৩২. চাকরির ক্ষেত্রে

সমরেশ মজুমদার

সুপারভাইজার প্রবীণ মানুষ। প্রবীণেরা জীবন থেকে যে-শিক্ষা পেয়েছেন তা নিশ্চয়ই মূল্যবান। অন্তত চাকরির ক্ষেত্রে ওই ভদ্রলোকের উপদেশ মেনে চললে বড় একটা অসুবিধায় পড়তে হবে না। কিন্তু সেটাই তো এতকাল দীপাবলী মানতে পারত না। অন্যায় দেখেও চোখ বন্ধ করে থাকার নাম যে-জীবন সেই জীবনযাপন করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে তার নেই। কিন্তু রামবিলাসকে ট্রান্সফার করে সেকশনের সমস্ত ফাইল ফিজিক্যালি ভেরিফাই করতে গিয়ে দিন দশেক অমানুষিক পরিশ্রম করতে হল। সেকশনের অন্য সমস্ত কাজ বন্ধ রেখেও এই মহাযজ্ঞ শেষ করা গেল না। বিভিন্ন অ্যাসেসির ফাইল সম্পূর্ণ নয়, কোনও কোনও ফাইলের পাত্তাই নেই। কিছু ফাইল দু’বছর আগে ট্রাইবুনালে গিয়েছে বলে রেকর্ডে পাওয়া গেলেও সেগুলো ফিরিয়ে আনার কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। দু’জন পেশকার ভয়ে অথবা বাধ্য হয়ে দীপাবলীকে এই ধুলো ঘাঁটতে সাহায্য করেছিল।

শেষপর্যন্ত ব্লু-বুকের যে অবস্থা দাঁড়াল তার সঙ্গে মান্থলি প্রগ্রেস রিপোর্টের কোনও মিল নেই। দীপাবলী ভাবল ব্যাপারটা কর্তৃপক্ষকে জানাবে। এতদিনের ভুল সংশোধন করে সত্যের কাছাকাছি রিপোর্ট পাঠাবার ব্যবস্থা করবে। কিন্তু সুপারভাইজার বললেন লিখিতভাবে রিপোর্ট দেবার আগে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে নিতে। কারণ লিখিতভাবে ওই রিপোর্ট দিলে তা ওঁর পূর্বসূরিদের বিরুদ্ধে যাবে। অথচ তাঁরা এইসব বিশৃঙ্খলার জন্যে দায়ী নন। যে-কোনও সেকশনে একজন অফিসার তিন বছরের জন্যে যখন আসেন তখন তিনি প্রথমে যেসব কেস টাইম-বার্ড হয়ে যাবে সেগুলো নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। যেটুকু কাজ না করলে নয় তার বেশি করেন না। তার জায়গায় যিনি আসেন তাঁকেও এই পথই অনুসরণ করতে দেখা যায়। এতকালের রিপোর্ট অসত্য ছিল তা প্রমাণিত হলে কোথাকার জল কোথায় গিয়ে পৌঁছাবে তা কেউ বলতে পারে না।

দীপাবলী শুনল না এই উপদেশ। সত্য জেনেশুনে গোপন করার কোনও যুক্তি নেই। রিপোর্টে সে কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ আনছে না, তবে ঘটনাটা এই তা কর্তৃপক্ষকে জানাচ্ছে। আজ যদি সে চুপ করে যায় আগামীকাল যিনি আসবেন তিনি চুপ না-ও করতে পারেন। সেক্ষেত্রে তার ওপরই বিপদ এসে যেতে পারে।

অতএব স্টেনোগ্রাফারকে ডেকে সমস্ত ঘটনাটা ডিকটেশন দিল দীপাবলী। সেটা যখন অফিসের হলঘরে টাইপ হচ্ছিল তখনই সাতকান হয়ে গেল। মিনিট দশেক বাদে রামবিলাস ঘরে ঢুল, ‘ম্যাডাম, উও লেটার আপ উইথড্র করিয়ে।’

‘কেন? আপনি কে এসব কথা বলার?’

‘আপনি আমাকে ফাঁসাতে চাইছেন।’

‘আপনাকে আমি কিছুই করাই না। আপনি একজন পেশকার, আপনার সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্কই নেই। আপনি আপনার কাজে যান।’

‘ম্যাডাম। আমি ভালয় ভাল, কিন্তু কেউ খারাপ করলে আমি তার চেয়ে খারাপ হয়ে যাই। দিল্লিতে এসে আপনি উলটোপালটা করবেন বলে যদি মনে করেন তা হলে খুব ভুল করেছেন। আপনাকে রিকোয়েস্ট করছি ওটা পাঠাবেন না।’

‘আপনি আমাকে ভয় দেখাতে এসেছেন নাকি? বেরিয়ে যান ঘর থেকে।’ চিৎকার করে উঠল দীপাবলী। সেই চিৎকার শুনেই বোধহয় কয়েকটি মুখ ঘরে উঁকি দিল। এঁরা এই অফিসেরই কর্মচারী। রামবিলাস তাদের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এই ভদ্রমহিলা কথা বলার তরিকাই জানেন না। আমি এঁকে সেটা শিখিয়ে দেব নাকি?’

একজন হাসল, ‘আওরাতলোগ হায়ার পোস্টমে যানে সে এইস্যাই হোতা হ্যায়।’

রামবিলাস বেরিয়ে গেল। প্রচণ্ড অপমানিত বোধ করছিল দীপাবলী। সে ঠিক করল রিপোর্ট নিয়ে আই এ সি-র সঙ্গে কথা বলার সময় রামবিলাসের প্রসঙ্গ তুলবে।

আধঘণ্টা বাদে আই এ সি-র টেলিফোন এল। তিনি অবিলম্বে তাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। তখনও ডিকটেশন দেওয়া চিঠির টাইপ-কপি সে পায়নি। একটা দু’পাতার চিঠি টাইপ করতে এত সময় লাগে? মনে মনে গজগজ করতে করতে দীপাবলী আই এ সি-র ঘরে চলে এল। ঘরে তিনি ছাড়া আই টি ও অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বসে আছেন। সে টেবিলের সামনে দাঁড়ানোমাত্র আই এ সি গর্জে উঠলেন, ‘আপনি কী করতে চাইছেন? আপনাকে সেকশনে পোস্ট করার পর থেকেই এসব ঝামেলা শুরু করেছেন কেন? ইউ ওয়ান্ট টু পুট মি ইন ট্রাবল!’

হতভম্ব দীপাবলী জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনি কী বলছেন?’

হাতের তলায় চাপা দেওয়া টাইপ করা কাগজটা এগিয়ে দিলেন আই এ সি। সেটা তুলে নিল দীপাবলী। তলায় রামবিলাসের সই। রামবিলাস কমিশনার অফ ইনকাম ট্যাক্সকে লিখেছে, থ্রু প্রপার চ্যানেল। চিঠির বিষয়বস্তু অসাধারণ। একজন সরকারি কর্মচারী হিসেবে রামবিলাস এত বছর অত্যন্ত বিশ্বস্ততার সঙ্গে কাজ করে এসেছে যার প্রমাণস্বরূপ গত দশ বছর ধরে তার অফিসাররা তাকে আউটস্ট্যান্ডিং সি সি রোল দিয়ে এসেছেন। সম্প্রতি দীপাবলী বন্দ্যোপাধ্যায় নামক একজন অফিসার সি ওয়ার্ডের ভার নেন। ভদ্রমহিলার ব্যবহার এবং কথাবার্তায় বিরক্ত হয়ে সে বদলির জন্যে আবেদন করে। সেই ব্যবহারের সাক্ষী হিসেবে কমিশনার ইচ্ছে করলে তাঁর অফিসের ইন্সপেক্টর ভার্মার সঙ্গে কথা বলতে পারেন। মাননীয় আই টি ও অ্যাডমিনিস্ট্রেশন তার বদলির ব্যবস্থা করলে সে সেকশনের সমস্ত ফাইল এবং অন্যান্য কাগজপত্র মিসেস বন্দ্যোপাধ্যায়কে বুঝিয়ে দিয়েছিল। এবং সেটা দিয়েছিল বলেই তিনি তাকে ছেড়ে দিতে আপত্তি করেননি। হঠাৎ দিন বারো পরে শ্রীমতী বন্দ্যোপাধ্যায় তাকে নিজের ঘরে ডেকে পাঠিয়ে অত্যন্ত খারাপ ব্যবহার করেন। তিনি কিছু ফাইল খুঁজে পাচ্ছেন না এবং এজন্যে তাকেই দায়ী করেন। সে বোঝাতে চাইলে যে চিৎকার গালাগালি করেছেন তা অফিসের সবাই শুনেছে। রামবিলাসের ধারণা, যদি কিছু ঘটে থাকে তা হলে তা সে চলে যাওয়ার পরেই ঘটেছে। শ্ৰীমতী বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর অধীনে যাঁরা কাজ করেন তাঁদের চাকরবাকরের মতো মনে করেন। এই ভদ্রমহিলার তত্ত্বাবধানে থাকা ফাইল যদি না পাওয়া যায় তা হলে তিনিই তার জন্যে দায়ী, কারণ সে সবকিছু সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দেওয়ার পর রিলিজ পেয়েছিল।

চিঠির তলায় তারিখ এবং সময় দেওয়া রয়েছে। অর্থাৎ সে যে-রিপোর্ট পাঠাচ্ছে তার অনেক আগেই রামবিলাস এই অভিযোগ করে দিয়েছে। কাগজটাকে টেবিলের ওপর রেখে দীপাবলী বলল, ‘সমস্ত ব্যাপারটাই মিথ্যে, সাজানো।’

আই এ সি বললেন, ‘আপনি এটাই বলবেন তা আমি জানতাম। কিন্তু এই চিঠি আমি যদি সি আই টি-র কাছে ফরোয়ার্ড করি তা হলে আপনার বিরুদ্ধে এনকোয়ারি হবে। আমি এসব পছন্দ করছি না।’

দীপাবলী বলল, ‘আপনার ভাল লাগছে না বলে আমি দুঃখিত। কিন্তু আমি একটা রিপোর্ট পাঠাতে চাই। জেনেশুনে মিথ্যে ফিগার নিয়ে কাজ করতে পারব না।’

‘হোয়াট ডু ইউ মিন বাই দ্যাট?’

‘আমি যা সত্যি তাই রিপোর্টে রিফ্লেক্ট করতে চাই।’

এইসময় আই টি ও অ্যাডমিনিস্ট্রেশন কথা বললেন, ‘স্যার, এক মিনিট সময় দিন, আমি ওঁকে বুঝিয়ে বলছি। বসুন, মিসেস ব্যানার্জি।’

দীপাবলী চেয়ার টেনে বসল। এই ভদ্রলোক তারই র‍্যাঙ্কের অফিসার, কিন্তু অনেক সিনিয়ার। ভদ্রলোক বললেন, ‘দেখুন, আমরা সবাই সরকারের প্রতি বিশ্বস্ত থেকে কাজ করতে চাই। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে প্রচলিত ধারার বাইরে যেতে পারি না। দেশের সমস্ত অফিসার যে-প্রক্রিয়ায় কাজ করছেন, আপনি তার বাইরে গেলে বেমানান হয়ে যাবেন। এই যে রামবিলাস চিঠি দিয়েছে, আপনার সেকশনে যদি কোনও ফাইল এখন না পাওয়া যায় তা হলে আপনাকেই দায়ী করা হবে ওই চিঠির ভিত্তিতে। আমরা যখন কোনও চার্জ নিই তখন ফিজিক্যালি ভেরিফাই করা সম্ভব হয় না। রামবিলাসকে যখন রিলিজ করছিলেন তখন নিশ্চয়ই এটা ভাবেননি। আপনি বুঝতে পারছেন নিশ্চয়ই?’

‘পারছি। কিন্তু আমি ফাইল সরিয়ে কী করব? সরাবই বা কেন?’

‘আপনার পূর্বসূরিরাই বা সরাবেন কেন?’ ভদ্রলোক পালটা প্রশ্ন করলেন। দীপাবলী জবাব দিল না। সে বুঝতে পারছিল চারপাশ থেকে জড়িয়ে ফেলার চমৎকার ব্যবস্থা হচ্ছে। এইসময় আই এ সি বললেন, ‘মিসেস ব্যানার্জি, প্লিজ ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড দি সিচুয়েশন। একটু মানিয়ে চলুন। ও কে?’

‘আপনি জানেন ওই রামবিলাস আমাকে অভদ্র ভাষায় অপমান করেছে?’

‘হতে পারে। কিন্তু তার আগে ও একই অভিযোগ আপনার বিরুদ্ধে করেছে।’

‘এটা বানানো।’

‘হতে পারে। কিন্তু প্রমাণ করার কোনও রাস্তা নেই। হাউএভার, আমি চাইছি এখানে কোনও ঝামেলা যেন না হয়। আপনার এখন ক্যারিয়ার তৈরির সময়। বয়স কম, অনেক দুরে যাবেন যদি ঠিকঠাক চলেন। আপনি যদি এভাবে চলেন তা হলে আমি সি আই টি-কে বলব আপনাকে উইথড্র করতে। আর সেটা আপনার পক্ষে প্রচণ্ড ক্ষতি হবে। সেসব না করে একটু শান্তিতে থাকতে দিন।’

দীপাবলী উঠে দাঁড়াল। গম্ভীর মুখে বলল, ‘আমি যেতে পারি?’

‘অফ কোর্স। তা হলে আপনি নিশ্চয়ই ওই রিপোর্ট পাঠাচ্ছেন না। দ্যাটস গুড।’

বেল বাজালেন আই এ সি। পিয়ন ঢুকলে হুকুম করলেন, ‘রামবিলাসকে বোলাও ইসকি কপি লেকে, তুরন্ত।’ তারপর দীপাবলীর দিকে তাকালেন, ‘সিট ডাউন প্লিজ। ওয়ান মিনিট।’

দীপাবলী বসল। এই মানুষদুটিও ইন্ডিয়ান রেভিনিউ সার্ভিস করে এসেছেন। তার থেকে অনেক বেশি অভিজ্ঞতা এঁদের। ওই বয়সে পৌঁছালে কি একই রকম আচরণ করবে? তার মনে পড়ল নেখালির দিনগুলোর কথা। অর্জুন নায়েককে কেন্দ্র করে একটি অপমান হজম না করতে পারায় সে চাকরি ছেড়ে দিয়েছিল অন্ধকার ভবিষ্যৎ সামনে রেখে। অবশ্যই রামবিলাস অর্জুনের সমকক্ষ নয়, এবং এই ঘটনা একই ধরনের বলা চলে না। কিন্তু এটা তো ঠিক, দুই জায়গায় সে মানিয়ে নিতে পারছে না। তার মধ্যে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা এত কম কেন? কেন সে আর পাঁচটা মানুষের মতো আচরণ করতে পারে না?

কিন্তু আজ একটা কথা স্পষ্ট, অপমানিত বোধ করে সেই সময়ের মতো আজ চট করে চাকরি ছেড়ে দিতে পারছে না। এই অল্প দিনেই তার জীবনটা পালটে গিয়েছে। দু’বছরের মধ্যে জীবন অনেক কিছু শিখিয়ে দিয়েছে তাকে। যে-মানুষের অপমান বোধ প্রবল তার পক্ষে পৃথিবীতে বাস করাই অসম্ভব। এইভাবে সবকিছু গায়ে মাখলে তো আত্মহত্যা করে সরে যেতে হয়। পৃথিবীতে মানুষের বসবাস কখনই তার মনের মতো হয় না।

রামবিলাস এল। এসে ঝুঁকে নমস্কার করল আই এ সি, আই টি ও অ্যাডমিনিস্ট্রেশন এবং দীপাবলীকেও। তারপর বিনীত গলায় বলল, ‘ইয়েস স্যার।’

আই এ সি বললেন, ‘শুনিয়ে, আই ওয়ান্ট পিস ইন দিস অফিস। ইউ শুড নো, হোয়াট ইজ ইয়োর জুরিসডিকশন। সমঝে?’

‘ইয়েস স্যার।’

‘নো মোর কমপ্লেন, নো মোর ফাইটিং! কপি হ্যায় জেবমে?’

‘ইয়েস স্যার।’ রামবিলাস পকেট থেকে টাইপ করা কাগজ বের করে এগিয়ে দিল। আই এ সি সেটা দেখে নিয়ে আগের চিঠিটার সঙ্গে জুড়ে ছিঁড়ে ফেললেন। ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে সেগুলো ফেলে তিনি বললেন, ‘ঠিক হ্যায়। ইউ মে গো নাউ।’

রামবিলাস একটা কথাও না বলে নমস্কার করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। এবার আই এ সি হাসলেন, ‘লুক মিসেস ব্যানার্জি, ইউ ক্যান গেট গুড বিহেভিয়ার ফ্রম দিস পিপল ইফ ইউ হ্যান্ডল দেম উইথ স্মাইলিং ফেস। আফটার অল দে আর আওয়ার টুলস। ইউ ক্যান নট ওয়ার্ক ইফ দি টুলস ডু নট ওয়ার্ক। ইউ মাস্ট নো দি আর্ট টু মেক দেম ওয়ার্ক। ও কে!’

ঘরে এসে চুপচাপ বসে ছিল দীপাবলী। টেবিলের ওপর তার ডিকটেশন দেওয়া রিপোর্ট পেপার ওয়েটের নীচে চাপা পড়ে ছিল। ওটার দিকে হাত বাড়াতেও ইচ্ছে করছিল না। এইসময় পরদা সরিয়ে রামবিলাস মুখ ঢোকাল, ‘মে আই কাম ইন ম্যাডাম?’

তাড়িয়ে দেওয়ার ইচ্ছেটাকে কোনওমতে সামলে নিল দীপাবলী। নির্ঘাত আর একটা মতলব নিয়ে এসেছে লোকটা। রাগারাগি না করে অন্যভাবে এর মোকাবিলা করা দরকার। সে মাথা নেড়ে ভেতরে আসতে বলল।

ঘরে ঢুকে নির্দ্বিধায় চেয়ার টেনে বসল রামবিলাস, ‘ম্যাডাম। আপনার সঙ্গে আমার সম্পর্ক খারাপ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু ওই রিপোর্টটায় যখন আপনি সই করবেন না তখন আমার কোনও অভিযোগ নেই। যা হোক, আপনি চাইছেন এই সেকশনের সবকিছু আপ টু ডেট থাক। খুব ভাল কথা। কিন্তু এত পরিশ্রম করেও আপনারা সব ইনফরমেশন পাননি।’

‘আপনি আমার কাছে কী জন্যে এসেছেন?’

‘সাহায্য করতে। আপনার প্রবলেম হল লাস্ট মান্থের মান্থলি প্রগ্রেস রিপোর্টের সঙ্গে এবার যেটা দেবেন তার ফিগার মিলবে না। কোই পরোয়া নেই। ডিফরেন্সটা আপনি নোট করে রাখুন আলাদা কাগজে। এখন থেকে প্রতি মাসে একটু একটু করে কমিয়ে থার্টি ফার্স্ট মার্চে কারেক্ট ফিগারে নিয়ে যাবেন।’ হাসল রামবিলাস, ‘এটা করলে আপনাকে কারও কাছে রিপোর্ট করতে হবে না।’

‘কিন্তু যে ফাইলগুলো মিসিং?’

‘ট্রাইবুনাল, আপিল, সি আই টি অফিসে ইন্সপেক্টর পাঠান, ঠিক পেয়ে যাবেন। আপনার ওয়ার্ডে কাগজ সরাবার মতো পার্টি কিছু আছে, কিন্তু ফাইল লোপাট করার দরকার কারও হয় না। আচ্ছা, নমস্কার। কথা শেষ করে বেরিয়ে গেল রামবিলাস।

যে-সমস্ত কেস এ-বছরের মধ্যে শেষ করতে হবে সেগুলোর দিন ধার্য করতে বলেছিল দীপাবলী তার পেশকারদের। ছাপা ফর্মে চিঠি গিয়েছিল পার্টিদের কাছে তাদের বুকস অফ অ্যাকাউন্টস, ব্যাঙ্ক পাসবুক ইত্যাদি নিয়ে আসার জন্যে। আয়করদাতাদের প্রতিটি আর্থিক বছর আলাদা করে বিচার করা হয়। যে- ব্যাপারটা বিস্ময়ের তা হল আয়করদাতা ও আয়কর বিভাগের সম্পর্কটা অনেকটা চোর পুলিশের। একদল লুকোতে চায় অন্যদল তা খুঁজে বের করার জন্যে তৎপর। মাঝখানে উকিলদের ভূমিকা প্রায় দালালের মতো। দীপাবলীর মনে হয় ওকালতির বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে এই একটি বিভাগে খুব বেশি না জেনেই নিজেকে সফল উকিল বলে প্রচার করা যায়। আজ সকালেই এক ভদ্রলোক এলেন। ঘরে ঢুকেই বললেন, ‘নমস্তে ম্যাডাম, আপনার সঙ্গে এই প্রথম আলাপ হচ্ছে, বান্দার নাম রাকেশ মিশ্র, আমার চারটে পার্টির ফাইল আপনার কাছে আছে।’

দীপাবলী বলল, ‘নমস্কার, বসুন।’

রাকেশ রোগা, লম্বা। একটা বিলিতি সিগারেটের প্যাকেট পকেট থেকে বের করে বললেন, ‘আপনি বাঙালি, না? ক্যালকাটায় আমি বছরে অন্তত দশবার যাই। সেটে লেগেই আছে। ওখানে তবু এখনও ডিসিপ্লিন আছে কিন্তু এখানে পয়সা না ছাড়লে কাজ পাওয়া যাবে না।’

‘পয়সা কেন দেন?’

সঙ্গে সঙ্গে দুই কান ধরলেন রাকেশ, ‘হি হি হি। একী বলছেন? বালবাচ্চা নিয়ে ভুখা মরব? পয়সা না দিলে কাম হবে না, পার্টি অন্য উকিল ধরবে। যে পূজায় যা মন্তর।’

‘আপনার ফাইলগুলোর নাম লিখে দিয়ে যান। যদি টাইম বার্ড কেস থাকে তা হলে হিয়ারিং-এর দিন দিয়ে দিচ্ছি।’

‘নেহি ম্যাডাম। আমার কেস তো আপ টু ডেট। আপনার আগের অফিসার সব ঠিক করে দিয়ে গিয়েছেন।’ রাকেশ পকেট থেকে একটা কার্ড বের করে সামনে রাখল, ‘এলাম আলাপ করতে। দিল্লিতে যদি আপনার কোনও কিছুর প্রয়োজন হয় তুরন্ত আমাকে জানিয়ে দেবেন, জিনিস এসে যাবে।’

নমস্কার করে রাকেশ উঠে গেল। কার্ডটার দিকে তাকাল দীপাবলী।

রাকেশ মিশ্র, কোনও ডেজিগনেশন নেই। কর্নট প্লেসে চেম্বাব। এইসময় সেকেন্ড পেশকার ঘরে ঢুকেছিল, চিঠি সই করাতে। তাকে কার্ড দেখাল দীপাবলী, ‘একে চেনেন আপনি?’ লোকটা নাম পড়ে মাথা নাড়ল, ‘হ্যাঁ। উনি তো মিশ্রসাহেব। ডিপার্টমেন্টে সবাই ওঁকে চেনে।’

‘আমাদের কাছে কী কী ফাইল আছে?’

‘এস ডি অ্যালয় অ্যান্ড কোম্পানি, রুইয়া স্টিল, জে কে ইন্ডাষ্ট্রিস। সব বড় ফাইল। ওদের নিজস্ব চাটার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট আছে কিন্তু কেস করেন ওই মিশ্রসাহেব। খুব ইনফ্লুয়েন্সিয়াল তো!’

‘মানে?’

‘চেয়ারম্যান বোর্ড অফ মেম্বারস কমিশনারদের সঙ্গে খুব ভাব আছে।’

‘বিলিতি ডিগ্রি আছে নাকি?’

‘ডিগ্রি? না ম্যাডাম। উনি বোধহয় অর্ডিনারি গ্র্যাজুয়েট।’

‘সেকী? তা হলে উকিল নন?’

‘উকিল, কিন্তু এল এল বি নন।’ পেশকার হাসল, ‘এখানে তে বি কম পাশ করলেই প্র্যাকটিস করা যায়। কত আই এ পাশ পার্টির চিঠি নিয়ে এসে কেস করে যাচ্ছে। এদেরও অফিস আছে, ক্লার্ক আছে। চেম্বারে গেলে মনে হবে এল এল বি কিংবা বার অ্যাট ল।’

‘ওর ফাইল তিনটে পাঠিয়ে দিন।’

পেশকার কাজ শেষ করিয়ে চলে যাওয়ার পর দীপাবলীর মনে হল রাকেশ মিশ্র যদি বলে ওকালতি করছে তা হলে তার ধারণা ঠিক। একজন অ্যাকাউন্ট্যান্ট প্যার্টির ব্যালেন্সশিট, প্রফিট অ্যান্ড লস অ্যাকাউন্ট বানিয়ে দেয়। সেটা দেখে রিটার্ন ফর্ম ভরতে হাতের কাছে একটা রেডি রেকনার থাকলেই হল। শুনানির সময় কোনও খরচ যদি অফিসার আয়ের সঙ্গে যোগ করতে চান তা হলে সেটা নিয়ে তর্ক করতে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট বিদ্যের দরকার পড়ে না। তা ছাড়া কোনও অফিসার গায়ের জোরে আয় বাড়াতে পারেন না। অনেক আটঘাট বেঁধেই অ্যাকাউন্ট্যান্ট হিসেবটা তৈরি করেন। এক্ষেত্রে আয়কর বিভাগে ওকালতি করতে চালু নিয়মগুলো মনে রাখতে পারলেই হল। নইলে রাকেশ মিশ্রর মতো লোক করে খেতে পারত না।

ফাইল তিনটে এল। দীপাবলী দেখল প্রত্যেকটারই কারেন্ট কেস করে গিয়েছেন আগের অফিসার। অর্ডার শিটের হাতের লেখার সঙ্গে সইয়ের কোনও মিল নেই। সম্ভবত রামবিলাস অর্ডার লিখেছে আর অফিসার হাতে সই করেছেন। এস ডি অ্যালয়ের ফাইলটা খুলল সে। অ্যাডভান্স ট্যাক্স কম দেওয়া ছিল। অফিসার পেনাল প্রসিডিংস চালু করে তিন দিন বাদে সেটাকে ড্রপ করেছেন কোনও কারণ না দেখিয়ে। ব্যালান্স শিট খুলল সে। নতুন ইনভেস্টমেন্ট হয়েছে দুই লাখ টাকা। বলা হয়েছে লোন নিয়েছে কোম্পানি। কার কাছ থেকে তা নিয়েছে তার কোনও কনফার্মেশন সার্টিফিকেট ফাইলে নেই। টার্ন-ওভারের পর যেসব খরচ দেখিয়ে গ্রস প্রফিট আনা হয়েছে সেটা রীতিমতো হাস্যকর।

পি এল অ্যাকাউন্টে অনেক খরচ আইনসংগতভাবেই পার্টি ক্লেইম করতে পারে না অথচ সেগুলো অ্যালাউ করে গেছেন অফিসার। সবচেয়ে মজার ব্যাপার আগের বছরে পার্টি ইনকামট্যাক্স থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা রিফান্ড পেয়েছিল বেশি ট্যাক্স অ্যাডভান্স হিসেবে তিন বছর আগে দেবার কারণে। এই তিন বছরের সুদ পেয়েছে সে। কিন্তু সুদটা যে তার ওই বছরের আয় এবং তা রিটার্ন ফর্মে দেখানো উচিত তা অফিসার লক্ষই করেননি। দীপাবলীর মনে হল এই কেস রি-ওপেন করা উচিত।

বাকি দুটো ফাইলেও মোটামুটি অসংগতি দেখা গেল। সেগুলো প্রথমটার মতো এতখানি নগ্ন নয়। প্রতি অ্যাসেসমেন্ট অর্ডারে লেখা আছে, মিস্টার রাকেশ মিশ্র, অথরাইজড রিপ্রেজেন্টেটিভ অফ দি অ্যাসেসি ফার্ম অ্যাপিয়ার্ড অ্যান্ড দি কেস ইজ ডিসকাসড। কোথাও উকিল শব্দটি ব্যবহৃত হয়নি অথচ রাকেশ মিশ্র একজন সফল উকিলের চেয়েও ভাল পশার পেয়েছেন। প্রথম ফাইলের অর্ডার শিটে হয়ে যাওয়া অ্যাসেসমেন্ট কেন আবার করতে হবে লিখে সই করল দীপাবলী।

বিজ্ঞজনেরা বলেছেন জীবনযাপন বড় সরল ব্যাপার যদি মানিয়ে চলতে পারো। হংসের মতো দুধটুকু খেয়ে জল ফেলে দাও, গায়ে মেখো না। কিংবা দুটোকে মিলিয়ে মিশিয়ে জটিল করতে যেয়ো না। সংসারে থাকবে সন্ন্যাসীর মতো। স্পর্শ করবে কিন্তু ধরবে না। এই আলগাভাব যে যত ভাল রাখতে পারবে তার তত ঝামেলা কম। কিন্তু যার শিক্ষা হবার নয় তাকে কে শেখাবে! নিজের কথা আপনমনে ভাবছিল দীপাবলী। তার ঘুম আসছিল না।

এখন মধ্যরাত। দিল্লিতে রাত ঘনালে গাড়ি কমে যায় রাস্তায়। অনেকক্ষণ তাই পৃথিবীটা শব্দহীন। আলোক বিছানার একপাশে কাত হয়ে মড়ার মতো ঘুমাচ্ছে। না, উপমাটা ঠিক হল না। মড়া শব্দ করে না। বেশি মদ্যপান হয়ে গেলে অলোকের নিশ্বাস শব্দময় হয়ে ওঠে। নিস্তব্ধ রাত্রের সব শান্তি ঘুচিয়ে দেবার পক্ষে তা যথেষ্ট। অথচ মদ না খেলে খুব সামান্য, বলা যেতে পারে মৃদু শব্দ হয়। প্রথম প্রথম একটু অস্বস্তি হলেও দীপাবলী সেটা সইয়ে নিয়েছিল। মজার ব্যাপার হল, দিনের বেলায় কিছুতেই মানতে চায় না অলোক। ঘুমন্ত মানুষের পক্ষে নিজের নাক ডাকার কথা জানা সম্ভব নয়। হাসিঠাট্টার মধ্যে ছিল ব্যাপারটা। কিন্তু আজ রাত্রে বন্ধুর বাড়ি থেকে যে-লোকটা ফিরে এল তার হুঁশ নেই বললেই চলে। কোনওরকমে জুততা মোজা ছেড়ে বিছানায় গড়িয়ে পড়ে যেই কাত হল অমনি চেতনা উধাও। আর তারপর থেকেই একসঙ্গে সিংহ এবং হায়েনা ডেকে চলেছে। পাশে শুয়ে ঘুমোয় কার সাধ্যি।

এখন অনেকেই একটু আধটু মদ খায়। খেয়ে ভদ্রভাবেই কাজকর্ম করে, কথা বলে। ব্যবহারে তারতম্য ঘটে না। অলোকের মদ খাওয়া ওই পর্যায়ে ছিল। তার যে নেশা ধরে যায়নি তা প্রমাণ করতে অনেক সন্ধে মদ না খেয়েও কাটিয়েছে। কিন্তু টেবিলে বসলে বোঝা যায় মদ খেতে ওর ভাল লাগে। আর আজ সীমা ছাড়াবার পর এ-ব্যাপারে জাহির করা সমস্ত অহংকার উধাও।

দীপাবলী প্রথম দিকে ভয় পেয়েছিল। ওরকম বিকট আওয়াজ যার শরীর থেকে হচ্ছে তার অসুস্থ হয়ে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। গায়ে হাত দিয়ে ঘুম ভাঙাতে চেয়েছিল সে। উঁ আ করে সামান্য সময় স্থির থাকার পর আবার কালবৈশাখীর ঝড় শুরু হয়ে গেল। এই শব্দ যতক্ষণ চলবে ততক্ষণ ঘুমাবার কোনও সুযোগ নেই দীপাবলীর।

নিত্য সন্ধ্যায় অলোকের সঙ্গে বাইরে যাওয়া মানে কোথাও বসে খাওয়াদাওয়া করা, একই কথা বলা। দিল্লিতে থাকার কারণে ওই আলোচনায় রাজনীতি এসে যায় আপনি আপনি। জওহরলাল লালবাহাদুর এবং সদ্য-নির্বাচিত ইন্দিরা গাঁধীতে তর্ক চলে। একজন মহিলা দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন তা মেনে নিতে পারে না ছেলেরা। অল্পদিনের মধ্যেই ভদ্রমহিলাকে চলে যেতে হবে এই বিশ্বাস অলোকেরও। গণতান্ত্রিক ভারতবর্ষে শুধু পৈতৃকসূত্রে প্রধানমন্ত্রিত্ব পেয়ে মুখ দেখিয়ে কেউ টিকিয়ে রাখতে পারে না। এক সরকারি আমলা বলেই দিলেন অতখানি কাপড়ে যারা কাছা দিতে পারে না তারা কী করে এতবড় দেশের সমস্যার মোকাবিলা করবে। দীপাবলীর মনে হয়েছিল সে ঊনবিংশ শতকের কোনও গ্রামের চণ্ডীমণ্ডপে বসে আছে। তর্ক করেছিল সে প্রথম দিকে, পরে বিরক্তিতে হাল ছেড়ে দিয়েছিল। মদ্যপান করতে করতে আলোচনা অন্যখাতে বইল। ইন্দিরা সুন্দরী, সুদেহী। অতএব তাঁর প্রেমিক থাকতেই পারে। স্বামীর সঙ্গে তাঁর কী ধরনের সম্পর্ক ছিল, জওহরলালের মন্ত্রিসভার এক মন্ত্রীর সঙ্গে কী ধরনের প্রেম ছিল, এমন নানান গালগল্প শুনলে মনে হয় এরা সেইসব বিশেষ মুহূর্তে ইন্দিরার ঘরে দাঁড়িয়ে সব দেখে এসেছে।

জানলায় চুপচাপ বসে চোখ বন্ধ করল দীপাবলী। বিধাতা কি জন্মমুহূর্তে তাকে এমন অভিশাপ দিয়েছিলেন যাতে সে আর পাঁচজনের মতো হতে পারবে না। কেন অন্য মানুষগুলোর কথাবার্তার সঙ্গে তার মেলে না। সে যে বেমানান হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ! আজ সন্ধ্যায় আড্ডাতে আরও মহিলা ছিলেন। তাঁদের হাতে নিরীহ ঠান্ডা পানীয়ের গ্লাস দু’বার বদলেছে। দু’বারই গৃহকত্রী ভেতর থেকে সেগুলো ভরে এনেছেন। অকারণে ঠান্ডা খেতে ভালবাসে না দীপাবলী। গৃহকত্রী দু’বার অনুরোধ করে চুপ করে গিয়েছিলেন। কিন্তু এক গ্লাস ঠান্ডা পানীয় কেউ এক ঘণ্টা ধরে তারিয়ে তারিয়ে খায় না। ব্যাপারটা যখন আবিষ্কৃত হল তখন গৃহকত্রী চাপাস্বরে বললেন, আমরা ভাই ওদের মতো জল দিয়ে খেতে পারি না তাই কোল্ড ড্রিঙ্ক মিশিয়ে নিই।’

দীপাবলী বলল, ‘খেতে ইচ্ছে করলে এই ক্যামোফ্লেজের কী দরকার?’

‘আপনি তো জানেন না, এই নিয়ে কথা হবে।’

‘কথা হবার ভয়ে লুকোতে হবে কেন? আমি যেমন টের পেলাম ওরাও তো পাচ্ছে। মুখে কিছু বলছে না।’

‘আপনি ওদের সামনে জল দিয়ে খেতে পারবেন?’

‘আমার ভাল লাগলে পারব, না লাগলে খাব না।’

‘ঠিক আছে। আমি লেবুর রস মিশিয়ে জিন দিচ্ছি। খুব ভাল স্বাদ। আপনি খেয়ে দেখুন খারাপ লাগে কিনা!’ গৃহকত্রী ভেতরে চলে গেলেন।

কথা হচ্ছিল ছেলেদের থেকে কিছুটা দূরত্বে। অতএব গ্লাস হাতে নিয়ে দীপাবলী যখন সেখানে চেয়ার টেনে বসল তখন মুখ ফিরিয়ে অলোক হাসল, ‘হঠাৎ এক গ্লাস জল নিয়ে এখানে এসে বসলে যে?’

‘জল নয়, জিনের সঙ্গে লেমন মিশিয়ে জল ঢেলে দিয়েছেন হোস্টেস।’ কথাটা শুনে যেন অলোক খুব অবাক হল। পুরুষরা কথা বন্ধ করে তাকাল। দীপাবলী ধীরে ধীরে গ্লাসে চুমুক দিল। লেবুর সঙ্গে কটু স্বাদ। খেতে খুব খারাপ নয়। দেখলে মনে হচ্ছে সাদা জল। টাকমাথা এক ভদ্রলোকের গলার স্বর ইতিমধ্যে জড়িয়ে গিয়েছিল। তিনি হাততালি দিলেন, ‘ব্রেভো। কনগ্রাচুলেশন। কলকাতার মেয়ে দিল্লিবাসিনীদের হারিয়ে দিল।’

সঙ্গে সঙ্গে খারাপ লাগা শুরু হল দীপাবলীর। সে জিজ্ঞাসা করল, ‘এভাবে কেন বলছেন? মদ খাওয়ার মধ্যে কি কোনও কৃতিত্ব আছে?’

‘নিশ্চয়ই। ওঁরা খাচ্ছেন ঠান্ডা মিশিয়ে হলুদ রং করে। লুকিয়ে লুকিয়ে। আপনি বুকের পাটা দেখিয়ে সরাসরি।’

‘তার মানে আপনারা যে সরাসরি খেয়ে যাচ্ছেন তাতে বীরত্ব প্রকাশ পাচ্ছে?’

‘আমরা? মানে? ও, ছেলেরা তো খাই এইভাবে। নাথিং অ্যাবনর্মাল।’

কথা বাড়াতে ইচ্ছে করেনি দীপাবলীর। তিন চুমুক দেবার পরে আর ভাল লাগছিল না। মুখে টক এবং তেতো, দুটো স্বাদই ছড়িয়ে পড়ছে। সে উঠে বাথরুমে চলে গিয়ে গ্লাসটা বেসিনে উপুড় করে দিল। তারপর যখন খেয়াল হল তখন অলোকের নেশা টইটম্বুর। দীপাবলীর মনে হল আজ ইচ্ছে করে বেশি মদ খেয়েছে অলোক। এই পর্যন্ত তার সঙ্গে একটাও কথা বলেনি। এই বেশি খাওয়া অন্য মহিলারাও অপছন্দ করলেন। বলাবলি হচ্ছিল, মদ খেয়ে যারা নিজেদের কন্ট্রোল করতে পারে না তারা খায় কেন? ব্যাপারটা আরও দৃষ্টিকটু হল যখন অলোক বাড়ি ফেরার পথে গাড়ি চালাতে চাইল। হাত পায়ের ওপর কোনও বশ নেই অথচ মনে জেদ আছে। গৃহকর্তা অনেক করে বুঝিয়ে শেষপর্যন্ত ট্যাক্সি ডেকে দিলেন। এই প্রথম গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে সেটাকে রেখে ট্যাক্সিতে ফিরতে হল। মনে পড়ল, অলোক একদিন বড়াই করে বলেছিল সে এমন মদ খায় না যে গাড়ি চালাতে গিয়ে হাত কাঁপবে। মানুষের কথা বলার সময় হুঁশ থাকে না বলেই কথা না রাখতে পারার সময়ের কথা ভাবে না।

অলোক একইভাবে নাক ডেকে যাচ্ছে। দু’হাতে মাথা আঁকড়ে ধরল দীপাবলী। মৃদু যন্ত্রণা শুরু হয়ে গিয়েছে। বিজ্ঞজনেরা বলবেন এই হল জীবন, উঁচু নিচু আছে। সবসময় একই নিয়মে একই পথে চলে না। মেনে নিতে হয়। কিন্তু একটা মানুষ কত মেনে নিতে পারে? অফিসে প্রতিটি দিন তাকে মেনে নিতে হচ্ছে। এখানকার আবহাওয়া এত নগ্ন যে টিকে থাকতে গেলে মুখ বন্ধ রাখতেই হবে। রাকেশ মিশ্রর কেসটা দিয়ে আর এক যুদ্ধ শুরু হয়েছে। লোকটা নোটিশ হাতে করে ঢুকেই বলেছিল, ‘ম্যাডাম, আপনার কি মাথা খারাপ হয়েছে?’

দীপাবলী বলেছিল, ‘কেন? আপনার ওই কেস রি-ওপেন করলাম বলে?’

‘নিশ্চয়ই। এসব ঝামেলা করছেন কেন? আমাকে কী করতে হবে বলুন?’

‘যা করতে হবে তা কি আপনি পারবেন?’

‘নিশ্চয়ই। আপনি যা চাইবেন তাই হবে?’

‘আপনি একজন সত্যিকারের ল-ইয়ারের মতো ম্যানুয়াল, কেস ল দেখিয়ে, আর্গুমেন্ট করে আমাকে বোঝান কেন কেসটার আবার শুনানি হবে না? আপনি পারবেন না কারণ সেটা করতে গেলে পড়াশুনা থাকা দরকার।’

‘আই সি? আপনি আমাকে ইনসাল্ট করছেন।’

‘কিছুই করছি না। লোন সার্টিফিকেট এনেছেন?’

‘নিশ্চয়ই।’ একগাদা কাগজ এগিয়ে দিল লোকটা। দীপাবলী দেখল পাঁচ হাজার দশ হাজারের সার্টিফিকেট যারা কোম্পানিকে ধার দিয়েছে। আর সার্টিফিকেটগুলো ছাপানো ফর্মে। পার্টিরা আলাদা হলেও ফর্ম একই মেশিনে ছাপা। সে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘এইসব লোকের আই টি ফাইল নম্বর নেই?’

‘না ম্যাডাম। সব হাউসওয়াইভস। বিয়ের সময় যে গিফট পেয়েছিল তা থেকেই লোন দিয়েছে। কোনও ইনকাম নেই।’

‘বিয়ের পর যে-ব্যাঙ্ক টাকা রেখেছিল তার অ্যাকাউন্ট নম্বর দিন।’

‘টাকা রাখার স্কোপই পায়নি। যে-তারিখে লোন দিয়েছে তার দিন দশেক আগে বিয়ে হয়েছে কারও কারও!’

‘সেকী? এই মহিলাদের একই সঙ্গে বিয়ে হয়েছে?’

‘অবাক হচ্ছেন কেন? হলে অবিশ্বাস করতে পারবেন?’ রাকেশ মিশ্র বললেন, ‘ঝামেলা বাড়িয়ে কী হবে? কাগজগুলো ফাইলে রেখে দিন। আপনার আমার সম্পর্ক বজায় থাকলে সব ঠান্ডা থাকবে। আমি আই এ সি-কে এই নোটিশের কথা বলছিলাম। উনিও তাই আপনাকে বলতে বললেন।’

অর্থাৎ তাকে চক্রব্যুহে ঢুকতে হবে এবং বেরিয়ে আসার কৌশল ঠিক করেই। রাকেশ ইঙ্গিত দিয়েছিল তাতে মদত করার জন্যে ডিপার্টমেন্টের ওপরতলার অফিসাররা আছেন। স্রোতে গা ভাসিয়ে চললে কোনও বিপদ নেই উলটে লাভই হবে।

এখনও কোনও সিদ্ধান্ত নেয়নি দীপাবলী। আজ রাত্রে জানলায় বসে সে স্থির করল যুদ্ধ করবেই। ব্যাপারটা মেনে নিলে সবাই জানবে সে আর আলাদা নয়। অকারণে একবার হাত নোংরা করলে জীবনে আর পরিষ্কার হবে না। সে মুখ ফিরিয়ে অলোকের দিকে তাকাল।

এই অলোক তার অপরিচিত। বিয়ের আগে যে-মানুষটাকে সে দেখেছে বিয়ের পর যেন আমূল বদলে গেল। তখন তাকে দেখার জন্যে, কথা বলার জন্যে, যেন পাগল হয়ে থাকত অলোক। দিল্লি থেকে বারংবার ছুটে গেছে মুসৌরি, নাগপুরেও। তাকে একটু আনন্দ দিতে সবকিছু করতে পারত অলোক। এখন পাওয়া হয়ে যাওয়ার পরে কী উদাসীন হয়ে গিয়েছে। আকাঙ্ক্ষার জিনিস পাওয়া হয়ে যাওয়ার পরে শিশুরা যেমন হেলায় ফেলে রাখে ঠিক তেমনি। অথচ ভালবাসা প্রতিমুহূর্তে প্রতিপালিত হতে চায়। তাকে আগলে রাখতে হয়। অলোকের সেই বোধ নেই।

বুকের ভেতরটা হঠাৎ হুহু করে উঠল দীপাবলীর। সে উঠে বাইরের ঘরে চলে এল। দরজা বন্ধ করতে অলোকের নাক ডাকার আওয়াজ সামান্য কমল। অন্ধকার ঘরে সোফায় পা গুটিয়ে শুয়ে পড়ল দীপাবলী। কিন্তু তবু, তার ঘুম আসছিল না।

সকল অধ্যায়

১. ১. কাকভোর বলে কিছু নেই এখানে
২. ২. টেলিগ্রামটা ছিঁড়ল দীপাবলী
৩. ৩. এরকম একটা দিনের কথা
৪. ৪. অর্জুন নায়েক
৫. ৫. ঘুম এসেছিল অনেক রাত্রে
৬. ৬. এস ডি ওর অফিসে
৭. ৭. অবস্থা খুব গোলমেলে
৮. ৮. দীপাবলী বসে পড়ল
৯. ৯. সতীশবাবু
১০. ১০. দাদাবাবু
১১. ১১. বাঙালির চরিত্র
১২. ১২. শুতে বসতে অস্বস্তি
১৩. ১৩. ন্যাড়া গাছটা
১৪. ১৪. হাটতলা পেরিয়ে
১৫. ১৫. সকালে উঠেই তিরি চলে গিয়েছে
১৬. ১৬. দোতলা বাসের জানলা
১৭. ১৭. জীবন দাবা খেলার মত
১৮. ১৮. এ এক অপূর্ব আনন্দ
১৯. ১৯. দিল্লী শহরে
২০. ২০. ইন্টারভিউ কেমন হল
২১. ২১. খাম খুলে চিঠির ওপর নজর
২২. ২২. বুকের ভেতর জমে থাকা ছেলেবেলা
২৩. ২৩. ঘুম ভেঙ্গেছিল সাতসকালে
২৪. ২৪. কিছু জিনিসপত্র কেনার ছিল
২৫. ২৫. যাত্রাপথে
২৬. ২৬. কিছু ভাল ছেলেমেয়ে
২৭. ২৭. কর্মচারীদের আচরণবিধি
২৮. ২৮. শুভ্রাদের বাড়ির সামনে
২৯. ২৯. নতুন ফ্ল্যাটে
৩০. ৩০. দিল্লীতে দূরত্ব কোন সমস্যাই নয়
৩১. ৩১. সরকারি চাকরিতে
৩২. ৩২. চাকরির ক্ষেত্রে
৩৩. ৩৩. ঘরে বাইরে নিরন্তর যুদ্ধ
৩৪. ৩৪. প্রাথমিক পর্বে নির্লিপ্ততা
৩৫. ৩৫. এ এক অদ্ভুত সম্পর্ক
৩৬. ৩৬. দীপাবলী এবং অলোক
৩৭. ৩৭. হাওড়া স্টেশনে
৩৮. ৩৮. কলকাতা অফিসের এক নম্বর বস
৩৯. ৩৯. সুখের চেয়ে স্বস্তি ভাল
৪০. ৪০. মনোরমা কলকাতায়
৪১. ৪১. মনোরমার জ্বর
৪২. ৪২. মনোরমার বিদ্রোহ
৪৩. ৪৩. নিজের মনের অন্ধকার

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন