এখান থেকে চলে যাবে। জানার পর এ-বিষয় নিয়ে আর কথা বলেনি। আজ সে নিজে থেকেই ডেকেছিল তিরিকে। কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে মেয়েটা আচমকা প্রশ্ন করল, ‘আমাকে তুমি সঙ্গে নিয়ে যাবে না?’

‘তুই আমার সঙ্গে যাবি!’ খুব অবাক দীপাবলী।

মাথা নাড়ল তিরি।

‘দুর! আমার নিজেরই কিছু ঠিক নেই। কোথায় থাকব তাই জানি না। তোকে নিয়ে রাখব কোথায়?’

‘কেন? তুমি কোথায় থাকবে?’

‘জানি না রে!’

‘তা হলে আমার কী হবে?’

গলার স্বরে চমকে উঠল দীপাবলী এবং দ্রুত সহজ করতে চাইল তিরিকে, ‘কেন? এখানেই থাকবি। আমি সতীশবাবুকে বলে যাব। এর পরের অফিসার এলে তাঁর কাছে কাজ করবি।’

‘সেই লোকটা যদি একা হয়?’

দীপাবলী মেয়েটার মুখ দেখল, ‘তুই তো আমার আগে একটা লোকের কাছে কাজ করেছিস!’

মুখ নামাল তিরি, ‘তখন করেছিলাম, তোমার কাছে থাকার পর আর করতে চাই না। তা ছাড়া—!’

দীপাবলী অপেক্ষা করল। তিরির মুখ আরও নামল, ‘তুমি চলে গেলে অর্জুনবাবু আমাকে ঠিক জোর করে ধরে নিয়ে যাবে। তুমি আমাকে সঙ্গে নিয়ে চলো।’

‘তুই বরং এবার বাবার কাছে ফিরে যা।’

‘নাঃ।’ দ্রুত মাথা নাড়ল মেয়েটা, ‘বাবা তো দু’দিনও ঘরে রাখবে না।’

‘তা হলে বংশীর কাছে গিয়ে কিছুদিন থাক।’

‘তুমি সত্যি আমাকে নিয়ে যেতে পারবে না?’

‘এখনই না। যদি চাকরিবাকরি পাই, থাকার জায়গা জোটে, তখন তোকে নিয়ে যাব। কিন্তু এখান থেকে গিয়ে তুই কি মানিয়ে নিতে পারবি? বড় শহর হলে অনেক লোকজন থাকবে!’ দীপাবলীর কথা শেষ হতে-না-হতেই তিরি তড়াক করে উঠে দাঁড়াল। দূরে একটা জিপ দেখা দিয়েছে। একটি বাক্যও ব্যয় না করে মেয়েটি ভেতরে চলে গেল। দীপাবলী দেখল এগিয়ে আসছে জিপটা, অর্জুন নায়েকের জিপ। সঙ্গে সঙ্গে আড়াল হয়ে গেল। সেই ঘটনার পর অর্জুন নায়েকের দেখা পায়নি সে। থানার দারোগা শঙ্কর ঘোষ পর্যন্ত এদিকে পা বাড়াননি। প্রথম ক’দিন আক্রমণের ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকতে হয়েছিল। কিন্তু অর্জুন অদ্ভুত উদাসীন থেকেছে তার সম্পর্কে। অত বড় অপমানের পর প্রতিশোধ নেওয়ার আকাঙ্ক্ষাটাই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু অর্জুন মোটেই সে-পথে যায়নি। এমনকী সে যে এই তল্লাটে রয়েছে তাও বুঝতে দেয়নি। অথচ সতীশবাবু জানিয়ে গিয়েছেন অর্জুন বেশ বহাল তবিয়তে এখানে রয়েছে। অবাক হয়েছিল দীপাবলী। ক্রমশ সময় অবস্থাটাকে সহজ করে দিলে একটু কৌতুহলও জেগেছিল। তাকে অর্জুনের শত্রু ভাবাই স্বাভাবিক। আর এইসব লোক নিজের এলাকায় শত্রুকে পিষে ফেলতে মোটেই দ্বিধা করে না। রহস্য তাই সেখানেই।

জিপ থামতেই খুব ধীরেসুস্থে নামল অর্জুন। পরনে ধবধবে চুড়িদার পাজামা পাঞ্জাবি। দীপাবলী উঠে দাঁড়াতেই হাত জোড় করল, ‘নমস্কার। কেমন আছেন বলুন?’

দীপাবলী ওর ঠোঁটে সেই হাসিটাকে দেখতে পেল। গম্ভীর মুখে সে জবাব দিল, ‘ভাল।’ মাথা নাড়ল অর্জুন, চারপাশে তাকাল। তারপর বুকপকেট থেকে একটা ভাঁজ করা কাগজ বের করে এগিয়ে এল, ‘আপনার চিঠি। ডিরেক্টর সাহেব যাওয়ার আগে দিয়ে গিয়েছেন।’

দীপাবলী চিঠিটা নিল। এই লোকের মুখের চেহারা এবং গলার স্বর দেখে কে বলবে দু’দিন আগে থানায় ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় কীরকম আস্ফালন করেছিল! আপাত নির্লিপ্ত হয়ে চিঠির ভাঁজ খুলল সে। সুবিনয় সেন মার্জনা চেয়েছেন যাওয়ার আগে দেখা করে যেতে পারেননি বলে। শুটিংকে কেন্দ্র করে যেসব অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে গেছে তার জন্যে আন্তরিক দুঃখপ্রকাশ করেছেন। লিখেছেন, তাঁর এতদিনের পরিচালক জীবনে এমন ব্যাপার কখনও ঘটেনি। কিছু একটা তাঁর অজান্তে ঘটে যাচ্ছিল। আর এসব কারণে তিনি কিছু কাজ সংক্ষেপে তুলেই ফিরে যাচ্ছেন। দীপাবলী যদি কলকাতায় কখনও যায় তা হলে যেন তার সঙ্গে দেখা করে।

চিঠিটাকে আবার ভাঁজ করল দীপাবলী। কোনও প্রয়োজন ছিল না, তবু শেষ মুহুর্তে শিষ্টাচারে বেধেছিল বলেই হয়তো ভদ্রলোক এমন একটা চিঠি লিখে মনের ভার কমিয়েছেন। কিন্তু অর্জন নায়েক এখনও চুপচাপ দাঁড়িয়ে রয়েছে। এই চিঠি দেওয়ার জন্যে ওর এত দূরে আসার প্রয়োজন ছিল না। যে-কোনও অনুগতই ছুটে আসতে পারত। অর্থাৎ আর একটা মতলবের সামনে তাকে দাঁড়াতে হচ্ছে।

সে গম্ভীর গলায় বলল, ‘আর কিছু?’

‘না না। আপনার বোধহয় বিশ্বাস হবার কথা নয় এমনি বিনা কারণে আমি আসতে পারি?’ পায়চারির ভঙ্গিতে দু’পা হাঁটল অর্জুন, ‘আসলে মনে পড়ল, আপনি তো আমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছেনই, যাওয়ার আগে দেখা করা তো আমার কর্তব্য। সত্যি কথা বলছি, আপনি এখানে আসার পর এলাকার মানুষেরা কিছু ব্যাপারে উপকৃত হয়েছে।’

দীপাবলী কোনও কথা বলল না। তার মনে হচ্ছিল সে যা বলবে তারই সূত্র ধরে অর্জুন কথা বাড়াবে। অর্জুন উত্তরের জন্যে সামান্য অপেক্ষা করে বলল, ‘অবশ্য সব জিনিস চিরকাল একভাবে চলতে পারে না। আজ কিংবা কাল পালটানো শুরু হতই। আরে! আপনি অমন গম্ভীর মুখ করে আছেন কেন?’

‘আপনি তো হাসির কথা কিছু বলেননি!’

অর্জুন কিছুক্ষণ তাকাল, ‘আপনি আমাকে কী ভাবছেন বলুন তো! সেদিন পুলিশ দিয়ে অ্যারেস্ট করিয়ে থানায় নিয়ে গিয়েছিলেন বলে উলটোপালটা কিছু করব? দুর। আপনার কাজ আপনি করেছেন, আমি আমার ক্ষমতা ব্যবহার করেছি। প্রথম রাউন্ডে আপনি জিতেছিলেন, শেষ জেতাটা আমার। অবশ্য শেষ জেতা বলিই বা কী করে? এখনও তো অনেককাল বেঁচে থাকতে হবে। তাই বলছিলাম, ওসব ব্যাপার আপাতত চাপা থাক, যাওয়ার আগে আসুন আমরা ভালমন্দ কিছু কথা বলি।’

দীপাবলী মাথা নাড়ল, ‘অর্জুনবাবু, আমার কথা বলতে একটুও ভাল লাগছে না।’

জিভে ছোট্ট শব্দ তুলল অর্জুন, ‘ম্যাডাম, আপনি জীবনে প্রচুর দুঃখ পাবেন।’

‘মানে!’ চোখ ছোট করল দীপাবলী।

‘মুখের ওপর মনের কথা স্পষ্ট উচ্চারণ না করলে দুঃখগুলো দূরে থাকে।’

দীপাবলী হেসে ফেলল, না হেসে পারল না।

‘আমি কোনও হাসির কথা কিন্তু এবারে বলিনি।’

‘না। আপনার মুখে কবিত্ব কিংবা আধ্যাত্মিকতাও আমি আশা করিনি।’

‘আঃ। তাই বলুন। ম্যাডাম, পণ্ডিতরা যা বইয়ে লেখেন তা আমাদের মতো মানুষ জীবন থেকে শিখে নেয়। আমরা বলি আপনারা তার নামকরণ করেন। যা হোক, আমি লোকটা আপনাদের চোখে নিশ্চয়ই খারাপ। মদ্যপান করি, স্ত্রীলোক নিয়ে সন্ধের পর সময় কাটাই, নিজের অধিকারের সীমা বাড়াতে ঘুষ আর ঘুষি, দুটোরই সমান ব্যবহার করি। কেউ আমার ওপর লাঠি ঘোরালে শুধু লাঠি নয় তার হাতও ভেঙে দিতে একটুও দ্বিধা হয় না আমার। এ সবই ঠিক। কিন্তু আপনার সঙ্গে কোনও খারাপ ব্যবহার করতে ইচ্ছে করেনি কখনও। যেখানে খারাপ ব্যবহার করলে আনন্দ আসে সেখানেই করি। তাই আমার ওপরে আপনার রাগ থাকার কোনও কারণ নেই তো!’

‘কথাগুলো মনে হচ্ছে আপনি আগেও বলেছিলেন।’

‘হয়তো। তবে দ্বিতীয় কোনও মানুষকে বলিনি।’

‘দেখুন অর্জুনবাবু, আমি তো চলে যাচ্ছি, আপনার রাজত্ব চালাতে আর কোনও বাধা রইল না। এতে আপনার খুশিই হওয়া উচিত। হয়েছেনও নিশ্চয়ই। তবে আমার সঙ্গে ভাল ব্যবহার করেছেন আপিন, এটা নিশ্চয়ই মনে রাখব।’

‘আমি কৃতজ্ঞ থাকব। যদি কেউ কখনও আমাকে অভিযোগ করে বলে আমার মধ্যে একটুও ভাল নেই তবে তাকে আপনার কাছে পাঠিয়ে দেব। আপনি, আমি জানি, তখনও সত্যি কথা বলবেন।’ অর্জুন আচমকা ঘুরে জিপের দিকে এগোল। একটা পা ভেতরে তুলে সে গলা উঁচু করে বলল, ‘যাওয়ার সময় নিশ্চয়ই গাড়িটাড়ির প্রয়োজন পড়বে। এমনি দিলে তো নেবেন না। যদি জানান তা হলে ন্যায্য দামে ব্যবস্থা করে দিতে পারলে খুশি হব।’ কথা শেষ করেই সে জিপে উঠে ইঞ্জিন চালু করে বেরিয়ে গেল। জিপটা যত আস্তে এখানে এসে পৌঁছেছিল তার থেকে অনেক বেশি গতিতে ছুটে যাচ্ছিল ব্যবধান বাড়াতে। দীপাবলীর দুটো পা যেন মাটিতে শক্ত হয়ে সেঁটে গিয়েছিল। নড়বার শক্তি হারিয়ে ফেলেছিল সে। অর্জুন নায়েককে সে কিছুতেই বুঝতে পারছে না।

জেলা শহর থেকে সন্ধের ট্রেনে উঠে বসেছিল দীপাবলী, সকালেই শিয়ালদায় পৌঁছে যাবে। আবার কলকাতা। আর তখনই তার ভাবনাটা মাথায় এল। সে জন্মেছে উত্তর বাংলার চা বাগানে, কলেজ করেছে জলপাইগুড়িতে, অথচ একা থাকার জায়গা খুঁজতে আজ চলেছে কলকাতায়। একবারও মাথায় আসেনি জলপাইগুড়িতে ফিরে যাওয়ার কথা। প্রকৃতি তার স্বাভাবিক নিয়মেই কলকাতাটাকে বেছে দিয়েছে তাকে। যেখানে শেকড়, মাটি সেখানে নয়, যেখানে ডালপালা পাতা সেখানেই যাও। জানলার ধারে সিট পেয়েছিল সে। মাথা রাখার মতো দেওয়াল রয়েছে পাশে তাই একটু স্বস্তি। চোখ বন্ধ করে ছুটন্ত ট্রেনে বসে থাকতে থাকতে টুকরো টুকরো ছবির মতো সেইসব স্মৃতি ছুটে আসতে লাগল যারা চাপা পড়েছিল পারিপার্শ্বিকতার চাপে। অসীমের মুখ, সকরিকলি মনিহারি ঘাট পেরিয়ে যাওয়া স্টিমারে গঙ্গার বাতাস মেখে। অসীম! অসীম এখন কোথায় আছে? তৃতীয় বর্ষের একটি ছাত্র তার যাবতীয় অপরিপক্কতা নিয়ে সমবয়সি একটি মেয়ের মন পাওয়ার জন্যে শুধু আবেগের কাছে সমর্পিত হয়ে অনর্গল মিথ্যে বলে যাওয়া মুখ নিয়ে উঠে এল তার সামনে। এই একটি ঘটনার কথা জীবনের পরবর্তী পর্যায়ে দীপাবলী অনেক ভেবেছে। কেন সে হঠাৎ মনের অজান্তে অসীমের কথা ভাবতে পেরেছিল? তার ব্যবহারিক জীবনে কোথাও অসীম নেই। যে ছেলেমানুষির পর্যায়কে সে অনেক অনেককাল আগে ছেড়ে চলে এসেছে, সেই সময় কোন জাদুর টানে উঠে এল বিস্মৃতির গভীর থেকে!

রাতটা ছিল অন্ধকারের। চাঁদ ওঠার পক্ষ নয়, তারাগুলোও মিটমিটে। শুধু ছুটন্ত ট্রেনের শব্দ, শনশন অন্ধকার ছিটকে সরে যাচ্ছে দু’দিকে, গিয়েই আবার ঝাঁপিয়ে ফিরছে, দীপাবলী অগভীর ঝরনায় ডুবে থাকা পাথরের মতো সেই অন্ধকার দু’চোখে মিশিয়ে নিচ্ছিল। কতক্ষণ এভাবে কেটেছিল তার জানা নেই, হঠাৎ মনে পড়ল অমলকুমারের কথা। অমলের চিঠিটা আর পড়া হয়নি। এখনও হাতের ব্যাগের কোণে পড়ে আছে সেটা। হাত বাড়াল সে। চিঠিটা চোখের সামনে নিয়ে এসে বুঝল আলো বড় কম। কামরার ছাদের নীচে যে-বাল্‌ব ঝুলছে তা বড় কৃপণ। পাশের আসনগুলোতে যাঁরা বসে আছেন তাঁরা ইতিমধ্যেই সংসার গুছিয়ে নিয়েছেন। সঙ্গে টর্চ আছে। কিন্তু রেলগাড়ির কামরায় বসে টর্চ জ্বেলে চিঠি পড়তে দেখলে অনেকেরই বিস্ময় ছিটকে উঠবে।

দীপাবলী চিঠিটা নিয়ে ভিড় কাটিয়ে কাটিয়ে চলে এল বাথরুমের ভেতরে দরজা বন্ধ করে জোরালো আলোর নীচে ছোট্ট ঘরটিতে দাঁড়িয়ে চিঠি মেলল। ‘দীপাবলী। যা হবার কথা ছিল তা এ যাত্রায় হল না। ঠিক করেছিলাম মাকে নিয়ে একেবারে হাজির হব তোমার কাছে। ক’দিন নিস্তরঙ্গ বিশ্রাম নিয়ে শরীরের ওজন বাড়িয়ে মন হালকা করে ফিরব। হল না। কারণ জানাতে গেলে জায়গা লাগবে অনেক। টেলিগ্রাম করেও পা বাড়াতে পারলাম না যখন তখন নিশ্চয়ই বুঝবে গুরুত্ব কম ছিল না।

এখন আমি এবং মা একেবারে কলকাতার বাসিন্দা। মায়ের অবশ্য এখানে মোটেই ভাল লাগছে না। এর মধ্যেই মতলব আঁটছেন দেশে ফিরে যাওয়ার সুযোগ তৈরি করতে তো মানুষের জুড়ি নেই। পেয়েও গেছেন একটা। আমাকে সংসারী করার সমস্ত বন্দোবস্ত পাকা। কন্যা সুশ্রী, গৃহকর্মনিপুণা এবং সেইসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের গান জানেন। বাঙালি পরিবারে বিয়ের পরে মেয়েদের সংস্কৃতিচর্চা কর্পূরের চেয়ে দ্রুত উবে যায়, দেখেছি। মনে হয় তার ভাগ্যেও অন্য কিছু ঘটবে না। দিনক্ষণ স্থির হতে চলেছে। এ ব্যাপারে তো তোমার উৎসাহ ছিল যথেষ্ট। মা বারংবার বললেন, সেদিন তিনি তোমার দর্শন চান। নিজের কথা এখন আর ভাবি না। যে-মহিলাটি আসছেন তাঁর জীবনে আমার আচরণ যেন কোনও ছায়া না ফেলে সেটুকুই চেষ্টা করে যাব। এ-মাসের পঁচিশ তারিখে লগ্ন। লগ্ন শুভ এবং মেয়েটি যেহেতু রক্ষে পেতে চায় না তাই আমারও পালিয়ে যাওয়ার প্রশ্ন নেই। কিন্তু নতুন জীবনে পা বাড়াবার ঠিক আগের মুহূর্তে তোমার মতো বন্ধুর সঙ্গে কয়েকটা কথা বলতে চাই। আশা করব খুব, ‘অমল।’

ছোট ঘর, পায়ের তলায় ছুটন্ত ট্রেনের মেঝে ঝড়ের দোলায় দুলছে। কানে তালা পড়ার মতো আওয়াজ উঠছে চারপাশ থেকে। দীপাবলী কোনওমতে দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়াল। তার চোখের সামনে রায়কতপাড়া থেকে মেয়েদের কলেজ হস্টেল আসার জলপাইগুড়ির নির্জন জ্যোৎস্নাভেজা পথটা ভেসে উঠল। হঠাৎ সমস্ত শরীর কাঁপিয়ে কান্না উঠে এল গলায়, চোখে। সেই শব্দ মিশে গেল ট্রেনের চাকার আওয়াজে। কেন কান্না আসছে, কেন এমন করে বুকের ভেতরটা থেঁতলে যাচ্ছে সে জানে না, কিন্তু হঠাৎ যেন সমস্ত শরীর অবশ, দু’হাতের মুঠোয় বাথরুমের আংটা ধরেও যেন নিজেকে সামলাতে পারছে না কিছুতেই। কিছুক্ষণ পরে যখন বাইরে থেকে কারও ব্যস্ত হাতের শব্দ বাজল তখন চেতনায় ফিরল সে। হাতের মুঠোয় দলা পাকানো চিঠিটার দিকে তাকিয়ে মনে হল ছুড়ে ফেলে দেয়। কিন্তু তারপরেই মন পালটাল। আঁচলে চোখ মুছে গম্ভীর মুখে সে ফিরে এল নিজের জায়গায়, এসে ব্যাগে রেখে দিল চিঠিটাকে।

সাতসকালে কলকাতায় পৌঁছে মনের সঙ্গে মনের আড়াআড়ি শুরু হয়ে গেল।

এখন কলকাতার চেহারা কীরকম আদুরে! সারারাতের বিশ্রামের পর জড়সড় হয়ে থাকা। অতি বড় লম্পটও দীর্ঘ ঘুমের পর পলকের জন্যেও তপস্বীর চেহারা পেয়ে যায়। কলকাতা এখন তেমন। কোনও চেঁচামেচি নেই, কোনও ব্যস্ততা, মানুষেরা গায়ে গা লাগিয়ে কলকাতা ফুটপাতের দখল নিচ্ছে না। এমন ঠান্ডা কলকাতা যার সঙ্গে একমাত্র তারই তুলনা করা যেতে পারে, ছেড়ে থাকার কোনও মানে নেই। আহা, এই ভোর এবং সকালের আরম্ভটা যদি দিনভর থেকে যেত! দীপাবলীর মনে হল কলকাতার এমন চেহারা হলে এই শহরে কোনও আত্মীয়ের দরকার হত না। স্টেশন থেকে বেরিয়ে সে অনেকটা হেঁটে এল অকারণের কারণে। হাঁটতে ভাল লাগছিল তার। এইসময় ট্রামবাসগুলো কেমন নিজস্ব বলে মনে হয়। হ্যারিসন রোড ধরে কলেজ স্ট্রিট পৌছাতে পৌছাতে কখন কেমন করে দিনের কলকাতা জেগে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে অস্বস্তি। দীপাবলী ছোট্ট ব্যাগটা নিয়ে শ্যামবাজারের ট্রামে উঠে পড়ল। ট্রাম অবশ্য এখনও খালি। তবু অভ্যেসে সে গিয়ে বসল লেডিজ সিটে। বসেই সেটা খেয়াল হল। একটা পুরো ট্রাম খালি পাওয়া সত্ত্বেও কেন যে পা লেডিসমার্কা সিটগুলোর দিকে এগিয়ে আসে!

বনানীদি তখন তক্তাপপাশে বসে আনন্দবাজার খুলে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছিলেন। শব্দ শুনে দরজার দিকে ফিরে চোখ বড় করলেন, “ও মা! অফিসার যে! কী ব্যাপার, ঠিক দেখছি তো!’

গলার স্বরে যে-উত্তাপ ছিল তাতে ভাল লাগা তৈরি হল। দীপাবলী ঘরে ঢুকে ধপ করে বসে পড়ল তক্তাপোশে, তোমার চোখে ন্যাবা হয়নি। সারারাত ট্রেনে জেগে এসেছি, বেশি প্রশ্ন কোরো না।’

‘আরে! আমি প্রশ্ন করলাম কখন?’ বনানীদি সরে বসলেন, ‘ওঃ, তুই এসে খুব ভাল করেছিস। আজ আমাদের হেডমিস্ট্রেসের ভাইয়ের বিয়ে।’

‘তোমার হেডমিস্ট্রেসের ভাইয়ের বিয়ের সঙ্গে আমার কী সম্পর্ক?’

‘দাড়া না, সেদিন গড়িয়াহাটে গিয়েছিলাম। ঠিক মোড়ের মাথায় একটা শাড়ির দোকান আছে না, দেখেছিস, ও দেখিসনি, খুব বড় দোকান, তার শোকেসে যা একখানা সুন্দর শাড়ি দেখলাম না, কী বলব, মন জুড়িয়ে গেল। দোকানে ঢুকে দাম জিজ্ঞাসা করতেই জিভ কামড়ালাম। সাড়ে তিনশো টাকা! তুই বোঝ! সব ভাল ভাল জিনিস না বড়লোকরা নিয়ে নেয়।’

এরও সঙ্গে হেডমিস্ট্রেসের ভাইয়ের বিয়ের কোনও সম্পর্ক নেই।’

‘আঃ। সেইরকমই একটা শাড়ি পেয়ে গেলাম শ্যামবাজারের দোকানে। দাম মাত্র একশো বাষট্টি। কিনে ফেললাম দুম করে। ওটা পরেই তো আজ বিয়েবাড়িতে যাব। কিন্তু কেবলই মনে হচ্ছে একই শাড়ির দাম দু’জায়গায় দু’রকম হবে কেন? একদম নর্থ পোল সাউথ পোল? কাউকে দেখাতেও পারছি না।’

‘কেন?

‘বাব্বা! যা সব নতুন নতুন মেয়ে এসেছে আর তাদের যেমন ছোট মন! কত গল্প তৈরি করবে তা তো জানি। তা তুই এসে গিয়েছিস, ভালই হল, তুই একবার দ্যাখ তো শাড়িটায় গোলমাল আছে কিনা।’

দীপাবলী মাথা নাড়ল, বনানীদি, আমি শাড়ি চিনি না।’

‘যাঃ! মেয়েমানুষ শাড়ি চিনবে না কী!’

‘তুমি কি মেয়ে নও?’ ‘

তোরা আজকের মেয়ে, আমরা কোন কালের।’

‘উঁহুঁ, আমি মনে করি মেয়েদের অনেক কাজ আছে। শুধু শাড়ি গয়নার জন্যে তারা জন্মায় না।”

‘তোর সঙ্গে কথায় পারা যায় না। সর, তোকে শাড়িটা দেখাই।’

‘দাঁড়াও না। বিকেলে যখন বিয়েবাড়িতে ওটা পরে যাবে তখন দেখব।’

‘আ্যঁ! বিকেলে! সত্যি বলছিস, ততক্ষণ তুই এখানে থাকবি?’

দীপাবলী হাসল, ‘তোমাদের এই হস্টেলে কোনও সিট খালি আছে? ’

‘তার মানে?’

‘আমি চাকরি ছেড়ে দিয়ে এসেছি। কলকাতায় একটা থাকার জায়গা চাই। হাতে কিছু টাকা আছে। যদি এখানে জায়গা থাকে তা হলে খুব ভাল হয়, বেঁচে যাই।’ দীপাবলী তক্তাপোশের এক পাশে শরীর এলিয়ে দিল। দিয়ে বলল, ‘আঃ! কী আরাম!’

বনানীদি ঝটপট দেওয়ালের দিকে সরে গেলেন, ‘এই! সত্যি কথা বলছিস? তুই চাকরি ছেড়ে দিয়েছিস?’

হাসল দীপাবলী। তারপর মাথা নাড়ল। বনানীদির গলার স্বরে যত রাজ্যের অবিশ্বাস। পাগল না হলে কেউ এমন কাজ করে। পাগল! উন্মাদ। হঠাৎ গানের লাইনটা মনে পড়ল। উন্মাদকে না দেখে আকাশের চাঁদ পাণ্ডুর হয়েছিল।

বনানীদিকে বিস্তারিত বলার কোনও মানে হয় না। তবু কিছুটা বলল। এখনও এই কলকাতা শহরে অনেক মানুষ আছেন যারা যন্ত্রসভ্যতার চাপে নীরক্ত হয়ে যাননি। এখনও কিছু মানুষ আশ্চর্য সরল চোখে জীবনটাকে দেখে থাকেন। তাঁদের মনে ন্যায় নীতি ইত্যাদি ব্যাপার চমৎকার আঁটোসাঁটো হয়ে থাকে। ভাল এবং মন্দকে দুটো জায়গায় রেখে মাঝখানে একটা বর্ডার ফেলতে তাঁদের কোনও দ্বিধা নেই। এঁদের খুব সহজে ঠকিয়ে যেতে পারে মতলববাজ মানুষেরা। বনানীদি সেই গোত্রের মানুষ। অতএব ওপরওয়ালারা ঘুষ নিচ্ছে আর নিরন্ন মানুষ ঘুষি খাচ্ছে এবং তার মাঝখানে থেকে চোখ বন্ধ রাখতে পারেনি দীপাবলী, অথচ প্রতিবাদের শক্তি জন্মানোমাত্র মৃত করে দেওয়া হয় বলে চাকরি ছেড়ে এসেছে শুনে বনানীদি দ্রুত মাথা নাড়লেন, ‘ঠিক করেছিস। এইজন্যে বলি মেয়েছেলের উচিত স্কুল কলেজে পড়ানো। তুই ইচ্ছে করলেই পড়ানোর চাকরিটা পেতে পারিস। এক কাজ কর, বিটি-টা করে নে এখন।’

‘বনানীদি, তোমাকে অনেকবার বলেছি প্রাইভেট বাসের কনডাক্টরের মতো মেয়েছেলে মেয়েছেলে বলবে না।

‘ওরে বাব্বা! আসলে জন্ম থেকে কথাটা শুনে এসেছি তো তাই জিভের ডগায় বসে গেছে।

‘তুলে ফেলো। মেয়েমানুষ বললে যে মানে ছেলেমানুষ বললে ছেলেদের ক্ষেত্রে যখন সেই একই মানে হয় না তখন কেন বলবে!’ মাথা নাড়ল সে, ‘স্কুলে পড়াবার জন্যে আমি জন্মাইনি।’

‘তা হলে তুই কী জন্যে জন্মেছিস ভাই?’

নিশ্বাস বন্ধ করল দীপাবলী। তারপর অন্যরকম গলায় বলল, ‘সত্যি! জন্মটাই যে কেন হল?’

‘আঃ, আবার নাটক বা নবেলের কথা। তোর সব ভাল, মাঝে মাঝে এমন কথা বলিস!’

‘কীরকম কথা?’

‘জানি না।’

‘তবু?’

‘অন্যরকম। বুঝতে পারি কিন্তু ধরতে পারি না।’

‘বাঃ, চমৎকার। একটা উদাহরণ দাও।’

‘এই ধর রবীন্দ্রনাথের অনেক গানের মতো।’

‘কী বললে?’ স্প্রিং-এর মতো লাফিয়ে উঠল দীপাবলী। দু’হাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরল বনানীদিকে, ‘তুমি যা বললে তার এক ভাগও যদি পেতাম তা হলে দশবার জন্মাতে আমি রাজি আছি।’

‘তুই যে কী বলিস বুঝতে পারি না। সত্যি তুই এখানে থাকবি?’

‘হ্যাঁ।’

‘কিন্তু হস্টেল তো ভরতি।’

‘একটাও সিট খালি নেই?’

‘না। নাম লিখিয়ে বসে আছে কতজন।’

‘ওঃ। তা হলে কী করা যায়!’

‘একটা কিছু ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত তুই আমার কাছে থাক।’

‘বলছ?’

‘এতে আবার বলাবলির কী আছে?’

‘তোমার অসুবিধে হবে না তো?’

‘মারব এক গাঁট্টা।’ দীপাবলীর শরীরে আলতো চড় মারলেন বনানীদি।

‘মুশকিল কী জানো, বাড়ি ভাড়াও চট করে কেউ দেবে না আমায়। আবার নেই নেই করে কোয়ার্টার্সে যা সব সম্পত্তি জমে গেল তাই বা রাখি কোথায়?’

‘কোয়ার্টার্স ছেড়ে দিয়েছিস?’

‘না, এখনও কিছুদিন অধিকারে আছে।’

‘যা মুখ হাত ধুয়ে কাপড় পালটা। এ নিয়ে পরে ভাবনা করা যাবে।’

‘তোমার রুমমেট কোথায়?’

‘কাল বাইরে থেকেছে।’

‘মানে? বলো কোথাও গিয়েছেন।’

‘দূর! মাঝে মাঝেই ও হস্টেলে ফেরে না। তুই রাগ করবি কিন্তু ও নষ্ট মেয়েমানুষ।’

‘ওঃ। বনানীদি—!’

‘সত্যি কথা বললাম। মেয়েদের চারপাশে কোথাও একটা বর্ডার থাকা উচিত। ওর তা নেই।’

‘তাই বলে নষ্ট হয়ে গেল?’

‘তুই তো আছিস, বুঝতেই পারবি।’ বনানীদি তক্তাপোশ থেকে উঠে দাঁড়ালেন, ‘যা আর দেরি করিস না। আমাকে এখনই স্কুলে যেতে হবে। গামছা সঙ্গে আছে না আমারটা দেব?’

‘তুমি অকারণে ব্যস্ত হচ্ছ। আমাকে কয়েকটা দিন আশ্রয় দাও তা হলেই হবে।’

দুপুরে একা হয়ে গেলে কী করবে বুঝে উঠতে পারছিল না দীপাবলী। নতুন চাকরিবাকরির কোনও হদিশ ভাবামাত্র হবে না এটা সে জানে। একটা চাকরি পেতে কয়েক মাস, হয়তো বছরও অপেক্ষা করতে হতে পারে। কিন্তু থাকার পাকা জায়গা চাই! এই হস্টেলে যখন হল না তখন অন্য হস্টেলগুলোয় চেষ্টা করা উচিত। এর আগেরবার থাকার সময় সে আরও দুটো হস্টেলের খবর জেনেছিল। একটি আছে পূরবী সিনেমার সামনে, শিয়ালদায়, অন্যটি মানিকতলায়। দূরত্ব খুব বেশি নয়।

বিকেল তিনটে নাগাদ দীপাবলী আবিষ্কার করল কলকাতায় এসে একা বাস করছে এমন মেয়ের সংখ্যা যেন হুড়মুড়িয়ে বেড়ে গিয়েছে। কোথাও ঠাই নেই, খুব অল্প সময়ের মধ্যে যদিও বা দু’-একটা সিট খালি হতে পারে কিন্তু তার জন্যে প্রতীক্ষায় রয়েছে অনেকে। আর ওই দুটো হস্টেলে ঘুরে সে জানতে পারল শুধু উত্তরে নয়, দক্ষিণেও মেয়েদের থাকার হস্টেল বেড়েছে। কিন্তু চাহিদার তুলনায় তার সংখ্যা এত কম যে ঘুরে ঘুরে পা ব্যথা হওয়া ছাড়া নতুন কোনও লাভ হল না। এবং তখন তার রাধার কথা মনে পড়ল। কলেজে থাকার সময় সাহস দেখিয়ে সে রাধাদের কলোনিতে ঘর ভাড়া করে ছিল কিছু সময়। রাধা ছিল বলেই সেটুকু সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু অনভ্যাসের চন্দন এত শুকিয়ে খটখটে হয়ে গিয়েছিল যে অসুখ নিয়ে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু অমন একটা দুর্ঘটনা, সেটা না ঘটলে তো একসময় নিশ্চয়ই অভ্যেসে এসে যেত একা থাকা। দক্ষিণের হদিশ বিফল হতে গড়িয়াহাটের মোড়ে দাড়িয়ে সে একবার ভাবল রাধার কাছে যাবে কিনা। রাধা কী করছে কেমন আছে তা কলেজ ছাড়ার পর আর জানা নেই। এবং তখনই তার মনে পড়ল রাধার দাদার কথা। কী যেন নামটা—! দীপাবলী কিছুতেই মনে করতে পারছিল না। কিন্তু সেই সাধারণ সহজ লোকটি গড়িয়াহাটের ফুটপাতেই দোকান করত। দীপাবলী মুখ ফিরিয়ে দেখল গড়িয়াহাটের মোড়ের চার রাস্তার ফুটপাত জুড়ে সার সার দোকানে ব্যস্ততা চলছে। এদের সংখ্যা কম নয় এবং তার মধ্যে কোনটে বাধার দাদার তা খুঁজতে যথেষ্ট সময় লাগবে। তবে ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা হলে সে রাধার বর্তমান অবস্থা জানতে পারত। দীপাবলী হাঁটতে লাগল। তিনটে রাস্তা অনেকখানি ঘোরার পর সে দেখল একটি ঘণ্টা কেটে গিয়েছে। এবার চতুর্থ রাস্তায় পা বাড়িয়েই মনে হল একটা লোক অনেকক্ষণ তার পিছু ছাড়ছে না। লোকটিকে সে অন্তত এর আগের দুটো রাস্তায় পেছন পেছন আসতে দেখেছে। তখন মাথা ঘামায়নি। কলকাতার ফুটপাতে যে-কোনও মানুষের ইচ্ছেমতো হাঁটার অধিকার আছে। আর তা ছাড়া এতদিন বাইরে থেকে তার চিন্তায় আসে না একটা লোক খামোকা পেছন পেছন হাঁটতে পারে। সে ঘুরে দাড়িয়ে লোকটাকে দেখতেই বুঝল সন্দেহটা অমূলক নয়। মুহূর্তেই কেমন নার্ভাস হয়ে গেল মানুষটার মুখ। চোরের মতো ডানদিকে বাঁদিকে তাকাতে লাগল। দীপাবলী যে চট করে থেমে যাবে তা সম্ভবত ভাবতে পারেনি। এখন না পারছে থামতে না স্বচ্ছন্দে এগোতে। তবু দ্রুত সেই ভাবটা কাটিয়ে পাশের স্টলের সামনে গিয়ে পত্রিকা দেখতে লাগল। ওর দেখার ভঙ্গিতে বোঝা গেল পত্রিকাগুলোকে সে আগে নাড়াচাড়াও করেনি। দীপাবলী উপেক্ষা করল। আগবাড়িয়ে কথা বলার কোনও মানে হয় না, বিশেষ করে লোকটা যখন সরাসরি তাকে কিছু বলছে না। সে আবার হাঁটতে শুরু করল। হঠাৎ কানে এল, ‘আরে! দীপাবলী না!’

চমকে পেছনে ফিরতেই সে হতভম্ব। সুদীপ। ঢোলা পাঞ্জাবির নীচে প্যান্ট পরেছে, হাতে গোটা তিনেক মোটা ইংরেজি বই। একটু রোগা হয়েছে যদিও গায়ের রঙে ফরসাভাব এসেছে। সুদীপ এগিয়ে এল, ‘আমি ঠিক দেখছি তো? হ্যাঁ, ঠিকই। কী ব্যাপার?’

‘খুব চমকে গিয়েছিলাম।’ দীপাবলী বুকে হাত রাখল।

‘সেটা তো বুঝতেই পারছি। শুনেছিলাম তুমি বাংলাদেশের কোন জেলার ডাকসাইটে অফিসার।’

‘বাংলাদেশ নয়, পশ্চিমবঙ্গ।’

‘রাখো! আমাদের জেনারেশন পর্যন্ত কেউ চট করে পশ্চিমবঙ্গ বলতে পারবে না। কোন জেলায় আছ তুমি? এখানে কী করছ?’

‘অনেকগুলো প্রশ্ন হয়ে গেল। তার আগে বলো, তুমি এখন কোথায় যাচ্ছ?’

‘কলেজে ক্লাস করিয়ে বের হলাম। এখন কলেজ স্ট্রিটে কফিহাউসে যাব।’

‘সেকী? তুমি, তোমরা এখনও নাটক করো না?’

‘অবশ্যই। আজ রিহার্সাল নেই।’

‘তা হলে চলো তোমার সঙ্গে উত্তরে ফিরে যাই। যে প্রশ্নগুলো করেছ তার উত্তর দিতে কিছুটা সময় লাগবে।’ কথা বলতে বলতে দীপাবলী লক্ষ করল সেই অনুসরণকারী এবার উলটোদিকে হাঁটতে শুরু করেছে।

একটা টু বি বাস খালি পাওয়া গেল। সুদীপের সঙ্গে দোতলায় উঠে পাশাপাশি বসল সে। সুদীপকে দেখে তার কিছুতেই অধ্যাপক বলে মনে হচ্ছিল না। যদিও ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি থাকায় সুদীপকে বেশ ব্যক্তিত্ববান বলে মনে হচ্ছিল। অবশ্য একদিন এই সুদীপ শমিতের পাশে প্রায় নিবে থাকত। শমিতের মুখ মনে পড়ামাত্র তার মুখ শক্ত হল। সে জিজ্ঞাসা করল, “তোমাদের শমিতের খবর কী?’

‘আমাদের!’ হেসে ফেলল সুদীপ, ‘শমিত এখন বাংলাদেশের তামাম নাট্য প্রেমিকের। নতুন দল করেছে, নাটক নামিয়েছে। ফাটাফাটি ব্যাপার।’

তুমি দেখেছ?’

‘না শুনেছি। সময় পাইনি যাওয়ার।’

সুদীপের গলার স্বরে যতই নিরাসক্তি থাকুক তবু দীপাবলীর মনে হল বলার ভঙ্গি সহজ নয়। এই সুদীপ এবং শমিত একসময় হরিহর আত্মা ছিল।

রাসবিহারীর মোড় ছাড়ালে দীপাবলী বলল, ‘সুদীপ, আমি চাকরি ছেড়ে এসেছি। আপাতত কলকাতায় একটা থাকার জায়গা দরকার।’

‘তা হলে তুমি আজই মায়ার সঙ্গে কথা বলো।’

‘মায়া?’

‘তুমি জানো না আমি মায়াকে বিয়ে করেছি?’

‘দীপাবলী মাথা নাড়ল, ‘তা জানি।’

‘কার কাছে শুনলে?’

‘শমিতের কাছে।’

‘অ্যাঁ?’ চমকে উঠল সুদীপ, ‘শমিত! শমিতের সঙ্গে তোমার যোগাযোগ আছে?’

‘এখন নেই। কিছুদিন আগে ও আমার কাছে এসেছিল। তখনই যোগাযোগের রশি ছিঁড়ে গিয়েছে।’

‘তা হলে তুমি বেঁচে গেছ!’

‘মানে? ’

‘দীপাবলী, নাটক বুঝিয়েছে শুধু এই কারণে একটা লোককে চিরকাল কৃতজ্ঞতা জানানো যায় না যদি তার জীবন এবং আচরণের জন্যে মনে অবিরত ঘৃণা জন্মাতে থাকে।’ সুদীপ মুখ বিকৃত করল।

সকল অধ্যায়

১. ১. কাকভোর বলে কিছু নেই এখানে
২. ২. টেলিগ্রামটা ছিঁড়ল দীপাবলী
৩. ৩. এরকম একটা দিনের কথা
৪. ৪. অর্জুন নায়েক
৫. ৫. ঘুম এসেছিল অনেক রাত্রে
৬. ৬. এস ডি ওর অফিসে
৭. ৭. অবস্থা খুব গোলমেলে
৮. ৮. দীপাবলী বসে পড়ল
৯. ৯. সতীশবাবু
১০. ১০. দাদাবাবু
১১. ১১. বাঙালির চরিত্র
১২. ১২. শুতে বসতে অস্বস্তি
১৩. ১৩. ন্যাড়া গাছটা
১৪. ১৪. হাটতলা পেরিয়ে
১৫. ১৫. সকালে উঠেই তিরি চলে গিয়েছে
১৬. ১৬. দোতলা বাসের জানলা
১৭. ১৭. জীবন দাবা খেলার মত
১৮. ১৮. এ এক অপূর্ব আনন্দ
১৯. ১৯. দিল্লী শহরে
২০. ২০. ইন্টারভিউ কেমন হল
২১. ২১. খাম খুলে চিঠির ওপর নজর
২২. ২২. বুকের ভেতর জমে থাকা ছেলেবেলা
২৩. ২৩. ঘুম ভেঙ্গেছিল সাতসকালে
২৪. ২৪. কিছু জিনিসপত্র কেনার ছিল
২৫. ২৫. যাত্রাপথে
২৬. ২৬. কিছু ভাল ছেলেমেয়ে
২৭. ২৭. কর্মচারীদের আচরণবিধি
২৮. ২৮. শুভ্রাদের বাড়ির সামনে
২৯. ২৯. নতুন ফ্ল্যাটে
৩০. ৩০. দিল্লীতে দূরত্ব কোন সমস্যাই নয়
৩১. ৩১. সরকারি চাকরিতে
৩২. ৩২. চাকরির ক্ষেত্রে
৩৩. ৩৩. ঘরে বাইরে নিরন্তর যুদ্ধ
৩৪. ৩৪. প্রাথমিক পর্বে নির্লিপ্ততা
৩৫. ৩৫. এ এক অদ্ভুত সম্পর্ক
৩৬. ৩৬. দীপাবলী এবং অলোক
৩৭. ৩৭. হাওড়া স্টেশনে
৩৮. ৩৮. কলকাতা অফিসের এক নম্বর বস
৩৯. ৩৯. সুখের চেয়ে স্বস্তি ভাল
৪০. ৪০. মনোরমা কলকাতায়
৪১. ৪১. মনোরমার জ্বর
৪২. ৪২. মনোরমার বিদ্রোহ
৪৩. ৪৩. নিজের মনের অন্ধকার

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন